ডার্কসাইড পর্ব ৬৬
জাবিন ফোরকান
ইন্টারপোল।
বিশ্বব্যাপী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণে গঠিত এক আন্তর্জাতিক অপরাধ নির্মূল কমিশন। সারা পৃথিবীতে মানব কিংবা মা*দক পাঁ*চার, রা*হাজানি,হ*ত্যা,জু*য়া ইত্যাদি অপ*রাধমূলক কর্মকান্ড দমনে ইন্টারপোল অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।যা বিস্তৃত হয় নির্দিষ্ট দেশ কিংবা জাতিভেদের সীমানা পেরিয়ে অপর কোনো স্থানে গুরুত্বপূর্ণ অপরাধী পাকড়াওয়ের গোপনীয় মিশন পর্যন্ত।
আরিফিন কবির,ছদ্মনাম ভিকি,সম্প্রতি তেমনি এক মিশনের পরিচালনায় যুক্ত হয়েছে।বিষয়টি তার নিকট ছিল সম্পূর্ণ ঘোলাটে। হুট করে একদিন মাঝরাতে হেডকোয়ার্টারে ডাক পড়ে তার।উচ্চপদস্থ অফিসার তাকে অবহিত করেন,সুদূর রাশিয়া হতে পলাতক এক গু*রুতর অপরাধীকে পাকড়াও করতে ইন্টারপোল ইমারজেন্সি এক ডিপ কভার স্টিং অপারেশন সংঘটিত করতে যাচ্ছে।যার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়েছে।বলা বাহুল্য নয় অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মাঝে এতটা তোড়জোড় আরিফিনকে একটাই ধারণা প্রদান করেছিল।এই মিশন শুধুমাত্র অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে নয়,রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত হতে চলেছে।অভিজ্ঞতা তাকে নিশ্চিত করেছে,এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো রাঘব বোয়ালের হাত রয়েছে।তবে সেই রাঘব বোয়ালের সত্যিকার পরিচয় তার নিকট ধোঁয়াশা হিসাবেই থাকে যতদিন না ওই কৃষ্ণগহ্বরের অধিকারী মানুষটির সঙ্গে তার অভাবনীয় এবং অপ্রত্যাশিত এক সাক্ষাৎ হয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্যবর্তী কোনো এক স্থান, যেটাকে আধুনিক ভাষায় বলা হয় হাইডআউট।স্বচ্ছ আভায় উদ্ভাসিত কক্ষটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেই আরিফিন থমকে দাঁড়ায়।একটি টেবিল ঘিরে দন্ডায়মান মানুষগুলো বিনা কারণেই তার শিরদাঁড়ায় সামান্যতম শিহরণ খেলিয়ে দিলো।তবুও উচ্চশিরে সে প্রবেশ করলো,নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালালো চারিদিকে।তার নিজের টিমের অফিসার কয়েকজনও উপস্থিত।এক সুদর্শন ছেলে কেবিনেটের উপর বসে পা দোলাচ্ছে,হাতে একটি আপেল,তাতে আলসী কামড় বসিয়ে এক কানের লম্বাটে ধাতব দুলে ঢেউ খেলিয়ে সে নির্বিকার দৃষ্টিপাত করে আছে।তবে সকলের মাঝে দৃষ্টি হরণ করা ব্যক্তিটি দন্ডায়মান একটি হোয়াইট বোর্ডের নিকটে,তাতে ইতোমধ্যে প্রচুর আঁকিবুঁকি কাটা হয়েছে।আরিফিন প্রবেশ করতেই লাল নীল মার্কার হাতে ব্যক্তিটি ঘুরে তাকালো,সুগভীর দৃষ্টি তার আপতিত হলো অফিসারের উপর।আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ চালিয়ে থমকালো মুখমন্ডল বরাবর।ব*জ্রাহত হলো যেন আরিফিন,ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ওই নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বরমাঝে।ঘটনাটি আজ থেকে বারো কি পনেরো বছর আগে সংঘটিত হলেও আজও তার স্মৃতিপটে দিনটি সমুজ্জ্বল।
প্রচন্ড বর্ষণের রাত,সেই রাতে তার তর্জনী আঁকড়ে একটিমাত্র ছাতার আশ্রয়ে বাড়ি ফিরছিল গার্মেন্টসকর্মী মা।বাবা বহু পূর্বেই অপর নারীর মায়ায় বিভোর হয়ে সংসারত্যাগী হয়েছে।কিন্তু মা তো সন্তানকে ছাড়তে পারেনা।এক নীরব সংগ্রাম জীবনের সঙ্গে।সড়কে কোনো মানুষ তো দূরে থাক, জীবজন্তু পর্যন্ত ছিলোনা।ছিল কিছু নরপ*শু,দা*নব!তার মাকে টেনে হিঁ*চড়ে হায়েনার দলটি নিয়ে গেলো ফুটপাথের পাশের ঝোপে,চিৎকার করে আহাজারি বাদে আরিফিনের আর কিছুই করার ছিলোনা।চেষ্টার দরুণ ছু*রি*র আ*ঘাতে বিক্ষ*ত হয়ে ভেজা শক্ত ফুটপাথে পড়েছিল সে,গড়িয়ে নামছিল র*ক্তধারা।স্পষ্ট স্মরণে রয়েছে দৃশ্যটি আজও।অতর্কিতে এক ব*জ্রপা*ত ঘটেছিল,অমানিশার ছায়া এবং বারিধারার আস্তরণ হটিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল এক অবর্ণনীয় অস্তিত্ব। কিশোরমাত্র,সম্পূর্ণ শরীর চুপচুপে ভেজা,অতিরিক্ত শুভ্র মুখমন্ডলজুড়ে নির্বিকার ভাব এবং প্রজ্জ্বলিত এক কৃষ্ণগহ্বর খচিত নয়নে।এক পলক আরিফিন এবং পরক্ষণে হায়েনার দলের উদ্দেশ্যে তাকিয়েছিল সে।অতঃপর যা হয়েছিল তা কোনো অতিমানবীয় দৃশ্য ব্যাতিত ভিন্ন কিছু নয়। একা এক কিশোর,বনাম উন্মত্ত নরপ*শুর দল।তবুও মোকাবেলায় বেগ পোহাতে হলো সকলকে।এ যেন কোনো মানব নয়, যন্ত্র, এক মৃ*ত্যু প্রদানকারী যন্ত্র!
অতিরিক্ত দুর্বলতা, ভীতি এবং র*ক্তক্ষরণে জ্ঞান হারিয়েছিল আরিফিন।অতঃপর দ্বিতীয়বার যখন সে দৃষ্টি মেলে,তখন নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের বিছানায়।অক্ষ*ত মা তার শিয়রে বসা, নিরাপদ,পবিত্র,সুস্থ!ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল আরিফিন,মায়ের বুকে মুখ গুঁজে তার সজোর কান্না হাসপাতালের অপর রোগী এবং কর্মচারীদেরও বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল।তার বিছানার টেবিলের উপরেই তাজা ফলমূলের প্যাকেট এবং একটি ছোট্ট চিরকুট ছিল।সেটি তুলে খুলতেই গোটা গোটা অক্ষরে লিখিত দেখা গেলো,
“ এমন একজন পুরুষ হও,যে নিজের মাকে রক্ষা করতে জানে।”
কিশোর ছেলেটি ঠিক যেমনভাবে অতর্কিতে এসেছিল, তেমনি অগোচরে উধাও হয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে।মায়ের থেকে জেনেছিল,সে তাদেরকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েই চলে গিয়েছে।এক অমোঘ প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল সেদিন আরিফিন,মাকে রক্ষা করার মতন উপযুক্ত করে নিজেকে গড়ে তুলবে সে।আজ সেই পর্যায়ে সে পৌঁছেছে,যেখানে নিজেকে কারো সম্মুখে নত করার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়না।তবুও,সেই রাত্রি এবং সেই অচেনা অজানা অস্তিত্বকে সে কোনোদিনও ভুলে যাওয়ার মতন দুঃসাহস করেনি।
মানুষের ভাগ্য কতই না বিচিত্র!স্রষ্টার পরিকল্পনা বোঝে সাধ্য কার?সেই কিশোরই আজ আরিফিনের সামনে দন্ডায়মান। গায়ে গতরে অনেকখানি বৃদ্ধিলাভ হয়েছে তার, অবয়বজুড়ে প্রাপ্তবয়স্ক অনুভব,সেই শুভ্র মুখমন্ডল আড়ালকৃত মাস্কের অন্তরালে।তবুও ওই শোষণীয় কৃষ্ণগহ্বর চিনতে আরিফিনকে বেগ পোহাতে হয়নি।নিজের হৃদস্পন্দন রীতিমত থমকে যেতে অনুভব করলো সে যখন উভয়ের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় হলো।অতঃপর, নির্বিকারভাবেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তার অব্যক্ত প্রেরণা।
একটি দীর্ঘ প্রশ্বাস টানলো আরিফিন।নিঃশব্দে কক্ষের অভ্যন্তরে এসে বোর্ডে দৃষ্টি ফেললো।বক্ষমাঝে হৃদযন্ত্র তার স্পন্দিত হতে থাকলো অস্বাভাবিক এক গতিতে।বোর্ডের সামনে দন্ডায়মান আসমান নিজের কাজেই মগ্ন।কেউই তাকে কোনোপ্রকার বাঁধা দিচ্ছেনা।একমাত্র নিহাদই খানিকক্ষণ কি যেনো ভাবলো।অতঃপর আপেলটি ধরে রেখে লাফিয়ে মেঝেতে নেমে এসে বিড়বিড় করলো,
– সো….দিস ইয দ্যা প্ল্যান?
উত্তরে শুধুমাত্র মাথা দোলালো আসমান সামান্য,নিজের কার্যক্রম জারি রাখলো।একজন এজেন্ট নিজের তর্জনী চিবুকে ঘষে বিড়বিড় করলো,
– হুম,একটা রেইস,প্রতিযোগীদের আত্মত্যাগ, গ্যা*ম্বলিংয়ে উত্তাল অপরাধী,প্রমাণাদি সংগ্রহ,অন্তিম চালে বাজিমাত।
– এটা,প্ল্যান এ।
আসমানের গভীর কন্ঠস্বরে সকলে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো।অপর একজন শুধালো,
– প্ল্যান এ?তাহলে আমাদের হাতে প্ল্যান বিও রয়েছে?
উত্তরস্বরুপ মাথা দোলালো নিহাদ,আপেলে দীর্ঘ এক কামড় বসিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চিবুতে চিবুতে জানালো,
– অবশ্যই।আপনাদের মনে হয় আমরা দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছাড়া কাজ করি?
সকলে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করলো।তাদের মিশনের সঙ্গে এই বান্দাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সাহায্যকারী হিসাবে তারা স্থান পেয়েছে এই মিশনে, এটুকুই ব্যাখ্যা পেয়েছে তারা।তবে উভয় অস্তিত্ব যে আদতে ভিন্ন কিছু তা উপলব্ধি কঠিন নয়।আসমান পিছনে ফিরে একদফা গভীর দৃষ্টি ফেলে প্রশান্ত অথচ শীতল কন্ঠে জানালো,
– দিমিত্রী ভলকভ কোনো মস্তিষ্কহীন প্রাণী নয়।এই রেইসের অন্তরালে তাকে ধরতে পাতা ফাঁদের উপস্থিতি সে অনুভব করবে পূর্বেই,এর নিশ্চয়তা নব্বই ভাগ।
– আপনি এতটা জোর দিয়ে কিভাবে বলছেন?
একজন প্রশ্ন ছুঁড়তেই আসমান মাথা কাত করে বললো,
– ট্রাস্ট মি, আ গ্যাংস্টার ক্যান ডু আ লট।
আরিফিন মনোযোগ দিয়ে সবকিছু শুনে গেলো, অতঃপর উচ্চারণ করলো,
– অর্থাৎ আমরা সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকবো, তাইতো? টার্গেটকে এমন বিশ্বাস দিতে হবে যেন সে ভাবতে থাকে খেলা আদতে তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।অতঃপর,অন্তিম পর্যায়ে খেলার মোড় ঘুরিয়ে বাজিমাত চাল দিতে হবে।
– এক ম*রণকা*মড়!যে কাম*ড়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব।
নিহাদের কন্ঠে অব্যক্ত এক অশুভ উদগীরণ ঘটলো।সকলের দৃষ্টি তার উদ্দেশ্যে ঘুরে গেলো।তাতে তীর্যক হেসে আপেলে অন্তিম কা*মড় বসালো সে,এই যেন তার সেই নির্দেশিত ম*রণকা*মড়!
– আশা করছি আপনারা সবাই খুব ভালো অভিনয় করতে জানেন।
অন্তিম বাক্যে সকলে বিস্মিত হলেও আরিফিন সামান্য মাথা ঝাঁকালো,সে অনুভব করতে সক্ষম, কি হতে চলেছে।কতটা বৃহৎ পরিসরে তাদের মিশন পরিচালিত হতে যাচ্ছে।সেই সূক্ষ্ম জল্পনা কল্পনা এবং বিশ্লেষণ সমাপ্ত করে যখন আরিফিন আর তার টিম হাইডআউট ত্যাগ করছিল,তখন অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটে বসলো।
সকলে সামনে হেঁটে যাচ্ছে,পিছনে আরিফিন।হঠাৎ নিজের পাশে এক প্রভাবশালী অস্তিত্ব অনুভব করে অফিসার ঘুরে তাকাতেই আবিষ্কার করলো আসমানকে।তার পাশাপাশি হেঁটে আসছে। উভয় হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা।সহস্র প্রশ্ন উত্থাপিত হলো আরিফিনের অন্তরে,কিন্তু সেসব উচ্চারণকে সমীচীন মনে করলোনা।এই ব্যক্তি তাকে স্মরণে রাখেনি,খুবই বোকার মতন হবে বিষয়টি আশা করা।
– তোমার মা ভালো আছেন?
আরিফিনকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমানায় ঠেলে দিয়ে মৃদু কন্ঠে বিড়বিড় করলো আসমান,তার দৃষ্টি তখনো সামনে।নিজের অভ্যন্তরে এক আবেগের তাড়না অনুভব করলো আরিফিন, অধরে ফুটলো এক কোমল হাসি।উত্তর দিলো,
– মা খুব ভালো আছেন।
বর্তমান।
উপলব্ধি দিমিত্রীকে উত্তাল উর্মীমালা হয়ে বারংবার ঘাত প্রতিঘাতে বি*দ্ধ করছে।এতটা শোচনীয় পরাজয় সে নিজের চৌত্রিশ বছরের জীবনে কোনোদিন বরণ করেনি।বিস্মিত দৃষ্টি তার আবদ্ধ ওই অটল হিমালয়ের উদ্দেশ্যে,ক্ষুরধার যার চিন্তাশক্তি,নি*ষ্ঠুরতা যার অলঙ্কার।তার ফ্যাকাশে নয়নজুড়ে প্রগাঢ় অমানিশার দৃষ্টিপাত,অব্যক্ত এক চেতনা,শীতলতম উপাখ্যান।সত্যিই দিমিত্রী ভলকভ আজ পরাজিত হয়েছে।
নিজের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর পরিকল্পনায় বিন্দুমাত্র ফাঁকফোকর রাখেনি আসমান। গোটা রাশিয়ান গ্যাং ডায়নোসোরাসকে বাগে আনা কষ্টকর হবে বলে সুচারুভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইন্টারপোলকে জড়িয়েছে নিজের রেমান নামের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে।ফলাফল কি হতে পারে, সে সম্বন্ধে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেছে।একেক ফলের জন্য একেক পরিকল্পনা।শুধুমাত্র প্ল্যান এ,কিংবা বি নয়, আসমানের কাছে বর্তমানে প্ল্যান সি থেকে প্ল্যান ই পর্যন্ত সাজানো রয়েছে।সেই তথ্য অবশ্য একান্ত নিকট লোক ব্যাতিত কেউই জানেনা।শত্রুকে সর্বোচ্চ উল্লাসে ভাসিয়ে অন্তিম লগ্নে অহংকার গুঁড়িয়ে দেয়া আসমানের জাত বৈশিষ্ট্য।যার প্রতিফলন সে সাইফকে খ*তম করবার সময়েও দেখিয়েছে। দিমিত্রীর ক্ষেত্রেও সে একই পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে,তবে বিস্তৃত পরিসরে।রাশিয়ান বান্দা এবং তার শখের রমণী কায়সার কন্যা এই গ্যা*ম্বলিং রেইসের উদ্দেশ্য উদঘাটন করতে সক্ষম তা আসমান প্রারম্ভেই আন্দাজ করেছে।তবুও অটল থেকেছে পরিকল্পনায়। দিমিত্রীকে টেনে এনেছে জয়ের দুয়ার পর্যন্ত,যখন সে ভাবছিল সেই সর্বেসর্বা।অতঃপর,এক দানে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে সময় প্রয়োজন হয়নি আসমানের।
এত আয়োজন কিসের জন্য?
নিজের জ্যোৎস্নার জন্য।তিল তিল করে গড়ে তোলা সুখের পরিবারটির জন্য।তার অর্ধাঙ্গিনীর গর্ভে বেড়ে ওঠা আপন অংশের জন্য।একবার হারিয়েছে আসমান, নিমজ্জিত হয়েছে না পাওয়ার নিকষ আক্ষেপে।দগ্ধ হয়েছে তার অন্তর,পরিণত হয়েছে শক্ত পাথরে।মানবিক অস্তিত্ব ম্রিয়মাণ হয়ে রূপান্তর ঘটেছে যান্ত্রিক দানবে।অনুভূতি বিলুপ্তিলাভ করেছে। বেঁচে থাকার নাম হয়েছে এক সুতীব্র যন্ত্রণা। আরো একবার নিজের ভাগ্যচক্রের অভিশাপে একই পরিণতি বরণ করতে নারাজ আসমান।একজনকে সে রক্ষা করতে পারেনি,কিন্তু অপরজনের জীবনে সে কোনোদিন একজন ব্যর্থ পিতার তকমা লাগতে দেবেনা।যে দীপ্তি তার অমানিশার দুনিয়ায় সুখের কিরণ ছড়িয়েছে,তার তরে নিজের সর্বোচ্চটুকু বিলিয়ে দিতে কোনোপ্রকার কুণ্ঠাবোধ নেই হিমালয়ের।প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে। পতন নয়, এবার সে বিজয় সুনিশ্চিত করে তবেই প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।
একে একে রেসিং ট্র্যাকে উঠে আসতে দেখা গেলো প্লেয়ার এক্স,প্লেয়ার ওয়াই,প্লেয়ার বিটাসহ অন্যান্য প্রতিযোগীদের।প্রত্যেকের নিকটই রয়েছে অ*স্ত্র।তাদের আবির্ভাবে এখন যেন আর বিস্মিতও হচ্ছেনা কেউ।সবকিছুই বর্তমানে পরিষ্কার।সম্পূর্ণ রেইসটি আদতে ছিল একটি ধোঁকাবাজি।এই মৃ*ত্যুর খেলা ভ্রম বই ভিন্ন কিছু নয়।প্রত্যেকেই বু*লেটপ্রুফ ভেস্ট পরিধানকৃত,পোশাকের অন্তরালে লুকানো ব্লা*ড পাউচ তাদের মৃ*ত্যুর নাটকটি বাস্তবিক করে তুলতে সাহায্য করেছে।অত্যন্ত যত্ন সহকারে বোনা এক মোহাচ্ছন্ন ইন্দ্রজাল।একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নির্গত করলো দিমিত্রী।এমন অবস্থায়ও কিঞ্চিৎ হাসি লেপ্টে রইলো রাশিয়ানের ওষ্ঠজুড়ে।
– ওয়েল প্লেইড।স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি,তুমি আদতেই জাত খেলোয়াড়।
মাথা কাত করে দিমিত্রীকে লক্ষ্য করলো আসমান।তবে কিছুই উচ্চারণ করলো না।অগ্রসর হলো আরিফিন, কোনোপ্রকার ব্যাখ্যার বালাই পেরিয়ে নিজের পকেট থেকে একটি রিভ*লভার বের করলো, সেফটি লক খোলার মৃদু শব্দের সঙ্গে তার কন্ঠস্বর গর্জে উঠল,
– ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট,মিস্টার দিমিত্রী ভলকভ।
স্থির চেয়ে রইলো দিমিত্রী,পরক্ষণেই সামান্য হেসে সম্মতি জানালো,
– অবশ্যই।তবে তার আগে….
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাশিয়ান গ্যাংস্টারের মুষ্টিবদ্ধ হাত আছ*ড়ে পড়লো আসমানের মুখ বরাবর।পশ্চাৎ বেগের দরুণ কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো আসমান, ডান হাতখানি উঠে এলো নাকের উপর।পাশে থাকা নিহাদের ভ্রু কুঁচকে এলো,এক ঝটকায় পা তুলে মোক্ষম এক লা*থি হাঁকালো দিমিত্রীর বাহু বরাবর।সেটি চেপে ধরে পিছিয়ে আসলো গ্যাংস্টার।নিহাদ তৎক্ষণাৎ মনোযোগ দিলো আসমানের উপর।
– ভাই,ঠিক আছো?
মাথা ঝাঁকালো আসমান।একটি জোর প্রশ্বাস টানলো। তীক্ষ্ণ নয়ন তুলে তাকালো দিমিত্রীর উদ্দেশ্যে।
– যদি তুমি ভেবে থাকো তুমি জিতে গিয়েছ,তবে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করবে।ডিড ইউ ফরগেট দ্যা নেইম কায়সার অলরেডি?
দাঁতে দাঁত ঘষে ক্রোধ নিবারণ করে ব্যক্ত করলো রাশিয়ান বান্দা।তাতে শিরদাঁড়া টানটান করে দন্ডায়মান হলো আসমান।হাতের আঙ্গুল তার পৌঁছলো নিজের মাস্কে।
– না..!
হিসিয়ে উঠলো নিহাদ,ক্ষিপ্র বেগে এগোলো তার বাহু।কিন্তু সম্ভব হলোনা।মাস্কটি ছুঁড়ে মাটিতে ফেললো আসমান।উদ্ভাসিত হলো তার বিভীষিকা খচিত মুখমন্ডল।উপস্থিত প্রত্যেকে এক ঝটকায় যেন স্থির হয়ে পড়ল সম্পূর্ণ। দিমিত্রী এবং তাকে ধরে রাখা আরিফিন, উভয়ে নিজেদের হৃদযন্ত্র থমকে যেতে অনুভব করলো।দৃষ্টি আবদ্ধ রইলো তাদের আসমানের চোয়ালজুড়ে।পুষ্ট অধরের দুপাশ বেয়ে চোয়াল চি*রে গিয়েছে দুইটি সেলাইয়ের দাগ।স্থায়ী নি*ষ্ঠুরতার নিদর্শন।অত্যন্ত ভয়া*নক আস্ফালন।ইচ্ছা হয় দৃষ্টিকে সরিয়ে নেয়ার।তবুও কেউই পলক পর্যন্ত ফেলার দুঃসাহস অর্জন করতে সক্ষম হলোনা।
এক পদক্ষেপ এগোলো আসমান।নাক বেয়ে গড়িয়ে নামা র*ক্তের ক্ষীণ ধারা বৃদ্ধাঙ্গুলে মুছে নিলো,অধর কুঞ্চিত হলো তার অব্যক্ত অনুভবে।আরো এক পা এগিয়ে নিকটবর্তী হলো শ*ত্রুর।ঝুঁকে এলো নিকটে।আরিফিন অনুভব করলো,সে হাত দিয়ে দিমিত্রীর যে বাহু চেপে ধরে রেখেছে, সেটি কম্পিত হচ্ছে।ব্যাপারটি আসমানেরও নজরে এলো। কৌতুকহাসি প্রস্ফুটিত হলো তার চেহারায়।ওই বিভীষিকার মাঝে তা ঠেকলো এক অদ্ভুত অশুভ মোহের ন্যায়।
– হোয়েন আই সেইড আই অ্যাম দ্যা মনস্টার, আই ডিড নট লাই ভলকভ।
বজ্রকন্ঠস্বর শিহরণ খেলিয়ে দিলো দিমিত্রীর।অজান্তেই একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো সে।কপালে জমলো বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা। আরো একটু ঝুঁকলো আসমান,শত্রুকে সম্পূর্ণ কোণঠাসা করে ফেললো।
– এই দানবমূর্তির ভাস্কর কায়সারকে কিভাবে ভুলি বলুন?
উপলব্ধিতে দিমিত্রীর ভ্রুজোড়া তীব্র কুঞ্চন ধারণ করলো।আসমানের এই কলঙ্ক তবে, রাফার অবদান?বিষয়টি সম্পর্কে সে অবহিত ছিলোনা।ঠিক কেমন অনুভূত হলো অন্তরে, তা সে বুঝতে সক্ষম হলোনা।তবে এটুকু বোধগম্য হলো,আসমানের এবং তার স্ত্রী রোযার রাফাকে অত্যধিক মাত্রায় ঘৃণা করার কারণ মোটেও অমূলক নয়।কিন্তু সে কি রাফাকে ঘৃণা করতে পারছে?উহু,পারছেনা!এখানেই হয়ত দিমিত্রীর পতন।এতটাই কি তার ভালোবাসার গভীরতা?হয়ত হ্যাঁ, কিংবা হয়ত না।
আসমান কিছুক্ষণ নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলো দিমিত্রীকে।তার দৃষ্টি মিলিত হলো আরিফিনের সঙ্গে।মাথা দোলালো ইন্টারপোলের অফিসার,তাতে বেপরোয়া ভঙ্গিতে নিজের নয়নের তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি করলো আসমান।একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রাশিয়ান বান্দাকে ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য ছেড়ে পাশে সরে দাঁড়ালো আরিফিন।ওইটুকুই যথেষ্ট।অমানিশা নিজের বলিষ্ঠ বাহুর জোরালো আ*ঘা*তে দিমিত্রীকে ছিটকে ফেললো মাটিতে। পরক্ষণেই তার তলপেট বরাবর ঘা*ত হা*নলো।কুঁকড়ে গেলো দিমিত্রী,তলপেট চেপে ধরলো তীব্র য*ন্ত্রণায়।উপস্থিত অন্যান্য অফিসারগণ এহেন দৃশ্যে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এগোতে গেলো,কিন্তু দলপতি আরিফিনের ইশারায় নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকতে বাধ্য হলো।
– যতটা মানসিক যন্ত্রণায় তুই আমার জ্যোৎস্নাকে রেখেছিস,তার জন্য শুধুমাত্র আত্মসমর্পণ যথেষ্ট নয়।
আক্রোশ ঝরে পড়ল আসমানের কন্ঠে, ঘা*তে প্রতিঘাতে সে র*ক্তা*ক্ত করে তুলতে থাকলো দিমিত্রীকে।কেউ বাঁধা দিলোনা,কেউই না।শুধুমাত্র নীরব পর্যবেক্ষণ করলো।ক্ষমতাধর গ্যাংস্টারও আজ অসহায় হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ।এক অশুভ জগতের মহারাণীর ভালোবাসা তার পতনের কারণ।নারী যেমন জন্ম দিতে জানে,তেমন বিনাশ ঘটাতেও জানে।পরিহাসের হাসি হাসলো দিমিত্রী আপনমনে।তার মা,এক রমণীতেই তার এই পাপের সাম্রাজ্যের সূত্রপাত;এবং তার স্ত্রী,অপর এক রমণীতেই তার সাম্রাজ্যের অমোঘ পতন।ভাগ্যের পরিকল্পনা বোঝে সাধ্য কার?
চট্টগ্রামের সড়কপথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মার্সিডিজ।ড্রাইভিং সিটে রয়েছে হাবিব।পিছনের আসনে পাশাপাশি বসে আছে চারুলতা এবং রোযা।উভয়ের দৃষ্টিই তুলনামূলক শীতল এবং প্রশান্ত।রিয়ার ভিউ মিররে পিছনে অনুসরণরত দুইটি গাড়িকে পর্যবেক্ষণে রাখছে হাবিব। হিটটিমের ছেলেরা নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে পাশাপাশি আসছে তাদের।গাড়ির অভ্যন্তরজুড়ে নৈঃশব্দ্য।শুধুমাত্র আশেপাশের যানবাহনের গতিময় আওয়াজ এবং মানুষের হাকডাক পরিপূর্ণ করে রেখেছে পরিবেশকে।অবশেষে দীর্ঘ নীরবতার পর মুখ খুললো রোযা।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ইন্টারপোল?আসমান এত বড় চালটা কিভাবে দিতে পারলো আমি বুঝে উঠতে পারছিনা।
রোযার বক্তব্যে মৃদু হাসলো চারুলতা।মাথা ঝুঁকিয়ে নিকটবর্তী হয়ে জানালো,
– ভাইয়া পরিকল্পনা করেছে,আর ড্যাড বাস্তবায়ন করেছে।
বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকালো রোযা,চারুলতার অধর থেকে হাসি মুছে যায়নি বরং আরো বিস্তৃত হয়েছে।
– কাম অন রোযা,তুমি রেমান পরিবারের বউ,রিমেম্বার?এনিথিং ফর ইউ।ড্যাড শুধুমাত্র নিজের কানেকশন কাজে লাগিয়েছে,প্লাস,সরকারের বাধ্যগত কিছুটা সাহায্য।
রোযার অধরজোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে রইলো বিস্ময়জনক উপলব্ধিতে।তাকে উদ্ধার করার জন্য গোটা রেমান পরিবার ঠিক কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে তা চিন্তা করলেই কেমন এক প্রগাঢ় অনুভূতি হচ্ছে অন্তরে।
একটা সময় ছিল,যখন পৃথিবীতে একমাত্র দাদু ব্যাতিত পরিবার বলতে কেউই ছিলোনা রোযার।সেই প্রাণধিক প্রিয় দাদুও যখন ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমালো,তখন রোযা এই ধরিত্রীর বুকে অবহেলায় জন্মানো এক ঘাসফুলে পরিণত হলো।তার মৃ*ত্যুতে দুঃখিত হওয়ার মতন ব্যক্তিও ছিলোনা।কিন্তু আজ,ভাগ্য তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে?এক পরিবার,এক সুখের ছাউনী,ভালোবাসার আশ্রয়।আসমানের মতন স্বামীর ভালোবাসা,নিহাদের মতন ভাইয়ের প্রেরণা, চারুলতার মতন বোনের সঙ্গ,বিলাল রেমানের মতন পিতার আশ্রয়স্থল,কোনকিছুর অভাব নেই রোযার।সে আজ সত্যিই পরিপূর্ণ।অতীত বর্তমানের ভাবনাগুলো অজান্তেই তার নয়নে অশ্রুর সঞ্চার ঘটালো।
বেশ কিছুক্ষণ পর।
হাবিব মার্সিডিজ নিয়ে এক নির্জন স্থানে পৌঁছলো।সামনে প্রান্তর।যার উপর দন্ডায়মান একটি হেলিকপ্টার।ধাতব আকাশযানটির দেহজুড়ে খচিত বিশালাকৃতির ইংরেজি ” আর ( R ) ” অক্ষরটি।গাড়ি থামতেই সিটবেল্ট খুলে নেমে এলো চারুলতা।আশেপাশে তাকালো।তাকে অনুসরণ করলো রোযাও।হাবিব দরজা খুলে হেলান দিয়ে বললো,
– আপনারা সামনে যান ম্যাম।দ্রুতই ঢাকায় পৌঁছানো জরুরী।স্যার সেখানে আছেন,আপনারা নিরাপদ থাকবেন।
মাথা দুলিয়ে উভয় রমণী হেলিকপ্টারের দিকে এগোলো।বাহির থেকে চালকের আসনে ইতোমধ্যে অপেক্ষারত পাইলটকে নজরে আসছে।সর্বপ্রথম নিকটে পৌঁছলো চারু,শক্ত হাতে হেলিকপ্টারের দরজা স্লাইড করে খুলতে খুলতে বললো,
– রোযা এসো তুমি….
সমাপ্ত করা সম্ভব হলোনা।জোর এক ঝটকায় চারুলতা রীতিমত শূন্যে উঠে খানিকটা দূরে ছিটকে পড়লো।আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকালো রোযা,ক্ষণিকের জন্য তার মস্তিষ্ক কিছুতেই বুঝতে সক্ষম হলোনা ব্যাপারটা।পরমুহুর্তেই দৃশ্যটি স্পষ্ট হলো।হেলিকপ্টারের আসনে বসমান রমণীর মোহময় দৃষ্টি নজরে এলো।আপাদমস্তক কালো বডিকোন গাউনে আবৃত লাস্যময়ী শরীর,ঠিক উরুর কাছ থেকে বস্ত্রটি দুফাঁক হয়ে নেমে এসেছে একেবারে গোড়ালি অবধি।যার জন্য ধবধবে মসৃণ উরু সম্পূর্ণ দৃশ্যমান।এক হাতে একটি সিগারেট, ধোঁয়াটে হয়ে রয়েছে তার চারিপাশ।অপর হাতে কাঁধে ঠেকানো একটি বেসবল ব্যাট।যার মোটা প্রান্তে কয়েক ফোঁটা র*ক্ত চিকচিক করছে!
রাফা কায়সার!
ঝট করে চারুলতার দিকে ফিরে তাকালো রোযা। বেচারী সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে।মাটিতে কনুই ঠেকিয়ে উঠে বসেছে,দীঘল কেশরাশি তার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।কপালের দিকটা উষ্ণ র*ক্তধারায় আচ্ছন্ন।রোযার কেমন অনুভূত হলো বলতেও পারবেনা।সর্বাঙ্গ তার ক্রোধে ঝনঝন করে উঠলো যেন। অপ্রত্যাশিতভাবে হাত বাড়িয়ে রাফার বেসবল ব্যাটখানি পাকড়াও করলো,জোরালো এক ঝটকায় রীতিমত হিঁচড়ে ফেললো হেলিকপ্টার থেকে মাটিতে।ওই অবস্থায়ও খিলখিলে অশুভ এক হাসির ধ্বনি তুলে রাফা কায়সার বিড়বিড় করলো,
– নট ব্যাড।
ততক্ষণে সটান উঠে দাঁড়িয়েছে চারুলতা।রোযা এবং রাফাকে মুখোমুখি লক্ষ্য করে দ্বিতীয় চিন্তা বাদেই জোর ছুট লাগালো সে।তবে প্রস্তুত ছিল তার প্রতিপক্ষ।রাফা বিড়ালের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তেই তাকে দুহাতে ঘুরিয়ে উল্টো মাটিতে আছ*ড়ে ফেলে উপরে চড়ে বসলো রাফা।মোক্ষম কতক ঘু*ষি হাঁকালো সুদর্শনার মুখশ্রী লক্ষ্য করে।তখনো তার অধরের কোণে সিগারেটখানি ঝুলছে। চারুলতা হাতের তালুতে ঠেকিয়ে দিলো একের পর এক আ*ঘা*ত।অতঃপর রাফার তলপেট বরাবর ঘু*ষি দিয়ে নুইয়ে ফেললো লাস্যময়ী শরীরখানি।অদূর থেকে দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে দ্রুতই ছুটে এলো হাবিব।রাফা কায়সার এখানে কি করছে?কিভাবে এলো সে?চারিপাশে তো গার্ড থাকার কথা!তবে কি এই রমণী সকলকে খ*তম করে দিয়েছে?উপলব্ধির তীব্র শিহরণ খেলে গেলো হাবিবের শিরদাঁড়া বেয়ে। দ্রুতগতিতে পকেটে হাত গুঁজলো ফোনের আশায়।সম্ভব হলোনা।পিছন থেকে জোরালো এক ধাক্কায় তাকে পতিত হতে হলো ভূমিতে।মাথা তুলে ফিরে তাকাতেই সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো হাবিব।
চারিপাশ থেকে তাদের ক্রমশ ঘিরে ফেলতে আরম্ভ করেছে একটি সশ*স্ত্র দল।প্রত্যেকের পরিধানে বাদামী জ্যাকেট,মুখমন্ডল আবৃত ফেইস মাস্কে।কারো হাতে হকিস্টিক, কেউ বা ধরে রেখেছে লম্বাটে ধাতব চেইন, কারো হাতে ছু*রি,কেউ আবার সত্যিকারের রিভ*লভার।বনবন করে ঘুরিয়ে চলেছে প্রত্যেকে তা।ধাতব শব্দে চারিপাশ এক লহমায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
আবারো এক হাসির ঝিলিক।তলপেট চেপে ধরে যন্ত্রণার মাঝেও হাসতে হাসতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আঁধারের মহারাণী।হাবিব, চারুলতা এবং হতবিহ্বল রোযার উদ্দেশ্যে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি ফেলে জিভ দিয়ে নিজের টকটকে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে নিলো। সিগারেটখানি দূরে ফেলে দিয়ে লাইটার তুলে নতুন একটি জ্বাললো।তামাকের ধোঁয়াটে গন্ধে পরিবেশ যেন দূষিত হয়ে পড়ল।তার দলবল ততক্ষণে গোলাকৃতির বলয় তৈরি করে ঘিরে ফেলেছে স্থানটি,মধ্যিখানে আবদ্ধ প্রত্যেকের পানে নিবদ্ধ করেছে নিজ নিজ ধারালো পশুত্বঘেরা দৃষ্টি।না চাইতেও একটি ঢোক গিলে চারিদিকে চেয়ে পরমুহুর্তে রাফাতে আপতিত হলো রোযার দৃষ্টি।একরাশ ধোঁয়া বায়ুতে নির্গমন করে রাফা ফিরে তাকালো,তীর্যক অধরে জানালো,
– দিস ইয কল্ড,গ্র্যান্ড এন্ট্রি…. কিটেন!
কক্ষটি অন্ধকারাচ্ছন্ন।স্বচ্ছ জানালার ভারী পর্দা টেনে দেয়া।তার ফাঁকফোকর দিয়ে নগরের রং বেরংয়ের বাতির বহর দৃশ্যমান।ভোররাত প্রায়।নব্য দিনের সূচনায় রবির আগমন শুধুমাত্র সময়ের দাবী।পাঁচজন ছায়ামূর্তি কক্ষের চারিপাশে অবস্থান করছে।দুহাত পিছনে বাঁধা, শকুনে দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ।একটি চেয়ার,তাতে বসা রোযা।দুবাহু তার চেয়ারের পিছনদিকে নিয়ে হ্যান্ডকাফে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।দূর্বল রমণীমাত্রের এর অধিক কোনো শৃঙ্খলের প্রয়োজন নেই।মাথাটা তার ঝুলে আছে মেঝের দিকে,ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বুক উঠানামা করছে সমানতালে।শব্দ নির্গত হচ্ছেনা কোনো, শুধুই নৈঃশব্দ্য।
ক্যা….চ…. ক্যাঁচ!
সেই নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করে বিপরীত প্রান্তে একটি আরামকেদারা দুলছে। ধূমপানরত রাফা কায়সার তাতে অতি আলসী ভঙ্গিতে আসীন।এক হাতে কোহিবা সিগার,অপর হাতে স্বর্ণালী বুদবুদপূর্ণ হুইস্কি।বরফকুচিগুলো সমুদ্রে ভাসমান হিমশৈলীর ন্যায় প্রবাহিত।তাতে রমণী অধর ছোঁয়ালো, ধীরস্থির দীর্ঘ চুমুকে বরফের স্পর্শে ক্রমশ শীতল হয়ে এলো মসৃণ অধরজোড়া।তৃপ্ত সে,তবে সেই তৃপ্তি পূর্ণতা পাবে আর কিছুক্ষণের মাঝেই।
– এটুকুতেই মুষড়ে পড়লে…কিটেন?
মাথা তুললো রোযা,বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা জমেছে তার মুখমন্ডলজুড়ে।চিকচিক করছে মৃদু আভায়। অর্ধভগ্ন অবয়ব,তবে কোথাও নেই বিন্দুমাত্র দূর্বলতার চিহ্ন।এক দীর্ঘ প্রশ্বাস টানলো রোযা,পরক্ষণেই কিঞ্চিৎ আবর্তিত হলো তার ওষ্ঠযুগল,এক চিলতে হাসির রেখায়।
– প্রার্থনা করছিলাম,যেন আপনার পরপারের জীবন দূর্বিষহ হয়।
জবাবের বিপরীতে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো রাফা।তার মধুমিশ্রিত কন্ঠে তা শোনালো সাবলীল এবং মসৃণ। পুরুষ হৃদয়মাত্র আবেশিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।পুনরায় কোহিবা সিগারের স্বাদ আস্বাদনে মনোনিবেশ করলো রাফা,অতঃপর বললো,
– এবং আমি প্রার্থনা করছি তুমি যেন বেহেশতবাসী হও।
মাথা কাত করলো রোযা,কৌতূহল তার দৃষ্টিজুড়ে।রাফা তাতে বিনোদিত হয়ে যুক্ত করলো,
– কারণ দোযখ শুধুমাত্র আমার এবং আমার শুভ্রতার!
ফাঁক হলো রোযার উভয় অধর,মুহূর্তের জন্য কোনকিছু উচ্চারিত হলোনা।পরক্ষণেই তার কন্ঠ এক ভিন্ন মাত্রায় ধ্বনিত হলো,প্রভাবশালী এক আবহ সেই স্বরজুড়ে,
– স্রষ্টার পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করবার সাধ্য কার?
রাফা নয়ন তুলে তাকালো,
– আমায় ধার্মিক জ্ঞান দিচ্ছ?সিরিয়াসলি?
– উহু।শুধু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি,আপনি কত বৃহৎ একজন জাদুকরী।রূপকথার লাবণ্যময়ী ডাকিনীদের সঙ্গে আপনার বহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।স্নো হোয়াইট গল্প পড়েছেন?আজীবন তাকে কীভাবে নি*র্যাতিত করে এসেছে তার সৎ মা?অবশেষে তার পতন ঘটেছিল।সেই অমোঘ পতন ডেকে এনেছিল তার রূপের আসক্তি।রূপকথা শুধুমাত্র বিনোদনের উপাখ্যান নয়, শিক্ষণীয়ও বটে।আসক্তি কোনোকালেই ভালো কিছু বয়ে আনেনা কায়সার!
রোযার কথা খুব বেশি বিদ্বেষপূর্ণ ছিলোনা।তবুও রাফার অন্তরমাঝে কোথাও একটা ধৈর্য্যের সীমারেখাখানি চট করে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।তড়াক করে আরামকেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রাফা,শক্তভাবে চেপে ধরলো রোযার চিবুক,লালচে দাগ পড়ে গেলো বেচারীর চোয়ালজুড়ে।
– তোমরা ভালো মানুষেরা সর্বদা অপরকে খল চরিত্রে পরিণত করে নিজেদের উদার দেখাতে চেষ্টা করো।তুমি শিক্ষিতা,আমি নই?তুমি মানবতার ফেরিওয়ালা,আর আমি মানবতার দুশমন?এ কেমন বৈষম্য?
রাফার শরীর থেকে তামাটে বাস ভেসে এলো,তাতে কাশির উদ্রেক হলো রোযার।তবুও তাকে ছাড়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখালো না রমণী,বরং দ্বিগুণ শক্তিতে চেপে ধরে রীতিমত ঝাঁকিয়ে শুধালো,
– কেনো?কেনো শুধু তোমরাই ভালো আর আমি খারাপ?সবটুকু ভালোবাসা তোমাদের জন্য,আর তলানির উচ্ছিষ্ট ঘৃণাটুকু আমার প্রাপ্য?শুধুমাত্র আমি মানুষ হিসাবে বিপরীত বলে?আমার কি অনুভূতি নেই?আমার কি বোধ বুদ্ধি নেই?
রোযা কিছু উচ্চারণ করতে গেলেও রাফার অতর্কিত আবেগ প্রকাশে থমকে গেলো।এই মেয়েটিকে এর পূর্বে কোনোদিন এই ধরনের আচরণ করতে দেখেনি সে।সর্বদাই প্রশান্ত এক বিষাক্ত অস্তিত্ব রাফা।কিন্তু বর্তমানে আইলাইনার টানা ওই টানা টানা নয়নজোড়াতে অবাধ্য কিছু অশ্রুফোঁটা স্পষ্ট।এমন এক প্রভাবশালী অস্তিত্বের হঠাৎ ভগ্নদশা রোযাকে ক্ষণিকের জন্য বাকরুদ্ধ করে দিলো।হাতের হুইস্কির গ্লাস দূরে ছুঁড়ে ফেললো রাফা। কাঁচের পাত্রটি টুকরো টুকরো হয়ে স্বর্ণালী তরল ছড়িয়ে পড়ল মেঝে জুড়ে।দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরলো রাফা,চিৎকার করে উঠল,
– আমি কি বলেছিলাম?আমি কি ওদের বলেছিলাম আমায় এমন করে মানুষ করতে?আমি কি ওদের বলেছিলাম আমায় কুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে?আমি তো চাইনি!আমি এমন চাইনি!কিন্তু আমায় এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে!
রাফাকে রীতিমত বিকারগ্রস্থ দেখাচ্ছে। কেশরাশি তার এলোমেলো হয়ে পড়েছে, গ্রীবাজুড়ে ঘামের ফোঁটা, নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়া তীব্রতর,যেন শ্বাসকষ্টে ভুগছে।হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকলো রোযা। রাফার কথার অর্থসমূহ বোধগম্য হচ্ছেনা তার।সহসাই রমণী এগিয়ে এসে তার গ্রীবাদেশ আঁকড়ে ধরলো,সন্নিকটে ঝুঁকে বললো,
– ওই লোকটা আমার সঙ্গে কি করেছে জানো?কোথায় কোথায় স্পর্শ করেছে জানো?কত বয়স ছিল আমার বলতো? দশ?এগারো?কি বুঝতাম আমি স্পর্শের? লোকটাকে ড্যাডের চাইতেও বেশী ভালবাসতাম।আপন চাচা হয়তো!কিন্তু কি করলো সে?অন্ধকার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার বাহানায় আমার সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দিতো জানো?মাঝে মাঝে কাপড় খুলতে বলতো,গরম লাগছে তো!চেয়ারে বসিয়ে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতো আমার উদাম শরীরে,সুখ প্রস্রবণ খেলে যেতো তার শরীরে!কাঁপুনি ধরে যেতো,আমার শরীর স্পর্শ করবার আকাঙ্ক্ষায় আকুলি বিকুলি করতো আর আমি….
– চুপ!চুপ করুন আপনি!আমি আর শুনতে চাইনা!
রোযা পাল্টা চিৎকার করে উঠতেই রাফা তলপেট চেপে ধরে হাসতে আরম্ভ করলো।রীতিমত গগনবিদারী এক হাসি। রোমকূপ থেকে রোমকূপে শিহরণ খেলানো এক অনুভূতি। ঘাড়ের নিকট রোমসমূহ যেন বৈদ্যুতিক আবেশে দন্ডায়মান হয়ে গেছে।মুখের ভেতর তেঁতো স্বাদ অনুভব করলো রোযা,ঢোক গিললো।হুট করেই দিমিত্রী ভলকভের একটি কথা তার অন্তরে প্রতিধ্বনিত হলো,
” জগতের প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব একটি গল্প রয়েছে। তা হোক সে মানুষ দেবতুল্য কিংবা শয়তান স্বয়ং। ”
শয়তান স্বয়ং?রাফা কায়সার?তবে কি দিমিত্রী এই গল্পের কথাই বলছিলো?যা এককালের কোমল শিশু রাফাকে সম্পূর্ণ ধ্বং*স করে দিয়েছে?
” কেউ কখনো খলনায়ক হয়ে জন্ম নেয়না,এই পৃথিবী তাকে খলনায়কে রূপান্তরিত করে।”
যদি আসমান ভাগ্যের অভিশাপে খলনায়কে রূপান্তরিত হতে পারে,তবে রাফা কায়সার কেনো নয়?পার্থক্য কি উভয়ের মাঝে? দ্বিধাদ্বন্দে রোযার হৃদযন্ত্র তেজস্বী থেকে তেজস্বীতর হতে থাকলো।মাথাটা খানিক চক্কর দিলো।গা গুলিয়ে ওঠা ভাব।এক ভয়াল উপলব্ধি!রাফা কায়সার আর আসমান কি তবে এক?
– কি ব্যাপার?ভয়ে পেয়েছ…. কিটেন?
ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে নিতে মুখ তুলে রাফার উদ্দেশ্যে তাকালো রোযা।দুবাহু বুকে ভাঁজ করে রেখে অধরমাঝে সিগার আঁকড়ে চেয়ে আছে তার দিকে।এক মুহূর্তের জন্য রাফাকে ভিন্ন নজরে দেখতে বাধ্য হলো রোযা।এই রমণী আজ যে অশুভ অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে,তার দায় কার?
– ড্যাড ছিলেন খুব কঠোর মানুষ।যেদিন সে মামের সঙ্গে একঘরে থাকতো,তার পর কয়েকদিন মাম বিছানাই ছাড়তে পারতো না।আমি নিজের চোখে দেখেছি। মামের গলায় লাল টকটকে বাঁধনের চিহ্ন,পুরো বুকের অংশ ক্ষ*ত বিক্ষ*ত যেন নরপশু হা*ম*লা করেছে!একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিলাম,ভেবেছিলাম আমার ড্যাড বুঝি মামকে মা*রধর করে!কিন্তু সেদিন রাতে আমি যা দেখেছি…..
” কি দেখেছেন?” প্রশ্নটি নির্গত হলোনা রোযার কন্ঠ বেয়ে।প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার।বুকের উপর এক ভারী চাপ জেঁকে বসেছে যেন।মাথা নুইয়ে পড়লো তার,কিন্তু রাফা আজ থামবার পাত্রী নয়।যেন হুট করে জোয়ারে বাঁধ ভেঙেছে,বন্যার স্রোতের মতন এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে এই খলনায়িকার আবেগী আস্ফালন।
– আমার ভাইটাও একটা কুলা*ঙ্গার।চোদ্দ বছর বয়সে দুই দুইটা মেয়ে বান্ধবীকে টেনে এনেছিল নিজের বেডরুম পর্যন্ত।তোমার কি মনে হয়?বাড়ির কেউ দেখেনি?অবশ্যই দেখেছে।কায়সার এম্পায়ারে কোনোদিন কিছু অজানা থাকেনা।কিন্তু সবাই স্রেফ না জানার ভান ধরেছে। মামকে জিজ্ঞেস করেছি,বললো কি জানো?ছেলেরা একটু আধটু করতেই পারে,বয়সটাই অমন। আর ড্যাড?হাহা…বললো রাস্তার মেয়েগুলো তার ছেলের বিছানা গরম করা পর্যন্তই থাকবে।
– দোহাই লাগে আপনি একটু চুপ করুন!
এবার রোযার কন্ঠস্বর নিষ্প্রাণ শোনালো।রাফা মাথা কাত করে সিগারে দীর্ঘ টান দিয়ে বিড়বিড় করলো,
– সংকোচ হচ্ছে?আমারও হয়েছিল।কিন্তু কি জানো?আমার পৃথিবীতে ওসবই ছিলো স্বাভাবিক। উইম্যান ইয জাস্ট আ টয় ফর আ ম্যান,ভোগ্যপণ্য।এই ছিল আমার পারিবারিক শিক্ষা।বড় হওয়ার পর ভাবলাম,উল্টোটা কেনো নয়? নারী পুরুষের খেলার সামগ্রী হতে পারলে পুরুষ কেনো নারীর খেলার সামগ্রী হতে পারবেনা?আমার বন্ধুরা খুব চমৎকার কিছু বই উপহার দিয়েছিল আমাকে। একা একা রুমের কোণায় বসে সব খুঁটিনাটি পড়তাম আমি।আর জানতাম,পৃথিবী কোথায় পৌঁছে গিয়েছে,এবং আমরা কোথায় আটকে আছি!সেই উপলব্ধির পর আমি প্রথম আংকেলকে নিজের রুমে ডেকে এনেছিলাম।প্রচণ্ড তৃষ্ণা হচ্ছিল অন্তরে,পুরুষকে নিয়ন্ত্রণের তৃষ্ণা!যে কাজ আমি আমার ড্যাডকে মামের সঙ্গে করতে দেখেছি,ঠিক তাই তাই আমি পুরুষের সাথে করতে চাইতাম।আর আংকেলকে আমি সেদিন…..
– আপনি এক বদ্ধ উন্মাদ রাফা কায়সার!
রোযার দ্বিতীয় চিৎকারে রাফার শরীরে ভূকম্পন খেলিয়ে তীব্র হাসি খেলে গেলো।তার আওয়াজ বারংবার প্রতিধ্বনিত হলো দেয়ালে দেয়ালে।দুই হাতে মাথার দুপাশের চুলের গোছা মুঠি করে ধরে রাফা হাসতে হাসতে বললো,
– ইউ আর রাইট! আই অ্যাম আ ফা*কিং সাই*কোপ্যাথ! আই ডোন্ট ফিল, আই জাস্ট ওউন হোয়াটস মাইন!
ভীষণ আগ্রাসী শোনালো রাফার কন্ঠস্বর,এক লহমায় প্রফুল্লতা দূরীভূত হয়ে তার চেহারায় ভর করলো ক্রোধ।এক জ্ব*লন্ত শিখা প্রতিফলিত হলো দৃষ্টিমাঝে।
– কিন্তু আমাকে এমন হতে কারা বাধ্য করেছে রোযা?কে এমন সংস্কারের বীজ পুঁ*তে দিয়েছে অন্তরে?দায়ী কি শুধুই আমি?আমার মাম,ড্যাড,ভাই,আংকেল,বন্ধু বান্ধব,এই সমাজ,এই দেশ,এই পৃথিবী….তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই?
রোযার চেয়ারের হাতলে দুহাত রেখে ঝুঁকলো রাফা, বরাবর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে শুধালো,
– আমি যে বই পড়ে জাগতিক অশুভতা শিখেছি,সেই ঔপন্যাসিকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই?তাদের কলম কি দায়ী নয় এই মানসিক দ্বন্দ্বের পিছনে?এই রাষ্ট্র,এই সাহিত্য,এই চিত্রকর্ম আমাদের কি শিক্ষা দিচ্ছে রোযা?শুধুই সাবধানতা?নাকি…..শিক্ষার অন্তরালে একেকজন মানুষকে একেকটি পিশাচে রূপান্তর করার সূক্ষ্মতর পরিকল্পনা?
স্তব্ধ রোযা। স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র খেদ নেই তার।রাফা কায়সার আজ তাকে অবচেতন হৃদয়ে হলেও এক মহান শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে।পারিবারিক সংস্কার কিংবা কলমের জোর কতখানি,তার বাস্তব উদাহরণ আজ তার সম্মুখে দন্ডায়মান।আজকের এই রাফা কায়সারের পিছনে মানবজাতির অধঃপতনের হাত সর্বাধিক!
দীর্ঘ এক প্রশ্বাস টানলো রোযা।হঠাৎ করেই তার বুকে বড্ড প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে।কিসের প্রশান্তি?এক নব্য উপলব্ধির।রাফা কায়সার দূরে সরে দাঁড়ালো,উল্টো ঘুরে বিপরীত প্রান্তে এগিয়ে নতুন এক হুইস্কির গ্লাস তুলে নিলো।তাতে বোতল থেকে কিছুটা তরল ঢালতে ঢালতে বললো,
– এতসব নিকষ আঁধারের মাঝে যখন এক টুকরো শুভ্রতা এলো,তখন তাকে দর্শন না করে থাকা সম্ভব?
টেবিলে হেলান দিয়ে রোযার দিকে ফিরে গ্লাসে চুমুক দিলো রাফা।অতঃপর সেটি উঁচিয়ে ধরে জানালো,
– ঠিক ধরেছ কিটেন।আমি আসমানের কথা বলছি।স্কুল কলেজের বন্ধু বলো,ক্লাব বলো,রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যেকোনো পুরুষ বলো,আমার দিকে ফিরলেও অনুভূত হতো যেন ওই দৃষ্টি আমার অবয়বে নয়,বরং অবয়ব ভেদ করে চলে যাচ্ছে অভ্যন্তরের গোপনীয়তায়।লালসা,কামনা,এক অবাঞ্ছিত বাসনা।পুরুষ মাত্রই লালসার দাস!আমার বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিলো ওই একটিমাত্র অস্তিত্ব। যার নজরে কোনোদিন উন্মাদনা তো দূরে থাক,স্নেহ কিংবা সম্মান ব্যাতিত ভিন্ন কিছু উপলব্ধি করিনি।শুভ্রতা আশেপাশে থাকলেই অনুভূত হতো এক নিরাপদের আবেশ, উষ্ণতায় জড়ানো মোহময় নিবাস।কঠোর সে,শীতল সে, অনুভূতিশূন্য মেশিন সে,কিন্তু….কামবাসী কাপুরুষ নয়!সে জানতো,একজন নারীকে কিভাবে সম্মান দিতে হয়।এবং আজ পর্যন্ত,সে নিজের ওয়াদা পালন করে এসেছে।আমাকে ক্রোধপূর্ণ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি।এমন শুভ্রতার প্রতি আসক্ত না হয়ে কি পারা যায় বলো?ঠিক যেমন তুমি তার অস্তিত্বে আসক্ত,তেমন আমিও…..
– আসক্তি নয়,ভালোবাসা।
রোযার উত্তরে থমকালো রাফা।কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে তাকালো প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশ্যে।
– আসমান আমার ভালোবাসা।আসক্তি কোনো অনুভূতি নয়,অভিশাপ। আর এখানেই আপনার পতন রাফা।যদি তা অনুভূতি হতো,আপনি কোনোদিন চন্দ্রকে গ্রাস করার অভিলাষ রাখতেন না।শারীরিক উপভোগ নয়,তার অন্তরের ভালোবাসা চাইতেন।কিন্তু আফসোস,আমি আপনাকে কোনোদিন ভালোবাসার দাবী রাখতে শুনিনি।শুনেছি শুধুমাত্র গ্রাস করার আকাঙ্ক্ষা।
এবার যেন রাফার স্তব্ধ হওয়ার পালা।রোযার বিহ্বলতা দূরীভূত হয়েছে। অভিব্যক্তিজুড়ে এক আত্মবিশ্বাসী অনুভব, নয়নজোড়া সুস্থির।এমন দৃষ্টি এবং অবয়বে উচ্চারিত প্রত্যেকটি বাক্যই যেন সংবিধানের নীতির ন্যায়,না মানা অসম্ভব!
– আপনার বর্তমানের পিছনে আপনার গোটা পরিবার, গোটা সমাজের দায় রয়েছে।সত্যি কথা।আপনি যে মানসিক অস্থিতিশীলতায় রয়েছেন, তা অনেকাংশে তাদের দান।নিজেকে প্রশ্ন করুন রাফা,আপনার নিজের কোনোই ভূমিকা নেই এতে?একটুও না?এক বিন্দুও না?
শুধুমাত্র কয়েকবার পলক ফেললো রাফা,উত্তর করতে সক্ষম হলোনা। কাঁচের গ্লাসজুড়ে চেপে বসলো তার আঙুলসমূহ।সিগারেট ফুরিয়ে আসছে,তবুও সুখটানের খেয়াল নেই।তার সম্পূর্ণ মনোযোগ রোযার উদ্দেশ্যে আপতিত।কিঞ্চিৎ হাসলো অমানিশার দীপ্তি।বললো,
– উত্তরটা আমিই দিচ্ছি।আপনার পতনের জন্য আপনিই দায়ী রাফা!আপনার পরিবার হয়ত আপনাকে ভুল সংস্কার দিয়েছে, বেঠিককে সঠিক ধরে আপনি বড় হয়েছেন।কিন্তু আপনার স্কুল কলেজ আপনাকে ভুল শিক্ষা দেয়নি।আপনি পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান স্রেফ উপেক্ষা করেছেন,মস্তিষ্কে ঠাঁই দিয়েছেন ওই ধূসর জগৎকে।আপনার বন্ধু বান্ধব যখন আপনাকে বিপথে ঠেলে নিয়েছে,তখন আপনি সাগ্রহে গিয়েছেন।আপনার ক্লাসে নিশ্চয়ই একজন দুইজন এমন শিক্ষার্থী ছিল,যাদের বন্ধু বান্ধব নেই বললেই চলে,সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে নিজের মতন থাকতো,কথা বললে হয়ত নিজের সবটা উজাড় করে দিতো।আপনি তেমন সৎ সঙ্গকে উপেক্ষা করেছেন রাফা।যে আংকেল আপনাকে বারংবার অপবিত্র করেছে,তাকেই আপনি নিজের দাসে রূপান্তর করেছেন।কেনো জানেন?কারণ তাতে আপনি আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন।আপনি আপনার মনোবলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি।সুতীব্র চাহিদায় গা ভাসিয়েছেন।আপনি নিশ্চয়ই জানতেন,জাগতিক দৃষ্টিতে কোনদিকে ভুল আর কোনটিকে সঠিক মনে করা হয়?তবুও আপনি ভুল বেছে নিয়েছেন,কারণ ভুলকে অনুসরণ সহজ!
রাফার অধর ফাঁক হলেও কোনো শব্দ উচ্চারিত হলোনা।তার হাতের কম্পন স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো রোযার।মাথা কাত করে জ্যোৎস্না তাকালো ওই আঁধারের উদ্দেশ্যে,
– এই পৃথিবী আপনাকে নির্বাচনে বাধ্য করেনা,আপনি আপন ইচ্ছায় নির্বাচন করেন।সেই নির্বাচন বেঠিক হলে তার দায় আপনার!নিজের বাসনা চরিতার্থ করে পৃথিবীকে দোষ দিয়ে ভিকটিম কার্ড প্লে করা বন্ধ করুন রাফা!আপনার এই অবস্থার জন্য আপনার দায়বদ্ধতা সর্বাধিক।আর কোন শুভ্রতার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছেন?এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল যে আপনি বোধ হয় সঠিক,আপনার এবং আসমানের মাঝে আদতে কোনো পার্থক্য নেই।উভয়েই পরিস্থিতির শিকার।
কিন্তু বর্তমানে বলছি,না!আপনি এবং আসমান কোনোদিন এক হতে পারবেন না রাফা।আসমান আপনার জীবনের খলনায়ক,ঠিক তেমনি আপনি তার জীবনের খলনায়িকা।পার্থক্য হলো,আসমানের অভিশপ্ত ভাগ্য তাকে ভুল পথে প্রেরণ করেনি।সে হ*ত্যা করেছে, নি*ষ্ঠুর হয়েছে,কেনো জানেন?কারণ ঐসব রাঘব বোয়ালদের কোনোদিন টিকিটাও ছুঁতে পেতোনা আমাদের দেশের আইন কানুন!আসমান একজন খু*নী, একজন ক্রুর ব্যক্তি।কিন্তু কাদের জন্য?আপনাদের মতন কিছু মানুষের মুখোশধারী ন*রপিশাচদের জন্য যাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা এই জগতের নেই।আসমান হয়ত একজন কি*লিং মেশিন হয়েছে,কিন্তু কোনোদিন একজন নারী অসম্মানকারী, পিতাকে উপেক্ষাকারী, স্ত্রীকে নির্যা*তনকারী,ভাইকে পরিত্যাগকারী,বোনকে আ*ঘা*তকারী হয়নি রাফা!এই বোন শুধুমাত্র চারুলতা নয়,আপনিও!
তড়িৎ খেলে গেলো রীতিমত রাফার শরীরে।দূর্বল হয়ে এলো হাঁটুজোড়া। ধপ করে পড়ল সে আরামকেদারার উপর।দ্বিতীয় গ্লাসটিও পতিত হলো মেঝেতে। আরো একবার চুরমারধ্বনি।তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদগিরিত হলো রোযার কন্ঠস্বর,
– আসমান ভুল,আবার আসমান ঠিক।জগতের কোনো মানুষই কখনো একশো শতাংশ সঠিক হয়না।কিন্তু আপনি রাফা কায়সার?আপনি পরিস্থিতির শিকার নন, আপনি পরিস্থিতির দাস!ওই শুভ্রতার নিটল প্রতিজ্ঞার কারণেই আপনি আজও জীবিত রাফা।লজ্জা করেনা আপনার বারংবার তার জীবনকে তছনছ করে দিতে?একজন নারী হয়ে অপর এক নারীর ধ্বং*সে যেদিন আপনি আনন্দিত হয়েছিলেন,সেদিনই আপনার মনুষ্যত্ব বিকিয়ে গিয়েছে।
– শাট আপ!শাট আপ!
রাফার কন্ঠস্বর ক্ষীণ শোনালো,তবুও থামলোনা রোযা।বরং উচ্চকন্ঠে চিৎকার করে উঠল,
– আপনি একজন সাই*কোপ্যাথ,এবং এর জন্য একমাত্র আপনি দায়ী! সো ডোন্ট ইভেন এক্সপেক্ট সিমপ্যাথি!একজন খলনায়ক সৃষ্টির পিছনে শুধুমাত্র এই পৃথিবী নয়,তার নিজস্ব মানসিকতাও সমানভাবে দায়ী! সো স্টপ ফিলিং সরি ফর ইওরসেল্ফ,ইউ আর আ ক্রি*মিনাল ফর ইওর ওউন মিসফরচুন!
– আই সেইড শাট দ্যা ফা*ক আপ!
রাফার হাতের জোরালো আ*ঘা*ত আছ*ড়ে পড়ল রোযার কপোলে।রীতিমত ছিটকে গেলো রোযা, চেয়ারসমেত।শুধুমাত্র পিছনে দেয়ালের বাঁধার কারণে রক্ষা হলো।মুহূর্তের মাঝে অধর কে*টে রক্ত গ*ড়াতে থাকলো তার,সম্পূর্ণ কপোল ছেয়ে গেলো লালচে কালো আঙুলের দাগে।ঝনঝন করে উঠলো সমগ্র শরীর।তবে শারীরিক যন্ত্রণার থেকে অধিক চিন্তা অনুভূত হলো দীপ্তির।এক লহমায় তাকালো নিজের উদরের পানে, দুহাত আবদ্ধ থাকায় স্পর্শ করতে সক্ষম হলোনা।
” আমার অংশ,আমাদের পূর্ণতা….”
অন্তরে প্রতিধ্বনিত হলো তার।কাঁপতে থাকলো শরীর।রাফা এক নজর পর্যবেক্ষণ করলো শুধু।পরক্ষণেই বেপরোয়াভাবে উল্টো ঘুরল,অনুভূতিহীন কন্ঠে আদেশ ছুড়লো,
– ফিনিশ হার!
অতঃপর শুধু গটগট করে হেঁটে যাওয়ার শব্দ।কক্ষের বাইরে চলে গেলো রাফা।একটিবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালোনা।দূর্বল অনুভবে মুখের ভেতর জমা র*ক্তটু*কু থু করে ফেলে দিয়ে রোযা নয়ন তুলে তাকালো।লক্ষ্য করলো উপস্থিত পাঁচজন গার্ডকে।বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো নয়নপল্লব,জোরপূর্বক খোলা রাখলো।এতক্ষণ কথোপকথন এবং অনুভবে এতটাই বিভোর হয়েছিল সে যে এদের নজরেই আসেনি। রোযাকে ঘিরে আসতে আরম্ভ করলো হায়েনার দল। একেকজনের উদগ্রীব চাহিদায় জ্যাকেট এবং শার্টের বোতাম খুলে নিজেকে উন্মুক্ত করবার কার্যক্রমে রোযার বুঝতে বাকি রইলোনা রাফা তাদের ঠিক কোন কার্যসাধন করতে আদেশ করেছে।
তবে কি চিত্রলেখার পরিণতি বরণ করতে চলেছে রোযাও?
কোনোদিন না! চিত্রর সঙ্গে রোযা আপন তুলনা দেয়ার দুঃসাহস কোনোদিন করেনি।কিন্তু একটি দিক দিয়ে সে চিত্রলেখার তুলনায় একটু আলাদা।
চিত্র আসমানকে লাভ করেছে তার প্রফুল্ল দশায়,এবং রোযা আসমানকে পেয়েছে তার ধ্বং*সপ্রায় অস্তিত্বে।চিত্র লাভ করেছে প্রেমের আখ্যান,রোযা রচেছে বিনাশকাব্য।চিত্র পেয়েছে এক স্বাভাবিক মানুষকে,রোযা পেয়েছে এক অনুভূতিহীন মেশিনকে।যে কর্মসাধন চিত্র প্রথম সাক্ষাতেই করে দেখিয়েছে,তার কাছাকাছি কিছু আদায় করতেও রোযাকে একাকী পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ এক কণ্টকাকীর্ণ পথ।চিত্র আসমানের সৌন্দর্য্য দেখেছে,রোযা দেখেছে কলঙ্কময় বিভীষিকা।চিত্র যন্ত্রকে রূপান্তর করেছে মানুষে,এবং রোযা রূপান্তর দূরে থাক কোনোদিন পরিবর্তনটুকুর ইচ্ছা ব্যক্ত করেনি।চিত্র হাত ধরেছে চন্দ্রের,রোযা হাত ধরেছে অমানিশার।
চিত্রলেখা ভালোবেসেছে মানুষ আসমানকে,রোযা ভালোবেসেছে কলঙ্কিত এক দা*নবিক অস্তিত্বকে।
এ কোনো তুলনা নয়।শুধুমাত্র এক বিভিন্নতার দলিল।পরিস্থিতি এবং সময়,চিত্র এবং রোযাকে একে অন্যের অতুলনীয় গুণে গুণান্বিত করেছে।তাই উভয়ের পরিণতি কোনোদিনও এক হবেনা,অসম্ভব তা!
রোযার উপর সম্পূর্ণ ঝুঁকে এলো একজন গার্ড,লক্ষ্য তার ঘাড়।সম্পূর্ণ শরীর গুলিয়ে উঠল জ্যোৎস্নার,তবুও অপেক্ষা তার অমোঘ সময়ের।একে একে তার কাঁধ এবং কোমরে জড়ালো অপবিত্র হাতের স্পর্শ।ঘাড়ে ঠেকলো ধা*রালো দাঁতের ছোঁয়া।ঠিক তখনি…..
ধাতব এক ঝনঝনানি।কেউ বুঝতেও সক্ষম হলো না কি হচ্ছে।শুধুমাত্র বিস্ফারিত নয়নে লক্ষ্য করলো রোযার হাতের বাঁধন খুলে গেছে।হ্যান্ডকাফটি সশব্দে আছ*ড়ে পড়েছে মেঝেতে।তারপরই ক্ষীপ্র গতিতে এগোলো তার ডান হাত,ঘাড়ে মুখ ডোবানো গার্ডের গ্রীবার সবথেকে স্প*র্শকাতর ধ*মনী বরাবর গেঁ*থে গে*লো সুঁচালো এক অ*স্ত্র,ছিট*কে উঠলো র*ক্ত।রোযার অফহোয়াইট বর্ণের বুকজুড়ে লেপ্টে গেলো সেই চিহ্ন।মুহূর্তের মাঝেই হুড়মুড় করে পতন ঘটলো গার্ডের,তার পায়ের নিকট পরে রইলো নি*থর হয়ে।বাকিরা এতটাই হতবিহ্বল যে কোনো প্রতিক্রিয়াই করতে পারলোনা।শুধুমাত্র প্রসারিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো রোযার হাতের সূচের মতন সূক্ষ্মতর র*ক্তস্নাত বস্তুটির দিকে।
প্লেয়ার সিগমা,নিহাদের প্রদানকৃত গোলাপ।যার কণ্টকহীন বৃন্তের ভেতর সংরক্ষিত ছিল আপাতদৃষ্টিতে গোপনীয় এই ভয়াল অ*স্ত্র*টি!মুষ্টির মাঝে গোলাপটি চেপে ধরতেই অভ্যন্তরে এর অস্তিত্ব টের পায় রোযা,সেই রেইস চলাকালীন।কেনো দিয়েছে তাকে নিহাদ এই জিনিস?আ*ত্মরক্ষার জন্য?নাকি আ*ক্রম*ণের জন্য? যাই হোক না কেনো,নিহাদ উপস্থিত না থেকেও বাজিমাত করেছে!কারণ মাসের পর মাস এসব সুপরিকল্পিত চিন্তাভাবনা এবং আ*ক্র*মণ তো তাকে গুরু নিহাদই শিখিয়েছে!বিনা চাবিতে শুধুমাত্র হাতের কব্জির নির্দিষ্ট কোণে ঘূর্ণন ঘটিয়ে হ্যান্ডকাফ মুক্ত করার বিদ্যাও এই গুরুরই পাঠ।
তীর্যক হাসলো রোযা।অপর গার্ড প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই সূচটি স*জো*রে বি*দ্ধ করলো চো*খ বরাবর! তীক্ষ্ণ এক আর্তনাদধ্বনি তুললেও লাভ নেই।এই কক্ষটি প্রায় সাউন্ডপ্রুফ পূর্বেই বোঝা গিয়েছে।দরজা একজন বন্ধ করেই এসেছে,বাহির থেকে ধাক্কা না দিলে খুলবেনা।সেক্ষেত্রে,রোযা সর্বেসর্বা!
র*ক্তে*র ফিনকি ক্রমেই রোযার বস্ত্র রক্তিম আবহে রাঙিয়ে তুললো।তৎক্ষণাৎ একজন গার্ডের কোমর থেকে রিভ*লভার টেনে সে পা উঁচিয়ে লা*থি হা*কালো।হুড়মুড় করে পড়তেই এক লাফে চেয়ার থেকে উঠে ম*স্তিষ্ক ব*রাবর গু*লি ছুঁ*ড়লো।রীতিমত বি*স্ফা*রিত হ*লো তা*র ম*স্ত*ক,ছি*টকে বেরিয়ে এলো গ*লি*ত ম*গ*জ।খেদ নেই সামান্যতম এমন দৃশ্যে।শুধুমাত্র তীব্র আক্রোশ অস্তিত্বজুড়ে।
খু*ন ক*রেছে রোযা!মানুষ খু*ন করেছে! আদও মানুষ কি?নাকি সৃষ্টিজগতের নি*কৃষ্টতম অস্তিত্ব?
পরোয়া নেই।উদরে হাত ঠেকলো রোযার।একজন মা সে!এবং একজন মা এই ইহজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ যো*দ্ধা।
অপর দুজন গার্ড তাদের তিন তিনজন সঙ্গীর এমন ভয়*ঙ্কর পরিণতি লক্ষ্য করে সহসাই রোযাকে জাপটে ধরলো।পিস্তল কেড়ে নেয়ার চেষ্টায় একজন পুরুষালী শক্তি ব্যবহার করে তাকে আছ*ড়ে ফেললো পার্শ্ববর্তী টেবিলের উপর।ধস্তাধস্তি চলমান।রোযা কিছুতেই নিজের অ*স্ত্র ছাড়বেনা।উত্তোলিত হলো অপর গার্ডের পি*স্ত*ল,কাছ থেকে অত্যন্ত দক্ষ নিশা*না।অতঃপর….
থপ!
অত্যন্ত মৃদু এক শব্দ।গার্ডের শরী*র ধ*পাস করে পড়লো কার্পেটের উপর।মাথার নিকট থেকে বেরিয়ে এলো র*ক্তস্রোত।রোযার হাত চেপে ধরে রাখা অন্তিম গার্ড কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার শ*রীর কয়েকটি ঝটকা দিয়ে স্থবির হয়ে পড়লো।এক ধাক্কায় তাকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে রোযা উঠে দাঁড়ালো। হাঁপাতে হাঁপাতে তাকালো দরজার দিকে,যেটি এই মুহূর্তে হাট করে খোলা।দরজার ফ্রেমের সামনেই দন্ডায়মান হাবিব,সঙ্গী হিটটিমের তিনজন ছেলে।প্রত্যেকেই স*শ*স্ত্র।নিজের ধোঁয়া ওঠা রিভ*লভার কোমরে গুঁজে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে এগোলো হাবিব।রোযার সঙ্গে দৃষ্টিপাত হতেই উভয়ের অধরে ফুটলো হাসির ঝিলিক।
বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে:
চট্টগ্রামের সড়কপথ বেয়ে নিজেদের হেলিকপ্টারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলা রেমানদের গাড়িবহর অতর্কিতেই থমকালো মুহূর্তের জন্য।রোযা এবং চারুলতা বিস্মিত হয়ে তাকালো হাবিবের উদ্দেশ্যে,যে নিজের কানের এয়ারপিসের বক্তব্য একমনে শুনে চলেছে।
– কি হয়েছে হাবিব?
চারুলতার প্রশ্নে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নুইয়ে পরাজিত ভঙ্গিতে হাবিব জানালো,
– আমরা ফাঁদে পরে গিয়েছি।
– মানে?
তড়াক করে সিটে রীতিমত লাফিয়ে উঠলো চারু।রোযাও হতবাক।এই না সবকিছু সঠিকভাবে হচ্ছিল। এখন তবে কি? হাবিবের কন্ঠস্বর উভয়কে বাকরুদ্ধ করে দিলো।
– রাফা কায়সার ইয হেয়ার।আসমান ভাইয়ের প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকায় আমাদের কয়েকজন তাকে অনুসরণের অভিযানে নিযুক্ত ছিলো।সন্দেহজনক কিছুই নজরে আসেনি।কিন্তু বর্তমানে….
– বর্তমানে কি?
– ম্যাম,রাফা কায়সার বডি ডাবল ব্যবহার করেছেন। আই মিন,হয়ত উনি আন্দাজ করেছিলেন তার উপর নজর রাখার ব্যাপারটা।আজ সন্ধ্যার দিকেও ওনার গাড়ি পাতাল ক্লাবে গিয়েছে,উনি নেমেছেনও,ক্লাবে প্রবেশ করেছেন।কিন্তু তাকে বেরোতে দেখা যায়নি।আমাদের লোক পর্যবেক্ষণে রাখছিলো,কিন্তু অনেকক্ষণ পরে আবিষ্কার করলো যাকে আদতে তারা রাফা ভাবছিলো,সে রাফা নয়!অন্য কেউ!
– কিঃ!
চারুলতার কন্ঠস্বর বর্তমানে ফিসফিস অনুভব ছাড়া কিছু নয়।হাবিব ভ্রু কুঁচকে লুকিং গ্লাসে চেয়ে বললো,
– কায়সার আমাদের বোকা বানিয়েছেন।উনি অন্য কাউকে নিজের অবস্থানে রেখে চট্টগ্রামে চলে এসেছেন।শেষ খবর পাওয়া অনুযায়ী আমাদের গার্ডের কেউই বেঁ*চে নেই।হয়ত এখনো সড়কের আশেপাশের কোনো বিল্ডিং থেকে আমাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে।যদি আমরা পলায়নের চেষ্টাও করি,তবে তারা হা*ম*লা করবে!
– মাই গড!
নিজের মাথা চেপে ধরে সিটে হেলে পড়লো চারুলতা।দৃশ্যুসম্মুখে শুধুই ধোঁয়াশা তার।এত পরিশ্রম,এত সাধনা, এত পরিকল্পনার পরিণাম তবে শূন্য?না চাইতেও অশ্রুসজল হলো তার নয়ন।তবে কি সে আদতেই রোযাকে রক্ষা করতে পারলোনা? কোন মুখে সে আসমানের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? কোন মুখে সে নিহাদকে জবাবদিহি করবে?তারা যে ভরসা করেছিলো তার উপর!
– আমরা পালাবোনা।
শীতল বক্তব্যে চট করে চারুলতা এবং হাবিব উভয়েই ঘুরে তাকালো।অমানিশার দীপ্তি বসমান,চেহারায় বিন্দুমাত্র আশঙ্কা নেই,বড্ড সুস্থির সে।মাথা হেলিয়ে রোযা বললো,
– রাফা কায়সার তাহলে নির্বোধ নয়।ভালো।
– ম্যাম আপনি…..
– হাবিব আপনি যেমন ড্রাইভ করছিলেন,তেমনি করুন।রাফা কায়সার হেলিকপ্টারের আশেপাশেই থাকবে, আমরা যাবো সেখানে, যেন কিছুই হয়নি আর আমরা কিছুই জানিনা।ফাঁদে পা দেবো।
স্তব্ধতা।অতঃপর চারুর হুংকার,
– তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ রোযা?যদি কিছু…
– এছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকলে বলো।
এবার চারুলতা জবাব দিতে পারলনা। প্রত্যুতপন্নমতি, অর্থাৎ উপস্থিত বুদ্ধিমতি নয় সে।পরিকল্পনায় সময় প্রয়োজন তার। নৈঃশব্দ্যকে জবাব হিসাবে পেয়ে রোযা একটি নিঃশ্বাস ফেললো।জিজ্ঞেস করলো,
– আমাদের হিটটিমের ব্যাপারে রাফার জানার সম্ভাবনা কতটুকু?
– প্রায় অর্ধেক।
– ঠিক আছে।আপনি হিটটিমের গাড়ি দুটোকে বলুন সামনের মোড়ে ভিন্নপথ ধরতে।শুধুমাত্র আমি, চারু আর আপনি যাবো রাফার ডেরায়। আশি শতাংশ সম্ভাবনা আছে যে রাফা আমাকে আর চারুকে তুলে নিলেও আপনাকে নেবেনা,অযথা ঝামেলা কে চায়?আপনাকে আ*ক্রমণ করলে বেঁহুশ হয়ে থাকার অভিনয় করবেন। আর আপনাদের কাছে একে অপরকে ট্র্যাক করার জন্য যে মাইক্রোচিপগুলো আছে,তার একটা আমায় দিন,আরেকটা চারুলতাকে।রাফা তুলে নিলে আমাদের লোকেশন ট্র্যাক করবেন।
বিস্ময়ে রীতিমত ফাঁক হয়ে থাকলো হাবিবের চোয়াল। এমনকি চারুও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।এতটা বিস্তর পরিকল্পনা কখন করলো রোযা?
– আর হ্যাঁ,গাড়ির বক্সে যেসব চা*কু দেখেছি,আমায় দিন।
মাইক্রোচিপ এবং হি*ডে*ন *নাইফ রোযা ও চারুলতার দ্বারস্থ করতে করতে হাবিব কম্পিত কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– আসমান অ্যান্ড নিহাদ ভাই আর গোয়িং টু কি*ল মি ফর শিওর!
সামান্য হেসে রোযা হাবিবের কাধে হাত রাখলো,যেন ভরসা প্রদান করলো।
– চিন্তা করবেন না।অনেক হয়েছে এই ইদুর বিড়ালের লড়াই।এবার হয় এসপার,নয়ত ওসপার!
বর্তমান:-
হাবিবের দিকে এগিয়ে গেলো রোযা, কনুইয়ের গু*তো হা*নতেই বেচারা নুয়ে পড়ল।
– আউচ! ম্যাম!
– এত দেরী কেনো? আরেকটু হলে নিজেই কি*লিং মেশিন হয়ে যেতাম!
এমন গুরুগম্ভীর পরিস্থিতিতেও কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলো হাবিবের অধরে।রোযা বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্যে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
– আমার জিনিস কোথায়?
একজন ছেলে নিজের কাঁধের ব্যাকপ্যাক খুলে ভেতর থেকে একটি বক্স বের করলো।তাতে একজোড়া হিলজুতো।হিলের স্থানে সুউচ্চ ডলার চিহ্ন খচিত।রোযা সন্তুষ্ট হয়ে ছেলেটির পিঠ চাপড়ে দিলো,
– নাইস চয়েজ।
বেচারা খানিক লজ্জা পেয়ে গেলো।তবে তাতে পরোয়া না করে রোযা নিজের পায়ের জুতো খুলে হিলজোড়া পরিধান করলো।তার মৃদু ধ্বনি অদ্ভুত এক আলোড়ন তুললো অন্তরে সকলের।একটি হাত বাড়িয়ে একজনের কাছ থেকে নতুন একটি রিভ*লভার নিয়ে কোমরের হোলস্টারে বাঁধলো। অপর হাতে গাউনের অন্তরালে লুকানো হিডেন না*ইফ উঠে এলো।এগোলো সে কক্ষের বাইরের দিকে,অতর্কিতে চোখ গেলো দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা বেসবল ব্যাটের দিকে।তাদের তুলে আনার সময় রাফা এটিই ব্যবহার করেছিল।সেটি বাম হতে তুলে নিজের কাঁধে ঠেকালো রোযা।অতঃপর নির্দেশ দিলো,
ডার্কসাইড পর্ব ৬৫
– ডোন্ট ইন্টারফেয়ার!
কক্ষের বাইরে হেঁটে চললো রমণী।হাবিবের অনুসরণে সকলে বাইরে এলো।চেয়ে থাকলো করিডোর বেয়ে হিল পরিধানকৃত পায়ে এগিয়ে চলা রোযার পানে।তার গাউন তাজা র*ক্তখচিত চিত্র রঞ্জিত হয়েছে। আলো আঁধারির মাঝে ওই অবয়ব ঠেকলো বড়ই অশুভ।এক নিশিথিনী যেন।হেঁটে চলেছে নিজের শিকারের উদ্দেশ্যে।
স্থির হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো সবাই।নিজেদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া দূর্বার।এ চাঁদের জ্যোৎস্না নয়,অমানিশার মহারাণী স্বয়ং।
