তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৬
নীল মণি
জায়ন ছাদের নির্জনতা থেকে নেমে এসেই উত্তপ্ত হৃদয়ে ব্যাকুলতার ছায়া নিয়ে পকেট হতে ফোনটি টেনে বের করল।
একটু দেরি না করে বৃষ্টির নম্বরে কল দিলো।
“আপনি যেই নম্বারটি তে কল দিচ্ছেন, সেটি এখন নেটওয়ার্ক সূত্রের বাইরে আছে।”
–কানে বাজলো অচেনা অপারেটর ভয়েস।
জায়ন দাঁতে দাঁত চেপে পরপর দু’তিনবার আবার চেষ্টা করল, কিন্তু ফলাফল সেই একই।
মনের ভেতর একটা অজানা অস্থিরতা পাক খেতে লাগলো।
সে আর এত চাপ নিতে পারছে না – এক তো তার
ঘাড় ত্যাড়া হবু বউ একটাও কথা শুনছে না তার উপর এই বৃষ্টি কোথায় কি করে বলবে সে পড়িবার কে যে বৃষ্টিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
হঠাৎ কী ভেবে রুমে ফিরে গিয়ে বিছানায় বসে আহানকে কল করল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” কি রে কই তুই ? সেই যে গেলি তোর বাচ্চা বউ রে খুঁজতে খুঁজতে । আর তো দেখলাম না ।”
ফোনের ওপাশে আহান একটু হাসতে গিয়েও থমকে গেল, কারণ জায়নের কণ্ঠে ছিল কাঁপা সুর, অস্বস্তির ঘন ছায়া,
” বৃষ্টি ইস মিসিং এন্ড আই থিঙ্ক শি র্যান অ্যাওয়ে উইথ সাম অন্।”
” কি ই ই?”
আহান যেন চমকে উঠলো —-
” আমার কোন প্রবলেম নেই, শুধু আমি জানতে চাই ও সেফ কি না , কিন্তু ও একবার আমায় বললে হয়তো এরকম ভাবে যেতে হতো না , যদিও বা আমি সিওর না তবুও যদি সত্যি হয় তাহলে আই ডোন্ট নো হাউ আই উইল হ্যান্ডেল মাই ফ্যামিলি।”
” চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে ।”
” এক কাজ কর তবুও তোরা ৩ জন একটু আসে পাশে খুঁজে দেখে , ইউভি বা আকাশ কে এখনো জানার দরকার নেই …..
এই কথার মাঝে জায়ন এর কানে ভেসে আসলো পায়ের নূপুরের , সেই নূপুরের শব্দ ছুটেই চলেছে করিডোর ধরে
সে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো, মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।
চোখ বুলিয়ে নিলো চারপাশে —
তবুও কী এক অদৃশ্য টান তাকে টেনে নিয়ে গেল করিডোর ধরে ছাদের ঘরের দিকে…
ছাদের সিঁড়ির কাছে আসতেই উপরে থেকে ভেসে এলো এক নারীর কান্নার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–
শব্দটা তার জন্য অপরিচিত নয়, বরং অসীম পরিচিত।
এ কেবল পরিচিত নয়, এটি তার প্রিয় কিশোরীর কণ্ঠ— তার একান্ত আপন তার কিটি ক্যাট —-
এতো রাতে এই মেয়ে ছাদে কী করছে?
এই প্রশ্নেই গা সাড়া দিয়ে কিছু না ভেবেই দৌড়ে গেলো সে ছাদের দিকে।
কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে সামনে চোখ পড়তেই আচমকাই থমকে গেলো তার পা–
মনে হলো গোটা দুনিয়া যেন থেমে গেছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে….
সে কী দেখছে? তার চোখ কি ঠিক দেখছে?
না… না, সে এমন কিছু দেখতে চায় না।
সে এমন দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিল না, কল্পনাও করেনি।
রাগ, ক্রোধ, ঈর্ষা—সব মিলিয়ে যেন বুকের ভেতর একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল….
চোখের মণিতে জমে উঠলো রক্তের ঝাঁজ, কপালে জেগে উঠলো নীল শিরার জাল,
হাতের পেশি টনটন করে উঠলো, চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, আর সমস্ত শরীর নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারের প্রান্তে।
এই কী দৃশ্য সে দেখতে চেয়েছিল?
তার প্রাণের প্রিয় কিশোরী…
সেই মেয়ে যাকে সে নিজের নিঃশ্বাসের মতো আগলে রাখতে চেয়েছিল, বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল …..
সে আজ কার সামনে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে কারো পায়ে ভালোবাসার আবেদন রেখে চলেছে…..
তার বুক ফেটে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছিল–
“তুই কিভাবে পারলি?”
সে যার জন্য সমস্ত কিছু ছেড়ে দিতে রাজি, যার একটুকরো হাসির জন্য নিজেকে বিসর্জন দিতে পারে,
সেই কিশোরী আজ কীভাবে পারে অন্য কারো সামনে নিজেকে এতটা ভেঙে দিতে?
ভিতরটা যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে —
ভালোবাসা এতটাই একপাক্ষিক?
তাহলে যা সে ধরে রেখেছিল এতদিন… তা কি কেবল তার একার অনুভব ছিল?
সে জানে—
সে এখনো নিজের ভালোবাসা পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারেনি…
নিজের হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে রাখা সেই অনুভূতিগুলো, যা ছিল তার প্রাণের প্রিয় কিশোরীর জন্য, তার হবু ‘বাচ্চা বউ’ এর জন্য ….
তবুও…
তার মনের গভীরে কোথাও একটা অদৃশ্য বিশ্বাস ছিল
এই কিশোরীর হৃদয়ে কেবল তার জন্যই একটা আলাদা কোণা আছে।
একটা চুপচাপ, নীরব অনুভব… হয়তো না বলা, কিন্তু অস্বীকার যোগ্য নয়।
সে তো এতদিন নিজেকেই বুঝিয়ে এসেছে—
এই মেয়ে তাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক, তাতে কিছুই যায় আসে না।
সে যবে থেকে বুঝেছে এই মেয়ে তার হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে , যখন ভালোবেসেছে, নিঃস্বার্থভাবে, নির্মোহভাবে–
তাহলে তার তাকেই চাই —
সে তো বলতই–
“আমি চাই… কারণ আমি ভালোবাসি। তুই না বাসলেও তুই আমার।”
কিন্তু আজ…
আজ যখন সে দেখছে,
তার প্রিয় কিশোরী ফুঁপিয়ে কাঁদছে অন্য এক পুরুষের সামনে,
তার হাতে রাখছে নিজের হৃদয়ের সবটুকু আবেদন,
তখন কেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে?
কেন দম বন্ধ হয়ে আসছে, কেন হাত-পা কাঁপছে, চোখ জ্বলে উঠছে…
কেন মনে হচ্ছে সে আর এক কদমও এগোতে পারবে না?
সে তো বলেছিল— ভালোবাসা প্রতিদানে মাপে না।
তাহলে এখন এত কষ্ট কেন?
এই যে বুকের ভেতর এক অজানা হাহাকার, এই যে নিঃশব্দে ছিঁড়ে যাওয়া আত্মা–
এই সবকিছুর মানে কী?
সে তো জানত না , সে তো বুঝতো না—-
“ভালোবাসা কি ,ভালোবাসা কাকে বলে ,ভালোবাসা বলে মনে কোন আলাদা হয় কিনা?
ভালোবাসা কখনও একতরফা থাকলেও, হৃদয় একা থাকতে পারে না।
যখন প্রিয়জন কারো আরেকজনের সামনে নিজেকে বিলিয়ে দেয়,
তখন চোখের সামনে থেকে শুধু মানুষটা না…
ভেঙে যায় নিজের অস্তিত্বটাও..
তার মস্তিষ্ক জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হয়ে উঠেছে,
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দুই অবাঞ্ছিত মুখ…
তার হৃদয়ের কিশোরী আর এক অপরিচিত পুরুষ।
মস্তিষ্ক বলছে—
“মেরে দে… দু’জনকেই শেষ করে দে, এইখানে, এখনই… কবর পুঁতে ফেল সব সম্পর্ক, সব বিশ্বাস!”
তার হাত কাঁপছে না, বরং কঠিন হয়ে উঠছে…
চোয়াল শক্ত, মনের ভিতর একটাই তাণ্ডব–
“মেরে দেই? একেবারে শেষ করে দিই না?”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে,
এই ভাবনার মধ্যেই বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো…
একটা ভয়ঙ্কর শূন্যতা যেন ছিঁড়ে দিল তার ভিতরটা।
না!
সে কি পারবে?
সে কি সত্যিই তার প্রিয় কিশোরীর গায়ে হাত তুলতে পারবে?
সে যদি এই মেয়েটাকেই শেষ করে দেয়, তাহলে সে নিজে বাঁচবে কীভাবে?
এই মেয়েটা তো তার নিঃশ্বাসে মিশে আছে,
তার স্বপ্নে, তার রাগে, এমনকি তার ঈর্ষার মধ্যেও…
সে যদি মেয়েটাকে মেরে ফেলে… নিজে হয়তো বেঁচে থাকবে , কিন্তু প্রতিটা নিশ্বাস হবে মৃত্যুর মতো কষ্টদায়ক।
সে রোজ বাঁচবে, কিন্তু রোজ মরবে…
তাকিয়ে থাকবে ফাঁকা আকাশের দিকে, আর মনে পড়বে–
“এই আমি একদিন একটা চোখভরা মেয়ে ভালোবেসেছিলাম…
আর তাকেই আমি…”
না…
সে পারবে না।
এই সব অস্থির ভাবনার মাঝেই হঠাৎ সে আরেকটি আওয়াজ শুনতে পেল–
“আমি ও তোমাকে যবে থেকে দেখেছি, চোখ ফেরাতে পারিনি তিয়াশা। আমিও খুব পছন্দ করতে শুরু করেছি তোমাকে…”
আবারও চমকে উঠলো সে।
এই কণ্ঠ…
এ তো অয়নের….
আর নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না সে।
মুখ ফাটিয়ে এক তীব্র চিৎকার বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে—
“রোদ দ্….
এই বলে বজ্রের গতিতে ছুটে গেলো তাদের দিকে–
দেখতেই পেল, অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে তিয়াশা কাঁদছে, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে অয়ন।
রক্ত গরম হয়ে উঠলো তার,
মাথার রগে যেন আগুন ধরলো।
কোনো কিছু না ভেবেই, একঝটকায় অয়নের কলার চেপে ধরল,
নাক-মুখে একের পর এক ঘুষি— যেন সব জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, জেলাসি ছুঁড়ে মারছে তার ওপর।
“শালা কুত্**র বাচ্চা ভালো লাগে তাই না তোর? ব**ল আমার পুরো দুনিয়াটা শেষ করে দিলি!
তোকে আমি ভাই বলে ছেড়ে দিতাম? তোকে অনেকবার সাবধান করেছি ইন্দিরেক্টলি দূরে থাক–
কিন্তু তুই??
অয়নের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে, দাঁড়াতে পারছে না।
আরেকটু হলে হয়তো জ্ঞান হারাতই।
এদিকে তিয়াশা দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে—
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, জমে যাচ্ছে।
এই জায়নকে সে কখনো দেখেনি, এই জায়ন যেন তার পরিচিত মানুষটিই নয়।
সে একদম কাঁপা গলায় বলল—
“জায়ন ভাই… প্লিজ… ওনাকে ছেড়ে দিন… আর মারবেন না, প্লিজ!”
এই কথা শোনামাত্র জায়নের রাগ যেন আরও উগ্র হয়ে উঠলো।
সে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে তিয়াশার সামনে এল।
চোখে লাল আগুন, শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক।
হঠাৎই সে তিয়াশার মুখের চোয়াল শক্ত করে নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরল।
“কেন রে ব**ল* , প্রেমিক এর ব্যাথা সহ্য হচ্ছে না , আর তাই কাঁদছিস এখন?
আর আমার কথা… আমার অনুভূতি… আমার ভালোবাসা…
সেইটা মনে পড়লো না তোর?”
তিয়াশা যন্ত্রণায় কেঁপে উঠলো, ব্যথায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে–
“জায়ন ভাই… লাগছে… প্লিজ…”
জায়ন দাঁতে দাঁত পিষে, বুকের ওপর হাত রেখে বলল
“আর আমার এইখানে যা ছিঁড়ে যাচ্ছে, তার কী হবে বল?
আমি তোকে বলিনি?
তুই কি জানিস না তুই আমার জন্য কী?
একবারও ভাবলি না রোদ?”
তিয়াশা কিছু বলতে চাইছে…
কিন্তু সেই সুযোগ নেই।
তার কণ্ঠের আগেই জায়নের দৃষ্টি, জায়নের রাগ, জায়নের অধিকার সবকিছু চেপে বসেছে তার ওপর।
হঠাৎ জায়ন কিছু একটা ভেবে তিয়াশার হাত টেনে ধরলো।
একটাও কথা না বলে, তাকে টেনে নিচে নিয়ে যেতে শুরু করলো।
নামার আগমুহূর্তে একবার পেছনে ফিরে তাকালো অয়নের দিকে—
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৫
রক্তে ভেজা, হোঁচট খাওয়া শরীরটাকে লক্ষ্য করে একেবারে গলায় বিষ মিশিয়ে বলল–
“দশ মিনিট… দশ মিনিট সময় দিলাম।
এই বাড়ি থেকে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে বিদায় হবি ।
নইলে তোর কবর এই বাগান বাড়ির মাটিতেই আমি নিজে খুঁড়ে দিব!”