তাজমহল পর্ব ২০
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
তাজদার চোখ নিচু করে নিজের বুকের দিকে তাকালো। বোতামটা ঝুলে আছে সুঁতোর সাথে। এত শক্তি? সোজা বোতাম ছিঁড়ে নিয়েছে?
শাইনা ঝুলে থাকা বোতামটির দিকে তাকিয়ে তাজদারের দিকে চোখ তুলে তাকালো। শ্বাস প্রশ্বাস একটু দ্রুত হচ্ছে।
তাজদার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বলল,
“বোতামটা সেলাই করে না দেয়া অব্দি বাপের বাড়ি যেতে পারবেনা।”
শাইনা তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছিল তাজদার তাকে ঠেলে দিল। শাইনার বিছানায় দুহাত চেপে পড়ে গেল। অবাকচোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনার সমস্যা কি? সারাক্ষণ নাটক করার তালে থাকিনা আমি।”
কিছু মানুষ থাকে যাদের ভালোও কথা সবসময় কঠোর শোনায়। সেক্ষেত্রে শাইনা সে খুব কঠোর কথাও আস্তে করে বলে দিতে পারে। এতদিন সে সেটাই করছিল। কিন্তু আজ তার কথাটা বেশ কঠোর শোনালো। তাজদার স্পষ্টভাবে বলল,
“বোতামটা সেলাই না করে তুমি আজকে বাপের বাড়িতে যেতে পারবেনা। পারবেনা মানে পারবেনা। আমার কথাই শেষ কথা। আমিও তোমার সাথে মশকরা করার মুডে নেই।”
বেশ সিরিয়াস হয়ে কথাটা বললো সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শাইনা বলল,”মনে এত রং লাগেনি আমার। আমি ধাক্কাটাক্কা দিলে আপনার আরও অপমান লাগতে পারে। ভালো কথা বলছি। সরুন। বিয়ে করেছেন বলে যখন তখন গায়ের উপর উঠে আসাটা কি ধরণের কথা?”
তাজদার বলল,”এত কথা বলতে কে বলেছে? বোতামটা সেলাই করে দেবে কিনা?”
“আমি আপনার চাকর নই।”
“বরের বোতাম সেলাই করতে গিয়ে যদি চাকর হতে হয় তাহলে তুমি চাকরই। বোতামটা সেলাই করে দাও চাকরাণী।”
“ভাইয়াদের সামনে যদি বলি আপনি আমাকে চাকরাণী ডেকেছেন তাহলে কি হবে ভাবতে পারছেন?”
“পারছি তারা ভাববে চাকরও ডেকেছে ভালো কথা। সেটা বেশ মানিয়েছে। শেষে আবার রাণী ডাকলো কেন?”
শাইনা সত্যি সত্যি এবার ধাক্কা মেরে বসলো। তাজদার সিদ্দিকী একটু সরে গেল। শাইনা তার দিকে আর একবারও ফিরে তাকালো না। গায়ে আঁচল টেনে সোজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তাজদার বলল,
“সুই সুঁতো নিয়ে দ্রুত ঘরে আসা হোক।”
রান্নাঘরে মাছ মাংস রান্না হচ্ছে। কাজ করতে করতে সবাই নানান কথা বলছে। শাইনাকে দেখে তার বড় জা ঝিমলি বলল,”ভেতরে আসো, বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু লাগবে?”
শাইনা বলল,”বড়আম্মুর সাথে…
কথাটা শেষ করার আগেই রওশনআরা বেরিয়ে এল। বলল,”ঘরে চলো।”
শাইনা তার পেছন পেছন ঘরে গেল। ঘরে এসে রওশনআরা কাপড় ভাঁজ করতে করতে বলল,”ও কিছু বলেছে?”
শাইনার মুখ গম্ভীর। বেশ অভিযোগের সুরে সে বলল,”এডমিশন না নিতে বলছে। এটা কোনো কথা?”
রওশনআরা তার মেজাজ টের পেল। বলল,”তুমি এককথায় থাকবে।”
শাইনা রীতিমতো তিক্তবিরক্ত। এতবড় একটা কথা শুনেও বড়আম্মুর চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই। তাকে পড়াশোনা করতে দেবেনা জানলে সে দরকার পড়লে মা বাবা ভাইবোন সবার মুখে চুনকালি লাগিয়েও হলেও বিয়েটা ভাঙতো। দরকার পড়লে পালাতো। যদিও অসম্ভব ছিল কিছু সে চেষ্টাটা অন্তত করতো। তাজদার সিদ্দিকী রীতিমতো তাকে কন্ট্রোলে নেয়ার চেষ্টা করছে। তার জীবনের ছোটবড় সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা কি ধরণের স্বামীর অধিকার ফলাচ্ছে সে? তার বাবা অল্প পড়াশোনা জানা পুরুষ মানুষ। কিন্তু মায়ের সমস্ত ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিত। যেখানে তার কথার কোনো মূল্যায়ন নেই সেখানে সে সারাজীবন থাকবে কিভাবে?
রওশনআরা বলল,”তোমার ভাইদের কানে তুলে দেবে কথাটা। তারা তাজকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবে। পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়াটা ভালো হবেনা।”
শাইনা বলল,”আপনার কথা শুনবে না?”
রওশনআরা তার দিকে তাকালো। বলল,
“হাজারটা যুক্তি দেবে। এত যুক্তিতর্ক করবে কে তার সাথে?”
“তাহলে বড়আব্বু একবার বলুক। আমি তো পড়াশোনা ছাড়ব না জীবনেও। কিন্তু বড় আব্বু বললে হয়তো আর আমাকে কিছু বলবেনা।”
“উনি এইসব ব্যাপারে কথা বলতে চায় না। গরম মাথার মানুষ কখন কি বলতে কি বলে ফেলে তার হিসেব নেই।”
“আপনি আর বড়আব্বু বললেও কথা শুনবেনা?”
“বললাম না হাজারটা যুক্তি দেখাবে। তখন আর আমাদের না বলার জায়গা থাকেনা সেখানে।”
“বড়ো ভাইয়া?”
“রায়হানকে যদি মুখের উপর বলে তার বউয়ের সিদ্ধান্ত একান্তই তার তখন সে অপমানিত হবেনা?”
শাইনা অবাক। তাহলে তো এই তাজদার সিদ্দিকী যা বলবে তা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। কেউ তার সিদ্ধান্তে না বলতে পারবে না এটা কি ধরণের কথা? তার সব কথাকে প্রশয় দিয়ে এরা অমানুষ বানিয়ে ফেলেছে। শাইনা একের পর এক আশ্চর্য হচ্ছে। তার উপরে কোনো কথা বলা যাবেনা মানে? রোজগার ভালো না হলে এত দম্ভ, এত আধিপত্য থাকতো তার? চাকরির গরমে মা বাবার কথাও শোনেনা? অবশ্য আগেও এমন ছিল।
এখন আরও বেড়েছে। শাইনা দরকার পড়লে মরে যাবে সবার কথা শুনে তবুও সে পড়াশোনা ছাড়বেনা। এই তাজদার সিদ্দিকীর স্বভাব হয়ে গেছে সবার উপর কর্তৃত্ব ফলাতে ফলাতে। নিজেকে হনু মনে করে সে। সে যা বলবে তাই হবে। তার কথার বাইরে কোনো কথা থাকতে পারেনা। শাইনার এত মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার বলার বাহিরে। কথায় কথায় টাকার বাহাদুরি করা সস্তা মানসিকতার লোকটার প্রতি তার মনে জীবনেও শ্রদ্ধা আসবেনা।
রওশনআরা আশ্বাস দিয়ে বলল,”আমি তারপরও বলব, দেখি কি বলে। তুমিও এককথায় থাকবে। পড়াশোনা ছাড়া যাবে না।”
শাইনা ঘরে আসতেই তাজদার তার হাত শক্ত করে তার সামনে তুলে ধরে হাতের তালুতে তার শার্টটা দিল। তারপর কোমরে সুই ফুটিয়ে দিল। শাইনা ব্যাথা পেল। কোমরে হাত চেপে ধরে রেগে তাকাল। মেজাজ তুঙ্গে!
সুই সুঁতো তার হাতে তুলে দিয়ে তাজদার বলল,
“বোতামটা সেলাই করে দাও।”
যেন সে হুকুম করছে শাইনাকে। শাইনা শার্টটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলো জোরে। সুঁইটাও ছুঁড়ে মেরে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“সুঁই ফোটালেন কেন আগে জবাব দিন। মগের মুল্লুক নাকি। যান এখান থেকে। সেলাই না ধোলাই করে দেব।”
তাজদার শার্টটা নিয়ে এল। শাইনার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বলল,”শেষবারের মতো বলছি। সেলাই করে দাও। ফিরে এসে যদি দেখি সেলাই করোনি তাহলে তোমাকে আমি খাইছি।”
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শাইনা শার্টটা নিয়ে বিছানায় বসলো।
তাজদার ফিরে এল চল্লিশ মিনিট পরে। শাইনা তার দিকে শার্ট বাড়িয়ে দিল। তাজদার শার্টটা তার মুখের উপর ঝেড়ে বলল,
“নো থ্যাংকস।”
শাইনা নিজের বোরকা হিজাব বের করে রাখলো। তাজদার টিশার্ট খুলে শার্টটা গায়ে জড়ালো। শাইনা একবার ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালো। তাজদার আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“লুকিয়ে দেখা পাপ।”
শাইনা আবারও ফিরে গেল।
তাজদার শার্ট গায়ে দেয়ার পর খেয়াল করলো একটাও বোতামও নেই। জিতে যাওয়ার খুশিতে খেয়ালও করেনি যে শাইনা সব বোতাম ছিঁড়ে নিয়েছে।
সে চট করে শাইনার দিকে ফিরে তাকালো। শাইনা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে দিতে তাজদারের দিকে ফিরলো। ঠোঁটের কোণায় তীর্যক হাসি! তাজদার সিদ্দিকীর উপর গাদ্দারি ভাবা যায়?
শাইনা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল।
তাজদার তাকে টেনে এনে নিজের সাথে চেপে ধরলো। তার খালি বুকে শাইনার মুখ চেপে গেছে। শাইনা ছটফটিয়ে উঠলো। তাজদার তার মাথা চেপে ধরে রেখে বলল,
“টিট ফর ট্যাট।”
শাইনাও সাথে সাথে হাঁচি দিল জোরে। তাজদার এক ঝটকায় বহুদূরে! নিজের বুকের দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“হোয়াট দ্য হেল! কি এসব?”
তাজমহল পর্ব ১৯
শাইনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”মধু। আমার ঠান্ডা লেগেছে। জোরাজোরি করলে এই অবস্থাই হবে। এমনিতেই আছি নিজের জ্বালায়। তারমধ্যে এইসব যথেষ্ট বিরক্ত লাগে।”
বলতে না বলতে শাইনা আরও একবার হাঁচি দিল। নাকের মাথা লাল হয়ে এসেছে।
তাজদার বলল,”ছিহ!”