তাজমহল পর্ব ২৭

তাজমহল পর্ব ২৭
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

শাইনা অনেকক্ষণ ধরে নিঃশব্দে পড়ে ছিল বালুর মাঝে। উঠে বসার চেষ্টাও করেনি। ইচ্ছে করেই নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিল ঝড়জলের ভেজা কোলের মধ্যে।
তাজদার ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়াল। শাইনার না ফেরার ভাবনা তার ভেতরটা অস্থির করে তুলতেই অবচেতনে পা ঘুরে গেল।
ফিরে এসে দেখল, ঠিক যেভাবে ফেলে গিয়েছিল, শাইনা এখনো তেমনই পড়ে আছে। বালু তার চুলে, চোখে, গায়ে মিশে গেছে। ঝড়ের পানিতে পুরো শরীর ভিজে সপসপে। কিন্তু তবুও নড়েনি সে। তাজদার তাকে হাত ধরে তুলতে গেল। বলল,

“ওঠো, এভাবে কতক্ষণ পড়ে থাকবে?”:
শাইনার মুখের এক পাশে লেগে থাকা বালু কাঁদার মতো লেগে গেছে। চোখজোড়া লাল টকটকে। দীর্ঘ সময় ধরে কান্না আটকে রেখেছে। কাঁপা কাঁপা পলক আর শক্ত হয়ে থাকা ঠোঁট বুঝিয়ে দিচ্ছে সে ভেতরে ভেতরে পুড়ছে।
তাজদার চোখ সরু করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। কপাল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। সে বিরক্তভাবে মুখের পানি মুছতে মুছতে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আশ্চর্য! এত নাটকের কি আছে? তোমার এইসব অভিনয় দেখে মনে হচ্ছে যেন তোমায় কোনো পরপুরুষ ছুঁয়েছে! এসব ফিল্মি ন্যাকামো বাদ দাও। চলো আমার সাথে।”
বলেই একটানে শাইনাকে কোলে তুলে নেবে ঠিক তখনই ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা!
শাইনার দাঁতে বালু খিচখিচ করছে। সে মুখে জমে থাকা বালুর সঙ্গে থুতু ছুঁড়ে দিল তাজদারের দিকে প্রচন্ড ঘৃণায়।
থুতুটা গিয়ে ছুঁয়ে পড়ল তাজদার সিদ্দিকীর গায়ের একেবারে কাছ ঘেঁষে। মুহূর্তেই সময় থেমে গেল। শাইনার চোখের চাহনি আগুন ছুঁড়ল তাজদারের অহংকারভরা মুখের দিকে।

তাজদার সিদ্দিকী স্তব্ধ!
বাতাস থমকে রইল, সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল, শাইনার চোখদুটো জ্বলতে লাগল ক্রোধের আগুনে।
তাজদার সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে রইল শক্ত হয়ে। চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেল সে।
এই সেই শাইনা মমতাজ যার সামনে নিজের সমস্ত দম্ভ, অহংকার সংযমে বেঁধে রেখেছিল সে এতদিন। শুধু নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল বলে।

আজ সেই মেয়েই থুতু ছুঁড়ে দিয়েছে তার দিকে! এত ঘৃণা, এত অসম্মান তাজদার সিদ্দিকী কল্পনাতেও আনেনি।
তার ভেতরের সমস্ত গর্ব, অহংকার আর পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য মুহূর্তেই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল।
এই এক থুতুই শাইনার সমস্ত নীরব অপমানের প্রতিবাদ যেন। ছোটবেলার সব অপমান, হারানো আত্মসম্মান, আর অপারগ ক্রোধ জমা করে আজ এই সে ছুঁড়ে দিলো তাজদার সিদ্দিকীর মুখের ওপর।
তাজদার কথা হারিয়ে বসলো। শাইনার ঠোঁট থেকে ঝরে পড়া একবিন্দু থুতু তার ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে। এতদিন দেখেও না বোঝার ভান করলেও তার এই মুহূর্তে বুঝতে বাকি রইলো না এই মেয়েটা তার স্পর্শকে ঘৃণা করে, তার উপস্থিতিকে ঘৃণা করে, এমনকি এই সম্পর্কের দাবিকেও।

আকাশে আবার বিদ্যুৎ চমকাল। সেই আলোয় শাইনাকে দেখে মনে হলো যেন সে কোনো বিজয়ী যুদ্ধিনীর মতো যুদ্ধ জয় করে পেছনে পরাজিত সৈন্যকে ফেলে চলে যাচ্ছে নিঃশব্দ, দৃঢ়, দম্ভে ভরা পদক্ষেপে।
তার ভেজা চুল কাঁধে লেপ্টে আছে, শাড়িটা কাদায় মাখা। তবু এই মুহূর্তে সে সুশোভিত, সংহত। চোখে তৃপ্তির দীপ্তি, ঠোঁটে রুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ। মনে হচ্ছে সমস্ত অবমাননা, সমস্ত অপ্রাপ্তি আজ সে ফিরিয়ে দিয়েছে তীব্র ঘৃণার এক থাপ্পড়ে।

তাজদার সিদ্দিকীর চোখের দিকে আজ সে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে সে যত বড়লোক হোক না কেন, তার প্রতিপত্তি, আর অহংকার, তার দম্ভ, তার আভিজাত্য, এমনকি তার স্পর্শও শাইনাকে বিকৃত করে, ছোট করে।
আজ শাইনা সবকিছুর শোধ নিয়েছে। তাজদার সিদ্দিকীর সামনে দাঁড়িয়ে নয়, চলে যেতে যেতে, পেছনে না তাকিয়েই সে বলে দিয়েছে সব স্পষ্ট করে।
এতদিনের তার করা সমস্ত প্রতিবাদকেও ছাপিয়ে গেল এটা। তার সব রাগ, দৃষ্টিতে জমে থাকা ক্ষোভ, কাঁপা ঠোঁটের কষ্ট সব কিছু আজ ম্লান হয়ে গেল এটার কাছে।
এতদিন ধরে যে শাইনা শুধু মুখ ফিরিয়ে থেকেছে, কথা দিয়ে জব্দ করেছে, আজ সেই শাইনা নিজের ঘৃণা স্পষ্ট করে দিয়েছে এমনভাবে যা কোনো ভাষায় বলা যেত না।

তাজদার সিদ্দিকী মুখের ভাষা কম বোঝে। তাই এভাবেই বুঝিয়ে দিতে হয়েছে। যে থুতু সে ছুঁড়তো শাইনা আর তার ভাইবোনদের দেখলো আজ সেইসব থুতু শাইনা একসাথে ছুঁড়ে দিয়েছে তার দিকে। তাজদার সিদ্দিকীর চোখে চোখ রেখে আঙুল দিয়ে তার দোষ দেখিয়ে দিতে পারাটা শাইনা মমতাজের বিশাল অর্জন!
আর মুখ দেখাদেখি অব্দি হয়নি।
সকালে রওশনআরা কল দিয়েছিল। তাজদার সিদ্দিকী তখনো বিছানায় ঘুমোচ্ছিল। শাইনা চুল আঁচড়াচ্ছিল আস্তেআস্তে। হাত চলছেনা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চোখমুখ জ্বলছে। কিন্তু সে চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার।
ফোনে রিং বাজছে। তাজদার বালিশ থেকে মাথা তুলে ফোনটা রিসিভ কানে দিল। রওশনআরা ফোন করেছে। মা ছেলের কথাবার্তার এক ফাঁকে রওশনআরা বললেন,

“আনিস আর শাইনার সামনে চড় মেরেছ শুনে তোমার আব্বা রেগে গিয়েছে। আমরা ওকে বকেছি। তৌসিফ আমাদের সবটা জানিয়েছে। বাড়ি আসুক। তারপর একটা হেস্তনেস্ত করবো।”
তাজদার শোয়া থেকে উঠে বসলো। বাইরে বেরিয়ে এসে দরজাটা ভাজিয়ে দিয়ে গমগমে গলায় বলল,
“ফোন দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য কি তোমাদের মেয়েকে চড় কেন মেরেছি সেটা জানা? সত্যি কথা বলবে।”
রওশনআরা তার কথার টোনটা চেনে। শান্তভাবে বলল,”রেগে যেওনা। ও মেয়ে বড় হয়েছে। শাসন করলে আলাদাভাবে করতে। সবার সামনের চড় মারাটা আমাদের ভালো লাগেনি। তুমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো সেটা।”
তাজদার মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। তারপর বলল,

“বেশ, তোমাদের মেয়ে জাহান্নামে যাক। আমি আর ফিরেও তাকাব না। আমি বুঝে গেছি আমি একগাদা ছোটলোকের সাথে বসবাস করছি। যাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতার বালাই নেই। চড় কেন মেরেছি সেই কারণ না খুঁজে আমার কাছে জবাবদিহিতা চাচ্ছে আমি কার কার সামনে চড় মারলাম। কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে একা একা কক্সবাজার আসে? অ্যাহ?”
রওশনআরা চুপ করে রইলো। হাত কাঁপছে!
শাইনা রুমে বসেই সব শুনতে পেয়েছে।

তাজদার সিদ্দিকী আর রুমে এল না। বাইরে দাঁড়িয়ে গর্জন করে যাচ্ছে। রায়হান তাকে জিজ্ঞেস করেছে কেন মায়ের সাথে ওভাবে কথা বললো। আর এতেই তাজদার সিদ্দিকী রেগে গিয়েছে। ওটা তার মা নাকি প্রতিবেশী খালা যে কথায় কথায় ছেলের উপর রাগ করে বসে থাকে? ছোটবেলায়ও সে খেলার মাঠে গন্ডগোল বাঁধিয়ে এলে মা শাসনের বদলে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিত। মুখ দেখাত না। খাবার দিত ছোট মা। তাজদার তখন আরও রেগে যেত। সেও মায়ের সামনে যেত না। কথা বলতো না। দিনের পর দিন মা ছেলে মুখ না দেখে থেকেছে, কথা না বলে থেকেছে। সেই যে দূরত্ব বেড়েছে এখনো অব্দি মা ছেলে মুখোমুখি বসে কথাবার্তা বলেনি। মা ছেলেকে বুকে টেনে নেয়নি। পাহাড়সম একটা দূরত্ব আছে যেটা কোনোদিন কমারও নয়।

রায়হান এও বলল, আমার সাথে তো এমন করেনা আম্মা। তোর সাথে কেন করে? তুই নিজের মাকে নিজেই চিনিস না, বুঝিস না। কোন কথায় আঘাত পাবে সেটাও বুঝিস না। তোর কি এখন আর সেই বয়স আছে যে তোকে মা ভালোমন্দ শেখাবে ধরে ধরে? মায়ের সাথে কোন কথা কিভাবে বলতে হবে এসবও যদি তোকে এখন শিখিয়ে দিতে হয়। এতবড় চাকরি বাকরি করা মানুষকে এইসব শেখানোর দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না।
তাজদার সিদ্দিকী কানে ফোন চেপে ধরে চুপচাপ শুনে গেল। শেষে একটা কথা বললো,
“আমি মায়ের ছেলে কম শত্রু বেশি। আমার সব কথায় মহিলা দোষ ধরবে সেটা আমি জানি। নিজের মা যেখানে দোষ ধরছে সেখানে পরের মেয়ে….
তার কথা থেমে গেল। গলা ঝেড়ে সে বলল,

“আমি রাখছি…
রায়হান বলল,”শান্ত হ। মাথা গরম করিস না। শাইনাকে নিয়ে ঘুরেফিরে ভালোভাবে চলে আয়। আর আম্মাকে পারলে কল দিয়ে একটু শান্তভাবে কথাবার্তা বলিস। এত রাগ দেখাস না।”
তাজদার একটাও কথা বলল না। চুপ করে শুনে গেল সব। কথা ফুরাতেই, ঠিক যেমন ছিল তেমনই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে তখন শান্ত হাওয়া বইছে। ঝড়ের পরের মুহূর্তে পৃথিবীও দম নিয়ে শান্ত হচ্ছে।
শাইনা ধীরে দরজার পালটা একটু ফাঁক করল, কৌতূহলে উঁকি দিল বাইরে।
তাজদার সিদ্দিকী তখনো দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল, কপালে গভীর ভাঁজ, চোখে অদ্ভুত সংশয় আর ভেতরে জমে থাকা কিছু অনুচ্চারিত প্রশ্ন নিয়ে।

হঠাৎ করেই সে শাইনার দিকে ফিরল।
শাইনা সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেলল নিখুঁত কৌশলে, যেন সে মোটেও তাজদারের দিকে তাকিয়ে ছিল না এতক্ষণ!
তাজদার ফোনটা চুপচাপ পকেটে রেখে দিল।জীবনে আর ফোন দেবে না রওশনআরাকে যতক্ষণ না ওখান থেকে আগে ফোন আসে। রওশনআরা তার ‘মা’ কম, ‘প্রতিবেশী খালা’ বেশি। শুধু তার ভুল ধরতে ব্যস্ত।
বাবাও প্রতিবেশী খালুর মতো। আড়ালে গালমন্দ করে নিজের ছেলেকে। ভাইবোনগুলোও এমন।
এই সংসারে সবাই তার প্রতিবেশী!
বউ তো সত্যি সত্যিই প্রতিবেশী!

দুপুরে খাবার দাবার সবাই একসাথে খেয়েছে। তাসনুভা ভেবেছে ভাইয়া তাকে আরও বকাঝকা করবে। কিন্তু কিচ্ছু বলেনি। বিকেলের দিকে সমুদ্রে নেমেছে তারা। আনিসের পাশে এসে দাঁড়ালো শাইনা। আনিস অদূরে তাজদারকে দেখলো। তারপর বোনের দিকে তাকালো। জানতে চাইল,
“কিছু বলবি?”
শাইনা দুই পাশে মাথা নাড়লো। আনিস তার কপালে হাত দিল।
“একি জ্বর তো অনেক।”
“কমে যাবে।”
“ঔষধ খেয়েছিস?”
“হ্যাঁ। ওরা ভাইবোন কথা বলছে তাই এদিকে চলে এসেছি।”
আনিস তাজদারের পেছনে তাসনুভাকে দেখলো। তারপর শাইনাকে প্রশ্ন করলো,
“বাড়িতে ঝামেলা হ’য়েছে নাকি?”

“হয়েছে বোধহয়।”
আনিস বলল,”থাক গে। তুই টেনশন করিস না। ওদের ঝামেলা ওরা মিটিয়ে নেবে। পানিতে নামিস না।”
কিন্তু তাসনুভা এসে শাইনাকে পানিতে নামিয়ে নিতে লাগলো। আনিস বাঁধা দিল।
“ওর জ্বর!”
তাসনুভা রেগেমেগে বলল,
“ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”
“যাবেনা ও। ছেড়ে দাও।”
“ওরা হানিমুনে এসেছে। মজা করবে এটা স্বাভাবিক।”
আনিস ভ্রু কুঁচকাল।

“ওর জ্বর, ও যাবেনা বললাম।”
তাসনুভা শাইনার হাত ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তেড়ে এসে বলল,
“আপনার বোনকে ভাইয়ার কাছে পাঠিয়ে দেন আনিস ভাই। ওরা হানিমুনে এসেছে। ভাইবোন নিয়ে ঘুরতে নয়। আমি ঘুরতে পারছিনা। ওকে ভাইয়ার কাছে যেতে দেন।”
আনিস শাইনাকে বলল,”তুই রুমে গিয়ে শুয়ে থাক শরীর বেশি খারাপ লাগলে।”
তাসনুভা কটমট করে বলল,

“আনিস ভাই আপনি আমার কথাকে পাত্তা দিচ্ছেন না।”
আনিস বলল,”তোমার ভাই একা একাই ঘুরছে তখন থেকে। খেয়াল করেছি আমি। তুমি তোমার কাজে যাও। ওদের ব্যাপারে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। তুমি ঘুরে বেড়াও।”
তাসনুভা চালাকি করে বলল,”আমাকে একটু সামনে এগিয়ে দেন তাহলে। ভাইয়া ভাববে আমি আপনার সাথে কোথাও গিয়েছি। আমার বন্ধুরা হিমছড়ি যাচ্ছে।”
আনিস বলল,”আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছেনা।”
তাজদার পানিতে নেমে এদিকে তাকিয়েছিল কপাল কুঁচকে। তাসনুভা তা দেখে আনিসের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“তাহলে কয়েকটা ছবি তুলেন।”
আনিস বলল,”আমি তেমন পারিনা।”
“তাও তোলেন।”
জোর করে আনিসের হাতে ফোন ধরিয়ে দিল সে।
এদিকে শাইনা একজন পুরোনো বন্ধু খুঁজে পেয়েছে। তার সাথে কথাবার্তা বলছে হাঁটতে হাঁটতে। কথার ফাঁকে কখন যে পানিতে তার গোড়ালি ডুবে গেছে খেয়ালই নেই। তাজদার সিদ্দিকী দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো।
শাইনা ছেলেটার সাথে হাসছে, কথা বলছে, হয়তো জ্বরের ঘোরে কথা একটু বেশিই বলছে। তাজদার সিদ্দিকী পানি থেকে উঠে এল। শাইনা তার বন্ধুকে বলল, ওইটা!
তার বন্ধু জানতে চাইল, তোর হাসবেন্ড?
“হু।”

তার বন্ধু হঠাৎ বলে উঠলো, আরেহ এটা সেই লোকটা না যে স্কুল মাঠে ছাগল চড়ানো মঈন চাচার ছাগল বেঁধে রেঁধেছিল তাদের বাগানের গাছের পাতা খেয়ে ফেলেছিল বলে?
শাইনা হেসে উঠে বলল, কবেকার কথা এখনো মনে রেখেছিস। আমি ভুলেই গেছি।
“আরেহ হ্যাঁ তাই তো! ওইসময় আমাদের হেডমাস্টার গিয়ে ছাগলগুলিকে ছাড়িয়ে এনেছিল। একরাত বেঁধে রেখেছিল তবুও। কিছু মনে করিস না হা হা।”
তাজদার পানি থেকে উঠে এল। শাইনা তাকে দেখে পানি থেকে উঠে এল। তাজদার সিদ্দিকী তার পাশ থেকে যেতে যেতে পায়ের গোড়ালি দেখলো, এমনকি অল্প করে ভিজে যাওয়া শাড়িটাও!
শাইনা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এমনভাবে দেখার মানে হচ্ছে, বন্ধুর সাথে পানিতে নামতে অসুবিধা হয়নি?

যদিও কক্সবাজার আসার পথে অনেক পরিকল্পনা করেছিল তাজদার সিদ্দিকী কিন্তু সবটা জলে গেছে। শাইনার জ্বর বেড়ে গিয়েছিল তাই রাতারাতি রওনা দিতে হয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে দুজনের কথা বন্ধ। কেউ বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি কারো সাথে কথা বলতে।
তাসনুভা খুব খেপেছে শাইনার উপর। শাইনার জন্যই তাকে এভাবে ফিরে আসতে হয়েছে। সে অসম্ভব বিরক্ত। আনিসকে বলেছে আপনারা যেদিকে যান সেদিকেই একটা না একটা কেলেংকারী লেগেই থাকবে।
আনিস শান্তভাবে বলেছিল, হ্যাঁ আমিও সেটাই ভাবছিলাম। যেদিকে যাই সেদিকে সেই কেলেংকারীও যায়। আপদ!
তাসনুভা রেগে গিয়েছিল খুব। তার নাম কেলেংকারী বলতে চেয়েছে আনিস ভাই? হেসে হেসে বাঁশ দিতে জানে এরা খুব।

শাইনা মনে মনে একটা ভয় পাচ্ছিল যে বাড়ি ফিরে মস্তবড় ঝামেলা হবে। তাজদার সিদ্দিকীর অসম্ভব শান্ত হয়ে যাওয়াটা তার লক্ষ্মণ! আর সেটাই হলো।
বাড়ি ফিরে তাজদার সিদ্দিকী তার মা-বেশী প্রতিবেশী খালাকে জানালো, তার প্রতিবেশী বউ প্রতিবেশীদের বাড়িতেই চলে যাক। দরকার পড়লে কাবিনের টাকা নিয়ে হলেও।
বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে! সকালে খাবার টেবিলে তার অনুপস্থিতিতে সকলেই তার নামে সমালোচনা করছিল। রায়হান বলল,

“পরিবারের কারো সিদ্ধান্তকে পাত্তা না দিতে না দিতে ভেবেছে পরের মেয়েটার উপরও একই কাজ করবে। ওর জন্য সংসার আসেনি। আমি আগেই বলেছি মেয়েটার জীবনটা নরক হবে। কেউ কানে নাওনি। বউ আমাদেরও আছে। আমরা সম্পর্কে কতটা এফোর্ট দিচ্ছি ও চোখে দেখতে পাচ্ছে না? আজব!”
রওশনআরা বলল,”ওর যা ইচ্ছে করুক। ওর বউ ও এখানে রাখতে চাইছেনা তাই বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে লন্ডনে চলে যাবে বলছে। যা ইচ্ছে করুক আমি কিছু বলবো না।”
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বলল,”নাকি বউ নিয়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছে? একটা কথা শুনে নাও। ও যদি বউ নিয়ে একবার দেশের বাইরে পা রাখে তাহলে ওকে আর জীবনেও এমুখো করাতে পারবে না।”
সবাই চুপ! তাজদার কিছুক্ষণ পর সেখানে এল। সবাই অন্যান্য কথাবার্তা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাজদার নাশতা করার সময় জোহরা বেগম হঠাৎ বললেন,
“তোমার গায়েও তো জ্বর এসেছে বোধহয়! পানিতে গা ডুবিয়ে রেখেছিলে নাকি তাজ? ঔষধ নিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”

সে চুপচাপ খেতে লাগলো। একবারও রওশনআরার দিকে তাকায়নি। না রওশনআরা তার দিকে তাকিয়েছে।
জোহরা বেগম বলল,”তোমার নানী ফোনে জানিয়েছে তাজের বউ যেন তাকে দেখতে যায়। মানে নতুন বউকে দাওয়াত করেছে। যাও ঘুরে এসো। তারপর শাইনা নাইওরে যাবে। তোমার নানী কোনসময় দুনিয়া ছাড়ে ঠিক নেই। তোমার বিয়েতে আসতে পারেনি। তোমার উচিত বউ নিয়ে দেখে আসা। তোমার বউকে দেখতে চেয়েছে।”
তাজদার মাথা নাড়লো। হ্যাঁ না কিছু বললো না। শাইনার জ্বর খুব বেড়েছে। জ্বরের সাথে বমি হচ্ছে, পেট ব্যাথাও আছে। তার মনে হচ্ছিল সে আর বাঁচবে না। এত কষ্ট হচ্ছিল।
তাজদার বাড়িতে ফেরেনি বাবার সাথে তর্কতর্কি করার পর। ফিরবেনা সেটা শাইনা জানে। রওশনআরাও ঘর থেকে বের হয়নি। বাড়ির পরিস্থিতি খারাপ।

তাজমহল পর্ব ২৬

শাইনা তাদের বাড়ি চলে গিয়েছিল। আশরাফ তাকে রাতারাতি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে অবস্থা গুরুতর হওয়ায়।
তাজদার এসে দেখলো শাইনা বাড়িতে নেই। তিতলিকে জিজ্ঞেস করলো। তিতলি বলল, ওদের বাড়িতে গিয়েছে। চলে আসবে বলেছে।
তাজদার ভেবেছে সে চলে যেতে বলেছে সেজন্য চলে গিয়েছে। তাই সেও রাগের বশে আর খোঁজ নেয়নি। এমনকি আফসার সাহেবকে ফোন করে বলেছে, তাদের মেয়ে যেন আর এই বাড়ির চৌকাঠ পার না করে। আফসার সাহেব হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন!
এদিকে তাসনুভার হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে অভিযোগ এসেছে। আনিসের স্যারটি আর কেউ নয়। তাসনুভার মামা শ্বশুর ছিল।

তাজমহল পর্ব ২৮