তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৬

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৬
ভূমিকা তালুকদার

(প্যারিস,ফ্রান্স।)
রাতের আকাশে চাঁদের আলো ম্লান, তার সঙ্গে শহরের ঝলমলে আলোগুলো যেনো মিশে গেছে। রাস্তার দুই পাশে পুরনো ইউরোপিয়ান বিল্ডিংগুলোর দেয়ালে নরম আলো ফেলে উঁচু ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ পাহারাদারের মতো। হালকা শীতল বাতাস ভেসে আসছে ঠাণ্ডার ছোঁয়া। রাত গভীর, তবুও প্যারিসের রাস্তায় সেই চিরচেনা শান্ত গুঞ্জন দূরে কোনো ক্যাফের দরজা আধখোলা, কেউ হয়তো হুইস্কি গ্লাস হাতে শহরের রাত উপভোগ করছে।এই নীরবতার ভেতর হঠাৎ এক অচেনা শব্দ একটা শক্তিশালী ইঞ্জিনের গর্জন। প্যারিসের অন্ধকার রাস্তায় ঢুকে পড়লো এক কালো রঙের ল্যাম্বরগিনি । গ্লসি বডি, ম্যাট ফিনিশ গাড়িটা যেনো রাতের অন্ধকার গিলে ফেলছে। এর হেডলাইটের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে রাস্তায় ছিটানো শিশিরবিন্দু। সেই গর্জন ধীরে ধীরে থেমে গেলো, যখন গাড়িটা এসে দাঁড়ালো এক বিশাল গেটের সামনে।দুজন কালো স্যাুট পড়িহিত দুজন গেট ম্যান সদরে গেট খুলে দিলো। গেটের ওপরে বড় অক্ষরে ইংরেজিতে খোদাই করা SHADOW EMPIRE।

এ গেট সাধারণ কোনো গেট নয় পেছনে চোখ ধাঁধানো একটা বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স। গেটের ওপাশে লম্বা ড্রাইভওয়ে, দুপাশে সাজানো ফোয়ারা আর বাগানের সুগন্ধি ফুল। বারান্দার ঝাড়বাতি ঝলমল করছে, যেন ভেতরের জাঁকজমকের আভাস দিচ্ছে। রাত হলেও পুরো প্রপার্টি এমন আলোয় ভরা, যেন অন্ধকারের কোনো অস্তিত্বই নেই।গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা আস্তে খুলে গেলো। ভারী কালো কোট আর শার্প স্যুটে ঢাকা লম্বা চেহারার একজন পুরুষ ধীরে পা রাখলো ঠাণ্ডা মার্বেলের উপর। যে আর কেউ নয় জায়ান। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু ভেতরের আগ্রাসী শান্তি ফুটে উঠছে নীরব অথচ বিপজ্জনক এক আবহ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গা ঘেঁষে ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার কোট হালকা উড়ছে, পায়ের বুটের শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।কিন্তু জায়ান থামলো না গেটের দিকে। সে ধীরে ধীরে ঘুরে গেলো গাড়ির বিপরীত পাশে। সেখানে দরজাটা আস্তে খুললো। অন্ধকারের ভেতর ফ্যাকাশে আলোয় ভেসে উঠলো একটা ম্লান মুখ। লিয়ানা আধোচোখে খোলা দৃষ্টি, কিন্তু চেতনার শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কাঁধে লেগে আছে, ঠোঁটে রক্তের ক্ষীণ দাগ, গলার কাছে ছেঁড়া সিল্কের ছোঁয়া। তার নিস্তেজ দেহ যেনো গাড়ির সিটে হারিয়ে গেছে।জায়ানের হাত ধীরে এগিয়ে গেলো। দৃঢ় অথচ কোমল স্পর্শে সে আনলক করলো সিটবেল্ট। তারপর মুহূর্তের মধ্যে লিয়ানাকে নিজের বাহুতে তুলে নিলো। যেনো পৃথিবীর সব ভার এক নিঃশ্বাসে নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিলো সে। তার বাহু শক্ত, অথচ স্পর্শে আছে এক অদ্ভুত মায়া।

কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের গরম ধোঁয়া আর পেছনে মিলিয়ে যাওয়া আলো। জায়ান ধীরে ধীরে পা ফেলছে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে রাতকে নিজের দখলে নিচ্ছে। চোখের ভেতর আগুনের রেখা, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত নীরবতা। জায়ান সেই নীরব রাতকে ছিঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো, তার বাহুতে লিয়ানার নিস্তেজ দেহ আর এই প্যারিসের রাত তাদের রহস্যময় গল্পের সাক্ষী হয়ে রইলো ।রাতের নিস্তব্ধতায় জায়ান ধীরে ধীরে বিশাল সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে পা দিতেই চারপাশ যেনো আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে গেলো। পুরো বাড়িটা নীরব, যেনো প্রাণহীন। এত বড় অট্টালিকা, অথচ কোনো শব্দ নেই,কেউ আছে কি না বোঝাই যাচ্ছে না। শুধু দূরে কোথাও থেকে হালকা বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, যেনো পুরোনো দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে।
জায়ান ধীর পায়ে এগিয়ে চলল ভেতরের দিকে। তার চোখে ছিল অদ্ভুত এক শীতলতা, ঠোঁটের কোণে এক অচেনা দৃঢ়তা। হঠাৎ রান্নাঘরের দিক থেকে এক টুকরো আলো ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। সেই আলোয় ভেসে উঠলো এক মধ্যবয়স্ক ফরাসি মহিলার ছায়া। হাতে একটা ট্রে, মুখে অচেনা আতঙ্কের ছাপ।পোশাক বিদেশি মেইড দের মতো।
তিনি সামনে এগিয়ে এলেন, চোখে বিস্ময়।

জায়ান স্যার।
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই জায়ান হাত তুললো। শুধু একটুকরো ইশারা। কোনো শব্দ নয়, শুধু ইশারা,যেনো কড়া নিষেধ।
একটি শব্দও করবে না।
মহিলাটি গলা শুকিয়ে গেলো। তার চোখে অদ্ভুত ভয়ের ছায়া। দূরের ঘড়ির টিকটিক শব্দ যেন হঠাৎ আরও স্পষ্ট শোনা গেলো।জায়ান ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলো। তার ভারী বুটের আওয়াজ নিস্তব্ধ বাড়িটাকে আরও ভয়াল করে তুলছিলো। পেছনে দাঁড়ানো ফরাসি মহিলাটি নিশ্চুপ চোখে তাকিয়ে রইলেন,তবে চোখ তার থেমে গেলো জায়ানের কোলের দিকে।
সেখানে নিস্তেজ এক তরুণী,বয়স খুব বেশি হলে আঠারো-উনিশ। পরনে বিয়ের শাড়ি।বিদেশি মহিলা হলেও সাজ পোশাক দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন এইটা বিয়েরই পোশাক হবে।
তিনি এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনের ভেতর ফিসফিস করে বললেন,

তবে,ওনি কি মিস লিয়ানা??
কথাটা মুখ দিয়ে বেরোল না, ঠোঁট নড়লো সামান্য। কিন্তু উত্তর তিনি পাননি
জায়ান কোনো দিকে তাকালো না, শুধু এগিয়ে চললো, যেনো পাথর কঠিন ইচ্ছা নিয়ে।উপরে উঠতেই লম্বা করিডর। একের পর এক দরজা। প্রায় সবগুলোই বেডরুমের মতো। করিডরের শেষ প্রান্তে একটি দরজা, অন্যসবের চেয়ে আলাদা। উপরে খোদাই করা মোটা অক্ষরে একটাই শব্দ
JAYAN।
জায়ান এক মুহূর্ত থামলো। ঠোঁট শক্ত করে চেপে দরজার হাতল ধরে আলতো করে ঘোরাল।
ধীরে ধীরে দরজা খুললো।

ভেতরটা অন্ধকারে ঢাকা। তবে বাইরের চাঁদের আলো সরু রেখার মতো এসে পড়ছে বেলকনির কাঁচের দরজা দিয়ে। সেই আলোয় ভেসে উঠলো রুমের আকার। ঘন কার্পেট, অচল ল্যাম্পশেড, একপাশে লম্বা কাচের জানালা
সবকিছু নিস্তব্ধ, ঠান্ডা, এবং অদ্ভুতভাবে রহস্যময়।
জায়ান পা রাখতেই রুমের ভেতরের হাওয়া যেনো বদলে গেলো। নিস্তব্ধতার ভেতর তার বুকের শব্দটাই যেনো শোনা যাচ্ছিল। হাতে এখনো নিস্পন্দ লিয়ানা চাঁদের আলোয় তার মুখটা কাগজের মতো ফ্যাকাশে।জায়ান লিয়ানাকে ধীরে ধীরে বেডের ওপর শুইয়ে দিলো। লিয়ানার নিথর শরীরটা ধূসর চাদরের ওপর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলো। পাশে বসে থাকা জায়ান হাত বাড়িয়ে এক পাশে রাখা নরম বালিশটা তুলে এনে লিয়ানার মাথার নিচে আলতো করে রাখলো, যেনো তার ঘুম আরেকটু শান্ত হয়।

লিয়ানার চুলগুলো বিয়েতে সুন্দর করে খোপা করা ছিলো, তাতে লাল গোলাপের ফুল গোঁজা ছিল যত্নে। কিন্তু এত ঝড়ঝাপটার পর খোপা ভেঙে গিয়েছে, চুলগুলো এখন এলোমেলো হয়ে বালিশে ছড়িয়ে আছে। মাঝেমাঝে চুলের ফাঁকে গোলাপের লাল পাপড়ি আটকে আছে, কিছু পাপড়ি বালিশের ওপর গড়িয়ে পড়েছে। দৃশ্যটা যেনো নিঃশব্দে কোনো গল্প বলছে,একটা ঝড় কেটে গেছে, আর তার অবশিষ্ট রঙ লেগে আছে চুল আর বালিশে।জায়ান ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে বেলকনির দিয়ে বাইরে তাকালো যেখাানে হালকা আলোয় ভেসে থাকা প্যারিসের আকাশে এক টুকরো চাঁদ দেখা যাচ্ছিলো। সে গভীর দৃষ্টিতে সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো, মুখে গাম্ভীর্য জমে আছে। মনে হচ্ছিলো, তার ভেতরে ঝড় বইছে যা মুখে ফুটে ওঠেনি, কিন্তু চোখে ছাপ ফেলেছে।
হঠাৎ মাথা ঘুরাইতে চোখ পড়লো বিছানায় শুয়ে থাকা লিয়ানার নিথর শরীরের দিকে। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো সরাসরি এসে পড়েছে তার মুখে।যার আলোয় মেয়েটার ফর্সা মুখটা অদ্ভুত রকমের শান্ত আর লাবণ্যময় দেখাচ্ছিলো, যেনো কোনো চিত্রশিল্পীর তুলির টান। মুহূর্তের জন্য জায়ান স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছিলো কোনো স্লিপিং বিউটি সুয়ে আছে বিছানায়। জায়ানের হাতের মুষ্টি ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে এলো, গলার ভেতর দিয়ে একরাশ ঢুক গিলে ফেললো সে।

তারপর ধীরে ধীরে সরে এসে টেবিল থেকে এসির রিমোট তুলে নিলো বোতাম চাপতেই ঠান্ডার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো রুমের কারণ তার কপাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ছিলো। রিমোটটা রেখে সে চোখ নামিয়ে , গভীর নিশ্বাস ফেললো।
এরপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য, তারপর হঠাৎ করে হাত দিয়ে গলার টাই টা ডিলে করলো, কালো ব্লেজার খুলে সেটি সোফার ওপর ছুঁড়ে মারলো। তার ভেতরের তাপ যেনো এই কাজের সাথেই ছিটকে বেরিয়ে আসছে। ব্লেজারের পর সে শার্টের বোতামগুলো একে একে খুলতে শুরু করলো, প্রথমে দু একটা, তারপর সবগুলো। শার্ট এর বোতম গুলো খুলা মাত্রই চাঁদের আলোয় জায়ানের ফর্সা শরীরের ওপরের শক্তপোক্ত পেশি আর স্পষ্ট সিক্সপ্যাক যেনো আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ফুটে উঠলো। পুরো দৃশ্যটা যেনো নিস্তব্ধ রুমে এক নিঃশব্দ শক্তির বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে।জায়ান ধীরে ধীরে বিছানার কাছে এসে ঠান্ডা মার্বেল ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলো। তার দৃষ্টি এক সেকেন্ডের জন্যও লিয়ানার মুখ থেকে সরলো না। ঘর নিস্তব্ধ,শুধু এসি’র মৃদু শব্দ আর বাইরে চাঁদের আলো।
জায়ানের আলতো হাত এগিয়ে গেলো লিয়ানার মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলের দিকে। আঙুলের ডগা দিয়ে সেগুলো সরাতে সরাতে তার ঠোঁটে অজান্তেই ভেসে উঠল গুনগুন,একটা নেশালো গলায় ফিসফিসে সুর,

“Hein yeh nasha”
“Yeh hein zeher”
“Iss pyaar ko hum kya naam de?”
গানটা শেষ হওয়ার আগেই তার চোখ পড়লো লিয়ানার গায়ে চাপানো লাল বেনারসির দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই তার শিরার র*ক্ত যেনো আগুনের মতো ফুটে উঠলো। তার মস্তিষ্কের ভেতর যেনো বজ্রপাত হলো এই শাড়ি,তার বউয়ের গায়ে অন্য একজন পুরুষের দেওয়া শাড়ি!জায়ানের বুকের ভেতর গর্জে উঠল অদম্য ক্রোধ। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এল রক্তিম আভায়, দৃষ্টি হয়ে উঠলো ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ণ। মুখের সব পেশি শক্ত হয়ে গেল, যেন নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

তার নিঃশ্বাস এখন তীব্র ও ভারী। গলার শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল, যেন প্রতিটি রাগের ঢেউ শরীরের ভেতর গর্জন করছে। মনে হচ্ছিল,এই শাড়ি পরার অধিকার ওর নেই। আমার বউ, অন্যের ছোঁয়ায় রঙিন হবে? না! যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি, তা কখনো সম্ভব নয়। রাতের নিস্তব্ধতা ভারী হয়ে আছে রুমের চারপাশে। জানালার পর্দা হালকা দুলছে, দূরে বৃষ্টির শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। নরম আলোয় বিছানার একপাশে নিঃশ্বাসের মৃদু ওঠানামা লিয়ানা গভীর ঘুমে ডুবে আছে, মুখে নির্ভাবনার শান্ত ছায়া।

জায়ান লিয়ানার আরো কাছে এগিয়ে আসে, তার চোখে অদ্ভুত এক শীতল আগুন। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে তার আঙুল লিয়ানার মুখের বাঁক ছুঁয়ে যায় চোয়ালের হাড় থেকে ঠোঁটের কিনারায় গড়িয়ে নামছে সেই স্পর্শ, ঠোঁটের কাছে এসে থেমে যায় মুহূর্তের জন্য, তারপর আবার নেমে আসে গলার নিচে।লিয়ানার শরীর হালকা কেঁপে ওঠে ঘুমের ভেতরেই। শ্বাস কিছুটা গভীর হয়। ঠিক তখনই জায়ানের চোখের দৃষ্টি আরও অন্ধকার হয়ে ওঠে। হঠাৎ শক্ত হয়ে ওঠে তার হাত এক ঝটকায় সে আঁচল সরিয়ে দেয় শরীর থেকে।

রুমে শুধু শ্বাসের শব্দ,একটা গভীর, ভারী, আরেকটা শান্ত অথচ অচেতন। আলোয় জায়ানের তীক্ষ্ণ চোয়ালের ছায়া পড়ছে দেয়ালে, যেনো এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে,কামনা আর সংযমের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্ত।পুরো রুম জুড়ে চাঁদের আলো নিস্তব্ধতার সঙ্গে গা মিশিয়ে আছে। বিছানায় শুয়ে থাকা লিয়ানার নিঃশ্বাস শান্ত, কিন্তু সেই শান্তিই জায়ানের বুকের ভেতর তোলপাড় তুলছে।তার চোখ ধীরে ধীরে নেমে আসে লিয়ানার মুখ থেকে গলার বাঁক তারপর বক্ষ,যেখানে একটা তিলক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো,মন চাইলো সেখানের ঠোঁটের শীতল স্পর্শ ছুয়িয়ে দিতে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে জায়ানের , বুকটা উঠানামা করছে দ্রুত গতিতে। আঙুলের ডগা কেঁপে ওঠে,সে হাত বাড়ায় লিয়ানার উন্মুক্ত উদরের দিকে। মুহূর্তের জন্য থেমে যায়, তারপর ঝুঁকে পড়ে লিয়ানার দেহের উষ্ণতা আর মৃদু গন্ধ নিজের ফুসফুসে টেনে নেয়। এক গভীর শ্বাস,মাথার ভেতর যেন বজ্রপাতের শব্দ।

তার ভেতরের পুরুষ সত্তা মুহূর্তেই জেগে ওঠে। শিরায় শিরায় গরম রক্তের ঢেউ বইছে।ঠিক তখনই নিজের বুকের ভেতর ধাক্কা খায় কিছু।জায়ান হঠাৎ সরে যায়। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। শ্বাস ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে, যেনো বুক ফেটে যাবে। দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড,চোখে অন্ধকার, কানে নিজের নিঃশ্বাসের গর্জন।দেয়ালের দিকে হেলে পড়ে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে দাঁত চেপে ধরলো ঠোঁটে। লাইটারের আগুন জ্বলে উঠতেই তার চোখে ঝলসে ওঠে গোপন অস্থিরতা। প্রথম টানটা ফুসফুসে গিয়ে যেন বিস্ফোরিত হয়,ধোঁয়ার সঙ্গে বেরিয়ে আসে এক গর্জন ভরা দীর্ঘশ্বাস।

উনত্রিশ বছরের জীবনে কোনো নারীকে এতটা কাছে টানেনি, আশেপাশেও ঘেষতে দেয় নি।কাছে যায়নি কোনো নারীর। অথচ আজ এক মুহূর্তে সে দূর্বল হয়ে পড়ছে। এই মেয়েটা তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে,ভয়ানকভাবে।
জায়ানের হাত শক্ত হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হয়। বুকের ভেতর ক্রোধ আর কামনার জোয়ার মিলেমিশে এক বিষাক্ত ঝড় তৈরি করছে। জায়ান আর সহ্য করতে পারে না। দ্রুত পা চালিয়ে দরজার দিকে যায়, এক ঝটকায় দরজা খুলে বেরিয়ে যায়, তারপর দরজাটা এমন জোরে আছড়ে দেয় যে শব্দে দেয়াল কেঁপে ওঠে।জায়ান ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। শরীরটা কেমন যেনো অস্থির লাগছে। কেনো জানি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জায়ান তো কখনো দুর্বল হয় না, সব সময় নিজের উপর দারুণ কন্ট্রোল থাকে তার। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে? বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ধাক্কাধাক্কি চলছে, হার্টবিট যেন কানে বাজছে।তার চোখ পড়লো খোলা বোতামের শার্টের ভেতর ঝলসে ওঠা ত্বকের দিকে, আর হঠাৎ করেই সারা শরীরে গরম ঢেউ ছড়িয়ে গেলো। কপালে ছোট ছোট ঘামের ফোঁটা জমে উঠলো। জায়ান গভীর শ্বাস নিলো,কিন্তু কোনো কাজ হলো না।

তারপর সে ডাইনিং স্পেসের কোণে রাখা ক্যাবিনেটের দিকে এগিয়ে গেলো। সেখানে সারি সারি সাজানো অসংখ্য অ্যালকোহলের বোতল। একটা হুইস্কির বোতল নামিয়ে আনে। তারপর গ্লাসে ঢেলে এক ঢোঁকে গিলতে শুরু করলো। এক গ্লাস, তারপর আরেক গ্লাস।
শেষ গ্লাসটা শেষ করে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে নিলো জায়ান। তারপর গ্লাসটা শক্ত করে চেপে ধরলো, চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য। আর পরের সেকেন্ডেই প্রচণ্ড জোরে গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলো পাশের দেয়ালে।
একটা বিকট শব্দে গ্লাস চুরমার হয়ে ছিটকে গেলো চারদিকে।

রাত তখন গভীর, মার্কো তখন উপরের একটা রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। কানে ইয়ারপিস লাগানো, কারও সঙ্গে জরুরি কথোপকথন চলছিলো। ঠিক তখনই নিচ থেকে ভেসে এলো এক বিকট কাঁচ ভাঙার শব্দ।
সে মুহূর্তে মার্কো থেমে গেলো। কান থেকে ইয়ারপিস খুলে ছুঁড়ে ফেলল একপাশে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে দৌড়ে নিচে নামলো সে। এত রাতে কী হলো বুঝতে পারলোনা।
ডাইনিং স্পেসে পৌঁছেই হাত বাড়িয়ে লাইটের সুইচ অন করলো।

ক্লিক!
ডাইনিং স্পেসের আলোয় ভরে উঠলো।
মার্কোর চোখ সোজা গিয়ে পড়লো জায়ানের দিকে। জায়ান তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, বুকের ওপর হাত রেখে গভীর শ্বাস নিচ্ছে।
মার্কো ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে জায়ানের পিঠে হাত রাখল।
কী রে, কখন এলি? ডাকলি না কেন? লিয়ানাকে এনেছিস?
জায়ান গম্ভীর গলায় জবাব দিলো।
বিয়ে করে নিয়ে এসেছি।
কথাটা শুনে মার্কোর মুখে বিন্দুমাত্র বিস্ময় ফুটলো না। যেন ও আগে থেকেই জানতো এমন কিছুই হবে। বরং এক চিলতে দুষ্টু হাসি খেলে গেলো তার ঠোঁটে। চোখ টিপে হেসে বলল—
ফার্স্ট নাইট এ তুই এখানে কেন? তোর বউ কোথায়?
ঘুমোচ্ছে।
আহারে! মেরেছিস আবার?
জায়ান মাথাটা একটু নেড়ে বললো,

না। শুধু একটা থাপ্পড় মেরেছি আর একটা চুমু খেয়েছি। তাতেই অজ্ঞান হয়ে গেলো। এতটাই দুর্বল বোকা মেয়ে।
মার্কো এবার জোরে হেসে ফেললো, হু হু করে, যেনো গোটা রুম ভরে উঠলো তার হাসিতে।
দাঁত কেলানো বন্ধ কর।তা না হলে দাঁত আর দাঁতের জায়গায় থাকবেনা।খুলে হাতে ধরিয়ে দিবো।
জায়ানের এমন কথা শুনে মার্কো এবার জোর করেই মুখ চেপে হাসি গিলে নিলো।
এভাবে বলছিস কেনো ভাই আমার কষ্ট পেলাম,বাই দা ওয়ে,তোর নিজের শরীরই তো দেখে মনে হচ্ছে দুর্বল হয়ে আছে।বুকের ওপর হাত দিয়ে কেন রেখেছিস ? সব ঠিক আছে তো?
জায়ান এবার বুকটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে, গলার স্বর ভারী করে,
বুকের জালাটা দিন দিন বাড়ছে,আর আজকে তো মনে হয় সুগার লেভেল টু মাচ্‌ হাই হয়ে উঠেছে।
সুগার? ডায়াবেটিস হলো নাকি তোর আবার হায়!হায়!
জায়ান ঠোঁটে এক ফোঁটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি টেনে বলে,

ডায়াবেটিস হলে তো মিষ্টি খাওয়া দোষ,কিন্তু আমি তো এখনো মিষ্টি খেয়েই দেখলাম না।
কি বলছিস আবল তাবল,?? জীবনে সুইট খাস নি?
এই মিষ্টি,সেই মিষ্টি না। নেশা জাতীয়। একমাত্র চাহিদা। My personal sweet।
মার্কোর চোখ বিস্ফোরিত, হঠাৎ কেশে উঠে জায়ানের এমন কথা শুনে,
তোর অবস্থা এখনই এমন, আর মিষ্টি যদি খেতে শুরু করিস, তাহলে কী হবে, ভাবতেই ভয় লাগছে!….
তারপর জায়ান কিছু বলতেই যাবে ঠিক সেই সময়।

ট্রিং… ট্রিং…
ফোনের শব্দে রাতের নিস্তব্ধতায় কেটে গেল তীক্ষ্ণ ছুরির মতো। জায়ান চোখ তুললো ভ্রু সামান্য কুঁচকে গেলো। মার্কো টেবিলের উপর থেকে ফোনটা তুলে নিলো ধীরে,
ইয়েশ্ মার্কো স্পিকিং
ওপাশ থেকে ভেসে এল এক কর্কশ, চাপা গলা।কোনো ফরাসি লোক হবে।ফারাসি ভাষায় দু লাইন বলে উঠলো লোকটা,যা ছিলো।

সেদিন রাতের ফুটেজটা পাঠালাম। ভালো করে দেখবেন সেদিনের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের দৃশ্যে।
লাইন কেটে গেল। ডাইনিং স্পেসের ভেতর আবার সেই নিস্তব্ধতা। শুধু দেয়ালের ডিজিটাল ঘড়ির টিক টিক। মার্কো ধীরে ফোন নামিয়ে স্ক্রিনে তাকালো, চোখে তীব্র চকচকানি। তারপর জায়ানের দিকে ঘুরলো, ঠোঁটের কোণে এক ভয়ংকর বাঁক।
পেয়ে গেছি… তোর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ।
এই এক কথার মধ্যে যেন বিস্ফোরণ লুকিয়ে ছিল। জায়ান ধীরে মাথা তুললো। নিমিষেই তার আবেগ অনুভুতি যন্ত্রণা আদৃশ্যে হয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে, হাতের রগ টান টান,মাথাটা এদিক সেদিক করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো, লম্বা ছায়ার মতো সোজা ,পায়ে ভারি বুটের শব্দ যেনো মেঝে কাঁপিয়ে উঠলো।
উপরে চলো।

তারপর দুজনেই বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে যায় মার্কোর রুমে।দরজা ঠেলতেই যে দৃশ্য সামনে এলো, তা স্বাভাবিক কোনো মানুষের রুম ছিলো না। প্রথমেই চোখে লাগলো কালো দেয়াল,গাঢ় ম্যাট ব্ল্যাক পেইন্ট, যেন আলো গিলতে পারে। ডানপাশের ওয়ালজুড়ে অদ্ভুত সিলুয়েট প্যাটার্ন, কালি ছোপের মতো এলোমেলো, তবু যেন অর্থপূর্ণ কিছু গোপন প্রতীক।

রুমের ভেতর আলো অদ্ভুতভাবে ম্লান, যেন ইচ্ছাকৃত অন্ধকার তৈরি করা। দেয়ালের রঙ গভীর ব্ল্যাক, তাতে লাল আর ধূসর স্ট্রোক,অদ্ভুত সব বিমূর্ত চিত্র, যেগুলো প্রথম দেখায় শিল্পকর্ম মনে হলেও যতক্ষণ তাকাবে, তত বেশি অস্বস্তি গায়ে জড়িয়ে ধরবে।রুমের গন্ধ চামড়ার ফাইল আর পুরোনো কাগজের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকা কিছু অদ্ভুত শীতলতার আভাস। জানালার পর্দা টেনে রাখা, রুমের আলো শুধু টেবিল ল্যাম্পের ঝিমঝিমে হলুদে সীমাবদ্ধ। সেই আলোয় উঁকি দিচ্ছে এক সারি বইয়ের শেলফ, যা একেবারে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। বইগুলো,মোটা, ভারী, কালো কভারের
বেশিরভাগেই সোনালি হরফে লেখা নাম

“Criminal Law,Forensic Jurisprudence,International Crime Syndicates”(ফৌজদারি আইন, ফরেনসিক আইনশাস্ত্র,আন্তর্জাতিক অপরাধ সিন্ডিকেটস “)
এক কোণে ঝোলানো কালো স্যুট, চকচকে লেদার বেল্টে গোঁজা পিস্তল হোলস্টার,একই সঙ্গে সভ্যতার মুখোশ আর রক্তাক্ত সত্যের ইঙ্গিত। দেয়ালের ওপাশে টানানো আইনি নোটিশ, কয়েকটা হাতে লেখা ড্রাফট,কিন্তু অদ্ভুতভাবে গোছানো, যেন প্রতিটি কাগজ তার শত্রুর রক্তের দাগও গোপন করে রেখেছে।টেবিলের উপর ল্যাপটপ খোলা, স্ক্রিন ব্ল্যাঙ্ক। পাশে ফাইলের স্তূপ।

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৫

গ্লাসে অর্ধেক ভর্তি হুইস্কি,বরফ গলে গিয়ে শীতল স্রোতের মতো লেপ্টে আছে। আর চেয়ারে বসতেই মনে হলো, এই জায়গাটা কেবল লইয়ার মার্কোর জন্য নয়। জায়ান ধীরে ধীরে সোফায় বসলো।
মার্কো ধীরে এগিয়ে গিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিন অন করলো। আলো ঝলসে উঠতেই এক মুহূর্তে তাদের মুখ দুটো সাদা হয়ে গেল আলোয়। স্ক্রিনে ফোল্ডার ওপেন হলো। নাম একটাই,
“TRUTH”

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here