ডার্কসাইড পর্ব ৪২
জাবিন ফোরকান
হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ির পিছনে পৌঁছলো আসমান।অতি সন্তপর্নে মাথা সামান্য তুলে সড়কের দুধার পরীক্ষা করতেই বিপরীত প্রান্তের গলির মতন জায়গাজুড়ে একটি অডি এ সিক্স মডেলের গাড়ি অবস্থান করতে দেখল।তবে গাড়িটি নয়,বরং এর দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মানুষটি তাকে বিস্মিত করলো।চরম বিস্মিত! পরিধানে একটি ধবধবে শুভ্র ফ্রক,যার দৈর্ঘ্য হাঁটু পর্যন্ত,নিচে লেদার বুট।একটি বেল্ট ঝুলছে কোমরে বেপরোয়াভাবে।দীঘল কেশরাশির মাঝে ধূসর বর্ণের আবহ।তবে সামান্যতম পরিবর্তন আসেনি লাস্যময়ী চেহারায়।পূর্বের ন্যায়ই ঢেউ খেলানো বিস্তৃত অধরজুড়ে টকটকে রীতিমত অপ্রয়োজনীয় লিপস্টিক। দৃষ্টির মাঝে মাদকীয়তা।দুহাতে একটি পি*স্ত*লে পুনরায় ম্যাগাজিন ভরতে ব্যাস্ত।
রাফা কায়সার!
কুঞ্চিত হলো আসমানের মুখাবয়ব।ওই নাম এবং নামের অধিকারিণী উভয় তার নিকট বিষধর স*র্প ব্যতিত ভিন্ন কিছু নয়।তড়িৎ গতিতে উঠলো আসমান, মস্তিষ্ক হিসাব করে নিয়েছে ইতোমধ্যে।ম্যাগাজিন ভরতে ভরতে সে চার লাফে রাফার নিকট পৌঁছাতে পাঁচ সেকেন্ড সময় নিলে প্রস্তুত হওয়ার আগে ধরাশায়ী সম্ভব।দ্বিধাদ্বন্দ্বের সময় নেই এইখানে।সুইস নাই*ফটি দক্ষতার সাথে দুই আঙ্গুলে ঠেকিয়ে অত্যন্ত দ্রুত রীতিমত চোখের পলকে সড়ক টপকে অডির সামনে পৌঁছে তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাফার একটি হাত টেনে ধরলো আসমান। ভড়কে যাওয়া দৃষ্টি তুলে তাকাতেই রাফা সম্পূর্ণ স্থির হয়ে পড়ল।বিন্দুমাত্র পরিশ্রম করতে হলোনা তার হাত থেকে অ*স্ত্রটি কেড়ে নিতে।তবুও সাবধানতা বজায় রেখে দরজার সঙ্গে তাকে চেপে ধরে কন্ঠে ছু*রির ধা*রালো প্রান্ত ঠেকালো আসমান, হুমকিস্বরূপ।এক মুহূর্তের জন্য রাফার দৃষ্টিতে বিহ্বলতা খেলে গেলো,পরমুহুর্তেই সেই অনুভব ছাপিয়ে প্রকাশ পেলো আকর্ষণ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– হাউ রোম্যান্টিক!
ঘোর লাগানো কন্ঠে কেমন ছন্নছাড়াভাবে রাফার উচ্চারণ সামান্য প্রকম্পন তুললো আসমানের অস্তিত্বে।এই রমণীর অস্তিত্ব তার চিত্তে বিন্দু পরিমাণ হলেও চির সৃষ্টিতে সক্ষম।সামান্য ঝুঁকলো সে নিকটে।
– গলায় ছু*রি ধরে রেখেছি পুষ্পমাল্য নয়।
তাতে যেন দ্বিগুণ মাত্রায় বেসামাল হয়ে রাফা আসমানের হাতখানা চেপে ধরলো, টানলো অতি সন্নিকটে।
– আই ফাইন্ড ইট ভেরি রোম্যান্টিক,ডোন্ট ইউ?
একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস নির্গত হলো আসমানের বক্ষ হতে,সামান্য মাথা কাত করে ভিন্নদিকে চেয়ে শুধালো,
– ধূসর বইয়ের দুনিয়া এবং বাস্তবতার মাঝে ফারাক আকাশ পাতালের ম্যাম!
বিস্তৃত হাসিতে উদ্ভাসিত হলো রাফার টকটকে অধর, তার অবয়ব হতে কিঞ্চিৎ উৎকট বাস ভেসে আসছে।মস্তিষ্ক তার অচলপ্রায়,নেশার ঘোরে সামান্য নিয়ন্ত্রণহীন।তবুও আপন বৈশিষ্ট্যে সদা প্রজ্জ্বলিত রাফা ঝট করে হাত বাড়িয়ে আসমানের চিবুক চেপে ধরলো।তার মুখ এদিক সেদিক ঘুরিয়ে প্রাণভরে অবলোকন করলো সৌন্দর্য্য কিংবা কলঙ্ক।অসন্তুষ্ট মনোভাবে তার মুখ কুঁচকে এলো সামান্য,
– হুম…. মেইবি আই ডিড নট পানিশ ইউ এনাফ!চাঁদবদনখানি এখনো যথেষ্ট আকর্ষণীয়।তাইতো আবারো বিয়ে করেছ!
মুষ্টিবদ্ধ হলো আসমানের হাত।নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও রাফার হাত ক্রমশ চেপে বসলো,এতটা জোরের সঙ্গে যে হিং*স্র পশুর ন্যায় ধা*রালো নখের আঁচড় পড়লো কপোলে।তবুও নির্বিকার দৃষ্টিপাত আসমানের। তাতে ধপ করে জ্ব*লে উঠলো রাফার মস্তিষ্ক।
– ওই মেয়ের দুঃসাহস কি করে হয় তোমাকে বিয়ে করার?তুমি শুধুমাত্র আমার সম্পত্তি!আর কারো না, আন্ডারস্ট্যান্ড?
– আমি একজন জলজ্যান্ত মানুষ,কারো বাবার সম্পত্তি নই।
– মানুষ? নাকি মেশিন?
প্রশ্নটি আসমানকে থমকাতে বাধ্য করলো।তাতে রাফা তার কাঁধে হাত চেপে রীতিমত জড়িয়ে ধরলো তাকে,
– আই মিসড ইউ ভেরি মাচ মাই ডগি!
অশ্রুপাত হলো নয়নে,আসমানকে নিজের বুকের গভীরে যেন মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছুক রাফা,এমনভাবে আঁকড়ে ধরলো তার বলিষ্ঠ অবয়বখানি।
– আমি নিশ্চিত ওই মেয়ে তোমাকে তোমার টাকা পয়সার লোভে বিয়ে করেছে!নাহলে কার সাধ্য এই দানবকে বরণের?শুধুমাত্র আমি রাফা কায়সার তা করার অধিকার রাখে!বুঝেছ?এই বিয়ের খবর শুনে নিজেকে শান্ত রাখতে পারিনি বিশ্বাস করো। পি*স্ত*লটা নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়েছি,আজ ওই বিচ্ টার একদিন নয়তো আমার একদিন….
রাফার বক্তব্য আসমানের কর্ণপাত হলোনা।তার দৃষ্টির সম্মুখে ভাসছে বর্তমানে একটি আঁধার কক্ষ, যার মাঝে কুটিল হাসি সম্বলিত এক রমণী তার লালসা বাসনা মেটাতে অকথ্য অ*ত্যাচার চালিয়ে চলেছে শরীরের উপর।কাটাকুটির খেলায় শুভ্রতার দেহ র*ক্তধারায় রেঙেছে,তবুও রমণীর লোভাতুর কামনা পূরণে তা যেন যথেষ্ট নয়।ভালোবাসার নামে হিং*স্রতা চাই তার,মানব মস্তিষ্কের চরম অবক্ষয়, ধূসরতার চাদরে আচ্ছাদিত হৃদয়।যেখানে যত অধিক ভালোবাসা তত অধিক যন্ত্রণা। স্বাভাবিকভাবে নেয়া যায় কি তা?
আসমানের মতন পাথর হৃদয়ের অধিকারী অস্তিত্বেরও চিত্তে কাপন ধরলো।অতীতের সকল স্মৃতির উদগীরণ তার বক্ষমাঝে উন্মাতাল ঘূর্ণিপাক ঘটালো।থরথর করে কাঁপতে থাকলো সর্বাঙ্গ এই রমণীর আলিঙ্গনের মাঝে, নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো, দৃষ্টিতে ভর করলো ধোঁয়াশা।শ্রবণ ক্ষমতা সম্পূর্ণ হ্রাস পেয়েছে যেন।অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে তার অন্তর।সামান্যতম শক্তিও অনুভূত হচ্ছেনা যে এই রমণীকে ঠেলে দূরে সরাবে। ট্রমা —শব্দটির যথার্থতা বুঝি আজ অনুধাবন হচ্ছে ব্যাপকভাবে।হাত থেকে ছু*রিখানারও পতন ঘটলো ঝনঝন ধ্বনিতে।
সহসাই ঘটলো ঘটনাটি।ঠিক যেন আঁধারের গর্ভে প্রজ্জ্বলিত শিখার সম্ভাষণ।রাত্রির অন্ধকার দূরীভূত করে যেমন দিবাকর আপন আভায় সিক্ত করে ধরিত্রীকে ঠিক যেন তেমন করেই এক ভরসার স্পর্শ ঠেকলো আসমানের পিঠে।তার নিগূঢ় প্রভাবে সে অমানিশাকে মুক্ত করলো অশুভ ছায়ার শৃংখল হতে, টেনে নিলো আপন প্রশান্তির আলিঙ্গনে।
ধূসরতার মূর্ত প্রতীক রাফা কায়সার মুখোমুখি হলো চাঁদের রক্ষক রোযা রহমান চড়ুইয়ের।
নমনীয় গঠনের মাঝেও অদ্ভুত এক কঠোরতা, আসমানের সর্বাঙ্গে চেপে বসা তার দূর্বল বাহুজোড়াও যেন অমিত শক্তির আঁধার।সুরক্ষা দেয়ালের মাঝে সে মুড়িয়ে নিয়েছে হৃদয়রাজকে।কোনো অভাগ্যের স্পর্শ সে ঠেকতে দেবেনা আপন অন্তরের মাঝে, অপবিত্রতায় সিক্ত হতে দেবেনা তার শুভ্রতাকে। রোযাকে জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা গুঁজলো আসমান, খানিক শিশুসুলভ ভঙ্গিতে।অর্ধাঙ্গিনী তার পিঠে বুলিয়ে আনলো ভরসার ছোঁয়া, কপোলে মৃদু চুম্বন এঁকে জানালো,
– আতঙ্কিত হয়োনা চাঁদ,তোমার তরে আমি লড়ব।
আসমানের কি হয়েছে সে নিজেও বলতে পারবেনা।কিন্তু রোযার আলিঙ্গন তার নিকট অত্যন্ত প্রশান্তিময় অনুভূত হচ্ছে।রাফা কায়সার আর এই রমণীর মাঝে তুলনা করাও বোধ হয় পাপ হবে তার জন্য।তাই সেদিকটায় গেলোই না তার হৃদয়,শুধু বিলিয়ে দিলো নিজেকে প্রশান্তির মাঝে।যেন পিপাসার্ত মরুযাত্রী লাভ করেছে হিমশীতল সুপেয় জল।
দৃশ্যটি অন্তর্জ্বালা তৈরী করলো রাফার মাঝে। ক্ষীপ্র হাত এগোলো সে আসমানকে লক্ষ্য করে, ছাড়িয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে,কিন্তু রোযার বাহু তাকে দমন করলো কঠোরভাবে।চেপে ধরলো হাতটি,সামান্য জোরে মুচড়ে দিলো খানিক।
– আউচ!
লাফিয়ে উঠে হাত চেপে পিছনে সরে গেলো রাফা, বি*স্ফারিত নয়ন মেলে চেয়ে থাকলো আসমানের অর্ধাঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে।এই মেয়ের কোমলতার অন্তরালে লোকায়িত দানবিক সত্তাটি যেন উঁকি দিয়েছে সামান্য,এখনো সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়নি।কিন্তু একবার যদি উন্মুক্ত হয়,তাকে ঠেকানো অসম্ভব!
– দিনে দুপুরে সড়কপথে দাঁড়িয়ে নাট্যমঞ্চ উপস্থাপন মোটেও মানানসই নয়।তার উপর গু*লিব*র্ষণ?ধরে নিতে বাধ্য হচ্ছি,আপনি একজন বদ্ধ উন্মাদ!
তেতে উঠল রাফা।তাতে বিন্দুমাত্র পরোয়া ঘটলোনা রোযার মাঝে।আসমানকে নিজের পিছনে ঠেলে দিয়ে সামনে এগোলো সে,মুখোমুখি হলো অশুভ রমণীর।খেঁকিয়ে রাফা বললো,
– তোমার দুঃসাহস কি করে হয়ে মেয়ে আমাকে স্পর্শ করার?দুই টাকার দেমাগ ভাঙতে আমার দুই সেকেন্ডও লাগবেনা।
– কেনো?মঙ্গল গ্রহের ডাকিনী সর্দারনী আপনি?অভিশাপ দিয়ে নেপচুনে নির্বাসিত করবেন আমায়?
এমন গু*রুতর পরিস্থিতির মাঝেও রোযার নিষ্পাপ প্রশ্ন রাফাকে ঠিক যতটা বিস্মিত করলো, আসমানকে ততটাই বিনোদিত করলো।তার শারীরিক কম্পন সামান্য কমলো, অধরে ফুটলো বিলুপ্তপ্রায় হাসির রেখা।
– আমার সাথে মজা করো?
– আপনি আমার নাগর লাগেন যে ভরদুপুরে আপনার সাথে ফষ্টিনষ্টি করবো?
– সোজা কথা বলতে পারোনা?প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে দাও কেনো?
– একেবারে উত্তর না করে আপনার মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাচ্ছিনা তাই।
– তুমি জানো একজন কায়সারের সঙ্গে কথা বলছো তুমি?
“ কায়সার ”— সম্বোধনটি রোযার সর্বাঙ্গে যেন তড়িৎ খেলিয়ে দিলো।এতক্ষণ সে সম্পূর্ণভাবে এই রমণীর পরিচয় অনুধাবন করেনি,এবার করেছে।নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো।কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোযার হাত উত্তোলিত হলো, ক্ষীপ্র গতিতে এগোলো রাফার উদ্দেশ্যে। প্রতিক্রিয়াস্বরুপ বুজে এলো রাফার দৃষ্টি।তবুও কিছু অনুভব না করে উত্তেজিত হৃদযন্ত্রের বাঁধা পেরিয়ে মিটমিট করে তাকালো সে।একদম তার গালের সন্নিকটে থমকেছে রোযার হাত,কাপছে তেজে। চ*ড়টি না লাগিয়ে শেষমেষ মুঠো পাকিয়ে হাত গুটিয়ে নিলো রোযা।বিড়বিড় করলো,
– সুযোগমতো আমি আপনাকে ধ্বংস করবো, কথা দিচ্ছি!
হতবিহ্বল চেয়ে থাকলো রাফা,উত্তেজিত মস্তিষ্ক এবং মাদকীয় অস্তিত্ব তার সঠিকভাবে ভাবতে অক্ষম বর্তমানে। রোযার গ্রীবার উদ্দেশ্যে এগোলো তার হাত, বেরিয়ে এলো ধা*রালো নখর। নয়নের মাঝে ভর করলো শীতল হিং*স্রতা।তবে পাশ*বিকতা প্রদর্শনের সুযোগ ঘটলোনা। মুহূর্তটিতে ব্যাঘাত ঘটালো অপর একটি গাড়ির হর্ন।ঘুরে চাইতেই গাড়ির দরজা খুলে রীতিমত ছুটে আসতে লক্ষ্য করা গেলো এক রাশিয়ান পুরুষকে।
– বেইবি…. তিভ পারিয়াতকেয়া?[ তুমি ঠিক আছো?]
সুযোগমতন রোযাকে টেনে নিজের কাছে সরিয়ে আনলো আসমান। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো পরিস্থিতি। রাফার নিকট এসে তাকে আগলে নিলো পুরুষটি,
– স্তোস্তা তবয় স্লুচিলস ভুদ্রুক?[ হঠাৎ কি হলো তোমার?
– দিমিত্রী…..প্লীজ….
– জ্ঞায়েশ, কাক ভলনুয়েশশা? [ কত দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো জানো?]
রাফাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই পুরুষের উপস্থিতিতে বিরক্ত হয়েছে অধিক।তবুও সে তাকে জোরপূর্বক আলিঙ্গন করলো,তারপর নৃ*শংস দৃষ্টিপাত ঘটালো আসমান এবং রোযার উদ্দেশ্যে।রাশিয়ান বক্তব্য পাল্টে ইংরেজিতে জানালো,
– আমার স্ত্রীর যদি সামান্যতম ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে আমি…..
এক পদক্ষেপ এগোলো আসমান,তার বুটজোড়ার দৃপ্ত অবস্থানে শব্দপাত ঘটলো চারিপাশে। দিমিত্রীর কন্ঠস্বর মাঝপথেই থমকাতে বাধ্য হলো।তাকে ঘিরে ফেললো পরাশক্তিধর আবাহন,নেতৃত্বে দন্ডায়মান অমিত অশুভরাজ।যার নিগূঢ় শোষণীয় কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হতে বাধ্য যে কেউ।
ইংরেজিতে ধ্বনিত হলো বজ্রকন্ঠ,যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়,
– এই মুহূর্তে এই ললনাকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যান।এবারের মতন মাফ করলাম।কিন্তু মনে রাখবেন মিস্টার দিমিত্রী ভলকভ!যদি দ্বিতীয়বার আমার অর্ধাঙ্গিনীর উপর আ*ঘা*ত আসে,আমি ভুলে যাবো যে রাফা কায়সার একজন নারী এবং পুরুষের নারীদের উপর অমূলক দৃষ্টিপাত করার অধিকারটুকু পর্যন্ত নেই!আন্ডারস্ট্যান্ড?গেট…. লস্ট…. নাউ!
স্পষ্টত কম্পিত হলো দিমিত্রী।তবে পাল্টা কোনোপ্রকার শব্দ উচ্চারণ করলোনা।শুধু একনজর রোযার উদ্দেশ্যে চেয়ে খানিকটা জবরদস্তি করেই রাফাকে তুললো গাড়িতে।উল্টো ঘুরে গাড়ি চলে যাওয়ার পূর্বে প্যাসেঞ্জার সিট থেকে মুখ বাড়ালো রাফা,হাতে তার একটি কালো সানগ্লাস উঠে এসেছে।সরাসরি তাকালো সে রোযার উদ্দেশ্যে,
– ডোন্ট ফরগেট দ্যা নেইম রাফা কায়সার!
ভ্রু কুঁচকে তাকালো রোযা। গ্লাসটি দিয়ে নয়ন ঢেকে সে দৃষ্টি ফেরালো আসমানের পানে,
– উই উইল ডেফিনিটলি মিট অ্যাগেইন…. মাই ফেইভরিট টয়!
কোনো ভ্রুক্ষেপ করলোনা আসমান,তাকালো পর্যন্ত না।ঘুরে দাঁড়ালো।গাড়িটি ধীরে ধীরে চলে যেতে আরম্ভ করলো অদূরে,অনুসরণে দিমিত্রীর গাড়িটি।ভেতরে কয়েকজন লোক রয়েছে অতিরিক্ত।হয়ত নিরাপত্তার জন্য। সকলে দৃষ্টির অন্তরালে যেতেই রোযা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।চাইলো আসমানের দিকে,
– তুমি ঠিক আছো?
কোনো জবাব এলোনা।অমানিশার অবয়বজুড়ে হিমশীতলতা।অদূরে অজানার উদ্দেশ্যে চেয়ে আছে সে।রোযা স্পষ্টত খেয়াল করলো প্যান্টের পকেটে ভরে রাখা হাত দুটো তার অতি ক্ষীণভাবে কাপছে তখনো।কিসের অনুভূতিতে?আতঙ্ক,ক্রোধ,ঘৃণা, নাকি এর চাইতেও সুগভীর কিছু?নিজের নতুন কেনা ফোনখানা তুলে রোযা বিড়বিড় করলো,
– চারুলতাকে ডাকছি,ও এসে আমাদের নিয়ে যাবে।তোমার ড্রাইভ করার দরকার নেই।
কোনোপ্রকার উত্তর করলোনা আসমান। তখনো তার নির্বিকার চাহুনি দিগন্তজুড়ে।
২০- ই জানুয়ারি।
নগরে জেঁকে বসেছে ঋতুসেনাপতি শীত।তীব্র শৈত্যপ্রবাহে কাপছে সমগ্র দেশ। ইট পাথরের নগরজুড়ে শীতল ছোঁয়া।অস্বস্তিকর উষ্ণতায় অভ্যস্থ নগরবাসী অতর্কিত শীতে জবুথবু যেন।তবুও থেমে নেই জনজীবন।বরং নব উদ্যমে চলমান তা।বছরের প্রারম্ভেই আপন জগৎ গুছিয়ে নেয়ার ব্যর্থ কিংবা কতিপয় সফল প্রচেষ্টা।
আগারগাঁওয়ের সড়কপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে নিহাদের বাইক।আজ বাইকস্যুট পরিধান করেনি।কিছু কাজের প্রয়োজনে অতি দ্রুত পোশাক বদলানোর প্রচেষ্টায় হুডির উপর ডেনিম জ্যাকেট চড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।তবুও শান্তি ঝামেলা মিটেছে।নিজের একটি ছোটখাটো বাইক রাইডিং কোম্পানি এবং ট্রেনিং সেন্টার খুলেছে সে।নানান ব্যস্ততায় ইদানিং সময় যে কোথায় কেটে যায় টেরটুকুও পায়না। সিগন্যাল পড়তেই থামলো সে,আনমনে হাতঘড়িতে সময় দেখলো বিনা প্রয়োজনেই।আজকে বিশেষ কোনো কাজ নেই তার,ভাবলো এই সময় ব্যবহার করে একবার মেঘতীরে যাবে কিনা।কিন্তু আসমান ব্যবসার দিকে এবং রোযা পড়াশোনায় মনোযোগী।থাকার মধ্যে চারুলতা হয়ত আছে,কিন্তু তারও ফ্রিল্যানসিং প্রজেক্টে ব্যাস্ত সময় পার করার কথা।একমাত্র অকর্মার ঢেঁকি কি তাহলে সে নিজে?অনুভব হতেই আপনমনে হাসলো নিহাদ।এই ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে জীবন নিয়ে তার সত্যিই কোনো অভিযোগ নেই।বেশ তো আছে মুক্ত স্বাধীন পাখির ন্যায় বিস্তৃত আকাশে ডানা মেলে বিচরণ করে।
– এক্সকিউজ মি?
মেয়েলী কণ্ঠের ডাকে নিহাদের ভাবনায় ছেদ পড়ল।ঘুরে তাকিয়ে সড়কের একধারে অপেক্ষমাণ এক রমণীকে নজরে পড়লো। ফিকে হয়ে আসা বেগুনি বর্ণের সালোয়ার কামিজ পরিধানে।কালো একটি পাতলা শাল গায়ে জড়ানো। কাঁধে রংচটা ব্যাগ।মুখশ্রী বলতে তেমন কিছু নেই, শ্যামলতার আবহ।একটি গাড়ির পাশ গলে বাইক নিয়ে এগোলো নিহাদ।সহজাত স্বভাবে শুধালো,
– কি ব্যাপার লেডিফিঙ্গার?বাইক রাইডার ভেবে ভুল করেছেন,এটা আমার নিজস্ব বাইক। রয়েল এনফিল্ড ক্লাসিক থ্রি ফিফটি, গোটা গোটা ৫ লাখে নিয়েছি হুহ্!এত সাধের বাইক কোনো কোম্পানি বিলিবন্টন করেনা।
মেয়েটি স্পষ্টত বিব্রত হলো।সে সত্যিই নিহাদকে রাইডার ভেবেছিল।তাই মুখ ফিরিয়ে জানালো,
– আম…আমি দুঃখিত।
একটি নিঃশ্বাস ফেললো নিহাদ।আশেপাশে তাকালো।কোনো লোকাল নজরে আসছেনা।মেয়েটি হয়ত লোকালের যাত্রী,নিশ্চয়ই বাধ্য হয়ে রাইডার খুঁজছিল খরচের পরোয়া না করেই।একবার ভাবলো কি দরকার?নিজের রাস্তা দেখুক নিহাদ।কিন্তু পরক্ষণে হৃদয়ের নিকট হার মানলো,আসমান গুরুর শিক্ষা তার বড়ই কঠোর!
– বাগড়া তো একটা দিয়েই দিয়েছেন লেডিফিঙ্গার, এখন উঠুন পিছনে।কোথায় যাবেন?
– না না।আপনাকে প্রস্তাব দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।কিন্তু আমি কোনো সি এন জি খুঁজে নেবো।
– সি এন জি ড্রাইভার যদি আপনাকে কিড*ন্যাপ করে ফুস করে দেয়?তার থেকে এই বাইকে বসা ভালো না?কিডন্যাপ হওয়ার আগে অন্তত গর্ব করতে পারবেন এক হ্যান্ডসামের বাইকের পিছনের সিটটা কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও আপনার দখলে ছিলো!
হাসলো রমণী।তাকে লেডিফিঙ্গার বলে সম্বোধন আর এখন এমন ছন্নছাড়া কথাবার্তা অদ্ভুতভাবে নিহাদের উপর বিশ্বাস তৈরি করেছে তার।ছেলেটিকে যেন অবিশ্বাস করা সম্ভব নয়।এমনটাই মনে হলো অন্তর থেকে।
– আপ…আপনাকে ধন্যবাদ।আমার সত্যিই দেরী হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু আপনার কোনো সমস্যা নেই?
– আজকের দিনের জন্য আমি যাযাবর।দেখবেন, আস্তে করে উঠবেন,আমার বাইক যেন ব্যথা না পায়!
আবারো হাসলো মেয়েটি।সাবধানে চড়ে বসলো পিছনে।নিহাদের কাঁধে একটি হাত রাখলো।অতিরিক্ত হেলমেটটি তার দিকে বাড়িয়ে নিহাদ হ্যান্ডেল ধরলো।
– হোল্ড টাইট লেডিফিঙ্গার। আই অ্যাম আ ফাস্ট রাইডার।
– অহনা।
– হ্যাঁ?
– আমার নাম লেডিফিঙ্গার নয়,অহনা।
নিহাদ আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলোনা।সিগন্যাল ছাড়তেই এগোলো।অহনার প্রদত্ত ঠিকানায় পৌঁছতে তার বিধ্বংসী বাইকের আধ ঘন্টা সময় প্রয়োজন হলো।একটি আবাসিক এলাকার আট তলা বিল্ডিং।নেমে গেলো অহনা।
– আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।আমি সত্যিই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
– নাটক না করে নিজের কাজে যান।
– আপনি সত্যিই কিছু চান না?
– পাঁচ লাখ টাকার বাইকের মালিককে কি দিতে চান আপনি?
অহনা লজ্জাবোধ করলো,কিছু না বলেই উল্টোপথ ধরলো।সোজা গেইটের কাছে।ছোট্ট পকেট গেট খুলে বেরিয়ে এলো বয়স্কা,বয়স কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশের ঘরে হবে তার।নিহাদ চলে যাবে ভাবলেও কেন যেন গেলো না।সামান্য কৌতূহল অনুভব করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো দৃশ্যপট।
– আম্মা!
বয়স্কার বুকে আছড়ে পড়লো অহনা।নিজের মেয়েকে কাছে টেনে স্নেহ বুলিয়ে দিলেন জন্মদাত্রী।
– ভালা আসেনি আমার আম্মাজানে?
– আমি খুব ভালা আসি আম্মা।এই লও, তোমার মাসিক খরচের লাইগ্যা চারটা হাজার ট্যাকা আনসি।
– আরে আমার পাগলিডা।এইসবের কি দরকার?তুই এহন বড়ো কলেজে পড়স,তোর খরচাপাতি আসে না?
– তাতে কি আম্মা?তুমিও তো এই ঘরে কাম করো।ওই সামাইন্য বেতনে কি হয়?এইটা তুমি রাইখো,যহন যা মনে চায় কিনবা,খাইবা।
– আমার আম্মাজান,বড় নসিব কইরা তোরে জন্ম দিসি। আল্লাহয় যেন তোর উপর মুখ তুইল্যা চায়।
অহনার কপালে চুমু খেলেন তার মা।অপরদিকে অদূর থেকে সম্পূর্ণ দৃশ্য অবলোকন করে গেলো নিহাদ। জানেনা ভেতরে কেমন যেন অনুভূত হলো,এক অজানা অনুভূতি।
মিনিট পনেরো পর অহনা ফিরে এলো।নিহাদকে লক্ষ্য করে বিস্মিত হলো ভীষণ।
– আপনি এখনো যাননি?
– না।প্রেমিকার আশায় বসে আছি।
এমন বেফাঁস উত্তরে অহনার শ্যামলা ত্বকে লালিমা ফুটলো।
– তাহলে থাকুন।আমি গেলাম। থ্যাংকস অ্যাগেইন।
অহনা হেঁটে এগোতেই নিহাদ তার পিছনে বাইক নিয়ে এলো।
– উঠুন।
– জ্বি?
– কালা নাকি?শুনতে পান না?
– না মানে…
– একবার যখন পাঁ*চার করিনি দ্বিতীয়বারও করবোনা।সময় দেখেছেন?সন্ধ্যা নামছে প্রায়।যে একখান চমলক্য শাল জড়িয়েছেন, তাতে হাইপোথারমিয়ায় ভুগলে আপনার মাতুশ্রীর কি হবে?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল অহনা।জীবনে বেপরোয়া পুরুষ সে বহু দেখেছে,তাদের কঠোরভাবে নিবারণও করেছে।কিন্তু এই পুরুষটিকে কেন যেন কিছুতেই অন্য পুরুষদের শ্রেণীতে ফেলতে পারছেনা।এমন আচরণে হয়ত তাকে সস্তা ব্যক্তিত্ব অনুভূত হতে পারে,কিন্তু অহনার অন্তর বলছে তা নয়।এই ছেলেটি ব্যাপক কিছু,যাকে ঠিক ঘৃণা করা অসম্ভব।মানুষকে সম্মোহিত করবার জাদু আছে যেন তার মাঝে।
মস্তিষ্ক নিবারণ করার আগেই হৃদয়ের আস্কারায় অহনা নিহাদের বাইকের পিছনে চেপে বসলো। তীর্যক হাসলো নিহাদ,রিয়ার ভিউ মিররে তা যেন স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো অহনার।বাইক এগোলো,এবারের গন্তব্য ভিন্নপ্রান্তে।
মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির হল অভিমুখে যতক্ষণে নিহাদের বাইক এসে থামলো ততক্ষণে অহনা এবং তার মাঝে একপ্রকার বিস্তর আলাপ হয়েছে।ব্যক্তিগত বিষয়ে নয়, সবই মজার ছলে।দেবের সিনেমা পছন্দ অপছন্দ নিয়ে বেশ একচোট লেগেছে তাদের।অহনা জিৎ ভক্ত,দেব ভক্তদের চক্ষুশূল!অহনা যখন বাইক থেকে নামছে নিহাদ তখনো মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে,
– ছি ছি ছি!আগে জানলে এই কাঙালিকে বাইকে জায়গা দিয়ে বাবুটাকে অপবিত্র করতাম না!
– ইশ!আমি যেন খুব নেচেকুদে উঠেছি আপনার বাইকে?কে বলেছিল…. প্রথমবার যখন পাঁ*চার করিনি দ্বিতীয়বারও করবনা! হুহ?
– প্রথমবারেই পাঁ*চার করা উচিত ছিল!
বিনিময়ে হাসলো অহনা,যেন জানে নিহাদ তা কখনোই করবেনা,ভরসা করছে সে এই পুরুষটিকে।আশেপাশে তাকিয়ে মেরিডিয়ান নামটি নজরে আসতেই নিহাদ বললো,
– আরিব্বাস।আপনি তো লেডিফিঙ্গার ঝাকানাকা চীজ!স্কলারশিপ?
– হুম,৮০%।
– নার্ড!
– একটু আধটু।
– অস্বিকারও করছেনা আবার।কি দেমাগ!আমার ভাবীও এখানে পড়ে,কই তাকে তো দেমাগ দেখাতে দেখিনি!
– ভাবী?
মাথা কাত করলো নিহাদ,
– রোযা রেমান, চেনো নাকি?চেনার তো কথা,আমি শুনলাম ডিপার্টমেন্টে নাকি সে হেব্বি ফেমাস?
– আপনি রোযা আপুর দেবর?
হেলমেট খুলে চুলে হাত বোলালো নিহাদ,যেন নিজের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করছে,চোখ টিপ দিয়ে জানালো,
– সন্দেহ আছে?
অহনার অভিব্যক্তিতে দারুণ পরিবর্তন ঘটলো।সন্নিকটে সরে এলো সে নিহাদের।
– সত্যি?আপনি আমাকে আগে বলবেন না?রোযা আপু আমার খুব ভালো বান্ধবী,উহু শুধু বান্ধবী নয়।ও আমার বড় বোনের মতন।আমাকে অনেক আদর করে।পড়ালেখায় খুব সাহায্য করে।এইযে,এখন ফিরে প্রজেক্টে বসবো,আপু বলেছে আমাকে বুঝিয়ে দেবে সমস্যা হলে।উনি আমার আইডল।
– বাবারে বাবা।এত প্রশংসা আমার ফুলটুশীর?শি ইয রিয়েলি গ্রেট, আই নো দ্যাট।
মৃদু হাসলো অহনা,দৃষ্টি তার প্রজ্জ্বলিত অব্যক্ত অনুভূতিতে।নিহাদ পুনরায় হেলমেট মাথায় চড়াতেই নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং অস্বস্তি ঝেড়ে অহনা বলল,
– যদি কিছু মনে না করেন,একটা জিনিস চাইবো?
ভ্রু তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো নিহাদ।
– আপনার ফেসবুক আইডি,বা অন্য কোনো কন্ট্যাক্ট আইডি পাওয়া যাবে?চাইলে ই মেইলও দিতে পারেন।না চাইলেও ইটস ফাইন।
– কেনো?আবার বাইকের বুকিং দেবেন নাকি?
অহনা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো অস্বস্তিতে।
– না না,দুঃখিত।বাদ দিন।
– ফোন দিন।
– হু?
– ফোনটা দিন, কানে কম শোনা রমণী!
না হেসে পারলোনা অহনা,নিজের সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোনটা এগিয়ে দিলো।নিহাদ হাতে নিয়েই বললো,
– আহাহা!পুরোই প্রাচীন কালের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন!
– সবাই কি আপনার মতন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় নাকি মিস্টার?
আপনমনে হাসলো নিহাদ,সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম তার হয়নি,কিন্তু অহনার ভ্রান্ত ধারণা আপাতত দূর করার ইচ্ছা হলোনা।ভাগ্যে থাকলে হবে হয়ত… ক্রমান্বয়ে?ফোনটি ফিরিয়ে দিয়ে নিহাদ বললো,
– এই নাম্বারে হোয়াটস অ্যাপ। চ্যাটিং ৫০, ভয়েস মেসেজ ১০০, অডিও কল ৫০০ আর ভিডিও কল ১০০০ টাকা!
– আপনি একটা ফাজিল ছেলে!
দাঁত দেখিয়ে হাসলো নিহাদ,ইঞ্জিন চালু করে বাইকের হ্যান্ডেল ধরলো।যান্ত্রিক গর্জনকে ছাপিয়ে নিহাদ ব্যক্ত করলো,
– অনলি লে পাগলু ড্যান্স ইয রিয়েল!
– হেহ! হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ ইয দ্যা বেস্ট!
গ্লাভস পরিহিত তর্জনীতে অহনার কপালে টোকা দিলো নিহাদ,তারপরই বাইক চালিয়ে চলে গেলো আপন গন্তব্যে।অহনা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকলো, যতক্ষণ না নিহাদের বাইক আড়াল হয়ে যায় দৃষ্টিসীমার।তারপর আপনমনে হেসে হলের দিকে এগোলো, হাতের ফোনে সদ্য সেইভ করা নাম্বারটা দেখলো।নাম হিসাবে দিয়েছে,
“ গ্রীক গড!”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রইলো অহনা,পরমুহুর্তেই অট্টহাসিতে ফে*টে পড়ল।আশেপাশের গুটিকতক ছেলেমেয়ে তাকে এমন বেখেয়ালে হাসতে দেখে ভাবলো মেয়েটি পাগল হয়ে গেলো নাকি?
তখনো কেউই কল্পনা করতে সক্ষম হয়নি এই হাসিখুশি মেয়েটির ভবিষ্যত কতটা রোমহর্ষক হতে সক্ষম!
পরদিন।
গাড়িতে করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে রোযা।আজ একটি প্রজেক্ট আছে তাদের,ফিল্ডে নিয়ে যাওয়া হবে প্রথমবারের মতন।তাতে ভীষণ উত্তেজিত সে।জার্নালিজমের ব্যাপারটা তার দারুণ লাগছে।মুক্ত বাক্যের বিনিময়,যৌক্তিক আলোচনা সমালোচনা, সত্য উদঘাটনে মিডিয়ার ভূমিকা বিষয়গুলো ভীষণ চ্যালেঞ্জিং।তাই আলাদা টান কাজ করে যেন।তাছাড়া ভার্সিটিও ভীষণ প্রিয় তার।প্রথম প্রথম কিছুটা হীনমন্যতায় ছিল স্টাডি গ্যাপের কারণে। ক্লাসমেটদের সিংহভাগ তার চেয়ে বয়সে ছোট।কিন্ত এখন আর অস্বস্তি হয়না।বরং প্রচণ্ড ভালো লাগে।তাকে সকলে রোযা আপু বলে সম্বোধন করে,যেন সবার ভরসার গুরুজন সে।গাড়িতে বসে পথিমধ্যে ফাউন্টেন পেনের গল্পের কাজ শেষ করে ই মেইলে পাঠিয়ে দিলো।তার ধারাবাহিক গল্পটি আজ সমাপ্ত,পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করা দুষ্কর।আপনমনে খুশি হলো সে।
মেরিডিয়ানের মূল সড়কপথে আজ খানিকটা যানজট সৃষ্টি হওয়ায় ড্রাইভার ভিন্নপথে হলের সামনের চাপা সড়ক বেয়ে এসেছে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রোযা হলের সামনে বেশ ভিড় লক্ষ্য করলো।ব্যাপারটা কি হলো?তার হৃদয় অজানা এক আশঙ্কায় তার হৃদয় ভার হলো সহসাই।কেন এমন অনুভূত হলো নিজেও বলতে পারবেনা।ড্রাইভারকে থামতে বলে নেমে গেলো রোযা,ড্রাইভার নিজেও তাকে অনুসরণ করলো।তাকে আদতে ড্রাইভার না বলে বডিগার্ড হিসাবে সম্বোধন করা উচিৎ।যুবক ছেলেটার নাম হাবিব।আসমানের কোনো এক বিশ্বস্ত লোক। ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে রোযাকে তীক্ষ্ণ সতর্কতায় সামনে পৌঁছতে সাহায্য করলো হাবিব।কিন্তু দৃশ্যপটে দৃষ্টিপাত ঘটতেই সে অনুভব করলো রোযাকে নিয়ে আসা একদম উচিত হয়নি!
সম্পূর্ণ বরফখন্ডে পরিণত হলো রোযা।প্রসারিত দৃষ্টি তার আবদ্ধ হলের দিকে।তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে ঝুলছে এক বি*ব*স্ত্র নারী মৃ*তদে*হ!দিবাকরের আভা প্রতিফলিত হয়ে তার সমস্ত র*ক্তা*ক্ত অবয়ব দৃশ্যমান, খু*বলে খু*বলে খে*য়েছে তাকে ন*রপ*শুর দল! তা পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থে নেই সামান্যতম সুতোর আবরণও!মানবিকতার সীমাহীন অবক্ষয়।বর্ব*রতার অতিক্রান্ত দেয়াল। ঝুলিয়ে রেখেছে দে*হ*টি,অতি অবহেলায়।যেন প্রদর্শন করছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পরিণতি।দুহাতের ভা*ঙা বি*কৃত আ*ঙুল চুঁইয়ে টপটপ করে র*ক্ত গ*ড়াচ্ছে ভূমিতে।
“ দেখ…. দেখে নে বিদ্রোহের পরিণতি!”
ডার্কসাইড পর্ব ৪১
চিৎকার করে যেন তাই জাহির করে চলেছে দৃশ্যটি।নিজেকে সামলাতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হলো রোযার।অভ্যস্থ সে নৃশং*সতায়,কিন্তু এহেন পা*পাচার?ধরিত্রী আজ পুনরায় কলুষিত করেছে পাপিষ্ঠ গোষ্ঠী! টলে উঠলো রোযা,হাবিব তার কাঁধ স্পর্শ করে নিবারণ করলো পতন।তবুও দৃপ্ত দৃষ্টিতে মানবজাতির অবক্ষয়ের প্রদর্শন অবলোকন করে গেলো রোযা, যতই শরীর ভে*ঙে আসুক আবেগের তাড়নায়, এক মুহূর্তের জন্যও পলক পড়লোনা তার চোখের।
