ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২০
অবন্তিকা তৃপ্তি
কুহু আচমকা এমন ঘনিষ্ট হওয়াতে চমকে বড়বড় চোখে তাকালো কাব্যের ঠিক রাগী; রক্তিম মুখের দিকে!
কাব্য এইবার নিজের মেজাজ হারিয়ে নিজেও কুহুর সাথে জোরে চেঁচিয়ে কথা বলতে লাগলো—-‘একদম চুপ! আজ আমি না; তুই আমাকে উত্তর দিবি! সবকিছুর; ইচ এন্ড ইভরি কোয়েসশনের উত্তর তুই আজকে আমায় দিবি! আজ তুই বলবি আমাকে তোর এক্সাক্ট সমস্যাটা কি। টেল মি কুহু; আমার হাতের আজ প্রচুর সময়। সব শুনব আমি তোর: সব উত্তর। আমাকে বল তোর এক্সাক্ট সমস্যা কি? কি জন্যে তুই এমন করছিস আমার সাথে? তোকে রিজেক্ট করেছি শুধুমাত্র এইজন্যে তুই ঢ্যাংঢ্যাং করে একটা খারাপ ছেলের সঙ্গে হাহাহিহি করছিলি? উত্তর দে কুহু; মুখে কুলুপ এটে থাকলে আমার হাতে আজ তুই থাপ্পড় খাবি।’
কুহুর ফ্যালফ্যাল চোখে কাব্যকে দেখে যাচ্ছে। কাব্যের নাক; ঠোঁট;রাগী মুখটুকু—- পুরোটাই তৃষ্ণার্তের মতো দেখে যাচ্ছিল অনবরত! কাব্য এতটা কাছে ওর; এতটা পাশে: গায়ে গা ছুঁইছুঁই করছে এতটা কাছে এলে কুহু কি করে ওর রাগটুকু ধরে রাখবে; কি করে কঠিন হবে এই মানুষের উপর? কুহুর বুক ধুকপুক করছে প্রচণ্ড!
ধিক কুহুর ওই হৃদয়কে; যে হৃদয় এতবার ভেঙ্গে যায় যার কারণে— তার জন্যেই ধাকধাক করে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কুহু নিজেকে সামলালো;বুকের উপর উপচে পরা প্রেমগুলোকে লুকিয়ে গেল; কান্নাগুলো গিলে ফেলল তাৎক্ষণিক!
পরপর চোখ-মুখ কঠিন করে তিক্ত গলায় প্রশ্ন করল———‘কি জানতে চাইছেন আপনি? বলুন আমাকে! কি জানতে চান? আমি যখন তিলে তিলে প্রতিটাদিন নিঃশেষ হচ্ছিলাম: আপনি আমার সাথে একবার কথা বলেছেন? ভালো না বাসেন; বোন হিসেবে তো কিছুটা সহমর্মিতা আমি ডিজার্ভ করতাম তখন। একটাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন— কুহু তুই ঠিক হয়ে যাবি: আমি আছি পাশে? বলেছেন? অথচ কাপুরুষের মতো ছয়মাসের জন্যে আমার মুখোমুখি হবেন না দেখে পালিয়ে গেলেন।আর এখন কোন অধিকারে আমার থেকে এসব জানতে চাইছেন? উত্তর দিন!’
কুহু পরপর ওর বাহু থেকে কাব্যের হাত প্রাণপণে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল——-‘ছাড়ুন আমাকে। কিচ্ছু বলবো না আমি আপনাকে; কোনো কৈফিয়ত দেব না। ছাড়ুন আমাকে; কি হলো ছাড়ুন!’
কুহু অস্থির;মরিয়া কাব্যের থেকে প্রাণপণে ছাড়া পাবার জন্যে। এই মানুষটার সামনে আর দু মিনিট থাকলে কুহু খেই হারিয়ে তার বুকেই ঝাঁপিয়ে পড়বে! গলে যাবে বরাবরের মতো এই লোকের দু’চোখে— যা কুহু চাইছে না; ক্ষমা করবে না কুহু এই লোককে; কোনদিন নয়!
কুহুর কথাগুলো শুনে কাব্য ভ্রু কুচকে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। ও কুহুর সঙ্গে দেখার করার কথা বলেনি, চেষ্টা করেনি—- এটা কুহু কি বলছে? পরিস্থিতি তখন এতটা ঘোলাটে ছিলো কাব্য চেয়েও শুরুতে কথা বলতে পারেনি। তারপর তো ও কুহুকে মেসেজ দিয়ে ছাদে ডেকেছিল— সেদিন ছাদে না এসে কুহু ওকে ব্লক করে দিল তারপর সব জায়গা থেকে।
কাব্য কুহুর হাতটা এবার খামচে শোর ওকে নিজের দিকে আরও টেনে নিলো; কুহু তখনো চোখ নামিয়ে কাব্যের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত! কাব্য ভ্রু কুচকে মাথাটা নামিয়ে বলল——‘আমার চোখের দিকে তাকা কুহু; তাকা বলছি। আমি তোকে ডাকিনি? কথা বলার জন্যে একবার তোর সময় চাইনি? কেন মিথ্যা বলছিস কুহু?’
কুহু কাব্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে ব্যস্ত, এত শক্ত করে চেপে ধরে
রেখেছে কেন? কাব্য এইবার ভয়ানক ধমক দিয়ে উঠলো ———-‘এই, আমার দিকে তাকাতে বললাম না!’
কুহুর হাত থেমে গেল। তীব্র জেদ নিয়েই কাব্যের রাগী চোখে চোখ মেলালো কুহু।চেতে উঠে বলল———‘আমি মিথ্যা বলছি, আমি? আপনার সাথে মিথ্যা বলার রুচিটাও আমার নেই, কাব্য ভাই! আমি যা ফেইস করেছি তাই বলেছি!’
কাব্য এইবার রেগে গেল! কুহুকে ঝাড়ি দিয়ে ওর হাত ছেড়ে দিতেই কুহু দু কদম পিছিয়ে গেল। কাব্যর পাগল পাগল লাগছে; কুহুর জেদ বলছে ও মিথ্যা বলছে না; অথচ কাব্য সঠিক বলছে।
কাব্য এবার হাল ছাড়লো; অতিষ্ট হয়ে বলল——-‘ঘৃণা; ঘৃণা ঘৃণা! এতটা ঘৃণা আমি কি সত্যি ডিজার্ভ করি, কুহু? ওকেহ! ফাইন! আমি প্রুভ দেখাচ্ছি তোকে। আমি মেসেজ দেইনি, না? লেটস রিভিল ইট! তারপর তোকে ধরে আমি মারব; একেকটা কথার জন্যে থাপ্পড় খাবি একেকটা! তার আগে মেসেজ দেখবি!’
বলে কাব্য ফোন বের করছে। কুহু ততক্ষণে নিজের হাত মালিশ করছে: ব্যথা করে দিয়েছে হাতটা পাষাণ লোক! কুহু হাত মালিশ করতে করতে কাব্যের দিকে তাকিয়ে রইল!
কাব্য মেসেঞ্জার খুলে ছয়মাস পুরনো মেসেজ স্ক্রল করে বের করছে। হঠাৎ মেসেজটা খুঁজে পেল কাব্য: সেটা কুহুকে দেখাতে গেল; কুহুও উৎসুক ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো মেসেজটা দেখার জন্যে!
ঠিক তখুনি হঠাৎ করে কাব্যকে পেছন থেকে কেউ একজন ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।
ফোন হাতে কাব্য সামনে কুহুর দিকে আচমকা ঝুঁকে গেল। কুহুও অবাক হয়ে কাব্যের দিকে তাকাল; তাকালো কাব্যকে জড়িয়ে ধরা হাতের মালিকের দিকে। দুটো মিষ্টি; নরম হাত কাব্যের বুকের উপর শক্ত করে ধরে রেখেছে; এবং যখন ফিনফিনে স্বরে বলল————‘কাব্য; কত খুঁজেছি তোমায়! এখানে ওর সাথে কি করছো?’
কাব্য মাথা নিচু করে হাত-দুটো দেখল; পরপর হাতের মালিককে চিনতে পেরে যেতেই দ্রুত ভ্রু কুঁচকে কুহুর দিকে তাকালো! কুহুর বুক যেন কেউ খামচে ধরে রেখেছে; বুকের ভেতর কান্না জমে আসছে আবারও; ছয় মাসের পুরনো সেই কান্না!
কুহু কাব্যকে বুঝতে দিলো না; ও স্রেফ কাব্যর আড়ালে একটা বেঞ্চ খামচে ধরে তাকিয়ে রইলো কাব্যের চোখের দিকে! অথচ কাব্য স্পষ্ট লক্ষ করেছে— কুহুর চোখ ভেজা; হাত কাঁপছে! তারপর কাব্যের চোখ গেল—- কুহু বেঞ্চ কেমন আঙুলের নখে মারাত্মক খামচে ধরে রেখেছে!
কাব্য সেটা দেখে তড়িগড়ি করে দ্রুত ঊর্মিকে নিজের থেকে ছাড়ানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেল; অথচ উর্মি ছাড়ছেই না। কুহু জোরে একটা শ্বাস ফেলল; হাপড়ের মতো বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কাব্যের দিকে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টি ছুড়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল ওই কক্ষ থেকে। কাব্যের একহাত ঊর্মির হাত তখনও নিজের থেকে ছাড়াচ্ছিল কুহু চলে যেতেই কাব্য হতবম্ব হয়ে কুহুর যাওয়াটুকু দেখল !
কাব্যের চোখ থেকে সরছেই না— কুহু কাদল মাত্রই! কাব্যকে লুকিয়েই হোক; কুহু কেদেছে! ও কুহুকে আবার কাঁদিয়েছে! শিট! শিট!
ঊর্মি তখন কাব্যের বুকের উপর হাতদুটো শক্ত করে চেপে আহ্লাদি গলায় বলে উঠলো——-‘মিসড ইউ কাব্য!’
ঊর্মির কথা কানে আসা মাত্রই কাব্যের হুশ ফিরল! ও ঊর্মিকে ঝটকা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিল আচমকা। ঊর্মি অবাক হয়ে নিজের হাতদুটোর দিকে চেয়ে আবার কাব্যের দিকে তাকাল। কাব্য ফুঁসছে; নাকের নীচটুকু ঘষতে ঘষতে ঊর্মির দিকে গরম চোখে তাকাল। ঊর্মি ওই তাকানো দেখে ভরকে গেল একপ্রকার: দু পা পিছিয়ে গিয়ে আমতা-আমতা করে বলল———‘আ..আর ই..ইউ ওকে কাব্য?’
কাব্য এইবার যে সমস্ত রাগ ছিলো মনে; সেসব একে একে ঊর্মির উপর উপর ঝেড়ে চিৎকার করে বলল———‘তুমি এটা ইচ্ছে করে করেছো রাইট? কুহুর সামনে আবার এই নাটক করেছো কেন? ও তোমার জন্যে কেদে বেরিয়ে গেছে ঊর্মি। ঊর্মি হুয়াই: টেল মি হুয়াই? আমরা রিলেশনে নেই এখন; কেন ওর সামনে আমার গায়ে পড়ে যাও? বাকি সময় তো তোমাকে দেখাই যায়না আমার আশেপাশে! রিভেঞ্জ নিচ্ছো না?’
ঊর্মি কাব্যের এমন রেগে গজরাতে গজরাতে বলা কথা কানেই তুলল না। ও আলগোছে মিষ্টি হেসে কাব্যের বুকের উপর দুটো হাত রাখল: সঙ্গেসঙ্গে কাব্য ওই হাত-দুটো ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিল।
রেগে তাকাল ঊর্মির দিকে। ঊর্মি কাব্যের রাগকে তোয়াক্কা না করে হেসে হেসে বলল——-‘বা রে। আমার বয়ফ্রেন্ড তুমি; জড়িয়ে ধরতে পারিনা? ওটার জন্যে কি এখন আশেপাশের মানুষ দেখা লাগবে? কামঅন কাব্য!’
কাব্য মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে জোরে শ্বাস টানল; এই মেয়েকে একটা থাপ্পড় কেন দিতে পারে না কাব্য! শুধুমাত্র মেয়েদের উপর হাত তুলে না বলেই কি?
কাব্য পরপর ঊর্মির দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলল———-‘একমাত্র তোমার বাবার দিকে চেয়ে আমি তোমাকে স্টিল সহ্য করছি ঊর্মি। আমাকে ক্ষেপিও না; ওয়ার্ন করছি আমি! আমার হাত উঠে যাবে!’ ’
ঊর্মি আবারও নির্লজ্জের মতো হাসে: কাব্যের গায়ের উপর দুটো হাত আবার রাখতেই: কাব্য আবার হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে ফেলল। ঊর্মি হেসে আবার বলল———‘ওরে বাবা; এত রাগ! আরে রিভেঞ্জ কেন নিব আমি কাব্য? তুমি তো আমারই; এখনো; এতকিছুর পরেও!’
কাব্যের মাথা ধরে যাচ্ছে; অতিষ্ট গলায় কটা কথা বললো স্রেফ ———‘তুমি একটা সাইকো ঊর্মি; ইউ নিড ট্রিটমেন্ট!’
ঊর্মিও হেসে চোখ টিপে বলল——-‘আমার ট্রিটমেন্ট তো তুমি; কাব্য!’
কাব্য মেজাজ হারিয়ে ফেলল; ও ঊর্মিকে একবার কড়া চোখে শাসিয়ে চলে গেল গেল কক্ষ থেকে! ওখান থেকে বেরিয়ে ঊর্মির সাইকিয়াট্রিককে কল দিল; কথা বলল তার সাথে কিছুক্ষণ। আজকের ঘটনা বলার পর ঊর্মির সাইকিয়াট্রিক জবাবে কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন———‘ও কি ঠিকমতো মেডিসিন নিচ্ছে?’
কাব্য কপালে আঙুল ঘষে; দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল——-‘জানিনা। কিন্তু আমার পক্ষে আর মেজাজ ধরে রাখা সম্ভব না ডক্টর।আম সো টায়ার্ড!’
ডক্টর কাব্যকে বোঝালেন———‘তুমি শান্ত হও! আমি প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলছি এ ব্যাপারে। উর্মিকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্যে উনাকে রাজি করাতে হবে; তাহলে তুমিও কিছুটা ওর পাগলামি থেকে রক্ষা পাবে।’
কাব্য শুনে বলল——-‘প্লিজ; এজ আর্লি এজ পসিবল এটা করুন; আমি আর ওকে নিতে পারছি না।’
‘ডোন্ট ওয়ারি; বয়! আমি দেখছি এটা! ‘ ———- ডক্টর কাব্যকে সান্ত্বনা দিলেন।
কাব্য কল কেটে তানিমের কাছে গেল। তানিম কাব্যকে দেখেই বলল————‘কি রে: কুহু তো চলে গেল দেখলাম।’
কাব্য অনুভূতিশূন্যভাবে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ক্লাসের দিকে যেতে যেতে বলল———‘হু!’
‘মানে তুই জানিস? তোরা না কথা বলছিলি?’—- তানিম অবাক হয়ে বলল!
কাব্য উত্তর দিল না এই প্রশ্নের, ও চুপচাপ হাঁটছে! আজকের পর মনে হচ্ছে না— কুহু ওর সঙ্গে আর কথা বলবে; কুহুকে আজকেও আবার কষ্ট দিয়েছে কাব্য! নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা লেগে যাচ্ছে কাব্যের। ও কেন সবদিক সামলাতে পারছে না।
দুপুর ২:৩০!
কায়া ও উমা কলেজ থেকে ফিরছিল। আজ বড্ড গরম পড়েছে ঢাকাতে! ঘনঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়া নিয়ে কায়া প্রচন্ড বিরক্ত; সেটাই বলে যাচ্ছে উমাকে; উমা শুনছে এসব— মাঝেমধ্যে তাল মেলাচ্ছে।
গল্প করতে করতে ওরা একটা গলি পেরুচ্ছিল! হঠাৎ ওই গলি থেকে একটা বাইক শা করে কায়ার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আচমকা এমন হওয়ায় কায়া উল্টে পড়তে গিয়ে বেচেছে। ও নিজেকে সামলে সোজা ক্ষেপে গিয়ে; বকে উঠল———-‘এই কে রে! দেখে চলতে পারিস না?’
বলে পেছন তাকাতেই কায়া দেখল—- বাইকে দাঁড়ানো লোকটা একটা বৃদ্ধ লোকের সামনে নেমে দাঁড়িয়েছে। কায়া এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে যাবে, উমা ওকে আটকে দিল, বলল——-‘কিছু বলিস না কায়া; ভালো ছেলে মনে হচ্ছে না দেখে। চল যাই আমরা!’
কায়াও হয়তোবা আঁচ করতেপেরেছে। ও মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ সামনে ফিরে হাটা শুরু করল। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ পেছন থেকে বৃদ্ধ লোকটার আর্তচিৎকার কানে আসতেই কায়া পেছনে তাকাল। সঙ্গেসঙ্গে কায়ার পুরো দুনিয়া ঘুরে গেল। কায়া মুখে হাত চেপে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল! বৃদ্ধ লোকটার পেটে ছু ড়ি চালিয়ে বাইকের লোকটা পালিয়ে যাচ্ছে উল্টো রোডের দিকে।
কায়া সাথেসাথে দৌড়ে গেল ওই বৃদ্ধ লোকটার সামনে। ওদের চিৎকারে মানুষ অনেক জড়ো হয়ে গেছে আশেপাশে। কায়া লোকটার হাত ধরে বসল রাস্তাতেই! বৃদ্ধ লোকটা কায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে ব্যাথাতে কাতরাতে কাতরাতে বলে যাচ্ছেন——-‘আ. . মারে বাঁ. .চাও মা!
কায়া উনার হাত চেপে ধরে নিজেই অস্থির হয়ে বললো———‘কি. . কিচ্ছু হবে না আ. .আপনার দাদু!’
কায়া পাগলের মতো সবার দিকে চেয়ে বলল———-‘উনাকে হসপিটাল নিতে হবে।আপনারা হেল্প করুন প্লিজ!’
কেউই এগিয়ে আসছে না; সবাই ফিসফিস করছে। একটা মা র্ডার কেসে বিনা দোষে কেইবা ফাঁসতে চাইবে? উমা আশেপাশের সবার দিকে চেয়ে হাতজোর করে অনুনয় করে বলল———‘প্লিজ একটু হেল্প করুন কেউ। উনি মরে যাবে তো!’
এতবার করে বলার পরেও কেউই এলো না। কেউ কেউ মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছে! কায়া এদেরকে পাথরের মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে এবার সবার দিকে চিৎকার করে বলল———‘এখানের এত লোকের মধ্যে কারোর কি মেরুদন্ড নেই? লোকটা মারা যাচ্ছে; আর আপনারা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছেন?’
এবারেও কারোর মধ্যে হেলদুল নেই। কায়া অধৈর্য হয়ে উমার দিকে চেয়ে প্রায় কেঁদেই বলল———‘পাশের হসপিটালে কল কর উমা, দ্রুত!’
উমা কল দিচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটার মাথায় কায়া হাত বুলির দিতে দিতে কেদে কেদেই বলল——-‘কি.. কিচ্ছু হবে না আপনার দাদু; ঠিক হয়ে যাবেন আপনি! ওকে! একটু চোখ খুলে রাখুন প্লিজ! কিচ্ছু হবে না আপনার!’
কায়া এবার উমার দিকে চেয়ে বললো—-‘কল রিসিভ করেছে?’
উমা বলল——‘অ্যাম্বুলেন্স আসছে!’
কায়া এইবার জনসমাগমের দিকে চেয়ে চিৎকার করে রাগী গলায় বলল——-‘সবাই এখন থেকে চলে যান এক্ষুনি। একজনের জীবনের বিনিময় সার্কাস দেখার কোনো অধিকার নেই কারোর! জায়গা খালি করুন এক্ষুনি; রাইট নাও!!
কায়ার কথায় কজন গেল; কজন তখনো থেকে গেল। এরমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এলো! কায়া-উমা দুজনেই বৃদ্ধ লোকের সাথে হসপিটাল গেল!
হসপিটালে যেতেই পুলিশ এলো: লোকটার পরিবারের লোকদের খবর দেওয়া হলো। হসপিটালে ভিড় জমতেই; কায়া থরথর করে কাপতে কাপতে একটাপাশে গিয়ে দাড়িয়ে গেল। বমি পাচ্ছে খুব ওর!
জীবনে এই প্রথম কায়া ভীষণ খারাপ:আতঙ্কিত একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। কায়ার সারাটা শরীর ভয়ানক কাপছিলো। হাতে শিভারিং হচ্ছে প্রচণ্ড! কায়া একটা পিলার চেপে কোনরকমে দাড়িয়ে আছে। ঠিক তখন কায়ার ফোনে কল এলো। স্নিগ্ধের ফোন দেখে কায়া অসুস্থের মতো জোরে একটা শ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো!
অপাহ থেকে স্নিগ্ধ বেশ আদুরে গলায় ডাকলো——‘হ্যালো জান! কলেজ থেকে ফিরেছিস?’
কায়া কাপতে কাপতে কিছু বলল ফিসফিস করে; আজ ওর গলা থেকে আওয়াজই আসছে না একদম। স্নিগ্ধ কায়ার বড়বড় শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল! স্নিগ্ধ এইবার সন্দেহ নিয়ে নড়েচড়ে বসে বলল———‘কায়া, জান, ঠিক আছিস তুই?’
কায়ার গলা একদম বসে গেছে। চোখের সামনে বারবার ওই খু নের দৃশ্য ভাসছে। কায়া থেমে থেমে কিছু বলার চেষ্টা করলো ফিসফিস করে——-‘এ. . একটা খু—— খু—ন——-‘
স্নিগ্ধ বুঝেনা কায়া থেমেথেমে কি বলতে চাইছে। ও আবার ছটফটে গলায় জিজ্ঞেস করে——-‘কি হয়েছে? ভালো করে বল। আচ্ছা: শান্ত হো! কই তুই, আগে সেটা বল!’
কায়া থেমে থেমে বলল——‘হ. . হসপি.. হসপিটালে!’
স্নিগ্ধ অবাক হলো; বলল——-‘কলেজ থেকে ফিরে তুই হসপিটালে কি করিস?’
কায়া থেমে থেমে আবারও বলল——-‘একটা খু—-খু—খুন. . .!’
স্নিগ্ধ এবারেও বুঝে না——‘খুব? খুব কি?’
কায়া বাকি কথা বলার আগে ওর গলা উপচে বমি চলে আসছে! ও ফোন কানে দৌড়ে মুখ চেপে ওয়াশরুমে গিয়েই হরহর করে বমি করে দিল। স্নিগ্ধ সেটা বুঝতে পেরেই উৎকণ্ঠিত হয়ে গেল মুহূর্তেই বারবার চেঁচিয়ে বলতে লাগল———‘কায়া,কায়া কি হয়েছে সোনা? বমি করছিস কেন? কায়া? এই কায়া ? কোথায় তুই? কোন হসপিটালে? এড্রেস দে আমারে! কায়া বমি কেন করতেসস জান?’
কায়া বমি করছে: স্নিগ্ধের কথা কানে আসছে অথচ ও কথা বলতে পারছে না। উমাও দৌড়ে এসেছে কায়ার পিছু পিছু। উমা এসেই কায়ার হাত থেকে ফোন নিজের হাতে নিয়ে স্মিগ্ধকে বলল———-‘ভাইয়া আমি উমা। কায়ার ফ্রেন্ড!’
স্নিগ্ধ সেটা শুনেই ভীষণ তাড়াহুড়ো করে বলল——-‘ওর কি হয়েছে? আর তোমরা হসপিটালে কেন? কি করছো ওইখানে?’
উমা সব কিছু বলল স্নিগ্ধকে। স্নিগ্ধ হতবম্ব হয়ে শুনে গেল পুরোটা! উমা কায়াকে একহাতে ধরে স্নিগ্ধকে বলল———
‘ও ট্রমাতে আছে ভাইয়া। বাসার কাউকে কল করে——‘
‘আমি কল দিচ্ছি ভাইয়াকে। তুমি ওর সাথে থাকো, একা বেড়িও না।’
স্নিগ্ধ কল কেটে; তাড়াহুড়ো করে কাব্যকে কল দিল। কাব্যকে জানিয়ে এইবার আরেকবার ভিডিও কল দিল কায়াকে। কায়ার বমি তখন কমেছে; চোখ মুখে পানির ঝাপটা: সেভাবেই হাপাতে হাপাতে স্নিগ্ধের কল রিসিভ করল। স্নিগ্ধ নিজেকে সামলে; কায়ার দিকে চেয়ে বোঝাল—— ‘কিছু হয়নি সোনা: এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট!’
কায়া এতক্ষণে কাউকে পাশে পেয়ে হাউমাউ করে কেদে ফেললো! স্নিগ্ধ কয়ার কান্না শোনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল——-‘আরে! কান্নার কি আছে কায়া? স্টপ ক্রাইং! ভাইয়া আসছে: বাসায় যাবি; আর ঘুমাবি; বুঝলি? সব ভুলে যা; লাইফের এসব ঘটনা সব মনে রাখতে নেই জান!’
কায়া কেদে কেদে বলল———‘লোকটা আমার হাতে মরে যাচ্ছিল স্নিগ্ধ! একটা মানুষ উনাকে এসে ধরেনি! আমি কত রিকুয়েস্ট করলাম সবাইকে; কেউই এলো না। আমি জানিনা লোকটা বাঁচবে কিনা, দাদুর বয়সী লোকটা! আমার দাদুর কথা মনে পড়ছে ভীষণ..উনি বাঁচবে তো স্নিগ্ধ?’
স্নিগ্ধ বোঝাল——-‘বাঁচবে; উনাকে উনার পরিবার দেখে নিবে। তুই একটা ব্রেভ গার্ল কায়া! এমন একটা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে, এতদূর অব্দি উনাকে এনে হসপিটালে এডমিট করা এটা সাধারণ মেয়েরা পারে না; বাট আমার কায়া পেরেছে। এখন আমার কথা শোন; বাড়ি যাবি; খেয়ে ঘুম দিবি। ঘুম থেকে উঠে রেগুলার পড়তে বসবি। আজ যা হয়েছে সব একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাহ; ওকে?’
কায়া নাক টেনে এখনো কাঁদছে, বলল———‘ভুলতে পারছি না আমি: আমার চোখে সব ভাসছে এখনো! লোকটার রক্ত এখনো আমার কলেজ ড্রেসে লেগে আছে।’
স্নিগ্ধ এবার কিছুটা থামল! কায়ার পাশে হয়তো ওকে দরকার। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেছে ভীষণ!
স্নিগ্ধ এবার শীতল গলায় প্রশ্ন করল——-‘আমি আসবো বাসায়?’
কায়া থামল; কান্না থামিয়ে বলল————‘তোমার পরীক্ষা?’
‘তোর জন্যে হাজার এক্সাম স্যাক্রিফাইজ করা আমার কাছে কিছুই না কায়া: তুই ভালো থাকলে আমি থাকবো! ——— স্নিগ্ধ গম্ভীর গলায় বলল!
কায়া চোখ মুছে নিজেকে সামলে বলল———‘না আসার দরকার নেই। এক্সাম দাও; আমি বাসায় যাচ্ছি!’
স্নিগ্ধ আবারো জিজ্ঞেস করলো ———‘আমাকে ভিডিও কলে রেখে বাইরে যা; দেখ বাইরে ভাইয়ার গাড়ি এসেছে কিনা।’
কায়া স্নিগ্ধের কথা অনুযায়ী তারপর তারপর কাব্যের সাথে বাসায় এলো!
কায়ার কান্না; ওর অস্থিরতা; ওর পাগলামি—— সবকিছু স্নিগ্ধকে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারলো না। স্নিগ্ধের নিজেরই ভীষণ অস্থির লাগছে। কায়া ঘরে কি করছে? ঘুমাচ্ছে? ঘুম আসবে ওর আজ? স্নিগ্ধ কি যাবে আজ? কিন্তু ওর এক্সাম? সেটা?
স্নিগ্ধকে অস্থির হয়ে দেখে ওর রুমমেট আরিফ বলল——-‘এত যখন অস্থির হচ্ছিস; চলেই যা না! এক্সামের কারণে গার্লফ্রেন্ডকে প্যারা দিয়ে নাই মামা! এক্সাম আবার আসবে; কিন্তু গার্লফ্রেন্ড গেলে আরেকটা পাওয়া মুশকিল!’
স্নিগ্ধ ফোন হাতে বসে আছে। ভাবছে— কায়াকে কি কল দিবি? যদি ঘুমে থাকে? ঘুমটা ভেঙ্গে গেলে আবার এসব মনে করে অস্থিরতা বোধ করবে। স্নিগ্ধ ফোনটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিল।
যা হবার তাই হবে! এই মধ্যে এখন যে তুফান চলছে— সেটা নিয়ে এক্সামেও ভালো করা পসিবল না। প্রয়োজনে রিটেক দিবে। কিন্তু কায়ার পাশে ওকে দরকার।
স্নিগ্ধ চটজলদি সাদা শার্টের উপর ব্লক লেদার জ্যাকেট জড়িয়ে ফোন নিয়ে সেভাবেই বাইকের চাবি হাতে বেরিয়ে এলো।
স্নিগ্ধ ভীষণ তাড়াহুড়ো করছিল। সেভাবেই বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালো। বাইকে উঠে হেলমেট পরে বাইক চালু করে হাই স্পাইড চললো বাসার উদ্দেশ্যে!
তারপর হঠাৎ.. . . স্নিগ্ধের বাইকের সামনে একটা মাতাল ড্রাইভারে ড্রাইভ করা ট্রাক তেড়ে এলো! স্নিগ্ধের বাইকের স্পিড হাই থাকায় ও ঠিক সময় বাইকের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
তারপর যা হবার তাই হলো! ট্রাকের এক ধাক্কায় স্নিগ্ধের বাইক উল্টে পড়লো! স্নিগ্ধ বাইক থেকে ছিটকে পড়ল রাস্তার একপাশে! সঙ্গেসঙ্গে মাথাটা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগলো। আর তখন আরেকটা নিয়ন্ত্রণহারা গাড়ি স্নিগ্ধের উপর দিয়ে চলে গেল।
গাড়িটা আটকানো গেল না; ট্রাকটাকেও নাগালে ধরা গেল না। মুহূর্তের মধ্যে স্নিগ্ধের আশেপাশে মানুষের ভিড় জমে গেল। স্মিগ্ধ কুকাচ্ছে; শেষ নিঃশ্বাস টুকু নিচ্ছিল! ওর পুরো শরীর রক্তে মেখে গেছে একদম। স্নিগ্ধ রক্তাত হাত বাড়িয়ে লোকেদের কিছু বলছে—- হয়তোহ ওকে বাঁচানোর অনুরোধ করছিল।
অথচ এবারেও ওরা নিশ্চুপ; কেউই এলো না কায়ার বড্ড শখের পুরুষকে বাঁচানোর জন্যে; কেউই এলো না ওকে একটাবার হাত দিয়ে হসপিটালে টেনে নেবার জন্যে।
স্নিগ্ধের উচানো হাত দুর্বল ভঙ্গিতে নেচে পরে গেল। স্নিগ্ধ হা করে জোরে একটা শ্বাস নিলো; একবার তাকিয়ে দেখল এখানে ওর আশেপাশে দাড়িয়ে থাকা প্রত্যেকমানুষকে।
এখানে একটাও কায়া নেই। নাহলে আজ স্নিগ্ধকেও ওই বৃদ্ধ লোকটার মতো হসপিটালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলত! স্নিগ্ধের হঠাৎ মনে হলো—- আচ্ছা ওই বৃদ্ধ লোক কি জীবিত আছেন? সুস্থ হয়েছেন?
স্নিগ্ধ হাসে পরপর! সুস্থ হবেন না কেন! কায়া; ওর শখের নারী ওকে মনুষত্ব দেখিয়েছিলো! অথচ স্নিগ্ধের বেলায় এখানে এতগুলো লোকের মধ্যে কেউ নেই— যে স্নিগ্ধকে একটুখানি মনুষত্ব দেখাবে!
স্নিগ্ধের চোখ একসময় বন্ধ হয়ে এলো! পালস রেট নেমে গেল— নিম্ন থেকে নিম্নস্তরে! তারপর. . . তারপর যা হবার তাই হয়ে গেল!
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৯
শাহবীর সিদ্দিক স্নিগ্ধ আর থাকল না; রইল না! কায়াকে জান; সোনা বলে আর কেউ ডাকবে না। কায়ার পাগলামি সামলে নেবার জন্যে আর কেউই রইল না; কেউই না; কেউ না, কেউ.. . . না!