তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৫
ফারহানা নিঝুম
রাত ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে নিজের গভীরতায়।
নীরবতার চাদরে ঢাকা পৃথিবী যেন থেমে আছে।
আকাশের বুকে এক টুকরো রূপালি থালা চাঁদটা ঠিক যেন বিষণ্ন প্রেমিকার মতো নিঃশব্দে আলো ঢালছে নিচে।
তার শুভ্রতা ছুঁয়ে যাচ্ছে ছাদ, জানালার কাচ, আর গাছপালার পাতায় পাতায়। এক অপার্থিব শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
আহমেদ বাড়ির প্রতিটি কোণ এখন নিস্তব্ধ।
সব ঘর অন্ধকারে ডুবে শুধু দূর থেকে ভেসে আসা কোনো পাখির ডাকে বোঝা যায়, সময় এখন মধ্যরাতের কাছাকাছি।বাড়ির মানুষজন ঘুমে বিভোর। ঘুমে অচেতন ফারাহ।তবে তড়াক করে তার মস্তিষ্ক জেগে উঠেছে। ঘুমের ঘোরেই কেউ যেনো তাকে আলগোছে কোলে তুলে নিয়েছে তা অনুভব করতে পারছে সে।চোখ দুটো মেলে রাখতে পারছে না কোনো মতেই! ঝাপসা দৃষ্টি! মুখটা পরিষ্কার হচ্ছে না আগু’ন্তকের!
“কে?ছ.. ছাড়ুন আমায়!”
আগুন্তক কি শুনলো? উঁহু শুনেনি। নিয়ে চললো ফারাহ কে। ফারাহ কখন যে আবারো অচৈতন্য হয়ে যায় তার খবর নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে আটকে গেল ফারাহ।আবছা আলো এসে মুখে উপছে পড়ছে তার।চোখ দুটো খিঁচিয়ে বুঁজে নিল সে! জানালার কাছে পর্দাটা অল্প সরে যাওয়াতে আলো এসে পড়েছে মুখে।ধীরে ধীরে চোখ দুটো খুলে দেখার চেষ্টা করছে ফারাহ।সে যে কারো বুকে লেপ্টে আছে তা বুঝতে আর বাকি নেই তার। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো সে, ওড়না টা অবহেলা পড়ে আছে ফ্লোরে! নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে ফারাহর। বিবস্ত্র যুবক কে দেখে হৃদপিন্ড প্রবল বেগে ধুকপুক করছে তার।
যষ্ট ইন্দ্রিয় বার বার বলছে সে এখানে এলো কি করে?কাল রাতের ঝাঁপসা দৃশ্য মনে পড়তেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল তার।তবে কি তাশফিন তাকে নিয়ে এসেছে?
“এই লেফটেন্যান্ট সাহেব ছাড়ুন আমায়!সরুন বলছি।”
তাশফিন ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
“নড়ে না সুখ একটু ঘুমাই।”
বুকের ভেতর ধক করে উঠল ফারাহর।ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বর বুঝি এত সুন্দর। লজ্জায় মুচকি হাসলো ফারাহ,তবে তা তাশফিনের অগোচরে।
“সরে ঘুমান! আমাকে ছাড়ুন! সরুন নির্লজ্জ কমান্ডার।”
নির্লজ্জ শুনে পিটপিট চোখ করে তাকালো তাশফিন, বোঝার চেষ্টা করছে কি বলল তাকে?তাশফিনের প্রশস্ত চাহনিতে ঘাবড়ে গেল ফারাহ,শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“সরুন শুনতে পাচ্ছেন না?”
কাঁথা সরিয়ে উঠে বসলো তাশফিন। এলোমেলো চুল গুলো হাতের সাহায্যে আরো খানিকটা এলোমেলো করে ঘুম কা’টানোর চেষ্টা করছে সে।
ফারাহ ওড়না খুঁজে চলেছে ফ্লোরে পরে থাকা ওড়না দেখে বিছানা থেকে নামতে নিলে হেঁচকা টানে নিজের বুকে এনে ফেলল তাশফিন।
হকচকিয়ে গেল ফারাহ,চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আসে।
“ক..কি করছেন?”
“করিনি তবে করব,আদর।”
কন্ঠনালি রুদ্ধ হয়ে এসেছে ফারাহর, এত নিকটে এসে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। কিন্তু অভিমানী মন অভিমান গুলো ভুলেনি।কাল রাতে তাশফিন কেমন করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে!মনের দুঃখে ব্যথিত কন্ঠে বলে উঠে সে।
“আমাকে ধরবেন না আপনি। আমাকে কেন নিয়ে এসেছেন এই ঘরে? কাল রাতে না বের করে দিয়েছিলেন মনে নেই?এখন কেনো নিয়ে এসেছেন কোলে করে?”
ফিচলে হাসে তাশফিন,ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধোয়।
“তার মানে তুমি দেখেছিলে আমি তোমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছি।”
বেকুব বনে গেল ফারাহ,চোরা চোখে তাকায় তাশফিনের দিকে। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাশফিন।গলা খাঁকারি দিয়ে বলল।
“ঝাঁপসা ঝাঁপসা দেখেছিলাম।”
“তাহলে বাঁধা দিলে না কেন?”
পাল্টা প্রশ্নে ফের বেকায়দায় পড়ে গেল ফারাহ! উফ্ এই লোকটা এত জিজ্ঞাসাবাদ করছে কেন?
“তুমি আমার কোলে উঠতে চাও এটা আগে বললেই তো হতো জান।”
চোখ টিপে তাশফিন, বড়সড় ঢোক গিললো ফারাহ। উঠতে ছেয়ে ছটফট করে।
“ছাড়ুন আমাকে। ফাজিল লোক একটা।”
“না ছাড়লে?”
ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয় তাশফিন, রাগে ফুঁসছে ফারাহ।
“না ছাড়লে আমি কিন্তু?”
“চুমু খাও।”
“কী?”
“বললাম কড়া করে একটা চুমু খাও।গুড মর্নিং কিস বলে যাকে।”
তাশফিনের হঠাৎ পরিবর্তনে থমকে গেল ফারাহ।এই লোকটা তাকে কি সব বলছে? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তাশফিনের দিকে। নিম্না’ষ্টো কাম’ড়ে হাসলো সে, ফিসফিসিয়ে জড়ানো কন্ঠে বলে।
“কোলে বসে লিভ কিস করলে দারুণ কিছু ফিলিংস আসে ম্যাডাম। অনেক কিছুই করতে মন চায়।”
সব টুকু নিঃশ্বাস কন্ঠনালিতে আটকে এসেছে ফারাহর!এ কাকে দেখছে সে? এটা আসলেই তাশফিন তো?
“ক..কি বলেছেন এসব?”
“বুঝো নি? আচ্ছা ওয়েট আমি বুঝাচ্ছি।”
অকস্মাৎ ফারাহ কে টেনে কোলে বসিয়ে দিল তাশফিন।আটকে উঠে ফারাহ।দু দিকে দু পা ছড়িয়ে বসে আছে সে, মনিকোঠা হতে এই বুঝি মনি দু’টো বেরিয়ে আসবে তার। এক হাতে কোমর অন্য হাতে গাল টেনে ওষ্ঠোপুটে মিশিয়ে নিল তাশফিন। আশ্লেষে চুষে নিচ্ছে প্রেম সুধা। শ্বাস নিতে না পারায় ফারাহর মনে হচ্ছে এই বুঝি সে ম রে যাবে। মিনিটেথ মধ্যে ছেড়ে দিল তাশফিন, বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে বলল।
“নাউ ইউর টার্ন।”
ফারাহর বুকের ভেতরটা যেন এক তীব্র বিস্ফোরণে ছি’ন্নভিন্ন হয়ে গেল। হঠাৎ পাওয়া স্পর্শে, চুম্বনের আ’গুনে, সে সম্পূর্ণভাবে স্তম্ভিত। তাশফিনের চোখে সেই চেনা উন্মা’দনা, যা মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয় আবার টানে এক অদ্ভুত পিশা’চী আকর্ষণ।সে যেন কোনো প্রশ্রয় চায় না, অনুমতি তো নয়ই। তাশফিনের আঙুল এক অদ্ভুত মায়ায় ওর গলার রেখা বেয়ে নামছে, রোমকূপে হালকা কাঁপুনি তুলছে ধীরে ধীরে পোশাকের সীমা পেরোতে চাইছে, ঠিক যেন তার অধিকার আছে এতটা ঘনিষ্ঠতায়।
“তুমি তো এখনও বোঝোনি, ম্যাডাম,”
ফিসফিস করে বলে তাশফিন, ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু মুচকি হাসি।
“তোমার শরীরটা আমার ভাষা বুঝে ফেলেছে, শুধু মনটাই পিছিয়ে আছে সুখ।”
ফারাহর চোখ বিস্ফা’রিত। সে বুঝতে পারছে না পালাবে, না ঠেকাবে, না আত্মসমর্পণ করবে শরীর একরকম, মন আরেক। তার ঠোঁট ফাঁকা বাতাস খুঁজে ফিরছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু শব্দ নেই।
তাশফিন এবার কানের কাছে ঠোঁট এনে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“একটু এগোলে দেখা যাবে, ভালোবাসা কতটা বেপরোয়া হতে পারে।”
ফারাহ যেন নিজেকেই চিনতে পারছে না। বুকের ভিতর তীব্র কাঁপুনি, শরীর তার কথা শোনে না, শুধু মন ছটফট করছে পালাতে। হঠাৎই সে দু’হাত দিয়ে তাশফিনকে ঠেলতে চায়, কিন্তু তাশফিন থামবার নয়।
এক টানে তার কামিজের পেছনের চেন খুলে ফেলে তাশফিন ওটা ছিল কেবল একখণ্ড বাঁধন যা তার চোখে এখন অপ্রয়োজনীয়।
কানে কানে বলে তাশফিন, নিঃশ্বাসে আগুন মিশে।
“তোমার এই ভদ্রতা খুব সাজে না ফারাহ। আমার জন্য একটু খারাপ হও না সুখ।”
চোখ দুটো খিঁচিয়ে বুঁজে নিল ফারাহ।ফের শুনতে পেলো তাশফিনের নে’শাভরা কন্ঠস্বর
“ডু ইউ নো হোয়াট ড্রজ মি টু ইউ দ্য মোস্ট? ইয়োর লিপস। ইয়োর ইনোসেন্স। ইট মেইকস মি ওয়ান্ট টু ক্রাশ ইউ ইন্টু মাইসেলফ মেইক ইউ ক্রাই, ডিপলি, ডেসপারেটলি।”
চোখে যেন এক আ’গুনের লেশ জ্বলে ওঠে ফারাহর। লজ্জায়, অভিমানে সে হঠাৎই ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু ঠিক তখনই পিঠ গিয়ে ঠেকে তাশফিনের প্রশস্ত উষ্ণ বুকে। যেন দেয়াল।
দেয়ালের মতো শক্ত আর অদৃশ্য কারাগারের মতো বাঁধা।
তাশফিনের দুই হাত এবার কাঁধে পড়ে। কোমল নয় প্রবল। সে আরেকবার মুখ নামিয়ে বলে,
“নাউ আই ওয়ান্ট টু সি হাউ লং ইয়োর রেজিস্টেন্স লাস্টস, সুইটহার্ট।”
ফারাহর মুখ লাল, চোখ ছলছল করছে, কিন্তু ঠোঁট থরথর করে উঠে কেবল ফিসফিসিয়ে বলে।
“আপনি অসহ্য!”
তাশফিন হাসে, সেই পুরুষালি, বুনো হাসি।
“একজ্যাক্টলি, আই’ম রিয়ালি ব্যাড ফর ইউ।”
ফারাহ কে ছেড়ে দিল তাশফিন। অবাক নেত্রে ফিরে তাকালো ফারাহ।চোখ টিপে বাঁকা হাসে লোকটা।বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে ফারাহর। অপেক্ষা করলো না ছুট্টে পালিয়ে গেল রুম থেকে।সহসা হেসে ফেলল তাশফিন। বিড়বিড় করে বলল।
“এইটুকুতে এই অবস্থা জান। ইশ্ কি করব তোমার?”
ফুরফুরে সকাল। হালকা শীতল বাতাস, আকাশে মেঘের মুদ্রা, আর চারপাশে মুগ্ধকর নিস্তব্ধতা। স্নেহা আর আরিয়ান একসাথে হাঁটতে বেরিয়েছে। স্নেহা নিজের রীতিতে হাসছে, আরিয়ানের পাশে, কিন্তু তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাবনা কাজ করছে।
আরিয়ান সাধারণত খুবই সতর্ক, তবে আজ সে একেবারে আলাদা, স্নেহাকে তার পাশে পেয়ে একটু স্বস্তি পাচ্ছে। কপালের ওপর মৃদু ঘাম, কিন্তু সে খুশি সে শুধু স্নেহাকে জানাতে চাচ্ছে যে, তাকে আরো কাছে অনুভব করতে চায়। কৃষ্ণপুরের রাস্তা, যার প্রান্তে আধুনিক শহরের জাঁকজমক শেষ হয়ে যায়, সেখানে প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার।
“তুমি তো এখানকার আগে আসনি, তাই না?” স্নেহা জানতে চায়, একটু হাসি চাপা দিয়ে।
আরিয়ান স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“না, আসলে না। তোমার এলাকার সৌন্দর্য দেখতে পেয়ে একটু অবাক হয়েছি। মনে হচ্ছে সময়টা এখানকার নদীর মতো ধীরে চলে ।
স্নেহা বুঝতে পারে, আজকে সে আরিয়ানকে একটু বেশি কাছ থেকে অনুভব করছে, তবে অস্বাভাবিক কিছু নয়, সে যে তার স্বামী।তাদের সুন্দর একটি সম্পর্কের মিষ্টি ইঙ্গিত।
আরিয়ান হাঁটতে হাঁটতে স্নেহার দিকে এক ধরনের আগ্রহপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলে।
“তোমার এলাকা সত্যিই শান্ত। এখানে এমন কিছু আছে যা অনেক জায়গায় নেই। তোমরা এখানকার প্রকৃতির মধ্যে নিশ্চুপ রয়ে যাও, তাই না?”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৪
স্নেহা আইঢাঁই করে অকস্মাৎ আরিয়ানের হাত চেপে ধরে। কিঞ্চিৎ অবাক হলো আরিয়ান,ফিরে তাকালো ত্বরিতে। লজ্জায় নত হয়ে আসে মস্তক।
“ওই আমি হাত ধরে হাঁটতে চাই।”
নৈঃশব্দ্যে হাসলো আরিয়ান, দুদিকে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।ডান দিকে ফিরে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল সে।মন চাইছে আদুরে মেয়ে কে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু এখন কিছুই সম্ভব নয়।তার উচিত স্নেহা কে আগলে রাখা যত্ন নেওয়া,ফিল করানো তাকে আরিয়ান কতটা ভালোবাসে! মেয়েটা বড্ড কষ্ট পেয়েছে, আরিয়ান চায় না সে আরো কষ্ট পাক।একটু সময় দিলে হয়তো আরিয়ানের সাথে মিশে যেতে পারবে সে।
