তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১১
ভূমিকা তালুকদার
(ফ্রান্স, প্যারিস)
প্যারিসের হাসপাতালের ভি আই পি কেবিনে প্রতি মুহুর্ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চলেছে জায়ান। ফাঁকা হোয়াইটওয়াল, হালকা মৃদু বাতাসের সাথে শীতল আলো পড়ছে তার মুখে। তার চোখ বন্ধ, শ্বাস নেওয়া মৃদু, কিন্তু পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলো একদম স্থির থাকতে পারছে না।কি থেকে কি হয়ে গেলো আচমকা।চোখের পলকে।তবে এর পেছনে যদি কোনো অপশক্তির হাত থেকে থাকে তাহলে তার পরিণতি যে কি ভয়াবহ হতে চলেছে,তা উপস্থিত সকলের চোখে দৃশ্যেমান।মার্কো জায়ানের হাতে হাত রেখে বারবার চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, যেনো কেবল একটি নড়াচড়া জায়ানের নিঃশ্বাসের সাথে মিলিয়ে দেখতে চায়। এলেনা,যার চোখ ভিজে গেছে, হালকা কাঁপন ধরে ধরে, কিন্তু মুখে জোর করে শান্তির ভান। নাদিয়া বারবার ফোন দেখছে, বারবার সময় চেক করছে।
জায়ান ঠিক হয়ে যাবেতো?,এলেনা হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কন্ঠ অচেতনভাবে কেঁপে উঠেছে।
আমাদের এখন অপেক্ষা ছাড়া। আর কিছু করার নেই। এলেক্স এক টুকরো নিঃশ্বাস নিয়ে বলল।
এক মিনিটও কাটতে পারে না, আরেক মিনিট যেনো দীর্ঘ হয়ে যায়। প্রত্যেকের হৃদয় অস্থির, চোখে অজানা ভয়, আর মনে একটাই আশা—জায়ানের নিজে চোখ খোলা।
নাদিয়া হঠাৎ এগিয়ে এসে মার্কোর হাতে হাত রাখলো আর বললো,
জায়ানের বাড়িতে একটা কল দেয়া উচিত না??দেয়া ঠিক হবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মার্কো:
আমার ফোনটা জায়ানকে উদ্ধার করার সময় মেইবি সেখানেই,পরে গিয়েছে সেইদিনের পর থেকে আর খুজে পাচ্ছি না,তবে আমার মনে হয় না বাংলাদেশে এই মুহুর্তে কল দেয়া ঠিক হবে।জায়ানের সম্পর্কে তার পরিবার কিছুই জানেনা,এখন যদি আমরা তাদের জায়ানের কথা জানাই,তাহলে বুঝতেই তো পারতেছিস কাহিনী অনেক দূর চলে যাবে।অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।আর জায়ানের অনুমতি ছাড়া আমরা তার সম্পর্কে কিছু বলতেও পারবোনা।
পাশ থেকে এলেনা সামনে এগিয়ে এসে বলে,
Exactly! মার্কো ঠিকি বলেছে,জায়ান সুস্থ হয়ে উঠা আগ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিৎ। এখন তোরা সবাই বাড়ি যা,আমি এখানে জায়ানের কাছে থাকছি। একটু থেমে আবার বলে উঠলো-
জায়ান না-হয় আমায় কোনোদিন আপন করে নেয় নি, হৃদয়ে স্থান পাইনি তো কি হয়েছে,আমার হৃদয়ে তো… -বলতে গিয়েই থেমে গেলো মেয়েটা
যাই হউক এখন অন্তত পাশে থেকে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে তো পারবো।
এলেনার কথা শেষ হতে না হতেই,এলেক্স বলে,
ভুল জায়গায় ভুল মানুষকে হৃদয় দিলে,
সেই হৃদয় আর হৃদয় থাকে না,,,
চূর্নবিচুর্ণ হয়ে যায়।
কথাটা মাথায় রাখিস।যেই জিনিস তোর না সেই জিনিসে আশা রাখাও বোকামো। অধিকার খাটানোও শুভা পায় না।
নাদিয়া:
Shut up!guys….হসপিটাল এইসব বলার জায়গা না।এখন এইসব কথা না বলে বেশি বেশি প্রে কর সবাই,, যেনো জায়ান আমাদের মাঝে দ্রুত ফিরে আসে। i hope তোরা বুঝতে পেরেছিস।
তাদের এসব কথার মাঝেও জায়ানের নিঃশ্বাসের প্রতিটা ওঠা-নামা তাদের মনে যে ধাক্কা দিচ্ছে। কেউ বলতে পারছে না, কেউ দেখতে পারছে না, কেউ চোখের কোণ থেকে অশ্রু ফেলছে,কেবল একটা অদৃশ্য শৃঙ্খল তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, যেটি একমাত্র আশার শক্তিতে বেঁধেছে।ঘড়ির কাঁটা চলে, কিন্তু সময় যেন থেমে গেছে। হাসপাতালের নিঃশব্দ কক্ষে শুধু তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ আর হৃদয়ের গর্জন শোনা যায়।
(বাংলাদেশ, ঢাকা)
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ। লম্বা গেটটা পেরিয়ে ঢুকতেই দুপুরের রোদে চকচক করছে ইট-সিমেন্টের বিশাল দালান। বারান্দা জুড়ে ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট দল, কারো হাতে মোবাইল, কারো হাতে ফাইলভর্তি খাতা, কেউ আবার ছায়ার নিচে বসে গল্পে মশগুল। চারপাশে একটা চাপা উত্তেজনা,বোর্ড পরীক্ষা আর মাত্র ক’দিন পর, তাই আজ প্রবেশপত্র বিতরণ।কলেজের ভিতরে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, তবুও যেন হাওয়ার মধ্যে একটা গম্ভীর গন্ধ বড় পরীক্ষার আগে যেমন থাকে। এই ভিড়ের মাঝেই মেরিন আর রিমা নিজেদের পুরোনো আড্ডার জায়গায় বসে আছে। তাদের ঠিক সামনেই চুপচাপ বসে লিয়ানা, হাতে ফাইল ধরা, কিন্তু চোখ যেন কোথাও দূরে হারিয়ে গেছে।মেরিন চোখ কুঁচকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল,
কিরে, কী হয়েছে তোর? এমন পেঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেনো?
লিয়ানা সামান্য চমকে উঠে মুখ তুলল,
কই!কিছুই তো হয়নি।
রিমা সঙ্গে সঙ্গেই মুচকি হেসে মেরিনকে চোখ টিপল, তারপর লিয়ানার দিকে ঝুঁকে,
কিছুতো একটা হয়েছেই,বলে ফেল আমরা আমরাই তো।
লিয়ানা মুখ ঘুরিয়ে ধীর গলায় বলল,
বাদ দে তো।
মেরিন ঠোঁট বাঁকিয়ে দুষ্টুমি করে গা ঠেসে দিয়ে,
কেনো বাদ দিবো কেন, রোমিও কলেজে নিয়ে আসেনি তাই বলে মন খারাপ ?
লিয়ানা কপাল কুঁচকে ঘুরে তাকালো,
রোমিও কে? বাজে বকিস না।
রিমা হেসে উঠে,
আরে, হ্যান্ডসাম ড্যাশিং ম্যান জায়ান খান।
লিয়ানা মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল। তারপর গলাটা অদ্ভুতভাবে নরম হয়ে এলো,
উনি দেশে থাকলেই তবেইতো দিয়ে যাবে!
ওরা দু’জনেই থমকে গেলো। মেরিন আর রিমা দু’জনের মুখে একসাথে ‘হাঁ’ হয়ে গেল যেন,কেউ যেন আচমকা এমন একটা কথা বলেছে যা তারা আশা করেনি।
মানে কী?
ঐ লোকটার কথা আর বলবি না বুঝেছিস? এতো পাষান লোক,গরিলা,এনাকোন্ডা, আর্কিওপটেরিক্স, দাদা ভাই,কেন যে জায়ান খান রাখতে গেলেন! নামটা রাখা উচিত ছিলো জাওরা খান।
লিয়ানা কথা শেষ করতেই মেরিন সঙ্গে সঙ্গে হেসে ফেটে পড়লো, আর লিয়ানা মুখে বিরক্তির ভান করলেও ভেতরে কোথাও যেন হালকা একটা ধাক্কা লাগল কোনো গভীর অভিমান । তার আঙুলের ডগা ফাইলের প্রান্ত ঘষতে লাগল,তবে কেউ খেয়ালও করলো না তা।
রিমাঃআমার কি মনে হয় জানিস উনি হয়তো ফ্রান্সেই বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকে।হতেও পারে,মানে..
আর কিছু বলার আগেই মেরিন রিমার মুখ চাপা দিয়ে ধরে,
চুপ শালী! কি বলছিস এসব,তারপর লিয়ানার দিকে তাকিয়ে,
আরেএএএ,,তুই এই মাথা মোটার কথা একদমই কানে নিস না,ভাইয়া মেইবি কোনো কাজে গিয়েছেন,চলে আসবেন।
লিয়ানা কিছুই বললো না, চুপ করে বসেই থাকলো।কি যেনো ভেবেই চলছে মেয়েটা তখন থেকে।মেরিন লিয়ানাকে ধাক্কা দিতেই,
বিয়ে করুক না জাহান্নামে যাক,তাতে আমার কি বাল,ঐ জায়ান খান যদি আমাকে ফুফু বানিয়ে দেয়,আমিও লিয়ানা খান তাকে মামা বানিয়ে দিবো।
রিমা,
আইডিয়াটা কিন্তুু খারাপ না লিয়ু!একদম Tit for tat!
এই দুই পাগলের এমন বিপদজনক কথা শুনে মেরিন হতবাক, কি বলবে কিছুই বুঝতেছেনা,,,কিছুক্ষণ মাথা চুলকিয়ে,,পাশে বসে থাকা দুই পাগলের কান ধরে বললো তোরা দুইটা তো মরবি মরবি আমকেও নিয়ে মরবি অনেক হয়েছে চল চল।গেটের বিশাল লোহার পাট খুলে যখন তিনজন একসাথে বেরোল—লিয়ানা, রিমা আর মেরিন—তখন দুপুরের রোদটা একেবারে সোনালি হয়ে রাস্তার ধুলোয় পড়ে ঝলমল করছে। বাইরে রাস্তার ওপরে কয়েকটা রিকশা, দু’একটা বাইক, আর ঠিক গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এক চকচকে কালো রঙের মার্সিডিজ। গাড়িটার গ্লাস যেন আয়নার মতো ঝকঝক করছে, সূর্যের আলো তাতে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।
তাদের চোখের সামনে প্রথমে শুধু সেই গাড়িটাই ধরা দিলো… কিন্তু পরের মুহূর্তে—
গাড়ির সামনের ফেন্ডারের পাশে, হাত দুটো গুটিয়ে, এক পা সামান্য সামনের দিকে, দাঁড়িয়ে আছে এক পুরুষ। নীল শার্টের কলার অল্প খোলা, সাদা প্যান্টে অদ্ভুত এক কনফিডেন্স ঝরে পড়ছে, চোখে কালো সানগ্লাস। তার চুলে হালকা বাতাস লেগে এলোমেলো হয়ে আছে, ঠোঁটে এক টুকরো নিঃশব্দ হাসি—যেন জানে, ঠিক এই মুহূর্তে তিন জোড়া চোখ তার দিকেই স্থির হয়ে আছে।
মেরিনের ঠোঁট ফাঁক হয়ে ও মাই গড..ফিসফিস শব্দ বেরোলো, আর রিমার চোখে ছায়া পড়লো হালকা বিস্ময়ের।
রকস্টার ইশান শেখ।
তার উপস্থিতি যেন রাস্তাটা, বাতাসটা, এমনকি সময়কেও থামিয়ে দিলো।এক সেকেন্ড,,দুই সেকেন্ড,তারপরই মেরিন এর চোখ বিস্ফারিত,রিমা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না,
ওনি হঠাত এখানে,,আমাদের কলেজে আবার!তার চোখে হঠাৎ চকচক করে ওঠে উচ্ছ্বাস।
ভালোই হয়েছে! ওইদিন অটোগ্রাফ নিতে পারিনি, আজকে নেবই নেবো!
বলেই ব্যাগ থেকে তাড়াহুড়ো করে ছোট্ট ডায়েরিটা বের করে সোজা ছুটে যায় গাড়ির সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে।
ভাইয়া, আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান,প্লিজ, একটা অটোগ্রাফ দিন!
ইশান ধীরে ধীরে চোখের সানগ্লাস খুলে বুক পকেটে রেখে দেয়।তারপর, সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে এক চিলতে হাসি,
yes,,why not!বাট,কথা শেষ না করেই হালকা করে মাথা ঘুরিয়ে লিয়ানার দিকে তাকায়।
তোমার বন্ধুবি যদি বলে তবেই দিবো।
রিমা ভ্রু কুঁচকে—বন্ধুবি? কী বোঝাচ্ছেন?
ইশান এর গলা নরম, কিন্তু দৃষ্টি একেবারে সোজা গিয়ে থামে,
ওই যে,ব্রাউন আইস মেয়েটা।আই মিন,লিয়ানা।
রিমাও ঘুরে তাকায় লিয়ানারর দিকে,আর মেরিনও তাকিয়ে থাকে একদম থমকে,লিয়ানার মুখে হতবাক ভাব, যেন কিছুই বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে এই পরিস্থিতিতে।ইশান এবার নিজেই কয়েক পা এগিয়ে আসে, সানগ্লাসহীন গভীর দৃষ্টি লিয়ানার দিকে নিবদ্ধ করে,
তাহলে বলো, অটোগ্রাফ কি দিবো তোমার বান্ধুবিকে?
লিয়ানার ভ্রু কুঁচকে যায়, চোখে সামান্য বিরক্তি,
মানে কী? আপনি ওকে দিন, আমার কাছে এসে এসব বলছেন কেন? অদ্ভুত!এই তোরা থাক আমি চললাম,গাড়ি চলে আসবে এখুনি।
বলেই সরে যেতে চায়, কিন্তু ঠিক তখনই ইশান শান্ত গলায় বলে ওঠে,
যাবার দরকার নেই। তোমাদের ড্রাইভারকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি।
একটু থেমে মুচকি হেসে যোগ করে,
আমি নিজেই পৌঁছে দিবো তোমাকে।
ইশান রিমার হাত থেকে ডায়েরিটা টেনে নিলো। একটা সিগনেচার করে বলল,
তোমরা যাও, তোমাদের বান্ধবীর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
রিমা অবাক হয়ে তাকাল,রিমা আর মেরিন না চাইতেও একসঙ্গে দ্রুত সামনে হাঁটা দিলো।ঠিক সেই মুহূর্তে।
গাড়িতে ওঠো।
লিয়ানা কেঁপে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো, ঠোঁটে একরকম নীরব ক্লান্তি, কিন্তু চোখে তীক্ষ্ণতা।
শুনুন, ওইদিন একটা, মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছিল। আমি রেগে গিয়ে কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলেছিলাম। সত্যিই,,আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।
আরে, আরে, কী করছো? আমি কি তোমাকে সরি বলতে বলেছি নাকি? একধাপ এগিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
বলেছি, গাড়িতে উঠো।
গাড়িতে উঠবো? মানে, আমি আপনাকে চিনি না, জানি না। গাড়িতে কেন উঠবো? দয়া করে সামনে থেকে সরে যান।
ইশান হালকা হেসে ফেললো, চোখে যেন খেলা করে যাচ্ছে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস।
তুমি একমাত্র মেয়ে যে বলতে পারলো,আমাকে চেনে না। জানো কত মেয়ে আমার পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
লিয়ানা কাঁধ ঝাঁকাল, ঠান্ডা গলায় বলল,
তো যান না ওদের কাছেই। দয়া করে আমার সামনে আর আসবেন না।
ইশানের হাসি কিছুটা গভীর হলো, গলায় নামলো নিচু স্বর
আহা,সবাই আর তুমি কি এক? ইউ আর ডিফারেন্ট। তাইতো!
কি?
ইশান সামনে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলো, একহাত তুলে ইশারা করল,
উঠে পড়ো। রাস্তায় মানুষ দেখছে।বেপার টা মোটেও ভালো না।
লিয়ানা দাঁত কামড়ে তাকিয়ে রইল, কিন্তু চারপাশে লোকজনের নজর, পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর উপায় নেই। অনিচ্ছায়, যেন নিজের মনকে ধমক দিয়ে, ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই, ভিতরের ভারী নীরবতা যেন বুকের ভেতর ঢুকে বসলো।কালো মার্সিডিজটা ধীরে ধীরে গেট পেরিয়ে শহরের ভিড়ের ভেতর ঢুকে গেলো। জানলার কাঁচ নামানো, ভেতরে বসা ইশানের হাতে স্টিয়ারিং,আঙুলের হালকা খেলা, কব্জিতে ঝলসে উঠছে ঘড়ির সোনালি ঝিলিক। রোদের আলো এসে পড়েছে তার ব্লু শার্টে, মুখের অর্ধেকটা ঢাকা সানগ্লাসে, তবুও ঠোঁটের কোণে সেই ধীর, আত্মবিশ্বাসী হাসি।
আমার কাছে কি চাই, আপনার?
ইশান সিটে একটু সরে বসল, চোখ সরাসরি তার দিকে না রেখে বাইরে তাকালো।
তোমাকে।
লিয়ানার মাথা হালকা ঘুরে গেলো, চোখে বিস্ময়,
মানে কি?
ইশান এক মুহূর্তের জন্য চোখ ফেরালো না রাস্তা থেকে, কেবল স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
ওইদিন.,প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। Believe me।রাতে ঘুমাতেই পারি না।
কি?! গাড়ি থামান! আমি বলছি, গাড়ি থামান। এইসব উল্টাপাল্টা কথা আর শুনতে আগ্রহী না আমি। অসহ্য! আপনি কেমন লোক? কোথাকার কে—জানেন তো আমি কে?
তার কথার ঝড় থামাতে ইশান হঠাৎ ঠুস্ করে নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি ধীরে ধীরে সাইডে আনলো,রাস্তায় হালকা ধুলো উড়ছে, গাড়ি থামার সাথে সাথে একটা তীক্ষ্ণ নিস্তব্ধতা নেমে এল। ইশান ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে লিয়ানার দিকে তাকালো, সানগ্লাসের ভেতর তার চোখের গভীর অন্ধকারটা যেন সব গিলে নিতে চায়।ঠোঁটের কোণে সেই ধূর্ত হাসি ফিরিয়ে বলল,
আমি খুব ভালো করেই জানি…তুমি কে।ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরলো, চোখে যেনো অদ্ভুত এক জেদ ও শীতল আগুন—
শিল্পপতি সোলেমান খানের মেজো ভাই ফাহিম খানের বড় মেয়ে… লিয়ানা খান।
এক সেকেন্ড থেমে, গলায় ঠান্ডা হাসি,
জানো, তোমার নাম জানতে আমাকে রাজউক কলেজের টুয়েল্ভের সব সেকশনের হাজিরা খাতা দেখতে হয়েছে,কত সময় নষ্ট করেছি বলো তো… আজকের কনসার্ট ক্যানসেল করলাম শুধু তোমার সাথে দেখা করতে। বলো, কী করবো আমি?
লিয়ানা হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইল,
দেখুন, আপনি যা চান তা কোনোদিন হবে না,কোনোদিনও না! প্লিজ আমার পেছন ছেড়ে দিন,তা না হলে মারা পড়বেন,জানে মরে যাবেন।
মরে যাবো?
চোখে এক বিন্দু পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল ইশান,
তা তো আমি এখনই যাচ্ছি.,শোনো, বিয়ে করো আমাকে।
আপনি কি পাগল?! শুনুন মিস্টার, বিয়েকে কি কোনো মজার বিষয় ভেবেছেন? যাকে খুশি তাকে বলে দেওয়া যায়?
কই, কে বলেছে যাকে-তাকে,আমি তো শুধু একজন মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই। আর সেই মেয়ে,তুমি।
গাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো, জানালার বাইরে পরিবেশ যেনো আরও গভীর হয়ে উঠলো।লিয়ানা আর কিছু বললো না। তার চোখে যেন অসংখ্য কথা জমে আছে, কিন্তু ঠোঁট সেগুলো প্রকাশ করার সাহস পেলো না। গাড়ির ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল শুধু ইঞ্জিনের মৃদু গর্জন, আর জানালার বাইরে হাওয়ার শব্দ।ড্রাইভারের আসনে ইশানের মুখে এক অদ্ভুত স্থিরতা, যেন কিছু ঠিক করে নিয়েছে সে। রাস্তার আলো গাড়ির ভেতরে এসে কখনো তার চোখে পড়ে, কখনো মিলিয়ে যায়।হঠাৎ সামনের গেট ভেসে উঠল,খান বাড়ির বিশাল লোহার ফটক। গাড়ি ধীরে ধীরে থামলো।গেটের রক্ষী তাড়াতাড়ি খুলে দিলো, ইঞ্জিনের গর্জন নীরবতার ভেতর মিলিয়ে গেল।এক মুহূর্তও নষ্ট না করে লিয়ানা তড়িঘড়ি সিটবেল্ট খুলে ফেললো। দরজা ঠেলে নেমেই সে একটুও পেছন ফিরে তাকালো না,সোজা এগিয়ে গেলো বাড়ির ভেতরে। পেছনে, ড্রাইভারের সিটে বসা ইশান এক দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে প্রায় ফিসফিস করেই বলে উঠল,
বিয়ে তো আমি তোমাকেই করবো, wait and see।
তার গলায় অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, যেনো সেই কথার মধ্যেই ভবিষ্যতের রায় লিখে দিলো।লিয়ানা সিঁড়ি বেয়ে এক নিশ্বাসে উপরে উঠে গেলো। করিডরের শেষের মাথায় বড়ো আম্মুর রুমের দরজার দিকে পা বাড়াতেই ভেতর থেকে নাফিসা খান বেরিয়ে এলেন। হঠাৎ লিয়ানাকে এইভাবে রুমের দিকে আসতে দেখে তিনি খানিকটা বিস্মিত হয়ে বললেন,
কি হয়েছে মা?
জায়ান ভাইয়ার বন্ধুর নম্বরটা দেও,ঐ যে যিনি তোমাকে সেদিন ফোন করেছিলেন।
নাফিসা খান একটু অবাক হলেও ফোন অন করে নম্বরটা দিয়ে দিলেন
লিয়ানা আর কিছু শোনেনি। তারপর সে প্রায় দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। দরজা বন্ধ করেই নম্বরটা ডায়াল করলো। স্ক্রিনে লেখা উঠলো switch off!
একবার,দুইবার,তিনবার, প্রতিবারই একই উত্তর। ফোন বন্ধ।দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে এবার সে জায়ানের নম্বর ডায়াল করলো। সেখানেও সেই একই যান্ত্রিক উত্তর, switch off।
লিয়ানা চুপচাপ বিছানায় বসে পড়লো। বুকের ভেতর যেন কেউ নীরবে একটা ভারি তালা ঝুলিয়ে দিলো। ঠোঁটের কোণে তিক্ত হাসি এনে, প্রায় নিজের সাথেই কথা বলে উঠলো,
আপনি কি সারাজীবনের জন্য চলে গেলেন? ইচ্ছে করেই এইসব করছেন তাই না?এক মুহূর্ত থেমে, গলার স্বর আরও নিচু করল,
তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১০
আপনি কি সত্যি,বিবাহিত,বউ আছে,তাই চলে গেলেন?
রুমের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। জানলার বাইরে র আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন সেও কিছু বলতে চাইছে,কিন্তু চুপচাপ রয়ে গেলো, ঠিক লিয়ানার মতো।
