তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২০
ফারহানা নিঝুম
রাতের নীরবতায় গাড়িটি শহরের দিকে এগিয়ে চলেছে। চারপাশে আধো অন্ধকার, রাস্তার বাতিগুলো হলুদ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে কিছু বাতি জ্বলছে-নিভছে। রাস্তার ধারে পুরনো ভবনগুলোর ছায়া দীর্ঘ হয়ে পড়েছে, যেন রাতের আঁধারে তারা ফিসফিস করে কিছু বলছে।
ফাঁকা রাস্তার পাশে ছোটখাটো দোকানগুলো অর্ধেক ঝাঁ’প নামিয়ে রেখেছে, কিছু দোকানের সামনে আলো জ্ব’লছে, হয়তো শেষ মুহূর্তের কোনো ক্রেতার অপেক্ষায়। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে ফুটপাতে শুয়ে থাকা কিছু মানুষ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে, তাদের পাশেই একটা পথকুকুর নিশ্চিন্তে গোল হয়ে শুয়ে আছে। দুতিনটে কুকুর হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে আশেপাশে।
দূরে খোলা চায়ের দোকানে এফএম রেডিওর গান ভেসে আসছে গাড়ির জানালা দিয়ে, মৃদু হাওয়ায় শহরের ঘ্রাণ মিশে আছে পেট্রোল, ধোঁয়া, আর রাতজাগা শহরের একান্ত গোপনীয়তা। মাঝে মাঝে বিপরীত দিক থেকে আসা এক-দুইটা হেডলাইট জ্বলা গাড়ি দ্রুত চলে যাচ্ছে, আবার সব শান্ত হয়ে যাচ্ছে।ভরসার একটি কাঁধ,হাতে হাত মিলিয়ে চুপচাপ বসে আছে ফারাহ। উঁহু বসে আছে বললে ভুল হবে ঘুমিয়ে গেছে ফারাহ।
মেয়েটা কেঁদেছে,বিদায় বেলা নিজের আপনজনদের জড়িয়ে ধরে প্রচুর কেঁদেছে।স্নেহা কে ছেড়ে আসতে চায় না ফারাহ।স্নেহাও ছাড়তে চাইনি একদম। তবে মেয়েদের কে তো একদিন না একদিন পরের ঘরে যেতেই হবে,এটাই যে দুনিয়ার নিয়ম।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দু’টো গাড়ি নেওয়া হয়েছে। প্রথম গাড়িতে নূপুর ঝুমুর তাশফিন এবং ফারাহ।তাশফিন চাইছিল নূপুর থাকুক ফারাহর সঙ্গে। মেয়েটার সাপো’র্ট প্রয়োজন।অথচ মেয়েটা তার হাত ছাড়েনি এক মূহুর্তের জন্য।
তন্দ্রা কে টে গেল আকস্মিক, রাস্তার ধারে লাগানোর সারি সারি ল্যাম্পপোস্টের আলো মুখ পড়ছে তার।চোখ কুঁচকে আলতো ভাবে তাকানোর চেষ্টা করে।খামচে ধরে তাশফিনের শেরোয়ানির হাতাটা।আদল পানে চাইলো তাশফিন, বুঝতে চেষ্টা করলো ফারাহর অভিব্যক্তি।নাক মুখ কুঁচকে নিচ্ছে সে।
“কী প্রবলেম বলো সুখ?কী হয়েছে?”
বারংবার মুখ চেপে ধরছে ফারাহ,গাড়ি থামানোর ইশারা করে।তাশফিন তৎপর হয়ে গাড়ি থামাতে বলল।
“স্টপ দ্যা কার।”
গাড়ি থামাতে হলো,তাশফিন তটস্থ ভঙ্গিতে ফারাহ কে নিয়ে নিচে নেমে এলো। মেয়েটা অদূরে গিয়েই গড়গড় করে বমি করে দিল।তাশফিন নাক ছিটকালো না, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পানির বোতল নিল নূপুরের হাত থেকে।ফের এগিয়ে এসে মুখে পানির ঝাপটা দেয় ফারাহর। ভালো করে কুলি করে নেয় ফারাহ।এত লম্বা জার্নি সে আগে করেনি, শরীর যে সায় দেয় না তার। হঠাৎ করেই অনুভব করলো শরীরের তীব্র উষ্ণতা। বুঝতে বাকি নেই তার জ্বর এসেছে। জ্বরদগ্ধ শরীর টা সায় দিল না একটু খানি হাঁটার। হাড়ের গিঁটে গিঁটে ব্যথা অনুভব করছে। শরীর টা ভীষণ দূর্বল ।
রাতের প্রথম প্রহর।আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে ডুপ্লেক্স বাড়িটা।গেটের কাছের লাইট গুলো জ্বলছে। বাড়ির নতুন বৌ অসুস্থ। আত্মীয় স্বজনদের মুখে মুখে অনেক কথা। হঠাৎ করে মেয়েটা অসুস্থ হলো কেন? অনেকেই নতুন বউ কে দেখে যেতে পারলেন না।যতটা দেখেছেন তাতে কারোই মন ভরেনি। খাওয়ার পর্ব শেষ করে বাড়ির পথে রওনা দেন অতিথিরা।আপাতত তাশফিন শেখ চায় না তার অসুস্থ বউ কে কেউ বিরক্ত করুন।
নিকষ কালো আঁধারে ডাকা পড়েছে পৃথিবী। পাল্লা দিয়ে ঘড়ির কাঁ’টা এগিয়ে চলেছে।ঘরটা নিস্তব্ধ, নিস্পন্দ। চারদিকে নিকষ কালো আঁধার, জানালার বাইরে ঝুলে থাকা পুরোনো পর্দাটা বাতাসের ঝাপটায় একটু নড়ে ওঠে, কিন্তু আলো ঢোকার উপায় নেই।
ঘরের কোণে রাখা ছোট্ট বিছানায় শুয়ে আছে এক অসুস্থ ফারাহ। নিস্তেজ শরীরটা ভারী লাগছে, যেন কোনো শক্তিই অবশিষ্ট নেই। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, কপালজুড়ে ছোট ছোট ঘামবিন্দু জমেছে। একা। নিঃসঙ্গ। চারপাশের নীরবতা তাকে আরও গুমোট করে তুলছে।হঠাৎ দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে হয়তো বাতাসের ধাক্কায় জানালার কাচ কেঁপে উঠেছে, নাকি অন্য কিছু? মেয়েটা সামান্য নড়ে ওঠে, দুর্বল হাতে কিছু খুঁজতে চায়, কিন্তু শক্তি নেই। ধীরে ধীরে চোখ দুটো ক্লান্তিতে বুঁজে আসে, যেন এই গভীর আঁধারে মিশে যেতে চায়।থাইগ্লাসটা কেমন ঝাপসা ঠেকছে তার নিকটে।খট করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো এক অবয়ব। ফারাহ কি তাকে চিনে?জানা নেই তার। লোকটা ডার্ক চকলেটরঙা আলমারি হতে নিজ টাওয়েল এবং যাবতীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশ রুমে গেল, ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো।রুম অন্ধকারে ডু’বে আছে, নিছক আলো জ্বালানোর প্রয়োজন বোধ করেনি তাশফিন। এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। তুলতুলে নরম শরীর টা নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে,আধো আধো চোখে দেখার প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। হাতে হাত স্পর্শ করে উষ্ণতা অনুভব করার চেষ্টা করে তাশফিন। বন্ধ ঘরের মধ্যে আজ প্রথম তারা দু’জন। কাঙ্ক্ষিত রমণী কে পেয়ে ভেতরে ভেতরে প্রবল উত্তেজ’নায় কাঁপছে তাশফিন।ধীর গতিতে পাতলা কাঁথা টেনে ঢেকে দিল ফারাহ কে।ঘুম প্রয়োজন মেয়েটির। নূপুর নিজ দায়িত্বে ওষুধ খাইয়ে গেছে তাকে। আকস্মিক খুক খুক করে কেশে উঠলো সে। বুকে ব্যথা হচ্ছে তার,শীত করছে প্রবল ভাবে। ডান দিকে ঘুরে টেনে ধরে তাশফিন কে। ক্ষণিকের জন্য থমকায় তাশফিন। হৃদয় স্পন্দন প্রবল বেগে ছুটে চলেছে।পুরুষ্টু পিঠে মেয়েলি মোলায়েম স্পর্শ কেঁপে উঠলো তাশফিনের বক্ষঃস্থল।
“ফারাহ?”
“হুঁ।”
ঘো’রের মধ্যে জবাব দেয় ফারাহ। বুকের সাথে লেপ্টে আছে ফারাহ নামক যুবতী।গাল,নাট ঠেকেছে বুক বরাবর।ক্ষণে ক্ষণে নিঃশ্বাসের ঘনত্ব বাড়ছে।কাঠপুতুলের ন্যায় চুপচাপ বসে আছে তাশফিন।তার শক্তপোক্ত প্রাণের সহিত মিশে রয়েছে আরো একটি পবিত্র প্রাণ।যে কিনা তার বউ।অতি আদরের বউ। আলগোছে ছুঁয়ে দিল তার কপোল, চুম্বন এঁকে দিল ললাটে।
“অ্যাম স্যরি সুখ। আমি তোমার জ্বর বাঁ’ধিয়ে দিলাম।”
ফারাহ শুনলো কিনা তা জানা নেই, তবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাশফিন কে।
সকালটা যেন স্নিগ্ধতার এক অপূর্ব প্রদর্শনী। বাতাসে একধরনের মিষ্টি ঠান্ডা, যেন রাতের শিশির এখনো লতাপাতায় আলতোভাবে লেগে আছে। আকাশটা হালকা নীল, কোথাও কোথাও তুলোর মতো সাদা মেঘ ভাসছে।
সূর্যের আলো ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, এক সোনালি আভা সবকিছুকে ঘিরে ধরেছে। গাছের পাতায় আলোর ঝিলিক, যেন হাজার ছোট ছোট হীরার টুকরো খেলা করছে। পাখিরা একে একে ডানা মেলে দিয়েছে, তাদের কাকলি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
হালকা শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে, আর তার সাথে রোদের উষ্ণতা এক অদ্ভুত সমন্বয় তৈরি করছে। বাগানের ঘাসে এখনো শিশিরের কণা, রোদ তার ওপর পড়তেই সেগুলো মুক্তোর মতো ঝলমল করে উঠছে।
এমন এক সকাল যেন মনকে প্রশান্ত করে দেয়, সব ক্লান্তি ভুলিয়ে নতুন আশার আলো ছড়িয়ে দেয় হৃদয়ের কোণে কোণে। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠলো ফারাহ। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিজের পরিচিতি কামড়া দেখতে না পেয়ে ঘাবড়ে গেল সে? ভালো করে ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠতেই বুঝতে পারলো সে আপাতত শেখ মঞ্জিলে রয়েছে।
পাশে অপ্রত্যাশিত পুরুষ কে দেখে আরেক দফা চমকে উঠে। উদোম গায়ে পাতলা কাঁথা টেনে শুয়ে আছে। বিবস্ত্র যুবক। লজ্জায় কুঁকড়ে যায় ফারাহ,এই পুরুষ কে দেখা মাত্র চাঞ্চল্য ভাবটা নিমিষেই হারিয়ে যায় দূর অজানায়।
“সুখ বুকে এসো।বুক খালি খালি লাগছে।”
অকস্মাৎ এমনতর কথায় চমকে উঠে ফারাহ।তাশফিন অপেক্ষা করতে পারলো না,হাত টেনে প্রিয়তমা কে বুকে টেনে নেয়। কাঁথা টেনে দিল গলা পর্যন্ত। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে।
“পুরো রাত এভাবে ছিলে।”
লজ্জায় ওষ্ঠাদয় কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে এলো ফারাহর।
“ছিহ্ ছিহ্ লেফটেন্যান্ট সাহেব আপনি এরকম ভাবে খালি গায়ে একজন মেয়ে কে জড়িয়ে ধরেছেন!এই আপনার লজ্জা করে না?”
শব্দ বিহীন হাসলো তাশফিন,নাক ঘষে ফারাহর গলায়
শিরশিরানি করছে ফারাহর সর্বাঙ্গে।
“দেখি জ্বর কমেছে?”
হাত দিয়ে কপাল চেক করে তাশফিন,না জ্বরটা নেই।কাল রাত সে জেগেছে।মধ্য রাতে জ্বর বেড়েছে ফারাহর,বাড়ির কাউকে ডাকেনি তাশফিন। বিয়ের এই ঝামেলা, সবাই নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছে।তাশফিন নিজ দায়িত্বে নিজ বউয়ের দেখা শোনা করেছে। জলপট্টি দিয়েছে, অবশেষে ভোরের দিকে জ্বর ছেড়েছে তার।
উঠে বসলো তাশফিন, থাইগ্লাসটা ভেদ করে স্বচ্ছ আকাশের দিকে দৃষ্টি ফেলল।ভাবুক হলো সে, পরিবর্তন হলো মুখের ভাবভঙ্গি।ফারাহ উঠলো তৎক্ষণাৎ,গায়ে কালকের জড়ানো লেহেঙ্গা টা আছে।তাশফিন কি তার গয়না খুলে দিয়েছে?রুমে চোখ বুলিয়ে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা সব গুলো গয়না।
“আলমারিতে শাড়ি আছে, ফ্রেশ হয়ে এসো জরুরি কথা আছে।”
কন্ঠস্বর গম্ভীর। ফারাহ আশ্চর্যের ন্যায় তাকালো তাশফিনের পানে! ফারাহ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো আলমারি থেকে মেরুর রঙের শাড়ি আর হাতা লম্বা ব্লাউজ টা নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল।তাশফিন চটজলদি ল্যাপটপ নিয়ে বসলো,নাইমের ইমেইল গুলো চেইক করতে হবে। অনেক গুলো ইমেইল এসেছে তার,একে একে সব গুলো চেক করলো সে। চেহারায় ফুটে উঠেছে স্পষ্ট গাম্ভীর্য ভাবটা। সূক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলল আশেপাশে,খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা ভাবলো সে।
খক শব্দ করে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এলো ফারাহ।সটান ল্যাপটপের শাটার বন্ধ করে উঠে দাড়ালো তাশফিন।
“শুনো আজকেই ফার্স্ট, আজকেই লাস্ট। এরপর আর আমি এক কথা রিপিট করব না।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৯
প্রথমত তুমি আমার ওয়াইফ,ওয়াইফ মানে অবশ্যই বুঝো! এখন থেকে আমার সব দায়িত্ব তোমার উপর বর্তায় । আমি কিন্তু এক চুল পরিমান ছাড় দেওয়ার মানুষ নই । আমার সব দায়িত্ব এখন থেকে তোমার। আমার ছোট থেকে ছোট কাজ এখন থেকে তোমাকে দেখতে হবে। এবং কি আমি এক গ্লাস পানিও ঠেলে খেতে পারব না, কারণ তুমি আছো। আমার ড্রেসিং থেকে শুরু করে আমাকে গোছানোর দায়িত্ব টা আজকে থেকে তোমাকে দিলাম।এখন তুমি ছোট বলে যে ছাড় পাবে তেমনটা নয়। তোমাকে শিখতে হবে,দিন শেষে আমি তোমার মাঝে আমার সুখ খুঁজব,আর সেই আমার প্রাপ্য সুখটুকু দিতেই হবে। আমি যখন ডাকবো ঠিক তখনই আসতে হবে,একটুও লেইট করতে পারবে না। আমার কথায় সারমর্ম একটাই, সম্পুর্ণ আমাকে সামলাতে হবে তোমাকে।ডিড ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?”