ডার্কসাইড পর্ব ৬
জাবিন ফোরকান
হাতঘড়িতে সময় রাত এগারোটা ত্রিশ। কনকনে একটি হওয়া বইছে।আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে একটি ঘূর্ণিঝড়, যা মোকাবেলায় এলাকাভেদে সমুদ্রবন্দরসমূহে জারি করা হয়েছে ৭ – ১০ পর্যন্ত বিপদসংকেত। সেই ঝড়ের আভাসস্বরুপই যেন প্রকৃতিজুড়ে আজ ঝোড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে হিমশীতলতার চাদর উড়িয়ে।
রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে চলছে ৮ নম্বর বিপদসংকেত।মধ্যরাতের পরিবেশ ক্রমশই হয়ে উঠছে উন্মাতাল।এর মাঝেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে রোযা। আগামীকাল দাদুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে বলে আজ তার জন্য কিছু নতুন পোশাক এবং অবসর কাটানোর উদ্দেশ্যে পছন্দসই গুটিকয়েক বই কিনেছে সে।সবকিছুই আসাদ উদ্দিনের কাছ থেকে সেদিন পাওয়া দশ হাজার টাকা দিয়ে।প্রথমে ভেবেছিল নিজের হাতখরচের জন্য রেখে দেবে, মাসকাবারি হয়ে যাবে।কিন্তু পরবর্তীতে দাদুর জন্য খরচকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজ বাড়িওয়ালীর সামনে পড়লে আর রক্ষা থাকবেনা।ভাবতে ভাবতে অত্যন্ত দ্রুত এগোনো সত্ত্বেও ক্রমশ গতি বৃদ্ধির চেষ্টা করতে থাকলো রোযা।তাতে হাঁপিয়ে উঠছে সে, ঘেমে যাচ্ছে শরীর।শীতল বাতাস বওয়াতে একটুখানি মুক্তি। রোযার বিল্ডিংটাও সাপের মতন পেঁচিয়ে চলা অলিগলির ভেতরে, গুণে গুণে সাতটি গলি পেরোতে হয়।আর গলিগুলোও কেমন চাপা এবং ঘিঞ্জি ধরণের।যদিও বসতি নেই আশেপাশে, শুধুমাত্র মোড়ে মোড়ে কিছু টং দোকান এবং মুদিদোকান।গভীর রাত্রে এই গলির মাঝে কাউকে মে*রে ফেলে রেখে গেলেও কেউ টের পাবে কিনা সন্দেহ!
ঢোক গিলে জোরপূর্বক নিজের অশুভ চিন্তাসমূহ দূরে সরিয়ে রাখল রোযা।
যত ভাববে তত আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। তা করে কাজ নেই। পঞ্চম গলি পার হয়ে রোযা ষষ্ঠ গলিতে পা রাখতেই সামনের দৃশ্য দেখে থমকে পড়তে বাধ্য হলো।এই গলি সবথেকে নির্জন, চাপা পথের ওপাশে আগে একটি ছোটখাট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ছিলো।যা দুর্বল স্থাপত্যের কারণে গত বছর ধ্বসে পড়ে।কোনো মেরামতের দায়িত্ব নেয়নি মালিকপক্ষ, হ*তাহ*ত কিছু হয়েছিল কিন্তু ক্ষমতার দাপটে সেসব ঝামেলা থেকে পার পেয়ে গিয়েছে তারা। মিডিয়ায় কোনোপ্রকার নিউজ কাভারেজ করেনি এই অবৈধ স্থাপনা এবং সংঘটিত দুর্ঘটনা সম্পর্কে।এমনি হয়।তুচ্ছ শ্রমিকের জীবন কোনো মূল্য রাখেনা আভিজাত্যে মোড়ানো মালিকের অন্তরে।বর্তমানে কারখানাটি একপ্রকার বিদ্ধ*স্ত অবস্থায় দন্ডায়মান, দিনের বেলায়ও দেখলে মনে হয় যেন ভূত – প্রেতের মতন পরাশক্তিদের আড্ডাখানা।
তবে আজ সেই কারখানা নয় বরং ভিন্ন একটি দৃশ্য নজর কেড়েছে রোযার।বিপরীত প্রান্তে থেমে আছে একটি বাইক।কোনপ্রকার আলোর ব্যবস্থা না থাকায় শুধুমাত্র রাত্রির নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যতে যতটুকু দর্শন সম্ভব হলো তাতে রোযা অনুধাবন করলো বাইকটি অ্যাপ্রিলিয়া আর এস ফোর কিংবা হোন্ডা সি বি আর।যেসবের মূল্য বাংলাদেশী টাকায় ৪ লাখ ৮০ হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ ৭৫ হাজার পর্যন্ত! এই সম্পর্কে জানার কারণ অবসরে বসে অহেতুক ইউটিউবের ভিডিও ঘাঁটাঘাঁটি করা। তাছাড়া অদ্ভুত হলেও সত্য ছোটবেলা থেকে বাইকের প্রতি অদ্ভুত একটা ঝোঁক ছিল তার।যদিও কোনোদিন চালানো তো দূরে থাক চড়া পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠেনি তার পক্ষে।
কিন্তু এই তল্লাটে এত দামী বাইক নিয়ে কারো ঘুরঘুর করার কথা নয়।ভাবতেই বাইকের পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাদেহী মানুষটিকে চোখে পড়ল রোযার।হেলমেট পরিধান করে থাকায় কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা, শুধুমাত্র পরনে রয়েছে বাইক স্যুট তাই প্রদর্শিত হচ্ছে।এ কে?এখানে কি করছে?এভাবেই দাঁড়িয়েই বা কেনো আছে মাঝ গলিতে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর কোনোদিন পাওয়া সম্ভব নয়। রোযা মাথা হেলিয়ে এগোলো।তার হাত সহসাই ঢুকে পড়ল ব্যাগের ভেতর।সেখানে থাকা মরিচগুড়া মিশ্রিত লিকুইড স্প্রের বোতলটা সে চেপে ধরলো।সতর্কতা অবলম্বন জরুরী।নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দ্রুত সে পেরিয়ে গেলো বাইক এবং আরোহীকে।কয়েক কদম এগোনোর পরেই,
– এক্সকিউজ মি?
থমকে পড়লো রোযা।তবে পিছন ঘুরলোনা।অনুভব করলো আরোহী ক্রমশ তার নিকট এগিয়ে আসছে।
– আপনি কি বলতে পারবেন সোবহান মঞ্জিলটা কোনদিকে?এখানে এত এত গলি যে গুলিয়ে ফেলেছি। গুগল ম্যাপও হার মেনে নিয়েছে।
আরোহীর কন্ঠস্বর ভীষণ উৎফুল্ল শোনালো।যেন সে অলিগলির মাঝে একপ্রকার হারিয়ে গিয়েছে এটি তার জন্য ভীষণ উপভোগ্য ব্যাপার। রোযা ফিরে তাকালো, আরোহী বর্তমানে তার থেকে হাত দুয়েক দূরে অবস্থানরত।হেলমেট এখনো পরনে, যার দরুণ চেহারা দেখা যাচ্ছেনা।
– এখানে সোবহান মঞ্জিল বলে কোনো বাড়ি নেই।সোবহান ভিলা বলে একটি দোতলা ভবন রয়েছে।আপনি সেটা চার নম্বর গলিতে ফেলে এসেছেন।
দ্রুতকন্ঠে সমাপ্ত করেই রোযা উল্টে ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করলো।কিন্তু মাত্র এক কদমের মাথায় অতর্কিতে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিলো আরোহী।সঙ্গে সঙ্গে আরোহীর শক্ত সামর্থ্য শরীরের পাশাপাশি নিজের ঘাড় বরাবর একটি ধাতব স্পর্শ অনুভব করলো রোযা।
পি*স্ত*ল!
অদ্ভুত একটি হাসির শব্দ ভেসে এলো।তাতে রোযা সম্পূর্ণ জমে গেলো নিজের জায়গায়।সে নিশ্চিত, একটুখানি নড়লেই তার সমাপ্তি!আরোহীর হেলমেট ছুঁয়ে যাচ্ছে তার গালে, হাজার চাওয়া সত্ত্বেও ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে ব্যাগের ভেতরের স্প্রের বোতলে আরো চেপে বসলো রোযার আঙুল।
– তোমার এক রাতের মূল্য কত?
কণ্ঠস্বরটি একইসঙ্গে কঠোর অথচ অনুরণিত শোনালো।শরীর না হেলিয়ে শুধুমাত্র মাথা কাত করে চাইলো রোযা।হেলমেটের গ্লাসের অপরপাশ থেকে তার উদ্দেশ্যে চেয়ে রয়েছে জ্বলজ্বলে একজোড়া টানা টানা চোখ।
– পাঁচ হাজার দেবো। হোয়াট ডু ইউ সে?
একটি ঢোক গিললো রোযা।তার হৃদস্পন্দন থমকে পড়েছে।সমস্ত শরীর ক্রমশ হিম হয়ে আসছে আতঙ্কে।তবুও হাল ছাড়বার পাত্রী সে নয়। গত কয়েকদিনে তার জীবনে যেসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গিয়েছে তাতে তার অভ্যন্তরে ‘সাহস’ নামক গুণটি রীতিমত দুঃসাহসে পরিণত হয়েছে!
– আপনি আমার সাথে এক রাতের জন্য আসেননি, এসেছেন আমাকে তুলে নিয়ে যেতে।
পি*স্ত*লের নলে দৃষ্টি রেখে নির্ভিক কন্ঠে জানালো রোযা।যদিও তার কন্ঠ কিঞ্চিৎ কেঁপেছে,তবুও তা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত শোনালো।আন্দাজে ভর করে চালটি চেলেছে রোযা। ভাবেনি আরোহী তাতে স্বীকৃতি জানাবে।
– ওহ মাই! হাউ ইন্টেলিজেন্ট ইউ আর!
বাইকের উপর পা তুলে বসে হেসে বললো আরোহী।সে বর্তমানে রোযাকে পি*স্ত*লের মুখে রাখেনি, সেটি শোভা পাচ্ছে তার ডান হাতে।কিন্তু নির্দেশনা স্পষ্ট, রোযা উল্টোপাল্টা কিছু করতে চাইলেই তাকে খালাস করতে আরোহী এক মিনিটও ব্যয় করবেনা।
– এখন….নিজ দায়িত্বে বাইকে বসবে নাকি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে?
প্রশ্নটি করেই আরোহী নিজের হেলমেট খুলে ফেললো।তাতে প্রথমবারের মতন তার চেহারা দৃষ্টিগোচর হলো।
রোযা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো। হেলমেট বেরিয়ে আসতেই নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো বাদামী কালো মিশ্রিত বর্ণের চুল।চন্দন ফর্সা ত্বক আবৃত চেহারায় নিখুঁত অঙ্গভঙ্গি।নাকের উপরে টানা টানা চোখ।চোখের ঠিক নিচেই এক কিনারে একটা ছোট্ট আঁচিল।সিল্কি চুলগুলো তার কপালে ছড়িয়ে রয়েছে,তাতে ঢাকা পড়ে গেছে কালো ভ্রু জোড়া।প্রথমবার দেখলেই বোঝা যায় আলাদা একটা স্টাইলের অধিকারী এই মানুষটি।তার এক কানে ঝুলন্ত লম্বাটে চেইনের দুলটা সেই কথারই জানান দেয়।
রোযাকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে লক্ষ্য করে মুক্তোর মতন দাঁত বের করে ঝকঝকে এক হাসি উপস্থাপন করলো সে।তারপর কপালের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
– শুধুমাত্র আমার চেহারা দর্শনেই যে কেউ স্বইচ্ছায় বাইকে উঠে বসে। কিন্তু প্রত্যেকের জন্য এই জায়গা বরাদ্দ নয়।
বাইকের পিছনের সিটে চাপড় দিয়ে ইশারা করলো আরোহী। রোযা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো।ছেলেটি অত্যন্ত সুদর্শন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কাউকে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে এভাবে অবাধ উপস্থাপন করতে সে কোনোদিন দেখেনি।তার চেহারা নিয়ে সে খুবই আত্মবিশ্বাসী তা স্পষ্ট।
– আমার কাছে কি চান?আমি অতি সাধারণ এক মেয়ে।কি লাভ হবে আমাকে তুলে নিয়ে গেলে?
রোযা প্রশ্ন ছুঁড়তেই আরোহী যেন বিরক্ত হলো। ঝাঁপ দিয়ে বাইক থেকে নেমে অগ্রসর হলো।
– সাধারণ কি অসাধারণ তা তো সময়ই বলে দেবে।
তৎক্ষণাৎ কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিলো রোযা।তার বুক দুরুপুরু কাপছে।সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে চাইছে।কিন্তু সে এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নয়।আরোহী তার কাছে পৌঁছতেই রোযা অতর্কিতে নিজের স্প্রে বের করে স্প্রে ছুঁড়ে দিলো তার মুখ বরাবর। কিন্তু তার গতির তুলনায় ক্ষিপ্র আরোহী প্রতিক্রিয়া করলো তৎক্ষণাৎ।মাথা নুইয়ে রোযার বাহু চেপে ধরে মুহূর্তেই স্প্রে বোতলটা ফেলে দিলো, তার পায়ের কাছে পড়তেই এক লা*থিতে সেটাকে পাঠিয়ে দিলো অজানা ঠিকানায়।
– তুমি খুব দুষ্টু দেখছি মেয়ে!
কথাটা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় বললেও রোযার বাহুতে তার জোর চাপই বলে দিলো সে কতটা বিরক্ত কিংবা ক্রোধান্বিত হয়েছে। রোযাকে ঘুরিয়ে নিজের সঙ্গে চেপে ধরে তার কানে সে ফিসফিস করলো,
– মনে হচ্ছে একটু বেশিই স্নেহ করে ফেলেছি।তাই এমন দুঃসাহস দেখানো হচ্ছে।
– আমাকে ছেড়ে দিন!আমি চিৎকার করবো কিন্তু!
– হুশ!একদম চুপ…. আমার উপর কিন্তু প্রয়োজনে খু*ন করার অর্ডারও আছে!
পি*স্ত*লের নলটি এসে ঠেকলো রোযার গাল বরাবর।এক শীতল শিহরণ খেলে গেল তার শিরদাঁড়া জুড়ে।তবে এই কি শেষ?প্রথমে নৃ*শং*স এক হ*ত্যাকা*ণ্ডের সাক্ষী হওয়া, সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত গিয়ে মানুষ হ*ত্যা*য় সহযোগিতা করা আর এখন অপহ*রণ! কি হচ্ছে তার জীবনে?
– এক্ষুনি বাইকে উঠবে নয়তো….
বলতে বলতে হঠাৎ থমকে গেলো আরোহী। রোযার সঙ্গে সে একপ্রকার লেপ্টে থাকার দরুণ তার শারীরিক কম্পন স্পষ্ট টের পেলো রোযা।মাথা উঁচু করে আরোহীর চোখজোড়ায় এক অভাবনীয় দৃষ্টি লক্ষ্য করলো সে।সেই দৃষ্টির উদ্দেশ্য অনুসরণ করে চাইতেই দৃশ্যপটে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি আবিষ্কার করলো রোযা।
গলির একদম সম্মুখপ্রান্তে, ভাঙা দেয়ালের পাশে দন্ডায়মান কেউ।ঠিক পাশেই ঝুলন্ত একটিমাত্র টিমটিমে বাতির হলদে আলোতে তার অবয়ব দৃষ্টিগোচর হচ্ছে স্পষ্ট। ব্যাগি জিন্স এবং টি শার্ট পরনে।মাথা আবৃত ক্যাপে, চেহারা আড়াল হয়ে রয়েছে ফেইস মাস্কের অন্তরালে যা তার সম্পূর্ণ গ্রিবাদেশ পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। অদ্ভুত কোনো কারণে অবয়বটি রোযার ভীষণ পরিচিত ঠেকলো।মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো সে।প্রশস্ত কাধ, চাপা কোমর, ত্রিভুজাকৃতির শারীরিক অবকাঠামো….. রোযার মস্তিষ্ক যেন উপলব্ধিতে কার্যক্রম বন্ধ করে দিলো সহসাই।
আসমান!
যত ভুলই হোক না কেনো তার কৃষ্ণগহ্বরের ন্যায় শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন আঁখিজোড়ার হিমশীতল এক র*ক্তপিপাসু দৃষ্টি রোযা কোনোদিন ভুলতে পারবেনা।
আসমান এখানে কি করছে?কিভাবে এসেছে?কেনই। বা এসেছে এসব প্রশ্নের উত্তর লাভের কোনোপ্রকার অবকাশ নেই আপাতত।রোযার আগে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভ করতে হবে।আরোহী তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে ভরকে গিয়েছে।এই সুযোগ!শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে রোযা ঝটকা দিয়ে উঠল।তাতে তাকে ছাড়তে বাধ্য হলো আরোহী, ছিটকে গেলো পিছনে।সময় নষ্ট ব্যাতিত ছুটতে গেলো রোযা, কিন্তু তার পরনের ওড়নার দুই প্রান্ত একত্রে নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিয়ে টান দিলো আরোহী।তাতে ছিটকে রোযা পড়লো তার বাইকের উপরে।মাথাটা ঠু*কে গেলো তার শীতল ধাতুতে।
ওড়নাটি দিয়েই তার কন্ঠ পেঁচিয়ে ফেলল আরোহী। ঘাড়ে হাত রেখে চেপে ধরে রাখলো উবু হওয়া অবস্থায়। রোযা একটুখানি আশায় চাইলো আসমানের দিকে। সে কি রোযাকে চিনতে পেরেছে?যদিও নাবিলের হ*ত্যা*র ঘটনাটির প্রায় একমাস পেরিয়ে গিয়েছে,কিন্তু এক মাসে ভোলার কথা নয় নিশ্চয়ই।সে কি রোযাকে মানুষ হিসাবে হলেও একটুও সাহায্য করবেনা?
উল্টো ঘুরে গেলো আসমান! রোযাকে হতবিহ্বল করে দিয়ে সে পুনরায় গলির অভিমুখে হাঁটতে আরম্ভ করলো।যেন কিছুই হয়নি, কোনো দৃশ্যই সে উপলব্ধি করেনি!ক্রোধ এবং হতাশায় রোযার নয়নে অশ্রু জমলো।দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। কার কাছে কি আশা করছিল সে? একজন পশুর কাছে মনুষ্যত্ব আশা করা মহাবোকামি নয় কি?
– আসমান…প্লীজ!
কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই রোযার কন্ঠ থেকে নির্গত হলো সাহায্যের সর্বশেষ আবেদনটি।পরক্ষণেই রোযা নিজের মুখে নিজেই হাতচাপা দিলো। কার কাছে সাহায্য চাইছে সে?যে সব দেখেও মুখ ফিরিয়ে নিলো তার কাছে?এতটা অধঃপতন তার কবে ঘটলো?
অবশ্য ততক্ষণে একসঙ্গে দুইটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে। গলির মুখে প্রায় আড়াল হয়ে যাওয়া আসমান থমকে দাঁড়িয়েছে,যদিও এখনো পিছনে ঘুরে তাকায়নি।অপরদিকে রোযাকে ধরে রাখা আরোহী স্থির হয়ে গিয়েছে, হাতের বাঁধনও তার ঢিলে হয়ে এসেছে অনেকখানি।ব্যাপার কি? রোযা মাথা হেলিয়ে তার চোখে অবিশ্বাস্য এক বি*স্ফা*রিত দৃষ্টি দেখতে পেলো।
– আসমান ভাই… তুমি?
অদ্ভুত হলেও সত্য আরোহী এরপর হঠাৎ করেই রোযার উপর থেকে নিজের সবটুকু আগ্রহ যেন হারিয়ে ফেললো।তার সমস্ত আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হলো আসমানের উপর।
গলির প্রান্তে তখনো পিছন ঘুরে দন্ডায়মান আসমান।আরোহী রোযাকে ছেড়ে কয়েক কদম অগ্রসর হলো,
– আসমান ভাই….আমি নিহাদ…
ঘুরে তাকালো আসমান। কোনোপ্রকার শব্দ উচ্চারণ না করে চুপচাপ এগিয়ে আসলো সামনে।অপরদিকে পালানোর মোক্ষম সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও দ্বিধান্বিত অবস্থায় বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো রোযা।ব্যথায় তার কপাল টনটন করছে, গলায়ও চাপ পড়েছে।তবুও সেসব ভুলে সে চেয়ে আছে তার জীবনে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় দুজন পুরুষের অদ্ভুত আচরণের দিকে।পরিস্থিতির উত্তেজনায় পালানোর চিন্তা যেন তার মাথা থেকে বেমালুম বেরিয়ে গিয়েছে।
আসমান নিহাদ নামক বাইক আরোহীর তিন হাত দূরে থমকে দাঁড়াতেই একে অপরের মুখোমুখি হলো তারা।নিহাদ আসমানের তুলনায় কয়েক ইঞ্চি লম্বা।সে যাই হোক, অদ্ভুতভাবে আসমানের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমশই তার নয়ন ভিজে উঠতে শুরু করেছে।ভগ্ন কন্ঠে সে আসমানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে সে বললো,
– তুম…তুমি বেঁচে আছো আসমান ভাই?আমি ভেবেছিলাম…
জবাব দিলোনা আসমান।শুধু নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো নিহাদের দিকে।নিহাদ অতি দ্রুত নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে পিছনে রোযার দিকে চাইলো, তাকে উদ্দেশ্য করে আসমানকে জিজ্ঞেস করলো,
– ওকে চেনো?
– হ্যাঁ।
একশব্দে উত্তর করলো আসমান।তাতে অদ্ভুত স্বস্তি পেল রোযা।যাক, অন্তত অস্বীকার করেনি! নিহাদ কিছুক্ষণ সময় নিলো।যেন কিভাবে কথা বলবে গুছিয়ে উঠতে পারছেনা। আচ্ছা, ভাববার বিষয়।নাবিল এবং এই নিহাদ, উভয়ই আসমানকে দেখার পর সর্বপ্রথম অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিল সে বেঁচে আছে বলে! এর অর্থ কি?বাকি সকলের কাছে কি আসমান বর্তমানে মৃ*ত?চিন্তাটি সহসাই গোত্তা খেয়ে গেলো রোযার মস্তিষ্কে।
– তুমি জানো এই মেয়েকে আমি কেন তুলে নিয়ে যেতে এসেছিলাম?
নিহাদ প্রশ্নটি করলো বহু ভাবনা চিন্তার পর।বোধ হয় ব্যক্তিগত কিছু এখনি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছুক নয়।আসমানের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য আপতিত হলো রোযার উপর।তারপর পুনরায় এক শব্দে উত্তর দিলো সে,
– হুম।
আতকে উঠলো রোযা।আসমানের থেকে একটি দুটো শব্দ ছাড়া বিশ্লেষণ পাওয়া অসম্ভব।তাই সে সহসাই আঁকড়ে ধরলো নিহাদের বাহু।
– কে পাঠিয়েছে আপনাকে? কেন তুলে নিয়ে যেতে চান আমাকে?
– চাচ্ছিলাম।কিন্তু বর্তমানে আর চাইনা।
মৃদু হেসে রোযার দিকে তাকালো নিহাদ।নিজের বাহুখানা ছাড়িয়ে নিয়ে আসমানের দিকে ফিরল সে।অপরদিকে রোযা শুধুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ ব্যাতিত আর কিছু করতেই বর্তমানে সক্ষম নয়।
– আমি আন্দাজ করছি নাবিল কায়সারের মৃ*ত্যুর পিছনের রহস্য তোমার মাঝেই নি*হিত, আসমান ভাই।
যথারীতি জবাব নেই।ওই একই ভঙ্গিতে দন্ডায়মান আসমান।একটি নিঃশ্বাস ফেলে নাক চুলকে নিহাদ জানালো,
– পরিস্থিতি বর্তমানে জটিল। নিজের পুত্রশোকে অস্থির বাদশাহ সাহেব।এত সহজে তিনি নিস্তার দেবেন না।তুমি নিশ্চয়ই জানো কে বি গ্রুপের ক্ষমতার শিকড় কতদূর বিস্তৃত।
এক পলক রোযার দিকে চেয়ে নিহাদ যুক্ত করলো,
– এই মেয়ের জীবন বর্তমানে সংকটাপন্ন।যেকোনো মূল্যে সত্যি উদঘাটন করবে কে বি গ্রুপ।আমি আজ চলে যাচ্ছি, মনে রেখো, কে বি গ্রুপের হিটটিমে আমি ছাড়াও আরো বহু সদস্য রয়েছে! এবং তাদের টার্গেটের পরিণতি কি হয় সে সম্পর্কে তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানেনা!
এটুকুই।উল্টো ঘুরে গেলো নিহাদ।হনহন করে চললো নিজের বাইকের উদ্দেশ্যে।অতঃপর কোনপ্রকার বিদায় ব্যাতিতই মৃদু গর্জন তুলে তার বাইকটি গলি বেয়ে ধীরে ধীরে আড়াল হয়ে গেলো দৃষ্টির সীমানা থেকে।
নিহাদ চলে যাওয়ার পরই নড়েচড়ে উঠলো রোযা।এতক্ষণে যেন তার হুশ ফিরেছে।কি বলে গেলো ছেলেটা?কে বি গ্রুপ তার খোঁজ করছে? নাবিলের মৃ*ত্যু নিয়ে সন্দেহ করছে? মুহূর্তেই রোযার হৃদয়ে শীতল আবহ ছড়িয়ে পড়ল। এখন! কে বি গ্রুপের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার সামর্থ্য তার নেই।সে অতি সাধারণ এক রমণীমাত্র!অন্যদিকে ক্ষমতাশালী কে বি ইন্ডাস্ট্রিজ অর্থের জোরে চাইলে যেকোনো কিছুই হাসিল করতে পারে।
চট করে আসমানের দিকে তাকালো রোযা।না চাইতেও তার ঠোঁটজোড়া ফাঁক হলো।কম্পিত কন্ঠে সে উচ্চারণ করলো,
– এ… এখন…কি হবে?
কাধ উঁচু করে আসমান বোঝালো, যে সে জানেনা। এটুকু প্রদর্শন করেই সে পুনরায় উল্টো ঘুরে গেলো।উদ্দেশ্য স্থানটি পরিত্যাগ করা। রোযার কি হলো সে বলতে পারবেনা।ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সে খপ করে চেপে ধরলো আসমানের হাত।
– কোথায় যাচ্ছেন আপনি?সবকিছু আপনার দোষ!
থামলো আসমান।মাথা হেলিয়ে তাকালো রোযার দিকে।তার প্রজ্জ্বলিত কালো দৃষ্টিমাঝে অদ্ভুত এক পরাশক্তি যেন উঁকি দিচ্ছে।
– ডোন্ট!
ঝটকা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো আসমান।তার দৃশ্যমান চেহারার অংশে ভ্রুজোড়ার অস্বাভাবিক কুঞ্চনে স্পষ্টত তার বিরক্তি এবং ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছে। রোযা সয়ংক্রিয়ভাবে এক কদম দূরে সরে দাঁড়ালো।
– যদি আপনি আমাকে ওই কাজে বাধ্য না করতেন তাহলে….
– ন্যাকাকান্না কাঁদবেন না।আপনি পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন, লাভ ছিল বলেই করেছেন।
আসমানের অনুভূতিহীন গভীর কণ্ঠস্বরে রোযার চোখে জমাকৃত অশ্রুর ফোঁটা উপচে প্রবাহিত হওয়ার পূর্বেই সে জোরপূর্বক তা মুছে নিলো।
– আমার কি হবে এখন?
– জানিনা।
ভাবনা ছাড়াই এক শব্দে উত্তর দিলো আসমান।জবাব শুনে রোযার অধরে বিষন্ন হাসি ফুটে উঠলো। জগতে মানুষ সর্বদাই একলা, তার নিজের পথ নিজেকেই চলতে হয়।হৃদয়ে ঘূর্ণিপাক খেলে গেলেও দীর্ঘ প্রশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখলো রোযা।জীবনে সংগ্রাম লড়াই করতে করতে তার ইন্দ্রিয়ও যেন সবকিছুতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
আসমানকে আর কিছু বলার ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেললো রোযা।তাকে পাশ কাটিয়ে চললো গলির অপরপ্রান্তের দিকে।
– আপনি ঐদিকে কোথায় যাচ্ছেন?আপনার বাড়ি তো এইদিকে।
পিছনে ঘুরল রোযা।
– আপনি কিভাবে জানলেন আমার বাড়ি কোথায়?
জবাব নেই।এই দানবকে যতটুকু চিনতে পেরেছে তাতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে এর মুখ খোলানো অসম্ভব।তাই রোযা পুনরায় নিজের পথে অগ্রসর হলো,
– আমার বাড়ির ঠিকানা যেমন আপনার কাছে আছে তেমনি নিশ্চয়ই কে বি গ্রুপের কাছেও আছে।নিহাদ চলে গিয়েছেন, তার অর্থ এই নয় যে তারা নতুন কাউকে পাঠাবেন না। কোথায় যাচ্ছি জানিনা, কিন্তু অন্তত এই বাড়িতে থাকা আমার জন্য নিরাপদ নয়।
– আপনি বাড়িতেই ফিরবেন।অন্তত আজকের রাতের জন্য হলেও।
আসমানের বক্তব্য শুনলেও থামবার প্রয়োজনবোধ করলোনা রোযা।ঠিক তখনি দানবটির দ্বিতীয় বাক্য ভেসে এলো তার কানে,
– এবং আপনার সাথে আমি থাকবো!
সম্পূর্ণ বরফখন্ডে পরিণত হলো রোযা।সামান্যতম নড়চড় করতেও সক্ষম হলোনা।সে কি আদও ঠিক শুনেছে নাকি তার মস্তিষ্কের কল্পনা?
ঘড়ির কাঁটা বর্তমানে সময় নির্দেশ করছে বারোটা বিশ।বাইরে ইতোমধ্যে আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বজ্রপাত শুরু হয়েছে।থেকে থেকে ঝলকানিতে চমকিত হয়ে উঠছে সমস্ত আকাশ।তার সাথে মৃদু মেঘের গর্জন।
ভবনের সিঁড়িতে যখন রোযা পা রাখলো তখন মনে প্রাণে একটাই প্রার্থনা করতে লাগলো যেন কিছুতেই বাড়িওয়ালীর মুখোমুখি নয়।তার অনুসরণে রয়েছে নির্বিকার আসমান। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই রোযার আতঙ্ক বাস্তবে পরিণত হলো। ঠিক সিঁড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে বাইরের অবস্থা দেখতে দেখতে পান চিবুচ্ছে বাড়িওয়ালী। রোযা এবং আসমানকে দেখে তার গোলগোল চোখজোড়া রীতিমত কপালে গিয়ে ঠেকলো।
– আ…আন্টি…আপনি যা ভাবছেন তা না!
অতর্কিতে বলে বসলো রোযা।যদিও মহিলা একটিও প্রশ্ন করেনি।তাতে যেন পুনরায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল সে।
– বের হ!এক্ষুনি তুই বের হবি আমার বাড়ি থেকে!
তার চেঁচিয়ে ওঠার শব্দে আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকেও লোকজন বের হতে লাগলো।সবাই হতভম্ব হয়ে রয়েছে।রীতিমত লোক জড়ো করে ফেলেছে বাড়িওয়ালীর বাজখাঁই কন্ঠস্বর।লজ্জায় রোযা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েও থাকতে পারছেনা। আঁকড়ে ধরে রেখেছে রেলিং।
– রোযা…তুমি!আমি ভাবিনি তুমি এমন…
এই সম্পূর্ণ ভবনে একমাত্র এক মহিলা, না রোযাকে স্নেহ করতো সেও যখন এই কথা বললো তখন রোযা না পারতে বলে উঠলো,
– না আন্টি বিশ্বাস করুন…
– খদ্দের ধরে এনে আবার বড় বড় কথা!কি বলবে তুমি এখন? তোমার খালাতো চাচাতো ভাই এ?
বাড়িওয়ালী তেজস্বী ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়তেই হঠাৎ অগ্রসর হলো আসমান।একদম নির্বিকার কন্ঠে জানালো,
– স্বামী।
প্রকৃতির এমনি লীলাখেলা যে ঠিক একই সময়ে অদূরে একটি বাজ পড়ল। শব্দতরঙ্গ প্রকম্পন খেলিয়ে দিলো সম্পূর্ণ সিঁড়িঘর জুড়ে।সকলে বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আসমানের দিকে, এমনকি রোযা নিজেও।
ডার্কসাইড পর্ব ৫
– স…স্বামী?রোযার স্বামী? কবে বিয়ে হলো ওর?
– আজকেই।
পুনরায় উচ্চারণ করলো আসমান।তার ভঙ্গি এতটাই পরোয়াহীন যে তাতে রোযা ঈষৎ কম্পিত হয়ে উঠলো।অপরদিকে সিঁড়িঘরে জড়ো হওয়া সকলে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আসমানের দিকে।
