তাজমহল পর্ব ৩৭

তাজমহল পর্ব ৩৭
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

শাইনা বিলে ঘুরলো কিছুক্ষণ। তারপর বাড়ি চলে এল তাজদারের সাথে। তাজদার বাজারে চলে গিয়েছে। বাজার থেকে একদম ফিরলো খাওয়ার একটু আগে। ছোটবেলায় যেসব জায়গায় যেত সেখানেও গিয়েছে সে।
নতুন ভাগ্নে বউয়ের জন্য রান্নাবান্নার এলাহি আয়োজন। শাইনার পেট ভরে গিয়েছে খাবার দেখে। খুব বেশি খেতে পারলো না সে। সবাই বলাবলি করলো বউয়ের বোধহয় রান্না পছন্দ হয়নি।

রওশনআরা ছেলের বউয়ের স্বপক্ষে বলল, না না ও এতটুকুই খায়। এরচেয়ে বেশি খায় না।
খাওয়াদাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে বেশ গল্পের আসর বসলো। শাইনার খুব ভালো লেগেছিল। তাজদার জানালো তারা কালই রওনা দেবে। একদিন থাকতেই এসেছে। তার অনেক বন্ধু-বান্ধব আর স্যারদের বাড়িতে দাওয়াত আছে।
তাদের যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে সেটা বেশ বড়সড় আছে। কয়েকটা আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো গোছানো। শাইনা সুতির সেলোয়ার-কামিজ পরে বিছানায় শুয়ে পরেছে। শাড়ি, সাজগোজ রীতিমতো বিরক্ত লাগছিল তার।
বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়েছে সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাজদার ঘরে আসামাত্র হাত পা গুটিয়ে নিল। ওড়নাটা টেনে নিয়ে চোখ বুঁজে শুয়ে রইলো। তাজদার তার দিকে তাকিয়ে হাতের ঘড়ি খুলে নিল। একটানে টিশার্ট ছাড়িয়ে একটা শার্ট পরে নিল। শাইনা আঁড়চোখে সেটা খেয়াল করলো। বেড়াতে এসেও শার্ট পাল্টানো কমেনি।
এই লোকটা বড়আম্মুকে খুব জ্বালিয়েছে ছোট থেকে। এখন তাকে জ্বালাচ্ছে।
তাজদার শার্টটা পরে আয়নায় তাকিয়ে তাকিয়ে শার্টের হাতা গুটালো, কলার ঠিকঠাক করলো। শাইনার দিকে তাকাতেই শাইনা একদম ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকলো।
তাজদার তার পাশে এসে শুয়ে পড়লো কিছুক্ষণ পর। শাইনার একদম নড়াচড়া নেই। তাজদার বলল,
“তুমি এদিকে ফিরো। নইলে আমি তোমাকে এখন জাপ্টে ধরবো।”

শাইনা একদম চুপ। সে দেখতে চায় এই তাজদার সিদ্দিকী ঘুমের মধ্যে তার সাথে সাথে কি কি করে। তাজদার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর হঠাৎ শাইনার কানের কাছে গিয়ে বলল,”ধরলাম।”
শাইনা চমকে উঠে তার দিকে ফিরে গেল। বড় বড় চোখ করে তাকালো। তাজদার ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”ভয় পেয়েছ?”
শাইনা চুপ। তাজদার তার নাক চেপে দিয়ে বলল,”চলো ইংলিশ মুভি দেখবে। The Matrix.”
শাইনা বলল,”আমি বুঝিনা। ওরা খুব ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলে।”
“সাব টাইটেল আছে। বুঝে যাবে।”

তাজদার ল্যাপটপটা চালু করলো। পেট বরাবর রাখলো। শাইনার দিকে কপাল কুঁচকে তাকাতেই শাইনা তার পাশে এসে পিঠের নিচে বালিশ রেখে শুলো। আগামাথা কিছুই বুঝছেনা সে। কপাল কুঁচকে দেখছে। তাজদার তাকে সংক্ষেপে বলে গেল কি হচ্ছে, কি ঘটছে, কি হতে চলেছে। শাইনা বলল,”বোরিং!”
তাজদার বলল,”গাধী এগুলো অ্যাকশন থ্রিলার। ফিলোসফিকাল টুইস্ট আছে। মন দিয়ে দেখো।”
শাইনা বলল,”গাধী ডাকলেন তাই আর দেখবো না।”

বলেই সে ফিরে যাচ্ছিল। তাজদারের হাত তার মাথার নিচে গিয়ে তাকে টেনে ধরলো। শাইনার মাথা তার বাহুর উপর এসে থামলো। তাজদার বলল,”চুপচাপ দেখো। কোনো কথা না।”
শাইনা মন দিয়ে মুভিটা দেখতে লাগলো। মাঝেমাঝে অবাক হয়ে তাজদারকে জিজ্ঞেস করলো এইটা এমন তো? আমি ঠিকই ধরছি?” তাজদার ধৈর্য ধরে বোঝাল। মুভির কাহিনি বুঝে ফেলার আনন্দে সে এক্সাইটেড হয়ে পড়ল।
দেখতে দেখতে তার মাথাটা অচেতনেই তাজদারের বুকের উপর গড়িয়ে এলো। চোখ দুটো আধবোজা হয়ে এল। পুরোটা শেষ করতে পারলো না, তার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
তাজদার কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে রইল তার দিকে। একরকম হতাশ নিঃশ্বাস বের হলো। বাংলা সিনেমার প্যানপ্যানানি দেখতে বললে সারারাত জেগে থাকতো। গাধা!
ল্যাপটপটা পাশে রেখে দিয়ে ধীরে ধীরে শাইনাকে দু’হাতে টেনে নিল বুকের কাছে। শাইনাকে দুইহাতে আঁকড়ে ধরে চোখ বুঁজলো ধীরেধীরে।

পরদিন বিকেলে সবাই রওনা দিয়েছে পটিয়ার উদ্দেশে। তারপর দিন সকালে শাইনাকে দেখতে তার শাহিদা বেগম এসেছেন। রওশনআরার সাথে গল্পগুজব শুরু করে দিয়েছেন আনিসের বিয়ে নিয়ে। শাইনা চা বানাচ্ছিল। তাসনুভা ফ্রিজ ঘাটাঘাটি করে তার প্রিয় চকলেটটা বের করে নিচ্ছে। তিতলি আপেলের গায়ে কামড় বসাতে বসাতে বলল,
“চাচীমা ভাইয়া যাওয়ার আগে বিয়েটা হলে খুব ভালো হবে। খুব মজা হবে।”
শাহিদা বেগম বললেন,”চেষ্টা তো করছি মা।”
রওশনআরা বলল,”মেয়ে এখনো ঠিক হয়নি?”
“আনিসই মেয়ে পছন্দ করছেনা। বেশি সুন্দর মেয়ে নাকি ও বিয়ে করবে না। ওকে কে এইসব কানে ঢুকিয়ে দিয়েছে কে জানে। ওই ধরনের মেয়ে নাকি আমাকে বাছবে, আমার ঘরদোর বাছবে, আমার সংসারে নাকি থাকবে না। এটা কোনো কথা? আশরাফের বউই তো শহুরে মেয়ে। ও থাকছেনা?”
রওশনআরা বলল,”ও যেটা ভালো মনে করছে আর কি।”

তাসনুভা চকলেট মুখের মধ্যে দিয়ে মুখ নেড়ে খেতে খেতে বলল,”চাচীমা আসলে সুন্দরী মেয়েদের সবাই এফোর্ড করতে পারে না। আনিস ভাই ঠিক ভয়টাই পাচ্ছে।”
শাহিদা বেগম তার কথাটা বুঝে গেছেন। তাকে কোনোরকম জবাব দিল না। শুধু রওশনআরাকে বলল,”আমার ছেলেগুলো হয়েছে ওদের বাপের মতো। বড়টাকেও পছন্দ করে বিয়ে করালাম। এখন মেঝটাকেও করাতে হবে। কত ছেলে মেয়ে পছন্দ করে নিজেরাই বিয়ে করে নিচ্ছে আর আমার গুলো মা বাবার দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।”
রওশনআরা চুপ করে রইলো। শাইনা চোখের ইশারায় মাকে বললো বেশি কথা না বলতে।
রওশনআরার চেহারা ভার হয়ে গেছে।
শাহিদা বেগম মেয়ের ইশারা দেখে আর কিছু বললেন না। শাহিদা বেগম আসার সময় খালি হাতে আসেননি। মেয়ের জন্য অনেককিছু নিয়ে এসেছেন। এমনকি এটাও বলে গেলেন উনি অনেকগুলো কাঁথা সেলাই করতে দিয়েছেন। শাইনা কিছু বলেনি মাকে।

এতক্ষণ বেশ ভারী বৃষ্টি থাকলেও এইবার বৃষ্টি পড়ছে ঝিরিঝিরি। তাসনুভা ছাতাটা ঘুরাতে ঘুরাতে পুলের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এদিকের রাস্তাটা খুব সুন্দর। ছবি দারুণ উঠে। তার একটা ছাতা হাতে ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল।
যেহেতু সচরাচর এদিকে আসা হয় না। তাই ছবি তোলাও হয়নি কখনো। পুলটা কিছু মাস আগেই নতুন নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি গাছ তারপর পুলটা একটু উপরে উঠে গেছে। খরনার মেইন রাস্তার একটু আগে।
হঠাৎ একদল ছেলেপেলে আসছিল কথা বলতে। সবার হাতেই ছাতা আছে। প্যান্ট গোড়ালির উপর তুলে দেওয়া। কারো হাতে বাজারের থলে। তাসনুভার চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। সে হাত নেড়ে ডাকলো,

“আনিস ভাই!”
আনিসের মুখ ঢেকে গিয়েছিল ছাতার নিচে। তার নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে সে সামনে পেছনে তাকালো। তাসনুভার সামনে দিয়ে একটা রিকশা গেল তখুনি। রিকশাটা যাওয়ামাত্রই আনিস তাসনুভাকে দেখলো। তাসনুভা হাত নাড়তে নাড়তে বলল,
“একটু এদিকে আসেন।”
আনিস বন্ধুদের কি যেন বলে এগিয়ে এল। জানতে চাইল,”কি হয়েছে?”
তাসনুভা বলল,”আপনার বাজারের থলেটা ওই গাছতলায় রাখেন প্লিজ।”
“কেন?”
“রাখেন না।”
“আগে কারণ বলো।”

তাসনুভা বলল,”আমাকে কয়েকটা ছবি তুলে দেবেন প্লিজ। আমি এই রাস্তা দিয়ে কোথাও যাইনা। অনেকদিন পর এসেছি। কয়েকটা ছবি তুলে দেন।”
আনিস অবাক হয়ে বলল,”সিরিয়াসলি তুমি!”
তাসনুভা বলল,”প্লিজ থলেটা ওইখানে রাখেন। আচ্ছা আমাকে দেন। রেখে আসি।”
“না দরকার নেই।”
আনিস থলেটা রেখে এল। তাসনুভা খুশিমনে তার দিকে নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিল। তারপর একদৌড়ে পুলের উপর উঠে গেল। ছাতা নিয়ে, ছাতা ছাড়া, পিঠ করে দাঁড়িয়ে, হাত মেলে মুখ আকাশের দিকে তাক করে নানান অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুললো সে।
তারপর দৌড়ে দৌড়ে চলে এল। আনিসের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলল,
“থ্যাংকস! আপনি দারুণ ছবি তোলেন। আপনার বউ খুশি হয়ে যাবে।”
আনিস বলল,”ভুল কথা। মেয়েমানুষ শুধু ছবি তুলে দিলে খুশি হয় না।”
তাসনুভা প্রতিবাদ করে বলল,”কে বলেছে? আমার ছবি তুলে দিলে আমি খুব খুশি হই।”
আনিস আস্তে করে বলল,”ভালো।”

শাইনার ঘরটা তার কাছে স্বস্তির। বড় একটা জানালা আছে। খোলা রাখলে আর ঠান্ডা বাতাসের অভাব হয় না। তার বেশিরভাগ সময় কাটে জানালার ধারে বসে।
কট করে দরজা খুলে গেল হঠাৎ। শাইনা চমকে উঠলো। তাজদার ঘরে ঢুকলো। সাথে সাথে বলল,
“তোমার ফোন কোথায়?”
শাইনা বিছানার দিকে তাকালো। তাজদার সোজা বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো। শাইনা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
তাজদার তার শেয়ার দেয়া স্টোরির ছবিটা দেখিয়ে বলল,”এগুলো কি?”
শাইনা চুপ। ছবিটাতে লেখা ছিল,

“কত প্রেমিক মরে যায় প্রেমিকার অভাবে,
কত মানুষ বউ হারায় নিজেরই স্বভাবে।”
শাইনা হেসে বলল,”একটা সিম্পল স্টোরি। এত গায়ে লাগার কারণ?”
তাজদার স্টোরিটা ডিলিট করে দিল। শাইনা বলল,”আপনার বউ হারিয়ে যাবে বলে?”
তাজদার বলল,”ইউ ষ্টুপিড আমাকে সারাক্ষণ চেতিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে না।”
শাইনা মুচকি হাসলো। বলল,
“আপনি হয়তো জানেন না। ভাঙার জন্যই কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা ট্রুথ। সে যাইহোক শার্টটা দিন। ওয়াশিং মেশিনে কাপড় পরিষ্কার হয় না আমার মনে হয়।”
তাজদার বলল,”আমার যতদিন বলশক্তি আছে ততদিন আমার কাপড়চোপড় কাউকে ধুতে হবে না।”
শাইনা মিষ্টি করে হেসে বলল,”বেশ, যতদিন গায়ে বলশক্তি আছে ততদিন বউ ছাড়া থাকুন। বুড়ো বয়সে আসবো সেবা করতে।”

বলেই সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাজদার তার বাহু চেপে ধরে তাকে সামনে টেনে এনে বলল,
“ওকে ফাইন। আজ থেকে সব কাপড় তুমিই ধোবে। দেখি কতদিন পারো।”
বলেই শার্টের বোতামে যেই হাত দিল অমনি শাইনা বলল,”ছিঃ বাবুমশাই আপনাকে বললাম শার্টটা দিতে তাই বলে আমাকে এভাবে সামনে দাঁড় করিয়ে লাইভ টেলিকাস্ট দেখাবেন? ওয়েট আমি আপনার আরেকটু উপকার করে দিচ্ছি। ভিডিও করে রাখছি, আপনি এবার খুলুন।”
তাজদার শার্টের বোতামে হাত রেখে থেমে তার দিকে খেপাটে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। শাইনা চাপা হেসে সরে গেল। ভিডিও অন করে বলল,
“এবার যা করার করুন।”

তাজদার লম্বা পা ফেলে তার কাছে চলে এল। শাইনা একলাফে অন্যদিকে চলে গেল। তাজদার বলল,
“ইউউ!!! সামনে আসো। নয়তো দাঁড়িয়ে থাকো। আমি তোমাকে ধরবো।”
শাইনা জিভ দেখিয়ে বলল,”মামার বাড়ির আবদার!”
তাজদার আগেভাগে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,”আমি তোমাকে আজ ধরবোই। হুদাই রাগিয়ে দিয়েছ আমাকে।”
শাইনা হাসছে ইচ্ছেমতো। তার হাসি তাজদারকে আরও রাগিয়ে দিচ্ছে। সে শাইনার দিকে একপা এগোতে গেলে শাইনা দশপা দূরে সরে গিয়ে হেসে যাচ্ছে। হাসির খুব বেশি শব্দ হচ্ছে না অবশ্য। তাজদার আরেক পা এগোতেই শাইনা সরে গেল আবারও। ওড়না মুখে চেপে হাসছে সে।
তাজদার আর এগোলো না। রকিং চেয়ারে বসে গলা হালকা কাত করে বসে ঠোঁটের কাছে হাত বুলিয়ে বলল,
“বেরিয়ে যাও।”

শাইনা চোখ কুঁচকে ফেলে বলল,”চালাকি? আমি দরজা খুলতে গেলে আপনি আমাকে ধরে ফেলবেন। আমি আপনার ফাঁদে পা দেব না।”
তাজদার মাথা নেড়ে বলল,”না তোমাকে ধরবো না আমি।”
“কেন?”
“তোমাকে ধরার চাইতে ধরবো ধরবো ব্যাপারটা বেশি সুন্দর।”
শাইনা হাসি চাপা দিতে না পেরে বলল,”ওলেবাবালে!”
রাতে শাহিদা বেগম শাইনাকে কল দিয়ে বলল,”দেখেছিস কান্ড? আনিসকে নাকি আজকে কোন একটা মেয়ের সাথে দেখা গিয়েছে খরনা রাস্তার মাথায়।”

তাজমহল পর্ব ৩৬

“কোন মেয়ের সাথে?”
শাহিদা বেগম ফিসফিস করে বললেন,”ওটা নাকি তোর ননদ। আনিস নাকি ওর ছবি তুলে দিচ্ছিল।”
শাইনা বলল,”তো?”
“তো আবার কি? ওজন্যই তো ও কোনো মেয়েটেয়ে পছন্দ করছেনা। বুঝতে পারছিস না বেকুব?”

তাজমহল পর্ব ৩৮