ছায়াস্পর্শ পর্ব ৫
জান্নাত চৌধুরী
“সন্ধ্যার তোরজোর শুরু হয়েছে, আকাশে লাল ছায়া মাখা… গাঁয়ের বাতাসে থমথমে নিস্তব্ধতা।” চারপাশে মাগরিবের আযান পড়েছে বেশ অনেকটা সময় হলো। বদ্ধ ঘরে হতে বেড়িয়ে আসছে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। ইফরাহ্ কাদছে ,
অভিশপ্ত লাগছে সব কিছু। আধ টিন, আধ বেড়ার ঘর যেনগিলে নিচ্ছে সেই কান্না।
— ” অভিশাপ সব অভিশাপ… ওই মানুষ টা অভিশাপ। আমি ঘৃণা করি তাকে।যে মানুষের মনে মায়া দয়া নেই তাকে ঘৃণা করি।
জায়নামাজে বসে মোনাজাতে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। কাঁপা কাঁপা গলা , চোখ হতে পড়ছে অনবরত পানি …
—”ইয়া বর… কি চাইছেন আপনি। কি এমন পাপ করেছিলাম আমি?
কার কোন হিসেব মেলাতে গিয়ে আমার জীবনটাকে এভাবে জুড়ে দিতে চাইছেন আগুনে? আপনি কি দেখছেন না? শুনছেন না?
আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার সহায় হন আপনি । আমার নসিবে যদি তাকে রেখেছেন , তবে তাই হোক কবুল করছি তাকে। তবে , আমার নরম হৃদয় কে পাথর বানিয়ে দেন। শক্ত করুন আমাকে মালিক!
মোনাজাত শেষে তখনো জায়নামাজে বসা ইফরাহ্। পড়নে তার সাদা রঙ্গের এক থ্রিপিস। ওড়না দিয়ে মাথা ভালো করে ঢাকা। …
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে তার। বার বার যেন কানে বাজছে যুথির বলা সেই মর্মান্তিক ঘটনার কথা।
কেন জানিনা সেই ঘটনার বর্ণনার কথা শুনেই ভিতর থেকে ভীষণ ভেঙে পড়েছে ইফরাহ্। পুরো সমাজে যেন মেয়েদের স্থান ভীষণ নরবরে হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাঠের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ ভেসে আসে। থেমে যায় সে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় দরজার দিকে। কেউ টোকা দিচ্ছে , জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে এসেই হাঁক ছাড়ে …
—কে ?
অপর পাশে থেকে ভেসে আসেনা কোনো শব্দ। ইফরাহ্ ভ্রু কুঁচকায় দরজা থেকে সরে এসে বেড়ার ছিদ্র দিয়ে বাহিরে তাকায়। সন্ধ্যার হলুদ আলোয় এক পুরুষের অবয়। মাতব্বর চাচার ছেলে চয়ন , থেকে।তার আর বুঝতে বাকি নেই , কি উদ্দেশ্য এই ছেলের
ইফরাহ্র চোখ দুটোতে আগুন জ্বলতে শুরু করে , নরখাদক দেখা তো দূর। তাদের কথা মাথায় এলেও যেন, মস্তিষ্কের প্রতি এক ঘৃণা তৈরি হয় তার। উল্টো ঘুরে, ঘরের চিপায় চাপায় চোখ বুলায় সে । কোথায় যেন কি খুঁজছে, তবে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ চোখ চলে যায় সেই জিনিসটির উপরে। ইফরাহ্ এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নেয় সেটি। হারিকেনের আলোর দিকে ধরতে কেমন ঝলক দিয়ে ওঠে জিনিসটা। বেশ ধার সই চকচকে এক ” রাম দা” হাতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে
সাঁঝের বেলা আম্মা বাসায় নেই , হয়তো পাড়ায় কোথাও মিটিং বসিয়ে নিয়েছে। আব্বাজান কই সে খোঁজও নেই তার হাতে ,আর সেই সুযোগেই চয়ন এসেছে।
বারবার টোকা পড়ছে। ইফরাহ্ ধীর পায়ে দরজার কাছে এসেই খট করে খুলে দেয় ঘরের দরজা !
দরজা খুলা মাত্র চয়নের মুখ ফুটে ওঠে এক বিকৃত হাসি। ইফরাহ্ নাক ছিটকায় ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে।
— রূপমতী
এ্যাঁ ছিঃ ।
চয়নের মুখ থেকে আসা মদের বিকট গন্ধ যেন মূহুর্তে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, ইফরাহ্ পিছিয়ে যায় কিছু টা। চেহারায় এক রাশ বিরক্তি এসে ভীর জামিয়েছে তার। কাট কাট গলায় কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়ে মুখ খুলবে তার আগেই মাতাল কন্ঠ আবারো ভেসে আসে
—’আহ্ রূপমতী , তোরে দেখার স্বাদ আমার এই জন্মে না মিটুক।
আল্লাহ একবারে নিজ হাতে বানাইছে তোরে।
“শালার বহুত মাইয়া দেখছি জীবনে ,মেলা মাইয়ার স্বাদ নিছি এইত দুইদিন আগেও এক শা *লি রে…
বলতে গিয়ে মুখ চেপে ধরে চয়ন। ইফরাহ্ সন্দিহান চোখে তাকায় চয়নের দিকে। কেন জানিনা কোথাও কোন এক খটকা লেগেছে তার। সেই পুরণ করতেই চয়নকে ঘুরিয়ে আবারো প্রশ্নকরে সে।
দুদিন আগেও কিহ ! বলো চয়ন ভাই ?
—আহহ! এইসব কি ভাই ভাই করো রূপমতী ? তোমারে তো আমি বোইন না বউ করবার চাই।
মস্তিষ্ক বিকৃত হতে থাকে ইফরাহ্র! নিজের মনের সাথে বুঝা- পড়া করতে পারছে না সে। কেন জানি তার মনে হচ্ছে সব কিছু বেশ জড়ালো।
—”এলাকার ছোট নবাবের রানীর দিকে নজর দিয়েছেন … আবার নাকি বউ করবার ফন্দি এঁটেছেন! ব্যাপার খানা কি ছোট নবাব জানে ?
শুষ্ক এক ঢোক গিলে চয়ন। ইফরাহ্ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে কিছুটা …
মানুষটা কে সে যতই ঘৃণা করুক তিনিই তার বাঁচার উৎস।
—এই রূপমতী আমি জানি তুমি ছোট নবাবরে নিকা করবার চাও না। তাইলে তারে নিয়া ভাবার কি প্রয়োজন কও তো ,
এইদিকে আহো দেখি খানিকটা আদর করি …
কথা গুলো বলেই ইফরাহ্ দিকে হাত বাড়াতে যায় চয়ন। তবে তার আগে ছিটকে দূরে সরে যায় ইফরাহ্। সাথে সাথেই রাগান্বিত কন্ঠে বলে …
– সাবধান , এক পা এগিয়ে এলেই কিন্তু খুন করে ফেলবো।
চয়ন বেক্কল মার্কা এক হাসি দিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে ইফরাহ্ চোখে দিকে। তার পরপরেই তাকায় হাতে থাকা দা ‘ এর দিকে। সে যেন বেশ মজা পায় , কিছু টা নাটকীয় স্বরে বলে …
—আহ ! মেল্লা ডরাইছি রূপমতী । দেখো দেখো বুকের খাঁচায় হাত খান রাখো ,বুকটা কেমন ধরফর করে। জানোস রূপমতী , আমার বুকে ভীষণ জ্বালা। মনডা কয় তুরে বুকে পাইলে পরাণটা জুরায় যাইবো।
—বেড়িয়ে যান এখুনি নয়তো ,আজ সত্যি রক্ত ঝড়বে আমার হাতে ,আর লাশ হবেন আপনি ?
ইফরাহ্র গলা কাঁপে না , বিন্দু পরিমাণ ভয় নেই দুচোখর কোণায়।
চয়নের এত সময়ের শান্ত মস্তিষ্কটা হঠাৎ এক পৈশাচিক রূপ পায়। তেড়ে গিয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরে ইফরাহ্র গলা।
—শা’ লি নষ্টা মা* গি! বড়লোকের পোলার রে শরীল দিতে মজা পাও। আর আমি বুঝি গাঙ্গে ভাইসা আইছি।
ইফরাহ্ চোখ কোনায় পানি জমে , দম যেন আটকে আসছে। পুরো শরীর ঝিম ধরছে তার। কোনো মতে কাপা কাঁপা হাতে রামদা ছোঁয়ায় চয়নের কাঁধে। ধারালো বস্তুর আঘাতে মূহুর্তেই যেন লাল তরলের আবির্ভাব ঘটে!
– আহ! ওরেএএ
মৃদু এক চিৎকার দিয়েই ইফরাহ্ কে ছেড়ে কাঁধ ছেপে ধরে চয়ন। ধরে বুঝি প্রাণ এলো ! বড় বড় নিঃশ্বাস টানতে থাকে ইফরাহ্ , গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে তার , ‘কাশি হচ্ছে। চয়ন কাঁধে চাঁপা হাত সামনে এনেই বুঝতে পারে রক্ত ঝড়ছে ভীষণ। তবে সেদিকে খেয়াল না দেয় না সে … আরো ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে যেন গিলে নিচ্ছে ইফরাহ্ শরীর।
নিজকে সংযত করার বদলে আবারো তেড়ে যায় তার দিকে।
— আমায় আঘাত করছোস ?
কিরে আমার রক্ত ঝরাইছোস?
ন*টি *র জাত আইজ তো তোরে ….
কথা গুলো বলেই ইফরাহ্ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় চয়ন। তবে তার পথে বাঁধা হয়ে ভেসে আসে এক মেয়েলি কন্ঠের ডাক।
—চ চয়ন ভাই আপনি এইহানে ?
থেমে যায় চয়ন ! টিনের আধভাঙ্গা গেটের দিকে তাকতেই নজরে আসে প্লেট হাতে রাইসা দাঁড়িয়ে সেখানে।
রাইসা মেহবিন, চঞ্চল প্রকৃতির একটি মেয়ে, যতই দুঃখ থাকুক তবুও যেন হাসতে ভালোবাসে। গায়ে রংটা শ্যামলা বর্নের.. চেহারাটা গোল আকৃতির ! চোখ দুটি বেশ সুন্দর আকারে অতোটা বড় নাহ, শ্যামলা বর্নের মেয়েটির সুন্দরর্য ফুটে ওঠে তার চুলে। নজরকারা তার ঘন কালো লম্বা চুলগুলো যেন হাটু সমান হবে তার।
লম্বা আর কতই হবে , ৫ফিট ২। শরীরের গঠনও বেশ ভালো মোটাও নাহ চিকন ও নাহ। যাকে বলে parfait …
ইফরাহ্ তখনো ঘন ঘন নিঃশ্বাস টানছে। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি , রাইসার হাতে থাকা প্লেট গুলো ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে … মূহুর্তেই প্লেটে থাকা খাবার গুলো মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তবে তার সেদিক খেলায় নেই , সে দৌড়ে এসে আগলে নেয় ইফরাহ্ কে
—সোনাই ! এই সোনাই …
রাইসার চোখের পানি টলমল করেছে এক হাতে ইফরাহ্ কে জড়িয়ে অপর হাতে মালিশ করতে থাকে তার পিঠ। কিছুটা সময় যেতেই স্বাভাবিক হয় ইফরাহ্
চয়ন পালাতে চায় , ঝামেলা হবে ভেবেই লেজ গুটিয়ে নিয়ে চুপিচুপি উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরে গেটের দিকে। তবে তার আগেই কড়া গলায় বলা কথায় পা দুটো স্থির হয় তার
—আপনি এখানে কেন এসেছেন চয়ন ভাই?
চয়ন দাঁড়িয়ে ! তবে কোনো উত্তর করেনা কাধ হতে ঝড়া রক্তে শার্ট ভিজ গিয়েছে। রাইসার সেদিকে নজর বুলিয়ে তাকায় ইফরাহ্ হাতে থাকা বস্তু টির দিকে যেখানে হালকা ফোটা রক্ত।
ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। খুব ভালো আন্দাজ করতে পেরেছে পুরো কাহিনী , ইফরাহ্ কে ছেড়ে সম্মুখে এসে দাঁড়ায় চয়নের।
—পিপীলিকার পাখা গাজাই মরিবার তরে , এই প্রবাদ নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়।
চয়ন চোখে – চোখ রাখে রাইসার ,সে বুঝতে পেরেছে রাইসার কথার মানে। তবুও মুখে এক তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলে
—কাল যদি পুরো সমাজে তোর আপায় … কলঙ্কিত হয়। কলঙ্কিনী নাম দেয় পুরা সমাজ তখন , কেডা বিয়া করবো তোর আপারে। সকলে তোগো এক ঘরে কইরা দিবো।
এক মূহুর্তেই হো হো করে হেসে ওঠে রাইসা। মনে হচ্ছে সে যেন মজার কোন কৌতুক শুনেছে। এমন কৌতুক তার জীবনে শুনেনি …
—যার দোয়ায় গ্রামে বাইচ্চা আছো , যার ছায়ায় গ্রামের ইতোর পানা করতেছো ,তার রানীতে নজর ! খবরডা একবার পৌঁছে গেলে কি হইবো ভাবছো ? আগে নিজেরে বাঁচাও তারপর নাহয় আপার সম্মান লইয়া ভাইবো।
চয়নের মুখ যেন মূহুর্তে পানসে হইয়া যায়। ভয় যেন চারপাশ থেকে ঘিরে নেয় তাকে ,তবে নিজেকে শক্ত রাখে এতো সময়ে নেশা তার পুরোটাই কেটে গিয়েছে।
—তোর সৎ বোইন হয় ও , এতো মায়া কেন ওর জন্যে , ছোট নবাব তো ওরে রানী করবো তাতে তোর কি ফায়দা ?
– আমরা সৎ বোন হইলেও রক্ত কিন্তু এক ?
চয়ন মুখ কালো হয়ে যায় , মুখ ফুটে আর কথা না বাড়িয়ে মাথা নিচু করেই বেড়িয়ে যায় সে। রাইসা একবার তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে এক গাদা থু থু ফেলে মাটিতে
– জা নো য়ার !
ফুঁপিয়ে ওঠে ইফরাহ্। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে সে! কেমন এক দম বন্ধ কর পরিবেশ। ভিতর টা ছিড়ে যাচ্ছে তার
রাইসা দ্রুত এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ইফরাহ্র সামনে।
নিজেকে কেমন কুঁকড়ে নিয়েছে মেয়েটা। দু’হাতে তাকে টেনে জড়িয়ে ধরে বুকে।
— “আপারে… কান্দিস না আপা… প্লিজ কাঁদিস না।”
রাইসার আকুতি করছ ,ঠিক যেন নিজের হৃদয়ের রক্ত সে মুঠো করে তুলে দিচ্ছে বোনের সামনে।
— “তুই কাঁদলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় আপা… বুকের ভেতরটা যেন ছিঁড়া যায় । আল্লাহর দোহাই লাগে শান্ত হো আপা।
রাইসার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, চোখের কোণে অজান্তেই জমে ওঠে জল। সে আরও জোরে বোনকে আঁকড়ে ধরে।
চারপাশে থমকে যায় বাতাস, সন্ধ্যার হলুদ আভা ধীরে ধীরে কালোতে পরিণত হতে থাকে
ইফরাহ্ থামছেনা আরো জোরে জড়িয়ে ধরে রাইসাকে।
একটা ছোট্ট বাচ্চার মতো বুক ভেঙে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে… কান্নার শব্দটা যেন ভেতর থেকে ছিঁড়ে আসছে।
রাইসার জামার বুক ভিজে যাচ্ছে চোখের পানিতে
দু’জনের বয়সের খুব একটা তফাৎ নেই, যেন একসাথেই বড় হয়েছে তারা বোন না, যেন প্রাণের বন্ধু।
রাইসা মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে ইফরাহ্র। সাতে নিজেও আর চোখের জল আটকে রাখতে পারছে না।
—সব ঠিক হইয়া যাইবো আপা একটু শান্ত হো।
রাইসার গলা কাঁপছে , বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠেছে
সে জানে না কীভাবে এই যন্ত্রণার ভাগ নিতে হয়, তবুও নিজের পুরো ভালোবাসা ঢেলে দিতে চায় ছোট্ট আপার বুকে।
চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু কান্নার শব্দ ভেসে আসছে দুইটা মেয়ের, একটুকরো ভালোবাসা, আর ভাঙা এই পৃথিবীর ধাক্কায় দু’জনেই যেন আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে একে অপরের।
ইফরাহ্ কাঁদতে কাঁদতে রাইসার বুকে মুখ লুকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, তার বলা কথাগুলো যেন ছুরি হয়ে আঘাত করে বাতাসে
— “আল্লাহ… কেন আমারে দেখেন না আপনি? এতো মানুষ মরতেছে … তাদের মাঝে আমি কেন নেই। কেন আমাকে চোখে দেখছেন না আপনি
“ইয়া আল্লাহ… আমারে কঠিন এক মৃত্যু দেন। এমন মৃত্যু… এমন যন্ত্রণা দেন যা কখনো কোনো দুশমনের ও না হয়।
ইফরাহ্ কাঁপা কাঁপা হাতে মুঠো করে ধরে রাইসার জামার কোণা। মুখটা তুলে কান্নাভেজা চোখে তাকায় আকাশের দিকে—
— “আমার লাশ যেন কেও না পায় , পশুর মতো ঠিক যেন তিলে তিলে মরি… ধীরে ধীরে নিঃশেষ হই। তবুও এই যন্ত্রণা হতে মুক্তি দেন।
রাইসা হতবাক, নিথর। চোখের পানি প্রায় শুকিয়েছে তার।সে কিছু বলতে পারে না, শুধু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার আপাকে। বুকের কাছে জড়িয়ে রাখে এমনভাবে যেন তার এই ভালোবাসা দিয়ে ইফরাহ্র সব বিষাদ ছুঁয়ে মুছে দিতে পারবে।
—আপা রে … এই সমাজে বাইচা থাকতে হইলে ক্ষমতা আর টাকা থাকা লাগে।আমাগো মতো গরিব গো কেউ মানুষ ভাবে না আপা। মাইয়াগো কোনো দাম নাই সমাজে।
কাঁদতে থাকা ইফরাহ্ হঠাৎ মুখ তুলে রাইসার বুক থেকে দুই হাতে মুছে নেয় চোখের পানি। রাইসার দিকে তাকিয়ে কাট কাট গলায় বলে
—আব্বাজান রে খরব দে ,আমি ছোট নবাব রে নিকা করতে রাজি … এই বিয়া হইবো। কাল থেকেই শুরু হইবো সব আয়োজন
রাইসা শুষ্ক ঢোক গিলে। সে তাকিয়ে থাকে .. ইফরাহ্ সাদা মনির চোখ জোড়ায়। চোখ গুলো কেমন লাল হয়েছে
– সত্যি আপা তুই এই বিয়া করতে রাজি।
—জলদি বিয়ার আয়োজন করতে কও।
সমাজে নিয়মগুলো ভাঙ্গতে হবে। আর তার জন্যে আমার ওই মানুষটার ভীষণ প্রয়োজন.. “মানুষ শক্তের ভক্ত নরমের যম”।
ইফরাহ্ উঠে দাড়ায় , মাটি থেকে দা তুলে গটগট করে হেটে চলে যায় ঘরের ভিতর। নিষ্পল চাহনিতে তাকিয়ে থাকে রাইসা
—আমি জানিনা , ভবিষ্যতে কি হইবো। তবে তুই মেল্লা সুখি হবি আপা। ছোট নবাব মানুষ টা খারাপ হইলেও, সে যে উন্মাদের মতো চায় তোরে।
রাত গভীর হয়েছে অর্ধ মাতাল হয়ে, হেলে দুলে বাড়ি ফিরছে আরাধ্য! চলতে গিয়ে উস্টা খেয়েছে বেশ কয়েকবার। সিঁড়ি কাছে এসে রেলিং ধরে হেঁটে হেটে উপড়ে উঠছে সে তবে ব্যালেন্স করতে পারছে না নিজেকে আজ নেশা একটু বেশি চড়ে গিয়ে। দুপা এগিয়ে যেতেই আবারো পড়ে যেতে নিলেই উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের এক নরম তুলতুলে হাত তাঁকে বাঁচিয়ে নেয় …
—আরাধ্য ভাই সামলে কি যে করো না হ্যা !
– ” যাহ্ শা’ লা আকাশ ভরা তারা, মা*রা খাওয়া সারা” । কে ছুয়ে দিলে আমায়
আরাধ্য পিটপিট চোখে তাকায় হাতের মালিকের দিকে। মেয়েটি উজ্জ্বল শ্যামলা তবে চেহারায় বেশ মায়া জড়ানো। চোখ দুটো বেশ টানা টানা ঠোঁট কোনে ছোট একটা তিল। পড়নে গোলাপি রঙের এক সালোয়ার কামিজ। মাথা ওড়না টানা। আরাধ্য মুসকি হেসে নিভু কন্ঠে বলে ” আরে টুনটুনি যে … আর ইউ কামিং ? বাহ ! ভালোই হয়েছে ।এখন আমাকে টেনে টুনে একটু ঘরে দিয়ে এসো দেখি।
মানহা ফোস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়ে , এইদিকে আরাধ্য গা থেকে ভেসে আসা জুঁই -জেসমিনের মিশ্রণে মাতাল এক ঘ্রাণ , সাথে যেন কিছুটা মশলার মিশ্রণ। দুচোখ বুঝে নিঃশ্বাস একবার টেনে নেয় মানহা। খুব সাবধানে আরাধ্যে হাত নিজের কাধে নিয়ে ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যায় দোতলার ঘরে দিকে…
ঘরে ঢুকেই তার চোখ কপালে , মেঝের উপর কাপড় গুলো কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা পুরো ঘর এলোমেলো। এ আর এমন কি ? এমন তো আগেও হয়েছে। আগেও এ ঘরে আসা যাওয়া ছিলো তার , বারবার গুছাতে হতো এ ঘর। তাতে অবশ্য মানহা কোনোকালেই ক্লান্ত হয়নি। সে বেশ আনন্দ পায় এই মানুষটি সান্নিধ্য তাকে ভীষণ টানে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে বিছানায় আস্তে আস্তে শুইয়ে দেয় আরাধ্যকে। ঘরে আনতেই ঘুমিয়েছে সে। আরাধ্য কে শুইয়ে পায়ে থাকা জুতা গুলো খুলে এক পাশে নিয়ে রাখে। এদিক ওদিক তাকিয়ে এক এক করে গুছাতে থাকে পুরো ঘর। সব কিছুর গুছানো হলেই জায়গার জিনিস নিয়ে রাখে জায়গায়।
আয়না সামনে টাও বেশ অগোছালো। হাত ঘড়ি গুলো কেমন যেন ছড়িয়ে রাখা। চুলের চিরনীও তাই … একটা মানুষের প্রায় ৪৫টা হাত ঘড়ি , ১২টা চিরনী। নাক কুঁচকে নেয় মানহা চিরণির দিকে তাকিয়ে তাদের সাথে কথা বলছে সে।
—তোদের মালিক কি আদেও তোদের ছুঁয়েছে ? আমি মেয়ে হয়ে একটা চিরনী দিয়ে আমার বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়।আর এদিকে দেখো ১২টা চিরনি!
কথার মাঝেই মানহার চোখ যায় আয়নার সামনে সাজানো কতগুলো পারফিউমেম দিকে। চিরণি দের গুছিয়ে নিয়ে , সাজানো পারফিউমের বোতল গুলো থেকে একটা বোতল হাতে তুলে নেয় মানহা।
Black opium….
মানহা বেশ কৌতূহলী হয়ে , হালকা কিছুটা স্প্রে করে তার হাতে। এইতো ! এই সেই মাতাল করা সুবাস যা কিছু সময় আগেও ভেসে এসেছে আরাধ্য গা হতে। যার হালকা আভাস এখনো মানহা গায়ে লেপ্টে রয়েছে। সে তাকায় আরাধ্যের ঘুমন্ত মুখের দিকে। নিষ্পাপ শিশু লাগছে।
রাত আরো গভীর থেকে গভীর হচ্ছে এসময় এ ঘরে কেউ দেখলে গ্রামের বদনাম রটাবে এইসব ভেবেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় যায়
মানহা তবে আরাধ্যের ঘরে দরজা পেরোতেই মুখোমুখি হয় চেয়ারম্যানের।
খালু জান !
ঘুমিয়েছে বাঁদর টাহ্ ?
মানহা উপর নিচ মাথা নাড়ায় , চোখ দুটো তার মাটির দিকে স্তব্ধ চেয়ারম্যান সাহেব কিছু সময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরেন।
ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে রাত , চেয়ারম্যান সাহেব ঘরে এসেছে। দরজার কপাট টেনে বিছানায় বসতেই। কানে আসে অরুনিমার বলা কথা
ছায়াস্পর্শ পর্ব ৪
—আপনার পাপ গিলছে আমার ছেলেকে , সব কিছুই আপনার কর্মের ফল। আজ আপনার জন্য আমার ছেলে ধ্বংসে দিকে পা বাড়িয়েছে!
চুপ থাকে চেয়ারম্যান .. স্ত্রী বলা গুলো কোনো প্রকার উত্তর কাটে না সে। ভেপস্যা এক গরম গায়ে থাকা ফতুয়া খুলে আলনায় রেখে
নিঃশব্দে গিয়ে শুয়ে পড়েন অরুনিমার পাশে।
