তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫১

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫১
নীল মণি

বাপ তুই কি সকাল দিয়ে নিজেরে আয়নায় দেখিস নাই ?”
তাহসান সাহেবের মুখে এমন কথা শুনে জায়ন থমকে গেল।ভ্রু সামান্য কুঁচকে তাকিয়ে রইল তিনি কী বলতে চাইছেন বোঝার চেষ্টা করে।কিন্তু বেশি কিছু না ভেবেই দরজার ফ্রেমে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ও জিজ্ঞেস করল —
__”এই সময় এইখানে কি করছ তোমরা চাচু?”
তাহসান সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন —
__”সামনে থেকে সর তো। বাইরে গরমে প্রাণ যাচ্ছে। ভিতরে ঢুকি আগে।”
তাঁর এই নিরুত্তর ভঙ্গিমায় জায়ন কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল।চোখ সরু করে তাকাল ইউভি আর নাজিমের দিকে।তখনই ইউভি এগিয়ে এসে হালকা হাসি দিয়ে বলল —

__”ভাইয়া, তুমি তো সকাল থেকে ফোনই ধরতেছো না! বড় আম্মু চিন্তা করছিল তাই আমাদের পাঠাইছে। বলছে, তোমরা ওই বাসায় কেন এখনো পৌঁছালে না তাই এসেছি ।”
অমনি জায়ন গট গট করে তাকিয়ে পরল ইউভির দিকে ।
__”আরে সরবি তো এরকম সঙ্গের মতন দাঁড়িয়ে আছিস কেন দরজার কাছে ?”
তাহসান সাহেব এই বলে ঢুকতে যাবে তখন ই জায়ন বলল —
” তোমরা ফিরে যাও চাচু আমরা আজকে যাব না।”
তাহসান সাহেব থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন, বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে উঠল তাঁর— —
” তুই এত অপদার্থ কবে হলি বাপ বাসায় সবাই অপেক্ষা করতেছে তিয়াশা কে দেখবে বলে। আরে আমাদের এই দরজা দিয়ে কেন ফিরাচ্ছিস ?”
জায়ন এবার পড়েছে মহা ফ্যাসাদে সে তার বউ কে কি ভাবে এই অবস্থায় ওই বাসায় নিয়ে যাবে । যেন হঠাৎ একটা বিশ্রী ফাঁদে পড়ে গেছে ,তাই দরজা ছেরে এক হাত কোমরে ও এক হাতের আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘসতে ঘসতে বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” কেন আমার বউ কে কেন দেখতে হবে , আগে দেখেনি তারা ? আর বাসার লোক কে বলে দিও আমরা এই মুহূর্তে যেতে পারব না ,আরো দুদিন ওয়েট করতে আমার কাজ আছে এই বাসায় ।আমি এখন ওই বাসায় যেতে পারব না।”
জায়ন এর চোখে যেন একরাশ গম্ভীরতা, মুখে দ্বিধা… অথচ তাহসান সাহেব তো এসব বোঝেন না, তিনি ব্যস্ত বড়দের দায়িত্ব নিয়ে। জায়নের কথায় সরে না দাঁড়িয়ে, এক ঝটকায় দরজার ফাঁক দিয়ে অমনি ভিতরে ঢুকে গেলেন তিনি —
“চাচু দা…”
জায়ন বলতে পারল না, তার আগেই তাহসান সাহেব সোফায় ধপ করে গা এলিয়ে বসে পড়লেন। ক্লান্ত, হতবাক চোখে চারপাশ তাকালেন সারা ঘর যেন ।
এদিকে জায়ন এর দাঁত চেপে বেরোলো একটা ক্ষীপ্ত শব্দ–

__”শিট”
চোখ রক্তগরম, চোয়াল শক্ত। হঠাৎ পিছন ফিরেই ফুঁসে উঠলো নাজিম আর ইউভির দিকে,
__” বা** বাসরের রাতে কি ফোন নিয়ে বাসর করবো । তোদের মাথায় একটু বুদ্ধিও ঢোকে না? যে ফোন ধরিনি বলে চলে আসলি।
নাজিম গলা চেপে মুচকি হেসে বলে উঠলো,
“ওহ হো… সে তো তোকে দেখে বুজতেই পারছি, বেশ ঝড় বয়ে গেছে তোর উপরে। কিন্তু ভাইরে, ঝড় তো পেরিয়ে গেছে এখন কি সমস্যা ? আর আমার শাল….. সরি, বোনটা কোথায়?”
এই শুনে জায়নের মুখে বিরক্তির ছায়া স্পষ্ট। এর মধ্যেই ইউভি গম্ভীর স্বরে বলল,

__”তুমি কেন যাবা না ভাইয়া? বড় আব্বু, বড় আম্মু অনেক রাগ করবে”
জায়নের মুখে গম্ভীরতা, কিন্তু কণ্ঠে চাপা উদ্বেগ,
__”আমার বউ অসুস্থ। যাবো কি করে ? চাচু কে নিয়ে এক্ষনি বিদায় হ ।
এই কথা শুনে নাজিম আর ইউভি দুজনেই থমকে গেল।চিন্তায় ভরা ইউভির কণ্ঠ,
__”কি হইছে ভাইয়া? ঠিক আছে তো বনু?”
এই বলে ইউভি ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়াতেই ঠোট কাটা জায়ন এর উত্তরটা এলো ছোঁড়া ছুরির মতো,
__”তোর বনু আমার ভালোবাসা সহ্য করতে পারে নাই। তাই অসুস্থ ,আর তোদের মুখ দেখে আমিও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। তাই নাটক বন্ধ করে চাচুকে নিয়ে ফুটে পর।”
জায়ন এর কথা শেষ না হতে হতেই এর মধ্যেই তাহসান সাহেব ভরাট গলায় বলে উঠলেন,

_”হ্যা রে তোর মুখের আর গলার এত লাইন বসিয়ে মানচিত্র কে বদলে দিল?”
জায়ন একটু অবাক হি হল , তখন থেকে চাচু মুখের পেছনে কেন পড়েছে। ছুটে চলে গেল ওয়াশরুমে, ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের মুখ টা দেখতেই অবাক
হয়ে গেল । ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠলো এক চিলতে
দুষ্টু হাসি , মনে মনে বিড়বিড় করল —
” আমার বেড়াল এর বাচ্চা ও তো দেখছি ভালই হিংস্র,
নিজেকে এই বাঘের বাচ্চার হাত থেকে বাঁচাতে
ভালোই চেষ্টা চালিয়েছ কিটি। কিন্তু কোন লাভ নেই
বেইবি। ”
এদিকে তার এই চেহারার সাক্ষী হয়ে উঠেছে তার নিজের চাচু , সেদিকে তার কোন হেলদোল নেই।
জায়ন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল তার চাচুকে,

__” বেড়াল এর আচরের দাগ চাচু । তেমন কিছু না।”
তাহসান সাহেব ভ্রু কুঁচকে একবার জায়নের দিকে তাকালেন। মুখে হালকা ব্যঙ্গ, কিন্তু চোখে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
__” হুমম ভালোই হিংস্র বেড়াল মনে হচ্ছে মুখের সঙ্গে সঙ্গে গলায় ও বেশ ভালই আঘাত বসিয়েছে, টিটেনাস লাগিয়ে নিস নইলে সমস্যা হতে পারে।”
জায়নের মুখের রক্তিম চিহ্ন গুলোর দিকে এক ঝলক তাকিয়েই যেন আরও কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি, তারপর চোখ একটু সরু করে বললেন,

__” তো তিয়াশা আম্মু কোথায় দেখতে পাচ্ছি না ?”
,জায়ন সামান্য সময় নিলো, তারপর আড়চোখে তাকাল ইউভি আর নাজিমের দিকে একটা সতর্ক সংকেতের মতো। তারপর ইউভি নিজের চিরচেনা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে গলা খাঁকরি দিয়ে একটু হাসল — অপ্রসঙ্গিকভাবে
“হে হে বনু সকালে ঘুরতে গেছে চাচু , বনু এই বাসায় নাই তো হি হি ।”
কিন্তু কথাটা বলতেই স্পষ্ট বোঝা গেল এটা এমন একটা বাহানা যা খুব বেশি দূর টিকবে না। জায়নের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট, ভ্রু কুঁচকে তাকাল ইউভির দিকে। কথা গুছাতে পারেনি, আবার এমন একটা ব্যাপার বলে ফেলেছে যা অবিশ্বাসযোগ্য।
তাহসান সাহেব এর ভ্রু আবারো কুচকে উঠলো , সে মনে মনে ভাবলো জায়ন এইখানে , আর জায়ন তার বউ কে ঘুরতে পাঠিয়ে দিলো , যে ছেলে কাল পর্যন্ত বউ কে দেখার জন্য ছট পট করছিল , সে বউ একা ছেড়ে দিলো । আর এ ইউভি বেটায় বা জানলো কি করে ? এতক্ষন তো বলে নাই। তাই নিজের সন্দেহ পরিষ্কার করার জন্য বলে উঠলো

” হ্যা রে জায়ন তুই তিয়াশা আম্মু কে একা যেতে দিলি এইটা ও সম্ভব?”
তারপর ইউভির দিকে তাকিয়ে বলল —
” তুই কি ভাবে জানলি ও বাসায় নাই?”
ইউভির মুখ শুকিয়ে গেল। যেন মাথার ভেতর দিয়ে হঠাৎ বয়ে গেল এক ঝড়।কি বলবে সে । সব সময় কেন এর মাথায় হারি গুলো ভাঙ্গে সবাই বুঝে পায় না । এদিক দিয়ে ওদিক দিয়ে চারিদিক দিয়ে শুধু ইউভি ই ফ্যাসাদে পরে । তবুও নিজেকে সামলে আমতা আমতা করে বলল —
” ইয়ে মানে চাচু …..
বাক্য স্বপূর্ন করার দরকার হলো না। কারন জায়ন এর এই সব কিছু কারণ জায়ন, যার মেজাজ ইতিমধ্যে ফুসে উঠেছে, গলা নিচু করেই গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো ,

__” আমার বউ অসুস্থ চাচু , এবার তোমরা বাসায় ফিরে যাও ।”
ঐ মুহূর্তেই তাহসান সাহেব থমকে গেলেন। চোখ কপালে উঠলো। নাজিম আর ইউভি দুজনেই একসাথে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো জায়নের দিকে।
এদিকে তাহসান সাহেব ভাবছেন সুস্থ মেয়ে পাঠালেন এক দিন ও হলো না , অসুস্থ কি করে হলো ,,
তাই তাড়াতাড়ি সোফা থেকে উঠে দাড়ালো —
” তিয়াশা আম্মুর শরীর খারাপ তুই এখন বলছিস ।
কৈ কৈ মেজো আম্মু , উপরে নিশ্চই ” —
এই বলেই তাহসান সাহেব উপরে উঠতে যাবে জায়ন
সামনে এসে দাড়িয়ে পরল, জায়ন সামনে দাড়িয়েই
দাঁতে দাঁত চেপে বলল —
” চাচু আমার বউ এর রুমে যাওয়ার এলাও নেই কারো
তাই তোমরা প্লীজ যাও। ”
তাহসান সাহেব একটু হতাশ হলেন , হায় হায় ছেলের এ কি পরিনতি । তারপর একটু রেগেই বলে উঠলেন

” তুই কে রে আমার মেজো আম্মুর রুমে যাওয়ার এলাও করার ?”
জায়ন একটু হেসে তাকাল, কণ্ঠে তেমন কোন জোর নেই, কিন্তু উচ্চারণে ছিল এক অদ্ভুত শান্ত অথচ শক্ত একটা আত্মবিশ্বাস
__” ভুলে গেলে চাচু আমি ওর কে হই ?”
তাহসান সাহেব চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষন এই ছেলে যখন বলেছে যেতে দেবে না তখন যেতেই দেবে না ।
তারপর কিছু ভেবে এক আদেশের সুরেই বললেন —
” ঠিক আছে আমরা চলে যাচ্ছি, তবে ঘণ্টা দুই এর মধ্যে বাসায় মেজো আম্মু কে নিয়ে আসবি ।”
জায়ন একটু গম্ভীর আর রূঢ় কন্ঠে বলল —
” চাচু আমি না এই মাত্র বললাম যে আমার বউ অসুস্থ ।
আর আমরা এখন যেতে পারবো না।,”
তাহসান সাহেব ইউভিড় দিকে তাকিয়ে বলল —
” চল এখন।”
তারপর যেতে যেতে পেছন ঘুরে জায়ন কে বলে উঠলো —

” নইলে আমায় বড় ভাই কে পাঠা তে হবে।”
এই বলেই জায়ন এর বাসা ত্যাগ করলেন ওরা তিন জন । জায়ন স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষন ।
এদিকে, তিয়াশা চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে। শরীরে ব্যথা আছে ঠিকই, কিন্তু ওষুধের প্রভাবে যেন খানিকটা ঝাপসা হয়ে আছে সেই যন্ত্রণা। তবু মনে মনেই বিরক্তিতে ফুঁসছে সে। শরীরটা বলছে বিশ্রাম, আর মনটা বলে উঠছে, “এই লোকটার কাছ থেকে রেহাই নেই, না দিন, না রাত।” মনে মনে গজগজ করে উঠলো তিয়াশা,
__”নির্দয়ের বাচ্চা, এক চিলতে ছারও দিলো না।”

ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক চেনা গলার আওয়াজ, সেই স্বর যার উচ্চারণে সব সময় একরকম ছেলেমানুষি, আবার ঠিক তেমনই কর্তৃত্ব।
“বউ, সরি… ব্রেকফাস্ট বানাতে দেরি হয়ে গেল… চাচু এসেছিল আমাদের নি…”
শব্দগুলো শেষ হওয়ার আগেই যেন তিয়াশার মনে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ব্যথাটা যেন হঠাৎ উধাও! তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গেল সে কিন্তু শরীর তো কথা শোনে না। পা দুটো যেন একটুও সহানুভূতিশীল নয়, আর সেই অসহায় ভার নিয়ে সে আবার ধপ করে খাটে বসে পড়ল। হালকা চোখে জল এসে গেল, নিজের উপরেই বিরক্তি।কিন্তু চোখ উঠিয়ে তাকাল জায়নের দিকে, কণ্ঠে ছিল কাঁপা এক তাড়না,
__”কোথায় চাচু? আমি ওই বাসায় যাব।”
ব্রেকফাস্টের প্লেটটা দ্রুত রুমের সেন্টার টেবিলে রেখে তিয়াশার দিকে এগিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে বসে, চোখে মৃদু অভিভাবক সুলভ ভাব নিয়ে সে তিয়াশার মুখ ছুঁয়ে দেখলো, যেন তার সব ক্লান্তি সেই হাতের উষ্ণতায় গলে যাবে।

__”ব্যথা কমেছে, বেবি?”
তার স্বরটা ছিল নরম, আর চাহনিটা ছিল বুঝতে চাওয়ার।
তিয়াশা দাঁত কিঁচমিঁচ করে ফিসফিস করলো,
__”না, নাটক হচ্ছে… নিজেই ব্যথা দিলেন আবার জিজ্ঞেস করছেন কমেছে কিনা। নির্দয় পুরুষ!”
-জায়ন একটু হেসে মাথা নিচু করে আবারো চুপ করে তাকাল ওর চোখে, তারপর একটুও দয়া না দেখিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,
__” ভাবিস না বেশি জান, এই ব্যথা তুই রোজ পাবি।”
এই কথা শোনা মাত্র তিয়াশার চোখ কপালে। মুখ বড় বড় হয়ে গেল, ভ্রু কুঁচকে গলা চেপে বলল,
__”কি ই ই ই…??”
জায়ন নিজের হাসি চেপে হঠাৎ ই তিয়াশার কানের কাছে গিয়ে বলল —

__” নিজেই তো দুদিন আগে মারণাস্ত্র ড্রেস পরে আমাকে সিডুইস করতে চাইছিলিস আর এখন অসুস্থ হয়ে পড়ছিস , খুব ভালোবাসি তোমায় জান কিন্তু এই ব্যথা টুকু তোমায় যে সহ্য করে নেওয়া শিখে নিতে হবে, এইটাই এই প্রেমের ডিল।”
তিয়াশার গলা শুকিয়ে আসছে , কি করতে যে সেদিন
ওই ড্রেস পড়তে গেছিল আল্লায় যানে ।এর মধ্যেই জায়ন আবারো শুরু করল, এইবার গলার স্বর আরেকটু নরম, কিন্তু বাক্যের ধার আগের মতোই কাটা,

__” আর সেদিন নিজের কাছে নিজেকে যদি বেঁধে না রাখতাম তাহলে তোকে ওই দিন ই বুঝিয়ে দিতাম ওই মারণাস্ত্র ড্রেস পরে তুই কেমন ছুরি চালাচ্ছিলিস।”
তিয়াশা মুখ ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো —
” আমি ওই বাসায় যাব।”
জায়ন আবারো একটু হেসে বলল —
” এই অবস্থায় ওই বাসায় কি করে যাবি ? পরে যাব ।”
তিয়াশা এবার রেগেই উঠল —
” কে দায়ী এই অবস্থার জন্য অসভ্য নির্দয় বাঘের বাচ্চা?আপনি না বলেছিলেন সকাল হলে আমার কথা শুনবেন , তাই এখন আমি বলছি আমি ওই বাসায় যাব।”
জায়ন এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো–

” আগে ব্রেক ফাস্ট কর তারপর দেখছি। ”
তারপর জায়ন প্লেটের থেকে স্যান্ডউইচ টা হাতে নিয়ে
তিয়াশা কে খাইয়ে দিল। আর এক গ্লাস দুধ, কিন্তু দুধ
টা যখন তিয়াশার মুখের কাছে ধরলো , তখন তিয়াশা
মুখ ঘুরিয়ে আস্তে করে বলল —
” আমি দুধ খাইনা , ভালো লাগে না।”
জায়ন একটু বাকা হাসি দিয়ে বলল —
” তোর ইমিউনিটি সিস্টেম অনেক দুর্বল বউ , আমার
ও ভালো লাগে না । ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়ানোর জন্য
এগুলো দরকার তারাতারি শেষ কর।”
তিয়াশা দাঁতে দাঁত চেপে কিছু একটা গজগজ করল, গালি হয়তো, কিন্তু মুখে আওয়াজ পেল না কেউ। ধীরে ধীরে দুধটা খেয়ে নিল।
জায়ন খালি প্লেট টা নিয়ে উঠে তিয়াশার কপালে এক চুম্বন একে দিয়ে বাইরে যেতে যেতে বলল —

__ ” আমি একটু বেরোবো এই বেড থেকে যেন এক পাও নড়া না হয় বলে দিলাম।”
তিয়াশা আবার ও রেগে গেল , এই অবস্থায় রেখে তাকে এই লোক টা কোথায় যাবে । তাই একটু রেগেই
বলে উঠলো —
__ ” কোথায় যাচ্ছেন ?”
জায়ন পেছন ফিরে একটু বাকা হাসি দিয়ে বলল —
” আমার বউ এর জন্য বোরখা কিনতে আর র র ভাবছি কিছু মরণাস্ত্র কাবার্ডে থাকা দরকার। তারাতারি
চলে আসবো ।”
তিয়াশা ভেতরে ফুসে উঠল, গাল ফুলিয়ে রাগে যেন এক বস্তা আগুন বুকের ভেতরে। তারপর অনেক কষ্ট করে হাতের কাছে থাকা বালিশটা টেনে নিয়ে সমস্ত জোর দিয়ে ছুঁড়ে মারল দরজার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে দরজা ফাঁকা।

চোধুরী বাড়ি ভর্তি এখন অতিথি, কিছু কিছু অতিথি সকালেই চলে গেছে ,এখনো কিছু রয়েছে । তাহসান সাহেব ফিরে আসার আগেই প্রতিবেশীরা তাদের বাসায় ফিরে গেছেন। তারা জানতে পারেন নতুন বউ এই বাসায় নেই । অনেক এদিক ওদিক কোথাও তারা কানাঘুষ ও করছিল কিন্তু তাতে কার কি যায় এসে
যায়। সবাই তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিল বাসার পুরুষরা ও বাচ্চারা কিন্তু গিন্নিরা তখনও খায়নি। কারণ তাহাসান সাহেব বলেছিলেন জায়নদের আসতে একটু লেট হবে। তাই তাদের অপেক্ষাতেই চেয়েছিলেন সদর দরজার দিকে। একটু পরেই হঠাৎ বাইরে গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। আরে গাড়ির হর্ন তাদের খুব চেনা তাই তারা বুঝে গেলেন জায়ন ও তিয়াশা চলে এসেছে।

হঠাৎ সবার চোখ গেল সদর দরজা দিয়ে আসা জায়নের দিকে । অফ হোয়াইট রঙের কটন জিন্সের
সঙ্গে ডার্ক ব্রাউন রঙের টিশার্ট চোখে সানগ্লাস আর কোলে তিয়াশার ছোট্ট শরীর টা বোরখা দিয়ে পুরো ঢ
মোড়ানো। যেন এক রহস্যময় অথচ স্পষ্ট সংকেত নিয়ে ড্রয়িং পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। পেছনে ছায়ার মতো হেঁটে আসছে জেমস কিন্তু সে ড্রয়িং রুমেই থেমে গেল।
তিয়াশা’র মুখ দেখা যাচ্ছে না। অথচ এটাই ছিল সবাই দেখার অপেক্ষা যে বাসার মেয়ে কে নতুন বউ হিসাবে কেমন লাগচে।

সব ফাঁকা হয়ে গেল জায়নের সিদ্ধান্তে।কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করল না। সবাই জানে, জায়ন কেমন। নিজের মতো করে চলে, নিজের নিয়মে বাঁচে। কিন্তু প্রান্তিক সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হল। পাশে দাঁড়ানো দুই-তিনজন আত্মীয়র ফিসফাস —
“ছেলের এইসব পাগলামি আর কতদিন?”
প্রান্তিক সাহেব ভেতরে ভেতরে জ্বলছেন ,
“এখনো সবাই রয়েছে অথচ এই ছেলে আবারো সবকিছুর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে দিল ।”
এদিকে ইউভি আর আকাশ হা করে তাকিয়ে আছে, অবশ্য আকাশের এই সব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাই সে তেমন কোন চমক খায়নি । সে বুঝে গেছে এখন এসব এই বাসায় আসলেই দেখতে হবে ।
ইউভি সব ই বুঝতে পাড়ছে তার ভাইয়া যে তার বনু কে লোক সমাজ এ বের করার মত অবস্তায় রাখেনি , লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে ।

এদিকে নাজিম আর বৃষ্টি মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে
এমন কি এই খবর নাজিম তার তিন বন্ধুর কানেও
পৌঁছে দিয়েছে ।
তাহসান সাহেব তো আর কি বলবে এত বেপরোয়া সে
তো নিজেও ছিলেন না । তবুও সুরাইয়া বেগম এর পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন —
__” এই যে বউ শুনছো ?”
সুরাইয়া বেগম তাহসান সাহেব এর এরকম কান্ড দেখে
ভ্রু কুচকে তাকাল ।
তাহসান সাহেব একটু হতাশ হওয়া মুখ বানিয়ে আবারো শুরু করলেন —

__” আমি মনে হয় অনেক কিছু মিস করে গেলাম বউ।
এই হতচ্ছাড়া জায়ন টারে দেখে আমার আপসোস হচ্ছে।”
সুরাইয়া বেগম এক রাগান্বিত চেহারা নিয়ে বল লেন —
__” দুদিন পর ছেলে মেয়ের বিয়ে দেবে সে কথা ভাবো।
এই বুড়ো বয়সে যত্তসব আজাইরা কথা বার্তা।”
এই বলে সরে গেলেন সুরাইয়া বেগম আর এদিকে তাহসান সাহেব হতাশ হয়ে চেয়ে রইলেন জায়ন দের দিকে।
এদিকে রায়ান লক্ষ্য করল, মারিয়া হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। যেন চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেছে।রায়ান ওর পাশে গিয়ে চোখের উপর হাত রেখে একটু করা আওয়াজেই বলল,

__”ওই শাকচুন্নি, কি হা করে দেখছিস ? সময় হলে তোর কপালে জুটবে এইসব। এখন খাওয়া শেষ হলে ঘরে দৌড়া।”
কিছু না বুঝে মারিয়া সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ফুলিয়ে বলল,
__”রায়ান ভাই, তুমি সব সময় এরকম জল্লাদের বাচ্চার মতো ব্যবহার করো কেন? একটুও ভাল লাগে না কিন্তু, বলে দিলাম।”
এই বলে রাগে গজগজ করতে করতে মারিয়া ঘরের দিকে চলে গেল।আর পেছনে দাঁড়িয়ে রায়ান এর ঠোঁটে ফুটে উঠল এক খ্যাপাটে, বাঁকা হাসি।
উপরে যাবার আগে, তিয়াশা কে কোলে নিয়ে জায়ন বলে উঠল,
__”মা, এক প্লেট খাবার উপরে পাঠিয়ে দিও।”
মেহজাবীন বেগম দ্রুত সিঁড়ির পাশ থেকে বললেন,
__”মেজো আম্মু, কী হয়েছে রে? বোরখা কেন পরা? আর উপরে কেন যাচ্ছিস? নিচে এসেই খেয়ে নে না। সবাই তো অপেক্ষা করছে।”
জায়ন এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়াল। চোখে কেমন এক গম্ভীরতা, গলাটা সোজা, স্থির।

__”আমি চাই না, আমার বউয়ের মুখ কেউ দেখুক।”
এই কথা বলে সে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করল,
তিয়াশা তখনো চুপচাপ জায়নের কোলে লজ্জায় গুটিয়ে আছে । তার নিজের ও কিছু করার নেই এই ঘাড় ত্যাড়া বরের কাণ্ডে ।
পেছনে অজস্র চাহনি, প্রশ্ন, অভিমত, কানাঘুষো।
কিন্তু জায়নের মাথা সামান্যও ঘুরল না।
” আমার রুম তো ফেলে আসলাম ।”
তিয়াশা জায়ন এর শার্ট এর উপর নখ দিয়ে ফুল বানাতে বানাতে প্রশ্ন করে বসল।
জায়ন ওর নিজের রুমে যেতে যেতে একটু বাকা হেসেই বলল —
__ ” বিয়ের পরে দেখেছিস কোন মেয়ে কে নিজের রুমে থাকতে । এখন থেকে এইটাই তোর রুম মনে আমাদের রুম।”
তিয়াশা কে আগের দিনের ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসিয়ে দিয়ে জায়ন বলল —

” এখন একটু ঠিক লাগছে বেইব।”
তিয়াশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানিয়ে দিল । এর মধ্যেই
জায়ন তিয়াশার মুখের ওপর থেকে পরদা টা তুলে কপালে একটা চুম্বন একে দিয়ে বলল —
” আমার বউ কে যে এই বোরখা তেও মারাত্বক
লাগছে, আমার বুকে হাত দিয়ে দেখ কেমন আমার
হার্ট টা বিট করছে ।”
এই বলেই জায়ন তিয়াশার ছোট্ট হাত টা জায়ন এর প্রশস্ত বুকে রাখল , জায়ন এর হৃদয় এর প্রতিটা স্পন্দন অনুভব করতে পারছে তিয়াশা । অমনি চমকে জায়ন এর দিকে তাকিয়ে পরল তিয়াশা ।
জায়ন তিয়াশার দুই হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল —

__” জান আজ থেকে তোর মুখ থেকে আমি আর আপনি শুনতে চাই না আমার ভাল লাগে না ।”
তিয়াশা একটু নিজের গলার স্বর নিচু করে বলল —
__” তাহলে কি বলব?”
__ ” তুমি বলে ডাকবি ।”
__ ” আমি তুমি বলতে পারব না ।”
__ ” ঠিক আছে চল তাহলে ।”
__ ” আমাদের বাসায়, তুই আমার কথা শুনবি না আমি কেন শুনবো ?”
তিয়াশা অমনি গট গট করে তাকিয়ে পরল , আর মুখ
ফুলিয়ে বলে উঠলো —
__” আ আপনি হলেন ইবলিশ এর বড় ভাই । ”
জায়ন এবার গম্ভির স্বরেই বলে উঠলো–
__” আবার আপনি ?”
তিয়াশা ভয়ে ধীম স্বরে বলে উঠলো —
” কে যেন বলেছিল , সে দিনে আমার কথা শুনবে ।
মিথ্যে বাদী একটাও কথা শোনে না ।”
এই বলে তিয়াশা মুখ ফিরিয়ে নিল, নাক ফুলিয়ে বসে রইল। জায়ন ওর ওই অভিমানে মাখা মুখের দিকে একবার তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলল—

__” শুনেছি তো জান, তুই আসতে চেয়েছিলি এই বাসায়, তাই নিয়ে এলাম তো। এর জন্য তো তোর আমাকে একটা গিফ্ট দেওয়া উচিত, তাই না?”
তিয়াশা কিছু বলল না, কিন্তু হঠাৎ করেই ওর চোখের কোণে পানি গড়িয়ে পড়ল। কণ্ঠটা কেঁপে উঠল, একফাঁকে চাপা ব্যথা যেন ভাঙা গলায় ফুটে উঠল,
__” তুমি এত কষ্ট দাও কেন? তুমি কি আমার কষ্টটা বুঝতে পারো না?”
জায়ন থমকে গেল। চোখ বড় হয়ে গেল তার, বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে কেমন যেন ভারি হয়ে উঠল। সেই কোমল “তুমি” ডাক শুনেই যেন সমস্ত দম্ভ গলে জল হয়ে গেল বুকের ভেতরে। সেদিনের মতো আবারো বুকের ভেতর টর্নেডো ঝড় শুরু হল, আর নিজেই বুঝতে পারল এই মেয়েটার কান্না তাকে কেমন অসহায় করে তোলে। এদিকে আবার ওর ওই তুমি ডাক সে পরে গেছে দোটানায়,জায়ন একটু থেমে গলা সোজা করে বলল–
__” বুঝি তো বেইব, কিন্তু তুই কেন বুঝতে পারছিস না ?আমি নিজে ঠিক থাকতে পারছিনা তোকে কি কথা দেব বল কিন্তু এই আমি তোকে যেমন অসুস্থ থেকে সুস্থ করেছি, তেমন আমিই তো তোকে সুস্থ থেকে অসুস্থ করার দায়িত্ব টা রাখি কিটি ক্যাট।”

তিয়াশার তখন চোখ মুখ সব গরম হয়ে উঠেছে। কী করবে এই মানুষটার সব কথা ঘুরে ফিরে যেন একটাই জায়গায় গিয়ে ঠেকে । একবারের জন্য ইচ্ছা করছে ওর সব চুল ছিঁড়ে ফেলে দিক, কিন্তু… বর তো, টাক হয়ে গেলে দেখতে ভালো লাগবে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তি নিয়েই বলল,
__” আমি কিন্তু তোমার জ্বালায় দেশ ছেড়ে চলে যাব বলে দিলাম।”
জায়ন এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, হালকা ভঙ্গিতে নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলতে খুলতে সোজা সাপটা উত্তর দিল–

__” হুমম, আমার সঙ্গেই যাবি।”
তিয়াশার যেন গা হাত পা সব কেঁপে উঠল।এই লোক আবার প্যান্টের বেল্ট কেন খোলে? কি করবে আবার?জায়ন এর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল একটু রাগের সহিত বলল ,
__” আমার মাথায় আসলে গজব পড়েছিল, যে আমি তোমাকে আমার শখের পুরুষ বানিয়েছিলাম ।”
জায়ন মুচকি হেসে উঠলো, বেল্টটা খুলে বিছানায় তিয়াশার পাশে রেখে দিল । তিয়াশা থর থর করে কাপছে এই বেল্ট দিয়ে আবার মারবে না তো , কিন্তু জায়ন একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলল —
__” এই কথার জবাব এখনই পাবি, কারণ ইউ আর মাই কোর, এন্ড আই নিড অ্যা হার্ড কোর রাইট নাউ, বেইব।”
এই বলেই ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল, আর তিয়াশার যেন সাড়া শরীর আঁতকে উঠল। তবুও অনেক সাহস নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল–

__” একদম না… একদম না, প্লীজ—”
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় টক টক শব্দ। কেউ নক করছে। তিয়াশার মনে হলো, যেন বাঁচার জন্য কেউ স্বর্গের দরজা খুলে দিল। অন্যদিকে জায়ন চোখ বন্ধ করে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
__” ছ্যা এই যে শুরু হলো বা**… আমার রোমান্সের মধ্যে চন্দ্রবিন্দু।এর জন্যে এই বাসায় আসতে চাইছলাম না ।”
কিন্তু তবুও মুখের কোণে এক মুচকি হাসি রেখে বলে উঠল,
__” চিন্তা করিস না বউ, আমি তো শুধু এখন ড্রেসটা চেঞ্জ করতে যাচ্ছিলাম ,অন্য কিছু না। আমি কি এতটাই নিষ্ঠুর বল এখন কিছু করছিনা তবে রাতে কিন্তু রেডি থাকিস ।”
এই বলে পা বাড়িয়ে দিল দরজার দিকে। আর এদিকে
তিয়াশা রাগে নিজের বোরখার কাপর মুচড়ে ধরেছে।
এদিকে জায়ন দরজা খুলতেই দেখা গেল আয়েশা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন খাবারের প্লেট হাতে। তিনি স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন,

__” তুই যা বাবা, নিচে গিয়ে খেয়ে আয়।”
জায়ন তার ফুপুর কথায় হালকা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
__” না ফুপু খাবারটা তুমি দিয়ে যাও। আমি একটু পরে নিচে গিয়ে খেয়ে আসবো।”
আয়েশা বেগম একটু জোর দিয়েই বললেন,
__” আরে না রে বাবা, তুই যা, সবাই অপেক্ষা করছে ।”
জায়ন এবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কোমরে হাত দিয়ে বলল —
__” প্লীজ ফুপু, তোমরা খেয়ে নাও। আমি একটু পরে আসছি।”
আয়েশা বেগম আর কোন কথা বাড়ালো না, বলেই খাবারের ট্রে জায়ন এর হাতে দিয়ে চলে যেতে যেতে মুখে ফিসফিস করে বললেন,

__” আমাদের জামাই গুলারে আমার এই বাপের কাছে পাঠানো দরকার ছিল ক্লাস করতে।”
ট্রের ভেতরে খাবারের প্লেটে ইলিশ পাতুরি, মাটন কোমরা আর ঘ্রাণে ভরপুর সাদা পোলাও।জায়ন খাবারের প্লেটটা বেডসাইড টেবিলে রেখে, হ্যান্ডওয়াশ করে এসে তিয়াশার সামনে বসল। তারপর এক এক করে নিজের হাতে খাবার তুলে দিল ওর মুখে।

তিয়াশা তাকিয়ে রইল অবাক দৃষ্টিতে। এই মানুষটাই কখনও নির্দয় ভলোবাসা দেয় , আবার কখনও স্নেহশীল ভলোবাসা, কখনও উন্মাদ ভালোবাসা, কখনও প্রশ্রয়দাতা। সে মানুষটা যে কতভাবে ভালোবাসতে জানে ,তাও বুঝতে পারা যায় না সবসময়। কিন্তু তিয়াশা অনেক আগেই বুঝে গেছিল পৃথিবীর সব দোষ-ত্রুটি নিয়েও এই মানুষটা একান্তই তার। আর সে নিজেও…মনপ্রাণ দিয়ে, সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে এই মানুষটাকেই ভালোবাসে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে ধীরে ধীরে। তিয়াশা দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে চোখে ক্লান্তির ঘুম মেখেই কেমন যেন নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ঘুম ভাঙেনি এখনো। জায়ন যখন দুপুরে নীচে সবাইকে সঙ্গ দিয়ে খেয়ে উঠে তিয়াশার কাছে এসেছিল তখন দরজা খুলে দেখে, তার ছোট্ট বউটা একটু কুঁকড়ে কমফোর্টার টা কোন মতে গায় দিয়ে নিঃশব্দ ঘুমে বিভোর।

চুলগুলো এলোমেলো, ঠোঁটে একটুকরো প্রশান্তি।সে কিছু না বলে ঘরের জানালার সব কার্টেইন টেনে দিয়ে, হালকা অন্ধকার তৈরি করল ঘরের ভেতরটা। এয়ার কন্ডিশনারের পাওয়ার একটু কমিয়ে, ধীরে ধীরে আবারও তিয়াশার গায়ে কমফোর্টারটা ভালোভাবে জড়িয়ে দিল ।মাথায় হাত বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন এই মেয়েটার নিঃশ্বাসের ছন্দেই তার নিজের সমস্ত ক্লান্তি মুছে যায়। বিকালের আলো তখন একটু একটু করে বাসা বাঁধছে চৌধুরী বাড়ির উঠোনে। জায়ন নিচে নামতেই চোখ গেল ড্রয়িংরুমে বসে থাকা তার মা মেহজাবীন বেগমের কোলে থাকা ছোট্ট রেজোয়ান-এর দিকে।একটা ম্লান কিন্তু অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল জায়নের ঠোঁটে।
চুপিচুপি এগিয়ে গিয়ে মায়ের কোলে থাকা রেজোয়ানকে কোলে তুলে নিয়ে বলল—

__”এই যে আমার লিটল বয় , সরি .. তোমাকে কোলে নেয়ারও চান্স পাইনি।”
এই বলে আদর করতে লাগল রেজোয়ানকে ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুমু আর ছোট ছোট কথায় ভরিয়ে দিচ্ছিল সেই শিশু হৃদয়টা।
এদিকে আকাশ একটু পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল ইউভি আর নাজিমকে,
__”দেখলা ভাইয়ারা? ভাইয়া বলছে চান্স পাচ্ছে না।আরে বউকে কোল থেকে নামালে তো চান্স পাবে , এদিকে আবার রেজোয়ানকে কোলে নেবার আবার ‘চান্স’ খোঁজে?”
তার কথায় ইউভি আর নাজিম ঠোঁট চেপে হাসল,একটুকরো পরিবারের উষ্ণ রসিকতা যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।
রেজোয়ান তখন জায়নের চশমার দিকেই হাত বাড়িয়ে টানাটানি করছে। জায়ন হেসে উঠে ওকে বুকের মধ্যে একটু চেপে ধরে সবার দিকে তাকিয়ে রুহেঁনা বেগম কে বলল—

__”মেজো মা রোদ এখনো ঘুমাচ্ছে। তোমরা কেউ ওকে ডাকবে না। যতক্ষণ না নিজে ওঠে, আমি একটু বেরুচ্ছি।”
রুহেনা বেগম সেই মুহূর্তে তার এই ছেলের দায়িত্বশীল মুখ দেখে হালকা মায়াভরা হাসি দিয়ে বললেন—
__”ঠিক আছে তুই যা বাবা, আমরা কেউ ডাকব না।
এই সময় পাশে দাঁড়ানো আয়েশা বেগম হালকা কোমল স্বরে বলে উঠলেন,
__”হ্যাঁ রে বাবা, বৃষ্টি তো অনেকদিন পর এসেছে। তাই একটু পরে বাচ্চারা সবাই আমাদের বাসায় যাবে, রাতে ওখানেই থাকবে। তুইও চলে আসিস।”
কিন্তু জায়নের উত্তর এল নির্দ্বিধায়, একদম স্পষ্ট গলায়,

__”না ফুফু, আজ হবে না। আমরা পরে যাব।”
বলেই সে চোখ ফেরাল ইউভি, আকাশ আর নাজিমের দিকে—
__”তোরা কেউ বেরোবি না?”
ইউভি মাথা নেড়ে বলল,
__”না ভাইয়া, আমরা ফুফুর বাসায় যাচ্ছি।”
জায়ন আর কোনো কথা না বাড়িয়ে শুধু হালকা মাথা নেড়ে, একবার নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে, তারপর কোলে রেজোয়ানকে ফিরিয়ে দিয়ে জেমসকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
পিছনে থেকে সকলে একসাথে চেয়ে রইল সেই ছেলেটার দিকে, যে বাইরে থেকে যতই বেপরোয়া হোক, ভিতরটা অদ্ভুতভাবে কোমল, গভীর এবং… ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
আকাশটা ধীরে ধীরে বেগুনি আর কমলার মাঝামাঝি রঙে মিশে যাচ্ছে। রোদের শেষ রেখাগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে দূরের বহুতলের জানালা একটা হালকা দীপ্তি যেন ঝুলে আছে পুরো শহরের গায়ে। পাখিরা এক এক করে ফিরছে বাসায়, মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে তাদের ছায়া।

রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে জ্বলে উঠছে, আলো যেন নিঃশব্দে জানান দিচ্ছে দিন ফুরোল, এখন সন্ধ্যা। চায়ের দোকানে জমেছে ভিড়, ধোঁয়ায় ভরে উঠছে চারপাশ। কেউ অফিস থেকে ফিরছে ক্লান্ত মুখে, কেউ আবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে পরিচিত কোনও অলিগলি ধরে।দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর।এই শহরের সন্ধ্যা কখনও কোলাহলের, কখনও নির্জন প্রেমের কিন্তু সবসময়ই একটু থেমে যাওয়ার, একটু মন থেকে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার সময়।

” তা দোস্ত তোর কি আমাদের পিচ্চি ভাবির উপর একটুও দয়া মায়া হইলো না , এক তো এই বুড়া বয়সে
বিয়ে সারছোস। তার উপর আবার তোর হাটুর বয়সের
পিচ্ছি। হায় আল্লাহ এরম জোম দূতের কপালে আমাগো ফুট ফুটে ভাবি টারে না দিলেই পারতা। মাইয়া টারে অসুস্থ করে ছাড়ল ।”
তাদের চির চেনা চায়ের দোকানের সামনে আড্ডা দিচ্ছে চার বন্ধু এখন জেমস ও তাদের সঙ্গেই থাকে।
হঠাৎ করেই সাগরের মুখ থেকে বেরিয়ে এল তার নিজের বিপদ ডেকে আনার ঝড় ।
সাগরের কথার ধাক্কায় চারপাশ হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে যায়।

জায়ন থম মেরে যায়। চা-এর কাপটা আর ঠোঁটে ওঠে না। তার চোখ ঘোলা হয়ে ওঠে রাগে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, কপালের শিরাগুলো খেলা করতে থাকে যেন মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটবে।নাজিম এর উপর ও জায়ন এর মাথা গরম হয়ে উঠলো কারন এর সূত্রধার যে নাজিম ভালো করেই বুঝেছে।
সাগর নিজেও কেঁপে উঠলো জায়ন এর এই মুহূর্তে এই রূপ দেখে। সে তো নিজেও চায় মুখটা বন্ধ রাখতে কিন্তু বা** মুখ বন্ধ থাকে না। এদিকে আহান মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে । এদিকে জেমস পলাশের কানে
ফিস ফিস করে বলল —

” পালস ব্রো সাগর ব্রো ইস গণ ।”
এদিকে পলাশ দাঁতে দাঁত চেপে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো —
” ভাই তুমি আমার নাম ডার জানেযা দিয়েই ছাড়বা, ওই ডা পালস না ভাই । পলাশ ভাই পলাশ , কিন্তু তুমি ঠিক বলছো ওই বেডা শেষ ।”
জেমস একটু কান চুলকে বলল —
” ওহ সরি ব্রো পলাশ ভাই পলাশ হিহি।”
এদিকে তো এরা মুচকি হেসেই যাচ্ছে । কিন্তু আরেক জন এর যে হাত পা শুকিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই জায়ন
চিৎকার করে উঠলো —

” বা** তোদের কতবার আমার বউ নিয়ে একটাও কথা
বলবি না । আমার বউ আমি বুঝবো , তোদের কি রে বা**।”
এর মধ্যেই আহান পলাশ বলে উঠলো একই কথা —
” আমরা কিন্তু কিছু বলি নাই। ”
সাগর কাপা কাপা গলায় বলে উঠল —
” মামা আমিও কইতে চাই না , কিন্তু এই শা*য়ার
মুখ যেইহানে খোলার দরকার ওই হানে তো শান্তির মারে ডাইকা লয় । আর যেই হানে বন্ধ থাকার কথা
ওই হানে গর্ত খুইড়া বইসা থাকে।আর কমু না এই চায়ের দোকানের পটকার কসম।”
জায়ন দাঁতে দাঁত চেপে বলল —

” এই তোকে লাস্ট ওয়ার্ন করে দিলাম সাগর ।”
এর কিছুক্ষন পর আবারো ফিরে গেলো নিজেদের
নরমাল পরিস্থিতিতে, গল্প আড্ডা জমিয়ে জায়ন আর
জেমস বিদায় নিল ওদের থেকে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার
সময় এক ফ্লাওয়ার শপ এর সামনে দাড়িয়ে নিজে পছন্দ করে নানান রঙের গোলাপ। সেই গোলাপ দিয়েই ফ্লাওয়ার শপ এর স্টাফ কে দিয়ে একটা বুকে
বানিয়ে নিল আর সঙ্গে নিল পেস্ট্রি আর কিছু চকোলেট।
তার বাচ্চা বউ যে যে চকোলেট পছন্দ করে সব তুলে নিল। বাকিদের জন্য নিয়ে নিল চকোলেট আর পেস্ট্রি।
সন্ধ্যা রাতে বাসায় ফিরল জায়ন । বাসায় ঢুকেই কিছু চকোলেট আর পেস্ট্রি সুরাইয়া বেগম এর হাতে ধরিয়ে দিল।
তারপর গোলাপের বুকে আর বাকি চকোলেট আর একটা পেস্ট্রি নিয়ে উপরে উঠে গেল। এদিকে নিচে থাকা গিন্নীরা ছেলের কান্ড দেখে বারবার অবাক হয়ে যাচ্ছে ।
রুমের দরজা খুলতেই জায়ন ডাক দিল —

__” বউ ।”
কিন্তু রুমে কেউ নাই, ওয়াশ রুমের দিকে ডাক দিল
__” বউ ।”
কিন্তু না ওয়াশরুম এও কেউ নেই, অস্বস্তি লাগতেই ছুটে গেল তিয়াশার আগের রুমে। দরজা খুলে এক ঝলকে চারদিক খুঁজে দেখল না, ছায়াও নেই।
জায়ন একটু অবাক ই হল কোথায় গেল এই মেয়ে ,তারাতারি নিচে এসে মেহজাবীন বেগম কে জিজ্ঞেস করলেন —
__” মা রোদ কোথায় ? রুমে তো নেই।”
মেহজাবীন বেগম টিভির দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন —

__ ” ও তো সবার সঙ্গে তোর ফুপির বাসায় গেছে।”
এই কথা শুনে জায়নের মুখ মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল। কোমরে হাত দিয়ে গলা চড়িয়ে বলে উঠল,
__”ওর শরীর ভালো না, তাও পাঠালে? কে পাঠালো? আমি বলেছিলাম না ও ঘরে থাকবে?”
ছেলের চিৎকার এ মেহজাবীন বেগম ভ্রু কুঁচকে বলল —

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫০

__” চিৎকার করছো কেন ?ও তো নিজেই যেতে চাইল, নিজেই এসে বলল সেও যাবে , তোর মেজো মা বারন ও করেছিল । ও তো বলল ও ভালো আছে , সবাই থাকবে শুনে ওর ও থাকতে ইচ্ছে করেছে ।আর গেছে তাতে তোর সমস্যা কোথায় ? সবাই যাচ্ছে ওর যেতে ইচ্ছে করে না। ”
জায়নের মুখটা এবার একটু ঝুলে গেল। ঠোঁটে হালকা এক বিদ্রুপের হাসি, চোখে জ্বলজ্বলে রাগ। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বিড়বিড় করল,
__” রোদের বাচ্চা তোর যদি খবর না করি ……”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here