তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫৪
ফারহানা নিঝুম
দুপুর গড়িয়ে এসেছে নিঃশব্দ এক অবগাহনে। রোদে ঝলমল করছে উঠোনের একেক কোণ, যেন সোনালি আলোয় রাঙিয়ে তুলেছে গায়ে হলুদের প্রতিটি স্পর্শ। ঘরে বাইরে ব্যস্ততার ছায়া লেগে আছে চলছে মেহেদি বোনার প্রস্তুতি, গন্ধে ভরে আছে হলুদের সুরভি।
গোসল শেষ করে বাইরে এসছে ফারাহ। আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারছে না সে। রাগে দুঃখে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। আচ্ছা একটা লোক এত দুষ্টু কি করে হতে পারে? ফাজিল লেফটেন্যান্ট সাহেব তাকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিচ্ছে।তাও সত্যি সে যে বেঁচে আছে এটাই তো বড় কথা! অন্য কোনো স্ত্রী হলে এত দিনে অবাধ্য লাগামহীন স্বামীর অত্যাচারে পগারপার হয়ে যেতো!
রাগে দুঃখে কোনো রকমে শাড়িটা পেঁচিয়ে নিলো ফারাহ।সাজটাও খুব কম। অল্প একটু লিপস্টিক আর ক্রিম লাগিয়েছে সে। পিছনে ফিরতেই দু কদম পিছিয়ে গেলো সে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো সামনের পুরুষের দিকে। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ক্লিন শেভ করা গালে হাত বুলিয়ে বলল।
“উফ্ সুখ তুমি ইচ্ছে করে এমন করো কেনো বলো তো?”
চমকে উঠে ফারাহ নিজ অজান্তেই কি কোনো ভুল করেছে? কিন্তু কই কিছু তো মনে পড়ছে না?
“আ.. আমি কি করেছি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গা দুলিয়ে হেসে উঠলো তাশফিন,দু পা এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বলল।
“এই যে এত্ত সাজসজ্জা করেছো এগুলো আমার ভীষণ ভাবে ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করছে।”
চোখ দুটো যেনো মনিকোঠা থেকে বেরিয়ে আসবে এবার। পিছনের আঁচল টেনে সামনে নিয়ে এলো ফারাহ। তোতলাতে তোতলাতে বললো।
“দেখুন লেফটেন্যান্ট সাহেব এটা মোটেও ভালো হচ্ছে না। আপনি কিন্তু একবার এমনিতেও আমাকে ঘেঁটে দিয়েছেন, আমি কিন্তু এবার আপনাকে মে’রে দেবো।”
অবাধ্য পুরুষ কারো কথাই শুনে না।এবারেও তাই, এগুতে লাগলো ফারাহর দিকে।পা অনুযায়ী পিছিয়ে যাচ্ছে ফারাহ
পালাতে হবে তাকে,আর একবারও এই পুরুষ কে সইতে পারবে না সে।
“না আসবেন না লেফটেন্যান্ট সাহেব। আমি অনুষ্ঠানে যাবো।”
কথাটা বলেই দরজার দিকে দৌড় লাগালো ফারাহ। লম্বা হাত বাড়িয়ে কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো তাশফিন। ছটপট করছে ফারাহ, হাত ছাড়াতে চায় কোমড় থেকে।
“না না ছাড়ুন ম রে যাবো তো। ছাড়ুন আমায়।”
“ডোন্ট ওরি জান, দিস টাইম আই স্বেয়ার আই ওন’ট বি রাফ।”
ফারাহর ছটফটানি থামছে না। অবাধ্য পুরুষ মূহুর্তের মাঝে ঘেঁটে দিলো তাকে, মিশিয়ে নিলো তার সাথে। অস্তিত্বের মাঝে টেনে নেয় ফের। ক্রন্দনরত রমণীর মুখ পানে চায় এক পলক, দু’হাতে চাদরে জড়িয়ে নেয় বড্ড আদরে।
“ডোন্ট ক্রাই, জান। আই’ল লাভ ইউ ডিপলি।”
ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট গুঁজে যায়, মিলে মিশে একাকার দু’জনে।বদনের ব্যাথায় অন্তঃস্থলে কাঁপুনি তৈরি হয় মেয়েটার, থরথরিয়ে কেঁপে উঠে সে।কবুতরী পেলব ন্যায় বদন খানি দু’হাতে বুকে তুলে নিল তাশফিন শেখ।
“আই লাভ ইউ জান।”
“আই হেইট ইউ।”
হো হো শব্দে কেঁদে ফেলল ফারাহ,সহসা হেসে উঠলো তাশফিন।
রুবেনা শেখ বড্ড ব্যস্ত। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়ে বেরিয়ে এসেছে তাশফিন, একদম ফিটফাট সে। ছেলে কে এমন অবস্থায় দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলেন রুবেনা শেখ। ত্রস্তবেগে এগিয়ে এলেন ছেলের পানে।পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরোখ করে বলেন।
“তোকে না হলুদের জন্য হলুদ রঙের পাঞ্জাবি দিয়েছি ওটা পরলি না কেন?”
মোটা ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত করে তাকালো তাশফিন,গলা খাঁকারি বললো।
“নষ্ট হয়ে গেছে, ওয়াশ রুমে ভিজিয়ে রেখেছি।”
নাক মুখ কুঁচকে নিলেন রুবেনা।
“নষ্ট হয়ে গেছে মানে?তুই তো অনুষ্ঠানে আসলি না,সবে এসেছিস।তার মধ্যে নষ্ট হলো কেমনে?”
অধর বাঁকিয়ে হাসলো তাশফিন, প্রত্যুত্তরে বলে উঠে।
“তোমার ফারাহ লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়েছে।”
ঠাস করে বাহুতে বসিয়ে দিলেন রুবেনা শেখ।
“একদম ফাজলামি করবি না তাশফিন।যা ফারাহ কে বল নূপুর অনেকক্ষণ ধরে ওকে খুঁজেছে। তাড়াতাড়ি আসতে বল।”
উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে ভাবনায় পড়ে গেল তাশফিন।
“কি রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“ফারাহ অসুস্থ আম্মু,তাই আসবে না।”
রাগে গজগজ করে উঠেন রুবেনা শেখ।
“তাশফিন আগেই বলছি ফাজলামি করবি না।এমনিতেও অনেক কাজ বাকি।একদম ঢঙ করিস না তো।”
কপাল কুঁচকে নিল তাশফিন, বিরক্তিকর ভাব নিয়ে আওড়ালো।
“সত্যি বলছি, নিজেই গিয়ে দেখে এসো।”
প্রচন্ড রেগে গেছেন রুবেনা শেখ। ত্রস্ত পায়ে তাশফিনের রুমের দিকে এগুতে লাগলেন। দরজায় টোকা দিতেই নড়েচড়ে সেদিকে তাকালো ফারাহ।
“কে?”
“আমি ফারাহ, দরজাটা খুলে দে আম্মু!”
চোখ দুটো আকারে বড় হয়ে আসে ফারাহর। কাঁপতে লাগল রীতিমতো। বিছানায় শুয়ে আছে সে, নড়াচড়া করার শক্তিও নেই তার মধ্যে।এক টুকরো সাদা কম্বলের নিচে নিজেকে ঢেকে রেখেছে।এই মূহুর্তে রুবেনা শেখ চলে আসবেন তা আশা করেনি ফারাহ।কি বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছেনা না।
“আম্মু দরজা খোলা আছে, ভেতরে এসো।”
দরজাটা ঠেলে ভেতরে আসলেন রুবেনা শেখ। ফারাহ কে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠেন।
“একি কাণ্ড?তুই শুয়ে আছিস কেন?কি হয়েছে?”
“আসলে আম্মু শরীর টা খুব খারাপ লাগছে আমার। জ্বর জ্বর লাগছে!”
কপালে হাত ছুঁয়ে দেখেন তিনি, সত্যি শরীর গরম হয়ে আছে।কপাল চাপড়াচ্ছেন রুবেনা শেখ।
“এসব কখন? জ্বর উঠছে তো! তুই যে কি করিস?”
দরজায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে তাশফিন, ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি খেলা করছে।চোখ পাকিয়ে তাকালো ফারাহ।এই অবাধ্য লেফটেন্যান্ট সাহেবের জন্য আজকে তার এই অবস্থা! কান্না পাচ্ছে প্রচুর, কাউকে বলতেও পারছে না এই লজ্জার কথা।
রুবেনা শেখ লক্ষ্য করলেন কম্বল দিয়ে নিজেকে রীতিমতো পেঁচিয়ে ফেলেছে ফারাহ।
“এসব কি করছিস?এই গরমে কম্বল নিয়েছিস কেন?”
থতমত খেয়ে গেল ফারাহ, আমতা আমতা করে বলল।
“আমার শীত লাগছে খুব!”
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তাশফিন ঠোঁট টিপে হাসলো, প্রশান্তি লাগছে তার,তাকে চেনা বড্ড কঠিন,তার সুখ কে যে আর কত কি স’হ্য করতে হবে একমাত্র সে-ই জানে। কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে তাকালো ফারাহ,চোখ টিপে তাশফিন।রুবেনা শেখ না থাকলে হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে ফেলতো ফারাহ। লেফটেন্যান্ট সাহেব তাকে বড্ড জ্বালা’চ্ছে!
“ওর একটু খেয়াল রাখিস তাশফিন, দরকার নেই বাইরে কোলাহলের মধ্যে যাওয়ার।”
তাশফিন বাচ্চা বাচ্চা মুখ করে বললো।
“আমি তো অনেক খেয়াল রাখি আম্মু। তোমার ফারাহ তো আমার কথাই শুনে না।”
চোখ পাকিয়ে তাকালো রুবেনা শেখ ফারাহর দিকে।
“একদম ঢঙ করবি না ফারাহ। চুপচাপ তাশফিন যা বলে তাই শুনবি।”
রাগে ফুঁসতে লাগলো ফারাহ।একেই বুঝি বলে “শেয়ালের কাছে মুরগি ব’র্গা দিয়ে যাওয়া।”তাশফিন আস্ত একটা শেয়াল,আর সে নিষ্পাপ একটা মুরগি,যাকে তারই শ্বাশুড়ি অজান্তেই ব’র্গা দিয়ে চলে গেছে।
বিয়ে বাড়ি মানেই যেন একটুকরো জীবন্ত উৎসব। চারপাশে রঙের ছটা, গন্ধে ভেসে বেড়ানো ফুল আর মশলার মিশ্র ঘ্রাণ, আর তার ফাঁকে ফাঁকে ছুটে চলা কচিকাঁচার দল হেসে খেলে, দৌড়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। ওদের কণ্ঠে যেন অনর্গল এক আনন্দধ্বনি, যা পুরো বাড়িটাকে প্রাণময় করে তোলে। অন্দরমহলে চলছে টুকটাক সাজসজ্জা, বউ মেয়েরা ব্যস্ত রান্নাঘরের যুদ্ধভূমিতে, আবার কেউ কেউ ঘন হয়ে বসেছে আড্ডার আসরে মুখরতায় হারিয়ে যাচ্ছে সময়।
“আপুউ তোমাকে কি সুন্দর লাগছে।”
ফারাহর কথায় জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো ঝুমুর। বিয়ের কনে সে। লাল লেহেঙ্গা পড়েছে সে, গয়নাগাটি সব কিছু দিয়ে সাজানো হয়েছে তাকে। ঝুমুর অপেক্ষা করছে কখন ফারাহর আম্মু আব্বু আসবে?ওরা আসলেই তো নবীন কে এক পলক দেখতে পাবে সে।
“আচ্ছা ছোট ভাবী তোমার বাড়ির লোকজন এখনো আসেনি?”
ফারাহ হাতে চুড়ি পড়তে পড়তে বলল।
“এসে যাবে একটু পরেই,বলল রাস্তায় আছে।”
“ওহ্।”
ছোট্ট করে জবাব দিলো ঝুমুর।
“খালামনিইই।”
দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এলো মাহির।এসেই জড়িয়ে ধরে ঝুমুর কে।
“মনিই আজকে তোমার বিয়ে, আমি অনেক মজা করব।”
আধো আধো কন্ঠের কথা গুলো শুনে মৃদু হাসলো ঝুমুর, ফারাহ এক গাল হেসে কোলে তুলে নিল মাহির কে।
“শুধু তুমি না আমরা সকলে মজা করব বাবা।”
গালে টুপ টুপ করে চুমু খেলো ফারাহ। নূপুর ভেতরে এলো, সঙ্গে আছে তাশফিন। বোন কে দেখতে এসেছে এক পলক।তাশফিন কে দেখেই অন্তর আ’ত্মা কেঁপে উঠলো ফারাহর। ভেতরের দিকে মাহির কে নিয়ে চেপে গেলো।তাশফিন কে দেখেই হো হো শব্দে কেঁদে ফেলল ঝুমুর। মলিন হাসলো তাশফিন,বোন কে জড়িয়ে ধরে এক হাতে।
“কাঁদছিস কেন?”
“জানি না।”
“ধ্যাত পাগলামী কাঁদতে নেই।”
“ভাইয়া তোমাদের ছাড়া থাকব কিভাবে?”
“গিয়ে ভুলে যাবি।তখন আর মনে পড়বে না।”
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে ঝুমুরের।কিয়ৎ সময় ওই রকম ভাবেই জড়িয়ে থাকে।
“ঠিক আছে আর কাঁদিস না।”
তাশফিন অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে বেরুতে লাগলো, আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ফারাহ কে খুঁজলো।রুমের কর্ণারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ। পিটপিট চোখ করে তাকাচ্ছে তার দিকে। ব্লাড রেড কালারের শাড়ি পড়েছে সে, গলায় তার দেওয়া নেকলেস টা চকচক করছে। ঠোঁট জুড়ে বিচরণ করছে লালচে আবরণের সৌন্দর্য।জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো তাশফিন। চোখের ইশারায় ফারাহ কে বাইরে আসতে ইশারা করলো।অথচ নাকচ করলো ফারাহ।সুঁচালো চোখ করে তাকালো তাশফিন,আরো চেপে গেলো ফারাহ। একদম যাবে না।অবাধ্য লেফটেন্যান্ট তার সব কিছু ঘেঁটে দেবে।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫৩
ঘাড় ম্যাসাজ করলো তাশফিন, চোখের ইশারাতে যেনো বুঝিয়ে দিলো।
“ওয়ান্স আই গেট ইউ ক্লোজ,সুখ আই’ল্ল বাইট ইউ র’।”
বাঁকা হেসে বেরিয়ে গেলো তাশফিন, বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে ফারাহর।কি হবে আল্লাহ মালুম। লেফটেন্যান্ট সাহেব অবাধ্য,পাগল, উ’ন্মাদ।সে নাকচ করেছে যাবে না, এটাতে নিশ্চুপই ক্ষেপে গেছে লোকটা।
