তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৭ (২)

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৭ (২)
নীল মণি

সোডিয়াম এর ম্লান হলুদ আলোতে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক ব্যক্তির মনের গহীনের রমনী,
কিন্তু সেই আলোতেই কেউ যদি ঐ রমনীর দিকে তাকায় , তাহলে সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারবে, তার চোখের গভিরে ঠিক কতটা আগুন জ্বলছে। কিন্তু এই আগুনের একমাত্র কারন সেই ব্যক্তি যে এই রমনী কে তার হৃদয়ের গহীনে রেখেছে । হঠাৎ করেই সেই ব্যাক্তির কন্ঠস্বর ভেসে আসলো প্রাণভরা উচ্ছ্বাসে,

__” পাখী আমি তো ভাবতেই পারছি না তুই আমাকে
সারপ্রাইজ …….
ধসস স স স স স
আআআআআআআআ ও আল্লাহ আ আমার কোমর গেল গো ।.”
যেই বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারল না ছাদে উঠে তার রমনীর দিকে একটু পা বাড়াতেই ইউভি ধারাম করে ছাদের মার্বেল পাথরের উপর পরে গেল , নিচের দিকে তাকাতেই মাথা গরম করে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ,পিছলায়ে পড়ার কারণ স্পষ্ট,কোমর ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে গলা ফাটিয়ে বলল,
__” এই খানে কোন শা**উয়ার পোলা এত কলা গিলছে। আর ওর কোন নানীর জন্য খোশা গুলো দিয়ে শোঙ্গ সাজাইছে ,, ও বাবা গো আমার কোমর ”
তার পর কোমর চেপে ধরে ব্যথায় ছট পট করতে করতে ইউভি তার হৃদয় পাখির দিকে করুন দৃস্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

__” পাখি একটু ধরবি উঠতে পারছি না।”
অনু ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দে যেন হালকা শীতল হাওয়া কাঁপিয়ে গেল।, ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি । ইউভির দিকে তাকিয়ে নাটকীয়
ভঙ্গি করে করুন দৃস্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল ,
__” খুব ব্যাথা করছে ইউভি ভাই ?”
__” হ্যা রে পাখি উঠতে পারছি না ,কে যে এই কলার খোসা খেয়ে এখানে ফেলেছে ,একটু ধর না ।”
ইউভির এই কাতর গলায় বলা বাক্য অনুর মনে মায়া জমালেও সে আজ তার ভালোবাস দেখাবে না , অনু ইউভির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
__” আমি ফেলেছি আপনাকে সারপ্রাইজ দেব বলে ।ডেকে আনলাম সারপ্রাইজ দেব বলে আপনাকে কিন্তু আপনি তো বললেন না কেমন লাগল সারপ্রাইটিজ টা?”
ইউভি কথা টা না বুঝে , ব্যথায় কুকড়ে গোঙাতে গোঙাতে বলে উঠলো,

__ “উহ বাবা , কো কোথায় দিলি সার…….”
কিন্তু না হঠাৎই থেমে গেল সে। চোখ বড় হয়ে গেল, মাথায় যেন বাজ পড়ল সে কি ঠিক শুনল?
অনু কি সত্যি বলল যে সে-ই এই সব করেছে?
সে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন ভুল শুনেছে কিনা যাচাই করছে।
__” বেশি তাকিয়ে লাভ নেই ইউভি ভাইয়া , খোদার কসম বলতাসি আমার মন চাইতাছে আপনারে আরো ও প্যারা দেই।”
ইউভি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে ? এই সারপ্রাইজ এর জন্য সে অত সুন্দর রিসর্ট ছেড়ে চলে আসলো ? হায় আল্লাহ আগে যদি জানত এহে জনমে
আসতো না ।অনু তৎক্ষণাৎ কণ্ঠস্বর কড়া করে গর্জে উঠল,
__”এই ভাবে কি ভাবছেন ? মিথ্যে কথা বলার সময় মনে ছিল না ? কে বলেছিল পাখি আর মিথ্যে বলব না? আপনি জানেন না আমি মিথ্যে পছন্দ করি না?”
ইউভি হতভম্ব,ইউভির গলা শুকিয়ে উঠল , বারবার ঢোক গিলছে কাপা কাপা কন্ঠে বলে উঠলো,

__” আ আমি কি মিথ্যে বলেছি পাখি।”
অনন্যা অমনি চোখ দিয়ে এমন দৃষ্টি দিল , অনুর চোখ তখন দুই টুকরো বজ্রপাতের মতো যেন এক্ষুনি সেই চোখের ঝলকানি দিয়ে ইউভি কে পুড়িয়ে দেবে,
__” আপনিও জানেন আপনি কি মিথ্যে বলেছেন, আমি কিছু বলব না । আর এই যে এখান থেকে যদি কারো সাহায্য নিয়ে উঠতে চান তাহলে আমি বাসায় বলব আমি আপনাকে পছন্দ করি না , সারা রাত এখানেই বসে থাকবেন , কেউ যদি খুজতে আসে তবুও যেন এখানে বসে থাকা হয় ।”
এই কথা বলে অনু ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল, এবং বিন্দুমাত্র পেছনে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
ছাদের ম্লান আলোয় ইউভি অসহায়ের মতএকা বসে রইল, মুখে ব্যথার যন্ত্রণা আর চোখে অপমানের ছায়া
তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

__” ওড়ে রিসর্ট তোর যদি আমারে পছন্দ না হইসিলো , অন্য কোন ভাবে শাস্তি দিতি, রিসর্ট তোর কাছে যাওয়ার জন্য এই দরজাল মাইয়া রে দিয়া এই ভাবি শাস্তি দিলি, হৃদয় তুই আর কোন মাইয়া
পাস নাই আর কোন মাইয়ারে পাখি করতে ।”
ইউভি এই বলতে বলতে একভাবে ব্যথায় কুকড়ে বসে আছে । মনে মনে আবার ভাবল, রিসর্ট যাওয়া তার আজকের দিনে সবচেয়ে বড় ভুল তার থেকেও বড় ভুল রিসর্ট ছেড়ে আসাটা ।

__” জলপরী তুমি আমায় এত সুন্দর করে ডাকলে যে আমি আর নাজিম ভাইয়ার কথা রাখতেই পারলাম
না।।”
আকাশ আর আরোহী লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে, মুখে সেই মিষ্টি হাসি,আকাশ এই কথা গুলো আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,আরোহী টিউশন ফাঁকি দিয়ে আকাশের সঙ্গে এসেছে। আকাশের এই সাজানো, মধুর গলায় বলা কথাগুলো শুনে আরোহীর বুকের ভেতর জমে উঠছে ক্ষোভের পাহাড়। সে জানেএই মানুষটা এখন চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বানিয়ে বলছে। তবু মুখে সে কিছু প্রকাশ করল না, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

__” সোনা আজকে কিন্তু আমি প্রস্তুত , আজকে কিন্তু আমি আর গড়াগড়ি খাবো না।”
আরোহী একটু চোখ নামিয়ে কোমল শুরে আকাশের
সামনে এগিয়ে বলে উঠল ,
__”আমার হৃদয়ের ডাক্তার তুমি যে আমায় এত ভালোবাসো যে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি ।”
আরোহীর কথায় আকাশ ও একটু হেসে ভালোবাসার
কন্ঠে বলে উঠলো,
__” সোনা তুমি যদি বলো …….”
আকাশ ওই লেকের দিকে একবার তাকিয়ে আবার তার বাক্য সম্পূর্ন করে বলল,
__” তাহলে এই লেকেও ঝাঁপ দিব সোনা ।”
ভেতরে ভেতরে ক্ষোভের আগুনে ফুঁসতে থাকা আরোহীর মনে যেন একেকটা কথার শিখা জ্বলছ,
মনে মনে রাগে গজরাতে গজরাতে আওড়ালো,

__” আমি যা করব তাতে তোমার না চাইলেও এই সন্ধ্যারাতে লেকের পানিতে চুবনি খাবা ।”
এই ভেবেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক বাকা হাসি ,
আরোহি নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করে , ওই প্যাকেট সহ দুই হাত দিয়ে আকাশের গলা জড়িয়ে ধরলো,সেই জড়িয়ে ধরা যেন একসঙ্গে ছিল স্নেহের নরমতা আর প্রতিশোধের শীতল ধার,মিষ্টি, প্রায় মায়াবী স্বরে বলল,

__” তুমি আমায় এত ভালোবাসো যে আমিও তোমায় কিছু দিতে চাই।”
হঠাৎ এরকম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরায় আকাশের শরীর কেঁপে উঠল। চোখ বড় হয়ে গেল, নিঃশ্বাস যেন আটকে এল বুকে। সে ভেবেছিল আজ নিজেকে সামলে রাখবে, কিন্তু তার জলপরীর স্পর্শের সামনে আবারও দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর মাঝেই সে টের পেল, শার্টের ভেতর পিঠে কিছু পড়েছে। প্রথমে উপেক্ষা করল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর অদ্ভুত এক কুটকুটানি শুরু হলো। তবুও মুখে হাসি রেখে ভালোবাসার চোখে তাকিয়ে রইল, যদিও আরোহীর ঠোঁটের কোণে তখন স্পষ্ট বাঁকা হাসি। কিন্তু কিছু মুহূর্ত পর কুটকুটানি যেন হাজার সূচ একসাথে বিঁধতে লাগল। এবার আর সহ্য হলো না। আরোহীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হাত ঘুরিয়ে পিঠ চুলকাতে চুলকাতে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল,
__” সো সোনা আমার আমার খুব চুলকাচ্ছে তোমার ঐ বড় নখ দিয়ে একটু চুলকে দেবে ।”
আরোহী সেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি রেখে বলে উঠলো,

__” কিন্তু ডাক্তার সাহেব তোমাকে চুলকাতে গেলে যে
আমার নিজের ও হাত চুলকাবে । বিচুটি পাতার রিয়াকশন টাই এরকম যে একবার ছুলে সারা শরীরে
জ্বালা ঊঠে যায় । ”
আরোহীর কথা শুনে আকাশের পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে কিন্তু সে আপাতত কিছু বলতে পারছে না
চুলকানির তীব্রতায়। তিরিং বিড়িং করে লাফাচ্ছে , কিছু মাথায় ঢুকছে না তার । এই বিচুঁটি পাতা কৈ দিয়ে আসলো । কিন্তু এর মধ্যেই আরোহীর তীব্র গর্জন যেন আকাশের কান ভেদ করে ছিঁড়ে পড়ল ,
__” খুব চুলকানি না তোর রিসর্ট যাওয়ার , ফুর্তি করার ? নে এবার কর এবার সব চুলকানি মিটে যাবে
তোর ।”

আরোহীর মুখের ঝড় একটু থামিয়ে আবার বলে উঠলো,
__” শালা ঢপবাজ নাজিম ভাইয়ার কথা রাখসস?
তুই জানতিস না একবার আমি জানলে তোর কি হাল
করবো , তোর বুকে ডর নাই ? আর বাড়বে চুলকানি
চিন্তা করস না , এবার চুলকানি থামাইতে চাইলে
ওই লেকে চুবানি খা।”
অরোহী এই বলে পা বাড়িয়ে দিল যাওয়ার পথে ।
কিন্তু আকাশের কানে আপাতত কিছু যাচ্ছে না ,
চুলকানির যন্ত্রণা আর লাফঝাঁপের মধ্যে নিজেকে সামলাতে না পেরে শেষমেশ ঝাঁপিয়ে পড়ল পাশের লেকে। শুধু মনে মনে আওরালো,
__” প্রেমের নাম ছলনা ,বউ আমার একদম ভালো না।”

গড়িয়ে পড়ছে চোখের পানি, প্রতিটি ফোঁটা যেন তার অন্তরঙ্গ অনুভূতিকে উন্মুক্ত করছে। ঝালের তীব্রতা, সেই আগুনের মতো, বুক জ্বালাচ্ছে, গলা পোড়াচ্ছে, আর রক্তের প্রতিটি স্নায়ু কেঁপে উঠছে। নিজের ভেতরের প্রতিটি কোণে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি যেন একসাথে ফুঁসছে, বিকট হয়ে উঠছে, কিন্তু তবু চোখের সামনে সেই নীরব প্রহরীর প্রতিটি মুহূর্তকে সে বন্দি রাখছে।
মনে মনে জায়ন গজরাচ্ছে, শ্বাস আটকে, নিজের অন্তরের কণ্ঠে বলছে,

__”এরকম পাষাণ বউ যেন কারো না হয, এইটা আর বউ নয এটা যেন অন্য কোনো অলৌকিক সৃষ্টি যা শুধু আমাকে নয়, পুরো পৃথিবীকেই হতবাক করে দিতে পারে।”
এতক্ষণে সে বহুবার তিয়াশাকে হাত খুলতে বলেছে, বারবার আবেদন করেছে, কিন্তু এই পাষাণ মহিলা তার নির্দেশের প্রতি কোনো সাড়া না দিয়ে, বরং চোখ খুলে দিয়ে এক অদ্ভুত, চঞ্চল, মিষ্টি হাসি সহ তার পানি খাচ্ছে। সেই চোখের ভেতরে লুকানো মায়া, বিরক্তি, খামখেয়ালী সব মিলিয়ে এক রূপের তীব্রতা। জায়ন চোখের এই খেলা দেখে মনে মনে হাহাকার করছে, হৃদয় যেন এক ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠছে, শারীরিক সীমারেখা অতিক্রম করে অনুভূতিগুলো ছুটে যাচ্ছে।

মিষ্টি খাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত যেন তার কাছে একটা ছোট্ট শাস্তি, তীব্র তৃষ্ণা আর যন্ত্রণার মিশ্রণ। জায়নের ভেতরে সেই মায়াবী নারীকে বোঝার চেষ্টা, ধৈর্য ধরে রাখার লড়াই, আর একই সঙ্গে তার অন্তরের উত্তেজনা সব মিলিয়ে এক অচিন্তনীয় উত্তাপ সৃষ্টি করছে। সে দাঁত চেপে, শরীর চঞ্চল, মন ঘোমটানো, চোখে পানি আর অন্তরের জ্বলন্ত অনুভূতির মধ্যে স্থির, কিন্তু প্রতিটি ফোঁটায় অনুভব করছে সেই ক্ষুদ্র কিন্তু প্রবল শাসন, যা তার বউ এই মুহূর্তে জায়নের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।
একসময় মনে হচ্ছে, এই দৃশ্য, এই চোখের খেলা, এই মিষ্টি খাওয়া, সব মিলিয়ে যেন তার ভিতর ধ্বংস করে দিচ্ছে, এক অদ্ভুত আনন্দ ও যন্ত্রণার সমাহারে জায়ন নিজেকে হারাতে বসেছে।
__” তু তুই একবার শুধু হাত খোল , সব সুদে আসলে
উশুল করবো । এই যে যত চোখের পানি ফেলতে বাধ্য
করছিস আজ সারারাত যদি এর দশ গুণ চোখের পানি তোর চোখ থেকে ফেলতে বাধ্য না করি তাহলে
আমায় হুদাই বলে ডাকিস ।”

জায়নের চোখের ভেতরে আগুনের শিখা যেন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। এতক্ষণকার দমিয়ে রাখা রাগ, অস্থিরতা আর তৃষ্ণার তীব্রতা একসাথে মাথা তুলেছে। তার ঠোঁট শক্ত হয়ে আছে, বুক ওঠানামা করছে দ্রুততায়, আর চোখের ভেতর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যা তিয়াশা খুব ভালো করেই চেনে। এই দৃষ্টির মানে হলো, হাত খোলার পর আর রক্ষা নেই।
তিয়াশার বুকের ভেতর হঠাৎ করে একটা অচেনা শিহরণ বয়ে গেল। সে জানে, এই মানুষটা যদি এখন মুক্ত হয়, তাহলে আজ তার নিস্তার নেই। তাই ভয় আর খুনসুটির মিশেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে, হাতে থাকা চকোলেট কামড়ে ধরে, এক ধরনের দুষ্টুমি ভরা সাহস নিয়ে সরাসরি স্বীকার করে দিল,

__”আমি জানি তুমি আমায় শাস্তি দেবে, তাই আরো খুলবো না তোমার হাত।”
জায়ন এবার গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে সেই জ্বালা আর তৃষ্ণা ঢেউয়ের মতো ধাক্কা দিচ্ছে। কণ্ঠে কোমলতা এনে, মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে, প্রায় কাতর চোখে তাকিয়ে বলল,
__”আচ্ছা আচ্ছা কোনো শাস্তি দেবো না । কিন্তু প্লিজ… একটুখানি পানি দিবি বউ খুব কষ্ট হচ্ছে আর পারছি না।”
তিয়াশা সেই কণ্ঠস্বর শুনে একটু থমকালো। তার মনের ভেতর একটা দ্বন্দ্ব একদিকে, বহুক্ষণ ধরে কষ্ট পাচ্ছে তার শখের পুরুষটা, অন্যদিকে, হাত খুলে দিলে কী হবে সেই ভয়। চকোলেট চিবাতে চিবাতে সে বিছানা থেকে ধীরে ধীরে উঠল, গা গোলানো এক ভঙ্গিতে জায়নের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে বলল,
“আগে কসম খাও হাত খুললে তুমি আমায় শাস্তি দেবে না?”
জায়ন এবার যেন হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, চোখ নামিয়ে ফেলল, তারপর ধীর গলায় বলল,
__”আচ্ছা কসম খাচ্ছি কোনো শাস্তি দেবো না কিন্তু প্লিজ, তাড়াতাড়ি হাতটা খোল জান।”
তিয়াশার ভেতরের সতর্কতা এক মুহূর্তের জন্য হার মানল। কাপা কাপা হাতে এগিয়ে এসে সে জায়নের হাত খুলে দিল।

কিন্তু হাত ছাড়ার পর যা ঘটল, তার জন্য তিয়াশা একদম প্রস্তুত ছিল না। মুহূর্তের মধ্যেই জায়ন যেন বাঁধভাঙা নদীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল এক ঝটকায় তাকে কোলের মধ্যে তুলে নিল, শক্তভাবে দুই হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে নিল, আর কোনো কথা না বলে নিজের ঠোঁট তিয়াশার ঠোঁটে বসিয়ে দিল গভীর, দাবিদার, অধিকারী চুম্বনে।
তিয়াশার খাওয়া চকোলেটের মিষ্টি গলে গিয়ে ঠোঁটে লেগে ছিল জায়ন সেই মিষ্টতা, সেই উষ্ণতা, সবটুকুই তৃষ্ণার্তভাবে নিজের ঝালের তীব্রতা কমিয়ে নিতে চাইল । তিয়াশার নিঃশ্বাস কেঁপে উঠল, শরীর ঢলে পড়ল জায়নের বাহুর ভেতরে। আর জায়ন এর মুখের ঝালের প্রভাব তিয়াশার মুখেও ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা বুজতেই তিয়াশা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,

__” তুমি কিন্তু বলেছিলে আমায় শাস্তি দেবে না ।”
কিন্ত জায়ন কোন কথা বলল না , নিজেই তিয়াশাকে ছেড়ে দিয়ে তিয়াশার হাত থেকে চকোলেট টা নিয়ে
পাশের টেবিলে থাকা পানির বোতল নিয়ে ঢক ঢক
করে পানি খেয়ে নিল কিন্তু তবুও যেন নিজেকে সামলাতে পারল না , এবার চকলেট টা কামড় দিলো ।
চোখ থেকে পানি এখনো গড়িয়ে পরছে, বাদামি ঠোট জোড়া ফুলে লাল হয়ে উঠেছে । গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না তবুও বাইরে যেতে যেতে তিয়াশার দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলল ,
__” রে রেডি থাক ।”

এই বলে বেরিয়ে জেতেই তিয়াশার এবার ভয় করছে । এই লোক কে বিশ্বাস করে হাত খোলা মোটেই উচিত হয় নি, ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল ।এদিকে জায়ন এর কারনে তিয়াশার ঠোট লাল হয়ে উঠছে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে আসতে তার নিঃশ্বাস কেঁপে উঠছে, কপালে ঘাম জমে আছে, চোখদুটো লালচে, আর ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত টান। ঘরে ঢুকেই প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করল,
“মা! বাসায় যা যা মিষ্টি আছে… কুইক দাও!”

তার কণ্ঠে এমন এক তীব্রতা, যা শুনে মা ও থমকে গেলেন। চারপাশে থাকা গিন্নীরাও অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। কারণ, সবাই জানে জায়ন কখনোই মিষ্টি খায় না। শরীর ঠিক রাখার জন্য, ডায়েটের জন্য, বছরের পর বছর সে এক টুকরোও মিষ্টি মুখে দেয়নি। অথচ আজ হঠাৎ করে, সেই মানুষটা যেন প্রাণের তাগিদে মিষ্টি চাইছে।
গিন্নীরা ফিসফিস করে কথা বলছে,
__”এ কী হলো ওর? চোখমুখের অবস্থা তো অদ্ভুত কোথা থেকে এল এই ছেলেটা, এমন হাঁপাচ্ছে কেন? কিছু কি হয়েছে?”

কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস কারো নেই, কারণ তারা সবাই জানে জায়ন অযথা প্রশ্ন একদম সহ্য করে না।
মা কোনো কথা না বলে তাড়াহুড়ো করে সন্ধ্যারাতে বানানো পিঠে পুলি এগিয়ে দিলেন। জায়ন সেই প্লেটের দিকে তাকাতেই চোখের ভেতর হঠাৎ একরকম স্বস্তি ফুটে উঠল যেন মরুভূমিতে হঠাৎ জল দেখেছে। মুহূর্তের মধ্যে সে পিঠে-পুলির উপর প্রায় হামলে পড়ল।
প্রথম কামড়ে তার শরীর কেঁপে উঠল, চোখ একটু বুজে এল, যেন প্রতিটি মিষ্টতার সাথে শরীরের জ্বালা ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। একটার পর একটা খেতে খেতে, তার হাতের গতি থামছে না, ঠোঁটে কোনো কথা নেই শুধু খাবারের দিকে এক অদ্ভুত, বেঁচে ওঠার তাড়না।

কিছুক্ষণ পর অবশেষে জায়নের কাঁধ থেকে চাপটা একটু কমল। মুখে একটা গভীর নিঃশ্বাসের স্রোত বয়ে গেল, আর চোখে মুখে ধীরে ধীরে ফিরতে লাগল স্বাভাবিকতা। কিন্তু ঘরে উপস্থিত সবাই টের পেলএমন জায়ন তারা কোনোদিন দেখেনি।
এসবের মাঝেই আয়েশা বেগমের কণ্ঠে হঠাৎ এক ধরনের উৎকণ্ঠা মিশে এল। তিনি ভ্রু কুঁচকে ধীরে ধীরে বললেন,
__”হ্যা রে বাবা, তোরা তো সবাই এক এক করে চলে আসলি, কিন্তু আকাশ তো এলো না। বড় জামাই তো এসে বলল, আকাশ নাকি কি কাজে তার আগেই বেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাসায় তো আসল না, না ফোন ধরছে… চিন্তা হচ্ছে রে।”

জায়নের কপাল ভাঁজ পড়ে গেল। চোখে মুহূর্তের জন্য বিস্ময় ঝলসে উঠল, কিন্তু তার ভেতরের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দ্রুত কাজ করল। মনের মধ্যে মুহূর্তেই ভেসে উঠলো ইউভির হাসিমুখে বেরিয়ে যাওয়া, সন্দেহ যেন পাক খেয়ে গিয়ে বুকের ভেতর শক্ত হয়ে বসে গেল।
চোখে একরাশ কৌশলী স্থিরতা এনে সে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
__”তুমি চিন্তা করো না, ফুফি। আমি দেখছি। কিন্তু তার আগে বলো তো, ইউভি ও কি বাসায় এসে গেছে?”
আয়েশা বেগম উত্তর দিলেন বিন্দুমাত্র দেরি না করে,
“হ্যা, সে তো তোদের আগেই এসে সেই যে উপরে উঠছে, আর নিচে নামেনি। না তো বড় জামাই নেমেছে। বৃষ্টি বলল, তার নাকি ডিসেন্ট্রি হয়েছে।”

এই কথাটি শুনতেই জায়নের চোখে যেন তীক্ষ্ণ বিদ্যুৎ খেলে গেল। মাথায় মুহূর্তেই এক চিত্র গেঁথে গেল বৃষ্টি,আর এই তথাকথিত “ডিসেন্ট্রি”র গল্প। নিচে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা বৃষ্টি ও অনন্যার দিকে হালকা কিন্তু গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল সে যেন চোখ দিয়ে নীরবে হুমকি পাঠাল তারাও সেই দৃষ্টি লক্ষ করে নিচে মাথা নামিয়ে নিল । তারপর দাঁতে দাঁত পিষে সোজা উপরে উঠে গেল।
প্রথমেই ইউভির রুমে ঢুকে চারদিক ঘুরে দেখল ,খালি। এরপর বৃষ্টির রুমে গিয়ে অবাক হয়ে গেল সোফায় নাজিম প্রায় লুটিয়ে পড়েছে, মুখ কুঁচকে আছে, একরাশ অসহায় কষ্টে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
নাজিম তাকে দেখেই কাতর স্বরে বলতে শুরু করল,
“ভাইরে… তোর বো বোন রে তুই রেখে দে আমার লাগবে না ,রিসর্ট গেছি তাই তোর বোন মিথ্যে বলে বাসায় নিয়ে আসল, বলল ছেলের নাকি ডিসেন্টারি হইছে। আমি বাসায় এসে দেখি, আমার ছেলে খেলতেসে। তারে আমি জিজ্ঞেস করায়, সে কিছু না বলে ধোঁকা দিয়ে পায়েশ খাওয়ালো আর সেই পায়েশ খাইয়া এই নিয়ে ৫ বার ওয়াশরুম ঘুরলাম, তোর ওই বদমাইস বোন ছেলের ডিজেন্টারি বলে আমার ডিসেন্টারি বানায় দিল । ভাই একটু হাসপাতাল নিয়ে…”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৭

বাক্যটা শেষ হবার আগেই নাজিম কাতর আর্তনাদ ফেলে আবার সোফা থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে দৌড়ে গেল।
জায়ন দাঁড়িয়ে রইল, কোমরে হাত দিয়ে ঠোঁটের কোণে এক বাকা, বিদ্রূপমাখা হাসি। ভেতরে ভেতরে বিরক্তি যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠছে। রাগে নিজের চুলের গোছা চেপে ধরল, যেন এই মুহূর্তে কারো গলা চেপে ধরতে চায়।
কিন্তু সে থামল না। কী এক অদ্ভুত তাগিদে দোতলার প্রতিটি কোণ একবার ভালো করে ঘুরে দেখল। তারপর করিডোর বেয়ে সোজা ছাদের দিকে এগোল।
ছাদের দরজা ঠেলে বাইরে পা দিতেই তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল……

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here