ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৫

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৫
অবন্তিকা তৃপ্তি

~ ‘নাও, গেট আউট ফ্রম মাই কেবিন।’
‘কি?’ —- ঊর্মি অবাক হলো!
কুহু এইবার চেঁচিয়ে বলল—-‘আই সে, গেট আউট রাইট নাও! নাহলে আমি কিন্তু চিৎকার করব!’
ঊর্মি ভ্রু কুচকে কুহুকে দেখল! পরপর হালকা হেসে দরজা ঠাস করে খুলে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
বিপত্তি ঘটলো তখুনি! কেবিনের বাইরে ঠিক সেসময় কাব্য দুহাতে কফির কাপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে! এই মুহূর্তে ঊর্মিকে কুহুর কেবিনের সাঁবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কাব্য ভ্রু কুচকাল! কাব্যকে নিজের চোখের সামনে দেখে ঊর্মিও ভয় পেয়ে ঢোক গিললো একটা! কাব্য ভ্রু কুচকে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল——-‘তুমি এখানে কি করছো?’

ঊর্মির পা আচমকা থেমে গেল! কাব্য এখন, এখানে কেন? এইমুহূর্তে ঊর্মি মোটেও কাব্যকে এখন; এইরকম চোখের সামনে দেখবে বলে আশাই করেনি। ঊর্মি কিছুটা ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে গেল মুহূর্তেই। মাথাটা নামিয়ে নিজেকে একবার দেখে নিলো।ওরা দুজন কুহুর কেবিনের অনেকটা দূরে দাড়িয়ে আছে। মিথ্যা বললে কাব্য মুহূর্তের মধ্যে ধরে ফেলবে। বলা যায়না— রাগের মাথায় এই ভরা হাসপাতালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় যদি?
কাব্য ওকে চুপ থাকতে দেখে এবার দিল এক ধমক——‘কি হলো? চুপ কেন? কথা বলো!’
ঊর্মি কাব্যের ধমকের প্রতিউত্তরে কিছুটা হাসার চেষ্টা করে জবাব দিল——‘অব…কু…কুহুকে দেখতে এসেছিলাম।’
কাব্য সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু কুচকে ফেলল। কথাটা কানে যাওয়ামাত্রই ও তাড়াহুড়ো করে কুহুর কেবিনের দিকে দু কদম গিয়ে কি মনে করে আবার ফিরে এলো ঊর্মির সামনে। ভ্রু কুচকে; মারাত্মক ঠান্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল——‘ঊর্মি, ভালোয় ভালোয় জিজ্ঞেস করছি। কি করেছো তুমি ওর সাথে?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঊর্মি চুপ করে দেখতে লাগলো কাব্যকে। তার একসময়ের চেনা কাব্যের কণ্ঠে কুহু নামক মেয়েটার জন্যে উদ্বেগ, কপালের ভাজের রেখায় বোঝা যাচ্ছে—কাব্য ওই মেয়েটার জন্যে চিন্তা করে এখনো।
যেন যেন এই ব্যাপারটা ঊর্মির একটুও ভালো লাগল না। ঊর্মি ঢোক গিলে; কোনরকমে কিছু বলার চেষ্টা করলো—-‘আমি.. আমাকে এত খারাপ মনে—-‘
‘এই, এই মেয়ে, একদম চুপ। মিথ্যা বললে জানে মেরে দেব একদম। জাস্ট আমাকে বলো তুমি কি করেছো ওর সাথে? কি উল্টাপাল্টা বলে এসেছো?’ —- কাব্য তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে মারাত্মক রাগী কণ্ঠে শাসিয়ে উঠল; ওর চোখ ভয়ঙ্কর লাল! ঊর্মি আজেবাজে কিছু করেছে শুনলেই থাপ্পড় সবকটা ঊর্মির গালেই পড়বে।
কাব্যের সাথে এতকিছু করার পরেও ঊর্মির মনে এখনো কাব্যের প্রতি ভয়টা থেকে গেছে। রেগে গেলে কাব্য খুনকার জংলি হয়ে যায়।রাগের সময় যা মাথায় আসে তাই করে ফেলে..একটুও ভাবে না!

ঊর্মি হা করে কাব্যকে দেখে যাচ্ছিলো। এ কাব্যটা বড্ড অচেনা ঊর্মির কাছে; সম্পূর্ণটাই অচেনা। ঊর্মি কোনোদিন কাব্যকে ওর জন্যে এতটা চিন্তা করতে দেখেইনি। অথচ একসময় কত ভালোবাসা ছিলো ওদের।
আর এখন? যার জন্যে কাব্য মুখে বলে— ভালোবাসা নেই, তার জন্যেই এত মায়া; এত উদ্বেগ? হৃদয়ে কেউ যেন কামড়াতে থাকে ঊর্মির, ঘুঁপোকা খেয়ে নিচ্ছে ওর ভেতরের সমস্তটা— যেমনটা ঊর্মি পাগলামি খেয়েছিল কাব্য-ঊর্মির মিষ্টি-মধুর একটা সম্পর্ককে।
এসব ভেবে হঠাৎ কেমন যেন কান্না পেয়ে গেল ঊর্মির! কিন্তু ঊর্মি কাদলো না। এই পাষাণ লোকের কাছে ওর কান্নার কোনো দাম নেই, একটুও নেই। দাম আছে শুধু ওই কেবিনে অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটার, মেয়েটার মানসিক অবস্থার, ওর চোখের জল, ওর কষ্টটুকুর! কার জন্যে কাঁদবে ঊর্মি? হারিয়েই তো ফেলেছে কাব্যকে। জোর করে কতটুকুই বা আটকানো যায় একটা মানুষকে?

তাই ঊর্মি কান্না চেপে চেপে, বহু কষ্টে কটা কথা উচ্চারণ করলো স্রেফ—‘আমি…আ…কিচ্ছু করিনি, কিচ্ছু না। শু..শুধু একটিবার দেখতে এসেছিলাম সেই মেয়েটাকে, যার জন্যে আমার কাব্য আমাকে এতগুলো কথা শোনাতে দুবার ভাবলো না। বিশ্বাস না হলে তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস করো, আমার আর কিছু বলার নেই তোমাকে।’
ঊর্মি কান্না কষ্টে চেপে কথাটা বলে পার্স হাতে কাব্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হনহনিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেল। কাব্য ওকে আটকাতে চাইল; ডাকলো কয়েকবার। কিন্তু আটকাতে পারল না; ঊর্মি ততক্ষণে গাড়িতে চড়ে বসেছে।

ঊর্মি এসব কথা কাব্যকে শুনিয়ে যাওয়ার পর কাব্যর বুক ওয়ান আতঙ্কে ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে। ঊর্মি সাইকো; মাথা ঠিক নেই ওর। কুহু নাজুক এখন; মানসিক অবস্থা ভালো নেই। এখন ঊর্মি ওকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে গেলে মেয়েটা একদম ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
কাব্য সেটা মাথাত আসামাত্রই দ্রুত পেছন ঘুরে হেঁটে কফির কাপ শামিমার হাতে ধরিয়ে দিল——‘আম্মু এটা রাখো তো।’
শামিমা আচমকা কাব্যের ধরিয়ে দেওয়া দু হাতে দুটো কফির কাপ নিয়ে হা করে কাব্যকে দেখে বললেন——-‘ওমা। কি হয়েছে তোর? নিয়ে যে এলি; এখন খাবি না এটা?’
কাব্য এই পৃষ্ণের জবাব দিল না। দ্রুত তাড়াহুড়ো পায়ে কুহুর কেবিনের দিকে গেল। কেবিনের দরজাটা খুলে ঢুকতে যাবে..দেখতে পেল সাদাত-কবিতা বসা কুহুর পাশে। কুহু চুপচাপ সাদাতের কাঁধে মাথা রেখে কবিতার মুখে তুলে দেওয়া ফলটুকু খাচ্ছিল। কাব্য দরজার সামনে সেভাবেই দাড়িয়ে রইল! কুহুর কাছে যাবে বলেও আর যেতে পারলো না।সাদাতের সামনে এসব কথা তোলা যাবে না।

তাই চুপচাপ চলে এলো সেখান থেকে! আস্তে আস্তে হেঁটে এসে বসলো শামিমার পাশটায়। চুপচাপ বেঞ্চে মাথাটা নিচু করে বসে থাকলো। শামিমা দেখে গেলেন শুধু তার গর্ভের ছেলেটাকে। ছেলেটাকে কটাদিন ধরে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। ছেলেটা কেমন চুপচাপ; মন খারাপি নিয়ে বসে থাকে সবসময়ই! ওদিকে কুহুটার অবস্থাও ভালো নয়। ওদের এত কষ্ট কেন থাকবে? এটুকু বাচ্চা একেকটা।
শামিমা ছেলের কাঁধে কি মনে করে আলতো করে হাতটা রাখলেন। কাব্য কাঁধে মায়ের হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে কেমন মিইয়ে গেল! সেভাবেই বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু!

আজ কুহুজে হাসপাতাল ট্যাকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে। কুহুকে আজ নিয়ে আসা হচ্ছে বাড়িতে। কাব্য নিজেই গাড়িটা ড্রাইভ করছে। কুহু কবিতার কাঁধে মাথাটা এলিয়ে রেখে চুপচাপ জানালার দিকে চেয়ে আছে। সাদাত কাব্যের পাশের সিটে বসে কাব্যকে ব্যাবসার কাজের ব্যাপারে কিছু একটা বলে যাচ্ছেন। কাব্যের সেসব মন আজ একটুও নেই। ও লুকিং মিররে বারবার, না চাইতেও কুহুর দিকে তাকাচ্ছিলো। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পরে গেল কাব্যের!

সেটা এক বছর আগের কাহিনি। কুহু সেবার এসএসসি এক্সামের প্রথম দিন ছিলো। সেদিন বাংলা পরীক্ষা ছিলো। কাব্যের সেদিন একটা তাড়া ছিলো ভার্সিটিতে। ও নাকেমুখে কোনরকমে নাস্তা খাওয়া শেষ করছিল। ঠিক তখনই কোথা থেকে দৈতবলে কুহুর আগমন ঘটে ওদের ফ্ল্যাটে। স্কুল ড্রেস পড়ে, ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে একদম ফিটফাট হয়ে ওদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে হাসিমুখে। শামিমা কুহুকে দেখে গদগদ গলায় ওকে সোফায় এনে বসালেন। কুহু শামিমার দিকে চেয়ে বলল———‘বড়মা, আমার প্রথম এক্সাম আজ। বেশি করে দোয়া করে দাও তো।’
কুহু মাথাটা ঝুঁকে বসলো শামিমার সামনে। শামিমা হাসতে হাসতে কুহুর মাথায় কিছু দোয়া পরে ফু দিয়ে বললেন——-‘ভালো করে এক্সাম দে।এ প্লাস নিয়ে আয় অন্তত এইবার।’

কুহুর মনটা এবার খারাপ করে বলল——-‘ওনলি এ প্লাস ক্যান নট ডিটারমাইন ম্যাই ভ্যালু বড়মা।’
শামিমা বুঝতে পারলেন— কুহুর প্রিপারেশন এবারেও খারাপ। তাই সেটা নিয়ে আর ঘাটালেন না তিনি। কুহুর ক্রসবেল্টটা একটু ভাঁজ পরে গেছিল; শামিমা সেটা ঠিক করে দিতে দিতে বললেন——‘ঠিকাছে; শুধু এক্সামে মাথাটা ঠান্ডা রাখিস তাহলেই চলবে মা।’’
কুহু মাথা নাড়ালো। পরপর হঠাৎ, আচমকা বলে বসে——‘আমি বন্ধুদের সাথে আজ যাব না এক্সাম হলে। আমি তোমাদের করো সাথে যেতে চাই।’
শামিমার ক্রসবেল্ট ঠিক করা শেষ। কুহুর কথা শুনে গালটায় হাত বুলিয়ে বললেন——‘তোর চাচ্চুরা তো কেউই নেই বাসায় কুহু। কে নিয়ে যাবে?’

কুহু এবার দাঁত বের করে হেসে বললো—-—‘কেন? কাব্য ভাই? উনি তো বেরুচ্ছেনই!’
কাব্য সবে জগ থেকে পানি ঢালছিল গ্লাসে খাবে বলে। কুহুর কথা শুনে ডাইনিং থেকেই শাসিয়ে উত্তে চেচালো——‘আমি পারব না আগেই বলে দিচ্ছি। আমার তাড়া আছে।’
কুহু মনটা খারাপ করে শামিমার দিকে তাকাতেই; শামিমা ওতেই গলে গেলেন। কাব্যের দিকে চেয়ে ড্রইং রুম থেকেই বললেন——‘কটা মিনিটেরই তো ব্যাপার কাব্য। নিয়ে যা না। প্রথম পরীক্ষা দিবে, নার্ভাস ফিল করছে মেয়েটা।’
কাব্য পানি খাওয়া শেষে ব্যাগ তুলে কাঁধে। জবাবে ভ্রি কুচকে বললো——-‘তোমাকে বললাম না আমার প্রেজেন্টেশন আছে। দেরি হলে প্রবলেম হবে। এসব বলার পিপিআরেই এখন কিনা তুমিও ওর সাথে পাগলামি করছো আম্মু?’
শামিমা এবার নিজেই জেদ ধরলেন——‘কীসের দেরি আবার তোর? তোদের ভার্সিটিতে দেরিতে গেলে কিচ্ছু হয়না। আমি বলছি— নিয়ে যা ওকে। পাঁচ মিনিটে তোর দুনিয়া উল্টে যাবে না।’

মায়ের জেদে কাব্য এবার কড়া চোখে কুহুর দিকে তাকাল! যেন কাচা খেয়ে ফেলবে কুহুকে এইমুহূর্তে। কাব্যের এমন তাকানোতে কুহুর খুব একটা যায়-আসলো না। ও স্রেফ দাঁত বের করে হাসলো।
সেবার গাড়িতে কুহু কাব্যের পাশের সিটটায় বসেছিল। কাব্য গাড়ি ড্রাইভ করছিল বিরক্ত মুখে! কুহু একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে শুধু সেই কখন থেকে। একে তো দেরি হওয়াতে বন্ধুরা কল করে করে মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে; তার উপর এই ছাগল কুহুর অনর্গল বকবকানি। একসময় কাব্য মহা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললো——-‘আর একটা কথা তোর মুখ থেকে বের হলে আমি গাড়ি থেকে তোকে ফেলে দিয়ে চলে যাবো কিন্তু।’

ব্যাস! কুহুর সে কথাতে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। ও সেবার সেই যে চুপ করে বসেছিল; টানা দুদিন কাব্যের সাথে একটা কথাও বলেনি। কাব্য নিজে থেকে কিছ জিজ্ঞেস করার পরেও কথা বলানো যায়নি ওকে। এমনকি কাব্যদের ফ্ল্যাটেও যায়নি এ কদিন। সেবার শামিমা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কুহুকে মানিয়ে রাগটুকু ভাঙিয়েছিলেন..!
সেবার কুহু ছোট ছিলো, ওর রাগটুকুও অযথা ছিলো। তাই ভাঙানো গেছে! কিন্তু আজ? আজকের পর ওদের দুজনের মধ্যকার যে এক দেয়াল সেটা আদৌ কখনো ভাঙা যাবে? কুহুকে এভাবে মনমরা দেখতে কেন যেন কাব্যের একটুও ভালো লাগছে না। ও লুকিং মিররে এতবার তাকাচ্ছে, একবারের জন্যেও কুহুর চোখে চোখ পড়ছে না; কুহু ওর দিকে তাকাচ্ছেই না সবসময়ের মতো।

কুহু সেইযে চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে বসেছিল, ওভাবেই তাকিয়ে আছে। মুখে হাসি নেই; ঠোঁটে কথা নেই, চোখে চঞ্চলতাও হারিয়ে গেছে! এমনটা কেন হয়ে গেল? কাব্য তো এমনটা চায়নি কখনোই? ও তো সব স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল! কুহু এতটা ভেঙ্গে যাবে; ও সেটা আন্দাজ অব্দি করতে পারেনি।
কাব্য অন্যমনস্ক ছিলো; ডুবে ছিলো নিজের অন্য একটা জগতে। ওদিকে সাদাত বারবার ডাকছেন কাব্যকে—-‘কাব্য..শুনতে পারছো তুমি আমাকে? কাব্য?’
এতবার ডাকাডাকিতে কাব্য হঠাৎ হুশে ফিরতেই সামনে আরেকটা মোটরসাইকেল চলে আসে। কাব্য বুঝামাত্রই গাড়িতে জোরে একটা ব্রেক কষলো। আচমকা ব্রেকে সাদাত সামনে ঝুঁকে নিজেকে আটকালেন, একটু হলেও মাথায় ব্যথা লাগত উনার। ওদিকে কবিতা দুহাতে মেয়েকে আগলে সামনে ঝুঁকে আবার নিজেকে সামলে নিয়েছেন। সাদাত ভ্রু কুঁচকে কাব্যের দিকে তাকালেন——‘এটা কেমন ধরনের ড্রাইভিং, কাব্য? মন কোথায় তোমার? ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দাও; গাড়িতে মহিলারাও আছে।’

কাব্য অপরাধী চোখে সাদাতের দিকে তাকাল—-‘সরি চাচ্চু!’
কথাটা বলতে বলতে আরও একবার লুকিং মিররে কুহুর দিকে তাকালো। কুহু এইবার লুকিং মিরোরে ওর দিকে রাগী: মারাত্মক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে— যেন এক্ষুনি ওকে চোখের তাকানোতেই ধ্বংস করে দিবে। কাব্য-কুহুর চোখে চোখ মিলতেই কুহু অবহেলার শ্বাস ফেলে আবার জানালার দিকে তাকিয়ে ফেলল। কাব্য ভ্রু কুচকাল তখুনি! কুহু কি ওকে ইগনোর করতে চাইছে?
কাব্য ব্যাপারটা ভাবলো.! পরমুহূর্তে মনে হলো — হয়তো ওই ঊর্মি অবশ্যই কিচ্ছু বলেছে ওকে! তারজন্যেই কুহুর এমন রিঅ্যাকশন! কাব্য ভাবল— বাড়ি গিয়ে কুহুর সঙ্গে কথা বলবে। জানা দরকার কুহুর সঙ্গে ঊর্মির আসলে কি নিয়ে কথা হয়েছে।
বাড়ি পৌঁছালে সাদাত মেয়েকে নিয়ে আগে আগেই চলে গেলেন নিজেদের ফ্ল্যাটে। তাই সেবারের মতো কাব্যের আর জিজ্ঞেস করা হলো না..কুহুর আসলে কি নিয়ে ঊর্মির সঙ্গে কথা হয়েছে।

পেরিয়ে গেছে মাঝের কটাদিন! কুহু এতটা দিন সম্পূর্ণ বেড রেস্টে ছিলো। এখন ও তুলনামূলক সুস্থ বেশ।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে.. . সুস্থ হবার পরেই কুহুর মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিয়েছে! কেমন যেন দিনদিন পুরোটা বদলে গেছে কুহু। আগে যে একটা মায়াবি কুহু ছিলো, সে এখন কেমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। আগের মতো হাসছে না: কথাও ঠিকঠাক কারো সঙ্গে বলছে না।
এই যে এখন..কুহুর জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার কুহু করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা হচ্ছে— কবিতার কাছে বায়না ধরেছে ও চুল কেটে ফেলবে।কোমর সমান চুল এইবার কাঁধ সমান করে ফেলতে চাইছে! সেটাই স্যাম্পল হিসেবে কবিতার কাছে এনে হাজির করেছে ক্রিতি সানোনের কতগুলি শর্ট হেয়ার ছবি।

কুহুর এমন অদ্ভুত আবদার শুনে কবিতা তো পুরোটাই হতবম্ব। যে মেয়ে দুনিয়া শুদ্ধ তেল-শ্যাম্পু ব্যবহার করে চুলকে বহু কসরতের পর কোমর সমান লম্বা করেছিল—- সে এখন চুল কাটবে;; তাও কাঁধ সমান! যা দিয়ে একটা ছোট বেনুনিও করা যাবে না। সবসময় খোলা ছেড়ে রাখা ছাড়া আর কোনো স্টাইলিং করা যাবে না ওই চুলের ডিজাইনে।
কবিতা মেয়ের এই ছেলেমানুষিতে এইবার একদমই সায় দিলেন না। রান্নায় মশলা দিতে দিতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন——‘কুহু; বাচ্চামো করবে না। চুল কাটছো না তুমি এখন। সুন্দর চুল হয়েছে; ওটা থাকুক। যাও এখন এখন থেকে; আমাকে রান্না করতে দাও।’

কুহু বারণ শুনে মায়ের গলায় এবার ঝুলেই গেল একপ্রকার——‘আম্মু; ও আম্মু. প্লিজ না। এটা এখনকার নতুন ট্রেন্ড! কেটে ফেলিনা; প্লিজ! প্লিজ স্যালুনে চলো না আমার সাথে।’
কবিতা রান্না রেখে এইবার মেয়ের দিকে ঘুরে তাকালেন। আগের চেয়েও মারাত্মক শীতল কণ্ঠে বললেন——‘রুমে যাও; পড়তে বসো। আমি এক কথা দুবার বলতে চাইছি না তোমাকে কুহু।’
কুহুর মন খারাপ হয়ে গেল! ও মায়ের দিকে একবার চেয়ে দেখে তারপরেই জেদ দেখিয়ে হনহনিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল! নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল! নিজের চুল ইচ্ছে করছে ছিড়ে ফেলতে, কারণ এই চুল কাব্য ভাইয়ের পছন্দ। কুহু চায়না— ওর জীবনে কাব্য ভাইয়ের আর কোনো অস্তিত্ব থাকুক।
চুলের মতো, কাব্য ভাইকে ও ছুড়ে ফেলে দিবে.. নিজের শরীর থেকে, আত্মা থেকে, এমনকি মস্তিস্ক থেকেও!
কুহু জেদ বাড়লে সবসময় কান্না পায়..তাই এবারেও পেল! কুহু আয়নার সামনে দাড়িয়ে দুহাতে নিজের চুল মুষ্টি করে ধরলো। আয়নায় দেখল নিজেকে, ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে শুধু।

কুহু নাক টানল, চুলের গোড়ায় টান দিতে দিতে নাক টেনে টেনে বললো—-‘এই চুল আমার চাইনা; শুনছেন আপনি? চাইনা আমার আপনার পছন্দের এই লম্বা চুল। কেটে ফেলবো আমি সব; আমার যে সবকিছু আপনার নামে যা হয়েছিল; সবকিছু নষ্ট করে দিব আমি। প্রয়োজন পড়লে নিজেকেও জ্বালিয়ে দেব আপনাকর ভালোবাসার শাস্তিস্বরূপ। তবুও আপনাকে আমার চাইনা; আপনার কোনো অস্তিত্ব আমি আমার জীবনে চাইনা। চাইনা..চাইনা..চাইনা..কিচ্ছু চাইনা!
কুহু জেদ নিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলতে থাকে একের পর এক কথাগুলো! তারপর অস্থির হয়ে, নিজেই ড্রয়ার থেকে কাচি বের করে আচমকা দুবার না ভেবেই চুল একদম কাঁধের সমান করে কেটে ফেলল ঘ্যাচ্যাং করে। লম্বা এক গোছাচুল তরতর করে গড়িয়ে পড়ল মেঝেময়। কুহু কাচি হাতে চুপচাপ মেঝেতে পরে থাকা সেই চুলের মুঠির দিকে আনমনা হয়ে চেয়ে রইল। চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে শুধু মেয়েটার! এত শখের চুল ওগুলো…!

গলাটায় উপচে পরা কান্নারা বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। কুহুর যখন চুল কেটে পাগল-পাগল দশা ঠিক তখন হঠাৎ ওর ফোনে একটা মেসেজ আসে। কুহু ফোনটার স্ক্রিনে দেখে ঊর্মি আপুর মেসেজ। কাব্য-ঊর্মি ঘুরতে গেছে, একসাথে ডিনার করছে সেই ছবি কুহুকে পাঠিয়ে নিচে লিখেছে—-
‘ LOVELY TIME WITH MY MOST LOVELY PERSON’
ছবিগুলো দেখে কুহুর মনে হচ্ছে ওর চারপাশে ভূমিকম্প হচ্ছে। কুহু আচমকা রেগে উঠে ফোনটা হাতে খামচে তুলে ঊর্মিকে ব্লক করে দিয়ে সোজা সেটা আছাড় দেওয়ার মতো ছুড়ে ফেলল বিছানার উপর।
তারপর দুহাতে নিজের কান্নায় ভেজা মুখ মুছতে মুছতে পাগলের মতো বলতে থাকে——‘কার জন্যে কাঁদছি আমি? এই বেয়াদব কুহু; অসভ্য মেয়ে তুই একটা! কার জন্যে কাঁদবি? ওই মানুষটার জন্যে? যে তোকে কষ্ট দিয়ে দিব্যি আরামে আছে? চুপ; আর কান্না না। চুপ চুপ চুপ..একদম চুপ কুহু!’
মস্তিস্ক নিজেই শাসায়; কিন্তু মনটা তো বেপরোয়! ওটা কি ভালো-খারাপ; জেদ-আত্মসম্মান বুঝে আদৌ? শুধু একজনের নামেই ধাকধাক করে যায় সবসময়ই।

কুহুর এইমুহূর্তে ভীষণ অস্থির লাগছে। ওকে ডিপ্রেশনের মেডিসিন দেওয়া হয়েছিল বাসায় ফেরার সময়। ইদানিং মাঝেমধ্যে এটা খাওয়া লাগে ওর..নাহলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনা ও। কুহু পাগলের কত ড্রয়ার থেকে মেডিসিনের বক্স বের করে ঔষুধ বের করে চট করে সেটা মুখ ঢুকিয়ে পানি খেলো ঢকঢক করে..পরনের কাপড়টাও ভিজে গেল তাড়াহুড়ো করে পানি খাওয়ার সময়!
মেডিসিন নেওয়ার কিছুসময় পর মাথাটা ঠান্ডা হয়ে এলো! আস্তে আস্তে কুহুর পাগলামি কমল, একসময় নিস্তেজ হয়ে এলো কুহু! কান্না শুকিয়ে গেছে, এখন শুধু ঘনঘন শ্বাস পড়ছে! কুহু চুপচাপ মাথা এলিয়ে দিল বালিশে। দুনিয়া অন্ধকার করে ঘুম আসছে ওর! কুহু যখন ঘুমে তলিয়ে যাবে, তখন হঠাৎ কুহুর ফোন মেসেজ টোন বাজলো। এইবার কাব্য নিজে মেসেজ করেছে; সেখানে লেখা—

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৪

‘kuhu, plz ekbar dekha kor…Sonddhar por chade ay; ami thakbo. Ashish kintu…..!’
(কুহু, প্লিজ একবার দেখা কর। সন্ধ্যার পর ছাদে আয়; আমি থাকব। আসিস কিন্তু!)

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৬