ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩০

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩০
অবন্তিকা তৃপ্তি

কুহু সিল্কের শাড়ি পড়েছে। কুহুও হয়তো তাকাল তখন। কাব্য ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে, কুহু ভ্রু কুচকে ফেলল কেন যেন। আশপাশ দেখে বোঝার চেষ্টা করল—কাব্য ঠিক কাকে এমনভাবে দেখছে। কেউ তো নেই আশপাশে। পরপর ও কাব্যের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল। অন্যদিকে চেয়ে কাব্যকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করল।
কাব্য দেখছে কুহুকে, অবজার্ভ করছে। কুহুর চোখ, চোখে আজ ব্লু কাজল লাগিয়েছে, টানা টানা চোখ দেখাচ্ছে। ওর ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক— রেড ওয়াইন কালার, কাব্যকে তৃষ্ণার্ত করে দিচ্ছে ভীষণ। আজকাল রেড ওয়াইনও বুঝি এতটা নেশালো হয়? কুহুর পিঠের মাঝে কালো তিল, তিলের নিচে হোয়াইট——

ওয়েট: হোয়াট? কাব্য হঠাৎই ভ্রু কুচকালো। এটা… কুহুর ব্লাউজের পেছনের হুক দুটো খোলা? ওই তিল এইজন্যেই দেখা যাচ্ছে? কাব্য ভ্রু কুচকে চোখ ছোট করে মাথাটা সামান্য এগিয়ে আরও একবার দেখল— না, ঠিকই আছে; হুক খোলাই। কাব্য একবার সতর্ক চোখে আশপাশের সবাইকে দেখল; কেউ কি তাকাচ্ছে?
পরপর থমথমে মুখে বড় বড় পা ফেলে কাব্য এগিয়ে গেল কুহুর দিকে। দ্রুত, বড়বড় পা ফেলে আশপাশ সচেতন চোখে তাকাতে তাকাতে সোজা এসে কুহুর পেছনে বুক টানটান করে দাড়িয়ে গেল। কাব্যের উপস্থিতি অনুভব হতেই- কুহু ভ্রু কুচকে পেছন ফিরে তাকালো। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে- ছোটখাটো, ৫ ফুট ২ ইঞ্চির কুহুর পেছনে ৫’৯ ফুটের কাব্যকে দেখতে ভীষণ ফিকশনাল লাগছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কুহু মাথাটা তুলে কাব্যকে দেখলো, কাব্য আশপাশে তাকিয়ে থাকা ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখছে তো বডিগার্ডের ন্যায় সচেতন চোখে আবার অন্যপাশে তাকাচ্ছে—যেমন পাহাড়া দিচ্ছে কুহুকে।
আচমকা কাব্যকে এভাবে নিজের পেছনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কুহু যারপরনাই বিরক্ত হলো, নিচু স্বরে কাব্যকে শুনিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল———‘আপনি? আপনি এরকম আমার পেছনে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?’
কাব্য অন্যদিকে তাকাতে তাকাতে কুহুর মতোই ঝুঁকে ফিসফাস করে জবাব দিল———‘উম- সাইডে আয়, কথা আছে।’

কুহু সামনে তাকিয়ে সবাইকে একবার দেখল: সবাই আসতে-যেতে একবার হলেও বাকা নজরে দেখছে কাব্য-কুহুকে। কুহু ওদের দিকে চেয়ে ভীষন অপ্রস্তুত হচ্ছে, ও ঘাড়ের পেছনে হাত বুলিয়ে সবার দিকে হাসার চেষ্টা করে পরপর আবার পেছনে কাব্যের দিকে তাকাল, ফিসফিস করে শাসালো—‘আপনি যাবেন? লোক দেখছে। দেখুন— আমি আমার নামে কোনো কন্ট্রোভার্সি চাইছি না কাব্য ভাই।’
কাব্য মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে নজরে রাখতে রাখতে স্বাভাবিকভাবেই জবাবটা দিল———‘কন্ট্রোভার্সি যেন না হয়, সেজন্যেই ডাকছি সাইডে।’

কুহু নাছোড়বান্দার ন্যায় জবাব দিল———‘আসব না আমি, আপনার কথাতে তো আরো নয়।’
বলে ও নিজের মতো কাব্যকে পেছনে ফেলে হাঁটা ধরল অন্যপাশে। বেচারা কাব্য আবার কুহুর পিঠের পেছনটা দেখামাত্রই পুনরায় হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গেল কুহুর পেছনে। কুহু সামনে হাঁটছে; কাব্য ওর পেছনে হাঁটছে। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে কুহু হাঁটতে হাঁটতে রেগে নিচু স্বরে বলল———‘এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে, লোকে দেখছে কাব্য ভাই।’
কাব্যও নিজের মতো কুহুর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল———‘কিন্তু আমি এখন এখান থেকে সরলে লোকে কিন্তু আরো অনেক কিছু দেখে ফেলবে। আম ওয়ার্নিং ইউ।’
‘মানে?’ ———— কুহু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল।
কাব্য হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁট কামড়ে, নিচু গলায় কুহুর দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে——‘জি; আপনার খোলা পিঠের তিল দেখা যাচ্ছে ম্যাডাম।’

কুহু আচমকা হাঁটা থামিয়ে দিল; পেছন ফিরে কাব্যের দিকে তাকালো ভ্রু কুঁচকে, হয়তো ও কাব্যকে একটু বিশ্বাস করছে সম্ববত। কারণ কুহুর পিঠের তিলের কথা কাব্য ভাইয়ের জানার তো কথা নাই। কাব্য চুড়ান্ত মজা নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে কুহুর দিকে চেয়ে চোখ টিপলো, তারপর কুহুর দিকে মাথা নামিয়ে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল———‘ব্ল্যাকের সাথে ব্ল্যাক মানায়; কিন্তু হোয়াইট? সো ব্যাড চয়েস।’
শেষের কথাটা বড্ড আফসোসের সাথে যেন বললো কাব্য। ব্যাস; কাব্যের এক এক কথাতেই কুহুর চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। ও আচমকা এক দৌড়ে একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আলগোছে পিঠটায় হাত রাখল! ইশশিরে—পিঠে ব্লাউজের হুক লাগানো হয়নি। এতবড় কেলেঙ্কারী কান্ড ঘটে গেছে ভেবেই লজ্জায় মুখটা ছোট হয়ে গেল কুহুর। চোরের মতো মিনমিন করে তাকালো কাব্যের দিকে, কাব্যও ওদিকে দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিন্দাস হেঁটে কুহুর দিকে এগোল।

কুহু শুকনো মুখে মাথাটা নিচু করে আশপাশে শার্লিনকে খুঁজতে লাগলো। কাব্য কুহুর এভাবে কাউকে খোজার জন্যে তাকানো দেখে হালকা হাসলো। হাত উচিয়ে আশ্বস্ত ভঙ্গিতে সহসা বলল———‘চিল, আমি ডাকছি কাউকে।’
বলে ও চলে গেল অন্যপাশে। শার্লিনকে ডেকে পাঠালো কুহুর কাছে। শার্লিন ওদিকে গেলে কাব্য একটা আপেল নিয়ে সেটাতে কামড় বসাতে বসাতে দূরে একটা টেবিলের উপর দুহাত ঠেসে আরাম করে আপেল খেতে খেতে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইলো— ঠোঁটের হাসি যেন ওর টিজ করছে কুহুকে দূর থেকেই।
কুহু আড়চোখে একবার কাব্যের দিকে চেয়ে পরপর গলাটা শুকিয়ে গেল ওর।কুহুর এভাবে চোরের মতো চোখ ঘুরিয়ে ফেলা দেখে;কাব্য কীজন্যে মাথাটা নিচু করে নিশব্দে হেসে উঠলো যেন।

শার্লিন ব্লাউজের হুক লাগিয়ে দিল। কাব্যকে এড়াতে কুহু পরপর শার্লিনের পিছু পিছু হাটা শুরু করলো।
কুহুর বুকটা অজানা কারণেই ধুকপুক করছে শুধু। ও শার্লিনের পিছু ঘুরছে; ঘুরতে ঘুরতে কাব্যকেও কেন যেন বারবার আড়চোখে দেখছে। কাব্যও বন্ধুদের সাথে আড্ডার ফাঁকে কুহুর দিকেই ঘুরেফিরে নজর রাখছে। ওদিকে কাব্য তাকাতেই কুহু চোখ চোরের মতো লুকিয়ে ফেলছে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে— সেটা আবার কাব্যকে ভীষণ মজাও দিচ্ছে।
কুহুকে এভাবে ওকে চেকআউট করতে দেখে কাব্য হালকা হেসে তানিমের কানের কাছে বলল———‘ইউ আর রাইট; কুহু এখনো আমাকে পছন্দ করে এজ এ লাভার।’

তানিম সেটা শুনে বাকা হেসে কাব্যের দিকে তাকাল, কাব্য তানিমের দিকে চেয়ে চোখ টিপলো, ওর ঠোঁটে বিশ্বজয় করা হাসি! সেভাবেই হেসে আড্ডা দেওয়া আশপাশের ছেলেদের বলল———‘তোরা আড্ডা দে: আমি আসছি।’
কাব্যকে এমন ব্লাশ করতে দেখে জুনিয়র ছেলেরাও মজা নিয়ে বলল———‘কই যাচ্ছেন ভাই? ভাবি নাকি এই ট্রিপেই আছে শুনলাম।’
কাব্য থামলো; দু কদম এগিয়েছিল সবে। ওদের কথাতে আবার ফিরে এলো। ওদের আড্ডার সামনে একটু ঝুঁকে, ইনডেক্স ফিংগার দেখিয়ে চোখ টিপে বলল———‘উমম..যা শুনেছো, ঠিক শুনেছো।’
বলেই আবার ফিরে চলে গেল অন্যদিকে কুহুকে খুঁজে। ওদিকে কাব্যের এই এক কথাতে ছেলেরা হইচই লাগিয়ে দিয়েছে একদম। সবাই এটা নিয়েই ততক্ষণে গসিপ শুরু করে দিয়েছে।
ওদিকে কাব্য ছুটছে— কুহুকে খুঁজছে ও। এই সুযোগ— কুহুকে বলে দেবে ওর মনের কথাগুলো। কুহুর পক্ষ থেকে ‘না’ আসবে না সম্ভবত।
কাব্য অনেকক্ষণ ধরেও খুঁজে পাচ্ছে না কুহুকে। শার্লিন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলোক কাব্য ওকে আটকাল———‘শোনো, কুহুকে দেখেছো?’

শার্লিন তাকাল একবার কাব্যের অস্থির ঘর্মাক্ত মুখের দিকে; পরপর মুখটা গম্ভীর করে আঙুল দিয়ে ইশারা করে অন্যপাশ দেখিয়ে বলল———‘হাওড় পাড়ে গেছে।’
বলেই শার্লিন নিজের মতো হেঁটে চলে গেল। কাব্যকে জিজ্ঞেসও করলো না কিছু। কাব্য অবশ্য এসব ধার ধারলো না। ওর মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। কুহু একজন হাওড় পাড়? কাব্য ভ্রু কুচকাল, বিরক্ত ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে—-‘এই মেয়ে শোধরাবে না কোনদিন খোদা।’
কাব্য বড়বড় পা ফেলে চিন্তিত ভঙ্গিতে হেঁটে গেল হাওড়ের দিকে। হাওড় পাড়ে আসতেই কাব্যের পা থমকে গেল আচমকা। ওর চোখ-দুটো যা এতক্ষণ চিন্তিত হয়েছিলো, তাতে ভর করলো মারাত্মক রাগ— জেলাসীর রাগ ওটা। হাত-দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো সহসাই—

কুহুর বা হাতটা সিয়াম চেপে ধরে আছে, কুহু সিয়ামের চোখের দিকে চেয়ে কিছু বলে যাচ্ছে।
মূলত আসল কাহিনি হচ্ছে—- কুহু কাব্যের থেকে দূরে যাওয়ার জন্যে এই নিরিবিলি হাওড় পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে। সিয়াম ওকে একা এখানে দেখায় ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সিয়াম সেদিনের কথা ভেবে— কুহুকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কুহু যাবে না বললে— জোর করে হাত চেপে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ সিয়াম বেচারা সেদিনের মতো রিস্ক নিতে চায়না আর। কুহু আরেকবার পানিতে পরে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অথচ এই জেদি মেয়ে বারবার এই হাওড়ের পাড়েই এসে দাঁড়ায়।
পুরো ব্যাপারটায় সিয়ামের কোনো ব্যাড ইনটেনশন না থাকলেও— কাব্যের চোখে পুরো ঘোয়না একটা মতিভ্রম হিসেবে ধরা দিয়েছে। কাব্য ভেবেই নিয়েছে— সিয়াম জোর করে, অনুমতিবিহীন কুহুর হাত চেপে ধরেছে।
ব্যাস—- কাব্য নিজের মেজাজ খুইয়ে বসলো। হঠাৎ, অত্যন্ত দ্রুততার সাথে হেঁটে তেড়ে গিয়ে আচমকা সিয়ামের মুখে সরাসরি ঘু ষিই মেরে বসলো।
আচমকা এমন আক্রমণে সিয়াম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল। সিয়াম কিছু বুঝে উঠার আগেই কাব্য ওর মুখে আরেকটা

ঘু ষি বসাল।তাতেই সিয়াম নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ল দু-ফোঁটা। সিয়াম নাকে হাত চেপে কাব্যের হাত ধরে থামানোর চেষ্টা করে বলতে চাইলো কিছু———‘কাব্য তুই ভুল—-‘
বাকিটা বলতে পারেনা সিয়াম, কাব্য আরেকবার ওকে মেরে রীতিমত শুইয়ে দিল মাটিতে।
ওদিকে আচমকা কাব্যের এমন হিংস্রের মতো আক্রমণে আতঙ্কিত ভঙ্গিতে কুহু মুখে হাত চেপে হতবাক হয়ে তাকালো ওদের দুজনের দিকে। কাব্য সিয়ামকে মারতে মারতে তখন শুইয়ে দিয়েছে, চেঁচিয়ে বলল———‘বাস্টার্ড; তুই— ওর হাত ধরিস কোন সাহসে? কু ত্তার বাচ্চা— তোরে ও অনুমতি দিসে হাত ধরার? বল? দিসে ও অনুমতি?’
কাব্য সিয়ামকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলেছে ততক্ষণে। সিয়ামের কাব্যের হাত থামানোর চেষ্টা করতে না পেরে নিজেও এইবার কাব্যের কলার চেপে ধরে ঘুষি বসিয়েছে। দুজনের ধাওয়া পাল্টা আক্রমণে দুজনেই রেগে হিতাহিত জ্ঞান হারাচ্ছে।

কুহু বারবার হাত দিয়ে কাব্যকে আটকানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। এক পর্যায়ে কুহু কাব্যকে চেঁচিয়ে বলে উঠল———‘জাস্ট স্টপ ইট— স্টপ কাব্য ভাই। আই সেড স্টপ। ওকে জানোয়ারের মতো মারা বন্ধ করুন, প্লিজ আল্লাহর দোহাই লাগে।’
কুহু এত জোরে ‘জানোয়ার’ – শব্দটা বলেছে যে কাব্য থমকে গেল। সিয়াম এইযাত্রায় কাব্যকে নিজের উপর থেকে ফেলে দিয়ে কোনরকমে উঠে বসার চেষ্টা করতেই কেশে উঠে বমি করে বসলো।
কাব্য উঠে দাঁড়াল সিয়ামের দিক থেকে, ও দেখলোও না সিয়ামকে। সেরকমই কুহুর হাতটা চেপে ধরল শক্ত করে———‘চল এখান থেকে।’

বলে টেনে নিয়ে যাবে কুহুকে, কুহু পেছন থেকে প্রতিবাদ করে বলল———‘আমি কোথাও যাচ্ছি না কাব্য ভাই। হাতটা ছাড়ুন আমার।’
কাব্য পেছন ফিরলো, ওর চোখ লাল হয়ে গেছে একদম। কুহুর দিকে সামান্য ঝুঁকে হিসহিস করে বলল———‘আমি তোকে অপশন দেইনি: যেতে বলেছি, যাবি।’
বলেই আবার টেনে নিতে লাগল কুহুকে। কুহু এবার কাব্যের হাত ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে দিতেই কাব্য পেছন ফিরে তাকালো। কুহু চিৎকার করে বলল———‘এনাফ কাব্য ভাই। এনাফ ইজ এনাফ।’
কাব্য ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকালো। কুহু এই যেন কেদে ফেলবে রাগে-জেদে।
কুহু একবার ঢোক গিলে সিয়ামের দিকে তাকাল: সিয়াম রক্তাক্ত, জা নোয়ারের মতো মেরেছে কাব্য ওকে। কুহু সিয়ামকে এই অবস্থায় দেখে মানবতার খাতিরে কেন যেন কষ্ট পেল।

সিয়ামের আজ কোনো দোষ ছিলোই না; শুধুশুধু এতটা জখম হলো। সিয়ামকে এতটা রক্তাক্ত দেখে কুহু না চাইতেও মেজাজ হারালো, জেদে-রাগের বশে চেঁচিয়ে বলল———‘আপনি…আজ এসব কেন করছেন? আন্সার মি। আজ আমার হাতে অনেক সময়; সব শুনবো আমি। বলুন আমাকে; কি, প্রবলেমটা কি আপনার? আর ইউ জেলাস? সিয়ামকে আমার পাশে সহ্য হচ্ছে না? রাইট?’
কুহু থামলো; তারপর কাব্যের দিকে চেয়ে অপ্রকৃতস্থের ন্যায় হাসার চেষ্টা করে বললো———-‘দেন কংগ্রাচুলেশন, আপনি এখন থেকে রোজ সিয়ামকে আমার পাশেই দেখবেন। কারণ আমি কুহু, বাসায় গিয়ে এবার সিয়ামের কথা আব্বুকে বলে দিচ্ছি।’

কাব্য অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো কুহুর দিকে। রাগের মাথায় কুহু যা নয় তাই বলে যাচ্ছে। কাব্য একবার সিয়ামের দিকে তাকালো; সিয়ামও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে।
কুহু থামলো। একদলা কান্না আসছে ওর ভেতর থেকে। ও কান্না আটকে কোনরকমে থেমে থেমে কাব্যের দিকে আঙুল তুলে বলল———‘অ্যাকচুয়ালি আপনি কী চান-আপনি..আপনি না নিজেও সেটা জানেন না। আপনি সেই অজানা ফিলিংস নিয়ে নিজেও পাগল হচ্ছেন; আর আমার লাইফকেও হেল বানাচ্ছেন। এতকিছুর পরেও— এতকিছুর পরেও আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন; আমি আপনাকে এতদিন সম্মান দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন থেকে আর না। আমি ফ্রেডআপ হয়ে যাচ্ছি, আমি আর আপনার এসব পাগলামি, এসব, এই .. এই যা করে যাচ্ছেন এসব কিছু আর টলারেটই করতে পারছি না।’

কাব্য ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে; বলতে দিলো আজ কুহু যা বলতে চাইছে।
কুহু এবার উত্তেজিত হয়ে কাব্যের বুকে একের ওর এক ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলল———‘কজন লাগে আপনার? হু? ঊর্মি আপু তারপর আমি। আপনার শুধু চাই আর চাই। ফর গড’স সেক— ঊর্মি আপু আপনার পায়ের নিচে পড়ে থাকলেও; আমি কুহু— জীবনেও আপনার পায়ের কাছে পড়ে থাকিনি। সেদিন রিজেক্ট করেছিলেন না? করেছেন তো? হু? তারপর আমি একবারের জন্যে এসেছি আপনার কাছে? চেয়েছি আমাকে ভালোবাসুন? তারপরও আপনি আর আপনার সাইকো গার্লফ্রেন্ড আমার পেছনে পাগলা কুত্তার মতো পড়ে আছেন। হোয়াই? উত্তর দিন।’
কুহুর একেকটা ধাক্কায় কাব্য পেছাচ্ছে। শেষের কথাতে ও কুহুর দুইটা হাত চেপে ধরে থামিয়ে দিল, নিষ্প্রাণ কণ্ঠে উচ্চারণ করল———‘কি বললি? আমি পাগলা কুত্তার মতো তোর পেছনে পড়ে আছি?’
কুহু কাব্যের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো ঝাড়ি দিয়ে; উত্তেজিত হয়ে চেঁচাল———‘হ্যাঁ আছেন আছেন আছেন।’

কুহু দুহাত জোর করে কাব্যকে বলে গেল তারপর——‘দোহাই আপনার— লিভ মি অ্যালোন। আজ একটা কথা বলেছি আমি, আমি ট্যুর থেকে ফিরেই আব্বুকে সিয়ামের কথা বলে দিচ্ছি। অন্তত তখন আপনার আমার পিছু ছুটবে আশা রাখছি।’
কুহু তারপর কাব্যের মুখোমুখি এলো, কাব্যের নিষ্প্রাণ চোখে চোখ রেখে আঙুল দিয়ে শাসিয়ে উঠলো কাব্যকে——-‘ডোন্ট এভার ট্রাই টু ইন্টারফেয়ার ইন মাই ফাকিং লাইফ।’
কথাটা চিৎকার করে বললো যে সিয়াম অব্দি কানে আঙুল চেপে ধরলো। কাব্য-কুহুর এই ঝগড়া সিয়াম বড্ড আয়েশ করে দেখছে আজ। ও তো এটাই চাইছিল—- ও যা চাইছে তাই হচ্ছেই।
কুহুর এতগুলো বুক ঝাঁজরা করা কথাতেও কাব্য নিশ্চুপ, স্রেফ কুহুর চোখের দিকে চেয়ে আছে ও।
কুহু এবার সিয়ামের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাশভারী কণ্ঠে বলল———‘উঠুন।’
সিয়াম কুহুর দিকে চেয়ে আবার কাব্যের দিকে তাকালো। তারপর ইচ্ছে করেই কুহুর সামনে মুখটা আহত ভঙ্গিমা করে করে ধীরে ধীরে কষ্টে-কষ্টে উঠল। কুহু রাশভারী কণ্ঠে সিয়ামের দিকে না তাকিয়েই বলল———‘রুমে যান; আমি আসছি। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে যাবেন সাথে।’

সিয়াম বড্ড করুন মুখে কুহুর দিকে ইচ্ছে করেই তাকালো। কুহু সেই তাকানো দেখল—- অপরাধবোধ হচ্ছে ওর। সিয়াম চলেই যাচ্ছিলো, হঠাৎ যাবার আগে দু কদম পিছিয়ে এসে কুহুর অগোচরে কাব্যের দিকে চেয়ে স্রেফ শয়তানি হাসি ছুড়ে দিল। কাব্য ভ্রু কুঁচকে সিয়ামকে দেখলো তখন।
সিয়াম চলে যেতেই কুহু আবার আস্তে-ধীরে হেটে কাব্যের মুখোমুখি হলো। কাব্য সিয়ামের যাওয়ার দিকে একবার চেয়ে হালকা হাসল;তারপর কুহুর দিকে চেয়ে ম্লান মুখে হেসে বলল———‘ডান? শান্তি মিললো? আমাকে অপমান করতেই তো চেয়েছিলি এতদিন? নাও, ফিলিং বেটার?’

কুহু শুনলো। কাব্যের এমন আহত গলা আজ কুহুজে কাবু করতে পারলো না একফোটাও। ও সেভাবেই জেদি হয়ে কাব্যের চোখে চোখ রেখে চুড়ান্ত কঠোর কণ্ঠে শোনালো——‘আমি কুহু, আজ আমার সেদিনের সব কথা; সব আবেগ, সব অনুভূতি ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমি কুহেলিকা সিদ্দিক কুহু— কাব্য ভাই নামের কাউকেই এই জীবনে ভালোবাসিনি। শুনেছেন? হয়ে গেছে আপনার পুরুষত্বের আহুতি? নাও, গেট দ্য হেল আউট অফ মাই লাইফ।’
কথাটা বলে মুখ ফিরিয়ে কুহু কাব্যকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে; কাব্য আচমকা পেছন থেকে ওর হাত চেপে ওকে আটকে দিল।
পরপর কুহু কিছু বুঝে উঠার আগেই কুহুর হাতটা চেপে ওকে টেনে নিয়ে মিশিয়ে দিল নিজের সাথে, কুহু যেন আচমকা আক্রমনে চমকে উঠলো।

কাব্য কুহুর অবাক-বিস্মিত চোখে চোখ রাখলো, কুহুর কানের পাশটায় হাত রেখে চুল গুছিয়ে দিতে দিতে ঠোঁটে হিংস্র হাসি টেনে হিসহিস করে শোধাএল———‘ভালোবাসিসনি? কখনোই না? আর ইউ শিউর?’
কথাটা বলতে বলতে কাব্য কুহুর চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিতেই; কুহু মুহূর্তেই ছটফট করে উঠলো ছাড়া পাওয়ার জন্যে। গলার জোরে চেঁচাল———‘ছাড়ুন আমাকে কাব্য ভাই। অসভ্যতা করছেন আপনি এইবার।’
কাব্য শুনলোই না; কুহুর হাতটা বড্ড ছটফটে, তাই দুটো হাত মুচড়ে ধরে পিঠের পেছনে নিয়ে চেপে ধরল; কুহুর মুখের কাছে মুখ আনতেই ঢোক গিলে কুহু। কাব্য সেভাবেই হিসহিস করে বলল———‘আমার চোখের দিকে চেয়ে স্বীকার কর—- তোর আমার জন্যে কোনো ফিলিংস আর নেই। কাম অন কুহু; কনফেস কর।’
কুহু কাব্যের চোখের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না এই কথার পরে। হম্বিতম্বি করছে কাব্যের থেকে ছাড়া পাবার জন্যে, ও ভুলেও তাকাবে না কাব্যের ওই নেশালো হুডেড আইজের দিকে।

কুহুর এমন আচরণে, চোরের মতো চোখ লুকানো দেখে কাব্য এ যাত্রায় বিজয়ী হাসি হাসল; আচমকা কুহুর হাতটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল দু’কদম। কুহু ছাড়া পেতেই দু কদম পিছিয়ে অবাক হয়ে তাকালো কাব্যের দিকে।
কাব্য পেছাল, ম্লান চোখে মরা হাসি হেসে বলল———‘তুই বেইমানি করলেও কুহু; তোর এই চোখ।’
কাব্য নিজের দুটো আঙুল ইশারা করলো কুহুর ব্লু কাজলে ঘেরা ওই টানা টানা চোখ-দুটোতে——-‘এই চোখ কুহু-ওরা আমার কাছে বেইমানি করতে পারে না। আমি কাব্য— এখনো তোর কাছে এলে তোর হার্টবিট বেড়ে যায়, আই ক্যান ফিল ইট কুহু। আমি কাব্যকে যে তুই আজ একটা বাইরের ছেলের সামনে অপমান করলি— সেই কাব্যকেই তুই এখনও ভুলিসনি। আমি কাব্য তোর পেছনে কুত্তার মতো ঘুরছি বললি না।’

কাব্য মাথাটা নিচু করে নাক টেনে হাসলো; তারপর আবার কুহুর দিকে চেয়ে ম্লান গলায় বলল———‘কুত্তাকেও কুহু দু’দিন ভালোবাসা দেখলে আজীবন ওই মানুষের চেহারা ভুলে না। আর তুই কুহু— ক’দিন একটু খারাপ হলাম আমি, তুই— তুই আমার ১৬ বছরের ভালোবাসা-আদর সবটা ভুলে গেলি?’
কুহু তাকিয়েই রইলো কাব্যের দিকে। কাব্যকে আজ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না একদম। ওর ঠোঁটে টেনে রাখা হাসি, অথচ চোখ দুটো চুড়ান্ত রক্তিম হয়ে আছে। নিজেকে কুহুর সামনে স্বাভাবিক রাখছে হয়তবা।
কাব্য থামল না, একে একে বলে গেল——‘তুই, তোর অভিযোগ, সবটা আমি মানি, বুঝি। আর বুঝি বলেই আমি তোর কাছে অনেকবার এসেছিলাম কুহু। অনেকবার— তুই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিস বারবার। দিসনি? আমি তোকে মেসেজ করেছি; তুই আমাকে ব্লক করে রেখেছিস। আমি তোদের ঘরে গিয়ে শুনি— ম্যাডাম এখন ঘুমাচ্ছেন, তাই কোনো কাব্যের সাথে উনি দেখা করতে পারবেন না। বলিসনি তুই কাকিমাকে?’
কুহু চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকালো এই প্রশ্নে। কাব্যকে এড়াতে বলেছে ও এ কথা কবিতাকে, কিন্তু সেটা কাব্যের সামনে স্বীকার করার সাহস এখন নেই কুহুর।

কুহুর ওভাবে চোখ ফেরানো দেখে কাব্য হেসে উঠলো শব্দ করে। হাসি থামিয়ে ফের থেমে থেমে ভাঙা স্বরে বলল———‘তুই বলেছিস কুহু। সবটা তুই জানিস। কিন্তু তুই এতটাই ডিলিউশনে ছিলি, আমার সামান্য রিজেকশনের কারণে তুই এতটা বদলে যাবি, আই ডিডন্ট ইভেন নো দ্যাট। আমি এই কুহু— এই যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস, একে…উহু একদম চিনি না। আমি ওই কুহুকে চিনতাম, যে কুহু আমার একটা সামান্য কথাও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো। তুই…এই যে আমার সামনে দাঁড়ানো, এটা আমার সেই কুহু না।’
কুহু চুপ আজ, ওর চোখ টলমলে। ও আজ নিজের চোখে এই প্রথম কাব্যকে এতটা ভেঙ্গে পড়তে দেখছে।
কাব্য আবার হাসলো; মরা-নিষ্প্রাণ একটা হাসি। তারপর কুহুর দিকে চেয়ে আচমকা মাথাটা কাত করে বড্ড কাতর স্বরে বলল———‘তবুও আমি কাব্য ওই কুহুকে না, এই জেদী-রাগী-বদমেজাজি কুহুকেই ভালোবেসে ফেলেছি। হাউ স্ট্রেঞ্জ, না?’
কোথাও যেন একটা বজ্রপাত হলো। কুহু থমকেই গেল যেন। ও চুড়ান্ত অবাক-বিস্মিত চোখে কাব্যের দিকে তাকালো হঠাৎ।

কুহুর এমন অবাক হওয়াতে কাব্য হাসলো কেন যেন, ঠান্ডা মরা সেই হাসি। পরপর হাসি থামিয়ে কুহুর দিকে চেয়ে বলল———‘তুই কুহু. . আমাকে পাগল বানিয়ে ছেড়েছিস। আই ক্যান্ট ইমাজিন. . তুই জাস্ট আমাকে জেলাস করার জন্যে সিয়ামের প্রপোজাল একসেপ্ট করেছিস? সিরিয়াসলি কুহু?’
কাব্য ভীষণ অবিশ্বাস্য গলায় বলল। কুহু স্রেফ তাকিয়ে থাকলো। ওর কিছু বলার নেই, মুখ থেকে যেন আজ একটা শব্দও বেরুচ্ছে না।
কাব্য ভাইয়ের এই স্বীকারক্তির জন্যে কুহু না জানে কতটা দিবন-রজনী অপেক্ষা করে বসেছিল। আজ কাব্য ভাই বলেছেন— তিনি বলেছেন তিনিও কুহুকে ভালোবাসেন। নিয়তির খেল দেখো।
সাত মাস আগে কুহু ঠিক কাব্যের জায়গায় দাড়িয়েছিলো; আর আজ? স্বয়ং কাব্য ভাই সাত মাসের ব্যবধানে সেই একই জায়গায় দাড়িয়ে আছেন।
কুহু অস্ফুটে বলতে চাইলো কিছু———‘এসব মিথ্য. . .!’
কুহু কথাটা শেষ করার আগেই, কাব্য আবার বড্ড অস্থির হয়ে— একের পর এক বলে গেল———‘আমি. . আমি জানি না কুহু ভালোবাসা ঠিক কেমন হয়। বাট আমি. . আমি কেমন যেন ইদানিং হয়ে গেছি ইয়ার। তুই. . তুই আমাকে এমন বানিয়ে দিয়েছিস।’

কাব্য পুরোটা দায় দিল কুহুর উপরেই। কাব্য এগুচ্ছে এবার; এক পা দুপা কুহুর দিকে এগুতে এগুতে বলতে থাকে———‘আমি তোর দিকে তাকালেই মনে হয় আমার হার্টবিট, ওইটা এতটা জোরে বিট করে কুহু— আমি নিজেকে সামলাতে পারি না তখন। তোর স্মেল; তোর চুল। উম.. লম্বা চুল আমার পছন্দের ছিল বলে তুই কেটে দিয়েছিলি না? অথচ কুহু. . এই ছোট টমবয় টাইপের চুলেও তোকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে এখন. . তুই জানিসও না সেটা। তুই— তুই আমাকে অস্থির করে দিস কুহু. ., যখনই আমার কল্পনায় আসিস।’

কাব্য এগিয়ে; কুহুর বা হাতটা ছুলো। কুহু নিজের হাতের দিকে চেয়ে আবার কাব্যের দিকে তাকালো। কাব্য কুহুর বাম হাতের কব্জিতে থাকা শুকিয়ে যাওয়া কাটা কাটা দাগগুলোর দিকে চেয়ে ওগুলো ছুয়ে দিতে দিতে বড্ড কাতর স্বরে বললো———‘আর তোর হাতের এই দাগ, কেন করলি এমন কুহু? জানিস, আমার বুকে কেমন যন্ত্রণা দেয় এই দাগগুলো। জানিস না তুই, কিচ্ছু কিচ্ছু জানিস না তুই কুহু, পাষাণ তুই। আচ্ছা, কেন করেছিলি সেদিন এসব পাগলামি? বল! কুহু, এই দাগ, এগুলো আমি যতবার দেখব ততবার কুহু আমার বুকটা খোঁচাবে। আমার কুহু আমাকে ভালোবেসে মরতে গিয়েছিলো. . এই অপরাধবোধ আমি সহ্য করবটা কী করে? বল।’
কুহু কেন যেন, কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে আলগোছে কাব্যের হাতে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো, সেটা দেখে কাব্য স্রেফ হাসল। কুহু মাথাটা নামিয়ে নিলো।
কাব্য ম্লান কণ্ঠে বলল———‘আমি হাত ছুঁলাম, খারাপ লাগল। আর ওই বাস্টার্ড সিয়াম যখন ছুঁয়েছে— খারাপ লাগে না?’

কুহু মাথা তুলে ফের তাকাল কাব্যের দিকে। কাব্য এবার স্বীকার করে, বুকের বা-পাশে ইঙ্গিত করে বলল———‘কিন্তু আমার লাগে কুহু, ঘেন্না লাগে। বুকটা জেলাসিতে পুড়ে ভীষণ।’
কাব্য চূড়ান্ত অসহায়ের ন্যায বুকের বা পাশ আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হঠাৎ ভাঙা স্বরে বলে ফেলল———‘মাই ফাকিং হার্ট কুহু; ওইটা আমার কন্ট্রোল নেই আর।’
কাব্য পা থামালো, আঙুল দিয়ে বুকের বা পাশ খুঁচিয়ে এবার বিধ্বস্তের ন্যায় বলে উঠল———‘ইটস… ইটস বিটিং ফর ইউ ইয়ার!’
কুহুর চোখ হঠাৎ জলে ভরে গেল। ও নাক টানল;স্রেফ তাকিয়ে দেখলো কাব্যকে, কাব্যের অস্থিরতাকে, ওর এক্সপ্রেশনগুলোকে।

কাব্য একটু থেমে, চোখ ছোট ছোট করে কুহুর দিকে চেয়ে নরম, ব্যথাতুর গলায় বলল———‘আই’ম হেল্পলেস কুহু; আই ডোন্ট নো হোয়াট টু ডু উইথ দিস টাইপ অফ ফিলিংস: হাউ টু ডিল উইথ ইট! আই রিয়েলি ডোন্ট নো, ইয়ার। তুই জানিস কিভাবে ডিল করে এই ফিলিংসগুলো? শেখাবি আমায়?’
কুহু কান্না আটকে রেখেছে বহু কষ্টে: সেভাবেই ঢোক গিললো একটা। কাব্য কুহুর দিকে এক পা, দু পা করে এগোয়; কুহু এই কেন যেন আর পেছায় না। শুধু অপলক, টলমলে চেয়ে থাকলো কাব্যের দিকে—- চুড়ান্ত আশ্লেষে শুনে চলে কাব্যের মুখে ভালোবাসার কথাগুলো।
কাব্য এগিয়ে এসে কুহুর হাতটা চেপে ধরে নিজের সাথে মিশাল। কুহু আজ আর ছটফট করলো না একফোটাও; কেমন যন্ত্রের মতো মিশে গেল কাব্যের গায়ের সাথে। দেহের সাথে দেহের সংঘর্ষে আজ আর হইচই করলো না কাব্যের জেদী কুহু, স্রেফ অপলক কাব্যের ওই দুই-চোখের দিকে চেয়েই রইলো, আজ যেন চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে কুহু।

কাব্য নাকটা টানল আবার, ওর অ্যাডামস অ্যাপেল উঠছে-নামছে ঢোকের তালে-তালে।
কাব্য কুহুর চোখে চোখ রেখে স্বীকারোক্তি চাইলো এইবার ———‘আবার… আরও একবার তুই প্লিজ আমার প্রেমে পড় কুহু, ট্রাস্ট মি— আমি এবার তোকে একটা পুতুলের থেকেও বেশি যত্নে রাখব; তুই আবার আমার জীবনে ফুল হয়ে যা কুহু। আমি— আজ আমি শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য সেদিনের রিজেকশনের বলা প্রতিটা কথা ফিরিয়ে নিলাম।’
কাব্য আলগোছে কুহুর এলোমেলো চুল কানের পেছনে গুঁজে দিল; কুহুর শরীর ভয়াবহরকম শিউরে উঠলো ওই এক স্পর্শ যেন। কাব্য কুহুর কানের পেছনে চুল গুঁজতে গুঁজতে হালকা হেসে বলে গেল———‘তোর ফিলিংস, ওটা অবসেশন যদি হয়. . আমি কাব্য সেই অবসেশনেরই প্রেমে পড়েছি। তুই যদি আমাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে থাকিস. . আমি কাব্য ওই টিনএজ মেয়েটার ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে আজ মরে যাচ্ছি। তোর লাইফে আমিই থাকব; আর কোনো ছেলে না। আমি কাব্যই হব তোর ভবিতব্য, তোর লাভার, তোর হাজব্যান্ড— সবকিছু আমি, আমি শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্যই হব।’

এই এক সামান্য কথাতে এতক্ষণ পর, কুহুর চোখ থেকে এইবার হঠাৎ এক ফোঁটা জল আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ল। কাব্য আজ বুঝে— ওই এক ফোঁটা জল আজ গড়িয়ে পড়ার ছিল, কুহুর কাছে এই এক ফোঁটা জল ওর হাজার জনমের অভিযোগ বলে যাচ্ছে কাব্যকে। কাব্যের প্রতি সকল অভিযোগ-অভিমান-রাগ-জেদ সবকিছুর বহিপ্রকাশ ওই এক ফোঁটা অশ্রু। কুহু মুখে কিছু বলেনি আজ, অথচ এই এক ফোঁটা জল কাব্যকে বুঝিয়ে দিয়েছে সবটাই, সবকিছুই।
কাব্য বুক ভরে শ্বাস টানলো, কুহুর চোখের জলটা ভীষণ যত্ন নিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে নরম কণ্ঠে আকুতি নিয়ে শোধাল——-‘আমি শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য আজ এখন; এই মুহূর্ত থেকে সারেন্ডার করলাম কুহু। আমি কাব্য আমার আদুরে কুহুর প্রেমে পড়লাম। এবার কি হবে কুহু? হু? ভালোবাসা তো শেষমেশ হয়েই গেল।’

বলেই কাব্য ঠোঁট টেনে সন্তুষ্টি নিয়ে হালকা হাসলো। এবার কুহুকে ছেড়ে ওর দু হাত ধরে নিজের হাতের উপরে আলতো করে রাখলো। হাতের দিকে একবার চেয়ে হঠাৎ দু হাতে বড্ড আশ্লেষ নিয়ে একটা চুমুও খেলো, তারপর আবার মাথা তুলে কুহুর চোখের দিকে তাকাল।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৯

কুহুর চোখে চোখ রেখে ভীষণ সন্তুষ্টি নিয়ে, নরম কণ্ঠে বলল———‘আই লাভ ইউ কুহু। আই জেনুইনলি লাভ ইউ। প্লিজ ফিরিয়ে দিস না আমায়, প্রমিজ আজ তুই আমাকে একসেপ্ট করলে ট্যুর থেকে ফিরেই আমরা বিয়ে করে নেব। ব্যাস— আমি আর কখনো তোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার চান্স থাকবে না।’
কুহু শুনলো স্রেফ। কাব্য ভীষণ আগ্রহ নিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে— কুহুর জবাব শোনার জন্যে।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here