তাজমহল পর্ব ১৪

তাজমহল পর্ব ১৪
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

শাইনা নুইয়ে পড়েছে। কপালের আঘাতটা জোরে লেগেছে। পুরো মাথা টনটন করছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে কিছু একটা প্রচন্ড পরিমাণে আঘাত পেয়েছে।
কানের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দটা কমছেনা। কাঁধে পিনটা ফুটে বসে আছে। সে নড়তে চড়তে পারছেনা। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ সে নিজেই শুনতে পাচ্ছেনা।
মনে হচ্ছে সে কোনো দুঃস্বপ্নে ভাসছে। কিছুক্ষণ পর সবটা মিথ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃস্বপ্নটা ভাঙছেনা। সে ছটফটিয়ে উঠলো।
শরীরটা এত হালকা লাগছে তা বলার বাইরে। মনে হচ্ছে হাওয়ায় ভাসছে। শুধু গোলাপ ফুলের ঘ্রাণটা নাকে পাচ্ছে সে।

তারপর হঠাৎ করে মনে পড়লো পুরো ঘরের মেঝে আর বেডে বিছানো সাদা চাদরের একটি জায়গাও খালি নেই যেখানে ফুলের পাপড়ি ছিটানো হয়নি।
সে এখনো চোখ মেলেনি তবুও অল্প অল্প ফোঁপাচ্ছে। শরীরটা কাঁপছে।
নাকের সামনে হঠাৎ কমলার সুগন্ধি এল। শাইনা চোখ মেলতে মেলতে আবারও চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল।
দুটো চোখ তাকে পাহারা দিচ্ছে পাশাপাশি শুয়ে। শাইনা ইচ্ছে করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। নিঃশ্বাস ফেললো খুব আস্তেধীরে যেন শব্দও না হয়। কতক্ষণ এভাবে ইচ্ছে করে চোখ বুঁজে রাখা যায়? খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার।
হঠাৎ তার নাকের কাছে কমলার খোসার ছোঁয়া লাগতেই সে চট করে চোখ মেললো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাজদার সিদ্দিকী একদম তার পাশ ঘেঁষে বুক আর দুই হাতের ভর দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে কমলার কোয়া চিবোচ্ছে।
সে চোখ মেলতেই কমলার খোয়া চিবোতে চিবোতে তার দিকে তাকালো। তাকে তাকাতে দেখে শাইনা জড়োসড়ো হয়ে গেল। পরপুরুষ তাকালে যেমন জড়োসড়ো হয়ে আসে শরীর ঠিক সেভাবে। তার এখনো নিজের কিছু বোধ হচ্ছে না। না এই ঘর, না এই বর।
এই বাড়িতে ভয়ে ভয়ে পা রেখে মেঝ দখল করে টিভি দেখার জন্য তাকে কলিজা হাতে নিয়ে বসতে হতো। তাজদার সিদ্দিকী ঘরের দিকে কখনো উঁকি দেওয়ার সাহসও করেনি সে।
তার এখনো মনে আছে তখন সে ক্লাস ফোরে ছিল। বড় আম্মুর চুল আঁচড়ে দিত সে মাঝেমধ্যে। বড় আম্মু বলতেন সে চুল আঁচড়ে দিলে নাকি শান্তি লাগে।
যদিও ক্লাস সিক্স সেভেনে উঠার পর আম্মা তাকে ওই বাড়ির দিকে যেতে দেয়নি। শাইনা নিজেও ঘরকুনো হয়ে গিয়েছিল।

একদিন চুল আঁচড়ানোর একফাঁকে বড় আম্মু হঠাৎ বললেন তেলের বোতলটা নিয়ে আয় আমার ঘর থেকে।
শাইনা বড় আম্মুর কথামতো তেলের বোতল আনতে গেল। ভয় কাজ করছিল না তখন। কারণ সে জানতো তাজদার সিদ্দিকী নেই বাড়িতে। সে থাকলে বড়আম্মু তাকে ঘরে যেতে বলতো না।
বড় আম্মুর কথা মতো ঘরে গিয়ে তেলের বোতলটা খুঁজতে লাগলো সে। অনেকক্ষণ পর পেয়েও গেল। তেলের বোতল নিয়ে ঘর থেকে বেরোনো মাত্রই তার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো। সে কি ভয়! শাইনা কোনোদিন জ্বীন ভূতেও এত ভয় পায়নি। তার সামনে তাজদার সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে। চেহারার রঙ পাল্টে গেল তাকে দেখামাত্রই। কর্কশ স্বরে জানতে চাইল,”ওই এখানে কি করছিস?”
শাইনার মনে হয়েছিল সে মরেই যাবে। তিতলি এসে পড়ায় কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিল সে।
কিন্তু তারপরের দিন!

উঠোনে বসে সে আবারও বড় আম্মু চুল আছড়ে দিচ্ছিল। তখুনি তাজদার সিদ্দিকী খেলার মাঠ থেকে এল নেয়েঘেমে। বড় আম্মু জানতে চাইলেন,
“তোমার ঘড়িটা কোথাও পেলাম না। কোথায় রেখেছ অত দামী ঘড়ি?”
তাজদার সিদ্দিকী কাঠকাঠ গলায় বলল,”চোরচাট্টা সবগুলোকে বাড়িতে ঢুকতে দিলে জিনিস ঠিকঠাক জায়গায় থাকবে?”
বলেই শাইনার দিকে কেমন ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। বড় আম্মু চুপ করে গেল। শাইনার এত অপমান লেগেছিল। সে আম্মু না দেখেমতো চুপিচুপি কেঁদেছিল অনেক। তারপরের দিন বড় আম্মু ডাকলেও সে আর যায়নি চুল আঁচড়ে দেয়ার জন্য।

তখন শাইনা বিকেলবেলায় খেলা করতো বাড়ির পেছনের বিলে। তিতলি একা একা বসেছিল। শাইনা তিতলিকে ডাকলো খেলার জন্য। তিতলি এল না।
শাইনার অন্য একজন বান্ধবী ঝর্ণা তিতলিকে ডাকতে গেল। তিতলি তবুও এল না। কেন এল না জানতে চাইতেই ঝর্ণা বলল, তিতলি নাকি বলেছে, মেঝ ভাইয়া বলেছে চোরদের সাথে খেলা না করতে। ও একটা চোর। ভাইয়া আমাকে মারবে ওর সাথে খেলতে দেখলে।
কথাটা শুনে সবাই অনেক হাসাহাসি করেছে সেদিন। শাইনা বাড়ি ফিরে এসেছিল আর খেলায় মনোযোগ দিতে পারেনি।

তিতলি তার সাথে মাঝেমধ্যে খেলতো। তার মেঝ ভাই আসছে মনে হতেই শাইনার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যেত। অনেক সময় এমন হতো সে শাইনাকে ধাক্কাধাক্কি করে চলে যেতে বলতো তার সামনে থেকে।
শাইনার চোখের কোণা বেয়ে জলগুলো কি এমনি এমনি গড়াচ্ছে আজ? তাকে ঘিরে আজ এত আয়োজন অথচ কেন সে একটুও খুশি হতে পারছেনা জবাবটা তো তার কাছেই আছে।
এই ঘরের দিকেও তো সে কোনোদিন চোখ তুলে তাকাতে পারেনি, ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে পারেনি আজ একদম সেই ঘরে, তাজদার সিদ্দিকীর বিছানায়। তার পাশে, তার কাছে। এটি তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। সে কখনো চায়নি। বরং সে মনে মনে চাইতো তার জীবনসঙ্গী যেন এমন না হয়।

সে আলতো করে সরে পড়ছিল। তাজদারের একহাত তার পাশে এসে দেয়ালের মতো বিছানায় চেপে বসলো। শাইনা আটকে গেল। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তাজদারের দিকে। কান্না দলা পাকিয়ে তার গলার কাছে এসে থমকে গেছে। তাজদার তাকে বুকের নিচে টেনে নিল। তার মুখের উপর ঝুঁকে বলল,
“ওয়ান হান্ড্রেড সিক্সটিন ফোন কলস, সেভেনটি থ্রি মেসেজ। বাট নো রিপ্লাই। হোয়াই?”
বলেই ঠোঁট উল্টালো। শাইনা নড়েচড়ে উঠলো। অল্পস্বল্প কাঁপছে সে কাঁদুনির তালে। মুখটা হালকা ফিরিয়ে নিয়ে এলোমেলোভাবে বলল,
“আমি ঘুমাবো, ঘুম পাচ্ছে, কাঁধে লাগছে, আমার ভালো লাগছেনা।
আম্মা!!!”

তাজমহল পর্ব ১৩

ঠোঁট ভেঙে কান্না এল তার। অভ্যাসবশত অস্ফুটস্বরে মাকে ডেকে ফেললো সে। পাশ ফিরে গিয়ে এলোমেলো সুরে কি যেন বিড়বিড় করে কাঁদতে লাগলো। হাত পা কেমন খিঁচে যাচ্ছে তার। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। মোচড়াচ্ছে সে। তাজদার সিদ্দিকী তার পিঠের নিচে হাত গলিয়ে টেনে এনে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আলতো করে তার গালটা শাইনার গালে চেপে ধরলো। কান্নায় চোটে শাইনার গোটা শরীরটা দুলে উঠল। তাজদার সিদ্দিকী তার খসখসে গালটা জোরে শাইনার কোমল ত্বকে আরও চেপে ধরে, নাকঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“রিল্যাক্স!”

তাজমহল পর্ব ১৫