ডার্কসাইড শেষ পর্ব 

ডার্কসাইড শেষ পর্ব 
জাবিন ফোরকান

আলো আঁধারির মায়ায় রহস্যপুরীর ন্যায় ঠেকছে কারাগারের কক্ষটি।একটি কাঠের চৌকির উপরে চিৎ হয়ে হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে নাড়িয়ে চলেছে দিমিত্রী, ফ্যাকাশে দৃষ্টি তার শিক গলে চুঁইয়ে আসা জ্যোৎস্নাটুকু পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।এই আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে প্রবেশের প্রথম প্রথম বহু দিন,বহু রাত তাকে কারাগারের কপাটের মাঝে অতিক্রান্ত করতে হয়েছে।তবে বহু বছর অতীত সে এর ছায়াও মাড়ায়নি।ক্ষমতার দাপটে শৃংখলিত হওয়ার আশঙ্কার মোচন ঘটিয়েছিল সে।তবে আসমান নামক এক বাংলাদেশী বান্দা তাকে শেষমেষ এই লোহার শিকের মাঝে আবদ্ধ করে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে!

চমৎকার!
মনে মনে ভাবলো রাশিয়ান গ্যাংস্টার।সে জানে,খুব বেশিদিন এই লৌহকপাট তাকে সংকুচিত করে রাখতে সক্ষম হবেনা।নিজ দেশের গন্ডির মাঝে চালান হলে ঠিক কোনো না কোনো ব্যবস্থা হবে।তাতে হয়ত বছরখানেক সময়ের প্রয়োজন হবে।তাতে কি?কিন্তু….সে যদি মুক্তিও লাভ করে,অতঃপর কি করবে? চাঁদ জ্যোৎস্নার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছুদিন আগেই তার নিকট খবর এসেছে,সহধর্মিনী তার জীবিত নেই,আ*ত্মহ*ত্যা করেছে।কেমন বোধ করেছে দিমিত্রী? অনুভূতিহীনতা।রাফা কায়সারের প্রতি তার অনুভূতিগুলো কেমন যেনো ফিকে হয়ে এসেছে।স্মরণে রয়েছে আজও, রোযাকে কিডন্যা*প করার পূর্বে রাফার দুহাত আঁকড়ে ধরে সে আবেদন জানিয়েছিল, যাই হয়ে যাক না কেনো,রাফা নিজে যেনো এসবকিছুর মাঝে না জড়ায়। দিমিত্রী স্ত্রীর তরে নিজেকে উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত ছিল,কিন্তু তার স্ত্রী যে সাধারণ কোনো মানবীর কাতারে পড়েনা তা সে ভালোবাসার মোহে ভুলতে বসেছিলো।
” রাফা কায়সার একজন সাইকোপ্যাথ।তিনি কখনো ভালোবাসতে পারেন না,রাফা আপনাকে ভালোবাসে না
দিমিত্রী।”
” যদি একপ্রান্তে শুভ্রতা,এবং অপরপ্রান্তে আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন,তবে কাকে বেছে নেবেন রাফা?আপনাকে….নাকি শুভ্রতার আসক্তিকে?”
– আসক্তিকে বেছে নিয়েছে রাফা।

আপনমনে বিড়বিড় করলো দিমিত্রী।অতঃপর উঠে বসলো চৌকিতে সটান। অন্তরে তার চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। নারীতেই মুক্তি এবং নারীতেই ধ্বংস,এই তার জীবনের অমোঘ নিয়তি।জন্মদাতা ছিলেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে নি*কৃষ্টতম একজন পিতা,গর্ভাবস্থায় তার মাকে পি*টিয়ে জ*খম করে হ*ত্যা করেছিলো ওই অমানুষটি।অতঃপর,নিজেও অমানুষে পরিণত হয় দিমিত্রী।বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়নি সে জন্মদাতাকে।আপন ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলে মানবখু*লি পদতলে গুঁড়িয়ে।মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা তার, ছিল এক বিন্দু ভালোবাসার অনুভূতি,তার মতই ভাগ্যের রোষানলে খলচরিত্রে পরিণত হওয়া রাফা কায়সারের প্রতি। সংসারে বেঁধেছিল নিজেকে, একটুখানি শান্তির চাহিদার আশায়।কিন্তু এই রমণীও শেষমেষ তাকে ধোঁকা উপহার দিলো।রমণীদের ভালোবাসার পরিণাম শুধুই বিনাশ, তা হোক শরীরের কিংবা আ*ত্মার।

কিন্তু চাঁদ জ্যোৎস্না?তারা এত ব্যাতিক্রম কেনো?যে ভালোবাসা দিমিত্রীকে টেনে হিঁচড়ে আঁধারের সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে এনেছে,সেই ভালোবাসাই আসমান নামক এক পুরুষের জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছে।যে ভালোবাসার জন্য দিমিত্রী পৃথিবীতে দাস বানিয়েছে, সেই ভালোবাসার জন্য আসমান দাসরূপী পৃথিবীর সঙ্গে লড়ে গিয়েছে।একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এই ভালোবাসা।এক পাশে আলোকোজ্জ্বল অনুভূতি,অপর পাশে নির্দয় হাহাকার।
বিচিত্র ভালোবাসা!অগণিত তার অর্থ। মানুষ এবং অন্তরভেদে পরিণতি অনন্য।
এই অনুভূতিকে কুর্ণিশ জানায় দিমিত্রী।

চৌকি থেকে উঠে সন্নিকটে সরে জ্যোৎস্নার ঔজ্জ্বল্যে চেয়ে রইলো সে,একদৃষ্টে।হয়ত একদিন তার মুক্তি মিলবে এই কারাগারের দেয়াল হতে,তবে সেদিনও প্রতিশোধের দাবী নিয়ে সে মানুষরূপী জ্যোৎস্না এবং তার চাঁদের সম্মুখে দন্ডায়মান হবেনা।কারণ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ বলতে কিছুই নেই।তাদের প্রতি আসে শুধুমাত্র সম্মান এবং শ্রদ্ধা।
একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলো দিমিত্রী,অনুভব করলো হঠাৎ করেই ভীষণ হালকা অনুভূত হচ্ছে তার।অন্তরে এক প্রশান্তি ভর করেছে,যে প্রশান্তির খোঁজ সে গোটা জীবন ধরে করে আসছে।

– পাপা!
সম্বোধনটি কর্ণগোচর হতেই বক্ষমাঝে ঘূর্নিপাক খেলে গেলো।ঝট করে ফিরে তাকালো আসমান,দমকা হাওয়ায় এলেমেলো হয়ে ঝাঁপটে গেলো তার কেশ।হাতের আঙুলে তা কপালের উপর তুলে মিটমিট করে চাইলো, সম্মুখের দৃশ্য তাকে সম্পূর্ণরূপে বাকরুদ্ধ করে দিলো। একটি শিশুকন্যা,ধবধবে বস্ত্র জড়ানো অঙ্গে।তার সমস্ত অবয়বে খচিত ঔজ্জ্বল্যে,যাতে দৃষ্টি মেলানো ভার।আসমানের নয়ন কুঁচকে এলো,হাত দিয়ে আড়াল করলো সে নিজের দৃষ্টিশক্তি।
– বাবা?
দ্বিতীয় দফায় খিলখিলে হাসির সঙ্গে সম্বোধনটির উদগীরণ হতেই আসমানের হৃদস্পন্দন থমকে গেলো রীতিমত।সমস্ত শরীরে হাড়হিম শিহরণ বয়ে গেলো। অধরজোড়া ফাঁক হলো, উচ্চারণে কোনো আওয়াজ নির্গত হলোনা,শুধুই এক নিষ্ফল অন্তরের হাহাকার,

– মেঘ!
– হিহি!
আবারো শিশুসুলভ হাসির ধ্বনি। রশ্মিস্নাত মেঘ উল্টো ঘুরলো,ছুটতে আরম্ভ করলো।তার ছোট ছোট কেশরাশি দুলতে লাগলো বায়ুর বেগে।আসমান হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।পরক্ষণেই ছুটলো,
– মেঘ!মামণি আমার…দাঁড়াও!
– পাপা….ধরো আমাকে পাপা…
– মেঘ!প্রিন্সেস..!
ছুটতে আরম্ভ করলো আসমান,ঊর্ধ্বশ্বাসে।একটি বিশাল বাগান।ধবধবে বর্ণের অজানা প্রজাতির ফুলের গুচ্ছে পরিপূর্ণ।তার মধ্যিখানের সরু পথ বেয়ে ছুটে যাচ্ছে মেঘ, পিছু নিয়েছে পিতা আসমান।অদূরে অস্তমিত স্বর্ণালী দিবাকর,তার নয়ন ঝলসা*নো রোশনাই সমস্ত ভুবনে ছড়িয়ে যেনো জানান দিচ্ছে,এ স্বয়ং স্বর্গ।

– মেঘ!দাঁড়াও পাপা…
– হাহাহা…
পিছন ফিরে বিস্তর হাসলো কন্যা।তার ঝাপসা মুখচ্ছবিমাঝে এক বৃহৎ খুশির ঝিলিক প্রকাশ পেলো।এটুকুই,আসমানের পদক্ষেপ থমকে পড়লো সম্পূর্ণ।সন্তানকে একটিবার ছুঁয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালেও হতবিহ্বল হয়ে আবিষ্কার করলো মেঘের স্থান বর্তমানে দখল করে নিয়েছে এক রমণী।একই বস্ত্র পরিধানে তার,ধবধবে শুভ্র সাদা।দীঘল কাজলকালো চুলরাশি তার বায়ুর ঝাঁপটায় উড়ে বেড়াচ্ছে।সুদর্শনা মুখশ্রী তার, অধরজুড়ে মায়াবী হাসির ধারা।এক তরঙ্গ খেলে গেলো আসমানের মস্তিষ্কের নিউরন হতে পায়ের শিরা উপশিরা অবধি। হৃদস্পন্দন সীমানা ছাড়ালো।
– চি… চিত্র!

মৃদু হাসির ধ্বনি ভেসে এলো,রক্তিম আবহ মাখা চেহারায় ভালোবাসা তার মুখ তুলে চাইল।দিবাকরের আবহ তার কেশমাঝে প্রতিফলিত হয়ে অনন্য দীপ্তি ছড়াচ্ছে।যেনো এক অপ্সরী।এক্ষুণি ডানা মেলে উড়ে যাবে গগনের মেঘরাজির অন্তরালে।কম্পিত হাত উত্তোলন করলো আসমান,সম্মোহনী কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– পরিণীতা আমার…
– ব্রোকেন হার্ট…
পাল্টা হাত বাড়িয়ে আসমানের হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে নিজের আঙুলসমূহ গুঁজে এক চিলতে হাসলো চিত্রলেখা।সেই ঐন্দ্রজালিক হাসির সঙ্গেই কোমল কন্ঠে বললো,
– বেঈমান!

অপর হাতে রমণীর কপোল ছুঁতে যাওয়া আসমানের হাত মাঝ পথেই থমকে গেলো।ভ্রু কুঞ্চিত করে সে মহাবিস্ময়ে তাকালো,এক লহমায় যেনো সম্পূর্ণ দৃশ্যের রদবদল ঘটলো।কোথায় তার চিত্রলেখা?এ যে এক পিশাচীনি।নিকষ কালো আঁধারখচিত পোশাক পরিধানে, অধরজুড়ে টকটকে আভা।দিবাকর হারিয়েছে, তার পরিবর্তে রাত্রির মায়াজাল। গগনে উদিত লাল উজ্জ্বল রক্তিম চাঁদ।অশুভের মহারাণী রাফা কায়সার স্বয়ং।
– বেঈমান!
এবার কণ্ঠটি শোনালো অত্যন্ত কর্কশ,ভৌতিক এক আবেদন যেনো।শিউরে উঠলো আসমান,এক লাফে পিছিয়ে গেলো।

– লজ্জা করেনা তোর?বেঈমান কাপুরুষ!
চারিদিক থেকে নরকের প্রাণীরা যেনো ঘিরে ধরলো অমানিশাকে।মাঝে দুহাঁটু আঁকড়ে ধরে সংকুচিত হয়ে রইলো সে,থরথর করে কাঁপতে থাকলো।
– আমি… আমিহ…
– এই তোর ভালোবাসার নমুনা?নিজে তো দিব্যি সুখে আছিস,একবারও ওই রমণীর কথা ভেবেছিস যে তোকে ভালোবেসে ধ্বং*স হয়ে গিয়েছে?
– না না না না….
নরকের হিং*স্র প্রাণীগুলো জেঁকে ধরলো আসমানকে, যেনো গলাধঃকরণ করবে। রাফার উচ্চশব্দে হাসি এবং চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো,

– লম্পট কাপুরুষ!
– না!আমার পাপা বেঈমান না!
পাল্টা হাহাকার শোনা গেলো শিশুকণ্ঠের।অতঃপর আরো একটি কন্ঠস্বর,
– আমার স্বামী বেঈমান নয়,কাপুরুষ নয়।তার মতন পুরুষ নিজের জীবনে লাভ করা স্বপ্নেরও অতীত।
চাঁদের আপন জ্যোৎস্নার কন্ঠস্বর চিনতে একটুও বেগ পোহাতে হলোনা।আপ্লুত হলো আসমান,সন্তান এবং স্ত্রীর আত্মবিশ্বাসে।তবে এই মুহূর্তে তার একটিমাত্র ইচ্ছা, ভগ্ন কন্ঠে সে জানতে চাইলো,
– চিত্র,আমি কি সত্যিই বেঈমান?
শুধুমাত্র নৈঃশব্দ্য।অতঃপর শো শো বায়ুর আওয়াজ।চারিদিক থেকে আঁধার ছায়া ঘিরে ফেললো আসমানকে।যেনো এক অন্ধকার কূপ।ছটফট করতে লাগলো সে মুক্তির আশায়,অজানা শৃংখলে আবদ্ধ হলো তার সমস্ত শরীর।
– না!

অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে সটান উঠে বসলো আসমান।হাঁপাতে হাঁপাতে তাকালো চারিদিকে। রেমান গ্রুপের অফিস ভবনে নিজের কেবিনের কাউচে অবস্থান তার।বিশালাকৃতির কেবিনজুড়ে কারো উপস্থিতি নেই।ফাঁকা ডেস্কে ফাইল সজ্জিত,কিছুক্ষণ আগে অমনোযোগী কাজ করতে থাকা ল্যাপটপ এখনো খোলা রয়েছে।পরিধানের শার্ট ঘেমে লেপ্টে রয়েছে আসমানের শরীরে।বাস্তব জগতে নিজেকে আবিষ্কার করে সে উপলব্ধি করলো,এতক্ষণ যাবৎ দুঃস্বপ্ন দেখছিলো।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো তৎক্ষণাৎ,মাথায় আঙুল চালিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে খানিকক্ষণ বসে রইলো।
রোযাকে দুইদিন আগে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।ডেলিভারির জন্য অপেক্ষারত ডাক্তার আগামীকালের ডেট দিয়েছিলেন।তাই আজ সকাল থেকে ভীষণ অস্থির হয়ে আছে আসমান।অতি জরুরী প্রয়োজন না হলে কোম্পানিতে আসতো না সে।তবুও আসতে হয়েছে।কাজে এক বিন্দু মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। কাউচে বসতেই পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে পড়ে।কখন যে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে নয়ন সে টেরও পায়নি।তারপরই দুঃস্বপ্ন।

মাথা ঝাঁকালো আসমান।উঠে বাথরুমের সিংকে গিয়ে মুখে কনকনে শীতল পানির ঝাঁপটা দিলো।সমস্ত শরীরের যাচ্ছেতাই অবস্থা।শার্টটা খুলে ভেজা তোয়ালেতে মুছে নিয়ে অপর একটি ল্যাভেন্ডার বর্ণের হাফহাতা ওভারসাইজড শার্ট গায়ে জড়ালো।কেবিনের ক্লোজেটে ইমার্জেন্সির জন্য আলাদা পোশাকের ব্যবস্থা সে সবসময়ই করে রাখে।হৃদস্পন্দন শান্ত করতে বারকয়েক প্রশ্বাস টেনে সংক্ষিপ্ত মেডিটেশন সম্পন্ন করে গাড়ির চাবি আইভরি ফরমাল প্যান্টের পকেটে চালান করে দ্রুতই কোম্পানি থেকে বেরিয়ে পড়লো।
উদ্দেশ্য—কবরস্থান।

শীত ঋতু সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে।শুষ্ক প্রকৃতি রেঙে উঠছে বসন্তের আবহে।চারিদিকে বর্ণের ছড়াছড়ি।নব্য প্রস্ফুটিত ফুল এবং গাছের কচি পাতা।কবরস্থানজুড়েও সেই ঋতুরাজের প্রাণস্পন্দন ছোঁয়া।পাশাপাশি দুইটি ক*বর,আচ্ছাদিত শুষ্ক পাতার আবরণে।অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তা।হাঁটু মুড়ে সম্মুখে বসে আছে আসমান।আজ কতদিন বাদে সে এখানে হাজীর হয়েছে?হিসাব করতে পারলোনা। নিস্তব্ধপুরীর প্রাণহীন অরণ্যে একলা বসে আছে সে,এক অধরার খোঁজে।হৃদয় তার স্থবির হয়ে আছে অজানা কারণে।সবকিছু নিয়ে তার অন্তর প্রচন্ড চিন্তিত। তাইতো এখানে আগমন,অন্তিম কিছু আবেদন নিয়ে।দিনগুলো বিনা কারণেই স্মরণে আসছে আজ প্রচণ্ড।তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, চিত্রলেখা এবং মেঘ।বর্তমানে তাদের ঠাঁই নেই, লুটিয়েছে উভয়ে মায়াচক্রে।নতুন এক জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আসমান নিজেকে আবারো আবিষ্কার করেছে ওই হৃদয়হরণীর দুয়ারে।হয়ত বর্তমানে সে অস্তিত্বহীন,তবে তার প্রভাব ভোলা অসম্ভব।

– আমি কি তবে সত্যিই বেঈমান প্রতিপন্ন হলাম?তোমার তরে বোনা আমার সকল অনুভূতির বুনন তবে কি মিথ্যা প্রমাণিত হলো?আমাদের একত্রে অতিবাহিত মুহূর্তগুলোর ঐন্দ্রজালিক আবহের জাল ভেদ করা কি এতই সহজ?এতই সরল তাকে ভুলে যাওয়া যার জন্য এই অমানিশা রচেছিল গোটা এক বিনাশকাব্য?

আসমানের কন্ঠস্বর ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে এলো।সমস্ত শরীর এক অব্যক্ত আবেগের প্রবাহে কিশলয়ের ন্যায় কাঁপছে।
– জগতের নিকট হয়ত আমি বেঈমান।তোমাকে ভালোবেসে গোটা এক জনম নির্বাহ করতে পারিনি। উৎসর্গই কি তবে সত্যিকার ভালোবাসা?”ভালোবাসা” শব্দটিকে কি আদও কোনো জাগতিক মাপকাঠিতে সংজ্ঞায়িত করা যায়?
জবাব এলোনা।শুধুমাত্র হিমেল হাওয়ার বিচরণে কবরের মাটির উপর জমাকৃত শুষ্ক পাতাগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ে গেলো চারিদিকে।সেই দৃশ্য একমনে পর্যবেক্ষণ করলো আসমান।অধরে অধর চেপে মাথা নিচু করে রইলো।পরক্ষণেই তার চেহারায় সিক্ত অনুভূতির প্রস্ফুটন ঘটলো।

– তুমি আমার চিত্রলেখা।আমি জানি,গোটা পৃথিবীও যদি আমায় বেঈমান ভাবে,তার বিপরীতে তুমি আমায় দ্বিগুণ ভালোবাসবে।এই ভগ্ন সত্তাকে আগলে নেয়ার মতন যখন কেউ ছিলোনা, তখন তুমিই তিল তিল করে যান্ত্রিক পাথুরে বুকজুড়ে ফুটিয়েছিলে অনুভূতির মুকুল। হয়তো ধরিত্রী তোমায় ভুলে যাবে,কিন্তু এই ব্রোকেন হার্ট তোমায় কোনোদিনও ভুলতে পারবেনা পরিণীতা।তুমি ছিলে,আছে এবং থাকবে,আমার হৃদয়ে অতি যত্নে সংরক্ষিত এক গোপন অনুভূতিখচিত বাক্সজুড়ে।
চকিতে পাশের ছোট কবরখানায় দৃষ্টি গেলো আসমানের, আনমনে হাত বাড়িয়ে মাটি ছুঁয়ে দিলো।আজ অশ্রু নয়,বরং এক রোমন্থনে হাসির রেখায় আবর্তিত হলো তার অধর।

– মেঘ সোনা।পাপাকে মনে আছে?তুমি দেখছো আমাকে তাইনা?প্রার্থনা করবে তো আমার জন্য?আমার জীবনে আসতে চলা ছোট্ট বাবুটার জন্য?তুমি থাকলে খুব খুশি হতে নিশ্চয়ই?প্রিন্সেস….
ধরে এলো আসমানের কন্ঠ। একটি শক্ত ঢোক নেমে গেলো কন্ঠতালু বেয়ে।এই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।দুহাত তুললো মোনাজাতের ভঙ্গিতে।
কিছুক্ষণ পরেই তার পকেটস্থ ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।মোনাজাত সমাপ্ত করে সেটি তুলতেই দেখলো কলার আইডিতে ভাসছে, “বাবা”।দ্রুতই রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে বিলাল রেমানের কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কন্ঠ শোনা গেলো,

– রোযাকে মাত্র ডেলিভারির জন্য নিয়ে গিয়েছে।তুমি কোথায়?তাড়াতাড়ি আসো।
এটুকুই। আসমানও কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা।ফোন পকেটস্থ করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বক্ষমাঝে উথাল পাথাল ঝড় উঠেছে তার।বিনা কারণেই কেমন উদ্ভ্রান্ত লাগছে নিজেকে।তবুও সামান্য একটু বিলম্ব করলো।কবরের উদ্দেশ্যে চেয়ে অন্তিম বারের ন্যায় বিড়বিড় করলো,
– তুমি বিহীন কোনো সূচনা রচিনি আমি।আজ,জীবনের এক নব অধ্যায়ের সূচনালগ্নে আমি আবারও তোমারই দ্বারস্থ হয়েছি।প্রার্থনা দাও চিত্র,শক্তি দাও,ক্ষমতা দাও এই নব্য জীবনধারায়।
এক মুহুর্ত বিরতি,তারপর ম্রিয়মাণ কন্ঠে আর্জি জানালো,
– আমার জ্যোৎস্না এবং অংশের জন্য খোদার কাছে আবেদন জানিও,তিনি যেনো ওদের সুস্থ সবলভাবে আমার আলিঙ্গনে ফিরিয়ে দেন।

অন্তিম কয়েক পলক তাকালো সে কবর দুটির উদ্দেশ্যে,এক চিলতে সিক্ত হাসি হেসে দ্রুতই হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে নিয়ে উল্টো ঘুরল।বাইরে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো কিছুটা দূরে পার্ক করে রাখা পোর্শের উদ্দেশ্যে।
জান্তব পোর্শের ঝোড়ো গতিও হার মানতে বাধ্য হলো রাজধানীর যানজটের সামনে।আধ ঘন্টা এক স্থানে স্থির থেকে আসমান কিছুতেই অতিরিক্ত সময় খরচ করতে পারলোনা।এক লাফে পোর্শে ছেড়ে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী এক বাইকারোহীর পিছনের ব্যক্তির কাঁধ চেপে হন্তদন্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– গাড়ি চালাতে জানেন?
বেচারা অজানা মানুষের নিকট এমন প্রশ্নে ভড়কে গেলো প্রচণ্ড।তবুও দ্বিধান্বিত কন্ঠে জবাব দিলো।
– জ্বি।

কোনোপ্রকার সময় ক্ষেপণ ব্যাতিত তার হাতে চাবি ধরিয়ে দিয়ে আসমান বিড়বিড় করলো,
– হেলথ প্লাস হসপিটাল,যানজট ছাড়লে গাড়িটা যদি পৌঁছে দিতে পারেন আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।আর যদি অনৈতিক কাজ করে বসেন,তাহলে আমার কিছুই করার থাকবেনা।অগ্রিম ধন্যবাদ ভাই।
তার পিঠ চাপড়ে এক লাফে বাইকের প্রান্ত পেরিয়ে আসমান পাশের ফুটপাথে উঠে এলো।মানুষের ভীড় গলে ছুটতে আরম্ভ করলো লম্বা পদক্ষেপে, যতটা দ্রুত সম্ভব।আশেপাশের মানুষজন ফিরে ফিরে তাকে বিস্ফা*রিত দৃষ্টিতে অবলোকন করে গেলো।হতভম্ব হয়ে বাইকারোহী দুইজন একবার তাদের দিয়ে যাওয়া চাবি এবং পাশে রক্ষিত বিলাসবহুল রেসিং মডেলের গাড়িটির দিকে তাকালো।বড়লোকদের মতিগতি বুঝে ওঠার জো নেই।কি এমন জরুরী তাড়া ওই লোকটার যে অর্ধকোটি টাকার সম্পদও তার সম্মুখে কিছুই নয়?এক সেকেন্ড সে চিন্তা করেনি! আশ্চর্য্য!
মানুষ এতটাও বিচিত্র হয়?

মিনিট পনেরো দৌঁড়ে,মিনিট বিশেক রিকশায় এবং আবারো মিনিট বাইশ ছোটাছুটির পর আসমান যখন হাসপাতালে পৌঁছলো তখন ঘেমে নেয়ে এক হাহাকার অবস্থা তার।তবুও থামতে অনিচ্ছুক অবাধ্য শরীর।দ্রুতই পৌঁছলো করিডোরে।কিন্তু চারিদিক ফাঁকা লক্ষ্য করে এক লহমায় গুঁড়িয়ে গেলো তার সমস্ত অন্তর।হৃদয়জুড়ে এক আশঙ্কা জেঁকে বসলো।উন্মাদের মতন চারিদিকে তাকালো।দ্রুতই পকেটে হাত চালান করলো নিজের ফোন টেনে বের করার উদ্দেশ্যে।সকলে কোথায়?রোযার কি অবস্থা?আর কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব নয়।

নিহাদের নম্বরটিতে ডায়াল করতে গিয়েও একটি দৃশ্য অবলোকনে স্থির হতে বাধ্য হলো আসমান।চট করে ফোনের স্ক্রীন থেকে মাথা তুলে তাকালো সামনে।দুজন নার্স পাশাপাশি হেঁটে এগিয়ে আসছে।একজনের হাতে পরিচ্ছন্ন তোয়ালেতে মোড়ানো কিছু একটা।অত্যন্ত সাবধানে সে ধরে রেখেছে তা।আসমানের অবয়ব নজরে আসতেই উভয় নার্স ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলো।তার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলো।উদ্বিগ্ন এবং ভয়ংকর আতঙ্কিত কৃষ্ণগহ্বরখচিত নয়নে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে।একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করে এগিয়ে এলো একজন নার্স।আসমানের বিদ্ধস্তপ্রায় অবয়ব লক্ষ্য করেও চেহারায় বিস্তর হাসির প্রস্ফুটন ঘটালো।
– কংগ্র্যাচুলেশন্স,মিস্টার রেমান।আপনি একটি সুস্থ সবল পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন।
একদৃষ্টে চেয়ে রইলো আসমান নার্সের কোলে অতি সাবধানে ধরে রাখা পরিচ্ছন্ন বস্ত্রে আচ্ছাদিত তুচ্ছপ্রায় আকৃতির নবজাতকের পানে।নিজের শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে পারেনি সে,বর্তমানে দর্শন ইন্দ্রিয়কেও বিশ্বাস হচ্ছেনা।এ কি আরো এক স্বপ্ন?দুঃস্বপ্নের পর এক স্বর্গীয় স্বপ্ন?

– নরমাল ডেলিভারি হয়েছে।অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পর বেশি সময়েরও প্রয়োজন হয়নি,সৃষ্টিকর্তার রহমতে বেশ দ্রুতই ঘটে গিয়েছে সবকিছু।আপনার স্ত্রীও সুস্থ আছেন,শুধু বেশ দূর্বল।
অপর নার্স জানালো।জিজ্ঞাসা না করা সত্ত্বেও সে একজন সদ্য হওয়া পিতার বাকরুদ্ধ আবেগ উপলব্ধিতে সক্ষম।
নিজেকে রুদ্ধ করে রাখা সম্ভব হলো না আর।উঁকি দিলো আসমান,তোয়ালের মাঝে থাকা প্রাণটিকে অবলোকনের উদ্দেশ্যে।এক জোরালো ঝটকা অনুভব করলো সে সহসাই,নয়ন তার দ্বিগুণ প্রসারিত হলো উপলব্ধিতে।নবজাতক তার!গাঢ় গোলাপবর্ণের মুখমন্ডলজুড়ে নয়নরেখা বর্তমানে বুজে রাখা,শুধুমাত্র ছোট্ট ছোট্ট হাত দুখানা মুষ্টিবদ্ধ করে দুলিয়ে চলেছে বিনা কারণেই।মাথার ক্ষণকিছু চুল এলিয়ে রয়েছে।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চলছে,অত্যন্ত দ্রুত ওঠানামা করছে ছোট্ট বুকটি।কাদঁছে না সে,সেই পর্ব খতম হয়েছে ইতোমধ্যেই।

সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এলো আসমানের।কেমন অনুভব হচ্ছে এই মুখদর্শনে?জানেনা সে।
শুধু এটুকু জানে,বাবা হয়েছে সে।আরো একবার পিতৃত্বের দায়িত্ববোধ তার অস্তিত্বে জড়িয়েছে অলংকারস্বরুপ।
বাবা হয়েছে আসমান,এক পুত্রসন্তানের বাবা!তার সন্তান,তার র*ক্ত,তার অংশ…. তার ছেলে!
পরিচ্ছন্ন বস্ত্রে মোড়ানো অংশের উদ্দেশ্যে চেয়ে আসমানের পাথুরে অন্তরে ঠিক কেমন অনুভূতি হলো তা এই পৃথিবীর কোনো ভাষায় লিপিবদ্ধ কিংবা বর্ণনা করা সম্ভবপর নয়।জলজ্যান্ত প্রশান্ত পুরুষটিকে বর্তমানে দেখাচ্ছে দূর্বার উদ্ভ্রান্ত।যেনো নিজের অন্তিম চিন্তাশক্তিটুকুও লোপ পেয়েছে।দুবাহু উত্তোলন করলো সে,কাপতে থাকলো প্রতিটি আঙুল হতে আরম্ভ করে একেবারে কনুই অবধি।দ্রুতই কাঁধ ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে।প্রচণ্ড কম্পনের তোড়ে অংশকে ছুঁয়ে দেয়া আর সম্ভব হলোনা তার পক্ষে।সমস্ত অস্তিত্ব তার থরথর করে কাপছে, হিমশীতল হয়ে আসছে সর্বাঙ্গ।নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়েছে, দপদপ করছে মস্তিষ্ক।অসহনীয় অনুভব,বুকের বাম পাশ রীতিমত খা*মচে ধরলো আসমান। তীব্রভাবে,নখের অংশ গেঁ*থে গে*লো তার ত্বকে। স্মৃতিরা কড়া নাড়ছে দুয়ারে,এক অভিশাপধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে বারংবার।

– আপ…আপনি ঠিক আছেন?
অংশকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন নার্স বিহ্বল হয়ে পড়ল এমন দশা লক্ষ্য করে।
– কল দি ডক্টর!
অপর একজন নার্স ডাক্তারকে ডাকতে ছুটতে গেলে আসমান হাত তুলে থামিয়ে দিলো,জোরালোভাবে মাথা নাড়লো।বারকয়েক ঢোক গিললো।তাকে দেখালো সদ্য কারামুক্ত উন্মাদের ন্যায়।মুহুর্মুহু তাকালো চারিপাশে, উদ্ভ্রান্ত খোঁজ তার।
– বাবা….বাবা কোথায়?
ফিসফিস শোনালো তার কন্ঠস্বর,অত্যন্ত দূর্বল এবং সিক্ত।যেনো প্রশ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে।উভয় নার্স হতবাক।বহুবার সদ্য হওয়া পিতাকে মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে।কিন্তু এই পুরুষ?তার মধ্যকার দোলাচল,দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং প্রত্যেকটি প্রতিক্রিয়া এতটাই গুরুতর যে বুকে কাপন ধরে যায়।
– বেইবি….
বিলাল রেমানের কন্ঠস্বর ধ্বনিত হতেই পাই করে ঘুরে দাঁড়ালো আসমান।করিডোর ধরে এগিয়ে আসছে নিহাদ এবং তার ঠিক পাশেই বিলাল রেমান। তাদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেলো সে।দুহাত আঁকড়ে ধরলো পিতার,পাগলপ্রায় হয়ে বলল,

– এদিকে আসো,বাবা এদিকে আসো!
টেনে নিয়ে গেলো সে পিতাকে,আপন অংশের উদ্দেশ্যে।
বিলাল হতভম্ব,নিজের সন্তানের উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।আসমান হাঁপাচ্ছে রীতিমত,কথাগুলো শোনালো তার ছন্নছাড়া,
– কোলে নাও…
– আসমান…
– তুমি…কোলে নাও…
– বেইবি….
– দোহাই লাগে!তুমি ওকে কোলে নাও বাবা!

ভগ্নপ্রায় স্বরে চিৎকার ছুড়লো আসমান,দৃষ্টি উপচে তার বাহিত হলো এক ফোঁটা অশ্রুধারা।দৃশ্যপানে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো সকলে।এ কেমন পিতৃত্বের আবেদন?স্তব্ধ যেনো গোটা ধরিত্রী।
আসমান দুহাতে মাথা চেপে ধরে দেয়ালের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়ালো।অশ্রু তার বাঁধ ভেঙেছে।নিজের চুল নিজেই টেনে ধরলো আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে,কর্কশ কন্ঠে বলল,

– বাবা!কোলে নাও…ওকে…এক্ষুণি…
– কিন্তু তুমি ওর…
– আমি অভিশপ্ত!
আ*হত সিংহের গর্জন যেনো।স্তম্ভিত সকলে।আসমানের হাঁটু ভেঙে এলো,এক ফোঁটা অশ্রু রূপান্তরিত হলো শ্রাবণের বারিধারায়।সমুদ্রের উত্তাল ঊর্মীমালা যেনো বইছে তার কপোলজুড়ে।আবেগের জলোচ্ছ্বাসে প্রকম্পন জাগানিয়া এক ক্রন্দন।কাদতে কাদতে সে মেঝেতেই বসে পড়লো।নিজের গ্রীবাদেশ চেপে ধরলো দুহাতে,
– আমার অভিশাপ লেগে যাবে!তুমি ধরো…বাবা তোমার দুটো পায়ে পড়ি তুমি ওকে কোলে নাও!
সত্যি সত্যি বিলালের পায়ের উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালো আসমান,তৎক্ষণাৎ পিতা জোরালোভাবে সন্তানের কাঁধ চেপে ধরে ধমকে উঠলেন।

– আসমান!উঠে দাঁড়াও,এক্ষুণি,এই মুহূর্তে দন্ডায়মান হও!
নিহাদ ছুটলো,গুরুর ভগ্নপ্রায় অবয়বকে জোরপূর্বক টেনে দাঁড় করালো।বিলাল তাকালেন সন্তানের উদ্দেশ্যে, তীক্ষ্ণ এক ক্রুব্ধ দৃষ্টি তার নয়নজুড়ে।আসমানের কপোল সিক্ত হয়েছে ক্রন্দনফোঁটায়,মাস্কের প্রান্ত ভিজে উঠেছে।গ্রীবায় গড়িয়ে অশ্রুদানা নেমে গিয়েছে একেবারে বুক অবধি।দৃশ্যটি পিতৃহৃদয়ে ঠেকলো অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকিয়ে পিতা ধমক দিলেন,
– অভিশপ্ত?তুমি?আর ইউ ইনসেইন অওর হোয়াট?
– বা…
– শাট আপ!আমি তোমার মুখ থেকে আর একটা কথাও শুনতে চাইনা।তোমার সন্তান ও!তোমার র*ক্ত!তোমার অংশ!তোমার ভবিষ্যৎ!

ফিরলেন বিলাল দ্বিধান্বিত নার্সদের কোলে ধরে রাখা নবজাতকের উদ্দেশ্যে,অবাধ্য অশ্রু তার কপোল গড়িয়ে নামতে থাকলো।পুত্রের উদ্দেশ্যে ফিরলেন অতঃপর,
– আসমান…তুমি এই মুহূর্তে তোমার অংশকে নিজের আলিঙ্গনে তুলে নিয়ে তার কানে খোদার পবিত্র বাণী বিড়বিড় করবে,এটা তোমার পিতার অনুরোধ নয়, আদেশ!
– আমি পারবো না…
ভেঙে পড়তে নিলো আসমান,কিন্তু নিহাদের জোরালো ভারসাম্যে দন্ডায়মান রইলো।বিলাল মাথা কাত করলেন, কঠোর কন্ঠে আদেশ ছুঁড়লেন,
– তুমি পারবে,তোমাকে পারতেই হবে!আমি শেষবারের মতন বলছি আসমান….কোলে নাও তোমার অংশকে।
কন্ঠতালু বেয়ে এক খাবলা অব্যক্ত অনুভূতি নেমে গেলো অমানিশার।খটখটে শুকনো অনুভূত হলো মুখ।তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় তাকালো নিহাদের দিকে,অস্ফুট অনুরোধ জানালো,

– নিহাদ,তুমি অন্তত…
– না,ভাই।
দুহাত তুলে সরে দাঁড়ালো শিষ্যরুপী ভাই তার। টলটল করছে চট্টলার বিহঙ্গের নয়ন।অসীম আবেগে সে বিড়বিড় করলো,
– তোমার সন্তান ও।বিশ্বাস করে নাও,তোমার অংশ আবির্ভূত হয়েছে এই জগতে।আগলে নাও তাকে।জন্মের পর জন্মদাতার আলিঙ্গন লাভ করতে না পারার মতন অভাগা তাকে করোনা।দোহাই লাগে তোমার!
পরিস্থিতির মাহাত্ম্য যেনো নবজাতকও অনুভব করতে সক্ষম।তাইতো এতক্ষণ যাবৎ নিঃশব্দে আপন জগতে বিচরণ করা তুচ্ছপ্রায় প্রাণটি তীক্ষ্ণ চিৎকার ছুঁড়ে কেঁদে উঠলো।অন্তরে মোচড় দিলো সকলের ওই ক্রন্দনধ্বনিতে,ঠিক যেনো পিতার যাতনার ভার জেঁকে বসেছে ওই সদ্য জন্মলাভ করা প্রাণটির মাঝে।নার্স দুইজন সতর্ক হলো।

– দেখুন,আপনাদের মাঝে এসব কি হচ্ছে জানিনা কিন্তু একজন নবজাতকের জন্য এমন পরিবেশ উপযুক্ত নয়।আমরা বেবিকে কেবিনে দেয়ার ব্যবস্থা করছি।
– দুঃখিত।
অবশেষে উচ্চারিত হলো আবেগে উন্মত্ত পিতার প্রশান্ত কন্ঠস্বর।নয়নের অশ্রু সে জোরপূর্বক মুছে নিয়েছে।নার্সের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কম্পিত দুহাত তুললো আসমান।এক মুহুর্ত দ্বিধা নিয়ে চেয়ে থেকে পরবর্তীতে নার্স তার আলিঙ্গনমাঝে হস্তান্তর করলো ক্রন্দনরত নবজাতককে।ত*ড়িৎ তরঙ্গ খেলে গেলো যেনো আসমানের প্রতিটি অ*ঙ্গ প্র*ত্যঙ্গ জুড়ে।অংশকে সে তুলে ধরলো,একেবারে নিজের বুকের সন্নিকটে।তার যান্ত্রিক হৃদয়ে এক ভাঙন ধরলো,এমন ভাঙন যে পৃথিবীর কোনো শক্তির পক্ষে পুনরায় তাকে যন্ত্রে পরিণত করা সম্ভব নয়।তোয়ালের মাঝে তার ছোট্ট অংশটি ছটফট করে কাদঁছে,পর্যবেক্ষণ করে গেলো অমানিশার নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বর।উল্টো ঘুরল সে,উপস্থিত নার্সদের থেকে আড়াল হতে। মাস্কটি খুললো টেনে খানিক।অতঃপর ঝুঁকে অধর ছোঁয়ালো নবজাতকের কপালে।এ যেনো অগ্নিপরীক্ষা!

হাওয়ায় উবে যাওয়া কর্পূরের মতন উধাও হলো ক্রন্দনধ্বনি।দৃষ্টি মেলে নবজাতক নিঃশব্দে চেয়ে আছে পিতার পুষ্ট ওষ্ঠযুগলের দুপাশ বেয়ে চলে যাওয়া দগদগে ঘা*য়ের দিকে।খেয়াল করলো আসমান,অংশ তার হুবহু তার চোখ লাভ করেছে।ছোট্ট দুইটি কৃষ্ণগহ্বর জ্বলজ্বল করছে তার উদ্দেশ্যে।একটি হাত উত্তোলিত হলো,কোনো ভীতি নেই,নেই সংশয়,শুধুই যেনো নিবিড় কৌতূহল।ছুঁয়ে দিলো অংশ নিজের পিতার কলঙ্ককে।স্পর্শ অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রের অশ্রুফোঁটা টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল নবজাতকের চেহারায়।অধর তার কপাল বেয়ে কানের নিকট থামলো।অকল্পনীয় এক নমনীয় কন্ঠস্বরে ফিসফিস করে উচ্চারণ করে গেলো অমানিশা,পবিত্র আযানের ধ্বনি। কাপলো তার কন্ঠ, ভেঙে এলো স্বর।কান্না মিলিয়ে গেলো,পিতার আলিঙ্গনে নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেলো অংশ।অতি মুগ্ধতায় অশ্রুসজল নয়নে চেয়ে রইলো সকলে।

পরিবেশ শান্ত হতেই নবজাতককে বুকে চেপে আসমান কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎ হাঁটতে শুরু করলো।নার্স দুইজন উদ্বিগ্ন হতেই বিলাল হাত তুলে তাদের আশ্বাস দিয়ে কিছু বললেন,অপরদিকে নিহাদ নিঃশব্দে আসমানকে খানিকটা দূর থেকে অনুসরণ করে গেলো।হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে নামাজঘরের সামনে পৌঁছলো আসমান।কোনো দ্বিধা না করেই জুতো খুলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো।নিহাদ প্রবেশপথের মুখে দাঁড়িয়ে শুধু নীরব পর্যবেক্ষণ করে গেলো, কোনোপ্রকার বাঁধা দিলোনা।

নামাজকক্ষটি ফাঁকা।কিছুক্ষণ আগে মাত্র আসরের নামাজ শেষ হয়েছে।আর কিছু সময় বাদে মাগরিবের ওয়াক্ত গড়াবে।আসমান ঈদগামের সামনে মাঝ বরাবর থেমে উবু হয়ে অতি সন্তপর্নে তার অংশকে কার্পেটের উপর রাখলো।তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালো।কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা,অতঃপর হাঁটু মুড়ে বসে শুকরিয়া সেজদায় অবনমিত হলো তার ম*স্তক।দ্বিতীয়বার সৃষ্টিকর্তার সামনে নতজানু হলো অমানিশা।দৃশ্যটি লক্ষ্য করে নিজের অশ্রু আটকাতে বিফল হলো নিহাদ, উল্টো ঘুরে দ্রুত টিস্যু বের করে চোখ মুছতে থাকলো।
সেজদা থেকে উঠে দ্রুতই নিজের অংশকে পুনরায় কোলে তুলে নিলো আসমান।ছোট্ট শরীরের মাঝে তার বৃহৎ দুহাত জড়িয়ে তুলে ধরলো,নিজের চেহারায় ছুঁইয়ে বিড়বিড় করলো,

– রহমানুর রহিম,আপনি পরম দয়ালু।ভেবেছিলাম আমার ভাগ্য বুঝি শুধুই অভিশপ্ত।কিন্তু না। আপনি আমাকে আজ ভুল প্রমাণিত করে দিলেন।আমার অংশের পদার্পণে গুঁড়িয়ে দিলেন এই অভিশাপ চক্রের রেখাকে।আজ সত্যিই প্রমাণিত হলো, আপনি কতটা নমনীয়।আমার মতন পাপীষ্ঠের প্রার্থনা কবুল করেছেন আপনি,শুধুমাত্র কবুলই নয়,আমার গোটা অনর্থক জীবনকে আপনি ভালোবাসার অর্থে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
ভেঙে এলো আসমানের কন্ঠস্বর,আপন অংশের দিকে চেয়ে অশ্রুপাত হলো তার।তবুও জারি রাখলো,
– রক্ষা করেছেন আপনি আমার জ্যোৎস্নাকে,রক্ষা করেছেন আমার অংশকে।আফসোস হচ্ছে আজ,প্রচণ্ড আফসোস।যদি ঐ কালো অতীতের দিনগুলোতে একটাবার আপনার দ্বারস্থ হতাম তাহলে হয়তো….
নিজেকে নিজে থামালো আসমান।মাথা নাড়লো।অতীত স্মরণীয়,তবে কালো অতীত তার বর্তমানকে অগ্রাহ্য করার মতন ক্ষমতাশালী নয়,সে কোনোদিন তা হতে দেবেনা।অংশকে আরো একটু নিকটে তুলে ধরলো সে, তাতে অস্ফুট কিছু শব্দ করে ক্ষীণ হাতের আঙুলে নবজাতক আঁকড়ে ধরতে চাইলো পিতার চেহারার অংশ।এক চিলতে হাসলো আসমান,কান্নামাখা হাসি।

– আমার কৃতজ্ঞতা কবুল করুন খোদা,আপনার রহমতের বারিধারা বর্ষিত করুন এই নবজাতকটির উপর।পিতার অভিশাপ,কলঙ্ক কিংবা পঙ্কিলতা যেনো কোনোদিন তাকে ছুঁতে না পারে।এই নবজাতকের জন্মদাত্রীকে রহম করুন খোদা,তার ভাগ্যে আমার সবটুকু সুখ তুলে দিন,সে যেনো ভালো থাকে,সুস্থ থাকে, আমার পাশে থাকে আজীবন এবং হাসতে থাকে।
মাথা তুলে অদূরে তাকালো আসমান,অদৃশ্যমান মহা পরাক্রমের উদ্দেশ্যে।

– আজ আপনার দুয়ারেই এই পাপীষ্ঠ বান্দার জীবনের নতুন অধ্যায়ের নামকরণ হোক….
মাথা ঝুঁকিয়ে তুচ্ছ আকৃতির প্রায় ওজনহীন অংশের অতি কোমল অধরে নিজ অধরের স্পর্শ বুলিয়ে এনে আসমান ম্রিয়মাণ আবেগী কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– অবশেষে আবির্ভূত হয়েছ তুমি, জন্মদাতাকে ভাসিয়েছ অনুভূতির জলোচ্ছ্বাসে।ভেঙে গিয়েছে আজ যান্ত্রিকতার দুয়ার চিরস্থায়ীভাবে,টলটলে আবেগে ভাসছে অন্তর।পরিপূর্ণ করেছ তুমি আমাকে আজ।আমার আর তোমার জননীর জীবনের পূর্ণতা নিয়ে তুমি পবিত্র পদধূলিতে উদ্ভাসিত করেছ ধরিত্রীকে।তুমি আমার অংশ,আমার অস্তিত্ব,তুমি আমার…….পূর্ণ……
সামান্য একটু থামলো আসমান,আপনমনে বিস্তৃত হাসলো,
– আদহাম রেমান পূর্ণ।
প্রতি উত্তরস্বরুপ এক তীক্ষ্ণ শব্দ করে অবশেষে জন্মদাতার গালের অংশ সফলভাবে আঁকড়ে ধরতে সক্ষম হলো অংশ।

কেবিনের দরজা খুলতেই রোযার দৃষ্টি আপতিত হলো তার চাঁদ এবং কোলের অংশের উদ্দেশ্যে।বিছানায় উঠে বসে আছে সে,যদিও শরীর প্রচন্ড দূর্বল তবুও ভালোবাসার চিহ্নকে আগলে নেয়ার সুতীব্র বাসনা তাকে আচ্ছন্ন করে নিয়েছে।জন্মের পরই সন্তানকে জননীর বুকে দেয়া হলেও খায়েশ মেটেনি তার।বিশেষ করে আসমানের কোলে তাদের সদ্য জন্ম নেয়া অংশ,এই দৃশ্যটি যেনো স্বয়ং স্বর্গ হতে নেমে এসে রোযার নয়নকে মগ্ন করেছে।
রোযা এবং আসমানের মাঝে নীরব দৃষ্টি বিনিময় হলো। কৃষ্ণগহ্বর এবং তারকাখচিত উভয় নয়নজুড়ে ঘটলো সহস্র অব্যক্ত অনুভূতির আদান প্রদান,শব্দের উচ্চারণের দরকার পড়লোনা।এগোলো আসমান নিঃশব্দে,বিছানার পাশে বসে নিজের আলিঙ্গনে অতি যত্নে আগলে রাখা অংশকে তুলে ধরলো সে জন্মদাত্রীর উদ্দেশ্যে।সামান্য ঝুঁকলো রোযা,ঝাপসা দৃষ্টিতে মুগ্ধ তাকালো পূর্ণতার তুচ্ছপ্রায় আকৃতির অবয়বে।কেমন অনুভব করলো জননী?প্রকাশের কোনো ভাষা হয়না।

ক্যানোলা সম্বলিত কাপা কাপা দুবাহু বাড়িয়ে ধরলো জ্যোৎস্না।নিজের সন্তানকে প্রথমবারের ন্যায় আলিঙ্গনে তুলে অবলোকনে দৃষ্টি ঝাপসা হলো অঝোর অশ্রুধারায়।ছোট্টদেহী প্রাণটি ছটফট করে চলেছে।ডাগর ডাগর নয়নজোড়া উন্মুক্ত।তাতে খচিত প্রগাঢ় কৃষ্ণগহ্বরের মাঝে যেনো তারকার ঝিলিক।একদম একইরকম সেই চাহুনি।মুখায়বের গাঁথুনিতে স্পষ্টতর পরিচয়ের প্রতিফলন।কাকতালীয় অনুভবের সীমা লঙ্ঘন করে গিয়েছে একদম বুকের ডান দিকের একই স্থানে শোভা পাওয়া তিল পর্যন্ত।
অশ্রুমিশ্রিত কন্ঠে হেসে ফেললো রোযা,অংশকে তুলে ধরে তার কোমল কপালজুড়ে নিজ কপাল ঠেকিয়ে বিড়বিড় করলো,

– নয় মাস আঠারো দিন গর্ভে রাখলাম আমি,আর আপনি হলেন বাবার কার্বন কপি?এ কেমন অবিচার?
নবজাতক কিছু বুঝেনি স্পষ্ট,তবুও ওই চিরায়ত কোমল মুখজুড়ে এক প্রফুল্ল আবাহন খেলে গেলো।পুনরায় হেসে উঠলো রোযা,এক পরিতৃপ্তির হাসি।দৃশ্যটি নিষ্পলক দেখে গেলো আসমান।দৃষ্টি ফেরানো দায়।
– আমার অংশ,আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন,তুমি এই পৃথিবীতে পদার্পণ করে আমায় ধন্য করেছ।তোমার জননী আপ্লুত যে তুমি একদম তোমার বাবার মতন দেখতে হয়েছ।আমার চাঁদের টুকরো….
ধরে এলো কন্ঠ,কেঁদে ফেললো রোযা।আসমানের হাত জড়িয়ে গেলো তার কাঁধজুড়ে।অতঃপর তার কানের কাছে ফিসফিস কন্ঠে উচ্চারিত হলো,

– পূর্ণ….
– হুম?
– ওর নাম,পূর্ণ।
ঝট করে রোযা এক পলক তাকালো আসমানের উদ্দেশ্যে,পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি ফেরালো নবজাতকের পানে।উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– পূর্ণ?আমাদের পূর্ণ?
– আমাদের পূর্ণ।চাঁদ এবং জ্যোৎস্নার পূর্ণিমা,পরিপূর্ণতা, পূর্ণ!
– চাঁদ!

মাথা উঁচিয়ে স্বামীর কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো রোযা, আগলে রাখলো ভালোবাসার চিহ্নকে,পূর্ণকে।আসমান দুবাহুর মাঝে আড়াল করে নিলো তাদের,আপন উষ্ণতায় আচ্ছাদিত করে রক্ষা করলো গোটা ধরিত্রীর কাছ থেকে।
– একটা কথা স্মরণে রেখো চাঁদ,তুমি কোনো অভিশাপ নও।তুমি আমার ভাগ্যাকাশের সুখের চাঁদ। তুমি সেই চাঁদ যে নিজের কলঙ্কে উদ্ভাসিত রোশনাইয়ে আমার গোটা জীবন রাঙিয়ে দিয়েছে।তুমি সেই চাঁদ যে আমায় পরিপূর্ণতা দান করেছে,উপহার দিয়েছে পূর্ণকে!ম্রিয়মাণ হয়োনা চাঁদ,কখনোই না।আমার এবং আমার সন্তানের অভূতপূর্ব ভাগ্য যে আমরা তোমার মতন এক আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল অস্তিত্বকে স্বামী এবং পিতা হিসাবে লাভ করেছি।তুমি আমাদের কলঙ্কিত চাঁদ,এই কলঙ্ক অভিশাপ নয়,পরাক্রমী শক্তি।

মাথা তুলে বিভীষিকা খচিত কপোলজুড়ে অধরের স্পর্শ বুলিয়ে আনলো রোযা,অত্যন্ত যত্নভরে।শিথিল হয়ে এলো আসমানের হৃদস্পন্দন।বুঝতে একটুও বাকি রইলোনা,অর্ধাঙ্গিনী তার কেনো এই কথাগুলো বলেছে।নিশ্চয়ই কারো না কারো নিকট সে ঘটে যাওয়া ঘটনার আভাস পেয়েছে।এমনি তো মেয়েটা।নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলিয়ে যায় সে।চাঁদের শক্তি সে,অবলম্বন অমানিশার।সে যে স্বয়ং জ্যোৎস্না, চাঁদকে উদ্ভাসিত করাই যার ধর্ম।সে যে অমানিশার মহারাণী, আঁধার পথের পাথেয় হওয়াই তার কর্তব্য।

– ভালোবাসি জ্যোৎস্না।
– ভালোবাসি চাঁদ।
এর বেশি আর কিছুই উচ্চারণ করা সম্ভব হলোনা।একে অপরের কপালে কপাল ঠেকালো।অশ্রুর সকল বাঁধন আজ হার মেনেছে।টপটপ করে গড়িয়ে চলেছে উভয়ের কপোল বেয়ে।সিক্ত অনুভূতির মাঝে পূর্ণতার বিচরণ।তাদের র*ক্ত,তাদের অংশ,তাদের ভালোবাসার চিহ্ন।অবশেষে এক সুখকর সমাপ্তির ইশারা।

দুই সপ্তাহ পর।
পুরান ঢাকার নিকটবর্তী এক স্থান।কবরস্থানের বাইরে একজন দারোয়ানের অলস প্রহরা।তার নিদ্রাচ্ছন্ন মুহূর্ত ভাঙলো একটি বিলাসী গাড়ির চাকার মৃদুমন্থর কর্কশ শব্দে।দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ কচলে তাকালো সে সাবধানী ভঙ্গিতে,অন্যথায় চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়তে পারে।
কালো বর্ণের তকতকে পোর্শে রেসিং মডেলের গাড়ির দরজা খুলে বাইরে পা রাখলো আসমান।পরিধানে খাকী শার্ট এবং কালো ফরমাল।অদ্ভুত হলেও সত্যি সেদিন তার গাড়িটি হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলো অচেনা লোকদুটো,অদ্ভুত তাইনা!প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে হাত ধরে সে নামতে সাহায্য করলো খয়েরী বর্ণের সালোয়ার কামিজে আচ্ছাদিত রোযাকে। অর্ধাঙ্গিনীর কোলে তাদের ভালোবাসার চিহ্ন পূর্ণ।ছোট্টদেহী দিন চৌদ্দ বয়সী শিশুটি নমনীয় কোমল বস্ত্রে মোড়ানো।একটি ছোট্ট পাতলা হুডি অভ্যন্তরে পরনে।রোযা বেশ সাবধানে পূর্ণকে ধরে রেখেছে।কবরস্থানের প্রবেশপথের নিকটে এসে আসমান সন্তানকে নিজের কোলে তুলে নিলো।দিবাকরের রশ্মি হতে আড়াল করে এগিয়ে গেলো। বছরখানেক পুরাতন কবরের সামনে এসে উভয়ে থমকালো। ফলকে এখনো স্পষ্ট অক্ষরে খচিত,

” ইউনূস রহমান”
নিজের মাথায় ওড়না ছড়িয়ে দিয়ে নিষ্পলক তাকালো রোযা,আসমানের হাতের বাঁধন তার কাঁধে চাপলো, ভরসা দিলো যেনো।আর্দ্র দৃষ্টিতে স্বামীর উদ্দেশ্যে চেয়ে পরক্ষণে কবরের দিকে ফিরলো সে,
– কেমন আছো দাদু?
রোযার কন্ঠস্বর ম্রিয়মাণ শোনালো,অসংখ্য আবেগ জড়ানো তাতে।এক ফোঁটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ল রমণীর নয়ন থেকে।যে মানুষটাকে নিয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সবকিছুর সূত্রপাত হয়েছিল, আজ তার সামনেই নিজের গোটা পরিবারসমেত হাজীর হয়েছে রোযা।তার এই সুখ,এই প্রাপ্তি ওই মানুষটা ছাড়া অসম্পূর্ণ।নিজেকে সংযত করে রোযা বিড়বিড় করলো,

– দেখছ দাদু?তুমি যেমনটা চেয়েছিলে ঠিক তেমনটাই হয়েছে।আমার জীবন আজ পরিপূর্ণ।মা হয়েছি আমি, তোমার নাতির জননী।আজ আমার জীবনে সবকিছুই আছে,শুধুমাত্র তুমি নেই।তোমার প্রতি আমার খুব অভিমান।কেনো চলে গেলে তুমি?আর একটু সময় ক্ষেপন করা যেতো না?এই সুখের মুহূর্তটুকু নিজের চোখে উপলব্ধি করে যাওয়া যেতো না?দাদু….তোমার চড়ুইকে তিল তিল করে মানুষ করেছ তুমি,আর একটু বেশি তার পাশে তার হাতটা ধরে থাকলে কি ক্ষতি হতো? দাদু….দাদু আমার….

দাঁত দিয়ে অধর কা*মড়ে ধরলো রোযা,ওই বৃদ্ধ মানুষটির অমায়িক হাসিমাখা চেহারা ভাসছে তার নয়নপটে। প্রচন্ড স্মরণে আসছে অতীতের মুহূর্তগুলো।যার জন্য তার জীবনে আমূল পরিবর্তন।যদি না ইউনূস রহমান থাকতেন,তাহলে হয়তো কোনোদিনও আসমান নামক এক রুদ্র অস্তিত্বের সঙ্গে তার সাক্ষাৎই হতোনা।রোযার জীবনে,প্রতিটা লগ্নে,প্রতিটা চেতনায় না থেকেও গভীর প্রভাব ফেলে গিয়েছেন ইউনূস।নিজের নাতনীকে গড়ে গিয়েছেন আপন সন্তানের মতন।

পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে প্রেয়সীর অশ্রুজল মুছিয়ে নিয়ে তার হাতে দিলো আসমান।অতঃপর সামনে ফিরলো।এগিয়ে গেলো,কবরের একদম সন্নিকটে।কোলে তার পূর্ণ।ডাগর ডাগর নয়নে চেয়ে আছে সে পিতার কাঁধ আঁকড়ে ধরে। থমকালো আসমান,দমকা হাওয়া আসতেই পূর্ণকে চেপে ধরলো, আড়াল করে নিলো প্রাকৃতিক দ্বন্দ্বের হাত থেকে।অতঃপর তাকালো কবরের মাটির উদ্দেশ্যে।স্মৃতির পাতা ওল্টালো,স্মরণে এলো বৃদ্ধ মানুষটির আর্জি,
” আমার চড়ুইকে সুখ দিও…… একটুখানি সুখ।”
” দুঃখিত,আপনার কথা রাখা কোনোদিনও সম্ভব হবেনা এই অভিশপ্ত অমানিশার পক্ষে।”
সেদিন উচ্চারণ না করলেও অন্তরে বাক্যটি ধ্বনিত হয়েছিল বারংবার।কিন্তু আজ, বহু সময় পেরিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন উত্তর উচ্চারিত হলো,

– আমি কথা রেখেছি….দাদু।
রোযা নীরব পর্যবেক্ষণ করে গেলো দৃশ্যটি।আসমান হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে বসলো,পূর্ণ ছোট্ট মাথা হেলিয়ে তাকালো কবরের দিকে,ভীষণ কৌতুহলী আবেগ তাতে।
– উনি তোমার মাম্মাম আর পাপ্পার দাদু,প্রজাপতি।
তুচ্ছপ্রায় হাতটি পূর্ণ বাড়িয়ে ধরলো,
– উউম…

অস্ফুট এক স্বর নির্গত হলো।আসমান ছেলের হাত সাবধানে ধরে আলতো করে স্পর্শ করালো কবরের মাটি।তারপরই সরিয়ে নিলো,চুমু খেলো ছোট্ট হাতে।অতঃপর উঠে দাঁড়ালো,পিছনে সরে রোযার নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো।মুখ তুলে পূর্ণর কপালে স্নেহের স্পর্শ ছুঁইয়ে দিলো রোযা।তার কোমর জুড়ে জড়িয়ে গেলো আসমানের একটি হাত,অপর হাতে তাদের অংশ,পূর্ণ।হাসলো রোযা,আসমানের নাকে নাক ঘষে কাঁধে মাথা রেখে কবরের উদ্দেশ্যে তাকালো,

– দাদু,তোমার চড়ুই সুখে আছে,খুব সুখে।
উভয়ই চেয়ে রইলো,একদৃষ্টে। মৃদুমন্থর হাওয়া বয়ে চললো, কেশগুচ্ছ এলোমেলো হলো,মোনাজাতে হাত উঠলো।পূর্ণ আপন অপরিণত দৃষ্টিতে অবলোকন করলো পিতামাতাকে।
সময়টি মধুর,স্বর্গীয় সুধাময়।

অতিবাহিত হয় সময় নামক অপ্রতিরোধ্য স্রোতস্বিনীর দূর্বার স্রোত।উজান ভাটির উত্থান পতনের ধারায় খচিত হয় নবযাত্রা।ঋতুর বদলের মাঝে ঘুরেফিরে আসে সুখ শান্তি এই ভালোবাসাময় ধরিত্রীর নীড়জুড়ে।জীবনের প্রয়োজনে অসীম সংগ্রামরত মানুষগুলো হাসিল করে একটুখানি ভালো থাকার অধিকার।এ তাদের পুরস্কার, পরাক্রমশালী স্রষ্টা কর্তৃক পরীক্ষণের পর নিবেদিত কাঙ্ক্ষিত মধুর ফলাফল।
লিটল স্টার কিন্ডারগার্টেন।

সপ্তাহের অন্তিম দিন, বৃহস্পতিবারের ক্লাসজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়,গান,ছবি আঁকা,আবৃত্তি,নাচ ইত্যাদির মতন সৃজনশীল কার্যক্রমের। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।উৎফুল্ল,নিষ্পাপ শিশুগুলোর চোখমুখজুড়ে এক বিশালতার খুশির আবাহন।ঝিলিক খেলে যাচ্ছে তাদের বৃহৎ, সরু,বৃত্তাকার বিভিন্ন আকৃতির নয়নজুড়ে।আবদ্ধ তা একটিমাত্র দিকে।একটি স্টুলের উপর জলপাই বর্ণের কোট ইউনিফর্ম পরিধানকৃত শিশু ছেলেটি হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে বসেছে,হাতে শোভা পাচ্ছে কাষ্ঠ বর্ণের একটি বাদ্যযন্ত্র—উকুলেলে।তার মধুর সুরচারনায় মুখরিত চারিপাশ।শিক্ষক শিক্ষিকাগণও কিঞ্চিৎ আবেশিত ভঙ্গিতে চেয়ে আছেন,দৃশ্যটি হতে দৃষ্টি ফেরানো দায়।ক্ষণিক মুহূর্তের সুরেলা জাদু।অতঃপর শিশুটির সঙ্গে একেবারে অমানানসয়ী দরাজ কণ্ঠের আবাহন এক লহমায় গোটা শ্রেণীকক্ষকে ঐন্দ্রজালিক মায়াজালে ঘিরে ফেললো।

~বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে
দিসনে আজি দোল
আজও তার ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি
তন্দ্রাতে বিলোল~
শিশুসুলভ দরাজ ভাঙা কণ্ঠের মাঝে নজরুলগীতির আবাহন ঠেকলো দারুণ অনুভূতি জাগানিয়া।প্রত্যেক পংক্তিতে পংক্তিতে জড়িয়ে অজস্র আবেগের খেলা।একমনে উকুলেলের স্ট্রিংয়ে আঙুল খেলে চলেছে তার।
~আজও হায় রিক্ত শাখায় উত্তরী বায়
ঝুরছে নিশিদিন
আসেনি দখনে হাওয়া গজল গাওয়া
মৌমাছি বিভোল
বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে
দিসনে আজি দোল~

প্রতিটি মানুষের অন্তরে দোলা দেয়া এক অপরিপক্ক অথচ মায়াবী সুরের খেলা।অনুভূতির ভাঁজে ভাঁজে বাঁধা পড়ে অন্তর,নিজের অস্তিত্ব যেখানে অনুধাবন করা দায়। ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে সেই সুরের ছন্দপতন ঘটলেও তাই কেউই সম্মোহনী আবেশ থেকে বেরোতে পারলোনা যেনো।শিশুটি নিজের হাতের উকুলেলে নিয়ে স্টুল থেকে লাফিয়ে নিচে নামতেই থপ করে হওয়া শব্দটি সকলের জাদুর মোহ ভাঙলো।তৎক্ষণাৎ নড়েচড়ে উঠলো সকলে, করতালিতে উদ্ভাসিত হলো চারিপাশ।
– আউটস্ট্যান্ডিং!তুমি এত চমৎকার গান গাওয়া কোথা থেকে শিখেছ পূর্ণ?
শিক্ষিকার প্রশ্নে শিশু পূর্ণ মাথা হেলিয়ে ফিরে মুচকি হাসলো।তার মসৃণ কপোলের একপ্রান্তে গভীর এক টোলের উৎপত্তি ঘটলো তাতে।কোমল সেই স্নিগ্ধ হাসিতে সে জানালো,

– আমার পাপ্পার কাছ থেকে।
প্রফুল্ল হলো সকলে,শিক্ষিকা তার কাঁধ চাপড়ে বললেন,
– তোমার পাপ্পা,ইউ মিন মিস্টার নীলাদ্রি?
– জ্বি।আমার পাপ্পা আমাকে রোজ ঘুম পাড়ানোর সময় এই গানটা গায়,আমার খুব খুব প্রিয়।
মনোমুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করে শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন শিক্ষিকা। কিন্ডারগার্টেনে আরো সব দূর্দান্ত শিক্ষার্থী থাকলেও এই ছেলেটির প্রতি তিনি সম্পূর্ণ অজানা এক কারণে প্রচন্ড মমত্ববোধ করেন।
ক্লাসের সমাপ্তি হতেই শিশুদের দল ছোটাছুটি করে বেরোতে আরম্ভ করলো।পূর্ণ ধীর পদক্ষেপে কাঁধের ব্যাগটি টেনে দীর্ঘ করিডোর বেয়ে এগোতে লাগলো, চারিপাশে তার পরিচিত বন্ধুরা সকলে হাত নেড়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে,পাল্টা হেসে তাদের বিদায় দিলো পূর্ণও।এক হাতে তার একটি ট্যাব,তাতে ব্লুটুথ এয়ারবাড যুক্ত করে কিছু একটা শুনে চলেছে সে একনাগাড়ে।

– ওতোসা… ওতো…
– পূর্ণ!
নিজের পিঠে খানিক ধাক্কা অনুভব করে চটজলদি এয়ারবাড খুলে ফিরে তাকালো পূর্ণ। তার এক মেয়ে সহপাঠী ডাগর ডাগর উত্তেজিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।হাসলো পূর্ণ, শুধালো,
– বলো সুপ্রিয়া।
– তুমি আজকে দূর্দান্ত গান গেয়েছো।
– ধন্যবাদ।
– তোমার পাপ্পাও কি তোমার মতই এত চমৎকার গান?
খানিক ভাবলো পূর্ণ,পরবর্তীতে মাথা হেলিয়ে জানালো,
– আমার পাপ্পা আমার চাইতেও অনেক অনেক অনেক গুণ ভালো গায়।
– আমাকে শোনাবে?

পূর্ণ খানিক থমকালো। সুপ্রিয়া উৎফুল্ল ভঙ্গিতে চেয়ে আছে।তার দৃষ্টিতে চেয়ে অমানিশার অংশ জানালো,
– আমি দুঃখিত সুপ্রিয়া,কিন্তু আমার পাপ্পা তার পরিবার বাদে কাউকে কখনো গান গাইয়ে শোনায় না।
– তুমি রেকর্ড করে আনবে?
– দুঃখিত।
জবাবে মেয়েটিকে বিষাদী নয় বরং খানিক কৌতুহলী মনে হলো।উভয়ে করিডোর ধরে এগিয়ে গেলো। চট করে পূর্ণর হাতের ট্যাব নজরে আসতেই সুপ্রিয়া শুধালো,
– তুমি ওটাতে কি করছো পূর্ণ?
– শিখছি।
– কি শিখছ জানতে পারি?
– জাপানিজ ভাষায় কিভাবে বাবাকে সম্বোধন করা হয়।
– জাপানিজ?কি বলা হয়?
– ওতোসামা।কোরিয়ানে বলে আপ্পা, উর্দুতে আব্বা, ইতালিয়ান, রাশিয়ানে পাআপা….

বিস্মিত হয়ে সুপ্রিয়া চেয়ে থাকলো উত্তেজিত হয়ে ব্যাপারটি বর্ণনা করে যাওয়া পূর্ণর উদ্দেশ্যে।ছেলেটির প্রগাঢ় গভীর কৃষ্ণগহ্বর খচিত নয়নজুড়ে অনুভূতির খেলা যেনো।
– তুমি কতোগুলো শিখেছ?
– উম….এই পর্যন্ত বাইশখানা হবে।
– এতোগুলো ভাষাতে তোমার বাবাকে ডাকা শিখছো কেনো?পাপ্পা বললেই হয়।আমি তো আমার বাবাকে ড্যাড বলে ডাকি।
মৃদু হাসলো পূর্ণ,পুষ্ট কোমল অধরে তা ঠেকলো ভীষণ মায়াবী রহস্যময়।না চাইতেও সেই হাসির পানে চেয়ে নিজেও প্রফুল্লতায় ছেয়ে গেলো সুপ্রিয়া।পরক্ষণে বিড়বিড় করলো,
– তুমি তোমার পাপ্পাকে খুব ভালোবাসো, তাইনা পূর্ণ?

গুটিগুটি পায়ে কিন্ডারগার্টেন থেকে বেরোতেই সামনের দৃশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থবির করে দিলো পূর্ণকে।চেহারায় প্রস্ফুটিত হলো তার প্রফুল্লতার ঝিলিক, কৃষ্ণগহ্বর নয়নজুড়ে খেলে গেলো দারুণ উত্তেজনা।
– ইও মাই সানফ্লাওয়ার!
নীলচে শার্ট এবং জিন্স পরিধানে উৎফুল্ল সুদর্শন চেহারাটি পূর্ণর অন্তরে খুশির ঢেউ খেলিয়ে দিলো।তার পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ,মামা,চাচা,বন্ধু,শিক্ষক, একনাগাড়ে ক্রাইম পার্টনার,নিহাদ!ছুটলো সে,দুবাহু উদ্যত করে,
– মাচা!
শিশুসুলভ খিলখিলে হাসির উদগীরণ ঘটতেই নিহাদ দৌঁড়ে গিয়ে তাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে একেবারে কাঁধের উপর চাপিয়ে বসালো,তার ঘাড় আঁকড়ে ধরে হাসতে থাকলো পূর্ণ।প্রচণ্ড উত্তেজিত কন্ঠে বললো,

– মাচা মাচা মাচা!তুমি এসে গিয়েছ!
– হুম,এসে গিয়েছি।আমার ঝিংকুটাকে ফেলে বেশিদিন থাকি কি করে?
– তুমি কিন্তু এইবার দিনে এসে দিনে যেতে পারবেনা, খবরদার!
– অবশ্যই।এবার শ্বশুর আব্বার ভিটায় ঘরজামাই হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এসেছি।
নিহাদ চোখ টিপ দিতেই হেসে উঠলো পূর্ণ।
– আজকে আমরা অনেক মজা করবো তাইতো?
– একদম।গুরু দেবের ক্যালমা গানে উড়াধুরা নাচবো।হেই বলো,দাদু গেলো চমকে,পাড়া গেলো থমকে,মাথা গেলো বমকে কি দেখে ভাই?
– খোকাবাবু যায়,লাল জুতো পায়…

– বড় বড় দিদিরা সব উঁকি মেরে চাআআআআআ…. আসমান ভাই…. ওবুক ওবুক ওবুক!
নিহাদের কানে জোরালো টান পড়তেই গানের সুর হরহরিয়ে রূপান্তরিত হলো আর্তনাদে।পাশ থেকে তীব্র কৃষ্ণগহ্বরে চেয়ে অমানিশা শুধালো,
– আমার অংশকে এসব কি শেখাচ্ছো তুমি?আজকে বাড়িতে চলো,তোমার হচ্ছে!কোন দুঃখে যে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি!
– পাপ্পা!
কর্ণগোচর হতেই আসমান নিহাদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সন্তানের দিকে তাকালো।পূর্ণ বিস্তর হেসে দুবাহু বাড়িয়ে ঝুঁকে আসতেই তীব্রতর দৃষ্টি কোমল আবহে ছেয়ে গেলো,তাকে নিহাদের কাঁধ থেকে হটিয়ে নিজের আলিঙ্গনে তুলে নিলো আসমান।তার বুকে মাথা গুঁজে বারকয়েক হাসলো পূর্ণ।নিহাদ বেচারা ছাড়া পেয়ে নিজের কানের লতি ডলতে ডলতে গিজগিজ করতে থাকলো,

– বাজি রে বাজি…জ*ল্লাদ হাুউও![জ*ল্লাদ কাক]
তার বেদনায় থোড়াই কেয়ার ভাব দেখিয়ে আসমান নিজের অংশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করলো,
– আজকের স্কুল কেমন কেটেছে প্রজাপতি?
– খুউব ভালো!আমি…
– তোমার ইউনিফর্ম কোথায় আব্বু?
সমাপ্ত করার আগেই থমকে গেলো পূর্ণ।আসমানের দৃষ্টি তার ছোট্ট অবয়বজুড়ে।সাদা শার্ট এবং জলপাই বর্ণের প্যান্ট পরিধানে থাকলেও কিন্ডারগার্টেনের ব্যাজ সম্বলিত ইউনিফর্মটি উধাও।শার্টেও কিঞ্চিৎ ধূলোবালি লেগে রয়েছে।মুখ তুলে তাকালো অংশ,পিতার গলা জড়িয়ে ধরে মিষ্টি কন্ঠে জানালো,

– একটা মেয়েকে ধার দিয়েছি পাপ্পা।
– মেয়ে!তুমি এই বয়সেই মেয়ে পটানো শুরু করে দিয়েছ!সাবাস বাঘের বাচ্চা…না থুক্কু থুক্কু,বাঘের ভাতিজা!
– শাট আপ!
বিরক্তভরে নিহাদের পিঠ চাপড়ে সরিয়ে দিয়ে আসমান পূর্ণর উদ্দেশ্যে ফিরলো। কেশগুচ্ছে আঙুল চালিয়ে তা গুছিয়ে দিতে দিতে শুধালো,
– কেনো ধার দিয়েছ জানতে পারি?
মাথা দোলালো পূর্ণ।
– অবশ্যই।মেয়েটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল পাপ্পা, আর দেখে সব্বাই হাসাহাসি করছিলো।
– তুমি করোনি?
অংশ এবার জোরে জোরে ডানে বামে মাথা নাড়লো।
– উহু।সেদিন যখন মাম্মাম কিচেনে পিছল খেয়ে পড়ে গেলো তুমি তো হাসোনি।
এতক্ষণ যাবৎ মজার পরিবেশ থাকলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে মুগ্ধ এক দৃষ্টিতে ছোট্ট শিশুটির উদ্দেশ্যে চেয়ে রইলো আসমান এবং নিহাদ।সে আপনমনে বলে যাচ্ছে,

– আমি তোমাকে দেখে শিখেছি পাপ্পা,মেয়েদেরকে সম্মান করতে হয়,রক্ষা করতে হয়।তাই আমি মেয়েটাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছি,ওর জামা ময়লা হয়ে গিয়েছিল তো ধূলোয়,তাই আমার কোটটা ধার দিয়েছি।তুমি নাহয় আমাকে একটা নতুন ইউনিফর্ম কিনে দিও।কিন্তু আমার মন বলছে কিনতে হবেনা, দেখবে আগামীকাল ঠিক ওটা ফিরিয়ে দেবে মেয়েটা।
বিনা কারণেই আসমানের নয়নজোড়া সিক্ত হয়ে উঠল, জ্বলজ্বল করলো তা দিবাকরের রশ্মি প্রতিফলিত করে।কিছু বলতে সক্ষম হলোনা সে,শুধু নিজের অংশকে আরো জোরালোভাবে নিজের মাঝে আঁকড়ে ধরে তার অস্তিত্বের সুবাস প্রাণভরে গ্রহণ করলো।নিহাদ দৃশ্যটি নয়নাভিরাম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তার পিঠে হাত বুলিয়ে হাসলো,
– ওয়েল ডান সানফ্লাওয়ার,ইউ আর গোয়িং টু বি আ গ্রেট ম্যান।
জবাবস্বরুপ পিতাকে প্রাণভরে আঁকড়ে রাখলো পূর্ণ,এই ভরসার আলিঙ্গন যেনো গোটা ধরিত্রীর মাঝে তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল।আরো একটি মমতায় ঘেরা ছায়াতল অবশ্য রয়েছে তার, মায়ের কোল।

মেঘতীর।
উষ্ণ ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিয়ে এক প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বিলাল।আধপাকা গোঁফের অন্তরালে অধরজোড়া তার উৎফুল্লতায় আবর্তিত হলো।আরো কয়েক চুমুক কড়া কফির স্বাদ আস্বাদন করে তিনি বিড়বিড় করলেন,
– আই মিসড দিস।
মোহময়ী এক ধ্বনি তুলে হাসলো চারুলতা।নিজের কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
– তুমি প্রতিবারই এমন বলো ড্যাড।
– কেনো বলবোনা? মিস করি বলেই বলি।তুমি আর জামাই তো বছরের ছয়মাস ফরেইন ট্রিপে থাকো, আর বাকি ছয় মাস চট্টগ্রাম।এদিকে যে একটা বুড়ো বাবা আছে তার খেয়াল থাকে নাকি?
চারুলতা কফির মগ নামিয়ে রেখে নিজের পিতার উদ্দেশ্যে চাইলো।অবয়ব তার শক্ত সামর্থ্য,চেহারাজুরে কিঞ্চিৎ বয়সের রুক্ষ ছাপ এবং শুভ্র হয়ে আসা কেশরাশি ব্যতীত তার বয়স আন্দাজ কঠিনই বটে।
– প্রথমত,ওটা ফরেইন ট্রিপ না।ওটাকে বলে ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল।দ্বিতীয়ত,চট্টগ্রাম আমার শ্বশুরবাড়ি, আই মিন নিজের বাড়ি।তৃতীয়ত,তুমি একটুও বুড়ো মানুষ নও ড্যাড।আসমান ভাইয়ের সাথে বেরোলে তোমাকে অনায়াসে বড়ভাই হিসাবে চালিয়ে দেয়া যাবে।

হেসে ফেললেন বিলাল,হাত বাড়িয়ে নিজের মেয়ের মাথার চুল এলোমেলো করে দিতেই খিলখিল করে হেসে আদরটুকু গ্রহণ করে নিলো চারু। আজও যেনো বাচ্চাটি রয়ে গিয়েছে কন্যা তার।চোখের সামনেই কখন হামাগুড়ি দিতে দিতে বর্তমানে সংসারী হয়ে উঠেছে তার চারুলতা,বিলাল যেনো টেরটুকুও পাননি।
হাতে গোনা কিছু বছর পেরিয়েছে নিহাদ এবং চারুলতার বিয়ের।পূর্ণর জন্মের কয়েক মাস পরেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা।এর মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে গোটা রেমান পরিবার।বছর তিনেক পূর্বেই রেমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্ব আসমানের উপর অর্পিত করেন বিলাল।কোম্পানির সি ই ও হিসাবে বর্তমানে ছেলেটি তার ভীষণ কর্মব্যাস্ত এবং দায়িত্ববানও বটে।তবে পারিবারিক কর্তব্যে সে কোনোদিন ভাটা পড়তে দেয়নি।অভূতপূর্ব শক্তিতে সামলে গিয়েছে তা নিজের পরিবার হোক কিংবা ব্যবসা।এক্ষেত্রে চারুলতাও ভীষণ সাহায্যে এসেছে।বোর্ড অব ডিরেক্টরের প্রধান হিসাবে তার দায়িত্বও নেহায়েত কম কিছু নয়।নিজেদের চট্টগ্রামের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাকে প্রায়শই ঢাকায় যাতায়াত করতে হয় এই উদ্দেশ্যে।তবুও নতুন জীবনের সঙ্গে নিজেদের দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছে উভয় রেমান সন্তান।আসমান মনোযোগী হয়েছে ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি বিস্তৃতিতে এবং নিজের পরিবারের সঙ্গে সময় অতিবাহনে।অপরদিকে চারুলতা নিজের বিবাহিত জীবনে শৃঙ্খলিত হওয়ার বদলে মুক্ত বিহঙ্গের সঙ্গে জুড়ে পরিণত হয়েছে বাঁধনহারা চিলে।

নিহাদের নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে।বাইক রাইডিং কোম্পানির কার্যক্রম এবং এক্সক্লুসিভ শো রুমের কাজ তার তুঙ্গে।তবুও নিজেদের জন্য আলাদা সময় রাখতে সে কখনো কার্পণ্য করেনা।জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগে বদ্ধপরিকর এই দম্পতি।নিজেদের উপার্জনের নির্দিষ্ট অংশ ব্যবহার করে প্রতি বছর নির্দিষ্ট কিছু দেশ ভ্রমণে যায় তারা।তাছাড়া হুটহাট বাইক নিয়ে নাইট সাফারির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া,সারাটাদিন পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করা,আবার দূরে গেলে একে অপরকে ভিডিও কলে রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতন মুহূর্তের কমতি নেই তাদের মাঝে।সুখী তারা, প্রচন্ড সুখী।যা উপলব্ধি করে বিলাল রেমান নামক পিতার অন্তর কানায় কানায় পরিপূর্ণ।
– ভালো কথা।তোমরা তো গতকালই গ্রিস থেকে ফিরেছ।তবে আজই বাড়িতে আসার ব্যাপারটা কেমন হলো?আগে জানাওনি কেনো?
পিতার প্রশ্নে চারু খানিক রহস্য করে হাসলো।তারপর বললো,

– ভাইয়া বলেছে।
– আসমান?কেনো?
– ভাইয়া তোমাকে কিছু জানায়নি ড্যাড?
বিলাল উত্তর করার পূর্বেই মেঘতীর ভবনে প্রবেশ ঘটলো এক ঘূর্ণিপাকের।এ যেনো দূর্বার দুর্বোধ্য এক বায়ুঝড়। মাতাল হাওয়ায় বেগে ছুটে আসছে এক অবাধ্য নিহাদ এবং তার পিছনে পাগলা ঘোড়া ছোটানোর ভঙ্গিরত পূর্ণ।তাদের সম্মিলিত কন্ঠে প্রকম্পিত হলো গোটা মেঘতীর।
– আহা কেমনে রাখি বাঁন্ধিয়া,এই মনের পাখি বাঁন্ধিয়া….
– তুমি কাছে তবু যে দূরে,কতো যে দূরে ওরে বঁধূয়া….
– পরান যায় জ্বলিয়া রে এ এ,পরান যায় জ্বলিয়া রে!

চাচা ভাতিজার লম্ফজম্ফ সঙ্গীত কর্মসূচির উদ্দেশ্যে বাকরুদ্ধ চেয়ে থাকলেন বিলাল এবং চারুলতা।এক দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো বিহঙ্গের অর্ধাঙ্গিনীর অধর বেয়ে।স্বামী তার কোনোদিনও শুধরাবে না, তা বিয়ে হলেও বা কি?সাড়ে চার বয়সী পূর্ণর পাশে তাকে এর চাইতেও বাচ্চা অনুভূত হয়।বিলাল নিজের জামাই এবং নাতির কার্যক্রমে বিনোদিত হলেন ভীষণ। নাতি তার ঝপাৎ করে তার কোলে লাফিয়ে পড়ল,পরক্ষণেই হেলতে দুলতে সঙ্গ দিলো নিহাদের পাগলা কার্যক্রমে।

মোরগ যু*দ্ধের পিছন পিছন ছেলের স্কুলব্যাগ হাতে নিয়ে প্রবেশ করা আসমান একনজর তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।জানে,চাচা ভাতিজা একসাথে হলে কোনদিকে নিস্তার নেই। পূর্ণর ব্যাগটা সে সোফায় রেখে পরিধানের কোট খুলে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে কিচেনে এলো।ফ্রিজ খুলে আপেল এবং কলা বের করলো,পূর্ণর জন্য কিছুটা ফ্রুট কাস্টার্ড করে দেয়া যাক এমনি চিন্তাভাবনা।চপিং বোর্ড নামিয়ে পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে দেখলো,
“মিসেস রেমান?”
“মাই মুনলাইট,বেশি ব্যস্ত?”

মেসেজগুলো সিন করা হলেও কোনো রিপ্লাই নেই।একটি ঢোক গিলে কি যেনো ভাবলো আসমান।অতঃপর ডায়াল লিস্টে গিয়ে কল করলো।যথারীতি রিসিভ হলোনা।অপর প্রান্ত থেকে এক যান্ত্রিক কন্ঠ জানালো,
“আপনি যে নাম্বারে ডায়াল করেছেন সেই নাম্বারটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে।”
ফোন কেটে দিয়েছে।অনুধাবন করে কিঞ্চিৎ তীর্যক হাসলো আসমান।পরক্ষণে মোবাইল রেখে ফলে মনোযোগ দিলো।ছোট ছোট কিউব আকারে তা কে*টে নিতে নিতেই খেয়াল হলো অংশ তার গুটিগুটি পায়ে কিচেনে হাজীর হয়েছে।কোনোপ্রকার বিরক্তির আভাস না ছড়িয়ে সে একটি স্টুলের সাহায্যে কাউন্টারের উপর চড়ে চুপটি করে বসে পিতার কাজ দেখতে থাকলো একমনে।আসমানও কোমল হেসে নিজের কাজ জারি রাখলো।

– পাপ্পাহ?
– আয়?
– আব্বু?
– হুম?
– ড্যাড?
– বলো প্রজাপতি…
– বাবাই!
– উমহুম….
– ওতোসামা!
থমকালো আসমান।হাতের ছু*রিখানি সাবধানে কাউন্টারে রেখে দিয়ে মুখ তুলে তাকালো।অংশ তার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে,অধর জুড়ে এক চিলতে হাসির ধারা।মাথা কাত করে তার উদ্দেশ্যে চেয়ে আসমান শুধালো,
– এতবার এত রকমভাবে ডাকার অর্থ?
– মাম্মাম ডাকে,আমিও ডাকবো।

খিলখিল ধ্বনি তুলে হাসলো পূর্ণ,অমানিশার আস্তরণে দীপ্তির মহাউত্থান ঘটিয়ে জানালো,
– আমি পৃথিবীর সব ভাষা শিখবো পাপ্পা,শুধুমাত্র তোমাকে ডাকার জন্য।
স্তম্ভিত হয়ে রইলো আসমান।একদৃষ্টে চেয়ে রইলো সন্তানের দিকে।পূর্ণ বেশকিছু ভাষা নিয়ে নিজে নিজে চর্চা করছে তার অজ্ঞাত নয়,তবে তার উদ্দেশ্য কোনোদিন এমনকিছু ছিল তা উপলব্ধিতে বেগ পোহাতে হয়।অজান্তেই এক ঢোক গলাধঃকরণ করলো অমানিশা।এই ছোট্ট অংশটির জন্মের পর হতে প্রতিটি দিন তার একঝাঁক রঙিন অনুভূতিতে মোড়ানো যেনো।সন্নিকটে এগিয়ে পূর্ণকে একটানে কাউন্টারের উপর দাঁড় করালো আসমান।ছলছলে নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
– এত ভালোবাসো কেনো আমায়?

– কারণ তুমি যেমন আমার মাম্মামের চাঁদ,তেমন আমার জগতের সূর্যরশ্মি,পাপ্পা।
অবাধ্য অশ্রু গড়াতে দিলোনা আসমান।সন্তানকে নিকটে টেনে তার ছোট্ট অথচ শক্তিশালী বুকে মাথা ঠেকিয়ে আগলে নিলো অস্তিত্বমাঝে। পূর্ণও পিতাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলো,তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করলো,
– আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি পাপ্পা।
– পাপ্পাও প্রজাপতিকে খুব খুব ভালোবাসে।

পিতার কাঁধে মাথা গুঁজে দিলো পূর্ণ।বেশকিছুদিন পূর্বের ঘটনাটি আজও ভাসলো নয়নে।পার্কের মানুষগুলো পিতার অরক্ষিত চেহারায় ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।সমস্ত শরীরে সেদিন দূর্বার দুঃসাহসের তরঙ্গ খেলে গিয়েছিল তার,ক্রোধে উন্মত্ত হয়েছিল গোটা অস্তিত্ব।তবুও পারিবারিক শিক্ষা যেনো তাকে রুখে দিয়েছিল।তার সমগ্র জীবনজুড়ে এই পুরুষটির অস্তিত্ব, তাকে বিন্দুমাত্র হীনমন্য দেখতেও অন্তরে বাঁধে পূর্ণর।তাইতো মাত্র সাড়ে চারের জীবনজুড়েও তার উপলব্ধির কোনো কমতি নেই,আছে নিজের পিতামাতাকে জাগতিক অশুভ থেকে রক্ষা করার সুতীব্র এক বাসনা।
– আমি একদিন বড় হবো,অনেক বড় হবো পাপ্পা।সেদিন থেকে তোমাকে আর মাম্মামকে কেউ কষ্ট দিতে পারবেনা দেখো।

শিশুর কণ্ঠের আবেদন আসমানের বুকজুড়ে উথাল পাথাল আবেগের ঢেউ তুললো।দ্বিগুণ শক্তিতে সে আঁকড়ে ধরলো অংশকে নিজের,
– তুমি পারবে,আমি জানি তুমি আমাদেরকে সবসময় রক্ষা করবে,পূর্ণতা আমার।
আপনমনে নব প্রতিজ্ঞায় উদ্ভাসিত পূর্ণ পিতার বিভীষিকাখচিত কপোলে অধর ছুঁয়ে প্রতিফলন ঘটালো বাসনার।

চ্যানেল ট্রুথ টুয়েন্টি ফোরের স্টুডিওজুড়ে নিদারুণ উত্তেজনা।এ যাবৎকালের সর্বাধিক জনপ্রিয় ইন্টারভিউভিত্তিক অনুষ্ঠানের স্টেজে বর্তমানে পিনপতন নীরবতা।ক্যামেরার ওপাশের কর্মী এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ নিঃশ্বাস ফেলতেও দ্বিধান্বিত বোধ করছে।দেশের অন্যতম আলোচক,সমালোচক এবং সোশাল ইনফ্লুয়েন্সার হিসাবে পরিচিত রোযা রেমান নিজের টক শো অনুষ্ঠানের অতিথির উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন ছুঁড়েছে যে তার উত্তর করতে বেচারাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।কামিজের ওড়নাখানি গুটিয়ে নিয়ে হাতের কার্ডে নজর বুলিয়ে রোযা পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,

– মিস্টার অভিরাজ,আপনি তো দেশের দূর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের নিঃস্বার্থ সহযোগী,মানবতার ফেরিওয়ালা হিসাবে ভার্চুয়াল জগতে ভীষণ জনপ্রিয়।তবে গত বন্যায় আপনার ফান্ড থেকে উত্তোলনকৃত ৩ কোটি টাকার অর্ধেক পরিমাণ ত্রাণও কেনো দুর্গতদের দুয়ারে পৌঁছলো না?এর ব্যাখ্যা?
– দেখুন,শুধুমাত্র ত্রাণ ব্যাপার নয়।যাতায়াত,লোকবল, এবং অন্যান্য সকল খরচ মিলিয়ে আমাদের অবশ্যই খানিকটা বিবেচনা করতে হয়।
সামান্য হাসলো রোযা। কার্ড সরিয়ে নিয়ে সামনে বসা ধনকুবেরের উদ্দেশ্যে চেয়ে জানালো,

– গত বন্যায় আমরাও সহযোগীতায় গিয়েছিলাম।আমাদের ত্রাণ ছিল নব্বই লাখ টাকার।বাকি একটা টাকাও কেউ ত্রাণের থেকে নয় বরং নিজেদের পকেট থেকেই খরচ করেছে কারণ আমরা সেচ্ছাসেবী।আপনার ব্যাপারটা ভিন্ন ধরে নিলাম।তবুও,যাতায়াত এবং আনুষঙ্গিক খরচে যদি কয়েক লাখও ধরে নেই তবে বাকি দুই কোটি সাতানব্বই লাখ চুরাশি হাজার তিনশো ছাব্বিশ টাকার হিসাব কোথায় মিস্টার অভিরাজ?এসব আপনার ধনকুবের পিতার বেআইনী উপার্জিত অর্থ নয়,জনগণের পরিশ্রমের পবিত্র অর্থ।
উত্তর করতে চাইলেও অভিরাজের মুখ থেকে কোনো শব্দ নির্গত হলোনা।সে জেনেবুঝেই এই অনুষ্ঠানে এসেছে,কারণ তার ম্যানেজারের মতে দ্বিগুণ জনপ্রিয়তা লাভের সহজ উপায় ছিল এটি।তবে এমনভাবে তাকে ফাঁদে ফেলা হবে কল্পনাও করেনি।রোযা রেমানের সম্পর্কে যা শুনেছে তা নেহায়েত মিথ্যা নয়, আপনমনে ভাবলো সে।পুরোপুরি ঘাঁটাঘাঁটি করে সঠিক তথ্য আদায়ের পরেই যে এই রমণী এবং তার গোটা দল এই অনুষ্ঠানের পরিচালকের পদে আসীন হয়েছে তা প্রমাণিত।

রুদ্ধশ্বাস ঘণ্টাখানেকের পর অবশেষে স্টুডিওর মানুষগুলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেলো। সমাপ্তিতে রোযার সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিরাজ জানালো,
– আপনার সঙ্গে কাজ করতে পেরে ভালো লাগলো। আই সোয়্যার জীবনে কোনোদিন এতটা উদ্বিগ্ন হইনি যতটা আপনার এই অনুষ্ঠান আমাকে করে ছেড়েছে।
– এ তো সবে শুরু।আপনার গ্রহণযোগ্য আচরনের তারিফ করছি।দেখা যাক এরপর,আপনি আদতেই আলোচনা সমালোচনা হজম করতে পারেন কিনা।

– পরেরবার অবশ্যই প্রতিটা পয়সার হিসাব মিলিয়ে তবেই এখানে পা রাখবো।
কথাগুলো বন্ধুচ্ছলে বলা হলেও এর পিছনে নিহিত সূক্ষ্মতর বিরূপ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ অত্যন্ত দক্ষতায় এড়িয়ে গেলো রোযা। অভিরাজের প্রস্থান ঘটতেই তোড়জোড় আরম্ভ হলো বাকিদের।মাইক্রোফোন প্লাগ টেনে খুলে ক্যামেরার এপাশে আসতেই মেয়েলী কণ্ঠটি প্রতিবারের মতন বললো,
– দূর্দান্ত!আজ একেবারে ব্যাটাকে তুলোধুনো করে ছেড়েছ রোযা আপু!

নয়ন তুলে সাবিহার দিকে চেয়ে বিস্তৃত হাসলো রোযা।তার এক বছর আগে গ্র্যাজুয়েশন সেরেছে মেয়েটি, অতঃপর এই চ্যানেলে যোগদান করে ইন্টার্ন হিসাবে।নিজের স্নাতক সমাপ্তির পর এই চ্যানেলকেই আস্থাবান হিসাবে গ্রহণ করে রোযাও।তার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে চ্যানেলটি।আর যাই হোক,সত্য উদঘাটনে পিছপা হয়না এর কর্মী কিংবা কর্ণধার।তাই স্থানটি ভীষণ পছন্দের রোযার।সাবিহা সম্প্রতি তার অনুসন্ধানী দলের প্রধান রিপোর্টার হিসাবে যোগদান করেছে,মেয়েটি এক্ষেত্রে তুখোড়। হাড়ির খবর মুখে আনতে তার জুরি মেলা ভার। অবশ্য তা হবে নাই বা কেনো?তার বাগদত্ত, অনির্বাণ আহমেদ যে দেশের অন্যতম শীর্ষ সাংবাদিকের স্থানে অবস্থান করছে!

কাজের পর খানিকটা চা কফির আড্ডায় রোযা সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো,
– তো,বিয়েটা কবে হচ্ছে শুনি?আর কতকাল অপেক্ষায় থাকতে হবে?আরিয়ান ব্যাটাও শাদি মোবারক করে হানিমুনে নিউজিল্যান্ড,তুমি দেশে থেকে কি গুরুর ঘাস কাটছো?
প্রথম প্রথম এমন কথায় সাবিহা লজ্জা পেতো।তবে বর্তমানে তার ব্যক্তিত্বে কঠোরতার পরিবর্তন এসেছে কিছুটা।বিস্তর হেসে সে জানালো,
– এমনভাবে বলছো যেনো তুমি ওকে চেনোনা।বিয়ের নাম শুনলেই ওই ব্যাটার কিডনি স্ট্রো*ক করে।
– ইশ।চুটিয়ে প্রেম করলো, বাগদানও সারলো,এখন বিয়ে করলেই বুঝি সব মাটি?
– তা আর বলতে?বোঝোনা?নিজের স্টুডিও দাঁড় করিয়ে এখন বস বস ভাব নেয়।তিনি ইলোন মাস্কের চাইতেও অধিক ব্যাস্ত।যার নিজের ফিয়নসে বাদে দুনিয়ার সবাইকে দেয়ার মতন যথেষ্ট সময় আছে।
– এজন্যই বলেছি এই চ্যানেল ছেড়ে আমার স্টুডিওতে আসো।বসে বসে মানুষের গীবত ছাড়া আর কিছু করা হয় এখানে?

কন্ঠস্বরটি সাবিহা এবং রোযা উভয়কে হতচকিত করলো।মাথা হেলিয়ে তাকাতেই কটকটে লাল বর্ণের হুডি পরিহিত অনির্বাণ আহমেদকে চশমার লেন্সের অন্তরাল থেকে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখা গেলো।গটগট করে হেঁটে এসে সে সাবিহার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।অনুমতি ছাড়াই প্রেয়সীর আধ পান করা কফির মগ টেনে দীর্ঘ চুমুক দিল যেনো এ তার নিজের জমি।
– ঢং,যত্তসব!তোমাকে এখানে ঢুকতে দেয় কে?কতবার মানা করেছি গার্ডদের।
– কেনো?তোমার বাবার কোম্পানি এটা? হুহ,আমার বন্ধুর চ্যানেলের স্টুডিও।আমি আসবো,আমি যাবো, কার বাপের কি?

– এই তুমি কথায় কথায় আমার বাবাকে মাঝখানে কেনো টেনে আনো বলতো?
– যে একখান বাপ আপনার!হিটলারের সহযোগী।সামান্য এঙ্গেজমেন্ট করতে বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেব সেজে কি কাহিনীটাই না করলো। উফ্!
– ভালো হচ্ছেনা কিন্তু অনির্বাণ!
– উপস, ভুলে গিয়েছিলাম।আপনি তো আবার পাপাকি পারী!
কপোত কপোতীর খুনসুঁটি লক্ষ্য করে আপনমনে হাসতে থাকলো রোযা।আমূল পরিবর্তন এসেছে সকলের জীবনে।এবং এই পরিবর্তন আনন্দের।অনির্বাণের দৃষ্টি রোযার উদ্দেশ্যে আপতিত হতেই বান্দা বললো,
– আপনি আবার দাঁত বের করে হাসছেন কেনো?যান, নিচে যান।আপনার গোটা গুষ্টি অপেক্ষায় আছে দেখলাম।
– আমার গুষ্টি?

রহস্য করে হাসলো অনির্বাণ।
– নিচে যান,নিজেই দেখবেন।
এরপর আর অপেক্ষা করার মতন ধৈর্য্য থাকেনা।সাবিহাকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত নিজের ব্যাগ গুছিয়ে এলিভেটরে করে নিচে নেমে এলো রোযা। মূল প্রবেশ পথের সামনে আসতেই নজরে এলো দৃশ্যটি।পার্কিং লটে অবস্থানরত পোর্শের লেটেস্ট মডেল।ড্রাইভিং সিটের দরজা হাট করে খোলা,তাতে স্টিয়ারিং চেপে বসমান তার সন্তান।আর ঠিক পাশেই গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বনবন করে চাবি ঘোরাতে থাকা স্বামী।উভয়ের পরিধানে সিলভার জরীর কাজ সম্বলিত কালো ফতুয়া এবং কার্গো প্যান্ট।মুখের মাস্ক এবং ঢংয়ের সানগ্লাসজোড়াও জোড় বেঁধেছে।
– মাম্মাম!
রোযাকে দেখামাত্র ড্রাইভিং সিট থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে গেলো পূর্ণ। জননী তার মুহূর্তেই উবু হয়ে আলিঙ্গনে বেঁধে কোলে তুলে নিলো তাকে।চেহারায় অজস্র স্নেহচুমু এঁকে শুধালো,

– আমার ছোট্ট বাবুই পাখিটা!
– মাম্মা…
– উম্মাহ্…উম্মাহ্…
– হিহি।
এগোলো আসমান।জন্মদাত্রী এবং সন্তানের স্নেহঘেরা মুহূর্ত প্রাণভরে অবলোকন করে কন্ঠ পরিষ্কার করে বললো,
– সব আদর শুধুই ছেলের?বলছিলাম স্বামীর জন্য কিছু নেই?
যেনো আসমানের কথা শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেনি এমন ভঙ্গিতে রোযা পূর্ণকে দেখতে থাকলো।অংশ তার একবার বাবা পরক্ষণে মায়ের উদ্দেশ্যে তাকাচ্ছে।এমন দোলাচলের উৎস খুঁজছে যেনো।
– কি অদ্ভুত!আমাকে কি বটগাছ মনে হচ্ছে নাকি যে জবাব দিচ্ছনা?

এবারও আসমানকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে রোযা পূর্ণর চিবুক ছুঁয়ে বিড়বিড় করলো,
– ব্যাটা দেখতে হয়েছে একেবারে উজবুক বাপের মতন।আমার জিন কোথায় গেলো?
– এক্সকিউজ মি? হ্যালো?আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, সব শুনতে পারছি।
আসমানের কথার প্রতিক্রিয়াস্বরুপ সামান্য মুখ ভেংচে রোযা গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে চেপে বসলো,কোলে ধরে রাখলো সন্তানকে,যে এই মুহূর্তে পিতা মাতার অভিমান অভিমান খেলা ভীষণ উপভোগ করছে।
– শোনো বাবুই পাখি,দেখতে যতই ওই নিষ্ঠুর লোকটার মতন হওনা কেনো,তুমি কিন্তু আমার ছেলে ঠিক আছে?মাই বেইবি ইয আ মামা’ স বয়,রাইট?

– ইয়েস মাম্মাম!
ড্রাইভিং সিটে চেপে সিটবেল্ট জুড়তে জুড়তে অমানিশা ক্রুব্ধ কন্ঠে সতর্ক করলো,
– প্রজাপতি,সাবধানে ভেবেচিন্তে কথা বলবে কেমন?তোমার পরবর্তী উকুলেলে লেসন কিন্তু আমার হাতে, মাম্মাম তোমার কাককণ্ঠী,তার কাছে তুমি শকুনের মতন তর্ক করা বাদে কিছুই শিখবেনা।
– বাবুই!তোমাকে আমি ডোনাট করে খাওয়াবোনা কিন্তু!
– হেহ,ওই পুঁইয়ে যাওয়া ডোনাট তোমার খেতে হবেনা প্রজাপতি,আমি চিকেন মোমো বানিয়ে দেবো।
– বাবুই!
– প্রজাপতি!
– মাম্মাম,পাপ্পা,স্টপ ইট!
সন্তানের ধমকে দুই প্রাপ্তবয়স্ক অতর্কিতে নীরবতা পালনে বাধ্য হলো।পূর্ণ দুহাতে মুখ ঘষে তীব্র কন্ঠে রীতিমত আদেশ ছুড়লো,

– তোমরা এমন ঝগড়া করছো কেনো বলতো?তোমরা কি বাচ্চা?
ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে চেয়ে পরক্ষণে ঢোক গিললো চাঁদ এবং তার জ্যোৎস্না।এইটুকু শিশুর কন্ঠে এমন কথায় তাদের হাসি আসা উচিত,কিন্তু আসছেনা।এক প্রভাব আছে তার মাঝে,যা ঠিক উপেক্ষণীয় নয়।পূর্ণ দ্বিতীয় দফায় আদেশ করলো,

– চুপচাপ বাসায় চলো,তারপর বিচার বসাচ্ছি আমি।
সত্যি সত্যি সামান্য কেশে স্টিয়ারিং পাকড়াও করলো আসমান,নতুন মডেলের পোর্শে তার দ্রুতই এগোলো মেঘতীরের উদ্দেশ্যে।তবু সেখানে পৌঁছেও অবস্থার খুব বেশি উত্তরণ ঘটলোনা।অভ্যন্তরে প্রবেশ করেই রোযা হনহনিয়ে চললো কিচেনের উদ্দেশ্যে।অপরদিকে সোফায় এলিয়ে পড়লো পূর্ণ,ভাবছে সে এখনো।নিহাদ ডাইন ইন টেবিল থেকে সবটাই পর্যবেক্ষণে রাখছে।প্রোটিন শেকের বোতলে চুমুক দিয়ে ভীষণ উপভোগ করছে নাটক।
– কুভেড পেশেন্ট এখনো ক্ষেপা গাভীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি?
তার ব্যাঙ্গতে আসমান কোমরে দুহাত রেখে কটমট করে তাকালো,
– আমি কোনো লিজার্ড কিসারের মতামত গ্রহণে আগ্রহী নই,ধন্যবাদ।
নিহাদ একচোট লাগার উদ্দেশ্যে উদ্যত হচ্ছিলো কিন্তু তাকে সেই সুযোগ প্রদান না করে আসমান পূর্ণর দিকে ফিরলো।

– তোমার মাম্মাম আমার সাথে রাগ করেছে কেনো?
কিচেনে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে গলাধঃকরণ করতে থাকা রোযার উদ্দেশ্যে চেয়ে পরক্ষণে পূর্ণ নিজের পিতার দিকে তাকালো।মুচকি হেসে জানালো,
– তুমি ভুলে গেছো পাপ্পা?গতকাল মাম্মাম কুয়াকাটায় বেড়াতে যেতে চেয়েছিলো?
– হ্যাঁ তো?
নিজের কপাল চাপড়ে পরক্ষণে আসমানের কপালও খানিকটা ঠুকে দিয়ে পূর্ণ জানালো,
– তুমি দেখছি ভীষণ বোকা।
– ওহো!তাহলে ঘুরতে নিয়ে যাইনি বলে রাগ করেছেন মহাশয়া?
কিচেন থেকে তৎক্ষণাৎ রোযার ক্রুব্ধ কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

– বাবুই…ওনার সাথে কথা বলে নিজের সময় ও শক্তি খরচ করে লাভ নেই।খুউব ব্যাস্ত মানুষ কিনা!রেমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সি ই ও বলে কথা!বউ বাচ্চাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার মতন ফুরসৎ কি ওনার আছে?
সশব্দে পানির বোতল রেখে একটি আপেল বের করে বিনা কারণেই আওয়াজ করে করে সেটা কা*টতে থাকলো রোযা।পূর্ণ এবং আসমান খানিক থ হয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে।নিজের প্রোটিন শেকে আয়েশী চুমুক দিয়ে নিহাদ বিড়বিড় করলো,
– তুমি আজকে খালাস….আসমান ভাই!
– মাম্মাম ক্ষেপেছে!

পাল্টা ফিসফিস করলো পূর্ণও।আসমান ক্ষণকাল কি যেনো ভাবলো,পরক্ষণেই ছেলেকে কোলে তুলে সটান সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।রোযা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।ব্যাপারটা কি হলো?এভাবে ময়দান ছেড়ে পলায়ন করার বান্দা তো অমানিশা নয়!
কিছুক্ষণ বাদেই দেখা গেলো,পিতা এবং সন্তান উভয়ে নেমে আসছে নিচে।আসমানের হাতে গিটার,এবং পূর্ণর হাতে তার ছোট্ট উকুলেলে।বিস্মিত হয়ে পড়লো রোযা, মহাআগ্রহ ফুটলো নিহাদের চেহারায়ও।দ্রুতই সে ভেতরের রুমে থাকা চারুলতাকে মেসেজ করলো,
” অ্যাবসুলেট সিনেমা দেখতে এক্ষণই ডাইন ইন এরিয়ায় ল্যান্ড কর পেত্নী!”
কিচেনের সামনের হলে এসে আসমান কন্ঠ পরিষ্কার করে আদেশ করলো,

– প্রজাপতি… কর্ড সি শার্প…
– ইয়েস পাপ্পা!
স্যালুট ঠুকে ছোট্ট পূর্ণ নিজের কাজে নেমে পড়লো।তার নমনীয় ছোট ছোট আঙুলগুলো উকুলেলের স্ট্রিং চাপতেই আসমানের লম্বাটে শিরা উপশিরাখচিত আঙুলসমূহ গিটারের ফ্রেডবোর্ডে ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করলো।এক দারুণ সুরধ্বনিতে মুহূর্তেই মাতোয়ারা হয়ে উঠল সমস্ত মেঘতীর ভবন।
আসমানের কোমল কন্ঠস্বর এক জাদুকরী আবাহনে প্রতিধ্বনিত হলো সুরের তালে তালে,
~এমনও নিদানের দিনে বিনীত প্রার্থনা গো
লক্ষ কোটি ভুল আর ত্রুটি করিও মার্জনা গো
শোনাইবো তোমারে আজ করেছি বাসনা গো
ঐরাবতের হৃদয় হতে ক্ষুদ্র এ রচনা~

নিষ্পলক চেয়ে রইলো অর্ধাঙ্গিনী,হৃদস্পন্দন তার থমকেছে।এক সময়কার যন্ত্রণাদায়ক,ভগ্ন,নিঃস্ব কন্ঠস্বরটি সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়েছে মায়াবী,সম্মোহনী, মধুময় এক সুরেলা ধারায়।হৃদয়ের দুয়ারে কড়া নাড়ে যা ভীষণভাবে।ভালোবাসাময় এক আবেদনে।নিহাদও বসে থাকতে সক্ষম হলোনা।সহসাই ডাইন ইন টেবিলের কাঠের উপরে বাজনার তাল তুললো।পিতার সঙ্গে যোগদান করলো শিশু পূর্ণও। কন্ঠ মেলালো একযোগে।এক সুরধ্বনি খেলে গেলো সমগ্র মেঘতীরজুড়ে।

~আমি কি করিবো কোথায় যাব
কোন সাধনে পাবো গো
আরেকটিবার তোমারই দর্শন~
প্রেয়সীর হাত ধরে টেনে আনলো আসমান।না চাইতেও তার এহেন আবেগময়ী নিবেদনে রোযা আপ্লুত না হয়ে পারলোনা।অধরে ফুটলো তার মায়াকাড়া এক হাসি।স্বামী সন্তানের সঙ্গীতের মূর্ছনায় হালকা তালে নেচে উঠলো তার সমস্ত অস্তিত্ব।এক মুগ্ধ আবাহন!
~ কোন বাঁধনে বাঁধি আমি
কেমনে তোমায় রাখি গো
তুমি ছাড়া হৃদয় অচেতন…..~

চারুলতা হাজির হলো দ্রুতই,অনুসরণে উৎসাহী বিলাল।গোটা রেমান পরিবার নেচে উঠলো প্রফুল্লতার আবহে। পূর্ণকে বিলাল নিজের কোলে তুলে নিলেন,কন্ঠ মেলালেন সন্তান এবং নাতির সঙ্গে। ছেলে,ছেলের স্ত্রী, তাদের অংশ,মেয়ে,মেয়ের স্বামী,প্রত্যেকটি প্রিয় মানুষের উৎফুল্লতা তার চেহারায় প্রশান্তি এনে দিলো,নিদারুণ এক প্রশান্তিময়।সুরেলা সময় এবং প্রফুল্ল হাসির ধ্বনির মাঝে ঊর্ধ্বপানে চাইলেন তিনি,এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নামলো তার নয়ন বেয়ে।আপনমনে ধ্বনিত হলো,
” আয়েশা, দেখছো কি?আজ সত্যিই আমার জীবন পরিপূর্ণতা পেলো।শুধু একটা তুমির অভাব ঘুচলোনা।খেদ নেই,আমি তোমায় আজও ভালোবাসি ঠিক প্রথম দিন প্রেমে পড়ার মতন করে………”

গাড়িতে লাগেজপত্র তুলে নিয়ে নিহাদ এবং চারুলতার দিকে তাকালো আসমান। বোনের মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বললো,
– বাবার খেয়াল রাখিস।আর আমাদের কোম্পানিরও।দেখিস আবার এই কয়দিনে যেনো রেমান গ্রুপ দেউলিয়া না হয়ে যায়।
– তুই যাওয়ার কাজ যাবি এমনভাবে ইগোতে খোঁচা দেয়ার কোনো মানে হয়?
– ঠিক তো।তেঁতুল গাছের পেত্নীদের দেমাগ সবসময় সাত আসমানে থাকে জানোনা তুমি?
পাশ থেকে নিহাদ বলতেই চারুর গোত্তা হজম করে হাস্যরস তুললো।আসমান তার পিঠ চাপড়ে জানান দিলো,

– তাতে কি?এই পেত্নীটাকে সামলানোর জন্য তুমি আছোনা?
– ওবুক ওবুক,কি মহব্বত,বাজি রে বাজি!
– চট্টগ্রামে থাকতে থাকতে পুরোদস্তুর চট্টলার বাসিন্দা হয়ে গেছো দেখছি।
সামান্য ভ্রু কুঁচকে পরক্ষণে গাড়ির ভেতর উঠে বসলো আসমান।নিহাদ দরজা ঠেলে আটকে ঝুঁকলো।দম্পতি বিদায় জানালো অপর দম্পতিকে।রোযা চারুর উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো,
– বাবার খেয়াল রেখো,আর হ্যাঁ,নিয়মিত ফোন করবো কিন্তু।
– কিছু চিন্তা করোনা আমার ভাবীজান।তোমরা যাও,খুব আনন্দ উপভোগ করো।
নিহাদ পূর্ণর গাল টেনে বললো,

– মাচাকে সব ছবি পাঠাবে,ঠিক আছে?আমিও দেখি, তোমার বাপ তোমাকে কতকিছু ঘোরায় আর খাওয়ায়।
– অফকোর্স মাচা!
– হাই ফাইভ!
গাড়ি ধীরগতিতে যখন মেঘতীরের গণ্ডি পেরিয়ে সড়কপথে নেমে এলো তখন উপরের বারান্দা থেকে বিলাল,এবং লন থেকে নিহাদ চারুলতা একদৃষ্টে চেয়ে রইলো অধরে বিস্তৃত হাসি মেখে।অবশেষে অমানিশা এবং দীপ্তি তাদের সুখের পূর্ণতার পথে।

সড়ক বেয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো গাড়ি।আসমান আজ ড্রাইভ করছেনা,সে নিজের পরিবারের সাথে প্যাসেঞ্জার সিটে।পূর্ণ একটি ছবির বই নিয়ে ব্যস্ত আছে, রোযাও উৎসাহভরে তা দেখছে।আপন মানুষগুলোকে অবলোকন করতে করতে সূক্ষ্ম হাসির ধারা প্রস্ফুটিত হলো অমানিশার ওষ্ঠে।অবশেষে। রেমান প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তার রোযা কিংবা পূর্ণকে দেয়ার মতন সময়ের স্বল্পতা সৃষ্টি হয়েছে ভীষণ।বিয়ের পরও স্ত্রীকে নিয়ে তেমন কোথাও বেড়ানোর সুযোগ তার হয়নি।খুব শীঘ্রই রোযা এবং তার বিবাহবার্ষিকী আসন্ন।এই উপলক্ষ সম্পর্কে অবশ্য রোযার ধারণা নেই। দীর্ঘদিনের সুপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আজ আসমান রোযা ও তার অংশকে নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে ভিনদেশে।প্রথম গন্তব্য তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর, অতঃপর সেখান থেকে পূর্ণর পছন্দ ডিজনীল্যান্ড, রোযার ইচ্ছায় মালদ্বীপ এবং হাওয়াই…..গোটা একটা মাস অতিবাহনের পথে তারা।ভাবতেই হৃদয় আবেশিত হয়ে পড়ে।

অতর্কিতে গাড়ি থেমে গেলো মাঝরাস্তায়।টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছে।গাড়ি থেকে নেমে পরীক্ষণের পর ড্রাইভার অতিরিক্ত টায়ার ব্যবহার করে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়।ফ্লাইটের এখনো অনেক সময় বাকি,সময় হাতে নিয়েই বেরোনো হয়েছে যেহেতু।তাই এটুকু বিলম্ব আপত্তিকর হলোনা।বাইরে থেকে থেকে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে।হিমেল এক হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে বর্ষণের ঘ্রাণ।গাড়ির অভ্যন্তরে রোযা হঠাৎই এক টান অনুভব করলো।ভেতরে থাকা সম্ভব হলোনা।গাড়ির দরজা খুলে মুহূর্তেই বেরিয়ে এলো ফাঁকা সড়কে।

– একি!কোথায় যাচ্ছো?
আসমানের প্রশ্নের উত্তর এলোনা।অর্ধাঙ্গিনী তার ঝিরঝিরে বৃষ্টির মাঝে নিজেকে যেনো হারিয়ে ফেলেছে।ঘুরে ঘুরে একেবারে ফুটপাথের উপরে গিয়ে উঠেছে।মাথা দুলিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরক্ষণে আসমান গাড়ির বক্স থেকে ছাতা বের করে নিলো।
– আমি তোমার মাম্মামকে নিয়ে আসছি,কেমন?

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো সন্তান তার।বেরিয়ে এলো আসমান।বৃষ্টির তোড় সামান্য বেড়েছে,তাতে সমস্যা হয়না তবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে শরীর সিক্ত হতে বাধ্য।পায়ে পায়ে এগোলো আসমান।রোযা ফুটপাথের উপর ওড়না ছড়িয়ে বসে পড়েছে।চেয়ে আছে অসীম গগনের পানে।সন্নিকটে গিয়ে ছাতার মাঝে ছেয়ে ফেললো তাকে অমানিশা,সম্মোহনী মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করলো প্রিয়তমার চেহারায় ফোঁটায় ফোঁটায় জমা বৃষ্টিকণাকে।নীরব মুহূর্ত,শুধু ঝিরঝির প্রবাহ।অতঃপর সামান্য হাসলো আসমান,মাস্ক সরিয়ে নেয়ার তার বিভীষিকাময় চেহারা নিদারুণভাবে স্বর্গীয় দেখালো সহধর্মিণীর দৃষ্টিতে।

– কি হলো?এভাবে হাসছো কেনো?
প্রিয়তমের হাসিমাখা চেহারার প্রজ্জ্বলনে বিমুগ্ধ রোযা বিড়বিড় করতেই আসমান নিজের হাতে ধরে রাখা ছাতাটা আরেকটু নুইয়ে এনে বৃষ্টির ঝাঁপটা থেকে অর্ধাঙ্গিনীকে আড়াল করে নিয়ে জানালো,
– তোমাকে এভাবে ফুটপাথে বসে থাকতে দেখে বহু বছর আগের একটি ঘটনা স্মরণে এসে গেলো।
– ঘটনা?

মাথা কাত করেই প্রশ্ন ছুড়লো রোযা।আসমান তাতে মুচকি হেসে বললো,
– কোনো এক ঘোর বর্ষণের দিনে কেউ একজন আমার মাথায় ছাতা ধরে বলেছিল,আমি নাকি ব্যাকটেরিয়া!
জ্যোৎস্না তার হাসলোনা।বরং প্রসারিত নয়ন মেলে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো,অভিব্যক্তি তার ভীষণ রকম আন্দোলিত।যেনো হৃদমাঝারে তড়িৎ তরঙ্গ খেলে গিয়েছে।আসমান তাতে খানিক হতচকিত হলেও কন্ঠ পরিষ্কার করে শুধালো,
– এভাবে তাকাচ্ছো কেনো?সেটা একটা কলেজপড়ুয়া মেয়ে ছিলো।তাছাড়া আমি তার চেহারাও দেখিনি ঠিকমতন।
– মেয়েটা তোমাকে আচার খেতে দিয়েছিল,আসমান।
বাকরুদ্ধ হয়ে রোযার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে চেয়ে রইলো আসমান।বারিধারার বিস্তৃতি তাদের শরীরে হিমশীতল পানির ফোঁটার ঝাঁপটা দিয়ে গেলেও একে অপরের মাঝে কোনোপ্রকার হেলদোল হলোনা।যেনো সঙ্গীর নয়নের ঐন্দ্রজালিক আবহে হারিয়েছে তারা আপনাকে।

– জ্যোৎস্না….
– চাঁদ….
অধরযুগলে ফুটলো আর্দ্র হাসির রেখা,নয়নে টলটলে অনুভব।এই সুতীব্র আবেগ এক নব্য উপলব্ধির।একই বাঁধনে বাঁধা হয়েছে তাদের ভাগ্য বহু পূর্বেই।কেমন অনুভব করা উচিত এই জাদুকরী উপলব্ধিতে?হৃদযন্ত্র যে স্থবির হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ!সেই কবে কোথায় এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এক ভগ্ন হৃদয়ী পুরুষকে একটি আচার খেতে দিয়েছিল,কেউই কি তখন কল্পনাও করেছিলো আজ থেকে বছর বছর পর ভাগ্য তাদের আবারো একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দান ফলাবে পূর্ণতার!
ভাগ্য বড়ই রহস্যময়।

– বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে।
আসমানের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রোযা আলতো আঁচে নিজের অবাধ্য গড়ানো অশ্রুফোঁটা মুছে নিলো।হাসিতে উদ্ভাসিত হলো তার চেহারা।ঔজ্জ্বল্য নিয়ে ওই নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বরে চেয়ে বিড়বিড় করলো,
– আমাদের প্রথম দেখায় কি এমনি সৌন্দর্য্য ছিল চাঁদ আমার?
– হয়তোবা তা ছিল রূপকথাতুল্য এক অকল্পনীয় মহাযাত্রার সূত্রপাত।
– পৃথিবী কত বিচিত্র তাইনা?সেদিন তুমি ছিলে ভগ্ন হৃদয়ে বসে,আর আমি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে।
– আর আজ আমি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে,তুমি,আমার অর্ধাঙ্গিনী,আমার জ্যোৎস্নার উদ্দেশ্যে।
উবু হয়ে বসলো আসমান,প্রিয়তমার সমানে সমান উচ্চতায় নিজেকে নমিত করে ছাতার অন্তরালে আড়াল করে নিলো নিজেদের।অতঃপর….

সন্নিকটে ঝুঁকলো উভয়ে।অধরপল্লব মিলিত হলো এক সুমধুর অনুভূতির বিনিময়ে। ক্ষণকিছু মুহূর্ত,অব্যক্ত সকল আবেগের প্রকাশ।সামান্য সরে রোযার কপালে প্রগাঢ় স্নেহ ছুঁইয়ে আসমান বিড়বিড় করলো,
– পূর্ণতা আমার।
– আনন্দ আমার।
– ভালোবাসি জ্যোৎস্না।
– ভালোবাসি চাঁদ।

একে অপরের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হলো উভয়ে।ফিরলো গাড়ির অভ্যন্তরে,যেখানে অপেক্ষারত অংশ তাদের।বৃষ্টি তখন ঝমঝমিয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে। ভাগ্যযোগে গাড়ির টায়ার পরিবর্তন হয়েছে যথা সময়ে।ড্রাইভার বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে এগোনো শুরু করলো পুনরায়।ছাতা গুটিয়ে রেখে হালকা সিক্ত কেশে আঙুল বুলিয়ে আসমান সামান্য বৃষ্টিফোঁটা ঝেড়ে নিলো।তখনি অনুভব করলো,অংশ তার একদৃষ্টে চেয়ে আছে।আসমান মাথা হেলিয়ে কপালে এলোমেলো হয়ে পড়া চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি দেখছো প্রজাপতি?
পূর্ণর অধর এক আদুরে হাসিতে আবর্তিত হলো।
– তুমি খুব সুন্দর পাপ্পা!
হৃদস্পন্দন ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলো আসমানের, অনুভব করলো অস্তিত্বজুড়ে প্রবাহমান ঘূর্ণিপাক।সন্তানের বক্তব্যে স্তব্ধ জননী নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারলোনা,ঝুঁকে অংশের গালে এবং কপালে আদরের ছোঁয়া এঁকে দিলো।

– ঠিক বলেছ বাবুই আমার,তোমার পাপ্পা খুব সুন্দর!
একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো আসমান,অনুভব করলো এক ফোঁটা সুখের অশ্রু গড়িয়ে নামছে তার কপোল হতে।তবে এবার তাকে একা কাদতে হলোনা।কারণ তার অশ্রু মুহূর্তেই মুছে দেয়ার জন্য তার অর্ধাঙ্গিনী এবং তার সন্তানের হাত উত্তোলিত হলো, ঘুচিয়ে দিলো তা সকল বিষাদ,বিরহ এবং অপূর্ণতাকে।
চিত্রলেখা এবং মেঘ,আসমানের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।যাদের তরে রচিত হয়েছে এক আঁধার খচিত বিষাদে ঘেরা মহাকাব্য।তবে এই বিষাদ চিরস্থায়ী নয়।রোযার মতন কোনো এক রমণীর উত্তাল ভালোবাসা আসমানের ন্যায় পরাশক্তিধর অমানিশাকেও ছেয়েছে মায়ার কোমলতায়।হাত ধরে আরো একবার বাঁচতে শিখিয়েছে নতুনভাবে।

তাদের অংশ?পূর্ণ। সে তো আরো এক নব্য কোমল কাব্যের নাম। পিতার ভাগ্যের অভিশাপ গুঁড়িয়ে পদার্পণ করেছে সে ধরিত্রীতে।পরিপূর্ণতা দান করেছে জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রীর সংগ্রামে ঘেরা জীবন। যত বাঁধাই ভবিষ্যতে আসুক না কেনো, এই অমানিশা আর কোনোদিন নমিত হবেনা,যন্ত্রণায় থাকবে না।কারণ তার পাশে ভিত্তি হয়ে দাঁড়ানোর মতন তার রয়েছে গোটা একটি পরিবার,বিষাদের অশ্রু মুছিয়ে দেয়ার জন্য রয়েছে তার জ্যোৎস্না এবং অংশ।

ডার্কসাইড পর্ব ৬৯

গাড়ি এগিয়ে চললো স্মৃতিঘেরা স্মরণের উদ্দেশ্যে, বর্ষণের সীমানায় সিক্ত হয়ে এক জাদুকরী নতুন দুনিয়ার ঠিকানায়।
আসমান সুখী।
আসমান আজ সত্যিই সুখী।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here