তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৬৭+৬৮

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৬৭+৬৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

সোফায় পা গুটিয়ে বসে আছি আমি। আমার সামনে বিছানায় উবু হয়ে বসে আছে চিত্রা। আদ্র-রোদ্রর গলায় “A” আর “R” লেখা দুটো লকেট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে করে কে আদ্র আর কে রোদ্র তা সহজেই বুঝা যাচ্ছে। আমাদের সবার কাছে বাবুদুটোকে এক মনে হলেও আপু দৃঢ় কন্ঠে বলছে তারা জমজ হলেও চেহারা এক নয়। দু’জনের মাঝে কিছুটা অমিল আছে। আমার আর চিত্রার কাছে বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাই বাচ্চাদেরকে উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অমিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে চিত্রা।

আদ্র রোদ্রর চেয়ে ৩ মিনিটের বড়, এই কথাটাও আপু থেকেই জেনেছি আমরা। ডক্টর বলেছিলো, কিন্তু কে আদ্র আর কে রোদ্র সেটাই যেখানে বড় প্রশ্ন সেখানে বড় ছোট নির্ণয় করা একরাশ কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আপু কিভাবে যেন ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। কিভাবে ধরলো কে জানে? আদ্র- রোদ্রর সাথে দুষ্টুমি করতে করতেই কানে এলো শুভ্রর ডাক। চিত্রাকে গবেষনা চালিয়ে যেতে বলে আমাদের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম আমি। দরজার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই দুনিয়া ঘুরে এলো আমার। দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলাম আমি। মাথা ঘুরানোর ব্যাপারটা শুভ্রকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। কোনভাবে বুঝতে পারলেই শুরু করবে চিৎকার, “খাও না ঠিকমতো হেন তেন কতো কিছু।” অথচ এই দুসপ্তাহ ধরে আমি বেশ নিয়ম করেই খাবার আর ঔষধ খেয়ে চলেছি। তবুও এই দুর্বলতা পিছুই ছাড়ছে না। রুমে ঢুকতেই শুভ্রর গোমড়া মুখটা চোখে পড়লো। মুখ কালো করে জুতো আর মোজা খুলছে সে। আমি সামনে দাঁড়াতেই অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো সে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— কি লাভ হলো, বলো? এতো পরিশ্রম করে লাভ টা কি হলো?
উনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি৷ কনফিউজড হয়ে বলে উঠলাম,
— মানে? কিসের কথা বলছেন আপনি?
শুভ্র বাম পায়ের জুতোটাও ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বলে উঠলো,

— আপনার রেজাল্টের কথা বলছি। এতোকষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে ৩. ৭১?
শুভ্রর কথায় চোখ বড় বড় হয়ে এলো আমার। ৩.৭১? বলে কি? জামাইয়ের কাছে পড়ে এতো ইম্প্রোভমেন্ট হয়েছে ভাবতেই পারছি না আমি। বুকের ভেতর থাকা মনটা রীতিমতো লাফালাফি শুরু করেছে। আমার মনের অবস্থা “ভেরি হ্যাপি” টাইপ হলেও শুভ্রর মুখটা “ভেরি স্যাড” টাইপ হয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ক্লাস সিক্সের ম্যাথ এক্সামে সবাই যেখানে হান্ড্রেট পেয়েছে সেখানে সে পেয়েছে জিরো। বর যেখানে এতো কষ্ট পেয়েছে সেখানে আমার এতো খুশি খুশি ভাব মানায় না। তাই মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব আনার প্রচেষ্টা চালালাম। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না কারণ যখনই দুঃখ দুঃখ ভাব আনার চেষ্টা করি তখনই মনের মধ্যে খুশি নামক ভাইরাসগুলো লুঙ্গিডান্স মারে। তবুও যথাসম্ভব মন খারাপ ভাব নিয়ে বলে উঠলাম,

— মাত্র ৩.৭১? এতো কম! সরি…. নেক্সট টাইম ভালো করবো।
শুভ্র এ বিষয়ে কিছু বললো না। শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বললো,
— তোয়ালেটা দাও। ফ্রেশ হবো।
আমি তোয়ালে নিতে সোফার দিকে এগিয়ে যেতেই আবারও মাথা ঘুরে গেলো আমার। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। আশেপাশে ধরার মতো কিছু না থাকায় ফ্লোরে গিয়ে পড়লাম আর খাটের কোনাটা লাগলো মাথায়। শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়েই দৌড়ে এলো শুভ্র। আমার কপালে খানিকটা ফুলে উঠেছে। উনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই বরফ আনতে ছুটলেন। কপালে বরফ ডলতে ডলতে প্রশ্ন করলেন,

— আবারও খাবারে অনিয়ম করছো? ঔষধও নিশ্চয় খাচ্ছো না? এক্চুয়েলি কি চাও তুমি? বলো প্লিজ। টেনশনে রেখে মেরে ফেলতে চাও আমায়? আজকের এই ইন্সিডেন্টটা যদি সিঁড়িতে বা রাস্তায় হতো তখন বাঁচতে তুমি? নাকি আমি বাঁচতাম? তুমি খুবই কেয়ারলেস একটা মানুষ রোদ। এতোটা কেয়ারলেস হলে চলে না। তুমি দু’বছরের বাচ্চা নও। সবকিছু তোমাকে বলে বলে করাতে হবে কেন?
উনি এক নিঃশ্বাসে বকে চলেছেন আমায়। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছেন না। তবুও এক ফাঁকে ফট করেই বলে ফেললাম আমি,

— আমি নিয়মিত খাচ্ছি এবং ঔষধও নিচ্ছি। আমার মনে হয় ঔষধ গুলো কাজ করছে না।
শুভ্র এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম,
— আমি সত্যি বলছি। মামানিকে জিগ্যেস করুন না। আধ ঘন্টা পর পর কিছু না কিছু খাচ্ছি। ভালো না লাগলে জোর করেই খাচ্ছি। ঔষধও নিচ্ছি। তবুও বারবার মাথা ঘুরাচ্ছে।
— বারবার? সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কতোবার হয়েছে?
— ৫/৬ বার।
— তাহলে আমায় বলো নি কেন, ডাফার। এনিওয়ে,সব ঠিক থাকার পরও এতো দুর্বলতার কারণ কি? আঙ্কেল তো বলেছিলো এক সপ্তাহে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু এখন তো দু’সপ্তাহ চলছে।
নিজের মনেই কথাগুলো বলে চুপ করলো শুভ্র। কিছুক্ষণ ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— তোমার লাস্ট পিরিয়ড হয়েছে কবে?
উনার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। মুহূর্তেই ভীষণ অস্বস্তির মাঝে পড়ে গেলাম আমি। শুভ্র সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন,
— কি হলো? বলো। লাস্ট ডেট কবে ছিলো?
আমি ইতস্তত করে বলে উঠলাম,
— মনে নেই। তবে ৩/৪ মাস হবে হয়তো।
আমার কথায় কেশে উঠলেন শুভ্র। শান্ত গলায় বললেন,
— তুমি কতোটা কেয়ারলেস তার প্রমাণ স্পষ্ট। এতোদিন ধরে পিরিয়ড হচ্ছে না তোমার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই?
এটুকু বলে থামলেন উনি। মাথা চুলকে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— তুমি কি প্রেগনেন্ট?
উনার কথায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো আমার। ডান হাতটা অটোমেটিক পেটের উপর গিয়ে স্থির হলো। আমি ড্যাবড্যাব করে পেটের দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই কি আমি প্রেগনেন্ট? কথাটা ভাবতেই শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগছে। শুভ্র উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

— উঠতে পারবে? পারলে উঠে রেডি হয়ে নাও। হসপিটালে যাবো।
শুভ্রর গম্ভীর মুখ দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি তবে কি শুভ্র বেবি চাচ্ছে না? অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে শুভ্রর সাথে হসপিটালে চললাম আমি। সব শুনে ডক্টরও প্রেগনেন্সি টেস্ট করার জন্য সাজেস্ট করলো। আলট্রাসনোগ্রাফি শেষ করে বাসায় ফিরেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। যখন জাগলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। বিছানার এক কোণে ফাইল হাতে মাথা নিচু করে বসে আছে শুভ্র। মুখটা অসম্ভব রকম গম্ভীর তার। আমাকে উঠে বসতে দেখেই ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

— বেবি আসছে।
কথাটা শুনে যেখানে খুশিতে লাফিয়ে উঠার কথা ছিলো সেখানে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। শুভ্রর গম্ভীর মুখটা আমার সব খুশিই যেন চুষে নিয়েছে কোনো অন্ধকার গহ্বরে। আমি একটা ঢোক গিলে ফাইলটা হাতে নিলাম। সাথে সাথেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো শুভ্র। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ এতো গাম্ভীর্যতা কেন? উনি তো বাচ্চা পছন্দ করেন তাহলে? প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ফাইলটা বেড সাইড টেবিলে রেখে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়লাম আমি। কিছুক্ষণ পরই ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ হলো। কোমরে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ আর ঘাড়ে কারো ঠোঁটের স্পর্শটাও প্রকট আকার ধারণ করলো। বিরবির করে বলে উঠলো,

— আই লাভ ইউ রোদু। জীবনটাকে আজ হঠাৎ করেই অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। আমি বাবা হচ্ছি! ভাবতে পারছো তুমি? আমাকেও কেউ আধো আধো স্বরে “বাবা” বলে ডাকবে। কালো বড় বড় দুটো চোখ, ভুবন ভুলানো হাসি আর নরম তুলতুলে ছোট্ট শরীর থাকবে তার। ইশ! রোদ, এতো আনন্দ যে ধরে রাখতে পারছি না আমি। আমার প্রিন্সেসকে কিভাবে বুঝাবো যে আমি তার আগমনের খবরে প্রচন্ড রকম খুশি…প্রচন্ড! বেশি খুশি আর বেশি দুঃখে মানুষ নাকি অনেকটা স্তব্ধ হয়ে যায়? আমারও আজ একই অবস্থা রোদপাখি।
আমি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখে পানি টলমল করছে যেন চোখদুটোতে আস্ত দুটো বিল নিয়ে শুয়ে আছেন উনি। আমি মিষ্টি হেসে উনার বুকে হাত রেখে বলে উঠলাম,

— কিভাবে জানলেন প্রিন্সেস আসছে? প্রিন্সও তো হতে পারে।
— কি জানি? কেন জানি মনে হচ্ছে প্রিন্সেস আসছে তবে যেই আসুক আই এম অলওয়েজ হ্যাপি। আমি তো এটা ভাবছি, তুমি একমাসের প্রেগনেন্ট হওয়ার পরও ডক্টর আঙ্কেল ধরতে পারলেন না কেন? অদ্ভুত না, ব্যাপারটা?
আমি কিছু বললাম না। চোখ জোড়ায় আবারও ঘুম নেমে আসছে। মনে হচ্ছে, কতোদিন ঘুমোয় না আমি।

সকাল আটটা কি নয়টা বাজে। কারো হাসাহাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। জোর করে চোখদুটো খুলে পাশ ফিরে তাকালাম। রুম একদম ফাঁকা। আওয়াজটা ড্রয়িং রুম থেকে আসছে বুঝতে পেরে আবারও চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম আমি। কয়েক মিনিট পর ভারি মাথা নিয়ে উঠে বসে ওড়নাটা গায়ে পেচিঁয়ে চলে গেলাম নিচে। শুভ্র, মামু, মামানি,আপু, অভ্র ভাইয়া,দিদা সবাই মিলে হাসাহাসি করছেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকালো। আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

— এনি প্রবলেম? কি হয়েছে?
আমার কথায় মামানি এগিয়ে এলেন। গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন,
— আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না রে রোদ। এই বছরটা খুব লাকি আমার জন্য। দু’ দুটো নাতি পেয়েছি। এখন আরো একজন আসছে। এতোদিনের ফাঁকা ঘরটা পুরো করে দিলি তোরা দুই বোন। সুখী হ মা।
দিদাও এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। কপালে চুমু দিয়ে বলে উঠলেন,
— ছোট নাতবউ? বড় নাতবউয়ের চেয়ে সবকিছুতেই তো তুই ডাবল। কথাতে, কান্নাতে,হাসিতে,দুষ্টামিতে তো অতিথির বেলায়ও ডাবলই হবে,তাই না? রানু? তুই বরং সবকিছু চার সেট করে কিনে রাখ বুঝলি?
দিদার কথায় আবারও হেসে উঠলো সবাই। আমি লজ্জা লাল মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মামুও মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এমন সময় কোথা থেকে সাহেল ভাইয়া এসে শুভ্রকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলেন। পিঠে কয়েকটি চড় থাপ্পড় দিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললেন,

— বাহ দোস্ত! আজ না খুব শান্তি শান্তি লাগছে। কনগ্রাচুলেশন বস। আজ থেকে দুই বন্ধু মিলে দুঃখের গল্প করবো। ভাবতেই এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে।
শুভ্র অবাক হয়ে বললেন,
— মানে? দুঃখের গল্প! কিসের দুঃখ।
সাহেল ভাইয়া হেসে বলে উঠলেন,
— কিসের দুঃখ সেটা তো আজ থেকেই জানতে পারবি। বউ কতো প্যারাময় হতে পারে তা এই দশমাসে বুঝে যাবি। আমি তো এই পাঁচমাসেই শেষ! জীবন বের করে ফেলছে বন্ধু।
নাবিলা আপু সাহেল ভাইয়ার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাহেল ভাইয়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,
— সাহেল? তুমি কি বলতে চাইছো? আমি তোমাকে জ্বালাই?
সাহেল ভাইয়া হাসলেন। নাবিলা আপুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

— আমি কি বলেছি তুমি জ্বালাও? এই শুভ্র? আমি এমন কিছু বলেছি? আমার বউয়ের মতো লক্ষ্মী বউ এই তৃভূবনে নেই বুঝলি? সে আমাকে একটুও জ্বালায় না। তার তো শুধু রাত দুটোয় আইসক্রিম,ফুসকা,চটপটি,কাবাব,চিপস, কুলফি ইত্যাদি ইত্যাদি খেতে হচ্ছে করে। রাত ৩/ ৪ টার সময় লুডু খেলতে ইচ্ছে করে। মাঝরাতে হুট করেই মরাকান্না করতে ইচ্ছে করে। মাংস রান্না করলে বমি করে ভাসিয়ে দিয়ে তার মাছ খেতে ইচ্ছে করে। মাছ রান্না করলে মাংস খেতে ইচ্ছে করে। মাঝরাতে ৫/৬ বার করে বেডশিট চেঞ্জ করতে ইচ্ছে করে। বাগানে গেলে ফুল চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করে। আর…
সাহেল ভাইয়ার কথায় মুখ চেপে হেসে উঠলো সবাই। নাবিলা আপু রাগী গলায় বললেন,

— সাহেল! এতো জ্বালায় তোমায়? বেশ, এখন থেকে কিচ্ছু বলবো না। হ্যাপি?
সাহেল ভাইয়া মুচকি হেসে নাবিলা আপুকে নিজের কাছে দাঁড় করিয়ে বলে উঠলেন,
— আরে রাগ করে না। মজা করছিলাম তো। আমার বউটা আসলেই অনেক লক্ষ্মী।
মামু,মামানি, দিদা হালকা হেসে আমাদের রেখে যার যার রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি শুভ্রর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বলে উঠলেন উনি,
— বাট আই উইল ম্যানেজ সাহেল। তোর জন্য নতুন হলেও আমার জন্য নতুন না।
উনার কথায় তিনজনেই চোখ বড়বড় করে তাকালাম। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে একসাথেই বলে উঠলাম,
— মানে?
শুভ্র থতমত খেয়ে বলে উঠলেন,

— তোরা এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি তো রোদের কথা বলছিলাম। ও তো সবসময়ই এমনসব কাজ করে এটা তো নতুন কিছু না, এটাই বুঝাতে চাইছিলাম।
আমরা তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথেই বলে উঠলাম,
— ওওওওওও।
শুভ্র যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। একটু আধটু কথা বলে সবাই মিলে সোফায় গিয়ে বসতেই দৌঁড়ে এলো চিত্রা। ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে মেরে আমাকে টেনে দাঁড় করিয়েই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এক্সাইটমেন্টে গলা বন্ধ হয়ে আসছে তার। তবুও লাফাতে লাফাতে বলে উঠলো,

— আমি বলেছিলাম, তখন তো থাপ্পড় লাগাইলি। এখন মিললো তো? মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমাও কাজে লাগে বুঝলি? এনিওয়ে, আই এম সো হ্যাপি জানু। আমার বেস্টুর বেবি হবে। উফফ, আমার তো নাচতে ইচ্ছে করছে। এই শোন? আমি বরং কাজ করি। বাচ্চাদের নাম ঠিক করে ফেলি। পাঁচটা ছেলের নাম আর পাঁচটা মেয়ের নাম। ছেলের নামগুলো “র” দিয়ে হবে আর মেয়ের নামগুলো “শ” দিয়ে হবে। দা…
চিত্রার এক্সাইটমেন্টের মাঝেই বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন সাহেল ভাইয়া,

— পাঁচটা পাঁচটা কেন?
উনার কথায় রেশ ধরে আমিও বললাম,
— হ্যাঁ। পাঁচটা কেন?
চিত্রা সোফায় আরাম করে বসলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
— কেনো? কাল রাতে শুভ্র ভাইয়াই তো ফোনে বললো। “দশটা বাচ্চার নাম ঠিক করো চিত্রা। পাঁচটা মেয়ে, পাঁচটা ছেলে। কেবল তো শুরু কয়েকদিন পর দেখবে ভাগ্নে ভাগ্নি কোলে নেওয়ার জন্য কোনো হাত অবশিষ্ট থাকছে না। কেউ গলায় ঝুলে আছে তো কেউ পিঠে। দারুন না? ”
সবাই একসাথে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র সবার দিকেই একবার করে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— হোয়াট?
কেউ কিছু বললো না। সাহেল ভাইয়া হাসি চেপে বলে উঠলেন,
— নাথিং! ১০ টা কনগ্রাচুলেশন ভাই। আগেই দিয়ে রাখলাম পরে যদি এতো এতো ভাস্তে ভাস্তির ভীরে তোকে খুঁজে না পাই।
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ছোট্ট করে বললেন,”দাঁড়া তুই…” এটুকু বলতেই অট্টহাসি দিয়ে দৌঁড় লাগালেন সাহেল ভাইয়া আর তার পিছু নিলেন শুভ্র। ওদের যাওয়ার দিকে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই আবারও বকবক শুরু করলো চিত্রা। বই থেকে প্রেগনেন্সির উপর পাঁচ-ছয়টা বই বের করে বিজ্ঞদের মতো লেকচার দিতে লাগলো। আমি আর নাবিলা আপু শুধু অবাক চোখে তাকিয়েই রইলাম।

আজ নাবিলা আপুর ডেলিভারি। সবাই হসপিটালে গিয়েছে। আমার পাশে মাধবী আর রাহেলাকে বসিয়ে দিয়ে দশ মিনিট আগে শুভ্রও বেরিয়েছেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে। জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমি। চারদিকে শেষ বিকেলের নরম আলো। সূর্যটাও পশ্চিমের দিগন্ত ছুঁই ছুঁই করছে। আমি চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। দেখতে দেখতে প্রেগনেন্সির পাঁচ পাঁচটি মাস কেটে গেলো। আমাদের জীবনের পাতা থেকে সময়গুলো কতো তাড়াতাড়িই না হারিয়ে যায়। এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই অবাক চোখে দেখতে থাকি আমি। কেমন অদ্ভুত দেখতে লাগে আমায়। বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় এই ছোট্ট পেটটাতে আস্ত একটি জীবন টিকে আছে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে! এই পাঁচ মাসে শুভ্রকে খুব একটা জ্বালায়নি আমি।

কারণ প্রেগনেন্সি জনিত তেমন কোনো প্রবলেমই হয় নি আমার। বমি,মুড সুয়িং, খাবারে অরুচি খুব কমই হয়েছে আমার। শুধু একটা জিনিস বেশি বেশি হয়েছে তা হলো ঘুম। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোনোই প্রতিদিনের রুটিন হয়ে উঠেছে আমার। তেমন কোনো সমস্যা না হলেও অফিসের কাজ কমিয়ে দিয়েছেন শুভ্র। এখন চারটার মাঝেই বাসায় ফিরেন উনি। আদ্র-রোদ্রও বেশ বড় হয়ে গিয়েছে এখন। বসে থাকতে পারে, একজন আরেকজনকে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে চড় থাপ্পড়ও মারতে পারে। আপু আর চিত্রা প্রায় সারাক্ষণই আমার আশেপাশে থাকে এখন। চিত্রা প্রতিদিন বিকেলেই বাসায় এসে হাজির হয়। আমায় নিয়ে হাটাহাটি করে। তার ধারনা এই হাঁটাহাঁটিটা খুবই প্রয়োজন আমার নয়তো দিনদিন ফার্মের মুরগীর মতো ফুলে যাবো। ফোনের টোন কানে আসতেই ঘোর কাটলো আমার। জানালার বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটির দিকে তাকালাম। মাধবী দৌঁড়ে এসে ফোনটা হাতে দিয়ে গেল আমার। আমি মুচকি হেসে ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে আগ্রহী কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র,

— নাবিলার ছেলে হয়েছে রোদপাখি। মাশাআল্লাহ, বেশ কিউট হয়েছে। যদিও সব ছোট বাচ্চাকে আমার কাছে এক রকমই দেখতে লাগে।
— আলহামদুলিল্লাহ! আপনি আমায় সাথে নিলেন না কেন, বলুন তো? সবাই তো দেখে নিলো বাবু আমিই শুধু রয়ে গেলাম। কোলেও নিতে পারলাম না।
— মন খারাপ করছো কেন? এখানে এসেই কি লাভ হতো? নাবিলার নর্মাল ডিলেভারি হয়েছে কয়েক ঘন্টা পর রিলিজ করে দিবে। আসলে শুধু শুধু জার্নি হতো আর টেনশন করতে। হসপিটালের বাতাসটাই অসুস্থ বুঝলে? হসপিটালে ঢুকলে সুস্থ মানুষেরও নিজেকে মহারোগী বলে বোধ হয়। না এসেই ভালো করেছো, বুঝলে?

— হয়েছে। ফাউল লজিক দিতে হবে না। পিচ্চির কয়েকটা ছবি পাঠান আমি দেখবো। আর হ্যাঁ, বাসায় ফিরেই বাবু দেখতে নিয়ে যাবেন আমায়, প্রমিজ?
শুভ্র হাসলেন। হাসিমুখেই বললেন,
— ওকে প্রমিজ। বাট কাল সকালে। এই অবস্থায় রাতে তোমায় নিয়ে বের হচ্ছি না আমি।
— কিন্তু….
— নো আর্গিউমেন্ট। সকালে মানে সকালে। এখন বাই, রেস্ট নাও।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলাম। দিন যত বাড়ছে হুটহাট রাগটা ততই যেন বেড়ে যাচ্ছে আমার। চুলগুলো দু’হাতে হাতখোপা করে ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম আমি। পা দুটো বেশ ব্যাথা করছে আমার। এ এক নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে আমার। সন্ধ্যা হতেই দু পায়ে অসম্ভব রকম ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। এটা কি প্রেগনেন্সির কারণেই হয়? কে জানে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মাধুবী-রাহেলা কে রুম থেকে চলে যেতে বলে শুয়ে পড়লাম আমি। কিছুক্ষণ পরই ঘুম ছুঁটে গেলো আমার। ঘুমের মাঝেও কারো গভীর দুটো চোখ তাড়া করছিলো আমার। চোখ মেলে তাকাতেই শুভ্রকে চোখে পড়লো। আমাকে তাকাতে দেখে মুচকি হেসে বললেন,

— শরীর কেমন?
আমি দুর্বল হাসি দিয়ে বললাম,
— পা ব্যাথা করছে।
উনি কপাল কুঁচকে তাকালেন। তারপর কি ভেবে বললেন,
— দাও, আমি টিপে দিচ্ছি।
কথাটা শুনেই লাফিয়ে উঠলাম আমি। উনি অবাক কন্ঠে বলে উঠলেন,
— কি হলো?
—পায়ে হাত দিবেন না। দূরে বসুন।
উনি আরো কয়েকগুণ বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন,
— কেনো?
— আমার ভালো লাগে না তাই। প্লিজ পায়ে হাত দিবেন না। আমার অস্বস্তি লাগে।
— জাস্ট শাট আপ রোদু।

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৬৫+৬৬

— আ আমার মাথা ব্যাথা করছে। পা ব্যাথা করছে না। আপনি আমার মাথাটা টিপে দিন তো। আহ! কি মাথা ব্যাথা।
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আমি আড়চোখে তাকাতেই হেসে উঠলেন উনি। আমি চুপচাপ তাকিয়ে আছি। উনার আকাঁবাঁকা দাঁতের টুল পড়া হাসি। ইশ! কি সুন্দর করে হাসেন উনি। উনার হাসিটা দেখলেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। মনে হয়, এই বুঝি শেষ হলো দিন। ফুরিয়ে এলো বেলা! কেমন একটা অদ্ভুত চিনচিনে ব্যাথা সারা বুকজুড়ে….

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৬৯+৭০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here