তাজমহল পর্ব ৩৫
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
তাজদার স্পষ্ট স্বরে বলল,”আমি ভাত খাব না। তুমি নিয়ে যাও। নয়তো নিজেই খেয়ে নাও।”
এতক্ষণ শান্ত গলায় কথা বলছিল শাইনা। এবার একটু কঠোর ভঙ্গিতে তার দিকে তাকাল। তাজদার শার্ট হাতে নিতে গিয়ে শাইনারের দৃষ্টি টের পেল। ডান ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,”কি?”
শাইনা কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ গ্লাসে পানি ঢালতে লাগল। তাজদারও থেমে গিয়ে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আবার কী ভুল করল সে? আশ্চর্য! এভাবে তাকানোরই বা কী আছে!
পানি ঢালা শেষ করে শাইনা ধীরে ধীরে মুখ তুলল। ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“আপনি আসলে মিষ্টি কথা হজম করার মতো মানুষ নন।”
তাজদার স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখ কুঁচকে বলল,
“আমি আবার কী করলাম?”
শাইনা হঠাৎ চেঁতে উঠে বলল,
“কি করেছেন মানে? আপনাকে ভাত খেতে বলছি, তখন খেয়ে বসবেন। খাব না এটা কেমন কথা?”
তাজদার শার্টটা নামিয়ে রেখে ধীরস্বরে উত্তর দিল,
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না তাই খাব না। কিন্তু তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
শাইনা তার সাথে আর কোনো কথাবার্তা না বলে সোজা বিছানায় উঠে বসল। পিঠের নিচে বালিশ ঠেসে দিয়ে পা ভাঁজ করে শান্ত গলায় বলল,”খেয়ে নিন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথাটার ভেতরে আদেশের সুর।
তাজদার টেবিলে রাখা ভাতের প্লেট আর তরকারির বাটির দিকে তাকালো। তারপর দৃষ্টি গেল শাইনার দিকে। শাইনা তখন চোখ বুজে বসে আছে।
তাজদার বলল,”আমি যদি বলি খাব না তাহলে তুমি কি আমাকে জোর করে খাওয়াবে শাইনা মমতাজ?”
শাইনা এবারও নীরব। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
মনোযোগ পাওয়ার জন্য তাজদার আবার বলল,
“এগুলো এভাবে পড়ে থাকবে, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আমি খাব না মানে খাব না।”
কিন্তু সেটা নিছক মুখের কথা নয়। তাজদার সিদ্দিকী একবার সিদ্ধান্ত নিলে, তার চৌদ্দ গোষ্ঠীর সাধ্য নেই তাকে টলাবার। এটাই সবসময়কার নিয়ম। শাইনা মমতাজের জন্য সেটা কখনো পরিবর্তন হবে না।
তাজদারও বিছানায় উঠে বসল। কিছুক্ষণ পরে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল, একহাত তুলে চোখ ঢেকে রাখল। শাইনাও চোখ বুজে শুয়ে রইল। আজ যদি তাজদার সিদ্দিকী ভাত না খায় তাহলে সে কী করবে তা নিজেও জানে না।
সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু না, তাজদার সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে কোনো নড়াচড়া নেই। এমন জেদি মানুষ সে জীবনেও দেখেনি।
ঘুমিয়ে পড়েছে? শাইনার ভেতরে রাগ ফোঁসফোঁস করছে। একবার তাকিয়ে দেখল সে, তারপর আবারও শুয়ে পড়ল।
ঠিক তখনই তিতলির গলা ভেসে এল,”শাইনা ভাত খেতে আসো।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বর পাল্টে গেল,”ভাবি ভাত খেতে আসেন।”
শাইনা হঠাৎ তাজদারের দিকে তাকাল। তারপর শক্ত করে ধরে হাতটা চোখের উপর থেকে সরিয়ে দিল। হাতটা নামতেই তাজদার সিদ্দিকী এমন দৃষ্টিতে তাকাল যে শাইনার সব কথা আটকে গেল গলায়।
তাজদার ধীরস্বরে বলল,”সমস্যা কী?”
শাইনা একটা শব্দ উচ্চারণ করল,”ভাত।”
তাজদার ভ্রু কুঁচকে বলল,”বলেছি খাব না। কথাটা কি কথার মতো শোনায়নি? আমি কি তোমার সঙ্গে মশকরা করছি?”
ঠিক তখনই আবারও তিতলির ডাক শোনা গেল,”আম্মু ডাকছে। ভাত খেতে আসো..ভাবি-ইইই?”
তাজদার শুনে নির্লিপ্ত স্বরে বলল,”যাও।”
শাইনা চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো। তাজদার তখনও শুয়ে আছে। শাইনাকে দেখে আবার জিজ্ঞেস করল,”সমস্যা কী?”
এবার শাইনা কোনো জবাব দিল না।
তাজদার কপাল কুঁচকে তার দিকে চেয়ে আছে। শাইনা একদম সোজা গিয়ে তার পাশেই শুয়ে পড়ল গায়ের উপর কাঁথা টেনে। তাজদার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। তারপর হঠাৎ কনুইয়ের ভর দিয়ে ঝুঁকে শক্ত করে শাইনাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আনল।
শাইনা বিরক্ত মুখে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,”কি চায়?”
তাজদার ধীরস্বরে জিজ্ঞেস করল,”তুমি না খেয়ে চলে এসেছ?”
শাইনা ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,”আমি না খেলে আমাকে জোর করে খাওয়ানোর মতো আহ্লাদী মানুষ তো এই বাড়িতে নেই।”
সে আবারও তার হাত সরিয়ে দিল। তাজদার গম্ভীর স্বরে বলল,”টেবিলে যা রাখা আছে সেগুলো খেয়ে নাও মমতাজ।”
শাইনা পাশ ফিরেই শুয়ে রইল। তাজদার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,”তুমি খাচ্ছ না কেন? আমার না খাওয়ার সাথে তোমার কী সম্পর্ক?”
শাইনা এবারও কোনো উত্তর দিল না। তাজদার বিরক্ত হয়ে তাকে জোরে টেনে তুলে বসল করাল। শক্ত কণ্ঠে বলল,”খেয়ে নাও চুপচাপ। ভাত খাওয়া নিয়ে আমি আর কোনো কথা বাড়াতে চাই না।”
শাইনা তার চোখে চোখ রেখে খেপাটে দৃষ্টিতে বলল,”আপনি ভাত না খেয়ে ভালো করেননি। আমি আর কোনোদিনও আপনাকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করব না। যারা মানুষের অনুরোধ-আবদার পায়ে ঠেলে দেয় আমি তাদের কাছে দ্বিতীয়বার যাই না অনুরোধ আবদার নিয়ে। কথাটা মনে রাখবেন।”
কথাটা বলেই সে হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে গেল।
তাজদার তার দিকে তাকিয়েই রইল। শাইনা চুপচাপ চেয়ার টেনে ভাত খেতে বসল। মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। তাজদার বালিশে মাথা রেখে ঠোঁটের কাছে হাত ঠেকিয়ে আঁড়চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
শাইনা খাওয়া শেষ করেই সোজা গিয়ে শুয়ে পড়ল। আঁড়চোখে তাকাতেই তাজদারও তাকাল। এবার শাইনা সরাসরি চোখে চোখ রাখল। তাজদার তা দেখে গলা ঝাড়ল। চোখ সরিয়ে নিল।
শাইনা কাঁথা টেনে নিতে নিতে ঠান্ডা স্বরে বলল,”খাবারের সাথে ফালতু রাগ দেখাই না আমি। বেকুবরা শুধু এইসব রাগ দেখিয়ে নিজেকেই কষ্ট দেয়। আই লাভ মাইসেলফ।”
তাজদার কোনো কথা বলল না। শাইনা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সে দেখলো বাসনটা খালি। শুধু মুরগির হাড়গোড় পড়ে আছে, সাথে একটা চামচ। সে নিজে মাত্র কয়েক লোকমা খেয়েছিল, বাকিটা…..
বাসনগুলো রান্নাঘরে নিতে নিতে শাইনার ঠোঁটের কোণায় যে হাসির রেখাটা ফুটলো কিছুক্ষণের জন্য সেটা তাজদার দেখে ফেললো ঘর থেকে বেরোনোর সময়। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,”সকাল সকাল জ্বিনে ধরেছে নাকি? হাসছো কেন?”
শাইনা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,”বিড়ালের বেশে জ্বিন ঘরে ঢুকতেই পারে। ছোটবেলায় দাদীর মুখে শুনেছি।”
তাজদার অবাক হয়ে বলল,”বিড়াল?”
শাইনা গম্ভীর গলায় বলল,”জি। বাসনে অর্ধেক ভাত ছিল সেগুলোও খেয়ে গেছে। বিষয়টা বড়আম্মুকে জানাতে হবে। নতুন বউয়ের ঘরে জ্বিন-ভূত থাকাটা ভীষণ অস্বাভাবিক। আপনি কি কাল রাতে কোনো অস্বাভাবিক কিছু টের পেয়েছিলেন?”
সে একেবারে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল।
তাজদার এড়িয়ে গিয়ে কাবার্ড থেকে কাপড়চোপড় বের করতে লাগল। কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি। হঠাৎ থেমে শাইনাকে জিজ্ঞেস করল,”ব্লু রঙের ওয়েস্টকোটটা কোথায়?”
শাইনা ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি টেনে উত্তর দিল,”হয়তো বিড়ালটাই চুরি করে নিয়ে গেছে রাতে।”
তাজদার মাথা দুলিয়ে বলল,”হতে পারে। সকাল থেকে আবার আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাটা বেড়েছে। কি ভুলভাল খেয়েছি কে জানে। লক্ষ্মণ ভালো না।”
এতক্ষণ শাইনার বেশ মজা লাগছিল। কিন্তু এবার সে সত্যিই রেগে গেল। তাজদারের সাথে আর কোনো কথা না বলে সে সোজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার এঁটো খেয়ে গ্যাস্টিক?”
বাড়ির উঠোনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বউ নিয়ে রওশনআরা যাবেন মামার বাড়ি। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাজদার আনিসের সাথে কথা বলছে।
অনেক আগে থেকেই কথা ছিল নতুন বউকে নিয়ে বেড়াতে যাবে তাজদার। কিন্তু নানা কারণে যাওয়া হয়নি। এবার রওশনআরা জোর করলেন সময় ফুরিয়ে আসছে বলে। ছেলে-বউকে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে আসা দরকার। তাজদার চাইছিল না কিন্তু শাইনা এমনভাবে রাজি করাল তাতে মনে হয়েছে ব্যাপারটা আসলে তারই ইচ্ছে, রওশনআরার নয়।
তাজদার তাই সম্মতি দিল। আজকাল সে বউয়ের মন পাওয়ার চেষ্টা করছে খুব। উদ্দেশ্য একটাই শাইনাকে সাথে নিয়ে লন্ডন যাওয়া। দরকার হলে সে ছ’মাস যাত্রা পিছিয়ে দেবে কিন্তু একা যাবে না। তবে সেটা আদৌ হবে কি না সে নিজেই নিশ্চিত নয়।
রওশনআরা শাইনাকে বলেছে যেহেতু গাড়িতে করেই যাচ্ছ, তাই শাড়ি আর হিজাব পরো। বোরকা পরতে হবে না। সোজা আমাদের বাড়ির গেইটের সামনে গিয়েই থামবে গাড়ি।
শাইনা তার কথামতো গোল্ডেন রঙের একটা শাড়ি পরেছে, সাথে খয়েরি ব্লাউজ, ব্লাউজে সিকুয়েন্স আর স্টোনের কাজ আছে সাথে মানানসই হিজাব আর ব্যাগ। দামি শাড়িটা তার গায়ে অসাধারণ মানিয়েছে।
রওশনআরা তিতলিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছেন। শাইনা তাদের পিছুপিছু বেরিয়ে এল। আনিসকে দেখে একটু থামল। আনিস রওশনআরার সাথে কথা শেষ করে শাইনাকে লক্ষ্য করল।
শাইনা বলল,”আজ অফিস?”
আনিস বলল,”আজ ছুটি নিয়েছি।”
“আচ্ছা আসি। আম্মাকে বলো আমি গেলাম।”
“সাবধানে যাস।”
“আচ্ছা।”
ভাইয়ের সাথে কথা বলে শাইনা গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক তখনই তাজদার এগিয়ে এল। গাড়ির কাছে এসে নিচু স্বরে বলল,
“মেকআপ কম হয়েছে শাইনা মমতাজ।”
শাইনার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠল।
সে মোটেও একগাদা মেকআপ করেনি। তবুও সে জানে তাকে সুন্দর লাগছে। খারাপ লাগছেনা।
এই লোকটা ইচ্ছে করে এমন বলছে যাতে সে রেগে যায়। তার চোখমুখ গরম হয়ে উঠল, ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল। ঠিক তখুনি তৌসিফ দৌড়ে এসে রওশনআরাকে বলল,”বড় আম্মু আমিও যাচ্ছি।”
রওশনআরা বলল,”তুই ড্রাইভিং ভালো করে শিখেছিস তো? নাকি..
তৌসিফ বলল,”শিখেছি শিখেছি।”
তিতলি আদেশ দিল,”ড্রাইভার সাহেব এসিটা অন করে দিন।”
তৌসিফ জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তার মাথা চাপড়ে দিল। তিতলি চেঁচিয়ে উঠলো,
“আমার চুল! বাঁদর কোথাকার।”
তৌসিফ ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। তার পাশের সিটে তাজদার। তাসনুভা এসে রওশনআরার পাশে বসবে জানালো।
তাই তিতলি নেমে গিয়ে শাইনার পাশে বসলো। বলল,
তাজমহল পর্ব ৩৪
“শোনো তোমাকে বখশিশ টখশিশ দিলে সোজা নিয়ে ফেলবে। না না করবে না। ঠিক আছে?”
শাইনা বলল,”পাগল!”
গাড়ি ছেড়ে দিল। তিতলি বলল,”আমার বড় মামা বড় মামি ছোট মামা ছোট মামি..
তাসনুভা ধমকে উঠে বলল,”তিতলি চুপ। বেশি কথা বলো তুমি। কান উড়ে যাচ্ছে। এত কথা কীসের?”
বলেই সে কানে ইয়ারপিস গুঁজে দিল। তিতলি মুখ মোচড় দিয়ে বলল,”সব জায়গায় একে মাতব্বরি দেখাতে হবে।”