তাজমহল পর্ব ৩৪
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
ওড়নাটায় শক্ত করে বাঁধা শাইনা। এবার সে আর নড়াচড়ার করার সুযোগ পেল না। চেষ্টাও করলো না। কারণ তার চেষ্টা বৃথা যাবে। তাজদারের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“আমি আপনার পায়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটব এটা দ্বারা আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”
তাজদার বলল,”খুব সিম্পল। তুমি আমার পায়ে ভর রেখে লন্ডনে উড়াল দেবে।”
শাইনা তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু চুপ থেকে আবারও তাকালো। শান্ত ভাবে বলল,
“ছেড়ে দিন। আর কতক্ষণ এভাবে থাকব?”
“যতক্ষণ আমি চাই।”
শাইনা শেষমেশ বলল,”বেশ, আমার কথার গুরুত্ব আপনি কোনোদিন দেননি। কোনোদিন দেবেন সেই আশাও আজকে ছেড়ে দিলাম।”
তাজদার ভ্রু গুলো কুঞ্চিত করে তাকালো। চ বর্গীয় শব্দ করে বলল,
“তুমি আমায় বুঝতে চাওনা কেন ষ্টুপিড লেইডি?”
শাইনা পাল্টা প্রশ্ন করলো,”আমি আপনাকে বুঝতে চাইনা নাকি আপনি আমাকে বুঝতে চান না? আপনি বলতে পারবেন আপনি আমার কোনো কথা দ্বিতীয় বার ভেবে দেখেছেন কিনা? আপনি শুনেছেন কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। আপনি আমার সাথে এমন বিহেভ করেন মাঝেমধ্যে মনে হয় আমাদের বহুদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আমার প্রতি আপনার এক্সপেকটেশন আকাশ ছোঁয়া আর আপনার প্রতি আমার?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তুমি আমার প্রতি এক্সপেকটেশন রাখতে পারো।”
“কীসের?”
“ওই নাটক সিনেমা গল্প উপন্যাসে যা দেখায়।”
শাইনা বলল,”ভালোবাসার প্রথম শর্ত হচ্ছে বোঝাপড়া। আপনার আমার মধ্যে বোঝাপড়া আছে?”
“বোঝাপড়া?”
“জি, বোঝাপড়া শুধু কথায়, আর কাগজে কলমে হয় না। একটা মানুষের চোখ দেখে তার ভেতরের যন্ত্রণা বুঝতে পারাটাও একটা বোঝাপড়া।”
“খুব জটিল সাবজেক্ট মমতাজ। আমাকে আবারও স্কুলে ভর্তি হতে হবে।”
শাইনা জানতে চাইল,”আগ্রহ আছে?”
“না থাকলেও হতে হবে।”
শাইনার ঠোঁটের কোণা চাপা হাসির রেখা দেখা গেল।
“আমি আপনাকে ভালো না বাসলে আপনার কি যায় আসবে?”
তাজদার সাথে সাথে বলল, “আমি তোমাকে বিয়েই করেছি এইসব পাব টাব এই আশায়।”
শাইনার এবার হাসিটা লুকোতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। সে জানতে চাইল,
“আপনি আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কি কি করেছেন?”
“আমি কোনোদিন কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করিনি। আমি অর্জন করে নেওয়ায় বিশ্বাসী।”
শাইনা হাসল। যেন সে কথাটা শুনতে চেয়েছিল কারণ কেউ কিছু চাইলেই তা সহজে দেওয়া যায় না। অর্জন করে নিলে সেটা অপরপক্ষ না দিয়ে থাকতে পারেনা। তাজদার সিদ্দিকী বোধহয় এই প্রথম তার মনের মতো একটা কথা বললো।
তাজদারের চোখ অন্যদিকে ঘুরে গেছে। মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। শাইনা তার মুখের দিকে ভালো করে তাকালো। বলল,
“আমাকে এখানে রেখে যেতে আপনার এত আপত্তি কেন? তাজদার সিদ্দিকী কোনোকিছুতে ভয় পাওয়ার মানুষ তো নয়।”
তাজদার তার দিকে তাকালো। বলল,
“আমরা বিরোধী দলের মানুষ। দূরে গেলে বিরোধ আরো বাড়বে গ্যারান্টি! তাছাড়া দূরে চলে গেলে মানুষ আরো দূরের হয়ে যায়। আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তোমার বিশ্বাস আলাদা হতে পারে।”
“আপনি বলতে চাইছেন কাছে থাকলেই শুধু মানুষ কাছের থাকে?”
“তুমি কি আমার সব কথার বিপক্ষে বিরোধী দলের মতো বক্তব্য দিতে প্রস্তুত থাকো?”
“মোটেও না। আপনি জানেন না দূর থেকেও মানুষকে কি চমৎকারভাবে ছোঁয়া যায়।”
তাজদার তার দিকে চেয়ে রইলো। শাইনা বলল,
“এই যে আপনি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছেন আপনার কোথাও একটা মনে হচ্ছে না আপনি তবুও আমাকে ধরতে পারেননি?”
তাজদার অবাক চোখে তাকালো। যেন তার সত্যিটা শাইনা ধরে ফেলেছে। শাইনা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝে ফেললো তার চোখের ভাষা। তাই তার চোখেও কিছুটা আনন্দ দেখা দিল। সে বলল,”চোখের মিলনই সব লন্ডভন্ড করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে যদি সেখানে ভালোবাসা থাকে।”
তাজদার চুপ করে তার কথা শুনলো। এর আগে সে শাইনার কথা এত ভালো করে শোনেনি। শাইনাও তার সাথে এত ধৈর্য নিয়ে কথা বলেনি। তারচেয়েও বড় কথা শাইনা আগে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো না। এখন চোখের দিকে তাকিয়েই কথা বলে দিব্যি!
তিক্ত বিরক্ত হয়ে ওড়নার বাঁধন খুলে ফেললো তাজদার। শাইনাকে বলল,
“এইসব খুব জটিল বিষয় মমতাজ। আমি এত মেহনত করতে পারব বলে মনে হয় না।”
শাইনা পালঙ্কে বসে ফুটবোর্ডে হাত রেখে তার উপর থুঁতনি ঠেকিয়ে হাসছে। তাজদার তাকে হাসতে দেখে বলল,”হাসছো কেন?”
শাইনা বলল,”আপনি চেষ্টা করলেও সেটা বৃথাই যাবে।”
“কেন?”
শাইনা বলল,”প্রেম, ভালোবাসা, মায়া-মহব্বত, উপলব্ধি এইসব বলেকয়ে হিসাব নিকাশ করে, মেপেঝুপে আসেনা। এইসব আসে প্রলয় হয়ে। একটা গোটা মানুষকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়ে আবার নতুন মানুষ বানায়। আপনি হাত বাড়িয়ে ডাকলেই সে আসবে না বাবুমশাই।”
তাজদার হম্বিতম্বি দেখিয়ে বলল,
“হাত বাড়িয়ে ডাকতে যাব কেন?”
“মন বাড়িয়েই ডাকুন কিন্তু তার আগে আপনার মনটাকে চিনতে শিখুন।”
তাজদার তার পাশে গিয়ে বসলো। বেশ দূরত্ব আছে মাঝখানে। প্রশ্ন করলো,”আমি চলে গেলে তোমার কিচ্ছু যায় আসবে না।”
“আমি আপনার সাথে যাব।”
তাজদার তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
“মিথ্যেবাদী।”
শাইনা বলল,”আরেহ সত্যি। আপনি যদি আমার কয়েকটা কথা মানতে পারেন।”
তাজদার সিদ্দিকী কিছু মুহূর্তের জন্য উত্তেজিত হয়ে উঠলো। কিন্তু নিজেকে শাইনার সামনে সংযত রাখলো। শাইনা মমতাজকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। শাইনা ভ্রু নেড়ে বলল,
“বলবো?”
তাজদার সিদ্দিকী মাথা হেলিয়ে বলল,”শুনি।”
শাইনা স্পষ্টভাবে নিজের মনের কথাটা বলে দিল,
“আমি যেদিন আপনাকে ওইসব মানে..
সে একটু ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দিয়ে। একটু জিরিয়ে এবার একনিঃশ্বাসে বলল,
“আমাদের মধ্যে যেদিন বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা এইসব কিছু একত্র হবে মানে আমি যেদিন আপনাকে, আপনি যেদিন আমাকে
মন থেকে ভালবাসবেন সেদিন আমি নিজেই আপনার সাথে চলে যাব কোনো শব্দ ছাড়া।”
তাজদার সিদ্দিকীর চেহারার রঙ পাল্টে গেল। সে জানতে চাইল,
“মন থেকে? এখন কিছু নেই?”
“অফকোর্স আছে। জীবনসঙ্গী হিসেবে নয়। শয্যাসঙ্গী হিসেবে। সরি বাট এটাই তিক্ত সত্য। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না। ইটস নর্মাল। আমি মেনে নিয়েছি। আমার এতে আপনার উপর ক্ষোভ নেই।”
শাইনা রাগারাগি ছাড়া তাজদার সিদ্দিকীর সামনে এত বড় সত্যি কথা তুলে ধরতে পেরেছে বলে নিজেকে ধন্য ধন্য করছে মনে মনে।
সে তাজদারের হাতের উপর আলতোভাবে হাত রাখলো। তাজদার একঝটকায় সরিয়ে নিল। শাইনা ভড়কে গেল।
তাজদার তার দিকে তাকিয়েই রইলো। শাইনা বলল,”আমি সরি যদি আপনাকে হার্ট করে থাকি। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হবেই। এই জগত সংসারে মানুষ মনের মিলটাকে খুব ঠুনকো বিষয় হিসেবে দেখে অথচ সবকিছুর আগে সেটাই প্রয়োজন। আপনি খুব ইনটেলিজেন্ট পার্সন। আমি আপনার সাথে কথা বলে আরাম পাচ্ছি। প্লিজ হার্ট হবেন না আমার কথায়।”
তাজদার রুক্ষ গলায় বলল,”আমাকে হার্ট করা এত সহজ নয়। ”
শাইনা একটু স্বস্তি পেল। কিন্তু তাজদার সিদ্দিকী পেল না। শয্যাসঙ্গী ছাড়া শাইনা মমতাজের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই এটা সে ভাবতে পারছেনা।
শাইনা মমতাজের উপর তার ক্ষোভ বাড়লো কিন্তু এটা অস্বীকার করার জায়গাও নেই। তাই হয়তো সে শাইনার দিকে একটুও না তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই এসে বসলো। তৌসিফ শাইনাকে বলল,”মেজ ভাই কোথায় গিয়েছে?”
শাইনা বলল,”আমাকে বলে যায়নি ভাইয়া।”
রওশনআরা তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর দিকে তাকালো। সবাই চুপচাপ হয়ে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। রায়হান বলল,”তুমি আইইএলটিএস দিচ্ছ?”
শাইনা একটু ইতস্তত করে কিছু বলার আগেই তাসনুভা বলল,”আইইএলটিএস দেওয়া এত সহজ? যারা ইংরেজিতে ভালো রেজাল্ট করে তাদেরও কেয়ামত হয়ে যায়।”
শাইনা আর কিছু বললো না। তিতলির সাথে সে যত কথা বলে তার একভাগও তাসনুভার সাথে বলেনা। কথাবার্তা হয় না তাদের মধ্যে।
তৌসিফ বলল,”পড়তে হবে ভালো করে। আমি ইংরেজিতে এত ভালো ছিলাম না। আমি দেইনি?”
তাসনুভা চুপচাপ খেতে লাগলো। আজ সে বাবা ভাইয়ের সাথে খেতে বসে গেছে। তাজদার থাকলে অবশ্য খেতে বসতো না।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘরে। সবার খাওয়াদাওয়া শেষের দিকে। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী আর তৈয়ব সিদ্দিকীর সাথে রায়হান, তৌসিফ মিলে বেশ কথাবার্তা বলছিল ঠিক তখুনি তাজদার বাড়ি এল। সবাইকে খেতে দেখলো একসাথে। তিতলি বলল,
“ভাইয়া খেতে আসো।”
তাজদার খেতে এল না। শাইনা তাকে ডাকতে গেল না। বরং ভাত তরকারি বেড়ে ঘরে নিয়ে এল। তাজদার ঠোঁট শক্ত রেখে কপাল কুঁচকে তাকালো।
শাইনা বলল,
“বড় আম্মু বলেছে আপনি নাকি রাগ করলে না খেয়ে থাকেন। শুনুন রাগ হলে আরও পেট ভরে খাবার খাবেন। দেখবেন রাগ আর রাগ থাকছেনা। খালি পেটে রাগও আরও বাড়ে।”
তাজদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো। শাইনা তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“রাগ হলে তোমার বড়আম্মু ভাত বেড়ে দেয়নি তাই খাইনি। কথাটা সে বলেনি কেন?”
শাইনা চুপ করে কথাটা শুনলো। ভাত বেড়ে দিল। কিন্তু তাজদার খেতে বসলো না। শাইনা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
তাজদার বলল,”তুমি খেয়েছ?”
শাইনা কিছু বললো না। তাজদার বলল,
“আশ্চর্য! একটা কথা জিগ্যেস করছি। এত কি ভাবছ?”
শাইনা বলল,”ভাবছি, আপনি এর আগে কখনো আমাকে এই ধরণের প্রশ্ন করেছেন কিনা।”
তাজদার নিজেও মনে করার চেষ্টা করলো। কি আশ্চর্য! যার সাথে একঘরে একসাথে থাকে তাকে কখনো জিগ্যেস করা হয়নি সে খেয়েছে কিনা ব্যাপারগুলো অদ্ভুত না?
তাজমহল পর্ব ৩৩
শাইনার আচমকা মন খারাপ হলো। সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট ভাসছে। তাজদার সেটা খেয়াল করলো। শাইনা মন খারাপ লুকিয়ে বলল,
“খেয়ে নিন প্লিজ নইলে রান্নাঘরে গিয়ে আমাকে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে।”