তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৯

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৯
নীল মণি

সকাল ঠিক দশটা টা বেজে ষোলো, রোদের আলোটা জানালার কাঁচ পেরিয়ে ধীরে ধীরে ঘরের মেঝেতে পড়ছে—সোনালি রেখার মত,নিজের ঘরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তিয়াশা নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে বাগানের দিকে, যেখানে ভেজা ঘাসের উপর রোদের ঝিলিক পড়ে চিকচিক করছে, পাখিরা আজ যেন একটু বেশিই চুপচাপ, কেমন এক বিষণ্ন সকাল, হাওয়ায় কোনো খুশির গন্ধ নেই—সে দাঁড়িয়ে থাকে সেই আলোছায়ার ভেতর, একা, নিঃশব্দ, তার চোখে জমে থাকা অশ্রুগুলো কিছুতেই গলে না, এদিকে নিজের আম্মুর
এরকম শারীরিক অবস্থা, এদিকে বুকের গভীরে গুমরে ওঠে একটাই কথা “উনি চলে যাবেন…”আর এই সব মিলিয়ে মেয়েটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। সূর্যস্নাত সকালের মাঝেই তার সমস্ত পৃথিবীটা যেন ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে…

এই এক গভীর ভাবনার মাঝেই, যখন জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিয়াশার বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট একটানা দহনে পুড়ছিল, ঠিক তখনই হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে এলো এক চেনা কণ্ঠস্বর—
“দোস্ত…”
এই একটিমাত্র শব্দে যেন কোনো বাঁধ ভেঙে গেল।
আরোহীর কণ্ঠ শুনেই তিয়াশা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। চোখের জলে ভিজে যাওয়া মুখ নিয়ে ছুটে এসে নিজের প্রিয় বান্ধবীটাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।
আঁচলের কোণ ভিজে যাচ্ছে, ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে সেই কান্নার শব্দে—আরোহী কিছু না বলে শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো তাকে, কারন সে জানে না বুঝে উঠতে পারছে না এই কান্নার মানে… এই ব্যথার গভীরতা, কোনো শব্দে বোঝানো যায় না।
তবুও আরোহী জানে এই কান্নার গভীরতা কতখানি।
নিজেও হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তিয়াশার মাথায় ।এর মাঝেই তিয়াশা কান্না ভেজা চোঁখে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো —

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” সব হারিয়ে গেলো রে দোস্ত , সব হারিয়ে গেলো।
কিচ্ছু ঠিক হলো না , চলে যাবে রে দোস্ত উনি ।
আমার কথা টাও শুনল না । আমাকে ভালোবাসায়
ভরিয়ে দিতে চেয়েছিল আর আমি সেই ভালোবাসা
ছোঁয়ার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো …..
কান্নায় ভিজে উঠেছে আরোহীর পড়নের জামাটা–তিয়াশার বুকচেরা আর্তনাদে কাপছে তার কাঁধ, আর একটানা কান্নায় এখন হিচকি উঠে গেছে তিয়াশার। বুকের ভেতর থেকে যেন কষ্ট গলে গলে বেরোচ্ছে, কিন্তু তারপরও কমছে না তার ব্যথা।

আরোহী কিছু না বলে শুধু শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে তাকে, যেন সেই বন্ধনটা দিয়ে তিয়াশার ভাঙা পৃথিবীটাকে সামলে রাখতে চায়। তার চোখেও জল এসে ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু সে জানে–এই মুহূর্তে তিয়াশার কান্নাটাই বেশি জরুরি, কারণ কিছু ব্যথা কেবল চোখ দিয়ে বেরোতে জানে, মুখ দিয়ে নয়।
” বেবী এখন আমাকে বলতে পারবি কি সব খুলে।
আমি সব জানতে চাই , তুই যদি সব খুলে না বলিশ তাহলে তো জানতে পারব না বেবি তোর মনে কি ঝড় বইছে জান। আমি যে আমার বেবি টার এই অবস্থা
আর দেখতে পারছি না । কি ছিলিস আর নিজেকে
কি করেছিস ।”

রুমে ছেয়ে এলো এক নিস্তব্ধতা–একটা ভারী, শব্দহীন নিঃসঙ্গতা। তিয়াশার কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়া চোখ দুটো এবার কিছুটা স্থির হলো, নিঃশ্বাসটা একটু গভীর হলো, আর সেদিকে তাকিয়ে থাকা আরোহীর চোখে ধরা পড়ল—এই নীরবতা কোনও শান্তির নয়, এটা ঝড়ের পরে ফেলে যাওয়া ভাঙচুরের মতো।
তিয়াশা নিজেকে একটু সামলে নিলো—হঠাৎ যেন বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো জমে থাকা কথাগুলো।
কাঁপা কণ্ঠে, জলেভেজা চোখে, সে আরোহীর কানে একে একে তুলে ধরলো তার সমস্ত না বলা অনুভূতি, অভিমান, ভালোবাসা আর ভয়… যেন আজ না বললে সে দম আটকে মরে যাবে।
আরোহী একবারের জন্যও বাধা দিলো না, শুধু হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো–কারণ সে জানে, তিয়াশার এই ভাঙা হৃদয়টুকু আজ শুধু শোনাতে চায়, উত্তর চায় না।

দুপুর গড়াতে না গড়াতেই, এক নিঃশব্দ সিদ্ধান্ত নিয়ে জায়ন হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। হাসপাতালের নিঃশ্বাসজমা দেয়াল ছেড়ে এবার সে আশ্রয় নিল শহরের এক অভিজাত ফাইভ স্টার হোটেলে। বিকেলে আবার ফিরে আসবে হসপিটাল এ রুহেনা বেগম কে দেখতে। গ্লাসের জানালায় রোদ কাচ ভেঙে পড়ছিল ঠিকই, কিন্তু তার মন যেন কুয়াশায় ঢাকা।
সঙ্গে ছিল তার নীরব কিছু সঙ্গী সাগর, আহান আর পলাশ, যারা মুখে কিছু না বললেও, চোখের ভাষায় পড়ে ফেলেছিল জায়নের ভেতরের অস্থিরতা।
এই হোটেলের নরম বিছানা, নির্জন ঘর কিংবা শহরের আড়ম্বর–কোনোটাই তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছিল না। বরং প্রতিটি মুহূর্তে তার হৃদয়ের কোণে বেজে চলেছে
সেই রাতের তার প্রাণপ্রিয় কিশোরীর অন্য পুরুষের সামনে ভালোবাসা অভিব্যক্ত করার কথা । কি করে পারলো ?
মনে মনে এক দীর্ঘশ্বাস বলল–

” করতে চেয়েছিলাম বউ হয়ে গেলি দূরের কেউ ।
বানিয়ে ছিলাম নিজের কীটি ক্যাট কিন্তু বানিয়ে দিলি
তুই আমাকে নিজেই ম্যাড। ভালোবেসেছি তোকে খুব জান, কিন্তু হয়ে গেলি তুই নিজেই পাষাণ ।
চিন্তা নেই জান আমার জন্য পাষাণ হয়েছিস তুই তোর মনে জায়গা দিলি না আমায় , এবার থেকে আমিও দেখবো তোর ওই বালের ভালোবাসার অয়ন কে কিভাবে আর ভালোবাসা দিতে পারিস । দূরে যাচ্ছি ছেড়ে যাচ্ছি না । ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলাম নিস নি
এবার দুর থেকেই টের পাওয়াবো এই আবরার জায়ন
কি জিনিষ ।
I said i hate you but i also love you jaan ……”
এই বলেই হোটেলের কাঁচের জানলায় নিজের ওই হাত
থাবা বসিয়ে দিলো।

কেটে গেছে তিনটি দিন–
তবুও সেই দিনের মতোই থমকে আছে চৌধুরী পরিবার।এই ক’দিনেই বদলে গেছে অনেক কিছু।
বড় মেয়ে এইভাবে পরিবারের মান সম্মান নষ্ট করে এই ভাবে চলে যাওয়ায় প্রণয় সাহেব হয়ে পড়েছে খুব ই দুর্বল হয়ে পড়েছে তার সাহস হয়ে উঠছে না বড় ভাইয়ের সামনে যাওয়ার ।
তারই মাঝে বেরিয়েছে তিয়াশার রেজাল্ট,
অনলাইনে চেক করেছিল ইউভি। তিয়াশার রেজাল্ট যে অন্য কেউ ও চেক করে নিয়েছে তা তার জানা নেই।
গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে , খুশীর খবর কিন্তু এই মুহূর্তে ,কেউ এই আনন্দ উপভোগ করছে না , বাসায় কিছুই যে এখন স্বাভাবিক নেই, স্বাভাবিক থাকলে হয়তো এই আনন্দ টা ছড়িয়ে পড়ত চোধুরী পরিবারে।
তিয়াশা খাওয়া-দাওয়া প্রায় করেই না বলা চলে।

মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে, যেন দিনের পর দিন জল ছাড়া একটা ফুল।
চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, ঠোঁটে নেই একটুকরো হাসিও।
সে ভেবেছিল,জায়ন অন্তত বাসায় ফিরবে বিদেশে যাওয়ার আগে হয়তো একঝলক দেখা হবে, হয়তো ছাদে কিংবা ডাইনিং টেবিলের পাশে হঠাৎ মুখোমুখি হবে দু’জন।
সে ভেবেছিল কিছু না বলেও, তার চোখে চোখ পড়লে জায়ন বুঝে যাবে–
তিয়াশা অপেক্ষা করছিল। কেবল তার জন্যই।
কিন্তু সে আশাও টিকল না।
বড় আম্মুর মুখে শুনে সে বুঝে গেল —

জায়ন আর বাসায় ফিরবে না।
এই কদিন হোটেলেই থাকবে, সেখান থেকেই ফিরবে বিদেশে।
এই কথাটা শুনে
মেয়েটার ভেতরে লুকিয়ে থাকা শেষ আশাটুকুও যেন ধ্বসে পড়ল।
যেটুকু বিশ্বাস, যেটুকু অপেক্ষা, যেটুকু না বলা অনুভব
সবকিছু এক নিমিষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
তিয়াশা শুধু চুপচাপ তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে।
সামনে রোদের ঝলক থাকলেও তার চোখে কেবল অন্ধকার।
এখন আর কিছুই ভালো লাগে না তার , না নিজের রেজাল্ট, না বাইরের আকাশ, না প্রিয় কারো অপেক্ষা।
সবকিছুই যেন ধোঁয়া হয়ে মিশে গেছে হাওয়ায়…
একটা অসমাপ্ত ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাসের মতো।

রাত নামলেই জায়নের মধ্যে দেখা দিত এক অজানা অস্থিরতা।
চোখের ভেতর যেন রাগ, ক্ষোভ, হাহাকার আর অপূর্ণতার বিষ মিশে থাকত।
হোটেলের বার কাউন্টারে নিঃশব্দে বসে থাকত সে,
সামনে রাখা থাকত একের পর এক গ্লাস নেশায় ভেজা ঠান্ডা তরলে, নিজের ভিতরের আগুনটাকে নিভাতে চাওয়ার এক ব্যর্থ চেষ্টা।
রাত বাড়ত,
আর জায়নের চলার ভঙ্গিতে আসত টলমল কাঁপুনি।
কখনও সিকিউরিটি ধরে ধরে তুলত তাকে রুমে, কখনও সে নিজেই করিডোর ধরে ছায়ার মতো ঘরে ফিরে আসত।
হোটেলের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই ছুড়ে ফেলত
পড়নের শার্ট ,

টেবিলের উপর রাখা ফোনটা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত
অজস্র মিসড কল, একাধিক নাম…
কিন্তু সে কোনও কিছুকেই আর পাত্তা দিত না।
এই কদিনে তার চোখের তলায় পড়ে গেছে কালি,
মুখের ভেতর ক্ষয়ে গেছে শক্তির রেখা।তার সমস্ত শরীর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে এক বিষণ্ন মাদকতার গন্ধ ।যেখানে নেশা আছে, কিন্তু শান্তি নেই।যেখানে অভিমান আছে, কিন্তু সেই মানুষ টা নেই ,
চিৎকার করে বলতে থাকে —
” তোকে মা **রতে গিয়ে তিলে তিলে নিজে মরছি ।”
২ দিন আগেই রহমত সাহেব মেহজাবিন বেগমকে ফোন করে বলে দিয়েছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলে আসায় তাদের ব্যস্ততা ঢাকায় ফিরতে হয়েছিল।
সব মেহমানরা তারা তাদের নিজ বাসায় ফিরে গেছেন।

এদিকে পলাশ নূর আহান মিথিলা আরোহী ও তার পরিবার বাবাই একইসঙ্গে ফ্লাইটে করে ঢাকায় ফিরেছে।
রয়ে গেছে শুধু সাগর ও ইভা তারা জায়ন এর সঙ্গেই ঢাকায় ফিরবে। বেশিরভাগ মানুষই রাঙ্গামাটির গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছিল এক নতুন জীবনের মিলন ঘটাতে , সেই মিলনের সাক্ষী হতে ।
কিন্তু সবাইকে ফিরতে হয়েছে একরাশ উদাসিনতা নিয়ে।
জায়ন ও পরিবারের বাকি সবাই এই তিনদিন রুহেনা বেগম কে অনেক বার হসপিটালে দেখতে গেছিলেন।
এই দুই দিন রূহেনা বেগম এর সঙ্গে ছিলেন আয়েশা বেগম ও ইউভি। গত কাল রাতেই
রূহেনা বেগম এর জ্ঞ্যান ফিরেছে ।
আজ বুধবার,

আজ দুপুরে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
তবে শরীরের চেয়ে মনের অবস্থা যেন অনেক বেশি বিপর্যস্ত।
চোখে তাকালেই বোঝা যায়—একটা প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তার ভিতর দিয়ে।
আজ সকালেই তাকে জানানো হয়েছে…
বৃষ্টির কথা।সেই খবরটা শোনার পর থেকে একটাও কথা বলেননি তিনি।
চোখ দুটো শুধু ফাঁকা চেয়ে থাকে সামনের দিকে,
মনে হয়, শব্দ পৌঁছেছে কানে —
রূহেনা বেগম চুপ।
আর চুপ করে আছে গোটা চৌধুরী পরিবারও।
শোক এখানে শব্দে প্রকাশ পায় না,শুধু নিঃশ্বাসে, দৃষ্টিতে… আর নিস্তব্ধতায়।

” মেজো মা ভেতরে আসবো ?”
জায়ন এর স্বর আসতেই রূহেনা বেগম তাকিয়ে
ধীম কন্ঠে —
” জায়ন বাবা , তুই আয় আয় বাবা ভেতরে আয়।”
জায়ন ভেতরে ঢুকতেই একটা চেয়ার টেনে বসতে
বলল–
” এখন কেমন আছো মেজো মা?”
রুহেনা বেগম যেন লজ্জায় অনুশোচনায় তাকাতে পারছে না জায়ন এর দিকে , মনে মনে ভাবছে তার বড় মেয়ের জন্য ছেলেটার এই অবস্থা। চোঁখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা ছেলেটার।
” হ্যাঁ রে বাবা এখন ভালো লাগছে , আমায় ক্ষমা….

জায়ন চুপ করিয়ে দিলো ওনাকে , ওনার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই জায়ন বলল —
” মেজ মা প্লিজ আর কিছু বলবে না এই নিয়ে , আসলে আমি নিজেই বৃষ্টি কে বিয়ে করতে চাইছিলাম
না, চিন্তায় থাকতাম তোমার শরীর নিয়ে তাই কখনো কিছু তোমাদের বলে উঠতে পারিনি । বৃষ্টি তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরেছে কিন্তু ভুল পথে ,
তাই প্লিজ একটাই কথা এসব নিয়ে ভেবো না।”
জায়ন এর কথা শুনে যেন আরো নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন
রুহেনা বেগম —

” তুই বিয়ে তে রাজি ছিলিস না সেটা একবার আমায় কেন বললি না বাবা ?”
” তোমার শরীরের কথা ভেবে , দেখো এখন নিজেকে মেজো মা কি অবস্থা করেছো ঠিক এই ভয়েই কখনো বলে উঠতে পারিনি । কিন্তু?
” কিন্তু কি বল বাবা ?”
জায়ন এর চোখে একধরনের থমকে থাকা আলো, যেন বহু কথা আটকে আছে ঠোঁটের কোণে।
তার গলা থেকে হঠাৎই বেরিয়ে এলো নিচু স্বরে বলা একটা কথা নরম, কিন্তু ভিতরে চাপা আগুন জ্বলা ভাষা
” আমার এক মূল্যবান জিনিস তোমার কাছে আছে ,
যা আমার নয় ,তবুও এক অদ্ভুত টানেই
তা আমার হয় উঠে।
আমি তা চাই না,তবু চাওয়াটাই অনিবার্য হয়ে ওঠে।

যদি আমার কখনো মনে হয় সেই জিনিষ আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে তবে তা আমি একদিন ছিনিয়ে নেবো। ”
জায়ন এর কথায় রুহেনা বেগম ভাবতে লাগলেন কি বলে আমার ছেলে টা ওর কোন জিনিষ আমার কাছে আছে ? যাই থাকুক কখনো মুখ ফুটে বললে সেই জিনিষ আমি নির্দ্বিধায় দিয়ে দিবো , একটু ম্লান হাঁসি দিয়ে বললো–
” আমি জানিনা বাবা তোর কি জিনিষ আমার কাছে আছে , তবে তোর চেয়ে নিতে হবে না একবার বললেই পেয়ে যাবি।”
জায়ন এবার একটু হাসি দিয়ে বলল —
” তখন আবার কিন্তু এরকম শরীর খারাপ করে নিও না , আর আমায় প্রমিস করো নিজের শরীরের খেয়াল রাখবে। আর সাবধানে থাকবে ।”
রূহেনা বেগম মজা করেই বললেন —

“বাবা তুই এমন ভাবে বলছিস যেন আমায় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিস ।”
” জী কাল ইউএস চলে যাচ্ছি মেজ মা , জানিনা কবে ফিরব।””
তার কথা শেষ হতে না হতেই—
রূহেনা বেগমের মুখের ওপর যেন একটা ছায়া নেমে এলো।
চোখদুটো মুহূর্তে জলে ভরে উঠল।
“মজা করিস না বাবা…” — গলার স্বর কেঁপে উঠল।
জায়ন চোখ নামিয়ে বলল—
“মজা না, মেজো মা। সত্যিই যেতে হবে।খুব জরুরি একটা কাজ।”
“কি এমন কাজ,যার জন্য তোকে আমাদের ছেড়ে যেতে হবে, হ্যাঁ?”

তার স্বর এ অভিমান, আশঙ্কা আর ব্যথা মেশানো সুর।
জায়ন কণ্ঠ ধীমকরে বলল—
“আমার জীবনের থেকেও জরুরি, মেজো মা।”
আর সে কথাটুকু শোনামাত্রই
রূহেনা বেগমের চোখের কোণে জমে উঠল ভারী জলবিন্দু।
ভাঙা গলায় শুধু বললেন—
“তোর জীবনের থেকেও যদি কিছু জরুরি হয়…
তাহলে আমার কিছু বলার নেই বাবা…
তুই শুধু ভালো থাকিস।”
জায়নের চোখেও যেন কিছু কাঁপা কাঁপা অনুভব ভাসতে লাগল।
কথা আর এগোলো না…
শুধু ঘরে ছড়িয়ে পড়ল এক নিঃশব্দ বিদায়ের হাওয়া।
এর মাঝেই রুমে প্রবেশ করলেন তাহসন সাহেব, প্রণয় সাহেব, আকাশ , ইউভি —

” জায়ন কাল চলে যাচ্ছিস , সাবধানে যাস বাবা ।
প্রণয় সাহেব এর কথায় জায়ন বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে প্রণয় সাহেব কে জড়িয়ে বললেন —
” জী মেজো চাচু ,তোমরাও সাবধানে থাকবে ।
আর মেজো মার খেয়াল রাখবে । টেনশান নেবে না।”
সবার মধ্যে নেমে এলো এক কষ্টের মায়া জড়ানো ছায়া।
” কখন বেরোবি জায়ন ? একবার বাসায় তো চল ।”
তাহসান সাহেব জায়ন এর কাঁধে হাত রেখে বললেন ।
জায়ন বলল —

” চাচু একটু পরেই বেরোবো, কাল মর্নিং এ ফ্লাইট ঢাকার বাসা থেকে আমার কিছু ডকুমেন্ট কালেক্ট করতে হবে । সময় হবে না বাসায় যাওয়ার ।”
” আমি যাবো তোর সঙ্গে ? ”
” না না চাচু আকাশ ,ইউভি যাচ্ছে তো সঙ্গে সাগর ও আছে টেনশান নিও না । তোমার যেতে হবে না, তুমি মেজো মা আর মেজো চাচু কে বাসায় নিয়ে জেও ।”
তারপর আরও কিছু ক্ষণ নরম স্বরে চলল কথা,
ভাঙা গলায় হাসি, চোখে জল, আর কিছু না বলা অনুভব।জায়ন হাত ধরে বসল মেজো মায়ের পাশে,
রূহেনা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সন্তানের মতো নয়,এক বন্ধুর মতো।
শেষমেশ সময় এসে গেল।

জায়ন একে একে সবার সঙ্গে দেখা করল।একটা একটা হাত ধরল, গলা জড়িয়ে ধরল,আর চুপচাপ বিদায় জানিয়ে দিল তাদের যাদের সাথে রয়ে গেছে হাজারটা স্মৃতি,আর অগুনতি না বলা কথা।
তার চোখে তখন একরাশ নিরব অভিমান,পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।ভিতরে জমে থাকা কষ্ট আর ব্যথাকে গিলে ফেলেগটগট করে বেরিয়ে গেল সে।
পেছনে ফেলে গেল অনেক মন মরা মুখ,কেউ কথা বলল না, কেউ তাকে ডাকার সাহস পেল না।
শুধু দরজার দিকে চেয়ে থাকল চুপচাপ…
যেখানে কিছুক্ষণ আগেও দাঁড়িয়ে ছিল জায়ন
আর এখন কেবল রয়ে গেছে তার বিদেশী পারফিউম মেশানো বাতাস ।
জায়ন এর জিনিসপত্র দুই দিন আগেই আকাশ দিয়ে গেছিল হোটেলে , তাই সব কিছু নিয়েই একবার এ বেরিয়ে ছিল ।
সাগর আর ইভা জায়ন এর মার্সিডিজ টা ব্যবহার করল ঢাকায় যাওয়ার জন্য ।
আর ইউভির গাড়িতে বসলো জায়ন আর আকাশ,
ড্রাইভ ইউভি ই করবে ।
ইউভি নিঃশব্দে ড্রাইভ করেই যাচ্ছে , আকাশ ও চুপচাপ । তাদের প্রাণের ভাই আবার চলে যাচ্ছে ।
কিন্তু ইউভির মনে জমে আছে অনেক কথা কিন্তু সে যদি এখন বলতেও চায় , এই ঘাড় ত্যাড়া লোক শোনার আগেই কিছু বলে ফেলবে ।

” ভাইয়া নিজের চেহারা দেখেছো, মনে তো হচ্ছে ঘুমাও না কত রাত ।”
আকাশের কথায় গাড়ির মধ্যে থাকা নিস্তব্ধ পরিবেশ টা শেষ হয়ে উঠলো —
” তোর মনে হয় আমি ঘুমাই ।”
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলল –
” তাহলে কি করো রাতে ।”
জায়ন এক উগ্র হাঁসি দিয়ে বলল —
” আমার নিজেরই মনে থাকে না, তোকে কি বলবো।”
আকাশ আর ইউভি দুজনই জায়ন এর কথা মাথায় ঢোকাতে পারলো না। আকাশ মনে মনে ভাবছে —
” আমার ভাইয়ার মাথাটা কি পুরাই গেছে ?”

জায়ন নিজের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ইউভির টিশার্ট এর বুকে গুঁজে দিলো ।
ইউভি ড্রাইভ করতে করতে এক বার তাকিয়ে বলল —
” কি দিলে এটা ভাইয়া ।”
“পরে খুলে দেখিস , কিন্তু এই কাগজে লেখা কাজ গুলো যদি তুই না করতে পরিস তাহলে তোর ভালবাসার লাইফে সব দিয়ে বড় প্যারা ঘটাবো আমি।”
আকাশ জায়ন এর এই কথা শুনে একটু মুচকি মুচকি হাঁসি দিলো ।
জায়ন এক উগ্র হাঁসি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল —
” বেশি হাসিস না , ওই কাগজে তোর কাজ ও যুক্ত করা আছে ।”
আকাশ এর হাসি মুখটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল এক অজানা ভয়ে ।

এক অস্বস্তির সকালে , চৌধুরী বাড়িতে ছিল আরেক নতুন মন খারাপের দিন ।
” এমন এক ঘাড় ত্যাড়া ছেলে জন্ম দিয়েছি , যে যাওয়ার আগে একবার ও নিজের মায়ের সঙ্গে দেখা করে গেলো না । শুধু ফোন করে বলল চলে যাচ্ছি।”
মেহজাবীন বেগম সুরাইয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন নিঃশব্দ হাহাকারে,যেন বুকের ভেতর জমে থাকা সমস্ত কষ্ট আজ বেরিয়ে আসছে অশ্রু হয়ে।
তাঁর কাঁধে মাথা রেখে সুরাইয়াও থেমে নেই,
দুজনের কান্না এক হয়ে গিয়েছে নিঃশব্দ আকুতিতে।
রুহেনা বেগম ও নিজের ঘরে বসে কেঁদে চলেছে।
তিয়াশা সেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট।
নিজের রুমে দাঁড়িয়ে আছে সে তাকিয়ে আছে
চোখ জানলার বাইরে,আর মন কোথায় কে জানে…
নীল আকাশের বুক চিরে
একটি প্লেন ধীরে ধীরে দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে—
তিয়াশা তাকিয়ে থাকে অপলক,
চোখে জল নেই, কিন্তু ভিতরে রক্তক্ষরণ স্পষ্ট।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৮

তারপর নিঃশব্দে ঠোঁট কাঁপে,আর গভীর এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে—
“চলে গেলে… আমার ভেতরটা এলোমেলো করে দিয়ে।
একটা ঝড় তুলে দিয়ে তুমি চলে গেলে…
এই হৃদয়টাকে হাহাকারে ভরে দিয়ে…
শোনো, একদিন… ঠিক একদিন…
এই ঝড়ের দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকেই।
তুমি ছাড়া কেউ পারবে না থামাতে এই ভাঙনের সুর।
বুঝলে তো… আমার হৃদয়ের বাঘের বাচ্চা।”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here