তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৬

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৬
নীল মণ

এবারের মুহূর্তটা যেন জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা, সবচেয়ে বড় অলৌকিকতার শুরু। চারদিনের অন্ধকারের পরে এই সামান্য আঙুল নড়ে ওঠাই জায়নের কাছে মনে হলো যেন পুরো দুনিয়া নতুন করে জন্ম নিল। বুক ফেটে কান্না আসছিল, কিন্তু সেই কান্নার ভেতরে আজ প্রথমবারের মতো আশার এক অচেনা আলো মিশে গেল,সে উন্মাদের মতো ডাকতে লাগল,

__”ডক্টর, ডক্টর…… ”
কেবিনের ভেতরটা হঠাৎ যেন উল্টে গেল। জায়নের কণ্ঠে ছটফট করা আর্তনাদ শোনে পরিবারের সবাই হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে ঢুকল। সবার চোখে আতঙ্ক, মনে হচ্ছিল আবার কোনো দুঃসংবাদ এলো নাকি। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই তারা দেখল জায়নের চোখ বেয়ে এখনও অশ্রু গড়াচ্ছে, অথচ ঠোঁটে ফুটে উঠেছে অদ্ভুত এক হাসি। সেই হাসিটা অশ্রুর ভেতরে লুকিয়ে থাকা আলো, সেই হাসি যেন শতবর্ষের অন্ধকার ভেদ করে এক নতুন সকাল ঘোষণা করছে।
জায়ন হঠাৎ তার মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গলা ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

__”মা! আমার জান আঙুল নাড়িয়েছে….মা, ।”
মেহজাবীন বেগমের বুক হুহু করে উঠল, চোখ ছলছল করতে লাগল। তাঁর কণ্ঠ আটকে আসছিল ।
তারপর জায়ন ছুটে গেল বাবার কাছে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। চোখ ভরা জল, কিন্তু কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ।
__”বাবা….বাবা, আমার রোদ আঙুল বাড়িয়েছে। ও আমাকে ছেড়ে যাবে না।”
প্রান্তিক সাহেবের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। তিনি ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, বুক চেপে ধরলেন যেন সব কষ্ট এক মুহূর্তে ভুলে যেতে চাইছেন।
এরপর একে একে জায়ন ছুটে গেল তার মেজ চাচু ছোট চাচুর কাছে, মেজো মায়ের কাছে, ছোট মায়ের কাছে, ফুফি প্রত্যেককে জড়িয়ে এক কথাই বলছে বারবার।

ইউভি, বৃষ্টি , নাজিম আকাশ যে যেই সামনে আসছে তাকেই জড়িয়ে ধরছে জায়ন, একই কথা বলছে পাগলের মতো, কিন্তু সেই পাগলামিতে এখন কান্না আর একটু জীবন ফিরে পাওয়ার ভরসা , বিস্ময় আর আশার আলো।
ডাক্তার আর নার্সরা তাড়াহুড়ো করে কেবিনে ঢুকলেন, চারপাশে যন্ত্রপাতির শব্দ মিলিয়ে গেল পরিবারের কান্নার সাথে। সবার বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটাই বিশ্বাস জেগে উঠছে এইবার অন্ধকারের শেষ।
মেহজাবীন বেগম রুহেনা বেগম কেঁপে কেঁপে কোরআনের আয়াত পড়তে লাগলেন, ঠোঁট থেমে থাকল না এক মুহূর্তের জন্যও । প্রণয় সাহেব,ইউভি
বৃষ্টি একে অপরকে জরিয়ে যেন একটু আলো
দেখার আশা পেল বাবা ছেলে মেয়ের মধ্যে চলছে
এক খুশির কান্না।

ডাক্তার, সাথে দুজন নার্স,সবাইকে একটু সরে দাঁড়াতে বললেন তিনি। জায়নের চোখ তখনও ভিজে, কিন্তু বুকের ভেতরটা কাঁপছে। নার্সরা দ্রুত মনিটর চেক করল, ডাক্তার তিয়াশার হাত ধরে নাড়াচাড়া করলেন, চোখের পাতা পরীক্ষা করলেন।
কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগে পরীক্ষা করে হঠাৎ তাঁর ঠোঁটে ফুটে উঠল হালকা হাসি। সেই হাসি যেন সবার বুকের ভেতর জমে থাকা পাহাড়সম ভয় গলিয়ে দিল। তিনি ধীরে ধীরে মাথা তুলে জায়নের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,

__”আপনার ওয়াইফ সাড়া দিচ্ছে, খুব ভালো সাইন ধীরে ধীরে স্নায়ু কাজ করছে। ইনশাআল্লাহ আপনার মত হাসবেন্ড থাকতে আপনার ওয়াইফ সাড়া না দিয়ে
কোথায় যাবে । ”
এই কথাটা শুনতেই জায়নের বুক হুহু করে উঠল। সে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাক্তারের পা জড়িয়ে ধরল, মুখভরা অশ্রুতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল,
__” থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর, থ্যাঙ্ক ইউ…….”
ডাক্তার প্রথমে চমকে উঠলেন,চারদিন ধরে এই মানুষটাকে তিনি দেখেছেন অস্থির, অশ্রুভেজা, দোয়া আর কান্নায় কাতর। প্রতিদিনই তাঁর যন্ত্রণায় তিনি নিজেও স্তব্ধ হয়ে যেতেন , হতবাক হয়ে জায়ন কে ওঠাতে ওঠাতে বললেন ,

__” কি করছেন কি করছেন ? প্লীজ মিস্টার জায়ন ।”
ডাক্তার তার কাঁধে হাত চাপড়ে বলে উঠলো,
__'” আমি আমার ডিউটি করেছি , কিন্তু আমাদের সবার ওপরে একজন আছে , যার কাছে আপনি দিন রাত দোয়া করেছেন সঙ্গে আপনার পরিবারের দোয়া
আল্লাহ কি করে না শুনে পারতেন বলুন।”
ডাক্তারের কণ্ঠে দৃঢ়তা, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত মমতা। তাঁর এই কথাগুলো যেন কেবিনের প্রতিটি মানুষের অন্তরে গেঁথে গেল। মেহজাবীন বেগম অঝোরে কান্না করতে করতে কোরআনের আয়াত পড়তে লাগলেন, সবার মুখে নিঃশব্দে ভেসে এল “আলহামদুলিল্লাহ”। আর জায়ন দাঁড়িয়ে শুধু হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল,
__”আল্লাহ্ ও আল্লাহ্ তুমি আমার জানটাকে ফিরিয়ে দিলে।”
কেবিনের বাতাসে কান্না, দোয়া আর আশার মিশ্রণ ছড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল আজকের সকাল টা আর পাঁচটা সকালের মতো নয় এ সকাল হয়তো নতুন করে শুরু হবে ভালোবাসার, আশার, জীবনের গল্প
সবার চোখে পানি, ঠোঁটে প্রার্থনা। কেবিনের বাতাস ভারী হয়ে আছে অশ্রু আর আনন্দের মিশ্রণে। এই দৃশ্যটা যেন কোনো সাধারণ হাসপাতালের কেবিন নয় বরং এক অলৌকিক পুনর্জন্মের দরজা।

কেটে গেল আরও দুটো দিন।এই দুই দিন জায়ন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বেঁচে আছে কারন তিয়াশা এখনো চোখ মেলেনি । যদি পারত তবে তিয়াশাকে বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখত, কিন্তু নিষ্ঠুর মনিটর, যন্ত্রপাতি, ডাক্তার-নার্সদের নিয়ম সব যেন তাকে দেয়াল তুলে আটকে রেখেছে।
তবু সে বসে থাকে সারাদিন, কখনো ভেজা তোয়ালে দিয়ে তিয়াশার হাত মুছিয়ে দেয়, কখনো কপাল মুছে দেয়, কখনো কপালে আলতো চুমু খায়। তার হাত তিয়াশার হাত থেকে আলাদা হয় না এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়, হাত ছেড়ে দিলেই যেন আবার অন্ধকার গ্রাস করবে।
আজ কেবিনের বাইরে আছে শুধু ইউভি, আকাশ, নাজিম আর সাগর। বাকিরা সবাই খুব ক্লান্ত খাওয়া দাওয়া প্রায় নেই বললেই চলে তাই ইউভি আর আকাশ রোজ ই তাদের দায়িত্ব নিয়ে বাসায় দিয়ে আসত আর আজ তাদের আসতেই দেয় নি।বৃষ্টিও আসেনি তার ছোট্ট বাচ্চাটা মায়ের কোলে ছাড়া থাকতে পারে না, কেবিন তাই তুলনামূলক শান্ত।

দুপুরে জায়ন তিয়াশার পাশে ইউভিকে বসিয়ে একটু বাইরে গেল। কেবিনের সঙ্কীর্ণ বাতাসে বুক দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার, তাই সিগারেট ধরিয়ে হাসপাতালের টেরেসে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল, ধোঁয়ার সাথে যেন বুকের দুঃখও মিশে যাচ্ছিল। একটার পর একটা টান নিতে নিতে চোখ বেয়ে জল নেমে এল, যেন ভেতরের ভাঙা মানুষটাকে আর সামলাতে পারছে না। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, ভাবতে লাগল তিয়াশার কথা, তার হাসি, তার ডাকে “বর” বলে ডাকাটা সবকিছুই বুকের ভেতরে কাঁটার মতো বিঁধছিল,
__”আল্লাহ, আরেকটু শক্তি দাও আর পারছি না ।”

অবশেষে নিচে নেমে কেবিনে ঢুকতেই চমকে উঠল। সেই মুহূর্তে তার বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে গেল,সামনে যে দৃশ্যটা দেখল, তা দেখে বুক ধকধক করে উঠল তিয়াশা বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে, চোখদুটো খোলা, সেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চারপাশে ডাক্তার, নার্স, ইউভি, আকাশ, নাজিম, সাগর সবার মুখে অবিশ্বাস আর আবেগে ভরা হাসি।
এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে গেল জায়ন, যেন পাগল হয়ে গেছে। সে হুমড়ি খেয়ে তিয়াশাকে জড়িয়ে ধরল, বুক ফেটে কান্না করতে করতে কাঁপা গলায় বলে উঠল,
__” জান, আমার জান ………… আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম তোকে এই ভাবে দেখে, সরি সোনা সরি, আর কখনো রাগ দেখাবো না।”

কিন্তু তিয়াশার ঠোঁট কাঁপল, কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো এমন এক প্রশ্ন যা মুহূর্তেই জায়নের পৃথিবী থামিয়ে দিল,
__” আপনি কে, আমাকে এই ভাবে কেন জড়িয়ে আছেন?”
এই কথাটা শোনা মাত্রই যেন জায়নের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কেবিনে সবাই থমকে গেল, যেন হাওয়া আটকে গেছে। অথচ একটু আগেই তো তিয়াশা ইউভি, আকাশ আর ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল,ডাক্তার নিজেই তিয়াশাকে তার স্বামীর কথা বলেছিল পাগলামির তখন ই তো তিয়াশার চোখ বেয়ে পানি গরিয়ে পড়ছিল । তাহলে কীভাবে সে তার স্বামীকে চিনতে পারছে না?
হঠাৎ জায়ন তিয়াশার গাল ধরে পাগলের মতো কাঁপা কণ্ঠে বলতে লাগল,

__” জান আমি তোর বর, তোর বাঘের বাচ্চা দেখ, আমায় কেন চিনতে পারছিস না? তাকা আমার দিকে, তাকা।”
কিন্তু তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে নিল। জায়নের বুক যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে, তবুও সে ডাক্তারর দিকে ছুটে গেল, কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে ডাক্তারকে ধরল, চোখে একরাশ করুণার ভেজা আলো নিয়ে অনুনয় করল,
__” ডক্টর, আমার বউ আমাকে চিনতে পারছে না কেন? একটু দেখেন না, ও আমায় চিনতে পারছে না।”
হঠাৎই পেছন থেকে ভেসে এলো তিয়াশার কণ্ঠ ধীর, কাঁপা কিন্তু খুনসুটি ভরা স্বর,
__” ভা ভাইয়া, আমার আমার হ্যান্ডসাম সুন্দর বরটা কোথায়? এই পাগল বাজে দেখতে লোকটা আমার বর হতেই পারে না।”

এক নিমিষেই সবাই বুঝে গেল তিয়াশা মজা করছে, ইউভি, আকাশ, নাজিম, সাগর সবাই একসাথে হাসি আর আটকাতে পারল না, চোখ ভিজে গেল আনন্দে। কিন্তু জায়ন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন মাটি থেকে পা সরছে না। ভেজা চোখের কোণ থেকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি। আরেকটু হলে সে সত্যিই হার্ট অ্যাটাক খেয়ে ফেলত।
ডাক্তার তিয়াশার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, শান্ত কণ্ঠে বললেন,
__” মিসেস আবরার, ইউ আর সো লাকি টু হ্যাভ আ হাজবেন্ড লাইক হিম, ডোন’t গিভ হিম এনাদার প্যানিক অ্যাটাক।”

তিয়াশা এবার জায়নের দিকে তাকাল। তার চোখ ভিজে গেছে, বুক কেঁপে উঠছে। সামনে যে মানুষটা দাড়িয়ে আছে, সে তার প্রণয়ের পুরুষ , কিন্তু কী অবস্থা করেছে নিজের, মুখ শুকনো, ঠোঁট ফেটে চৌচির, চোখের নিচে কালি, লালচে চোখ অশ্রুতে ভিজে আছে, চুল এলোমেলো, শরীরে দুর্বলতার ছাপএই দৃশ্য দেখে তার বুক হুহু করে উঠল। আর যখন ডাক্তার বললেন যে এই মানুষটা প্যানিক অ্যাটাক পর্যন্ত পেয়েছে, তখন তিয়াশার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারনি সেই সময় । কান্নাভেজা কণ্ঠে উত্তর দিল,
__” ডাক্তার বাবু, আমি লাকি না, আমি অনেক বেশি ভাগ্যবতী যে ওনার মতো মানুষকে আমি আমার জীবনে পেয়েছি।”

এই উত্তর শোনার সাথে সাথেই জায়ন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। আবার ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তিয়াশাকে। দুর্বল শরীর হলেও তিয়াশাও তাকে জড়িয়ে ধরল, বুকের ভেতর সব ভালোবাসা ঢেলে দিল।
ডাক্তার মুচকি হেসে জায়নের দিকে তাকিয়ে বললেন,
__” মিস্টার আবরার, প্লিজ হ্যাভ সাম পেশেন্স, মিসেস আবরার ইস টু মাচ উইক।”
কিন্তু জায়নের কানে কিছুই ঢুকল না। চারপাশে ইউভি, আকাশ, নাজিম, সাগরের চোখে খুশির অশ্রু ঝলমল করছে, এমনকি নার্সের চোখও ভিজে উঠেছে। ডাক্তার নিজেও আবেগ সামলাতে না পেরে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন, ইউভির দিকে তাকিয়ে বললেন,

__” উই সেভ টু লাইভস, ইওর ফ্যামিলিস প্রে সেভ টু লাইভস।”
ইউভি এগিয়ে এসে ডাক্তারের হাত শক্ত করে ধরে কাঁপা গলায় বলল,
__” থ্যাংক্স টু ইউ ডক্টর। আমরা আমাদের বনু আর ভাইয়াকে সুস্থভাবে ফিরে পেয়েছি।”
ডাক্তার মৃদু হেসে এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
__” আকাশ, ইউর সিস্টার ইস ফাইন নাউ, স্টার্ট ইউর ক্লাস ফ্রম টুমোরো।”
আকাশ এতদিন ক্লাস করতে পারেনি। সে চোখ মুছে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল,
__” ইয়েস স্যার, সিওর আই উইল।”
ডাক্তার হাসি দিয়ে চলে গেলেন।
এরপর সাগর হাসিমুখে আকাশ, নাজিম আর ইউভিকে বলল,
__” ভাই ওগো, একটু একা ছাইড়া দে, আমরা বাইরে যাই চল।”
আকাশ মাথা নেড়ে বলল,

__” হ্যা, সাগর ভাই ঠিক বলেছে, ইউভি ভাই, নাজিম ভাই, চলো বরং কফি খেয়ে আসি, মাথা ধরেছে খুব।”
তারা আর কিছু না বলে বাইরে চলে গেল। বাসাতেও খবর পৌঁছে গেছে সবাই যেন বুকের ভেতর নতুন প্রাণ ফিরে পেল।
কেবিনে তখন শুধু জায়ন আর তিয়াশা। জায়ন ফুঁফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিয়াশাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
__” এরকম বলার থেকে আমাকে মেরে দে জান, তুই আমাকে ভুলে যাওয়ার থেকে আমার মৃত্যুবরণ আমার কাছে বেশি সুখের জান।”
এই কথায় মনে হল কেউ হঠাৎ করে ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিল।এমন কথা তার প্রিয় মানুষটির মুখ থেকে বেরোনো,এমন কথা তার প্রিয় স্বামীর ঠোঁট ছেড়ে শোনা,এটা যেন তার কাছে মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর, মৃত্যুর থেকেও নিষ্ঠুর।এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, যদি পৃথিবীটা থেমে যেত তবে হয়তো এই শোকটা সে সহ্য করতে পারত।সে ধীরে ধীরে জায়নের গলা ছেড়ে দিল।তার ভেজা চোখে এক অদ্ভুত আগুন, ভেতরে ভেতরে ভালোবাসা আর কষ্টের যুদ্ধ।
সে কাঁপা হাতে নিজের নরম আঙুলটা জায়নের শুকনো ঠোঁটের ওপর রেখে দিল।
তারপর কাঁপা কণ্ঠে, কিন্তু দৃঢ়তায় ভরা স্বরে বলে উঠল,

__”তুমি কি জানো, তোমার এই কথা, আমার মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে টেনে নিচ্ছে তুমি যদি এমন কোনোদিন ভাবো যে আমি তোমাকে ভুলে যাবো, বা তোমার থেকে দূরে চলে যাবো, তাহলে সেটা আমার কাছে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর হবে আমার দমই বন্ধ হয়ে আসছে এই কথাটা শুনে ,শোনো, আজকের পর যদি তুমি আর একবারও মুখে এমন কথা আনো মৃত্যুর কথা ,আমি তোমাকে চিনব না বা ভুলে যাবো, আমি সত্যিই তোমাকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে আসবো তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না, তুমি কি এটা বোঝো না? তুমি কি সত্যিই জানো না আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই নই? বলো জানো না তুমি?”
এই বলে সে যেন পুরো দুনিয়ার সব ভয়, সব শঙ্কা, সব কষ্ট ভুলে গিয়ে আবারো জায়নকে জড়িয়ে ধরল।
তার দুর্বল শরীর, অসুস্থ দেহ, তবু বুকের ভেতরকার সেই ভালবাসা এত প্রবল যে, মনে হলো সে যেন সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

জায়ন তার বুক ফেটে যাওয়া কান্নার মাঝেও, ভেজা চোখের দৃষ্টি নিয়ে তিয়াশাকে নিজের আরো কাছে টেনে নিল।তার কণ্ঠ কেঁপে যাচ্ছিল, শ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল, চোখে জল থামছিল না। জায়ন শ্বাস নিতে নিতে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে ,কণ্ঠ কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল,
__”জান, আমি প্রমিজ করে বলছি, কখনো তোকে ছাড়ব না এক সেকেন্ডের জন্যও না তুই আমার নিশ্বাস, তুই আমার জীবন, তুই আমার পৃথিবীর প্রতিটা আলো তোকে ছাড়া আমার সব অন্ধকার সরি সোনা, সরি আর কোনোদিন তোকে কষ্ট পেতে দেবো না, আর কোনোদিন তোর চোখে পানি আনব না আই লাভ ইউ জান, আই লাভ ইউ আমি তোকে ছাড়া সত্যিই নেই।”
তিয়াশা চোখ বন্ধ করে জায়নের শক্ত বুকের ভেতর মুখ গুঁজে দিল।তার ঠোঁট কেঁপে উঠল, শ্বাস কেঁপে উঠল, অশ্রু গড়িয়ে এল চোখ থেকে।ধীরে ধীরে সে বলল,

____”আই লাভ ইউ টু বর ,আই লাভ ইউ সো মাচ, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দোয়া, সবচেয়ে বড় অলৌকিকতা, কিন্তু তোমার যে অবস্থা আমি দেখছি, তা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না আমার সুন্দর বরকে আমি এভাবে দেখতে পারি না।
জায়ন তখন তিয়াশার কপালে, চোখে, গালে পাগলের মতো একের পর এক চুম্বন দিতে লাগল।
তার ঠোঁট কাঁপছিল, কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছিল কান্নার ভেতরে, তবু সে থামল না।চোখ ভরা জল নিয়ে, বুকের ভেতরের সমস্ত আবেগ উজাড় করে দিয়ে সে বলল,

__”তুই আমার চেহারার কথা বলছিস জান?
তোকে যদি আমার বুকটা চিরে দেখতে পারতাম,
তাহলে বুঝতে পারতিস আমার হৃদয়ের ভেতরে এখন কি অবস্থা।আমার বুকটা ফেটে গিয়ে যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।আমার ভেতরে পুরো পৃথিবী এলো মেলো হয়ে আছে।কোনো কিছু ঠিক নেই সোনা কোন কিছু ঠিক নেই ।সবকিছু ভেঙে গেছে, সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে।
একটা কথা মনে রাখবি,
তুই ঠিক থাকলে আমি ঠিক।
তুই যদি হাসিস, আমি হাসব।
তুই যদি বাঁচিস, আমি বাঁচব।
কিন্তু তুই যদি ঠিক না থাকিস,
তুই যদি আমার থেকে দূরে চলে যাওয়ায় চেষ্টা করিস
তাহলে আমি শেষ হয়ে যাব,পুরোপুরি শেষ হয়ে যাব।”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৫

এই কথাগুলোতে যেন কেবিনের বাতাস ভারী হয়ে গেল।ভালোবাসা, কান্না আর কৃতজ্ঞতার এক অদ্ভুত মিশ্রণে চারপাশটা থেমে গেল।শুধু জায়ন আর তিয়াশা
দুজন মানুষ, দুটো আত্মা, এক হয়ে বুক ভরা অশ্রু আর বুক ভরা ভালোবাসায় মিশে রইল।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here