তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩৩

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩৩
ভূমিকা তালুকদার

জায়ান একটা দীর্ঘশাস টেনে নেয়।
লিয়ানা জায়ানের কোমড় জড়িয়ে ধরে ঊরুর উপর মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। জায়ানের বুকের ভেতরটা আরও ভারী হয়ে উঠলো।চোখ দু’টো জোরপূর্বক বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করলো।চোখজোড়া বন্ধ করতেই পুরনো কিছু দৃশ্যগুলো ফের ভেসে উঠলো সেই রাত যা পুরো জীবনের গতি পথ এক নিমিষেই উলোট পালট করে দিয়েছিলো।
(সাল২০১৫,চট্টগ্রাম,)

চট্টগ্রামের মহাসড়ক পেরিয়ে পাথুরে রাস্তা দিয়ে তিনটে কালো রঙা মার্সিডিজ গাড়ি চরণগড়ের ভেতর দিয়ে হাটহাজারী চলে আসে। জায়গাটায় একটু বেশি গ্রামের ছোঁয়া আছে,এখানকার রাস্তাগুলো বেশ কর্দমাক্ত, শীতের শুরুতে এমনিতেও কুয়াশা থাকে তার উপরে দেশের আবহাওয়ার কোনো ব্যালেন্স নেই সারা বছর যখন মন চাইবে আকাশ মেঘলা হয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়,সেটা শীত হউক বা গ্রীষ্ম।রাস্তার দু’ধারে নারকেল গাছের সারি,আর তার মাঝখানে এক বিশাল পুরোনো দোতলা বাড়ি জায়ানের নানার বাড়ি।
বাড়িটার গায়ে পুরনো লালচে রঙের প্লাস্টার,
জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে, তবু ঐশ্বর্য লুকিয়ে রাখা যায় না।বড় গেটের ওপরে ঝুলছে একটা লোহার বোর্ডে লেখা —

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তালুকদার বাড়ি, ১৯৪২”
পুরো তালুকদার বাড়িতে রঙিন আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে আছে।গেট থেকে শুরু করে টিউব লাইট, এল এ ডি স্ত্রিপ দিয়ে সাজানো। সাথে রঙিন ফেইরি লাইট।ছোট বেলি ফুলের গাছগুলো থেকে ফুলের সুবাসে মৌ মৌ করছে চারপাশ।

ভেতরে ঢুকতেই বিশাল আঙিনা — মাঝখানে পুরোনো কুয়ো, পাশে আমগাছ আর কাঁঠালগাছের সারি।
তিনটি গাড়ি এসেই লোহার গেইটের সামনে এসে ব্রেক কষে।প্রথম গাড়ি থেকে নামে খান বাড়ির কর্তা বীর বিক্রম খান আর তার বিবি।তারপর সোলেমান খান,ফাহিম খান, রেজাউল খান আর তাদের বিবিগণ।তার পরের গাড়ি থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামে খান বাড়ির বাদরগুলো লিয়ানা, মাইশা,আরিশা,রিহান।গেট থেকে শুরু করেই সদর দরজা পর্যন্ত লাল কার্পেট বিছানো।তার উপর দিয়ে হেঁটেই খান বাড়ির সকলে ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে।কিন্তুু জায়ান তখনও গাড়িতে বসে আছে, একা গাড়ি চালিয়ে এসেছে সে,নিজের গাড়িতে কাউকেই উঠায় না।চোখেমুখে তিক্ত বিরক্তির ছাপ।যেনো অনিচ্ছা শর্তেও আসতে হয়েছে।গাড়ি থেকে নেমেই ঠাস্ করে দরজাটা অফ করে হনহনিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে।

ফারদিন তালুকদার এসে সোলেমান খানের সাথে কুশল বিনিময় করে। খান বাড়ির সকলের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্য নেমে এসেছে। ফারদিন তালুকদার নাফিসা খানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে এত দেড়ি করলি কেন,,বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ আর তোরা এলি রাতে ।বলেছিলাম দু’দিন আগে চলে আসতে।”
“আর বলো না ভাই, কি আর করার বাড়ির কর্তাগুলোই বিজনেস নিয়ে এতো বিজি ছিলেন তাই আসা হয়ে উঠলো না।”
সোফায় বসে থাকা বীর বিক্রম খান বলে উঠেন,
“বুঝলে ফারদিন আজকে পুরো ঢাকা শহরের রাজনৈতিক মিছিল এ পুরো রাস্তা জ্যাম ছিলো, সারাদিন জ্যামে আটকিয়ে ছিলাম।”

“হ্যাৃঁ, জানি তো এ দেশের পরিস্থিতি আবহাওয়ার মতো চেঞ্জ হয়”,-বলতে বলতেই ফারদিন সবাইকে নিয়ে দু ‘তলার বসার ঘরে নিয়ে যান।ফারদিন তালুকদার এ বাড়ির বড় ছেলে এক মেয়ে ফারিয়া আর বউকে নিয়ে একাই থাকেন তিনি ।জায়ানের নানা- নানী বেঁচে নেই প্রায় অনেক বছর হয়ে গিয়েছে।তবে জায়ানের ছুটো মামা ফাহাদ তালুকদার দীর্ঘ প্রবাসজীবনের পর মিশর থেকে সদ্য ফিরেছেন, হাতে PhD ডিগ্রি, মস্তিষ্কে জ্ঞানের দীপ্তি নিয়ে।যাকে তিনি বিয়ে করেছেনে আজ সেই নারীও তাঁর সহপাঠী, সহযাত্রী, একসাথে গবেষণার পরিশ্রমে গড়া এক আত্মিক সম্পর্ক।
দুই পরিবারই সম্মত হয়েছিলো এই বন্ধনে, তাই আজ তালুকদার বাড়িতে উৎসবের শেষ নেই।লিয়ানা সমেত বাড়ির চার বাঁদর বউ দেখতে চলে আসে নববধূর রুমে।রুমে আরও বেশ কিছু পরিজনেরা আছেন।লিয়ানা বিয়ে বাড়িতে এসেই পাঁচটা মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে আলরেডি। মেহেদী দেয়া হাত। আরেকটা খেতে মন চাইলো তার।কিন্তু না বেশি খেলে আবার হাত ধুতে হবে, না না পড়ে মেহেদীর কালার নষ্ট হয়ে যাবে।লিয়ানা চঞ্চল হওয়ায় বউয়ের গাঁ ঘষে বসে হা করে বউকে দেখতে থাকে আর বলে,

“তুমি না অনেক সুন্দর! বিয়ের দিন কি সব বউদের সুন্দর লাগে??”
ফাহাদ এর বউ মায়া হাসলো। এই পিচ্চি মেয়ের কথা শুনে, তিনি এতক্ষণ লিয়ানকেই দেখছিলেন,একদম গুলোমুলো মিষ্টি মেয়ে।বয়স কম হলেও বেশ পাকা।মায়া লিয়ানার গাল টেনে টেনে দুষ্টুমির ছলে বললেন,
“ওরেহহ পাকা বুড়ি।তুমিও একদম প্রিটি অনেক।বাচ্চা পরি।কিউট। ”
লিয়ানা দাঁত কেলালো।চুলে থাকা লাল ক্লিপটা হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে চুলে গুজে দিলো।পড়নে মেরুন কালারের পাকিস্তানি সারারা ড্রেস। চুলগুলো কাঁধ সমান।পাশে থাকা মায়া নিজের মাথার ঘোমটাটা টেনে ঠিক করে নিলো,
“বুড়ির দেখি হাসলে গালে টোলও পড়ে, হাউ সুইট।”

লিয়ানা আবার দাঁত কেলালো।কেউ তাকে ভালো সুন্দর বললে এতো ভালো লাগে,কেননা বাড়ির কেউ তো এসব বলে না,তারা তো তাকে বাঁদর উপাধি তে ভূষিত করে রেখেছে, তাই কেউ প্রশংসা করলে,মনে প্রজাপতি উড়ে বেড়াতে থাকে।তখনি মাইশা লিয়ানার হাত ধরে টানে নিয়ে যেতে থাকে
“চলো লিওপু আমরা লুকোচুরি খেলি।মজা হবে,এভাবে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না।”
“রাত হয়ে গিয়েছে ভয় করে আমার।তোরা যা।”
“চলো তো। আমরা সবাই মিলে খেলবো।”

বেশ্,মাইশা আরিশা,রিহান সহ আরও কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মিলে নিচে গার্ডেন চলে আসে, হাসাহাসি, লাফালাফি করে পুরো বাড়ি মাথায় করে রেখেছে, এখন আবার লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে।যে যার যার মতো জায়গা খোঁজে খোঁজে লুকোতে থাকে। লিয়ানাও এদিক ওদিক তাকিয়ে লুকোনো জায়গা খোঁজায় ব্যাস্ত।কই লুকানো যায়, কই লুকোলে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না।

বাড়ির পশ্চিম পাশের পুরনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আছে জায়ান,এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে মোবাইল।সিগারেট খাওয়ার অভ্যসটা স্কুল লাইফ থেকে শুরু হলেও তেমন বেশি খায় না,যখন প্রচন্ড মাথা ধরে থাকে, খুম বেশি টেনশনে ফিল হয় তখনি খায়,আজও তাই হলো।ফোনে বারবার কল ভেসে উঠছে,Band Coordination, Audition Team, Management,প্রতিবারই সে কলটা তাকিয়ে দেখে, কিন্তু রিসিভ করে না।সাথে বন্ধুদের কল তো আছেই,দু’দিন পরের প্রোগ্রাম এভাবে আজ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার ফলে এক প্রকার মাইনকার চিপায় ফেঁসে গেলো। ঠোঁটের কোণে ক্লান্তির আর হতাশার ছাপ।

পায়ের রক্ত মাথায় উঠার উপক্রম , চোখের নিচে গাঢ় ছায়া,কয়েক রাতের অঘুম যেন মুখে লেগে আছে।ঢাকার ইউনিভার্সিটিতে তার ব্যান্ড দলের ফাইনাল অডিশন প্রস্তুুতি,সেই এক সুযোগ, যার ওপর নির্ভর করছে তার পুরোটাই। কিন্তু আজ, মায়ের কথায়,দাদা জোর করার ফলে মামার বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজিরা দিতে হয়েছে তাকে,তবে প্রোগ্রামের খবরটা দিনে পেলে কখনই আসতো না।এখন সকালে ভার্সিটিতে থাকাটা খুবই দরকার, কল ও উঠায় না জায়ান,উঠিয়ে কি বা বলবে যে প্রোগ্রাম ফেলে বিয়ে খেতে এসেছে।মাথায় চেপে রাখা ক্ষোভে বুকটা জ্বলে উঠছে বারবার।গলায় চকচক করছে একটা সিলভার কালারের চেইন।চুলগুলো ঘামে ভিজে কপালে ছড়িয়ে আছে।সাদা শার্টের হাতাটা গুটাতে গুটাতে রুমের দিকে পা বাড়ায় তখনি রাস্তা আটকিয়ে দাঁড়ায় ফারিয়া।জায়ানের মামাতো বোন।পড়নে কালো রঙের সোনালি পাড়ের শাড়ি। দুধে আলতা গায়ের রঙ, বয়সে জায়ানের এক বছরের ছোটো।জায়ান ফারিয়াকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নিলে, ফারিয়া শাড়ির আঁচল ধরে আটকিয়ে দেয়।

“কই যাও? কথা আছে।”
“দেখ আমার মুড জঘন্য পরিমাণের খারাপ। রেগে দু’চার কথা বলে ফেলবো। গালি না খেতে চাইলে সামনের থেকে সর ”
“কি হইছে তোমার আবার? ” তুমি কি কোনো কারণে আপসেট??
জায়ান ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো। মূহুর্তেই কথার ধরন পাল্টিয়ে মৃদুস্বরে বলে উঠে।
“না তেমন কিছু না।নিচের অনুষ্ঠানে যা।সবাই তো সেখানেই!”
“তুমিও চলো একসাথে যাবো।তোমাকেই তো নিতে এলাম।কখন থেকে খুঁজে চলেছি তোমায়।”
জায়ান মনে মনে ভাবলো এই মেয়ে এমনিতেও পিছু ছাড়বে না।শরীরে যত হাই ভোল্টেজের রাগ আছে তা আপাতত পায়ে পিষে ফেলে ভাবলো এই মেয়ে তার কাজে আসবে, চুলগুলো হাত দিয়ে বেক ব্রাশ করতে করতে এক কথায় জোরপূর্বক মৃদু হেসে জবাব দিলো,

“আচ্ছা। ফারিয়া তোকে যদি একটা কাজ করে দিতে বলি পারবি?”
জায়ানের এত সুন্দর নরম শুরে কথা শুনে ফারিয়া বেশ খুশি হলো।সে তো এইটাই চায় জায়ান তার সাথে এভাবেই হেসে কথা বলুক।এমনিতেও এক্সাম দিয়ে ঢাকা চলে যাবে।জায়ানের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে।কত সপ্ন তার। নিজের ফুফাতো ভাই জায়ান খানের উপর এক কথায় ফিদা সে সেই ছোটবেলা থেকে।জায়ান তো গম্ভীর এক ঘেয়ে মানুষ কারোর সাথে মিশে না তেমন।তার সাথেও কথা বলে না।ফারিয়াই জোর করে জেচে পড়ে কথা বলতে আসে।দু আনার পাত্তা না দেয়া ছেলে আজ তার কাছ থেকে কোনো আবদার হেল্প চাইলো, সে কি করে না করবে।
“কি হেল্প বলো, তুমি যা বলবে তা করে দিবো।”
“তেমন কিছুই না শুধু বসার ঘরে সবাইকে গিয়ে বলবি আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা যেতে পারবো না।তুই এসে দেখেছিস যে আমি ঘুমোচ্ছি।”

“কিন্তুু কেন?”
জায়ান চোখ সরু করে বললো,
“আই হেইট টু মা’চ্ কুইস’সেন,যা বলেছি তা গিয়ে কর।নাও লিভ।”
ফারিয়া আর কিছু বলার সাহস পেলো না। আপাতত জায়ান যা বলেছে তা গিয়ে করে আসুক।তারপর না হয় আবার আসবে।জায়ানকে পটানোর এই একটাই রাস্তা তার হাতে।হাত ছাড়া হতে দেয়া যাবে না।এই সামান্য মিথ্যা বলাই যায় জায়ানের জন্যে। ফারিয়া শাড়ির আঁচল আঙুল দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাইতে রুম ত্যাগ করে।ফারিয়া যেতেই জায়ান পুরো রুম পায়চারি করতে থাকে একটা উপায় বের করতেই হবে, আজ রাতের মধ্যেই ঢাকা যেতে হবে।দাদার উপর এত রাগ হচ্ছে, ক্যারিয়ার তার, জীবনও তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারও কেবল তার।সকালে তাকে না পেয়ে যতই ঝামেলা শুরু হউক এতে জায়ানে কিছুই যায় আসবে না।

এইসব তো আর নতুন কিছু না।এখন নিচের করিডর দিয়েও যাওয়া যাবে না।এত মানুষ, মানুষের ভিতরে যেতেই তার দম আটকিয়ে আসে।আবার তাকে বাহিরে যেতে দেখলে বাড়ির লোকজন চৌদ্দটা প্রশ্ন করে বসবে,এইসব বা*লের কৈফিয়ত দেয়া জায়ানের খুবই জঘন্য লাগে।হাতের মোবাইলটা নীচে ছুঁড়ে দিয়ে সে একটুখানি বসে পড়ে বিছানার প্রান্তে, মাথাটা হাতের উপর।অতিরিক্ত টেনশনে প্যানিক হয়ে যাচ্ছে,পকেট থেকে দুটো সাদা বড়ি বের করে খেয়ে নেয়। হঠাৎ করেই দরজাটা হালকা শব্দে খোলে।
জায়ান চমকে সেদিকেই তাকায়।

ভেতরে ঢুকছে ফাহাদ, মুখে দুষ্টু হাসি, হাতে দু বোতল বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ, পিছনে তার দুই বন্ধু জামিল আর তামিম। দরজা বন্ধ করে ফাহাদ চাবিটা ঘুরিয়ে লক দিয়ে ফেলে দরজায়।
উফফ! এই রুমে একদম শান্তি আছে ! বলে সে হাঁপ ছাড়ে, তারপর বোতলটা হাতে নেড়ে হাসে, ভেতরে গিয়ে খাওয়া সম্ভব না, সবাই খেয়াল করবে। তাই ভাবলাম তোর রুমটাই পারফেক্ট।তুই যেই রুমে থাকবি সেইটা খালি থাকবে আমি ডে’ম সিউর ছিলাম।বুঝলি তোর মামির থেকে লুকিয়ে খেতে আসলাম।ম্যাডাম জানলে আবার মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে।

জায়ান বিরক্ত চোখে তাকায়, মামার আগমনের ফলে না জানি তার আরআরও কতো সময় লেইট হয়ে না যায়।মনে মনে মামাকে ইচ্ছেমতো গাল-মন্দ করে বলে উঠে,
“ইয়ে মামু তোমার আজকে ফাস্ট নাইট মামির কাছে থাকার দরকার।”
“আরে তোর মামির কাছে অনেক মানুষ, আমায় ডুকতে দেয় না।আরেকটু রাত হউক সব বিদেয় হলে তো যাবই।আগে মাইন্ড ফ্রেশ করে নি।”
জামিল সঙ্গে সঙ্গে গ্লাস বের করে, তামিম টেবিলের ওপর একটা সাদা ট্রে রাখে। কাচের গ্লাসে মদের ঝিকিমিকি আলো লেগে পড়ে, বাইরে বাজছে সাউন্ড বক্স থেকে ভেসে আসা গানের শব্দ,
“munni badnaam hu ei darling tere liye”
ফাহাদ প্রথমে নিজে ঢেলে খায়, তারপর গ্লাসটা জায়ানের সামনে ধরে, “তুই আমার থেকেও বেশি খাওয়া শিখে গেছিস আই নো। ”

জায়ান কিছু বলে না,খায় ঠিকি বাট আজ খেতে পারবে না।মামাকে কিভাবে বুঝাবে।ফাহাদের সাথে জায়ানের মামা ভাগিনার থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই বেশি। ছোটো থেকে জায়ানকে সব কিছুতে তার এই মামাই একমাত্র মানুষ যে ফুল সাপোর্ট দিয়ে এসেছে। একদমি ফ্রি মাইন্ডের ফাহাদ।জায়ানের এমনিতেই নেশা করার বদ অভ্যাস আছে তার উপড়ে তার এই দুষ্টু মামার কথায় না পেরে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নেয়।
এক ঢুকে পুরোটা গিলে ফেলে।পরপর চার গ্লাস খেয়ে, মন কে শান্তনা দেয়।আর খাস না জায়ান।পুরো রাস্তা কার ড্রাইবিং করে যেতে হবে পারবি না।বেশি নেশায় ধরে ফেলবে।রিলেক্স।
ফাহাদ আর তার দু বন্ধু মিলে মদের সাথে তাস খেলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।নেশায় একেকজন এর অবস্থা বেহাল।জায়ানের শরীর কিছুটা ঢুলতে থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।এসির নিচেও পুরো শরীর ঘেমে শার্ট শরীরের সাথে লেপটে আছে।উপরের দুটো বোতোম খুলতে খুলতে খোলা বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়।বেলকনির নিচে বাড়ির পিছনের গার্ডেন।কোনো মানুষ নেই।মুখেও হালকা ঘাম জমেছে, গলার শিরাগুলো টান টান। ফোনটা পকেট থেকে কাঁপছে, একের পর এক কল আসছে,

“Dhaka Uni Music Dpt”
“Ishan”
“Rafi Studio”
প্রতিটা কল মিস’ড হয়ে যাচ্ছে। স্ক্রিনের আলো নিভে আসছে,Battery Low: 10%।
জায়ান বেলকনি থেকে জাম্প দেওয়ার কথা ভাবলো,এখান থেকে জাম্প দেয়া তার জন্যে কঠিন কিছু না।ভার্সিটিতে মারামারি করে কতই কার্জন হলের দু ‘তালা হল থেকে লাফিয়ে নেমেছে।তবে এখন নেশার বসে আছে।তাও কাঁধটা সামান্য নিচু করে পায়ের পেশি শক্ত করলো।
একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ।

তিন… দুই… এক…
উপর থেকে জাম্প মারে
পায়ের গোড়ালি মাটিতে ছোঁয়া মাত্রই হাঁটু একটু ভাঁজ করে আঘাত সামলে নিলেও ঢুলে পড়ে গিয়ে হাতে আঘাত লাগতেই শার্টের হাতার অংশ সামান্য ছিঁড়ে যায়।কনুই থেকে দু’ফোটা রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।জায়ান সেদিকে মন না দিয়ে পিছনের গেইট পেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসে পড়ে।চোখজোড়া হালকা ঝাপসা হয়ে আসছে।যার ফলে গাড়িতে থাকা ওয়াটার পট থেকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে নেয়। গাড়ি স্টার্ট দিলো।সরু রাস্তা দিয়ে এগুতেই বাতাসের গতি বেড়ে চলেছে।পাতাগুলো উল্টো দিকে দুলতে থাকে,দূর থেকে বিদ্যুতের রেখা ছিঁড়ে যাচ্ছে আকাশের বুক,
তারপর এক বিকট গর্জন।মনে হচ্ছে তুমুল বৃষ্টি হতে পারে। জায়ান গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়।গাড়ি হাটহাজারী পেরিয়ে “চড়ণগড় “এর রাস্তায় নামে।জয়ানের চোখ ভার হয়ে আসছে।গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে দেয়।বৃষ্টির ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগালো।

কিন্তুু হঠাৎ,
গাড়ির বেক সিট থেকে এক মৃদু কাশির শব্দ ভেসে আসে।জায়ানের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।তার গাড়ি বেক সিট থেকে কার কাশির শব্দ কানে এলো। নাকি নেশার প্রভাব বুঝে উঠতে না পেরে।
সে আয়নায় তাকায় কিছুই দেখতে পায় না।
আবারও শব্দ আসে
জায়ান হঠাৎ ব্রেক কষে ফেলে,
গাড়ি ছিটকে গিয়ে রাস্তার পাশের বাঁশের বেড়ায় ধাক্কা খায়!
একটা বিকট আওয়াজে।গাড়ি হেলে পড়ে রাস্তার ধারে,

জায়ান এর মাথা গাড়ির স্টেয়ারিং এর সাথে ধাক্কা লাগতেই কপাল ফেটে তাজা রঁক্ত ছিটকে পড়ে।বেক সিট থেকে কেউ জোরে কেঁদে উঠে। ব্লিডিং বন্ধ করতে জায়ান কপালে হাত রাখে।গাড়ির লাইট অন করতেই দেখে বেক সিটে আর কেউ না বরং লিয়ানা।ভয়ে কেঁদে উঠলেও জায়ানকে দেখে মুখ চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাচ্চা মেয়েটা।নিজের অজান্তেই শেষে কিনা জায়ানের গাড়িতে উঠে লুকিয়ে পড়ে ছিলো। তাও আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।কি সর্বনাশ কান্ঠ হায় খোদা।লিয়ানা তুই তো গেলি।বাঘের খাঁচায় কেন মুখ দিতে গেলি।জায়ানের কাছ থেকে হাজার টা ঝারি শুনতে হবে ভেবেই কানে আঙুল গুজে দেয়।কিচ্ছুটি শুনবে না। ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।জায়ান এর হাতে আবার মার খাবে এই ভেবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।জায়ান নিজের কাছ থেকে একশ হাত দূরে তাকতে ব’লে লিয়ানাকে।কিন্তুু লিয়ানা শুধু একশো না একশো দশ হাত দূরে থাকে ভয়ে।এ কেমন বিপদের মুখে পড়ে গেলো মেয়েটা।বাহিরের আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ কানে লাগতেই কেঁপে উঠছে মেয়েটা।

লিয়ানাকে নিজের গাড়িতে দেখতেই জায়ানের পায়ের র*ক্ত মাথা উঠে যেতে থাকে।এই মেয়ের কত বড় সাহস ভাবা যায়।
“বেয়াদব মেয়ে তুই।হাউ ডিজগাস্টিং ”
জায়ানের চোখের ভেতরটা এক মুহূর্তেই লাল আগুনে ভরে উঠলো।যেনো চোখ নয় দুটি রক্তজ্বলা অগ্নিকুণ্ড।শিরাগুলো কপাল থেকে ঘাড় পর্যন্ত ফেটে ওঠা নীলচে দাগের মতো টানটান,
হাতের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরেছে।আঙুলের গাঁট সাদা হয়ে উঠছে রক্তচাপের চাপে।চোয়ালের পেশিগুলো কাঁপছে।মন চাচ্ছে এই মেয়েকে এখানেই যেন্ত পুঁতে ফেলতে।জায়ান ঠিক মানুষ, না কি ঝড়ের আগের বজ্র মেঘ বুঝা গেলো না। লিয়ানা ভয়ে গাড়িতে পিছাতে শুরু করে। নাক টেনে বলে উঠে,
“ভাইয়া তোমার গাড়িটা না তিন নাম্বারে ছিলো।আ..আমি ভেবেছি এটা আমাদের গাড়িটা।আ…আমি তো লুকোচুরি খেলছিলাম।তাই গাড়িতে এসে লুকিয়েছিলাম।কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি জনি না।”
“কি বললি তুমি?? ”
ন,,,না আপনি।

একে তো লিয়ানা বুঝতে পারছে না জায়ান তাকে কোথায় নিয়ে এলো।তার উপরে জায়ানের রাগ আর রাতের অন্ধকারটা এই বাচ্চা মেয়েটার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।জায়ান এদিকে রাগে গজগজ করতে করতে গাড়ির দরজা খুলে ঝড়ের মধ্যে বের হয়।গাড়িতে একটা ছাতা ছিলো ওটা বের করলো।বেক সিটের দরজা খুলেই লিয়ানার দিকে এগিয়ে গিয়ে চুল টেনে ধরে গালে ঠাস্ ঠাস্ করে চারটা চড় বসিয়ে দেয়।কান্নারত মেয়েটার উপর অমানবিক আচরণ এর মাত্রা তিব্র বাড়িয়ে,টেনে টেনে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ির থেকে বের করে দেয়।লিয়ানা আকুতি ভরা দৃষ্টিতে জায়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকে।কিছু বললে আরও মারবে এই ভয়ে কিচ্ছুটি বললো না।জায়ানের চোখের বিষকাঁটা বলে কথা আকুতি মিনুতি করেও লাভ হলো না।জায়ান লিয়ানাকে গাড়ির থেকে বের করে। নিজে গাড়িতে উঠে বসে পড়ে।গাড়ির ডোর লক করে দেয়।

“ফা*কিং স্টুপিড গার্ল।It’s your punishment ”
গাড়ির চলছেনা।স্টার্টও হচ্ছে না।ধাক্কা লাগার ফলে এমন হয়েছে।রাগে কতক্ষণ ইচ্ছেমতো গাড়ির স্টেয়ারিং এ হাত দিয়ে ঘুষি মারতে থাকলো।হাত থে’তলো গিয়েছে।ওদিকে লিয়ানা আধ ঘন্টা ধরে বৃষ্টির পানিতে পড়ে আছে।অনেকবার দরজা ধাক্কিয়ে জায়ানকে ডেকেছে, জায়ান ভাইয়া ভুল হয়ে গিয়েছে দরজাটা খুলো।সরি।আর হবে না।না পেরে মাটিতে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে।লিয়ানার কান্নার শব্দটা জায়ানের আরও বিশ্রি লাগছে।একেবারেই অসহ্যকর।গাড়ির ভিতর থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করে মুখে পুরে নেয়।রাগ কন্ট্রোল করার সর্বোচ্চ মাধ্যম। তা না হলে এই মেয়েকে এখানেই কবর দিয়ে দিবে।

এই মেয়ের বোকামোর ফলে গাড়িটাও খারাপ হয়ে আছে।বেশকিছুক্ষণ হওয়ার পর জায়ানের কানে আর লিয়ানার কান্নার শব্দ ভেসে আসে না।অনিচ্ছা শর্তেও কেন যেনো বুক টা ভারি হয়ে উঠতেই গাড়ির গ্লাসের ফাক দিয়ে নেশালো চোখে তাকাতেই দেখলো মেয়েটার নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে।টানা ঘন্টাখানিক বৃষ্টিতে ভিজার ফলে জ্ঞান হারিয়েছে।জায়ান গাড়িতে একটা জোর লাথি মেরে নিজের চুল টেনে ধরে রাখে।এইসব ফা*কিং মায়া দরদ তার মধ্যে নেই তাও আবার এই বেয়াদব মেয়ের জন্যেতো আরও আগেই না।কেনো যেনো গাড়ির দরজাটা খুলেই ছুটে গেলো লিয়ানার কাছে।কোনো রেসপন্স নেই।কিছু বুঝে উঠতে না পেরে লিয়ানাকে কোলে তুলে সামনের দিকে হাঁটা দেয়।একটু যেতেই একটা কুঁড়ের ঘর দেখতে পায়।ভিতরে লাইট জলছে।

জায়ান এগিয়ে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা ফাকা।ডাকলো ভিতর থেকে কারোর সাড়া শব্দ না পেয়ে. উপায়ন্তর না পেয়ে ঘরের ভিতরের প্রবেশ করে। কেউ নেই পুরো ফাঁকা।হাতের ছাতাটা এক পাশে রেখে।ঘরের মাঝে একটা ছোট চৌকির মধ্যে লিয়ানাকে শুইয়ে দেয়।মেয়েটার পুরো শরীর ঠান্ডায় জমে উষ্ণতা জ্বর চলে এসেছে।এমনিতেই জায়ান এর শরীর নেশাগ্রস্থ তার উপরে রাগে শরীরের র*ক্ত গরম হয়ে টগবগিয়ে ফুটছে।আবার লিয়ানার জন্যে কেমন মায়া মায়া ফিলিং’স কাজ করছিলো।না না মায়া ফায়া না।এই বেয়াদব মেয়পর কিছু হয়ে গেলে জবাবদিহিতা তাকেই করতে হবে।জায়ান লিয়ানার কাছে এগিয়ে যায়। লিয়ানার গাল চেপে ধরে বলে,

“ইউ আর সা’চ অ্যা ডিজগাস্টিং গার্ল। আই রিয়েলি হেট ইউ।আন্ডারস্ট্যান্ড??”
ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা লিয়ানা তেমন হুসঁ না থাকায়।কিছু শুনলো না বুঝলোও না।লিয়ানার শরীরে উষ্ণতার প্রয়োজন।ভেজা কাপড় খুলে গরম কিছু পড়ানো দরকার।লিয়ানাকে উঠানোর চেষ্টা করলো জায়ান। কিছুটা রেসপন্স করলেও চোখ মেলে তাকাতে পারছিলো না সে।
জায়ান দাঁতে দাঁত পিষে নিজের শার্ট এর বোতোম খুলতে থাকে।চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে
“i hate u!”
“i hate u”
“i hate u!”

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩২

শার্ট খুলে লিয়ানার কাছে গিয়ে পড়নে জামা খুলে নিজের শার্ট দিয়ে৷ গাঁ জড়িয়ে দেয়।কি অদ্ভুত যেই মেয়েকে নিজের কাছ থেকে একশো হাত দুরে রেখেছে এতবছর। শেষে কিনা।ভাবতেও শরীরটা কেঁপে উঠছে জায়ানের।এদিকে জায়ানের অবস্থা ক্রমশ খারাপ এর দিকে যেতে থাকে।নেশাভরা দৃষ্টিতে লিয়ানাকে কিছুক্ষণ পরক করে নেয়।শরীরের ভার সামলাতে না পেরে লিয়ানার পাশে চৌকিতে ঢলে পড়ে যায়।শরীরটা হেলে পড়তেই জায়ানের চোখে চারপাশ ঘোলা হয়ে আসে।
রাতের প্রথম প্রহরে ঘরে দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসে। দরজা খোলেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক….

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here