ডার্কসাইড পর্ব ২৬
জাবিন ফোরকান
পিতা মাতা—শব্দ দুইটি কোনো সন্তানের জন্য কতটা নিগূঢ় অর্থ ধারণ করে তা উপলব্ধি করার আগেই ভাগ্যের কাছে হারিয়েছে তাদের। স্নেহভাজন হয়ে জীবনে আবির্ভূত হয়েছিল ছোট চাচা আজাদ।ভাগ্যের পরিহাস তাকেও করে দিলো বিচ্ছিন্ন।এরপর দাদুর হাত ধরে একলা পথচলা।একমাত্র সম্বল জীবনের, একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ।বাবা – মা, ভাই – বোন, আত্মীয় – স্বজন; সবকিছুই ছিলো দাদু।প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা খাওয়ানো, তৈরি করে স্কুলে পাঠানো, স্কুল থেকে ফেরত নিয়ে আসা, টিউশন টিচারের কাছে নিয়ে যাওয়া,বাসায় পড়াতে বসানো, খাওয়ানো, যত্ন নেয়া….সবকিছুই সযত্নে করেছে দাদু।
পাবলিক পরীক্ষাগুলোর সময় ঘণ্টার পর ঘন্টা কেন্দ্রের সামনে বসে থাকতো, হল থেকে বের হলেই হাসিমুখে প্রথমে পানি খাইয়ে বলতো,
“পরীক্ষা যেমন হয়েছে হোক, সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।”
সে হয়ত জীবনে পিতা মাতার থেকেও বেশি কিছু ছিলো রোযার জন্য।বন্ধু,খেলার সাথী, খুনসুঁটির সঙ্গী।দিনশেষে প্রশান্তির নীড়।ভাগ্যের লোভ সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছেছে চরম পর্যায়ে।তাইতো এমন মানুষটিকে কেড়ে নিতে একবারও কুণ্ঠাবোধ করলোনা!
নিজের গোটা পৃথিবীর আলো হারিয়ে আঁধারে তলিয়েছে রোযা।এতটাই গভীর তা যে উত্তরণ অসম্ভব।ক্রমশই গভীর হতে আরো গভীরে তাকে শুষে নিচ্ছে ভাগ্যচক্রের উল্টো আবর্তন।হারাতে হারাতে আজ নিঃস্ব সে।ধরিত্রীর বুকে অবহেলিত এক ধূলিকণা।যার অস্তিত্ব থাকা না থাকায় এই মহান বিশ্বজগতের কিছু আসে যায়না।
রাতে ঘুমাতে পারেনি রোযা।যতটুকু ঘুমিয়েছে অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন দেখেছে।খাবারের রুচি শূন্যেরও নিচে ঠেকেছে।এই ধরায় যেন সে জীবন্মৃত।নিজেকে বারংবার প্রশ্ন ছুঁড়েছে।কি অবশিষ্ট আছে তার?কোনো পিছুটান রয়েছে কি? কার জন্য বাঁচবে সে?কিসের জন্য বাঁচবে? কোন উদ্দেশ্যে ভাসাবে এই জীবনতরী?বরাবরই উত্তর করতে ব্যর্থ হয়েছে তার অন্তর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতা,এবং সেই অস্থিরতা থেকেই ভয়াল এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ।সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারে শুধুমাত্র তার মৃ*ত্যু। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক কখন নিজের শরীর তাকে টেনে তুলেছিল জানালা বরাবর তা টেরটুকু পায়নি তার পরিশ্রান্ত মস্তিষ্ক।
বর্তমানে যেন সেই মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে কর্মক্ষম হতে আরম্ভ করেছে।তাইতো এমন অনুভূতি। রোযাকে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রেখেছে আসমান।এই দানবটির পক্ষে কাউকে এভাবে আগলে নেয়া সম্ভব তা আজকের পূর্বে রোযা কোনোদিন কল্পনা করতেও সক্ষম হয়নি। চিত্রলেখার কাহিনী শোনা এবং বাস্তবে নিজে অনুভব করার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে।আদতেই কি আসমান এমন কোনো কাজ করেছে নাকি রোযা কল্পনা করছে?
কল্পনা করছেনা তা প্রমাণিত হলো কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই।ওই অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ালো আসমান,তার বাহুডোরে আলিঙ্গনরত রোযা।বসলো বিছানায়।ততক্ষণে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলীন করেছে মেয়েটি।আসমানের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজেছে।ডুকরে কেঁদে উঠলো, আর্তনাদধ্বনি মিইয়ে এলো প্রশস্ত বুকের বাঁধায়।আসমান হস্তক্ষেপ করলোনা, কোনো কথাও বললোনা।শুধু তার একটি হাত রোযার পিঠে আলতোভাবে স্পষ্ট করলো, উপরে নিচে প্রবাহিত হয়ে যেন প্রশান্তি বিলাতে চাইছে।রোযা কাদলো, নিজেকে উজাড় করে দিলো।তার হৃদয়ের চাপা সকল অনুভূতির আজ উদগীরণ ঘটেছে।
– আমি এখন কি করবো?আমি যে সম্পূর্ণ এতিম হয়ে পড়লাম!কিভাবে বাঁচবো? কার জন্য বাঁচবো?
নীরব আসমান,তার মাঝে বিশেষ পরিবর্তন নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে চলা কথাগুলো শুনে যাচ্ছে সে।ওই একটি কাজেই পারদর্শী,শুনে যাওয়া। রোযাকে সে কোনপ্রকার বাঁধা দিলোনা,নিজের মতন প্রকাশ ঘটাতে দিলো আবেগ।বিলাপের মতন ছন্নছাড়া অনেককিছু বলে যাচ্ছে রোযা,তাতে কর্ণপাত করে নৈঃশব্দ্যবরনের মাধ্যমে যেন নিজ নিয়মে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রচেষ্টা।তার আলিঙ্গনে যেন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে উন্মত্ত এক সত্তা।ছেলেটার অস্তিত্ব যত শীতল, তার বাহুডোর তার চাইতে বহুগুণ উষ্ণ; মনে মনে ভাবলো রোযা।অদ্ভুত হলেও সত্য ভালো লাগছে তার।অশান্ত হৃদয়ে শীতলতার প্রলেপ দিচ্ছে আসমানের এমন নীরব উপস্থিতি।
ঠিক কতক্ষন এভাবে কেটেছে জানা নেই।রোযা যখন নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলো তখন নিজেকে আসমানের এতটা কাছে আবিষ্কার করে কিছুটা হতচকিতই হলো।আবেগের বশে সে এক দানবকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে উজাড় করে তো দিয়েছে,কিন্তু সেই অধিকার তার আদও জন্মেছে কি?মানুষটার সঙ্গে সে এক চুক্তির সম্পর্কে আবদ্ধ,যে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র পবিত্রতা নেই।উপলব্ধি করেই রোযা নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলো।আসমানের আলিঙ্গন ছেড়ে সরে বসে জোরপূর্বক নিজের চোখমুখ মুছে নিলো।
– আম..আমি সরি…আমার মাথা ঠিক ছিল না তাই…
– খাবার নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
অপ্রাসঙ্গিক কথাটি রোযাকে বিস্মিত করলোনা।এই বান্দাকে মোটামুটি ভালোই চিনতে পেরেছে সে গত কয়েকমাসে। ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে মেঝেতে পরে থাকা ভাঙা ট্রে,বাটি এবং খাবার দেখতে পেলো সে।একটি ঢোক গিলে বিড়বিড় করলো,
– সরি।
নিঃশব্দ আসমান।তার দৃষ্টি জানালার দিকে যা এখনো খোলা রয়েছে।যেন রোযা নিজে থেকে না গেলেও কোনো অশরীরী শক্তি তাকে টেনে নেবে বাহিরপানে, তাই সতর্ক নজর রাখছে।
– আমার ক্ষুধা নেই, খাবো না।তুমি যাও।
এবারেও নীরবতা। একটি নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কপাল ঘষে রোযা পুনরায় বলল,
– তোমাকে ধন্যবাদ।চিন্তা করোনা,আমি আর ওইরকম কাজ করতে যাবোনা।তুমি এখন যেতে পারো।
বিছানা ছেড়ে উঠলো আসমান।বোধ হয় চলে যাবে।রোযার এমন ভাবনার ঠিক বিপরীত কাজটা করলো সে।বিছানার কাছে এসে ঝুকলো,কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটানে রোযাকে তুললো, বসিয়ে দিলো নিজের এক হাতের বাহু বরাবর, অপর হাত ভারসাম্য রক্ষায় জড়িয়ে গেলো পিঠে।হতবিহ্বল রোযা না চাইতেও আঁকড়ে ধরলো আসমানের কাধ,তার আঙুলসমূহ চেপে বসলো পোশাকে।
– আসমান? ক…কি করছো তুমি?
কোনো জবাব নেই।ওই অবস্থাতেই রোযাকে কোলে নিয়ে আসমান রুম পরিত্যাগ করলো।করিডোর ধরে হেঁটে এলো হলরুমে।প্রথম কয়েক সেকেন্ড ছটফট করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে রোযা।জানে, লাভ নেই।আসমানের মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে সে অজানা এক অনুভূতি অনুভব করছে।তার শূন্যতাপূর্ণ হৃদযন্ত্র ধুকধুক ছন্দে স্পন্দিত হয়ে চলেছে।
সোজা কিচেনে ঢুকলো আসমান। ইন্ডাকশনের পাশে কাউন্টারের উপর বসালো রোযাকে। বিব্রতবোধ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি।সে যতটা লজ্জিত,আসমান ঠিক ততটাই নির্বিকার।ফ্রিজ খুললো দানবটি,তার মৃদু অথচ প্রভাবশালী কন্ঠস্বর রোযাকে শুধালো,
– প্রিয় খাবার?
– হ…হ্যাঁ?
– কানে ফোড়া হয়েছে?
– অ্যাহেম! নুডুলস….
এক নজর পিছনে তাকালো,যেন প্রিয় খাবার নুডুলস বলে ব্যাপারটাকে বিচার করছে।রোযা নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।সত্যি কথাই বলেছে,ভুল কিছু নয়।আসমান একটি নিঃশ্বাস ফেললো,স্পষ্ট কর্নোগোচর হলো তা।ফ্রিজ থেকে কিছু সবজি বের করে কেবিনেট থেকে নুডুলসের প্যাকেট বের করলো।পাত্রে তা সিদ্ধ হতে হতে ক্যাপসিকাম,গ্রিন অনিয়ন,এবং কিছু শ্রিম্প ধুয়ে সুন্দরমত কেটে নিলো।রোযা কাউন্টারে বসে অতি মনোযোগী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে গেলো তার প্রতিটা কাজ।
প্যানে সামান্য তেল দিয়ে তাতে একে একে পেঁয়াজ, মরিচ, গোটা একটা ডিম, মশলা এবং সবজি দিয়ে সেদ্ধ হয়ে আসা নুডুলস ঢাললো আসমান।কিছুক্ষণ কষিয়ে তাতে যোগ করলো সয়া সস এবং টমেটো সস।ফ্রিজ থেকে বের করলো এক প্যাকেট চীজ।তার কর্মযজ্ঞে রোযা না পারতে বলে উঠলো,
– আমি তো এতদিন জানতাম গরম পানিতে ম্যাগী নুডুলস আর মশলা ঢেলে নিলেই তাকে নুডুলস বলে!
চীজের প্যাকেট ছিড়ছিল আসমান।রোযার বাক্য কানে যেতেই মাঝপথে থমকে গেলো।মাস্কের অন্তরালে তার কপোল সামান্য উঁচু হয়ে উঠল।যদিও দেখতে পায়নি কিন্তু রোযা হলফ করে বলতে পারবে এইমাত্র আসমান হেসেছে! তা হোক খুব সামান্য হাসি।
নিজের রান্না সমাপ্ত করে বাটিতে বেড়ে তাতে কিছু গ্রিন অনিয়ন ছড়িয়ে চপস্টিক রাখলো আসমান।এগিয়ে দিলো রোযার দিকে। খাওয়ার কোনো রুচি এতদিন না থাকলেও বর্তমানে সুঘ্রাণে তার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।তাতে অস্বাভাবিক ধরণের শব্দ হলো।লজ্জায় মুহূর্তেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো রোযার চেহারা, পেট চেপে ধরলো সে।নিশ্চিত আসমান শুনতে পেয়েছে!কি লজ্জাজনক ব্যাপার!এখনি এমনটা হতে হলো?
আসমান অবশ্য এমন ব্যবহার করলো যে সে কিছুই শুনতে পায়নি।
– খাও।
এটুকুই উচ্চারণ করলো সে।কিছুটা বিব্রত এবং কিছুটা স্বস্তি অনুভব করে খাবার গ্রহণ করলো রোযা।ছেলেটি তাকে কিছু বলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেনি ব্যাপারটা তার কাছে ভালো লাগলো,একটু বেশীই ভালো। খাবারে মনোযোগ দিলো সে,মুখে পুরতেই অসাধারণ স্বাদে তার জিহ্বা থেকে পাকস্থলী পর্যন্তও যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।
– উম…চমৎকার।
আসমান এক বোতল জুস বের করেছে।একটা গ্লাস ভর্তি করে রোযার দিকে এগিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করলো,
– তেলমশলা একটু কমিয়ে দিয়েছি,সম্পূর্ণ খালি পেটে অধিক মশলাদার খাবার রুচবেনা।শরীর খারাপ হতে পারে।
– হ্যাঁ?এগুলো কি তাহলে?
– ঐগুলো সবজি, মাছ এবং চীজ,কিছুটা সস… স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে বাটির দিকে তাকিয়ে থাকলো রোযা।সত্যি বলতে আসমান তার জন্য রান্না করেছে, এবং করার সময় এতকিছু ভেবেছে ব্যাপারটা তার মাঝে এক অজানা শিহরণ খেলিয়ে দিলো।
– তুম…তুমি খাবেনা?
কথোপকথন ঘোরাতে জিজ্ঞেস করে বসলো রোযা।কাউন্টারে হেলান দিয়ে আসমান নিজের মাস্কটা টেনে খানিক উপরে তুলে জানালো,
– খেয়েছি।
– ওহ।
কিভাবে কি বলা উচিত ঠিক করতে না পেরে রোযা সম্পূর্ণ খাবারেই ঝুকলো।কাউন্টারে পা দোলাতে দোলাতে সে আস্তে আস্তে নুডুলস সাবার করছে, এমন অবয়বের দিকে নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে আছে আসমান।মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো দুশ্চিন্তা নেই।অথচ কিছুক্ষণ আগেই কিভাবে কাদছিলো! নিজেকে স্বাভাবিক প্রদর্শন করছে সে।কিন্তু আসমান খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছে যে অন্তরে কত বিশাল ঘূর্ণিঝড় লুকিয়ে রেখেছে রোযা।
হঠাৎ করেই তীব্র রক মিউজিকের শব্দে বেজে উঠল রোযার ফোন।নিজেই তাতে হতচকিত হয়ে বাটি ফেলে দিচ্ছিল,আসমান কাছাকাছি থাকায় রক্ষা হলো। ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি দেখিয়ে আসমান বাটি কাউন্টারে রাখতে রাখতে রোযা পায়জামার পকেট থেকে নিজের পুরোনো ফোনটা বের করলো।অনলাইন থেকে কেনা জামাগুলোর পায়জামায় এমন পকেট রয়েছে, যা রোযার বেশ পছন্দ হয়েছিল।আনমনে কখন ফোনটা ঢুকিয়েছে মনে নেই।ফেটে আসা স্ক্রিনে দৃষ্টি সরু করে তাকিয়ে একটি অচেনা নাম্বার আবিষ্কার করলো।রিসিভ করলো,
– আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?
এক মুহুর্ত নীরবতা।তারপর উত্তর এলো,
– তোর বাবার রেখে যাওয়া ডায়েরীটা আর তোর মায়ের রুপোর পায়েলটা এসে নিয়ে যাস।কালকের মধ্যে না এলে নর্দমায় ফেলে দেবো।
এটুকুই।লাইন কেটে গেলো।শূন্যতা নিজে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো রোযা।এই জিনিসগুলো চাচার হেফাজতে ছিল,মরহুম ভাই এবং মরহুমা ভাবির স্মৃতিস্বরুপ।বেরিয়ে আসার সময় আনা হয়নি, পরে কয়েকবার চাইলেও দেয়নি।নিজের বাবা মায়ের স্মৃতি বলতে রোযার কাছে কিছুই নেই। সবই হারিয়েছে ভয়ংকর অ*গ্নিকাণ্ডে।জিনিস দুইটির প্রতি তার আকর্ষণ তাই বহুদিনের, মৃ*ত্যুর আগে একবার হলেও ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছে।সুযোগটা এভাবে আসবে ভাবেনি।
ফোন নামিয়ে রাখতেই আসমানকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লক্ষ্য করে রোযা বুঝলো বান্দা মোটামুটি সবই শুনেছে।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাটি হাতে তুলতে তুলতে জানালো,
– আগামীকাল একবার মিস্টার আজাদের বাসায় যাবো।নিহাদ কি ঘুমিয়ে পড়েছে?যদি না থাকে তাহলে ওকে ডেকে…
– আমি যাবো।
নুডুলস মুখে দিয়ে থমকে গেলো রোযা।অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে রইলো আসমানের দিকে। নিটল অনুভূতিহীন সে।পুনরায় জানালো,উহু,আদেশ করলো।
– আমি তোমার সাথে যাবো।
জবাব দিতে সক্ষম হলোনা রোযা,শক্তভাবে গিলে নিলো খাবারটুকু। খাবার শেষ হতে হতে পেন্টহাউজের দরজা খোলার শব্দে ঘুরে তাকালো।দেখলো সিল্কের ঘুমের পোশাক পরিহিত অবস্থায় একটি বালিশ বগলদাবা করে ভেতরে ঢুকেছে চারুলতা।কিচেনের সামনে এসে একনজর তাকিয়ে থাকলো সে।তারপর ভেতরে উঁকি দিলো।আসমান রোযার হাত থেকে বাটি নিয়ে সিংকে রাখতে রাখতে বললো,
– উত্তর পাশের রুম।তুই জানালার সাইডে থাকবি।দরজা যেন খোলা থাকে।বাইরের অ্যালার্ট সিস্টেমটা অন করে দিস।
– ওকে বস।
দুই আঙ্গুলে স্যালুট ঠুকে রোযার দিকে এগোলো চারুলতা।বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো রোযা।কয়েক মুহূর্ত সে বুঝে উঠতে পারলোনা যে কি হচ্ছে আর কেন হচ্ছে।তাকে হাত ধরে কাউন্টার থেকে নামালো চারু, প্রশ্ন এড়িয়ে ছোট্ট বাক্যে জানালো,
– আমরা কয়েকদিন একসাথে ঘুমাবো,মজা হবে।
না চাইতেও রোযা ঘুরে তাকালো আসমানের দিকে, ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে নেই। স্ক্রাবে ডিশওয়াশ নিয়ে ধুয়ে নিচ্ছে বাটি এবং চপষ্টিক।
মসৃণ পিচঢালা
সড়ক বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আসমানের পোর্শে।আবহাওয়া আজ ঝলমলে।সন্ধ্যার আস্তরণে আচ্ছাদিত হয়েছে ধরিত্রী।শহর যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে সমগ্র দিনের পরিশ্রান্ত অভিযান শেষে।কিন্তু মতিঝিলের এই অঞ্চলে ব্যাস্ততার তেমন দর্শন নেই।উচ্চবিত্ত এলাকা।নীরবতা,প্রশান্তি জরুরী।
ড্রাইভিং সিটের ঠিক পাশেই বসে আছে রোযা।সোনালী বর্ণের সালোয়ার কামিজ তার পরনে।গত কয়েকদিনের তুলনায় চেহারা মোটামুটি পরিষ্কার। ধোঁয়াশে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাইরের দিকে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কপালে।হালকা একটু মাথা কাত করে আসমান তাকালো তার দিকে, পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।
মৃদু ধ্বনি তুলে একটি একটি একতলা ভবনের সামনে থামলো আসমানের গাড়ী।এটাই আজাদের বাড়ি।আগে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকতো।আভিজাত্যের প্রদর্শনে বর্তমানে বাড়ি কিনেছে।এই অঞ্চলে এমন ইউরোপীয় ধাঁচে তৈরি বাড়ি রয়েছে কয়েকটি।
নিজের সিটবেল্ট খুলে রোযা নামতে গেলেই হঠাৎ আসমান নিজের হাত বাড়ালো তার দিকে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রোযা।
– তোমার ফোন।
কিছুটা অবাক হয়েই নিজের ফোনটা আসমানের হাতে দিলো।কয়েক সেকেন্ডের মাঝে তাতে কিছু করে ফিরিয়ে দিলো আসমান।হতবাক হয়ে রোযা খেয়াল করলো তাতে স্টপওয়াচ সেট করা আছে ঊনত্রিশ সেকেন্ডের।
– স্টপওয়াচ থামার সাথে সাথে যে জায়গায় থাকবে ওই জায়গায় মাথা নিচু করে বসে পড়বে।
এর বেশি কিছুই বললোনা আসমান।রোযা অনুভব করলো তার হৃদযন্ত্র দ্রুতগতিতে স্পন্দিত হতে আরম্ভ করে।জানে প্রশ্ন করলেও এই মুহূর্তে উত্তর লাভ সম্ভব নয়।যা বলেছে তা করাই শ্রেয়।সতর্কভাবে দরজা খুলে বাইরে পা রাখলো সে। ফোন হাতে চেপে ধরে এগিয়ে গেল।সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে আটকালো আশেপাশে তাকিয়ে সন্দেহের উদ্রেক না ঘটাতে। দরজার দিকে এগোচ্ছে,এক পা,দুই পা…. নিজের উপর গাড়িতে বসা আসমানের ধারালো দৃষ্টির ভার অনুভব করতে পারছে।
আটাশ…ঊনত্রিশ…!
দরজা থেকে বরাবর এক হাত দূরত্বে রয়েছে রোযা। স্টপওয়াচ থামার সাথে সাথেই নিজের হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসে পড়লো।কয়েক সেকেন্ড জোর করে চোখ বুজে রাখলো।
থপ থপ থপ থপ!
চারটি ম্রিয়মাণ শব্দ তার কানে এলো।শিউরে উঠে দৃষ্টি মেলতেই নিজের জায়গায় জমে গেলো।তার দুপাশে মাটিতে এলিয়ে আছে তিন তিনটি মৃ*তদে*হ।র*ক্তে ভিজে উঠছে ভূমি।এক ঝটকায় পিছনে চাইলো, গাড়ির দরজার পিছনে সিট থেকে এক পা বের করে উঁকি দিয়ে রয়েছে আসমান।তার গ্লাভস আচ্ছাদিত ডান হাতে লম্বা নলের মতন সাইলেন্সারযুক্ত রিভ*লভার।তখনো হালকা ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছে নল থেকে।গাড়ির ঠিক পিছনেই ঝোঁপের আড়াল হতে দুটো হাত বেরিয়ে আছে, র*ক্তাক্ত!কিছুই ঠাওর করতে না পেরে রোযা একঝাঁক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো, আসমানের নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বর দৃষ্টিমাঝে।
গতকাল—
বারের এক কোণায় বসে আপনমনে অ্যালকোহলে বুদ হয়েছে আজাদ।এই বদভ্যাসটি তার আগে ছিলোনা।মধ্যবিত্ত থেকে তথাকথিত সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উচ্চবিত্তের পর্যায়ে পৌঁছানোর পর জগতের সকল রকম নিষিদ্ধ আনন্দ স্ফূর্তির দরজা তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তারই ফলস্বরূপ কাজের বিরতিতে বারের আশেপাশে চক্কর দেয়া।স্ত্রী তাতে অভিমান করে না, বরং নিজেই রাতের খাবারের পর ওয়াইনে মত্ত হওয়ার পরামর্শ দেয় কিছুদিন বাদে বাদেই।
আপন চিন্তায় আচ্ছন্ন মস্তিষ্কে গ্লাসের দিকে চেয়ে থাকা আজাদের মনোযোগ ভাঙলো নিজের কাঁধে অতর্কিত স্পর্শ অনুভব করে।ঝট করে ঘুরে তাকিয়েই নিজের পাশে আসন গ্রহণ করা চকচকে সুট পরিহিত ব্যক্তিকে নজরে পড়ল।ঘোলাটে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার পরিচয় অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পায়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো আজাদ।
– মিস্টার…আকাশ?
– আপনি এত উত্তেজিত হবেন না, বসুন মিস্টার আজাদ রহমান।
আকাশের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরে একটি ঢোক গিলে আজাদ নিজের চেয়ারে বসলো।একদম নির্বিকারভাবে বসে আছে মানুষটি,কে বি গ্রুপের কর্তার ডান হাত। আজাদের মতন ব্যবসায়ীদের জন্য তারা একপ্রকার সোনার হরিণের মতো।যাদের নাম শুধুমাত্র শোনা যায়,কখনো পাওয়া সম্ভবপর হয়না।কে বি গ্রুপের পর্যায়ে পৌঁছনো হয়ত এদেশের প্রত্যেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরই স্বপ্ন।
বারটেন্ডার একটি হুইস্কির গ্লাস এগিয়ে দিতেই চেয়ারে শরীর এলিয়ে তাতে আনমনে চুমুক দিলো আকাশ।অন্যদিকে নেশা উধাও হয়েছে আজাদের।কে বি গ্রুপের কারো অতর্কিত উপস্থিতি যে মোটেও সুখকর বিষয় হবেনা তা তার বিচক্ষণ ব্যবসায়িক মস্তিষ্ক ঠিকই আন্দাজ করতে সক্ষম।বিশেষ করে আকাশ প্রবেশের সাথে সাথে আশেপাশের টেবিলগুলোতে অবস্থান নেয় কালো পোশাকধারীদের সুবিধার ঠেকছেনা।কি চায় এরা?অবশ্যই প্রশ্ন করার দুঃসাহস প্রদর্শন করলোনা।আকাশ বেশ দীর্ঘ সময় নিয়ে নিজের হুইস্কিতে দীর্ঘ কয়েক চুমুক দিল।অতঃপর আজাদের দিকে তাকাতেই অজান্তেই শিউরে উঠলো মধ্যবয়স্ক পুরুষটি।
– শুনলাম আপনার বাবা গত হয়েছেন।মাই কণ্ডলেন্স।
একটি ঢোক গিলে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছে নিলো আজাদ।ইউনূস রহমানের মৃ*ত্যুর খবর এরা কিভাবে জানলো?কে বি গ্রুপের নিকট কোনোকিছুই কি অজ্ঞাত নয়?মৃদু হাসলো আকাশ।হাত বাড়িয়ে আজাদের কাধ স্পর্শ করলো।
– আপনার এক ভাতিজি রয়েছে রাইট?রোযা রহমান চড়ুই?
– চড়ুই..!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে তাকে জোরপূর্বক ঠেলে আকাশ বসিয়ে দিলো।
– কি আশ্চর্য্য!আপনি এত উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কেনো বারবার?
– আম..আমি আসলে…
– ইউ নো ইউ উইল ডা*ই বায় লায়িং,ডোন্ট ইউ?
আকাশের ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে আজাদের সমস্ত শরীরজুড়ে ভীতির তরঙ্গ খেলে গেলো।মাথাটা চক্কর দিচ্ছে,হৃদযন্ত্র দ্রুতগতিতে স্পন্দিত হয়ে চলেছে।
– আমি আর একবার জিজ্ঞেস করব।রোযা রহমান চড়ুই আপনার ভাতিজি,রাইট?
– হ… হ্যাঁ!
– ফোন নাম্বার আছে নিশ্চয়ই?
– ইয়ে মানে, বাবার মৃ*ত্যুর খবর দিতে যে নাম্বার থেকে কল দিয়েছে সেটি আছে।
– গ্রেট।কল দিন, সে ধরলে বলবেন আপনার বাড়িতে আসতে।
কম্পিত শরীরে আকাশের দিকে তাকালো আজাদ, মাথা নেড়ে জানালো,
– আসবেনা। আমাদের সম্পর্ক ভালো না।তাছাড়া ও এখন বিবাহিত।
“ বিবাহিত ” শব্দটি শুনে আকাশের ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু হলো।এর অধিক কোনো অনুভূতি প্রদর্শিত হলোনা।হুইস্কি নিঃশেষ করে একটি নোট টেবিলে রেখে সে উঠে দাঁড়ালো। আজাদ ভয়ে ভয়ে চেয়ে আছে।নিজের সুট টেনেটুনে ঠিকঠাক করে আকাশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মোকাবেলা করলো তাকে।
– আপনার ভাতিজি।আপনি তাকে কিভাবে, কোন উদ্দেশ্যে বাড়িতে নিয়ে আসবেন আপনার ব্যাপার।যত দ্রুত সম্ভব কাজ হয়ে যাওয়া চাই।আদারওয়াইজ….
বাক্যটি সম্পূর্ণ করলোনা আকাশ।একটি কার্ড আজাদের উদ্দেশ্যে রেখে উল্টো ঘুরল।ধরলো বাহিরের পথ।সে চলে যেতেই কালো পোশাকধারী ব্যক্তিবৃন্দ উঠে একে একে একই পথ অনুসরণ করলো।স্তব্ধ হয়ে রইলো আজাদ।একদৃষ্টে চেয়ে রইলো কার্ডটার দিকে।
নিজের গাড়ি থেকে ধীরপায়ে নামলো আসমান।রোযা মাটিতে বসে মাথার উভয় পাশে হাত চেপে রেখেছে।একঝাঁক অবিশ্বাস এবং বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।বিশ্লেষণের লক্ষণ প্রদর্শন করলোনা আসমান।গতকাল রাতে রোযার চাচার ফোনকল তার সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়েছিল।এতগুলো বছর ধরে যা ফেরত দেয়ার কোনো চিন্তাভাবনা হয়নি,হঠাৎ করে তা ফেরত দেবে?কেনো?ইউনূস রহমানকে সমাহিত করার দিন গোরস্থানে যে ব্যবহার আজাদ রহমানের মাঝে লক্ষ্য করেছিল,তাতে তার মতন অহংকারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী কেউ বস্তুগুলোকে তখনি নর্দমায় ফেলে দেয়ার কথা,ফেরত তো বহু দূরের ব্যাপার!তাহলে?ক্ষুরধার শীতল মস্তিষ্ক একটার পর একটা ছক মিলিয়ে সম্পূর্ণ ধাঁধার ব্যাখ্যা উপস্থাপনে সক্ষম হয়।
যেকোনো কারণে রোযাকে দরকার আজাদের।তার বাবা মায়ের স্মৃতিচিহ্ন ফেরত দেয়া একটি বাহানামাত্র।ফাঁদে ফেলতে চাইছে সে মেয়েটিকে।তাছাড়া আজাদ রহমানের শ্বশুরের সম্পর্কে যে তথ্য হাতে রয়েছে তাতে সেই কোম্পানি কে বি গ্রুপের অধীনস্থ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তিতে আবদ্ধ।এই জ্ঞানটুকু রোযার নেই,না থাকারই কথা।তাই হয়ত সে সম্পুর্ণ চিত্রটি ধরতে পারেনি শুরুতে।কিন্তু আসমান?কিছুই বুঝতে তার বাকি ছিলনা।
দ্রুতপায়ে রোযার দিকে এগিয়ে একটি হাত বাড়িয়ে ধরলো আসমান।তার প্রশস্ত তালুর দিকে চেয়ে রইল রোযা।কিছুটা বিষন্ন এবং উগ্র দৃষ্টি তার নয়নে।আসমান ভাবলো কিছু বোধ হয় বলবে,কিংবা প্রশ্ন করবে।কিন্তু তেমন কিছুই রোযা করলোনা।তার হাতটি ধরলো,উঠে দাঁড়ালো সোজা হয়ে।হাত ছেড়ে তৎক্ষণাৎ আসমান আশেপাশে চাইলো। পোর্শে নিয়ে ঢোকার সময়েই তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি ঝোপের আড়ালে এবং বাড়ির চারিপাশে ছায়ার ন্যায় অবস্থানরত ঘা*তকদের অস্তিত্ব টের পেয়েছিল। গাড়ির জানালার কাঁচ নমিত রাখার দরুণ ভেতরের দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ তারা লাভ করেনি।
যদি অনুধাবন করতো যে গাড়ির ভেতরে স্বয়ং আসমান ছিল,তবে কি আ*ক্রমণের দুঃসাহস করতো?
উত্তরটা হলো, না।কোনোদিন করতোনা।কিংবদন্তি গল্পের পৃষ্ঠা হতে হারালেও তার কল্পকাহিনী রয়ে গিয়েছে মানুষের অন্তরজুড়ে।কে বি গ্রুপের জন্ম দেয়া পিশাচ সে, তাকে টেক্কা দেয়ার সাধ্যি কার?
– একটা ফাঁদ ছিলো তাইনা?
রোযার মৃদু কন্ঠে আসমান ফিরে চাইলো, কোনোপ্রকার উত্তর করলোনা।একটি নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কপালে হাত বুলিয়ে মেয়েটি বিড়বিড় করলো,
– বাড়ির জানালা দিয়ে আমাদেরকে দেখছে মিস্টার আজাদের স্ত্রী।
সহসাই উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আসমান।বাড়ির একপাশের জানালায় ঝাপসা অবয়বে দৃষ্টিপাত হলো, তিরতির করে কাপছে মেয়েলী অবয়বটি।রোযা খানিক শুষ্ক কন্ঠে বললো,
– আব্বু আম্মুর জিনিসগুলো সত্যিই রয়েছে কিনা জানিনা, যদি থাকে তাহলে না নিয়ে ফেরত যেতে চাইনা।
আসমান এক মুহুর্ত স্থির থাকলো।তারপর এগিয়ে গেলো দরজার দিকে, কড়াঘাতের প্রচেষ্টা এড়িয়ে সোজা লক লক্ষ্য করে গু*লি ছুঁড়লো।ধাতব কর্কশ আওয়াজ তুলে দরজা খুলে গেলো মুহূর্তেই। পায়ে পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অভ্যন্তরের দৃশ্যপট নজরে এলো।ড্রয়িং রুমের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে হাতজোড় করে বসে আছে তার চাচা এবং চাচী।উভয়েই কেঁদেকেটে একসা।
– আমাদের কিছু করিস না চড়ুই…দোহাই লাগে তোর!
মাথা নুইয়ে রীতিমত তার পায়ে হামলে পড়তে চাইলো আজাদ,কিন্তু সহসাই নিজেকে দূরে সরিয়ে ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রোযা।দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে আসমান বিড়বিড় করলো,
– দুই মিনিট পনেরো সেকেন্ড সময় আছে আমাদের কাছে।
– আমাদের মে*রো না প্লীজ,আমরা কিছু করিনি।ওটা… ওটা তো কে বি গ্রুপ….
অশ্রুতে চাচীর জর্জেট শাড়ী সিক্ত হয়ে জড়িয়ে গিয়েছে।থরথর করে কাপছে সে।তবুও বিন্দুমাত্র মায়া হলোনা রোযার।এই দুইটি মানুষের প্রতি সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সম্মান হারিয়েছে সে।তার দাদুকে যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের…
– ওয়ান্ট মি টু কি*ল দ্যাম?
আসমানের প্রশ্নে দৃষ্টি তুলে তাকালো রোযা, আজাদ এবং তার স্ত্রী হতচকিত হয়ে চেয়ে আছে, প্রাণভিক্ষা চাইতে চাইতে কন্ঠ শুকিয়ে এসেছে তাদের।মাথা নেড়ে আজাদের দিকে ফিরে রোযা আদেশ করলো,
– আমার বাবার ডায়েরী,আর মায়ের নূপুর?
– আ…আছে,স্টোররুমে!
আজাদ কিছু বলার আগেই চাচী একলাফে উঠে দৌঁড়ে গেলো ভেতরে।আসমান হাতঘড়ির দিকে তাকালো,নীরবে সময়ের হিসাব মিলিয়ে চলেছে।তার অবয়ব লক্ষ্য করে আজাদ ঢোক গিলে অশ্রাব্য কন্ঠে শুধালো,
– আপনি আসলে কে?
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আসমান।অতঃপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আজাদের দিকে, নিজের অজান্তেই মেঝেতে ভর দিয়ে নিজের শরীর দূরে টেনে নিলো আজাদ।উবু হয়ে তার আতঙ্কিত দৃষ্টির মুখোমুখি হলো আসমানের কৃষ্ণগহ্বরের সম্মোহনী আবেশ।দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে লোকটি।মোকাবেলা করতে সক্ষম নয় এই সুতীব্র অশরীরী ভীতির।
– প্রলয়।
বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত শব্দে এমন এক কঠোরতা ছিল যা আজাদের হৃদযন্ত্র জমিয়ে দিলো মুহূর্তকয়েকের জন্য।রীতিমত জ্ঞানশূণ্য হয়ে দৃষ্টি বুজে নিলো।যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে নিজের মৃ*ত্যুর।ঠিক তখনি আবির্ভূত হলো চাচী।হাতে একটি ধুলো জমা প্যাকেট।সেটি বাড়িয়ে ধরতেই তা রীতিমত ছিনিয়ে নিয়ে খুলে দেখলো রোযা।
– প্লীজ আমাদের ছেড়ে দাও…কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন…
– নর্দমার কীট ঘেঁটে নিজের হাত নষ্ট করতে আমি ইচ্ছুক নই।
উল্টো ঘুরল রোযা,মাথা কাত করে দৃষ্টি বিনিময় করলো আসমানের সঙ্গে।অজ্ঞান হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা আজাদকে নিস্তার দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আসমান।চাচীর দিকে চোখ পড়তেই সে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে হড়বড় করে বলল,
– আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না!
– বলবেন।
অশ্রুসিক্ত নয়নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল চাচী।আসমান রোযাকে অনুসরণের উদ্দেশ্যে ফিরে ঘোষণা করলো,
– কে বি গ্রুপ জানতে চাইলে বলবেন তাদের নাকের ডগা দিয়ে এসে জিনিস হাতিয়ে আবার সশরীরে ফিরে গিয়েছি।বেকার নিজেদের মানুষের প্রাণ খরচা করলো।পরেরবার ফাঁদ পাতলে যেন আরেকটু ভেবেচিন্তে পাতে।
দরজার ঠিক সামনে এক সেকেন্ড থামলো।তার প্রভাবশালী কন্ঠ ধ্বনিত হলো চারিপাশে।উচ্চারিত শেষ বাক্যটি অজানা কারণেই কাপন ধরিয়ে দিলো হৃদয়জুড়ে।
– হাঙ্গরের জালে মেশিন ধরা পড়েনা।
পোর্শেতে আসমানের পাশের সিটে বসে নিজের হাতের ডায়েরী এবং নূপুরটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রোযা।তার দৃষ্টিতে অশ্রু জমতে চাইছে, বাঁধা দিয়ে রেখেছে সেই অনুভূতিতে।এইগুলো অক্ষত রাখার কারণ?যদিও অযত্নে ছিল,তবুও ফেলে দেয়নি।এর অর্থ কি আজাদ রহমানের মনের কোণে একটু হলেও অপরাধবোধের জন্ম নিয়েছিল?তাই নিজের ভাই ভাবির স্মৃতিগুলো বেহাত করেনি?
পুনরায় গাড়ি থেমে যাওয়াতে রোযা চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আশেপাশে তাকালো।এখনো সামান্য দূরত্বও পার করেনি তারা।এই স্থানে থামার মানে?
– গাড়িতে বসো।বের হবেনা,আমি আসছি।
– কো…কোথায় যাচ্ছ?
– উপহার পাঠাতে।
এটুকুই।গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো আসমান।রাত্রির আধারেও স্ট্রিট লাইটের মৃদু আভায় রোযা স্পষ্ট দেখলো অদূরে মিলিয়ে যাওয়া তার অবয়ব, উভয় হাতে চকচকে ধারালো তামার দড়ি পাকাতে পাকাতে এগিয়ে যাচ্ছে।আবার কার কপালে আজ আজরাইল ভর করলো?
হতভম্ব হয়ে রোযা আবিষ্কার করলো এই ব্যাপারগুলোতে তার আর একটুও খারাপ লাগা কাজ করছেনা।যেন কালো জগতের সঙ্গে সম্পূর্ণ অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে তার হৃদয় এবং মস্তিষ্ক।নিজের অজান্তেই তাই গাড়ির দরজা খুললো।নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো,আসমানের পথ অনুসরণ করে। গলির দেয়ালের আড়াল হতে অপরপাশে নজর বিছালো।
একটি কালো জ্বীপগাড়ি।এগিয়ে যাচ্ছে আসমান।পিনপতন নীরবতা,শুধুমাত্র বহুদূরে নীড়ে ফেরা কাকের দলের অশুভ কুহুতান। জ্বীপের দরজা খুললো সহসাই,কেউ নামতে গেলো বাইরে।কিন্তু তার আগেই ক্ষীপ্র গতিতে আসমান হামলে পড়লো, ঢুকে গেলো গাড়ীর ভেতরে।
হতচকিত মাহিন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল মাস্ক পরিহিত দানবটির দিকে।এতক্ষণ ধরে নিজেদের হিটটিমের কোনোপ্রকার খবর না পাওয়ায় সে সবেমাত্র দেখতে যাচ্ছিল যে কি হচ্ছে,কিন্তু এমন কিছু সে নিজের কোনো দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
– আ…আসমান!
– ইউ উইল বি আ নাইস গিফট্।
বিড়বিড় করে হাতের দড়িটি মুহূর্তের মাঝে মাহিনের গলায় পেঁ*চিয়ে সজোরে টান দিলো আসমান।বিদঘুটে গোঙানিতে পূর্ণ হলো বায়ু। ছটফটের জোরে কাপতে থাকলো সম্পূর্ণ গাড়ি।ক্রমশ চেপে বসলো আসমানের বাঁধন।জিভ বেরিয়ে পড়েছে মাহিনের, চোখ উল্টে গেছে কোটরে।মিনিটখানেকের ধস্তাধস্তি।পরক্ষণেই যেন মৃ*ত্যুর নিকট পরাজয়।বেরিয়েই রইলো জিভ, আধবোজা হয়ে এলো নয়ন পল্লব, মুখের কোন বেয়ে নামতে থাকলো ফেনার মতন কষ।
দড়িটা না সরিয়ে গলায় বাঁধলো আসমান, সুন্দর করে আবার দুটো পাপড়িও তৈরি করলো,একদম যথাযথ উপহারের সাজসজ্জার মতন।তারপর নিজের জুতোর ভেতর থেকে বের করলো একটি ব্লে*ড। মাহিনের শার্ট খুলে বুকে ছোঁয়ালো ধারালো স্পর্শ।শূন্য দৃষ্টি মনোযোগে আচ্ছন্ন,রচনা করবে মহাকাব্য।
অপরদিকে বাইরে গলির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রোযা জ্বীপের ভেতর কি হচ্ছে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা।চেয়ে আছে বিহ্বল দৃষ্টিতে।ঠিক তখনি কারো পদশব্দ শুনলো।ঠিক তার পিছন থেকে এগিয়ে আসছে, সিগারেট টানতে টানতে।হয়ত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিল কিংবা সিগারেট সংগ্রহে?আর যাই হোক, আসমানের নিশ্চয়ই এর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা নেই।যদি কোনো ঝামেলা হয়? দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেয়ালের এপাশে এসে পড়ল রোযা, পুরোনো দেয়ালে খসে আসা আধভাঙা ইটের টুকরো তুলে নিলো।লোকটি গলির বাক ঘুরতেই,
– এক্সকিউজ মি?
রোযার দিকে তাকালো সে, দৃষ্টিজুড়ে বিস্ময়।ঠিক তখনি সজোরে তার মাথা এবং পরেরবার ঘাড় বরাবর আ*ক্রমণ চালালো রোযা, কোনো ফাঁক রাখতে রাজী নয়।প্রথমবারে সফল না হলেও দ্বিতীয়বার ধরাশায়ী হয়ে অচেতন দে*হটি সড়কের পাশে লুটিয়ে পড়ল।ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস জারি রেখে সেইদিকে তাকিয়ে রইলো রোযা,তার হাতের ইটের টুকরো র*ক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে।তৎক্ষণাৎ সেটা ছুঁড়ে ফেলে নিজের বুক চেপে ধরলো।
জ্বীপ থেকে বেরিয়ে আসা আসমান হাত পনেরো দূরের দৃশ্যপট লক্ষ্য করে এগোলো।তার পদশব্দ শুনে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে ঘুরে চাইলো রোযা।আসমানের কপালে কয়েক ফোঁটা ঘাম এবং র*ক্তস্নাত গ্লাভস ব্যাতিত আর কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।কাছে পৌঁছে একবার রোযা এবং অতঃপর নিথর শরীরের দিকে তাকালো আসমান।
– হুম…এই এক্সট্রার কথা জানতাম না।
রোযা ভেবেছিল গাড়ি থেকে বেরিয়ে আদেশ অমান্য করায় তাকে একচোট শুনতে হবে।কিন্তু দানবটির নিগূঢ় দৃষ্টি তার নয়নে মিললো,অদ্ভুত জ্বলজ্বলে আবেশে পরিপূর্ণ তা।
– গুড জব।
প্রশংসা করলো?আসমান?রোযার?নির্ঘাত ভুল শুনেছে রোযা,তাইনা?
মারবেল ভবন।
আসমান কার্ড পাঞ্চ করে পেন্টহাউজের দরজা খুলতেই বাজনার ঝাঁপটায় রীতিমত চমকে উঠলো রোযা।তরঙ্গের ঝংকারে তার হৃদযন্ত্র পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে।যেন আসমানের নিঃশব্দপুরীতে নয় বরং কোনো বিয়েবাড়িতে ঢুকে পড়েছে।কি অদ্ভুত! কার এত আনন্দ লেগেছে জীবনে?বুঝে উঠতে দ্রুত ভেতরে ঢুকলো।
হলরুমে একটি ডিস্কো লাইট জ্বলছে,লাল নীল বাতি মুহুর্মুহু জ্বলে নিভে মেতেছে রঙ্গখেলায়।প্রচণ্ড জোরে বাজছে মিউজিক।এবং তার তালে তালে কোমর দুলিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নৃত্যশৈলী জারি রেখেছে….
– নিহাদ?
হতচকিত হয়ে সামনে চেয়ে থাকলো রোযা,অপরদিকে ভ্রু কুঁচকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো আসমান।মানুষের যেমন প্যানিক অ্যাটাক হয়, এই ছেলের তেমনি ড্যান্স অ্যাটাক হয় কদাচিৎ।বিশেষ আকর্ষণীয় নয় তার ব্যাঙের ন্যায় লম্ফঝম্ফ।কিচেনের প্রান্তে দাঁড়ানো চারুলতা একটা গাজরে কামড় দিয়ে বিনাশিনী ভঙ্গিতে চেয়ে আছে সেই উচ্ছল নৃত্যের দিকে, হাত পা ছুঁড়ে জম্বির মতন লাফিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই ছেলেটা।যেকোনো মুহূর্তে কারো গায়ে গাজরটা দিয়ে নিউক্লিয়ার বি*স্ফো*রণ ঘটাতে দ্বিধা করবেনা চারু।
আসমান থোরাই কেয়ার ভঙ্গিতে একবার ডান হাত আরেকবার বাম হাত তুলে নাচছে,নাচ বলা যায়না তাকে, বললে নৃত্যশিল্পীর অপমান করা হবে।হতবাক হয়ে রোযা খেয়াল করলো হলরুমের কাউচে বসে আছে ছোট্ট একটি শরীর,রুহি!নিহাদ তারই মনোরঞ্জন করার চেষ্টায় লিপ্ত।
~ হে বুকের মাঝে আগুন জ্বলে
নেভে না রে জল ছেটালে
কবে দিমু গলায় মালা রে
কবে আইবে আমার পালা রে
কবে দিমু গলায় মালারে ~
চিৎকার করে করে গানের সাথে মিলিয়ে গাইছে নিহাদ, তাতে ত্যাক্ত বিরক্ত চারুলতা খেঁকিয়ে উঠলো,
– তেলাপোকা কোথাকার!
গাজর ছুঁড়ে দিতেই সজোরে তা আ*ঘাত হা*নলো নিহাদের চাদি বরাবর।মেঝেতে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করলো বান্দা।তাতে খিলখিল করে তিনটি দাঁত দেখিয়ে হাসতে থাকলো রুহি।ভীষণ বিনোদিত হচ্ছে সে,হাততালি দিয়ে চলেছে তালে তালে।
– দেখেছিস, নারী নাচলে মানুষ সোনাদানা ছিটায়।আর পুরুষ নাচলে গাজর মা*রে!বৈষম্যের স্বীকার আসলে কারা?
যদিও বোঝা সম্ভব নয় কিন্তু নিহাদের কথায় দ্বিতীয় দফায় হাসলো রুহি।পুনরায় জীবিত হলো নিহাদ,লাফিয়ে উঠে পিছনে রোযাকে খেয়াল করলো।কোনপ্রকার সতর্কতা ছাড়াই এক হাতে টেনে নিলো তাকে, দুহাত মুঠোয় পুরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে চক্কর কাটতে লাগলো।রোযা ভড়কে গেলো সম্পূর্ণ।
– শিরায় শিরায় র*ক্ত, নিহাদ দেবের ভক্ত!
– নিহাদ!
– ইয়াহু….
– একটা ছাগল তুমি!
– উহুম,পরীর দুই নম্বর বাচ্চা।
– থাপ্পড় দেবো কিন্তু!
– দাও,মেয়েমানুষের থাপ্পড়ে ভিটামিন আছে।
– হা হা হা….
মাথা ঘুরছে রোযার,তবুও হাসির উদগীরণ ঘটলো তার মাঝে।বহুদিন পর,নিজের দাদু চলে যাওয়ার পর এই প্রথম তাকে প্রাণখুলে হাসতে লক্ষ্য করে অপলক চেয়ে রইলো চারুলতা। আরো একটি মানুষও, স্থানত্যাগের পাঁয়তারা এড়িয়ে আসমান এগোলো। স্পিকার বন্ধ করে দিলো সহসাই।তাতে হঠাৎই নীরবতা ধারণ করলো সমগ্র জায়গাজুড়ে।নিহাদ রোযাকে ছেড়ে কটমট করে তাকালো,
– এসে গেছে আমার আনন্দ বালিচাপা দিতে!
আসমান এক নজর তাকালো,বিড়বিড় করলো,
– লাউড মিউজিক ছোট বাচ্চাদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।
– কি করবো? কাদছিল তো।
ভ্রুক্ষেপ না করে কাউচ থেকে রুহিকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো আসমান।সেইদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রোযা চারুলতার দিকে ফিরলো।নিহাদের ঘুরানটি খেয়ে ঘেমেছে ভীষণ,ওড়নার খুঁটে মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,
– রুহি এখানে?
– ওর বাবা মা একটা ইমারজেন্সিতে বাইরে গিয়েছে কয়েক ঘণ্টার জন্য।আমাদের দিয়েছে একটু সামলানোর জন্য।
– ওহ।
– এমন বাঁদরনাচ দেখানো হবে আগে জানলে অবশ্য নিজেদের বাচ্চাকে রেখে যেতো কিনা সন্দেহ।
সঙ্গে সঙ্গে চেতে উঠলো নিহাদ।কোমরে হাত গুঁজে বললো,
– এই পেত্নী! তুমি যে ওই লম্বা লম্বা চুল এলিয়ে সন্ধ্যারাতে বেলকনিতে হাড্ডিসার পা ঝুলিয়ে বসে থাকো;আমি কি কোনদিন বলেছি তোমাকে তেতুল গাছের শাকচুন্নি লাগে?
– কি বললে তুমি?আমি শাকচুন্নি?
– না তো কি?নিজেকে মিস ইউনিভার্স মনে করো?দেখলে তো মনে হয় বায়োলজী ল্যাবের বক্সে বন্দী মানবদেহের কং*কালতন্ত্র!
– আর তুমি কি? গরীবের বডিগার্ড সালমান খান?
– ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট… আই অনলি সার্ভ গুরু দেব!
মাথায় হাত ঠেকালো রোযা,নির্গত হলো দীর্ঘশ্বাস।তার সামনে ভারত পাকিস্তানের বর্ডারের মৌখিক লড়াই অব্যাহত রইলো।আপনমনে হাসলো সে,তার মনটা কিছুটা হলেও হালকা অনুভূত হচ্ছে।
আধ ঘণ্টা পর।
নিজের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো রোযা।রুহিকে নিয়ে আসমান নিজের কক্ষে গিয়েছে,প্রয়োজন নেই তবুও অনুসরণ করলো সেই পথ।কেনো,কে জানে?আজকের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে কি?ওই জ্বীপগাড়িতে কি করেছে সে?জবাব দেবে কি?ভালো কিছু নিশ্চয়ই করেনি,কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে?কথা বলা প্রয়োজন।
ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই নিজেকে আসমানের রুমে আবিষ্কার করলো রোযা।দরজা খোলাই।ভেতরে বিছানার উপর রুহি, তার সামনে উপুড় হয়ে আছে আসমান। বাইরের পোশাক বদলেছে,টি শার্ট আর ট্রাউজার পরিধানে।তবে মাস্ক সরায়নি।রুহির হাতে সেই কালো টেডি বিয়ারটি।যেটা শুধুমাত্র স্পর্শ করার কারণেই রোযার উপর ক্ষেপে গিয়েছিল আসমান।কিন্তু রুহিকে খেলতে দিয়েছে?বাচ্চাদের প্রতি এতটাই দুর্বল কি তার হৃদয়?
রোযার উপস্থিতি অনুভব করলেও আসমান বর্তমানে নিজের সবটুকু মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রেখেছে রুহির উপর।ছোট্ট শরীরে জড়ানো গোলাপরাঙা ফ্রক, মাথার চুলগুলো দুইপাশে দুই তালগাছের মতন ঝুঁটি বাধা। ঠোঁটজুড়ে হাসি, ফোলা গালে সহজাত লালিমা।টেডি বিয়ার জড়িয়ে ধরে নাড়ছে আর উৎসুক নয়নে আসমানকে দেখছে।আসমান আঙুল নাড়লেই খেলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হাসির ঝংকার তুলছে।এ যেন অমৃতসুধা।
বিছানায় একপাশে বসলো রোযা নীরবে।আসমান রুহিকে কোলে তুলে নিয়েছে,এদিক সেদিক দুলিয়ে দোলনার প্রক্রিয়ায় রুহির হাসি বিস্তৃত হয়েছে।আসমানের চুল আঁকড়ে ধরে টানছে,ব্যথা পাওয়ার অভিনয় করছে তার ভুক্তভোগী।দৃশ্যটি অদ্ভুত নয়, বরং ভীষন মনোমুগ্ধকর ঠেকছে।নিজের হৃদয়ে আবেগের উদগীরণ অনুভব করছে রোযা।প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে অবলোকন করে যাচ্ছে,মস্তিষ্কে মুদ্রিত করে নিচ্ছে ভালো লাগার আবেশ ছড়ানো দৃষ্টিতে।
বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে টেডি বিয়ার নিয়ে রুহিকে খেলতে দেখতে দেখতে হঠাৎ রোযা আনমনে প্রশ্ন ছুড়লো,
– এটা তুমি ওকে দিয়েছ।
নিঃশব্দতা।রোযা দৃষ্টি তুলে আসমানের অবয়বে তাকালো,
– বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এই পুতুলের তাইনা?
ঝুকলো আসমান, রুহি উল্টে গিয়েছে, সোজা হতে পারছেনা।তাকে সোজা হতে সাহায্য করে ছুটে যাওয়া টেডিটি হাতে ধরিয়ে আপনমনে তার কন্ঠ প্রকাশ করলো,
– আমার মেয়ে।
ডার্কসাইড পর্ব ২৫
সম্পূর্ণ বরফ হয়ে গেলো।নিজের শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে না পেরে বি*স্ফা*রিত নয়নে চেয়ে থাকল রোযা।আসমান তাকালো,নিজের জ্বলজ্বলে নিগূঢ় কালো দৃষ্টি মেলালো রোযার সনে।তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো,
– পুতুলটা আমার মেয়ের।
কখন হাতের আঙুলগুলো বিছানার চাদরে আঁকড়ে বসলো রোযা টেরটুকুও পেলো না।
