ডার্কসাইড পর্ব ১৭

ডার্কসাইড পর্ব ১৭
জাবিন ফোরকান

“ অনুভূতি অপ্রয়োজনীয়। অনুভূতি মানুষকে দূর্বল করে। হৃদয়ে উৎপত্তি ঘটায় অনর্থক আবেগের। জীবন ততক্ষণ সহজ যতক্ষণ কোনপ্রকার শৃংখল তোমায় আবদ্ধ করেনা। একবার বিবেক সরিয়ে আবেগের চাদর গায়ে জড়ালে সেখানেই এই জীবনের সমাপ্তি। হৃদযন্ত্রের স্পন্দন, ফুসফুসের বায়ু প্রশুদ্ধকরণ, মস্তিষ্কের সিগন্যাল প্রেরণ, কোষের ধ্বংসসৃষ্টি খেলার নাম বেঁচে থাকা। সেই বেঁচে থাকা আর জীবন কখনোই এক নয়।জীবনের সংজ্ঞা আরো পরিব্যাপ্ত। আমি বেঁচে আছি।কিন্তু জীবনের সঙ্গে এই বেঁচে থাকার কোনপ্রকার সংযোগ নেই।”

থামলো কলম। এক মুহুর্ত হলদেটে পাতার উপর স্থির হয়ে রইলো জেল কালির নিব।পরমুহুর্তে চকচকে সেই কালির আচ্ছাদনে ঢেকে পড়লো সবকটি লাইন।আঁকিবুঁকি বয়ে চললো ধ্বং*সযজ্ঞের খেলায়। সামনের কালো টেডি বিয়ারটি নিজের নীল চোখের গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে,সুস্থির শরীরে।ডায়েরির মলাট বন্ধ হতেই পুতুলে দৃষ্টি আপতিত হলো।তর্জনী ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিলো কোমল শরীর।স্নেহের হাত টেনে নিলো তা বক্ষে।ব্লুটুথ স্পিকার মৃদু আওয়াজে সঙ্গীতের ভেলা ভাসিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~এখনো মাঝে মাঝে
মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে
শুনি তোমার পায়ের আওয়াজ
যেন তুমি এসেছ ফিরে
তুমি চলে গেছ অনেক দূরে
এই মনের আঙিনা ছেড়ে~
গানের কথা এবং সুরে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল আসমান।চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল অদূরে আভায় স্তিমিত রাতের শহরে।দরজার মৃদু শব্দে তার মস্তিষ্ক সতর্ক হয়ে উঠল বিনা প্রয়োজনেও।মাথা পিছনে হেলিয়ে উল্টো দৃষ্টিতে চাইলো সে।রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রোযা।

– আসতে পারি?
এই মেয়ে আবার অনুমতি নেয়া শুরু করলো কবে থেকে?মনে মনে ভাবলেও মুখে প্রকাশ ঘটালোনা।দৃষ্টি ফিরিয়ে চাইলো হাতের টেডি বিয়ারের দিকে।মিনিটখানেক অপেক্ষা করে রোযা নিজেই ভেতরে প্রবেশ করলো।রুমের চারদিকে চেয়ে সোফায় বসলো।
– ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছি বলে মনে পড়ছেনা।
আসমানের বক্তব্য কর্ণগোচর হতেই রোযা এক মুহূর্তের জন্য বরফ হয়ে গেলো।পরমুহুর্তেই আবার হাসিতে অধর উদ্ভাসিত করে সোফা থেকে উঠে এগিয়ে গেলো সামনে।
– তুমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু করছো বলে মনে হচ্ছে না।তাই একটু বিরক্ত করলে ক্ষতি কি?
আসমান মাথা তুলেও দেখলোনা।তার দৃষ্টি আবদ্ধ টেডি বিয়ারে।রোযা চেয়ারের কাছে গিয়ে থামলো।তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো।পুতুলটির নীলাভ দৃষ্টিতে আবদ্ধ হলো সে।

– তুমি চাইলে মাস্ক খুলে রাখতে পারো।এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই।
এক মুহূর্তের জন্য স্থবির হলো আসমান।তথাপি তার দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটলোনা।জবাব এলো দ্রুতই।
– আমি অভ্যস্থ।
– অভ্যস্থ হলেও…
বলতে গিয়েও থমকে পড়লো রোযা।সেদিন কিচেনে আসমানের প্রতিক্রিয়ার কথা তার আজও স্মরণে রয়েছে।চাপ সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক নয় সে।মাথা ঝাঁকিয়ে সে কথোপকথন জারি রাখার উদ্দেশ্যে বললো,
– এই টেডিটা ভীষণ ইউনিক।তোমার খুব প্রিয় বুঝি?
জবাব আসবেনা আশা করলেও ছোট্ট একটি প্রতিক্রিয়া পাওয়া সম্ভব হলো।তাতে রোযা বাক্য বিনিময় জারি রাখার দুঃসাহস করলো।

– হুম।
– নিজে কিনেছ?মনে হয়না।নিশ্চয়ই কেউ উপহার দিয়েছে।আমাদের প্রিয় কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া কিছুই এতটা যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করি আমরা। কে দিয়েছে তোমায়?তোমার বাবা?
– নিজে কিনেছি।
থতমত খেয়ে গেলো রোযা।জোরপূর্বক নিজের হাসি ধরে রেখে উচ্চারণ করলো,
– ওহ আচ্ছা।
এই ছেলের সাথে কথা বলা এতটা কষ্টকর কেনো?স্থির দাঁড়িয়েও রোযা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের ফোঁটা নেমে যাচ্ছে নিচে।নার্ভ সিস্টেম উত্তেজিত হয়ে আছে।যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে অপ্রিয় কোনো প্রতিক্রিয়ার মোকাবেলায়।

– নিহাদের কথায় উলটপালট কোনো ধারণা করোনা।
আসমানের অতর্কিত বাক্যে রোযা নিজের আপন ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো।ভ্রু উঁচু করে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো।আসমানে পিছনে ফিরেছে। টেডিটি টেবিলে রেখে তাতে কনুই ঠেকিয়ে বর্তমানে রোযার দিকে সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে সে।
– নিহাদের কথা?
– জিজ্ঞেস করছিল আমি জেলাস কিনা?
– ও..ওহ!

না চাইতেও রোযার গাল মৃদু লালিমায় ছেয়ে গেল।সে বুঝতে পেরেছিল নিহাদ মজা করছিল, আর আসমানকে সেসব নিয়ে জিজ্ঞেস করার প্রশ্নও ওঠেনা।কিন্তু এই পিশাচ নিজে থেকেই তা বলবে কে আন্দাজ করেছিল?রোযার লজ্জাবোধ আসমানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ালোনা।একটি নিঃশ্বাস ফেললো সে।মাস্ক একটু উপরে টেনে সে কঠোর কন্ঠে জানালো,
– অনুভূতি বলে কিছু আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই।যেটুকু তলানি রয়েছে তা শুধুমাত্র আমার পরিবারের জন্য।
না চাইতেও নিজের হৃদয়ে এক বেদনাদায়ক টান অনুভব করলো রোযা।পরিবার?চারুলতা এবং বাবা।এই দুইজন।যার মধ্যে রোযার কোনো স্থান কোনোকালে ছিল না এবং হবেও না।অন্তরে ঘূর্ণনের উদ্ভব ঘটলেও চেহারায় স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে রোযা মাথা দোলালো,

– অবশ্যই আমি জানি আসমান।নিহাদ মজা করছিলো। এতে এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই।
– নিশ্চিত করছি যেন কেউ আমার সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা পোষণ করে বসে না থাকে। আই হেইট এক্সপেকটেশনস!
কপাল কুঁচকে এলো রোযার।যারপরনাই বিরক্তবোধ করছে সে।খুব ভালোমতই জানা আছে আসমান তার পরোয়া করেনা,কিন্তু তাই বলে এতটাও সৎ হয়ে তা জাহির করার কি আছে? তেঁতে উঠে রোযা বলে বসলো,
– তুমি কি বলতে চাইছো আসমান?আমি তোমার থেকে কিছু এক্সপেক্ট করছি?
চেয়ার থেকে উঠলো আসমান।ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগোলো দেয়ালের কাছে।বাইরের শহর উদ্দীপ্ত হয়ে রয়েছে। সিটি ইউফোরিয়ার সবচেয়ে উচু বিল্ডিংয়ের উপর সিগন্যাল লাইট সবুজ আভা ছড়িয়ে জ্বলছে নিভছে।

– হয়ত না কিংবা হয়ত হ্যাঁ।মানবহৃদয় পৃথিবীর সবথেকে বড় রহস্য।যে রহস্যভেদ স্বয়ং হৃদয়ের অধিকারীর পক্ষেও ভেদ করা সম্ভব হয়না।
রোযার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।একপাশে তাকালো সে।বিতৃষ্ণার সঙ্গে বলল,
– আসমান।আমাদের সম্পর্কের মূলভিত্তি কি আমি জানি।তুমি আমার জন্য যা করেছ তা অনেক, তোমার প্রতি আমার নিবেদনের চেয়ে বহুগুণ বেশি।এর অধিক কিছুই নিশ্চয়ই আমি কোনোদিন চাইবো না।চিন্তা করোনা।
– একটা জিনিস খেয়াল করেছ?

মাথা হেলিয়ে রোযার দিকে তাকিয়ে আসমান গম্ভীর কণ্ঠে ব্যক্ত করলো,
– এর মধ্যেই তুমি তিনবার আমার নাম উচ্চারণ করেছ।প্রতিটা বাক্যে।
জমে গেলো রোযা।তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গজুড়ে এক শীতলতার তরঙ্গ খেলে গেলো।হৃদযন্ত্র অবাধ্য হওয়ার বদলে সন্দেহজনকভাবে রয়েছে অত্যন্ত স্থবির।যেন ধীরে ধীরে অনুভূতির দলেরা সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রোযার নৈঃশব্দ্য আসমানকে পুনরায় বলতে বাধ্য করলো,
– অনুভূতি বড্ড বেহায়া।এর মায়ায় জড়িয়ে নিজেকে ধ্বংস করোনা। হোক সে অনুভূতি করুণার কিংবা অন্যকিছুর।
– তুমি নিজেকে একটু বেশীই প্রাধান্য দিয়ে ফেলছোনা? আস…মান?
নিশ্চুপ থাকলোনা রোযা।নামটি উচ্চারণ করলো খেদ নিয়ে।এগোলো দানবের দিকে, নির্বিকার নির্ভীক হয়ে।

– আমাকে দয়া করছো?
– হ্যাঁ করছি।
– কেনো করছো?আমি করতে বলেছি?
সামান্য একটু হাসির শব্দ ভেসে এলো আসমানের মাস্কের অন্তরাল থেকে।
– এতটা আত্মভোলা হবে ভাবিনি।ভুলে গেছো চুক্তির মূল হোতা কে ছিল?
– ভুলিনি।আমি আবেদন করেছিলাম তোমার কাছে, নিজের জীবন রক্ষায়।কিন্তু সে তো পরে। তুমিই বা আমাকে আমার বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করেছিলে কেনো?প্রতিবেশীদের সামনে নিজেকে আমার স্বামী বলে পরিচয় দিয়েছিল কেনো?তোমার কি মনে হয়না এরপরই আমি এই প্রস্তাবের দুঃসাহস পেয়েছি?
নীরব আসমান।দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোযার দিকে।এগিয়ে গেলো রোযা,অদ্ভুত এক আকুলতার অনুভূতি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে।এই দোলাচলে পরাজিত হতে সে রাজী নয়।সন্নিকটে পৌঁছে দানবের বিস্তৃত বুকে ঠেকালো নিজ তর্জনী।

– ইফ ইউ হেইট এক্সপেক্টেশনস, দ্যান হোয়াই ডিড ইউ এভেন শো ইট ইন দ্যা ফার্স্ট প্লেস?
খপ করে রোযার তর্জনী পাকড়াও করলো আসমানের হাত।বলা বাহুল্য নয়,তাতে যথেষ্ট ব্যথা অনুভূত হলো।তবুও চেহারায় তার প্রদর্শন ঘটতে না দিয়ে রোযা দৃঢ় কন্ঠে বললো,
– তোমার মনে হয়না এখানে মূল চাহিদা আসলে তোমার নিজের?কি ভেবেছ?তোমার মতন একজন নৃ*শংস খু*নীর অনুভূতির সাগরে নিজেকে ভাসাবে কেউ?আরেন্ট ইউ থিংকিং টু হাইলি অব ইওরসেল্ফ?
সহসাই ঘটলো ঘটনাটি।রোযার উভয় হাত আসমানের দখলে চলে গেলো মুহূর্তেই। তা মেয়েটির পিছনে নিয়ে শক্ত হাতে আবদ্ধ করে রাখলো আসমান,তার অপর হাত উঠে গেল চিবুকে।দুই আঙ্গুল চেপে বসে এক ঝটকায় মুখ উপরে তুললো নিজের দৃষ্টির সঙ্গে মেলাতে।নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্তও হলোনা রোযা, কুঞ্চিত দৃষ্টিপাত ঘটালো কৃষ্ণগহ্বরমাঝে।

– নিজেকে আনা হুয়াং এর সানশাইন – গ্রাম্পি প্লটের হিরোইন মনে করো? রাগী,অনুভূতিহীন, ডমিনেন্ট এবং কালো অতীত সম্বলিত মেইল লিডের জীবনে হাসি, খুশি, অনুভূতির জোয়ার নিয়ে এসে নিজের নিষ্পাপতা দিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ করবে অতীতের গ্লানি, গুড়িয়ে দেবে অনুভূতিহীনতার দেয়াল?
স্তব্ধ হয়ে থাকল রোযা।আসমানের কাছ থেকে এমন সাহিত্যিক কোনো আবেদন আশা করেনি সে। আশা করেনি এমন তুলনাও।তবুও অস্বিকার করতে পারছেনা,অবচেতন এই মন নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে তুলনা করে ফেলছিল কাল্পনিক চরিত্রদ্বয়ের কাগুজে পৃথিবীর সঙ্গে।
– লাইফ ইজ নট আ ফেইরিটেইল রোযা!
কি অনুভব করবে সে?প্রথমবার এই পিশাচের কন্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হওয়ার আবেগ,নাকি এই মুহুর্তের গ্লানির গভীরতা?এক টানে নিজের মাস্ক খুলে ফেললো আসমান।ছুঁড়ে ফেলল দূর মেঝেতে।তার সেলাইয়ের দাগে দগদগে চোয়াল স্পষ্ট হলো দৃষ্টিতে।

– আয়নায় নিজেকে দেখলে এই অন্তর পোড়ে।না চাইতেও বুজে আসে চোখের পাতা।অবলোকন করতে অনীহা হৃদয়ের।আর তুমি কিনা দৃষ্টি ফেলতে চাও, ছুঁয়ে দেখতে চাও যেন কিছুই হয়নি? চাঁদের সাথে তুলনা করো আমাকে? ভাগ্যাকাশের সুখের চাঁদ?
আসমানের তপ্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে গেলো রোযার কপোল।এতটা সন্নিকটে শিহরিত হওয়ার বদলে ভারী চাপ জেঁকে বসলো শরীরে।যেন অবশ হয়েছে চিন্তাশক্তি।
– ওই চাঁদেরও কলংক আছে,কিন্তু তোমার অঙ্গজুড়ে সেই কলংকের হীনতা নেই। তুমি চাঁদের চাইতেও অতুলনীয় প্রেয়সী….. লাইনগুলো কখনো শুনেছ কিংবা পড়েছ?স্রষ্টার সৃষ্টি জড়বস্তু চাঁদ,এর সঙ্গে মানুষের তুলনা হাস্যকর নয়?
রোযাকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো আসমান।চেয়ে থাকলো রোযা, বিহ্বল হয়ে।সহস্র চেষ্টা সত্ত্বেও অশ্রু ভরে উঠলো নয়নে,তবুও তার জোয়ার ঠেকাতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা।উল্টো ঘুরল আসমান।পুনরায় দৃষ্টি ফেললো বাইরে।তার দাগে উদ্ভাসিত চেহারায় প্রতিফলিত হলো রাত্রির আবহ।

– একটি চুক্তি হয়েছে আমাদের মাঝে।যতদিন না কে বি গ্রুপের পতন ঘটছে ততদিন তাদের কবল থেকে তোমাকে আমি রক্ষা করবো।বিনিময়ে ব্যবহার করবো তোমায় নিজের প্রয়োজনে।তারপর একদিন, চুক্তির সমাপ্তি। ব্যাস….নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকিঝুঁকি দেয়ার চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন দেখছিনা এর মাঝে। তুমি আসতে পারো।আর কখনো আমার রুমে না এলেই আমি খুশি হবো।
নির্বিকার কণ্ঠের বক্তব্য শুনে গেলো রোযা।অতর্কিতে নামা অশ্রুর ফোঁটাকে মুছে নিলো সহসাই।বিদায় নিলো বিষাদ,স্থান দখল করলো শূন্যতা।তার সঙ্গে জমলো পর্বতসমান অভিমান।যদিও তার অধিকার নেই।তবুও মানুষের মন বলে কথা।এত সহজে কি নিয়ন্ত্রিত হতে চায়?

– যে নিজেই রাতের আঁধার থেকে প্রভাতের দীপ্তিতে আসতে রাজী নয়… তাকে দ্যুতিতে সিক্ত করার সাধ্য কার?
এটুকুই।উল্টো ঘুরল রোযা।হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।পিছনে ফেলে গেলো শীতল কক্ষে তার অস্তিত্বের বিনম্র উষ্ণতা। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো আসমান,অনুভূতিহীনতার নিটল হিমালয়।হিমবাহের পুরু আস্তরণ তার অস্তিত্বজুড়ে।সামান্য কাঠির খোঁচায় তা ভাঙা এতই সহজ কি?
সেদিনের মতোই ব্লুটুথ স্পিকার আজও থেমে নেই।নিস্তব্ধতা নাড়িয়ে সুরের প্রবাহ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে।

~এই প্রাণ এই মন
কেঁদে বলে সারাক্ষণ
ভুলে গিয়ে আছো তুমি সুখে
আমি কাটাই প্রহর আর ভালোবাসা
একা বেদনারই চরে
তুমি চলে গেছো অনেক দূরে
এই মনের আঙিনা ছেড়ে~

প্রভাত ঠিকই এলো শহরে।নিজের আভায় মুড়িয়ে ফেললো সমগ্র সৃষ্টিজগৎকে।দিবাকরের চোখ রাঙানি বেলা বাড়ার সাথে সাথে তপ্ত উষ্ণতার উন্মেষ ঘটালো।শহরের আনাচে কানাচে হতদরিদ্র মজুর শ্রমিকেরা যখন জীবনজ্বালায় অতিষ্ঠ তখন সিটি ইউফোরিয়ার ভবনে ভবনে এসির বায়ুতে আবদ্ধ কক্ষে বিলাসী অলস সময় ব্যয়ে লিপ্ত অভিজাত জন্ম।

গত দুইদিন জিমে মনোযোগ দেয়া হয়নি বিভিন্ন কারণে।তাই আজকে সকাল ৯ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত টানা দুই ঘণ্টা শরীরচর্চা করলো আসমান। পরে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নামলো নিচে।কিছুটা খাবার দরকার শরীরের। কারো হাতের রান্নাই যেন মুখে রুচবেনা।হলরুমের কাচের দেয়ালের পর্দা আজ সরানো হয়নি লক্ষ্য করে কিছুটা অবাক হলো আসমান।রোযা এই পেন্টহাউজে আসার পর থেকে একটা দিন বাদ যায়নি,মেয়েটি আলোর আভাসী। আঁধার তার জন্য নয়।কিন্তু আজ সেই আঁধারেই ছেয়ে রয়েছে চারপাশ।ভারী পর্দায় ঘেরা দেয়াল,যার কারণে প্রায় দুপুর ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত রশ্মির অভাব।

দৃশ্যপটে হস্তক্ষেপ করলোনা আসমান।চুপচাপ কিচেনে ঢুকলো।লাইট অন করে অ্যাপ্রোন গায়ে চড়িয়ে কাজে লেগে পড়লো।ডিম সিদ্ধ দিয়ে সবজি বের করে ধুয়ে নিলো। একে একে কেটে নিলো লেটুস, সাদা বাঁধাকপি, চেরি টমেটো, অ্যাভোকাডো এবং বিটরুট।বাটিতে নিয়ে তাতে অলিভ অয়েল, মেয়োনিজ, চীজ, হোয়াইট সস এবং কিছুটা গোলমরিচের গুড়ো মিশিয়ে নিলো। আধসেদ্ধ ডিমের একটা দুভাগ করে উপরে রাখলো,কুসুম গড়িয়ে যেতে থাকলো উপরে।মিক্সড সালাদ তৈরী।

– বাহ্।তুমি রান্নাও করতে জানো জামাই?
দুর্বল এবং ভাঙা ভাঙা কন্ঠস্বরটি কর্ণগোচর হতেই আসমান মুখ তুলে তাকালো।হুইলচেয়ার ঠেলে এগিয়ে আসছে নার্স,তার দিকে মিষ্টি হাসি নিয়ে চেয়ে আছেন ইউনূস রহমান।
– স্যার।আমি কি একটু বাইরে যেতে পারি আজ?আগামীকাল আমার ছেলের জন্মদিন।একটু কেনাকাটা করবো।কথা দিচ্ছি বিকালের মধ্যেই চলে আসবো।
নার্সের কথায় ভ্রু তুলে তাকালো আসমান।মাথা হেলালো,
– আপনাকে দায়িত্বে গাফিলতি করার জন্য নিযুক্ত করা হয়নি।আপনার ওয়ার্কিং আওয়ার শেষ হলে যেতে পারেন।
– ওকে স্যার।
ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেললো নার্স।তাতে ইউনূস বলে উঠলেন,

– তুমি যাও মা।কয়েক ঘন্টায় কিছুই হবেনা।আমি সামলে নিতে পারবো।আমার নাতনী জামাই সবাই আছে এখানে।
– স…সত্যি?
– হুম সত্যি।আমি বলছি তুমি যাও।
তারপরও আসমানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো নার্স।কোনপ্রকার প্রতিবাদ করলোনা বাড়ির কর্তা।শুধু দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।তাতে আশান্বিত হয়ে ইউনূস রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত পেন্টহাউজ ত্যাগ করলো সে। তার চলার পথে তাকিয়ে ইউনূস একগাল হাসলেন।
– মাঝে মাঝে পারিবারিক খুশির প্রয়োজন আছে।
কিছুই বললোনা আসমান।চুপচাপ আরেকটা বাটিতে কিছুটা সালাদ তুলে নিলো।সঙ্গে গ্লাসে ঢেলে নিলো আপেলের জুস।কিচেনের টেবিলে তা রেখে ইউনূস রহমানের হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে এলো কাছে। বললো,
– খেয়ে নিন।
হাসলেন ইউনূস।চামচ তুলে কিছুটা মুখে তুললেন।অপরদিকে আসমান চেয়ার টেনে অপরপ্রান্তে বসলো।

– তুমি খাবেনা?
আসমান দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই ইউনূস হাসলেন,বড্ড অমায়িক এক হাসি।
– সমস্যা নেই।চড়ুই আমাকে সবই বলেছে।আপন মানুষের সামনে নিজেকে খোলসে আবৃত করে রাখার কোনো দরকার নেই।
তারপরও এক মুহূর্ত দ্বিধান্বিত হলো আসমান।অবশেষে মাস্কটা খুলে রাখলো একপাশে।সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো বৃদ্ধের দিকে।ইউনূস রহমানের অধরের অমায়িক হাসিটি ক্রমেই বিস্তৃতিলাভ করলো।
– অ্যাকসিডেন্টের কারণে এমন ক্ষতচিহ্ন হওয়া সম্ভব নয়।
আসমানের নয়নে কিঞ্চিৎ বিস্ময় ফুটে উঠলো।নিজের বাটিতে চামচ নাড়তে থাকলো আনমনে।মুখে তুলতে অস্বস্তি হচ্ছে।ইউনূস অবশ্য প্রশান্ত রয়েছেন।তার অভিব্যক্তিতে কোনপ্রকার খেদ প্রকাশ পেলোনা।যেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।রোযা নিজের বৈশিষ্ট্য কোথা থেকে অর্জন করেছে তা অনুধাবনে বেগ পেলনা আসমান।

– আমি জানি আমার চড়ুই আমাকে যা বলে তার অর্ধেক সত্য অর্ধেক মিথ্যা।উভয়ের সংমিশ্রণে সে আমার জন্য কল্পনার স্বর্গ তৈরি করে।
এক চামচ সালাদ মুখে তুলে নিঃশব্দে বৃদ্ধের কথা শুনে যেতে থাকলো সে।বয়স এবং অসুস্থতায় দুর্বল শরীর কিছুটা কাপছে।নাকে সংযুক্ত নাসাল ক্যানোলা অবশ্য তার কথাবার্তা কিংবা অন্য কাজে বাঁধা সৃষ্টি করছেনা।চুলহীন চকচকে মাথার চামড়াও কিছুটা কুচকে এসেছে।চোখের দুপাশে পড়েছে কালির স্তর।

– বছর চারেক আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।কোনো হাসপাতালেই সেই অসুখ ধরতে পারলোনা।নিজেদের জমিজমা খুঁইয়ে গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ার মাদ্রাজ পর্যন্ত।সেখানে অপারেশন করা হলো এক টিউমারের।পাকস্থলীর পাশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল।হলাম সুস্থ, ফিরলাম দেশে।ততক্ষণে সম্বল বলতে যা ছিল সব শেষ।
আপেলের জুসের গ্লাসে চুমুক দিতেই হাত কাপা বেড়ে গেলো।আসমান উঠে দাঁড়িয়ে ধরলো গ্লাস, খাইয়ে দিল সন্তপর্নে।তারপর চেয়ার টেনে বসে পড়ল তার পাশেই।বাটি টেনে নিলো নিজের হাতে।ইউনূস রহমান হাসলেন, বড্ড মাধুর্যপূর্ণ এক হাসি।

– ভেবেছিলাম নাতনীকে নিয়ে নতুন করে সব শুরু করবো।একটু একটু করে গড়ে তুলব যৎসামান্য যতটুকু ছিল।কিন্তু তা আর হলো কই?কপালপোড়া আমার চড়ুই।এত ঝক্কি ঝামেলার মাঝেও ঠিকই পড়াশুনা ঠিক রেখেছিল।যদিও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল থেকে কমই পায়।আইসিটি আর বায়োলজির এ প্লাসটা মিস যায়।তাতে অবশ্য তার বুয়েটে পড়ার স্বপ্নে খুব বেশি বাঁধা আসেনি,কিন্তু পুরোনো অসুস্থতা ফিরে এলো নতুনরূপে।এবার শুধুমাত্র টিউমার নয়, ভয়াবহ স্টমাক ক্যান্সাররূপে।
তাচ্ছিল্যের কর্কশ হাসি হেসে নিজের হাত নাড়লেন।আসমান মুখে খাবার তুলে দিতেই ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে চিবুলেন।

– পড়াশুনাই উচ্ছন্নে যায় এই আমি অভাগার পিছনে খাটতে খাটতে।জলের মতন টাকা এসেছে, বাবার ইন্সুরেন্স পলিসি, মায়ের বাড়ির লোকদের কাছে থাকা গয়না, একটিমাত্র বাকি থাকা সম্বল পুকুরটি বিক্রি করে।হয়নি তাতেও।এরপরের টাকা কোথা থেকে এসেছে?আমি জানিনা।কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি।নিজেকে অপরাধী মনে হতো।কি হয় আমার মতন এক বুড়োকে ম*রতে রেখে দিলে?নিজের ছেলেই যাকে দেখেনি নাতনী হয়ে কতটুকু দেখবে?
আসমান নীরব।আরেক চামচ খাবার তুলে দিলো বৃদ্ধের মুখে।

– শেষে বুঝেছি,টাকাগুলো তুমিই দিয়েছ।আমি জানিনা তোমাদের সম্পর্ক নিয়ে আমাকে বলা কথাগুলোর কতটুকু সত্য কিন্তু প্রথমবারের মতন জীবনে একটু হলেও ভালো থাকতে দেখেছি আমি চড়ুইকে।বাবা মা গত হয়েছে,আপন চাচাও পর, অসুস্থ বৃদ্ধ দাদু… কি আছে ওর জীবনে?কিছুই নেই।তবুও আমাকে এখানে নিয়ে এসে যতটা খুশি সে হয়েছে সে খুশি হয়ত কোটি টাকা খরচ করেও কোনোদিন পাওয়া সম্ভব নয়।আমাকে নির্লজ্জ মনে করতে পারো, নাতনী জামাইয়ের টাকায় স্ফূর্তি করে বেড়াচ্ছি যেখানে আপন ছেলের ঘর করতে পারিনি।তবুও… অসহায় মানুষ তো, জীবনের একমাত্র সম্বল চড়ুইটার জন্য বড্ড মন আনচান করে।আ*ত্মহ*ত্যা মহাপাপ।নাহলে সেই কবেই নিজেকে শে*ষ করে…

– প্লীজ আপনি আর কথা বলবেন না।পানি খান।
গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো আসমান।চুকচুক করে সম্পূর্ণ গ্লাস নিঃশেষ করলেন ইউনূস।কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে জানালেন,
– তোমাকে আমি এসব বলেছি তা আবার চড়ুইকে বলোনা যেন।আমি ওর কাছে সেই লক্ষী বোকা ছেলেটি হয়েই থাকতে চাই,যাকে যা বোঝানো হয় তাই নিঃশব্দে বিশ্বাস করে নেয়।
সরাসরি আসমানের দৃষ্টিতে নজর মেলালেন ইউনূস।একটি হাত বাড়িয়ে দিলেন।চেহারার কদর্যতা তাকে বিরত রাখলোনা।নিজের হাতটি দিয়ে আলতোভাবে স্পর্শ করলেন আসমানের হাত।ইতস্তত করলেও সরিয়ে নিলোনা আসমান।চেয়ে থাকল নির্বিকার হয়ে।

– আমি আর কতদিনই বা?খোদার কাছে প্রতিদিন যে হারে নিজের মরহুমা স্ত্রী আর সন্তান বউয়ের সঙ্গে মিলনের কামনা করি,তাতে হয়ত খুব দেরী নেই এই ইহজগতের মায়া ত্যাগ করার।তার আগে তোমাকে একটা অনুরোধ করে যাই কেমন?ক্ষমতায় কোনোদিন সম্ভব হলে এই বৃদ্ধ মানুষটির আর্জি রেখো?
কি অনুরোধ?—প্রশ্নটি হৃদয়ে উত্থাপিত হলেও মুখফুটে করলোনা আসমান।ইউনূস রহমানের হাত তার বাহু টপকে কপালে ঠেকলো।আলতো করে মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে বিড়বিড় করলেন,
– আমার চড়ুইকে সুখ দিও…..একটুখানি সুখ।

অফিসরুমটি খুব বেশি বড় নয়।একটি সোফাসেট, টেবিল, জোড়া দুয়েক চেয়ার এবং টেবিলের উপর ল্যাপটপ।সবকিছুই পরিপাটি করে সাজানো হওয়ায় পরিবেশটা ভালোই লাগছে।টেবিলের অপরদিকের চেয়ারে শিরদাঁড়া টানটান করে বসে আছে রোযা।তার বিপরীতে ভারী ফ্রেমের চশমা পরিহিত এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক।তার পিছনের দেয়ালে কালো অক্ষরে লিখা,

“ ফাউন্টেন পেন ”
একটি অনলাইন বেইজড এন্টারটেইনমেন্ট পত্রিকা।বাংলা এবং ইংরেজি উভয় মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার বেশ চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে।বিদেশে এখনো অতটা দাপট বিস্তার হয়নি।প্রতি মাসে অবশ্য একটি করে প্রিন্টআউট ম্যাগাজিন বের হয়।কিশোর এবং তরুণদের মাঝে তার চাহিদা বলতে গেলে ব্যাপক।সামান্য এইচ এস সি পাশের সার্টিফিকেট দিয়ে কি করা যাবে ভাবতে ভাবতে রোযা যখন হতাশ তখন অনেকটা শখের বশেই এই পত্রিকার প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে নিজের লিখা ই মেইল করে সে।আজ প্রায় দুইমাস পর তার ডাক পড়েছে।
সামনে বসে থাকা মানুষটি এই পত্রিকার সম্পাদক, জ্যাক হেনরি।নামে পুরোদস্তুর ব্রিটিশ শোনালেও আদতে বাঙালি তিনি, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।নিজের চশমার লেন্সের ভেতর দিয়ে একটি কাগজের দিকে চেয়ে আছেন একদৃষ্টে।রোযার সামনে রাখা কফির মগ।তেতো হওয়ায় মুখে রুচবে বলে মনে হয়না।কিন্তু পান না করলে অভদ্রতা হবে বলে ক্ষণে ক্ষণে চুমুক দিচ্ছে রোযা।

– হুম… রোযা,কিছু মনে করোনা আমার ছোট বলে তুমি করেই বলছি।
– জ্বি অবশ্যই স্যার।
– সত্যি বলতে তোমার লিখা আমার এডিটিং টিমের ভালো লেগেছে।আমার নিজেরও।তোমাকে আমি আমাদের অনলাইন ডিপার্টমেন্টের একজন লেখিকা হিসাবে নিযুক্ত করতে ইচ্ছুক।
ঢোক গিললো রোযা। জ্যাক না থেমে বলে গেলেন,

– খুব বেশি প্রয়োজন না হলে অফিসে আসার দরকার নেই।শুধুমাত্র ই মেইলে লিখা পাঠিয়ে দিলে চলবে।এডিটর কর্তৃক অনুমোদিত হলে পাবলিশ করা হবে।প্রতি সপ্তাহে একটি করে লিখা জমা দিতে।ভূতের গল্প, প্রেমের গল্প, ফ্যান্টাসি গল্প; কাল্পনিক কিংবা বাস্তব… সাপ্তাহিক এডিশনে তা যুক্ত হবে।পাঠক সাড়া পেলে মাসিক প্রিন্টে প্রকাশিত হবে। স্যালারি নূন্যতম পাঁচ হাজার।শুরুতে এটাই পাবে। তারপর তোমার লিখার চাহিদা অনুসারে স্যালারির পরিমাণ বাড়তে পারে।নিজের মতন কাজ করবে,অফিসের ঝামেলা নেই শুধুমাত্র প্রতি সপ্তাহে লিখা পাঠালেই চলবে।এর বেশি কিছু আশা করলে তোমার পরের জনকে ভেতরে ডাকা হবে।

– না..না স্যার…আমি পারবো।
রোযা জবাব দিতেই জ্যাক একটি ফাইল এবং কলম ঠেলে দিলেন।
– ওকে দ্যান, সাইন কনট্র্যাক্ট।
এক পাতার সম্পূর্ণ পৃষ্ঠা পড়ে সাইন করে দিলো রোযা।কিছু না করার থেকে পাঁচ হাজার টাকা মাসিক ইনকামও বা কম কিসের?কোনো টিউশনের কাজ সে আপাতত করতে পারবেনা।সিটি ইউফোরিয়া থেকে ঘন ঘন বাইরে বের হওয়া যেমন সন্দেহজনক তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ।তাছাড়া নিজের মাঝে কেমন একটা দৃঢ়তাও জেগে উঠেছে তার হঠাৎ করেই।নিজের কিছু করা প্রয়োজন, ভালো পথে, দাদুকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেই বলে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই।আজ যে রাজা কাল সে ফকির।
সম্পাদক জ্যাক হেনরির অফিস থেকে বের হতেই চেয়ারে বসে পা ঝুলিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লক্ষ্য করা গেলো নিহাদকে।কিছু না বলেই রোযা এগোলো।নিহাদ তাকে অনুসরণ করলো।ফাউন্টেন পেনের বিল্ডিংয়ের বাইরে বের হতেই নিহাদ প্রশ্ন ছুড়লো,

– কি একটা অবস্থা!এখন আমাকে বডিগার্ডের ডিউটিও করতে হয়!
দ্রুতই পকেট থেকে মাস্ক বের করে মুখে লাগালো নিহাদ।নিজের হুডির টুপি মাথায় তুলে চোখে সানগ্লাস দিয়ে আবারও বললো,
– কি ঠাডাপড়া গরম!এর মধ্যে এক ফুলটুশীর জন্য সেলিব্রিটি সাজে সেজে ঘুরতে হচ্ছে।
– বললাম তো।বেতন পেলে তোমাকে একটা চকোবার আইসক্রিম খাওয়াবো।
– ইশ….চাকরি হয়ে গেছে নাকি?এত দেমাগ এখনি!
রোযা পিছন ফিরে কিছুটা হাসলো।নিহাদের বাইকের উপর থেকে হেলমেট তুলে নিজের মাথায় পরে নিলো।বাইকের চেহারা পাল্টেছে,সঙ্গে মডেলও।বাইকে উঠতে উঠতে নিহাদ বললো,
– আসমান ভাইয়ের পাতানো বউয়ের এত চাকরির শখ কেনো হলো হঠাৎ?ঝগড়া হয়েছে নিশ্চিত!
থমকে গেলো রোযা।আনমনে ঢোক গিললো।বাইকের পিছনে চেপে বসে নিহাদের কাঁধে থাবা দিয়ে আদেশ করলো,

– চুপ!বড্ড বেশি কথা বলো তুমি নিহাদ।
– খাই আমি সুজি কিন্তু একটু হলেও বুঝি।তুমি আর আসমান ভাই একে অপরের সাথে গোস্বা করেছ তা তোমাদের মুখ দেখলেই বোঝা যায়।নাহলে আজকে নিজের সাথে আমাকে কেনো আনলে?
– আমার হাতের চড় খেতে না চাইলে এক্ষুণি চলো নিহাদ!
– ওটা আমি মারবেলে ফিরে এমনিতেও খাবো।পাতানো বউয়ের বডিগার্ডগিরি করার অভিযোগে বদ্দা আমাকে দেয়ালে উল্টো টাঙিয়ে না রাখলেই হয়।

বাইকে চেপে বসে ইঞ্জিন চালু করলো নিহাদ।দীর্ঘশ্বাস গোপন করে তাকে আঁকড়ে ধরলো রোযা।জানালো না, “পাতানো বউ” শব্দটা তাকে কতটা আ*ঘা*ত করছে।
সিটি ইউফোরিয়ার কাছাকাছি পৌঁছতেই একজন লোককে নজরে পড়ল সড়কের পাশে।হাত নাড়ছেন, থামার উদ্দেশ্যে।পাশেই একটি গাড়ি দাঁড় করানো।মডেল চেনার আগেই বাইক থামালো নিহাদ।
– কি ব্যাপার স্যার?গাড়ি নষ্ট?লিফট দরকার?দেখছেন না বান্ধবী নিয়ে যাচ্ছি পিছনে?মাঝখানে কাবাবের হাড্ডি হওয়ার খুব শখ তাইনা?

লোকটি হাসলো।রোযা আনমনে তার অবয়বে দৃষ্টি বোলালো।বয়স আন্দাজ করা কিছুটা কঠিন,সুঠাম শারীরিক অবয়ব।কালো শার্ট ইন করা ফরমাল প্যান্টে।তাতে স্বর্ণালী বাকলের বেল্ট।আধপাকা চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো।ঠোঁটের উপর ঘন গোঁফ।দৃষ্টি উপচানো অদ্ভুত এক মায়া।
– ওহ ইয়াং ম্যান।কি আর বলি লজ্জার কথা?ছেলেমেয়েকে সারপ্রাইজ দিতে না জানিয়েই চলে এসেছি ইতালি থেকে।একেবারে তীরে এসে তরী ডোবার মতন গাড়িটা গেলো বিগড়ে।তোমাদের দেখে মনে হলো সিটি ইউফোরিয়ায় যাচ্ছ। মারবেল ভবনের সামনে নামিয়ে দেয়া সম্ভব হবে কি ইয়াং ম্যান?
– এইযে বেহায়ার মতন কাজটা করলেন।দেখছেন বাইকের সিট বরাদ্দ এরপরও…
ঠাস করে নিহাদের কাঁধে চাপড় লাগালো রোযা।পিছনে সরে মাঝখানে জায়গা করে বলল,

– আংকেল আপনি আসুন। সিট যথেষ্ট বড়। আশা করি এটুকু রাস্তা হেলমেটের সমস্যা হবেনা।আমরাও মারবেলের বাসিন্দা।আসুন।
– থ্যাংক ইউ মামণি।
লোকটির কণ্ঠস্বরের আদুরে অনুভবে না চাইতেও হাসলো রোযা।তিনি ফোনে কাউকে গাড়ি সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনা প্রদান করে চেপে বসলেন নিহাদ আর রোযার মাঝে।
– আংকেল ঠেলবেন না আমাকে…শেষে বাইকার উল্টে পড়লে কিন্তু বাইক আপনাদের পরকালের দুনিয়ায় ছুটিয়ে নিয়ে যাবে!

– হাহাহা…খুব মজার মানুষ তো তুমি!
ইঞ্জিনের হুংকারে তার কন্ঠস্বর চাপা পরে গেলো।সিটি ইউফোরিয়ার গেট পেরোনোর সময় গার্ডের কোনোপ্রকার বাধার সম্মুখীন হতে হলোনা।উল্টো সালাম দিয়ে স্যালুট ঠুকল গার্ডের দল।তাতে রিয়ার ভিউ মিররে পিছনে চেয়ে নিহাদ প্রশ্ন ছুড়লো,
– আপনি গভীর জলের ফিশ নাকি আংকেল?মানুষজন সালাম দিয়ে আবার স্যালুটও ঠুকে!
– হুম… সিটি ইউফোরিয়ার শেয়ারহোল্ডার…
তার কথাটি নিহাদের কানে গেলোনা।পিছন থেকে শুধু রোযাই শুনলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই মারবেল ভবনের সামনে এসে থেমে গেলো বাইক।চটজলদি ভেতর থেকে নামলো একে একে সকলে।
– তোমাদের আবারো থ্যাংক ইউ ইয়াং ম্যান। বিশেষ করে তোমাকে মামণি।তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে।
রোযা কিছুটা লজ্জা পেলো।

– না আংকেল, প্রয়োজনে মানুষকে সাহায্য করাই মানুষের কর্তব্য।
তার কথায় ছেদ তুলে নিহাদ জিজ্ঞাসা করলো,
– আপনি কোন ফ্ল্যাটের মাল?
নিহাদের প্রশ্ন শেষ হতেই ঘটনাটি ঘটলো।ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরের লিফটের দরজা খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আসমানের অবয়ব।ধবধবে সাদা টি শার্ট এবং কালো ব্যাগি জিন্স পরিধানে তার। ফিঙ্গারলেস গ্লাভসের একটি হাতে ঢোকাতে ঢোকাতে এগিয়ে আসছে।চোখ তুলে সহসাই নিজের পথে থমকে গেলো সে।নিহাদ এবং রোযা…. উহু।ওদের দেখে নয়।বরং….

ডার্কসাইড পর্ব ১৬

– মাই সন্!
দরাজ কন্ঠে উচ্চারণ করে দুবাহু মেলে এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।মুহূর্তের মাঝেই আসমানকে নিজের বাহুডোরে আলিঙ্গন করে নিলেন।পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন,
– কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?
একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো নিহাদ এবং রোযা।উভয়েই দ্বিধান্বিত।পুনরায় দৃশ্যপটে ফিরতেই আসমানের কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে মোকাবেলা হলো রোযার,অনুভব করলো অদ্ভুত এক চাপ জেঁকে বসেছে তার অন্তরজুড়ে।

ডার্কসাইড পর্ব ১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here