তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৪

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৪
ফারহানা নিঝুম

রাত গভীর। সড়ক ফাঁকা, শুধু স্ট্রিটলাইটের ক্ষীণ আলো পড়ে আছে কালো পিচের উপর। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে, আশেপাশে নিস্তব্ধতা।রাতের নীরবতা চিত্তে এক পশলা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। শহরের এক ফাঁকা রাস্তা।
“কি ব্যাপার জানু চুপ কেন?”
স্নেহার প্রশ্নে মনটা ভারী হয়ে এলো ফারাহর! ইস্ কি করবে এখন? লেফটেন্যান্ট সাহেব যে তার সাথে কথাই বলছে না! মনটা আইঢাঁই করছে।কি ভাবে কথা বলা যায়?

“বান্ধবী রেএএ তোর দুলাভাই আমার সাথে কথা বলছে না।’
ফারাহর উদাস কন্ঠে বলা কথা গুলো শুনে হেসে কুটিকুটি অবস্থা স্নেহার।
“বেশ হয়েছে।আরো এসো রাগ দেখিয়ে।”
রাগে গজগজ করে উঠল ফারাহ।
“চুপ কর শয়’তান একটা।”
“তুই শ’য়তা’ন।”
“তাহলে তুই ডা’ইনি।”
ফারাহ কম নয় ভেবে চিন্তে একটা নাম বের করলো সে।
“তাহলে তুই হা’তি।”
“তুই ঘোড়া।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একে অপরের সাথে তর্ক করছে ফারাহ আর স্নেহা। আরিয়ান এসেছে অনেকক্ষণ হলো। ওদের ঝগড়া দেখে থেমে গেল সে।এক জন আ’গুন তো অন্য জন আগু’নের ফুলকি।
“আরে ব্যস কখন থেকে ঝগড়া করছো দু’জনে? উফ্ এই হাতি ঘোড়া কি এসব?”
তৎক্ষণাৎ থেমে গেল ফারাহ এবং স্নেহা দু’জনেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। কিছু একটা ভেবে ফিক করে হেসে উঠলো দুজন। আরিয়ান এসে চেয়ার টেনে বসলো, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এবার বলো বিষয়টা কি?কি নিয়ে এত মাতামাতি?”
স্নেহা ফারাহ কে উদ্দেশ্য করে বলল।

“এই ঢঙী ভাইয়া কে রাগিয়ে দিয়েছে।”
বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো আরিয়ান।
“কি?তাশফিন রাগ করেছে?”
ফারাহ অপরাধী কন্ঠে বলল।
“আসলে আমি রাগ দেখিয়ে চলে এসেছি।তাই উনি রাগ করেছে।”
আহাম্মক বনে গেল আরিয়ান।
“এক মিনিট এক মিনিট। তুমি রাগ দেখিয়ে চলে এসেছো। কিন্তু তাহলে তাশফিন কেন রাগ করবে?আর রাগ করলেও আবার এসেছে কেন?”

“হ্যা উনিও এসেছে কিন্তু কেন সেটা জানি না।”
“বুঝলাম এবার সবটা।”
আরিয়ান কিয়ৎ সময় ভেবে বলল,
“তাহলে তুমি গিয়ে বরং রাগ ভাঙ্গাও।”
অধর প্রশস্ত হয়ে এলো ফারাহর।চট উঠে দৌড়ে উপরে যেতে লাগল সে।

রান্না ঘরে কাজ করতে ব্যস্ত আরিফা আহমেদ। হেল্প করছেন শায়লা আহমেদ। তিনি রান্না শেষ করেছেন অনেক আগেই।আরিফা আহমেদ তাশফিনের জন্য নিজের হাতে হালুয়া বানাচ্ছেন।তবে কিছুটা রাগ আছে তার উপর। ফারাহর বলা কথা গুলো ফেলতে পারছেন না তিনি। কিন্তু তাশফিন কে দেখা কখনো বোঝা যায় না সে এমন কিছু করতে পারে! চামচ নাড়াতে নাড়াতে ভাবনায় মগ্ন আরিফা আহমেদ। ফারাহ ভালো থাকুন তিনি সেটাই চান।
“আম্মু!”

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ঈষৎ চমকালেন আরিফা আহমেদ। পিছন ফিরে ঘুরে দেখলেন তাশফিন দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে আসার পর থেকেই তাশফিন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছে। আরিফা আহমেদ কথা বলছে না তার সাথে। বিষয়টি মোটেও পছন্দ হলো না উনার।
“আম্মু আপনার কি হয়েছে? আসার পর থেকে একটাও কথা বলেন নি।”
হালুয়া টুকু প্লেটে নিয়ে নিলেন আরিফা আহমেদ। ঘুরতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাশফিন কে।
“বলবেন কি হয়েছে?”

রাগে ক্ষো’ভে কড়া ভাবে বলেন আরিফা আহমেদ।
“কি হবে?কি হওয়ার বাকি আছে? আমি তোমার থেকে এসব মোটেও আশা করিনি তাশফিন। তুমি কিনা শেষমেষ আমার মেয়েটার সাথে এমন করলে।”
বড়সড় ধাক্কা খেলো তাশফিন,সে করলো টা কি?
“আমি কি করলাম আম্মু?”
রাগ টা থরথর করে বাড়ছে আরিফা আহমেদের।
“তুমিই জানো তুমি ঠিক কি করেছো!”
হালুয়ার প্লেট টা তাশফিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রান্না ঘর থেকে প্রস্থান করলেন তিনি।কিয়ৎ সময় থম মে রে দাঁড়িয়ে রইল তাশফিন, হালুয়ার প্লেট দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল।যাই হোক তার শ্বাশুড়ি কিন্তু বিন্দাস একজন মানুষ। কতটা স্নেহ করে তাকে। ইশ্ এই ফুরফুরে মেজাজের মহিলা টা কে তার দুষ্টু বউ কী না কি বুঝিয়েছে আল্লাহ মালুম।

বড়সড় এক নির্জন গোডাউনে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে সাইফুল। চারপাশটা নিস্তব্ধ, যেন নিঃশব্দে ওঁত পেতে আছে মৃত্যুর ছায়া। কনকনে ঠান্ডা বাতাস আর আধো অন্ধকার মিলেমিশে এক অদ্ভুত গুমোট পরিবেশ তৈরি করেছে। বাতাসে ধুলো আর পুরনো লৌহের গন্ধ সব মিলিয়ে যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
তার হৃদস্পন্দন যেন নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছে সে। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে, প্রতিটা নিঃশ্বাসে আতঙ্ক ঢুকে পড়ছে আরও গভীরে। তাশফিন।সেই ভয়ংকর নামটা এখন তার প্রাণনাশের মতোই পেছনে লেগে আছে। সে জানে, ধরা পড়লেই শেষ। তাশফিন ক্ষমা করে না। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় ম’রিয়া সাইফুল এখন শুধুই বাঁচতে চায়। জীবনটা হঠাৎ করেই এত দামি মনে হচ্ছে তার কাছে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসে র’ক্ত, বন্দুকের আওয়াজ আর তাশফিনের সেই ঠান্ডা, নি’র্মম চাহনি। আ’তঙ্ক তার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে, আর সে গোডাউনের এক কোণায় নিঃশব্দে কুঁ’কড়ে আছে কেবল একটু জীবনের আশায়।কপাল বেয়ে টুপটাপ করে ঘাম ঝরছে সাইফুলের। ঠান্ডা বাতাসেও শরীর ঘেমে একাকার আতঙ্কের ঘাম, অনিশ্চয়তার ঘাম। একহাতে কপাল মুছে অন্য হাতে বুক চেপে ধরে সে বসে আছে, যেন হৃদয়টা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার আগেই থামিয়ে দিতে চায়।

মস্তিষ্কে হাজারটা চিন্তা একসাথে কিলবিল করছে কী করা যায়? পালাবে? না কি এখানেই থাকবে আরও কিছুক্ষণ? দরজার বাইরে যদি কেউ পাহারা দেয়? যদি তাশফিন এখনই হানা দেয়? ভাবনার ভারে মাথা যেন ভারী হয়ে আসছে তার।সে জানে, ভুল একটিই হতে পারে তার শেষ ভুল।তবুও তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই, এই মুহূর্তে।কারণ সময় আর তাশফিন, দুজনেই থেমে থাকে না। সে যে রাফজাল কে ধরে ফেলেছে। সেই রাফজাল যাকে ভাড়া করে কৃষ্ণপুরে তাশফিন কে মে রে ফেলতে চেয়েছিল সাইফুল। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো কই? ফারাহ যে তাকে বাঁচিয়ে ফেলেছে!

“কি চাই?”
পুরুষালী কণ্ঠস্বরটা কানের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিল। কেমন একটা রুক্ষতা, অভিমানের ঠাণ্ডা ধার যেন মিশে আছে তাতে। মুহূর্তেই শরীর জমে গেল ফারাহর। গলা শুকিয়ে এল, নিঃশ্বাসটা আটকে গেল বুকের কোথাও। ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাল সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তাশফিন।চোখে আগুন নেই, তবুও জ্বলছে। মুখে রাগ নেই, তবুও তার ঠান্ডা দৃষ্টিতে যেন চিৎকার লুকিয়ে আছে। তাশফিন তার রুমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কি? ওর চোখে-চেহারায় এক চিলতে নরমভাবও নেই।ফারাহ চুপ। বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না সে। একসময় যে মানুষটা একটু দূরে থাকলেই ব্যাকুল হয়ে পড়ত, আজ সেই মানুষটাই এক ছাদের নিচে থেকেও দূরের কেউ হয়ে গেছে। তাশফিন আলাদা ঘরে থাকছে। নিজের স্ত্রী, নিজের সংসার তবুও সে যেন এই বাড়িতে একজন আগ’ন্তুক, শুধু প্রয়োজন পড়লেই উপস্থিত হয়। অভিমান, রাগ, ব্যথা সব মিলিয়ে একটা ভারী অদৃশ্য দেয়াল দাঁড় করিয়ে ফেলেছে সে ফারাহর চারপাশে।ফারাহ জানে, এই দেয়াল ভাঙা সহজ হবে না। তবুও, তার চোখে এখনও একটা আশা খুব নিঃশব্দ, খুব ছোট্ট একটা আশার আলো।

“ওই আসলে আমি এমনি।
বড় বড় পা ফেলে ভেতরে চলে এলো তাশফিন।সেই পা অনুযায়ী পিছুতে লাগল ফারাহ।পিছুতে পিছুতে এক সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে তার। আমতা আমতা করে বলল,
“স…স.
“স স কি হুঁ?”
“সরি। আমি শুধু দেখতে এসেছিলাম।”
ভ্রু কুঁচকে নিল তাশফিন।
“আমি কি কোনো শো পিস? আমাকে দেখার কি আছে?”
“আসলে আমি..
“বলো কি কি দেখবে? কিভাবে দেখবে? এখুনি দেখাবো!”
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় ফারাহ।ছিহ লোকটা কি সব বলে?

“আমি ওভাবে কিছু বলিনি।”
“বের হও।”
“হুঁ?”
“বলছি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে।”
লজ্জায় অপমানে কেঁপে উঠলো রমণী। আঁখি বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কণা।
“যাও যাও নিজের মতো করে থাকো । তোমাকে আমি ভুলে গেছি।”
রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ফারাহ। অস’ভ্য লেফটেন্যান্ট সাহেব।
“আমি কখনো আসবো না আপনার কাছে দেখে নিবেন।”
“ওকে।”

ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিল তাশফিন। বুকের ভেতর হো হো করে উঠলো ফারাহর।এত নিষ্ঠুর? এত নিষ্ঠুর হতেই হবে?কেন এমন করে?লোকটা সবসময় তাকে কষ্ট দেয়।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৩

দরজা লাগিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে তাশফিন। মেজাজ টা খারাপ তার, চলে যেতে বলেছে বলেই কি যেতে হবে? একটু জোর দেখিয়ে তো থাকতে পারতো। সে ফিরেছে আজ দু’দিন হলো অথচ একটি দিন ঠিক মতো বুকে নিয়ে ঘুমোতে পারেনি। নিষ্ঠুর রমণী সে। ভালোবাসা কি বুঝেও না। বাচ্চা বউ রাখা বড্ড কঠিন।ঠিক মতো ভালোবাসা টুকু দিতে চায় না। হাজার টা ভাবনা ভেবে কখন যে তাশফিন ঘুমের সাগরে ডুবে গেছে তার খেয়াল নেই।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৫