তাজমহল পর্ব ৪৭
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
ঘুম থেকে উঠে শাইনা গোসল করে নিল। অবেলায় গোসল করা নিয়ে শাহিদা বেগম প্রায়সময় চেঁচামেচি করলেও আজ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অন্য সময় দাদীমা আর মায়ের গলা শোনা যায়। আজ শোনা যাচ্ছে না। শাইনা গোসল করে বের হলো।
ওড়নাটা কাঁধের একপাশে ঝুলিয়ে তোয়ালেটা কাঁধের অন্যপাশে ফিরিয়ে মোচড়াতে মোচড়াতে রান্নাঘরে এল।
সাবরিনা একাই আছে রান্নাঘরে। চা বসিয়েছে। বিকেলে সবাই চা খায়। আজ ভাইয়ারা এখনো বাজার থেকে আসেনি। শাইনা ফ্রিজ খুলে একটা মাল্টা নিল। সাবরিনা ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে বলল,”সারাক্ষণ মাল্টা খেয়ে খেয়ে থাকবে?”
শাইনা মাল্টার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,”হু, বাড়ির সবাই কোথায়? আজ বাড়ি খালি?”
“দাদীমা তোমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছে। আম্মা বাইরে আছে বোধহয়।”
“রাত হলেই দুজনের টো টো করা বেড়ে যায়।”
মাল্টা খাওয়া শেষ হতে না হতেই শাওন নেয়েঘেমে বাড়ি এল। শাইনা কিছু জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল। শাওন তখুনি বলল,
“তুই রেডি হ। চল আমার সাথে।”
পেছন থেকে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে শাহিদা বেগম বললেন,”বৌমা একটু ওর বোরকাটা বের করে দাও।”
শাওন বলল,”ওঠ! হাঁ করে কি দেখছিস?”
শাইনা মৃদুস্বরে জানতে চাইল,”কোথায়?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শাওন অবাককণ্ঠে বলল,”কোথায় মানে? তোর বরকে মহিষে মেরে ফেলে রাখছে গোটা এলাকা জানে তুই জিগ্যেস করছিস কোথায়? এখনো রক্তবন্ধ হয়নি। মুখ দিয়ে শ্বাস ফেলছে। রাতের মধ্যেই অপারেশন দিতে হবে। বড়আব্বু বলছে তার আগে তোকে আর বড়আম্মুকে নিয়ে দেখাতে। চল।”
নিয়ে দেখাতে মানে? শাইনা শাহিদা বেগমের দিকে তাকালো। শাহিদা বেগম বললেন,”আনিস বলছে অবস্থার একটু উন্নতি হলে তোকে বলতে। কিন্তু..
উনার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। শাইনার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে, কণ্ঠনালি শুকনো হয়ে গেছে। ওই সাদা শার্টের মালিক তাজদার সিদ্দিকী ছিল? ওভাবে… এত এত রক্ত! এত হিংস্র আঘাত! আশেপাশে কেউ ছিল না? একটিমাত্র প্রাণীও না? শাইনার বুক ভেঙে পড়ছে, চোখে জল আর থামছে না।
সাবরিনা এসে তাকে বোরকটা পরিয়ে দিতে লাগলো। শাইনা একঝটকায় তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,”আমি কোথাও যাব না। দেখাতে মানে কি? কি দেখতে যাব? আমি ওভাবে দেখতে পারব না। আমি যাব না। আমি কোথাও যাব না। আমি সকালেই মেসেজে কথা বলেছি। না আমি যাব না।”
শাহিদা বেগম এসে শাইনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। শাইনার শরীর কাঁপছে কান্নার ঝাঁকুনিতে, বুক ভরে উঠছে অস্থির হাহাকারে। এই শরীরেই তাজদার সিদ্দিকীর এক টুকরো অস্তিত্ব, ক্ষুদ্র একটা বীজ নিঃশব্দে বেড়ে উঠছে বলে সন্তানের পিতার জন্য সে এভাবে কাঁদছে নাকি মানুষের বিপদে মানুষের চোখে জল নামাটাই স্বাভাবিক বলে তা কেউ জানে না। শাইনা মমতাজ নিজেও তার কান্নার উৎস নির্ণয় করতে পারল না।
তখুনি তৌসিফ এসে বলল,”শাইনা কোথায়? এখনো রেডি হয়নি?”
শাওন চেয়ারে বসে আছে গম্ভীরমুখে। তৌসিফকে ইশারায় দেখিয়ে দিল শাইনাকে। তৌসিফকে দেখার পর শাইনার কান্না আরও দ্বিগুণ হলো। শাইনা তার দিকে একনাগাড়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“আপনারা সবাই কোথায় ছিলেন? কি জঘন্য ভাবে মারছিল আমি ভিডিওতে দেখেছি। একা কেন ছেড়েছিলেন উনাকে?”
তৌসিফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এসবের উত্তর নেই তার কাছে। তার শার্টে এখনো রক্ত। রক্তগুলো দেখে শাইনার গা গুলাচ্ছে। চারপাশের সব বিষাক্ত লাগছে। সবকিছু তিক্ত লাগছে। সবাইকে অসহ্য লাগছে।
দাদীমাও বিস্তারিত জানতে চাইলেন সব, যেহেতু তৌসিফ প্রত্যক্ষদর্শী ছিল।
তৌসিফ জানালো,”মেঝ ভাই মহিষের ধারেকাছে যায়নি। মাঠের একপাশে গিয়ে ফোনে কথা বলছিল খায়রুল স্যারের সাথে। মহিষটা পেছন থেকে ছুটে এসেছিল। একদম শিং ত্যাড়ছাভাবে গলার পাশে….. কান থেকে গলা বুক পর্যন্ত সব ছিঁড়ে…..ডান হাতটার অবস্থাও ভালো না।”
বলতে বলতে তৌসিফের ঠোঁট শুকিয়ে এল। কথাগুলো আটকে আটকে এল।
শাইনার মাথা সাবরিনা তার কাঁধে টেনে নিয়ে শান্ত করাতে করাতে বলল,”তুমি দেখে এসো একবার। তৌসিফ ভাইয়া তাজ ভাইয়া হুঁশে আছে?”
তৌসিফ দুপাশে মাথা নাড়লো। শাইনাকে বলল,”চলো, দেরী হলে সমস্যা হবে।”
শাইনাকে দেখার জন্য পাড়াপড়শিরা ইতোমধ্যে বাড়িতে চলে এসেছে। কেউ কেউ বলছে ওকে বোরকা পরিয়ে দাও, কেউ কেউ বলছে বোরকা ছাড়াই পাঠিয়ে দাও। কেউ কেউ বলছে ওর হাতে কিছু লেবু পাতা দাও, ও বমি করতে পারে ওখানে গিয়ে।
সাবরিনা শাইনাকে বোরকা পরিয়ে দিল। মুখটা মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,”নিজেকে সামলাও। আল্লাহকে ডাকো।”
কোনোমতে একটা হিজাব প্যাঁচিয়ে শাইনা বেরিয়ে এল বাইরে। তিতলি রওশনআরাকে ধরে ধরে গাড়িতে এনে বসাচ্ছে। রওশনআরা কাঁদছে। তৌসিফ গাড়ির কাছে এগিয়ে আসতেই তিতলি তার হাতে থাকা শার্টটা বাড়িয়ে দিল। তৌসিফ তার গায়ের শার্টটা খুলে তিতলির হাত থেকে শার্টটা নিয়ে গায়ে চাপিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, “এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। তুই যাবি?”
তিতলি তার রক্তভেজা শার্টটা নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,”হ্যাঁ।”
সে একদৌড়ে গেল। আরেকদৌড়ে পানির জগ নিয়ে ছুটে এল। তৌসিফ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে পানি খেয়ে নিয়ে বলল,
“সবাইকে জানিয়েছিস ফোনে? আর কাকে কাকে জানাসনি খেয়াল করে দেখ।”
তিতলি বলল,”সবাইকে জানিয়েছি।”
“জগটা রেখে তাড়াতাড়ি আয়।”
তিতলি জগটা রেখে এল। শাইনাকে নিয়ে এল শাওন। শাহিদা বেগমও এলেন সাথে। তৌসিফ শাওন দুজনেই গাড়িতে উঠে বসলো। উঠোন ভর্তি মানুষ। একেকজন একেক কথা বলছে। দাদীমা দু’জনেই গাড়ি যাওয়ার পথে চেয়ে রইলেন।
হাসপাতালের সামনে ইতোমধ্যে অনেক আত্মীয় স্বজন এসে ভরে গেছে। এত এত মানুষ চারপাশে! হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতেই সবাই বলাবলি করলো,”ওর মা বউ এসেছে।”
তাসনুভা ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। মা আর শাইনাকে দেখে সেও একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো।
অনেকে শাইনাকে এই প্রথম দেখছে।
ওরা বলাবলি করলো,”ওটা তাজের বউ নাকি?’
পাশ থেকে একজন বলল,”হ্যাঁ। পাশের জন বউয়ের মা।”
“মেয়ে তো সুন্দর আছে। বউয়ের গায়ে বাচ্চা এসেছে নাকি?”
“হ্যাঁ, তাই তো শুনলাম।”
“হায় আল্লাহ! এমন সময় এতবড় বিপদ ঘটতে হলো।”
সবাই একসাথে বলাবলি করল,”বউ এসেছে। সবাই একটু জায়গা দাও।”
রওশনআরা নিজের ভাইদের দেখে আরও জোরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সবাই বলল,”শান্ত হও। ওর বউ বাচ্চার কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করো। সবাই একসাথে ভেঙে পড়লে তো হবে না।”
তিতলিও মায়ের দেখাদেখি কাঁদছে। তাসনুভা এসে তার পাশে বসলো। তার চোখমুখও ফোলা, গম্ভীর। সবটা শুনে সে শো রুম থেকে ছুটতে ছুটতে চলে এসেছে।
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী আর রায়হানকে দেখে রওশনআরা আরও শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন,”আপনারা বাপছেলে কোথায় ছিলেন ওকে ওভাবে মারছিল? কোরবানির গরুর মতো রক্ত ছুটছিল ভিডিওতে দেখিয়েছে…
রায়হান গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো চোখ নিচে নামিয়ে। তার শার্টেও রক্তের দাগ। তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর সাদা পাঞ্জাবিতেও।
শাইনা জানালার কাঁচের এপাশে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। ওপাশে তাজদার সিদ্দিকী শুয়ে আছে। পেট পর্যন্ত সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো শরীর, মুখে অক্সিজেন মাস্ক। শাইনার চোখ স্থির হয়ে গেল তার ওপর, একটুও নড়ল না। বুকের ভেতরটা ভাঙাচোরা কাচের মতো ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে লাগলো। এত ভিড়, এত হট্টগোল, এত মানুষের ভিড়ের মাঝে কান্না করার কথাও মনে থাকলো না তার। শুধু গাল বেয়ে নেমে আসা জল আরও ঘন হতে লাগলো তীব্র বেদনার সাক্ষী হয়ে।
তাজদার সিদ্দিকী আর তার সংসারের হিসাব এখনো ঝুলে আছে অমীমাংসিত পাতার মতো। পাহাড়সম অভিযোগ আর দায়-দায়িত্বগুলো না মিটিয়েই হাসপাতালের বেডে শুয়ে পড়া একরকম পালানোই বটে। বুক ফুলিয়ে, আঙুল উঁচিয়ে, নিজের পক্ষে প্রতিটি বাক্যকে ঢাল বানানো সেই ডিফেন্ডার তাজদার সিদ্দিকীকে এত সহজে হার মেনে নেয়া মানায় না। এই সংসার সমরাঙ্গনে সে যেমন একা জিততে পারেনা তেমন শাইনা মমতাজও নয়। হারজিত সমান সমান হওয়া চায়।
কত লেনাদেনা এখনো ঝুলে আছে, কত চাওয়া-পাওয়া অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, সংসার নামের সেই দীর্ঘ উপন্যাসের মোটা মোটা কতগুলো পৃষ্ঠায় এখনো কলমের কালি পড়েনি। তার আগেই যদি এভাবে হার মেনে নেওয়া হয়, তবে বিপক্ষ দল জিতেও আসলে জিতে না বরং বড়ো রকমের পরাজয়ে ডুবে যায়। আর তাজদার সিদ্দিকীর মতো মানুষ এ সত্য এত সহজে ভুলে গেলে চলে না।
আনিস এসে রায়হানকে বলল,”রায়হান ভাই বড়আম্মুকে নিয়ে আসো।”
তখন থেকে বেশি ছোটাছুটি সেই করছে। রায়হান তৌসিফ ওরা সবাই অমনভাবে রক্ত ছোটা দেখে তখন থেকেই স্তব্ধ হয়ে আছে। তাদের চোখে সামনেই এতবড়ো ঘটনা ঘটে গেল তারা সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না। আনিসই তখন থেকে দৌড়ের ওপরে আছে। তাজদারকে সেই অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছে।
তাই তার শার্টটার অবস্থা আরও ভয়ংকর। রওশনআরা যেতেই তাসনুভা তাকে ডেকে বলল,
“আনিস ভাই আপনি দয়া করে শার্টটা পাল্টে নিন। ওটাতে খুব জঘন্য দেখতে লাগছে।”
আনিস নিজের শার্টের দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে তাসনুভার দিকে তাকিয়ে বলল,”তোমার কাছে শার্ট আছে?”
তাসনুভা বিরক্ত গলায় বলল,
“আশ্চর্য! আমি কি এখানে শার্ট বেচতে এসেছি?”
“তাহলে আমি এখন শার্ট কোথায় পাব? অহেতুক কথাবার্তা বলার আগে দশবার ভেবে নেবে।”
কাঠকাঠ গলায় উত্তর ছুড়ে দিয়ে আনিস দ্রুত সরে পড়ল।
শাইনাকে আর রওশনআরাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। রওশনআরা ছেলের অমন অবস্থা দেখে করুণ সুরে কেঁদে উঠলেন। রায়হান বলল,”এখন কেঁদে লাভ নেই। সুস্থ থাকলে তোমাদের মা ছেলের তামাশার শেষ থাকেনা। এখন কেঁদে মাথা নষ্ট করবে না।”
ঝিমলি তাকে চোখের ইশারায় বললো চুপ থাকতে। মা তার ছেলের এই অবস্থা দেখে কাঁদবেনা? আশ্চর্য!
ঝিমলি তার এক খালার বাড়িতে গিয়েছিল। সেখান থেকে চলে এসেছে খবরটা শুনে।
ওদের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল ঠিক তখুনি শাইনা চারপাশে আলতো করে চোখ বুলিয়ে সবার অগোচরে তাজদার সিদ্দিকীর একটা আঙুল ধরলো।
তাজমহল পর্ব ৪৬
ঠান্ডা আঙুলটা ছোঁয়ামাত্র তার শরীর কেঁপে উঠল ভেতর থেকে। এতক্ষণ জোর করে আটকে রাখা চোখের জল হঠাৎ বাঁধ ভেঙে অবিরাম গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে আঙুলটা আরো শক্ত করে ধরে রাখলো। এমন পরাজয় সে তার চরম শত্রুরও চায় না। সেখানে তাজদার সিদ্দিকী তার পরম……..