ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৮

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৮
অবন্তিকা তৃপ্তি

মাগরিবের নামাজ পড়ে শার্লিন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের রুমে। সারাদিনের জার্নি; খেলাধুলা করে সবাই ভীষণ টায়ার্ড। তাই যে-যার মতো করে কেউ বিছানায়; কেউ মেঝেতে, অথবা কেউ সোফাতে কাহিল হয়ে ঘুমাচ্ছে। একমাত্র কুহুর চোখে আজ কোনো ঘুম নেই। ওর মনটা অস্থির; ওর রাতগুলো বরাবরের মতোই নির্ঘুম আজও।
বিকেলে শার্লিনের বলা কথা ওর কানে বাজছে বারবার। সত্যি কি কাব্য ভাই ওকে… ভা…ভালোবাসেন? কাব্য ভাইয়ের তো ঊর্মি আপু আছে। তাহলে শার্লিনের কেন মনে হলো সেটা? কোনোভাবে কাব্য ভাই ভেবেছেন ঊর্মি আপু—কুহু দুজনেই একইসাথে রাখতে? কুহুর রাগ হলো এবার! এমন যদি হয়, তবে কখনোই না! কুহু কখনোই চাইবে না—ঊর্মি আপুর বয়ফ্রেন্ডকে নিজের কবজায় করে ঊর্মি আপুকে চিট করতে কাব্য ভাইকে লাই দিতে।

ঊর্মি আপু সাইকো; হ্যাঁ, ঠিক আছে এটা। কিন্তু উনি একটা মেয়ে। কুহু মেয়ে হয়ে ওদের দুজনের সম্পর্কে কোনোদিন ঢুকতে চায়নি। কাব্য ভাই কুহুর পছন্দ ছিল— কিন্তু সেটা তখন, যখন কাব্য ভাই একেবারে শুধুমাত্র কুহুর জন্যে হবেন। এভাবে কুহু কারোর শেয়ার করা উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করবে না—এটুকু আত্মসম্মান কুহুর অন্তত আছে।
আর কাব্য ভাই— উনিও কি ঊর্মি আপুকে এত সহজে ছেড়ে দেবেন? দুজনের একে অপরের প্রতি কত ভালোবাসা— সেটা কুহু জানে। ওরাই তো এতকাল জাহির করলো কত গর্ব করে কুহুর সামনে— আজ এখন? ওদের এত ভালবাসাও ফুরিয়ে গেল?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হয়তো শার্লিনই ভুল ছিল! এসব কিছু না, কখনো ছিলোই না; নিছক চোখের ভ্রম হবে হয়তো।
কাব্য ভাই কুহুর কখনোই হবার নয়, হবেনও না। কুহু নিজের ভাগ্যকে মেনেই তো নিয়েছে!
কুহু বালিশ থেকে একবার মাথা তুলে সবাইকে দেখলো। সবার ঘুম কতটা আরামের হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস এলো কুহুর—- ওর মনে এত সুখ-আরাম কেন যে নেই।

ঘুম আসছিল না, আর মাঝরাতে ভীষণ অস্থিরও লাগছিল। তাই কুহু আলগোছে চুপিসারে উঠে পরলো বিছানা থেকে। ওড়না মাথায় নিয়ে; একটা চাদর ভালো করে গায়ে জড়িয়ে আলগোছে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।
একা একা হাঁটতে হাঁটতে একসময় এসে দাঁড়াল হাওড়-পাড়ে। এই জায়গাটা ভীষণ ঠান্ডা-ঠান্ডা। হাওড়ের পানি, ঢেউয়ের শব্দ—- সবটা নিঝুম রাতে মিষ্টি এক ভায়োলেনের মতো শোনাচ্ছিল। কুহু সস্থির একটা শ্বাস টানলো, তারপর পাড়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পানির দিকে। পানির ঢেউ, শব্দ—সবকিছু দেখছিল ও।
হঠাৎ মাথাত খেলে গেল একটা ঘটনা। কাব্য ভাইকে নিয়ে কুহুর ভীষণ মিষ্টি একটা মুহূর্ত। কুহু সাঁতার জানেনা, ছোট বেলা কাব্য ভাই কুহুকে দাদাবাড়ির পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন ইচ্ছে করে— যেন কুহু সাতরে পাড়ে আসতে পারে। কুহু তো আসতে পারেনি সেদিন সাঁতার দিয়ে, তবে পানি খেয়েছিল প্রচুর। কাব্য ভাই সেদিন কুহুকে পুকুর থেকে টেনে তুললেও, কুহু মারাত্মক রাগে-দুঃখে কাব্যের সাথে কথা বলেনি একটাদিন। পরে অবশ্য কাব্য ভাই কুহুর রাগ ভাঙাতে কুহুর পছন্দের আইসক্রিম পার্লারে নিয়ে আইসক্রিম খাইয়েছিলেন।

ছোট কুহুর রাগ সেবার সামান্য একশো টাকার আইসক্রিমে ভেঙ্গে গেলেও—- আজকাল কুহু বড় হওয়াতে রাগ আর ওভাবে ভাঙে না।
কুহু হঠাৎ এই ঘটনা মনে পড়াতে মাথা নিচু করে হেসে ফেলল, পরমুহূর্তে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। ফের তাকিয়ে রইলো চুপচাপ পানির দিকে।
‘হাই, এখন, এই সময়ে তুমি এখানে কুহু?’—
সিয়াম কুহুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর গায়ে ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট! সেটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে কুহুর দিকে চেয়ে আছে উৎসাহ নিয়ে ভীষণ।

কুহু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সিয়ামকে দেখলো, তারপর স্বভাববসত সিয়ামের গায়ের থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে পানির দিকে চেয়ে লম্বা শ্বাস টেনে জবাবে বলল———‘রুমে দমবন্ধ লাগছিল!’
সিয়াম কিছু বলল না; ওরা দুজনেই চেয়ে থাকল পানির দিকে।
আজ আকাশে ভীষণ বড় একটা থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো বরাবর এসে গড়িয়ে পড়েছে কুহুর গোলগাল সরল মুখটার দিকে। সিয়াম পানির থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো কুহুর চাঁদের আলোয় মাখামাখি মুখটা। সিয়ামের মাঝেমধ্যে আফসোস হয়—- এই কাব্য আসলেই একটা ছাগল। নাহলে কেউ এই মেয়েকে রিজেক্ট করতে পারে? অথচ সিয়ামের সবসময় মন চায়—- কুহুকে নিয়ে দুনিয়া এফোর-ওফোর করে ফেলতে।
কুহু চাদরটা দুহাতে গায়ের সঙ্গে মিশিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে ছিলো। সিয়ামই হঠাৎ নিজে থেকে কথা তুলল———‘কুহু?’
‘হু?’—- কুহুর নিষ্প্রাণ জবাব।

‘তুমি কাব্যকে ভালোবাসো, তাই না?’—— সিয়ামের সোজা,সংকোচচবিহীন প্রশ্ন।
কুহু অবাক হলো না; ও শুধু লম্বা একটা শ্বাস টেনে হাওড়ের পাড়ের বিশুদ্ধ বাতাস নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে চোখটা বুজে রেখে অত্যন্ত নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিল———‘তাম, ভালোবাসতাম।’
‘এখন বাসো না আর?’ —— সিয়াম আগ্রহ নিয়ে জবাব চাইল স্পষ্ট করে যেন।
কুহু সিয়ামের দিকে তাকালো, সামান্য হাসলো স্রেফ———‘কি মনে হয়? বাসি ভালো?’
সিয়াম ভ্রু কুচকালো; হয়তো ওর মনে সন্দেহ ঢুকছে। কুহু ওর শুকুয়ে যাওয়া মুখটা দেখে হেসে ফেললো, জবাবে আবার আকাশের দিকে চেয়ে একটা ঢোক গিলে ম্লান গলায় বললো———-‘আমি কাউকেই বহুদিন ধরে ভালোবাসিনা সিয়াম। আই ডোন্ট বিলিভ ইন লাভ এনিমোর।’

সিয়াম হাসলো খানিক, ———-‘বাট আমি তো জানতাম যে তোমার কাছে লাভ ব্যাপারটা ভীষণ ম্যাটার করে, ওই উপন্যাস ধরনের ভালোবাসায় তুমি বিলিভ করতে?’
কুহু আবারও হাসল, এবার ম্যাচোর একটা ত্রিশ বছরের পুরিপূর্ণ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নারীর ন্যায় জবাবে পানির দিকে চেয়ে বললো———-‘আগে বোকা ছিলাম তো, তাই বিশ্বাস করতাম এসব উপন্যাস ধরনের ভালোবাসা। এখন আর করি না, সিম্পল।’
কুহু থামল; তারপর জবাবে শুকনো হেসে ফের বললো——-‘আমাদের মতো কুহুদের জীবনে উপন্যাস ধরনের নায়করা ভাগ‍্যে থাকে না সিয়াম।’
সিয়াম এ কথা শুনে মাথা ঘুরিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে ফেললো; ওর বুকের উপর থেকে এক বোঝা যেন সরে গেল হঠাৎ।

তারপর চাঁদের আলোয় মেখে থাকা কুহুর দিকে চেয়ে ভীষণ স্বস্তি নিয়ে বলল———‘ইমাজিন, যদি কোনোদিন কাব্য এসে বলে সেও তোমায় ভালোবাসে— কী করবে?’
কুহু সিয়ামের দিকে হঠাৎ তাকালো, সিয়াম তখুনি প্রশ্নের ইশারায় ভ্রু উচালো। কুহু তাকিয়েই রইলো সিয়ামের দিকে, পরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলগোছে চোরের ন্যায় চোখ সরিয়ে নিলো। নিজের গায়ে চাদরটা আরো শক্ত করে খামচে ধরে জোরে একটা শ্বাস ফেলে নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দিল————‘অসম্ভব জিনিস নিয়ে আমি আগে থেকে ভাবি না সিয়াম। আর তুমি যার ভয় পাচ্ছো—- সে এখন আমার থেকে অনেক, অনেক দূরে। আলোকবর্ষ বুঝো? তার থেকেও অনেক দূরে।’
সিয়াম আবারও নাছোড়বান্দার ন্যায় বলল———‘যদি বলে? শুধু কল্পনা করো; কী করবে তুমি?’
কুহু জবাবে মাথাটা হালকা কাত করলো, একটা পাথর মাটি থেকে উঠিয়ে সেটা হাওড়ের পানিতে ছুড়ে বলল————‘এভাবেই ছুড়ে ফেলবো।’

বলে হালকা হেসে কুহু সিয়ামের দিকে তাকাল। সিয়াম দেখলো—- কুহুর ওই হাসির পেছনে ওর চোখ টলমল করছে, চোখের ভাষা ভিন্ন! একটা চাপা কষ্ট কুহুকে গুমরে মারছে হয়তো এখনো। কুহু ততক্ষণে চোখ সরিয়ে ঢোক গিলে আবারও পানির দিকে তাকিয়ে রইল। অবশ্য সিয়াম তাকিয়েই থাকে তখনো কুহুর দিকেই। চাঁদের আলো কুহুর মুখের উপর পড়ছে—কুহুর গোলগাল মুখটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে তাতে।
সিয়াম একদৃষ্টিতে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল———‘আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি কুহু।’

কুহু অবাক হয়ে সিয়ামের দিকে তাকালো। সিয়ামের চোখ-মুখ ভীষণ সিরিয়াস! ও আবারো বলা শুরু করল———‘আমি জানি না তুমি কী ভাবছো আমার ব্যাপারে। কুহু, আমাকে নিরাশ করো না কোনোদিন। তুমি তো জানো—ব্রোকেন হার্টের যন্ত্রণা কেমন। আমাকে ওই ফেজটা পার করতে দিও না প্লিজ। আমি ভয় পাচ্ছি কুহু—- কাব্য…কাব্য তোমার কাছে ফিরে এলে…আমাকে ছেড়ে দিবে? আমি জানি আমি তোমার একটা অপশন, তবুও!
কুহু ছোট একটা শ্বাস ফেলে সিয়ামের দিকে তাকাল। দুজনের চোখে চোখ মিললো । কুহুর বোধটা হঠাৎ উপচে এলো যেন— সিয়ামের চোখে সেই প্রেম নেই, যা কুহু কাব্যের চোখে দেখতো।
একমাত্র কাব্য ভাইয়ের হুডেড চোখ-দুটো কুহুকে মেরে ফেলতে পারতো, খুন করে ফেলতে পারত অনায়াসে— সিয়ামের চোখ ওটা পারবে না কখনোই।

কুহু তবুও সামান্য হেসে বলল———‘মনে থাকবে।’
বলে ওরা দুজন আবার পানির দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ দুজনের মধ্যে নিরবতা ছিলো; কেউই কথা বললো না— হয়তোবা বলার কিছু নেই আর। কারণ ওরা দুজনেই জানে— ওদের মনে কি চলছে।
সিয়ামই তাই এবার বলল———‘বারবিকিউ পার্টি হবে বোধহয়। যাওয়া উচিত আমাদের, বৃষ্টিতে এখানের মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেছে। পরে-টরে গেলে সর্বনাশ,আমি সাঁতার পারিনা।’
কুহু জবাবে বলল———‘তুমি এগোও; আসছি আমি।’

সিয়াম আগেই আগেই, মোবাইলের টর্চ জালিয়ে দেখেশুনে এগোল। লুহার হাতে ফোন নেই; অন্ধকারে ভালো করে সবটা দেখতেও পারছে না। তাই কোনরকম হাতড়ে হাতড়ে পা ফেলতে ফেলতে কুহু এগোতে যাবে—হঠাৎ কুহুর চাদরের এক কোণা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো, তাতেই আচমকা পা আটকে গেল। মাটি পিচ্ছিল থাকায় কুহু সামলাতে পারল না আচমকা এই আক্রমণ——পিচ্ছিল মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে ছিটকে পড়ল পাশের হাওড়ে। সাথেসাথেই হাওড়ের পানি ছলকে উঠে, এক আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল কুহু—কুহুও সাঁতার পারে না।
পানিতে সাঁতার কাটার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে কুহুর গগনবিদারী চিৎকার শুনে সিয়াম চমকে পেছন ফিরে তাকাল। কুহু ওই পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে সিয়ামকে ডাকছে সাহায্যের জন্যে———‘সিস্… সিয়াম… বা—চাও—বাঁচাও। পানি—আমি সাঁতার পারি না… পারি—-পা—পারিন—না!’

কুহু হাবুডুবু খেতে খেতে সিয়ামকে পাগলের মতো ডাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ সিয়াম নিজেই দিশেহারা— কারণ ও নিজেও তো সাঁতার পারে না।
সিয়াম কুহুর দিকে এগিয়ে এলো দ্রুত; ভীষণ ভয় কণ্ঠে বলল——-‘ ওয়েট; এক মিনিট— আমি তুলছি তোমাকে কুহু— জাস্ট ওয়েট!’
বলেই এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগল। বারবার বলে যাচ্ছে শুধু——‘একটু ওয়েট কুহু; আমি হেল্প করছি। একটু ওয়েট।’
বলে আশেপাশে ডাল খুঁজতে লাগল। কুহুর ওজন বইতে পারে এমন মোটা ডাল এখানে নেই। সিয়াম এবার হতাশ হয়ে মাথার চুল খামচে দৌড়ে অন্যদিকে গেল ডাল খুঁজতে।

ওদিকে পানির সাথে লড়তে লড়তে কুহুর কাহিল শরীর প্রায় ছেড়েই দিচ্ছে। সিয়াম আশেপাশে কিছু না পেয়ে এবার দৌড়ে গেল অন্যপাশে। কাব্য সামনেই ছিল; ও কয়লা পুড়িয়ে বারবিকিউ বানাচ্ছিল। সিয়াম ওর সামনে এসে হাপাতে হাপাতে ওর সামনে দাড়ালো, কাব্য ওকে দেখে তাকাল। সিয়াম হাপাতে হাপাতে পাগলের মতো বলল———‘কুহু—কুহু পানিতে পড়ে গেছে।’

কাব্য শুরুতে হাঁ করে স্রেফ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল সিয়ামের দিকে। কাব্য তখনই শুনতে পেল হাওড়ের থেকে ভেসে আসা কুহুর আর্তচিৎকার। পরমুহূর্তে কাব্য পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। হাত থেকে উত্তপ্ত কয়লা ছিটকে পড়ে গেল ওর পায়ের উপরে। কাব্যের পা সাথেসাথেই ফেটে-পুড়ে গেল অনেকাংশে। ও সেটা দেখলো না একবারের জন্যেও। সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে এক দৌড়ে, উন্মাদের মতো ছুটে গেল হাওরের দিকে। যেখানে ওর কলিজা, ওর সমস্ত সত্তা হারিয়ে যেতে বসেছে।
হাওড়পাড় থেকে কুহুকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। কাব্য আর ভাবলো না দুবার। জ্যাকেটটা খুলে পাড়ে ছুড়ে ফেলে ও লাফ দিল হাওড়ের পানিতে। হাওড়ের পাড়ে সিয়াম মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে মারাত্মক ভয় নিয়ে চেয়ে আছে। কাব্য বারবার সাঁতরে ডুব দিয়ে দিয়ে খুঁজছে কুহুকে। কোথাও হদিস নেই কুহুর।
কাব্য উঠলো পানি থেকে;শ্বাস ফুরিয়ে আসছে ওর। ও জোরে করে শ্বাস ফেলে আবার ডুব দিল;এভাবেই বারবার ডুব দিচ্ছে।
কাব্য পাগল হয়ে গেছে একদম। ও কুহুকে ডাকা শুরু করেছে এইবার। পাগলের মতো গলা ফাটিয়ে ডাকছে কাব্য

——-‘কুহুউউউউ!’
তারপর আবার ডাব দিল। কাব্যের চোখে চাঁদের আলোতে সিয়াম স্পষ্ট একটা ব্যাপার লক্ষ করল— কাব্যের ওই হুডেড চোখ টলমল করছে। কাব্য পানির উপরে যখন উঠছে; ও শার্টের হাতা দিয়ে বারবার ওর চোখ মুছছে। তারপর ভাঙা-ভাঙা স্বরে কান্নামাখা গলায় কুহুকে ডাকল——-‘ক ই চলে গেলি তুই কুহু?’
কাব্য..কাব্য কুহুকে হারিয়ে ফেলবে আজ। তারপর? কাব্যের জীবনে আর কেউই থাকবে না। এটা…এটা সম্ভব না। কুহুর থাকতে হবে, সম্ভব হলে কাব্য জোর করবে। আজ যদি কিছু হয়ে যায় কুহুর——-? আতকে উঠে কাব্য। জীবনে কোনোদিন যদি কোনো ভালো কাজ করে থাকে কাব্য—খোদা যেন তাঁকে তার কুহুকে ফিরিয়ে দিয়ে তার শোধ শোধরান।
কাব্য যখন দিশেহারা হয়ে প্রায় কেদেই দিবে; হঠাৎ কুহুর হাত একটা এসে কাব্যের পা জড়িয়ে ধরল। সাথেসাথেই কাব্য চমকে উঠে অস্ফুটে বলে উঠে—-‘কু-হু!’
সাথেসাথেই কাব্য আবারও ডুব দিল।

অতঃপর কুহুকে পাওয়া গেছে। কাব্য কুহুকে পাজকোলে তুলে এনে হাওড়ের পাড়ে রাখলো শুইয়ে। সিয়াম কুহুর মাথার কাছে বসেছে। প্রচুর পানি খেয়ে ফেলেছে কুহু ইতিমধ্যেই। ওর গায়ের চাদর নেই, ভিজে গায়ে শরীরের গঠন বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কাব্য একবার আড়চোখে তাকাল সিয়ামের দিকে। সিয়াম কুহুর বুকের দিকে চেয়ে ছিলো, কাব্য তাকাচ্ছে দেখে সাথেসাথেই গলা খাকারি দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো সিয়াম।
কাব্য ভ্রু কুঁচকে সিয়ামকে দেখলো; তারপর সাথেসাথেই কাব্য নিজের খুলে রাখা জ্যাকেট কুহুর শরীরের উপর মেলে দিয়ে আবার সিয়ামের দিকে শাসানো চোখে তাকাল। সিয়াম কাব্যের দিকে একবার তাকাল; পরপর মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল।

কাব্য এইবার কুহুর পেট জ্যাকেটের উপরেই প্রেস করতে শুরু করল।অনেকক্ষণ প্রেস করতে করতে একসময় কুহুর মুখ থেকে পানি বের হতে শুরু করল। কাব্য পেটে প্রেস করছে বারবার;ততক্ষণ প্রেস করলো যতক্ষণ কুহুর পেটের পানি সব বের না হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ কুহু মৃদুমন্দ ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখ খুলে তাকালো আস্তে-আস্তে। কুহুর শুরুতেই কাব্যের দিকে চোখ গেল, কাব্য ওর পেট প্রেস করা চি ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে; ভীষণ অসহায়-টলমল চোখে।

কুহু স্পষ্ট দেখতে পেল—কাব্যের চোখে জল। ওর চোখ, হুডেড আইজ টলমল করছে। কুহু একদম আচমকা ভয়ে উঠে বসে কাব্যকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেদে ফেলল। কাব্য আচমকা থম হয়ে গেল সম্ভবত। ও কুহুর চুলের দিকে অবাক হয়ে তাকালো যেমন, কুহু কাব্যের শার্টের আস্তিন চেপে ধরে কেদে কেদে বলে যাচ্ছে——-‘আমি মরে যাচ্ছিলাম, আমি ওই পানি— ওই পানিতে, হা শ্বাস আটকে এসেছে আমার— আমি না বাঁচলে আজ—-আমি সাঁতার—-আপনার পা দেখে…আমি মনে করেছি— আমি বাঁচ—-তাই ধরে—-‘
কুহু কান্না আর ভয়ের চোটে ভালো করে কথাও বলতে পারছে না। কুহু অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে, যতবার মনে পড়ছে পানিতে থাকাকলিন বিভৎস ঘটনা।

কাব্য তখনও কুহুর চুলের দিকে চেয়ে; ভিজে গা লেপটে আছে কাব্যের সাথে। হয়তোবা কুহুর মাথাতেও নেই— ও কাব্যের সাথে মিশে আছে। ভয়ের চোটে বেচারির সমস্যা-ইগো সব পালিয়ে গেছে।
কাব্য জোরে একটা শ্বাস ছাড়লো; তারপর আলগোছে কুহুর পিঠটা আকড়ে ধরে ওকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে কিছু বললো না, স্রেফ জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে লম্বা একটা শ্বাস টানল যেমন।
এটার দরকার ছিলো কাব্যের: এই জড়িয়ে ধরার দরকার সত‍্যি ছিলো কাব্যের জন্যে।
শুধু আজ কুহু নয়; কাব্যও ভেঙেছে। ভীষণভাবে ভেঙেছে। কাব্যের জান আজ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে পারতো। কাব্য আজ বুঝেছে—- কুহুকে হারিয়ে ফেললে ও ঠিক কতটা নিঃস্ব হয়ে যেতে পারতো। কুহুকে আজ না পেলে—- কাব্যও..ও বেচে থাকত কি করে?

কাব্য এসব ভয়ঙ্কর কথাগুলি ভাবতে ভাবতে কুহুর পিঠটা আরও চেপে ধরে নিজের সঙ্গে মেশায় ওকে; কুহুর ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে স্রেফ অস্ফুটে বলে——-‘তু-ই থেকে যা কু-হু, প্লিইজ।’
কাব্যের অস্ফুটে বলা কথা কুহু না শুনলেও: ঠিক এইবার কুহুর যেন ওর হুশ এলো। ও মাথা তুলে কাব্যের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। কাব্যও সরে নাক টেনে কুহুর দিকে তাকাল, কাব্যের চোখ সম্পূর্ণ লাল— এই যেন কেদে দিবে। কাব্য-কুহু দুজনের চোখে চোখ মিলে যায়—- সিয়াম পাশেই তখন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দুজনেকই দাতে দাঁত চেপে দেখছিল।

কুহুর চোখ বদলে যায়। যেই চোখে এতক্ষণ ভয়, কাব্যের বুজে আসেও খুঁজছিল, সেই চোখ আচমকা রক্তিম হয়ে উঠে। কুহু হঠাৎ কাব্যকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিল। কাব্য দু কদম পিছিয়ে অবাক হয়ে তাকালো যেমন। ও এমনটা আশা করেনি সম্ভবত। এই ধাক্কার আশায় কাব্য হয়তবা ছিলোই না।
কাব্য কুহুর দিকে অবাক চোখে যখন চেয়ে চেয়ে দেখছিল; তখন কুহু জেদের মাথায় উঠে দাঁড়াল। সাথেসাথেই ক্লান্তিতে পড়ে যেতে নিলে; কাব্য দ্রুত ওকে উঠে ধরতে গেল——‘ঠিক আছিস তুই?’
সঙ্গেসঙ্গে হাত বাড়িয়ে কুহু কাব্যকে থামিয়ে দিল ওখানেই। কাব্য বিমূঢ় হয়ে গেল যেন। কুহু সিয়ামের দিকে তাকাল এবার, ক্লান্ত কণ্ঠে বলল———‘আমাকে রুমে দিয়ে আসবে সিয়াম?’
কাব্য মাথা ঘুরিয়ে তাকাল সিয়ামের দিকে, পরপর কেমন ঠান্ডা চোখে তাকাল কুহুর দিকে। কুহু কাব্যের ওই তাকানো নজর আন্দাজ করে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়াম হয়তো অবাকই হয়েছে, ও কাব্যের দিকে একবার চেয়ে কুহুকে ধরতে যাবে, হঠাৎ কুহু নিজের গায়ের দিকে চেয়ে বলে উঠে——‘এটা কার জ্যাকেট?’
কাব্য ম্লান কণ্ঠে বলল——‘আমার, এটাও কি এখন ফেলে দিবি?’

কাব্যের কণ্ঠে জড়তা নেই একদমই। ও ভীষন ঠান্ডা চোখে কুহুর দিকে চেয়ে বললো।
কুহু কাব্যের দিকে রক্তিম চোখে চেয়ে; হঠাৎ জ্যাকেটটা খুলে ছুড়ে ফেললো মাটিতে। কাব্য ম্লান চোখে, মরে যাওয়া দৃষ্টিতে ওর মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া জ্যাকেটটা দেখে একদৃষ্টিতে —- ওটা একটা জ্যাকেট ছিলো না শুধু, ছিলো কাব্যের ভালোবাসা, ওর আদরগুলোর অবহেলা মাটিতে ওভাবে বুঝি গড়াগড়ি খাচ্ছে আজ।
কুহু কাব্যের দিকে দাতে দাঁত চেপে একবার চেয়ে পরপর সিয়ামকে ফেলেই নিজেই গায়ে ভিজে একটা চাদর জড়িয়ে চলে গেল! ক্লান্তি, দুর্বলতা থাকার দরুন যাবার পথে কতবার হোঁচট খেলো, একবার ফিরেও তাকালো না।

কুহু যেতেই সিয়াম কাব্যের পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর কাব্যের তখনো নিজের জ্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মজা নিয়ে বললো——-‘আহারে ফেলে চলে গেল জ্যাকেটটা। আচ্ছা জ্যাকেটটা ফেলে গেল? নাকি তোকে?’
কাব্য সিয়ামের দিকে না তাকিয়েই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উঠল; সিয়াম আবার বলে যায়———‘পাথর চিনিস কাব্য? তুই কুহুর জীবনে এই হাওড়ের পানিতে ছুড়ে ফেলা একটা পাথরের মূল্য রাখিস স্রেফ। তবুও থ্যাঙ্কস বাডি, আমার গার্লফ্রেন্ডকে বাঁচানোর জন্যে।’
বলে সিয়ামও হাসতে হাসতে শিস বাজিয়ে চলে গেল। শুধু পেছনে থেকে গেল কাব্য। কাব্য জ্যাকেটটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আচমকা কি যেন হলো, রেগে উঠে জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে জোরে ছুড়ে ফেলল হাওড়ের পানিতে।

কাব্য নিজের রুমে ফিরেছে সেই কখন। ভেজা কাপড়ে এখনো মেঝেতে বসে আছে নিশ্চুপে। তানিম কাব্যের মুখে সবটা না শুনলেও, বুঝতে পেরেছে কুহু-ঘটিত ঝামেলায় ঘটেছে। তাই ও এক্ষুনি কাব্যকে ঘাটাল না। বেচারা রাগে নিজেই নিজের ফোন ছুড়ে আধা ভেঙ্গে ফেলেছে, তাকেও নিশ্চয়ই মেরে ভর্তা বানিয়ে দিতে পারবে নিসন্দেহে।
এখন তানিম কফি বানাচ্ছে। কাব্য সেই তখন থেকে একটা কথাও বলছে না, কেমন যন্ত্রের ন্যায় বসে আছে সেই একই ভঙ্গিতে।
ওর চোখে ভাসছে———কুহু ওভাবে চলে গেল। জ্যাকেটটা ছুড়ে বোঝাতে চাইল— কাব্যের জীবনে ওর কোনো মূল্যই নেই? সেটাই কি বোঝাল?
কাব্যের হঠাৎ চোখটা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। ও সাথেসাথেই শার্টের আস্তিনে পানি মুছে ফেলল তানিম দেখার আগেই। কুহু পেরেছে…কাব্যের ওই এক থাপ্পড়ের বদলা ও কতই নিষ্ঠুরভাবে নিতে পেরেছে। একেই বুঝি বলে রিভেঞ্জ! কুহু তো তাহলে রিভেঞ্জের রানী হয়ে গেল আজ থেকে…কাব্যের সুযোগ হলে ও একটা অ্যাওয়ার্ড দিবে সেটার জন্যে কুহুকে।

তানিম কফির কাপ হাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসে পাশে মেঝেতে বসে কাব্যের দিকে কফির কাপ বাড়িয়ে দিল। কাব্য সেটা না নিয়ে স্রেফ কম্পিত কণ্ঠে ডাকল——-‘তানিম?’
‘হু?’—- তানিমের উত্তর।
‘একটা থাপ্পড়ের শাস্তি স্বরূপ আমার আর ঠিক কতটা শাস্তি পাওয়া বাকি আছে এখনও?’——— কাব্যের নিষ্প্রাণ কন্ঠ।
তানিম জবাবে বললো——-‘ভুলে যা ওইটা: কুহুকে তুই ভালোবাসিস তো আর না। থাপ্পড় এসব ম্যাটার কেন করবে তোর জন্যে?’
কাব্য উত্তর দিল না। তানিম কাব্যের কফির কাপ মেঝেতে রাখল। বলল———‘রিজেক্ট করা ভুল না তোর। পরিস্থিতি এমনি ছিল তখন।’
কাব্য হঠাৎ কেমন ম্লান কণ্ঠে বলে উঠলো——‘তানিম?’
‘হু?’—- তানিম তাকালো।

‘আমি…আমি বোধহয় ..কুহুকে ভালোবেসে ফেলেছি।’— কাব্যের গলাটা কাপলো সম্ভবত।
তানিম অবাক; প্রচন্ড চমকে উঠে তাকালো কাব্যের দিকে। কাব্য এতক্ষণে তাকালো তানিমের দিকে, অস্থির হয়ে সবকিছু এক্সপ্লেইন করার তাগিদ নিয়ে বললো———‘তুই জানিস…কুহু..কুহু আজ যখন আমাকে ওভাবে ধাক্কা দিল— আমার..আমার কেমনটা লেগেছে? কুহু…যে কুহুকে আমি মনে করেছিলাম ভালোবাসিনা— সেই কুহু যখন আমার দেওয়া জ্যাকেট আবর্জনার ন্যায় ছুড়ে ফেলল…জানিস আমার ঠিক কেমন লেগেছিল?’
কাব্য থামলো; ভাঙা স্বরে থেমে থেমে আঙুলে বুকের বা পাশ খোঁচাতে খোঁচাতে বলল———‘ঠিক এইখানটায় তানিম— কেমন একটা বোঝা বোঝা লাগে আজকাল। কুহুর দিকে, ওর চোখে ঘৃণা—- আমার সহ‍্য হয়না আজকাল। আমি চাই ও আমার আশেপাশে আগের লক্ষ্মী কুহুটা হয়ে থাকুক। কুহুটা থাকলোই না ইয়ার!’

কাব্যের শেষের কথাটা বড্ড করুন শোনালো যেমন। তানিম স্রেফ শুনে গেল আজ, বলতে দিল কাব্যকে ওর সব কথা। কাব্য থামলো, নাকটা টেনে আবার বলল———‘আমি…আমি বুঝিয়েছি নিজেকে ও আমার বোন; বলেছি— কাব্য বোনের প্রতি স্রেফ তোর ভাইয়ের ভালোবাসা থাকতে পারে। অনেক বুঝিয়েছি আমি নিজেকে। কিন্তু…কিন্তু যখনই কুহু আমার সামনে আসতো—- আমার চারপাশ কেমন একটা..বুঝিস তুই? কেমন একটা হয়ে যেত, আমি তাকিয়েই থাকতাম ওর বাচ্ছামোর দিকে। ওর কথা; ওর লাফানো, সমস্ত প্রবলেমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হ্যাপি থাকা— সবকিছু—-ওর ইভরি সিঙ্গেল ডিটেইলস আমার ভালো লাগত।’
কাব্য নিজের কপালে থাপ্পড় দিতে দিতে অতিষ্ট গলায় নিজেই নিজেকে গালি দিয়ে বলল———‘অথচ আমি গাধা; রামছাগল এটা বুঝিই না। আমি কাব্য কুহুকে কবে থেকেই বোনের নজরে দেখছি না— আমি গাধা কিনা সেটা বুঝতেই পারলাম না।’

কাব্য আবার নাক টানল; গলা পরিষ্কার করে আবার বলা শুরু করে——-‘আর আজ যখন বুঝলাম—- তখন সবটা সবটা আমার হাতের বাইরে। কুহু….কুহু এখন আমার আর থাকেওনি।’
কাব্য এবার ভীষন অসহায় হয়ে তানিমকে বলে উঠল——-‘আমি এমন কেন তানিম?’
তানিম কাব্যের কাঁধে হাত রাখলো স্রেফ। কাব্য সেই হাত সরিয়ে দিয়ে, চোখ দুটি অতিষ্ট হয়ে ঘষতে ঘষতে আবার বলল——-‘লাইফের সব ইম্পোরটেন্ট ডিসিশন আমি এতটা গোলমেলে; এতটা প্রবলেম্যাটিক নেই কেন বল না? ঊর্মির ব্যাপারটাই দেখ। ও প্রপোজ করল; কিছু চিন্তা করলাম না, একসেপ্ট করে ফেললাম। ক্লাসের সুন্দরী মেয়ে বলে কথা।’

কাব্য শেষের কথাতে নিজেই নিজের উপর অনেকক্ষণ হাসল পাগলের মতো, তারপর আবার বলা শুরু করলো——‘তারপর যখন বুদ্ধি হলো; বোধ এলো— ঊর্মির সাথে ব্রেকআপ করলাম—- সেটাও বাল আমার পিছু ছাড়লো না, হেল করে রেখে দিয়েছে আমার লাইফ।’
কাব্য এবার গম্ভীর হল; বলে গেল——-‘আর যখন কুহু প্রপোজ করল…আমি গাধা কি করলাম? সেটা রিজেক্ট করলাম। বাহ; কি সিদ্ধান্ত আমার।’
কাব্য হাততালি দিল। তারপর হেসে হেসে নিজেই নিজেকে বলল———-‘দেন ভাব— আমি কুহুকে কি বলে রিজেক্ট করতে পারি? আমি কাব্য, কুহু..কুহুকে রিজেক্ট করলাম কার কথা বলে? ওই পাগল; সাইকো ঊর্মির কথা বলে। বাহ! তানিম—- তোর কি আমাকে এখন একটা চুড়ান্ত গাধা মনে হচ্ছে না?’
তানিম সাথেসাথেই স্বীকার করে মাথা নাড়লো——‘হু; তা তো মনে হচ্ছেই।’

কাব্য থামলো; এবার অস্থির হয়ে বলে যেতে লাগলো——-‘কুহুকে এনে দে না ভাই, প্লিজ। কিভাবে করলে ও ভুলে যাবে আমার দেওয়া থাপ্পড়, আমার সব অপমান, কষ্ট সবটা! কিভাবে; কিভাবে, ঠিক কিভাবে করলে ও আগের মতো হয়ে যাবে। জাস্ট টেল মি। ওর কাছে মাফ চাইতে হবে? ওর পায়ে ধরতে হবে? কি, ঠিক কি করলে ও আমাকে ভালোবাসবে আগের মতো? তুই তো লাভগুরু, এতদিন আমাকে কুহুর পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিস। আমার এখন কুহুকে চাই; এট এনি কস্ট। আমারে এনে দে প্লিজ। ওকে আমার চাই তানিম। তুই যা সাজেশন দিবি আজ; সব করবো আমি। সব! বল আমাকে কি করতে হবে?’

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৭

কাব্য অস্থির হচ্ছিল ভীষণ। ও পারলে আজই কুহুর কাছে ছুটে যায়। কুহুর আচরণ এতদিন সহ্য করতে পারলেও: এখন থেকে আর একমুহূর্ত পারছে না— যখন থেকে কাব্য নিজের ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পেরেছে।
বেচারা কাব্য আজ ভীষণ অস্থির; আজ যেন ভীষণ তাড়াহুড়ো ওর! কুহুকে পারলে এক্ষুনি রুম থেকে বের করে কাজী অফিসে টেনে নিয়ে বিয়ে করে ফেলার মতো ভীষণ অস্থির; উৎকুণ্ঠিত হয়ে আছে এ যাবতকালের সেরা রামছাগল মিস্টার শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৯