তোমার জন্য সব পর্ব ১৩
রেহানা পুতুল
বরফ শীতল গলায় মায়ের মুখপানে তাকিয়ে বলল মাহমুদ।
মাহফুজা শুকনো মাটিতে আছাড় খাওয়ার মতো নড়ে উঠলেন। দাঁড়ানো থেকে চেয়ার টেনে বসলেন। বুঝলেন ছেলের মুখ নিসৃত বাক্যটি ক্ষোভের ও অধৈর্য্যের।
তিনি বিস্মিত গলায় ছেলেকে শুধালেন,
“কাহিনী কি? কি শুরু করলো তারা এসব?”
মাহমুদ এ টু জেড মাকে বিস্তারিত বলল। মাহমুদা প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে গেলেন ছেলের উপর। বললেন,
“কোন এককালে উপকার করেছে বলে তোর মাথা কিনে ফেলেছে নাকি। এরা গোটা পরিবার মেন্টাল। পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার এদের। যত্তসব আজাইরা যুক্তিখণ্ডন। এটা বাংলা সিনেমা? নায়কের উপকার করলো। এবার ধনীর অবুঝ দুলালীকে বিয়ে করে সেই ঋণ পরিশোধ করো। পথ চলায় এমন উপকার মানুষ মানুষের করেই। এর চেয়ে বড় বড় উপকার তোর বাবা মানুষের করেছে। আমি করেছি। কিন্তু আমরা কোন প্রতিদান আশা করিনি। এখন একবিংশ শতাব্দী। যুগ অনেক এগিয়ে। বহু মনোচিকিৎসক রয়েছে। চিকিৎসা করাক। দেশের বাইরে নিয়ে যাক মেয়েকে। তারাতো পয়সাওয়ালা।”
“মা থামোতো। এমন শুরু করেছ,মনে হচ্ছে বিয়ে হয়ে গেলো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“শোন,তুই আর কোন যোগাযোগ করিস না। তারা বা সেই মেয়ে করতে চাইলে বাহানায় এড়িয়ে যাবি।”
মাহমুদ মায়ের বোঝার জন্য বলল,
“প্রথমে তোমরাওতো খেয়া মেয়েটাকে পছন্দ করেছো।”
“করছি বলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নাই। আমরাতো তাদের কোন পাকা কথাই দেইনি। আমি শীঘ্রই তোকে বিয়ে করাবো। এরপর দেখি সেই মেয়ে কি করে। আমাকে মেয়ে ও তার বাবার নাম্বার দে। কিছু কথা শোনাবো।”
“কাকে বিয়ে করাবা? পাত্রী কই?”
“কলি আছে না।”
” কলি বা তারা যদি রাজি না হয়?”
“চেষ্টায় কিনা হয়। দেখি। তুই রাজি কিনা সেটা বল? বাকিটা ওপরওয়ালার ইচ্ছা।”
মাহমুদ হেসে বলল,
“একজন পারে না বাসায় চলে আসে। আরেকজনের সঙ্গে ত কথাই বলা যাচ্ছে না দুনিয়ার সব ইগো,আত্মসম্মান, পারসোনালিটি নিয়ে বসে আছে উনি।হুহ্! আমি ভেবে জানাবো মা।”
” ঠিক হয়ে যাবে। সময় লাগবে। আমি।গেলাম। ঘুমাবো। টেনশন করিস না। ঘুমায়া পড়।”
মাহমুদ খিটখিটে মেজাজ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
বিকেলের অবসরে কলি তার রুম লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখা মেলে এক টুকরো উদার আকাশ। আজ আকাশের মন ভালো। তাই তার বুকে নেই কোন নীল মেঘের আনাগোনা। কেবলই থোকায় থোকায় গুচ্ছ পুষ্পরাশির ন্যায় সাদা মেঘপুঞ্জগুলো আপন মনে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার বুক চিরে দু’ডানা মেলে উড়ে গেলো একটি অচেনা পাখি। একেলা পাখিটির মাঝে নীড়ে ফেরার তাড়া।
সঙ্গীর বিরহে পোড়া বিরহী প্রেমিকার মতো আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কলি। তার কোন প্রেমিক বা ছেলেবন্ধুও নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েদের জীবনে এসব আসার ফুরসত নেই। তাদের সময় কাটে,বেলা ফুরোয় যাপিত জীবনের রোজকার হিসেব মেলাতেই।
তখনই উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো কলির ভাবনায় ঠাঁয় পেলো একটা বিষয়। মনে পড়লো মাহমুদ স্যারের মায়ের কথা। এক মিস বিহেভিয়ারের জন্য কম মাশুল দেয়নি স্যার। যথেষ্ট হয়েছে। শোধবোধ। উনার মা মিসেস মাহফুজা। এই নারীটি যেমন প্রাণোচ্ছল। তেমনি মমতায় ঘেরা তার অন্তরখানি। স্যারের বিয়েতে শুধু দাওয়াত নয় তাকে নিয়েই ছাড়বে এই স্নেহময়ী জননী। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে বিয়ের দিন,বৌভাত সবকিছুতেই হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি থাকতে হবে তার। কি পরবে তখন। এত আয়োজনে পরার মতো ভিন্ন ভিন্ন ড্রেস কই? টাকাও কই? উপহারই বা কি দিবে? ত্রিশ দিন কাটাতে হয় যাদের হিসেব করে করে। সেখানে বিয়ের মতো আনন্দোৎসবে অংশগ্রহণ করার কথা কল্পনা করা তার জন্য বিলাসিতার নামান্তর।
আচ্ছা স্যারের বিয়ে কবে। কিঞ্চিৎ কৌতুহল জাগলো কলির মনে। এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো নাকি। ক্লাসে এগুলো বলবে না স্যার। স্বাভাবিক। নিজের প্রয়োজনেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে স্যারের থেকে। তাহলে হয়তো যতটুকু সম্ভব আগে থেকে একটু পিপারেশন নেওয়া যাবে। হুট করে ইনভাইটেশন পেয়ে গেলে বিপাকে পড়ে যাবো। তবে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে না। এতে স্যার ধরে নিবে আমি তার বিয়ে খেতে উৎসুক হয়ে আছি। তার মাতো ছাড়বে না আমাকে। তাই জেনে নেওয়া। ভার্সিটি গেলে কথাপ্রসঙ্গে টপ করে জিজ্ঞেস করে ফেলবো।
কলির ভাবনায় ছেদ ঘটে রেবেকার আগমনে।
“হ্যাঁরে কলি তুই এখন কোন বর্ষে?”
“এটাতো সরকারি ভার্সিটি নয় আম্মু। এখানে সেমিস্টারের হিসাব। তোমার বোঝার সুবিধার্থে বলছি। আমি এখন তৃতীয় বর্ষে আছি অর্থাৎ সেভেন সেমিস্টারে আছি। কিন্তু কেন আম্মু বলতো?”
“নাহ এমনিই জানতে মন চাইলো।”
মলিন হেসে বলল রেবেকা।
কলি জানে মা কেন এটা জিজ্ঞেস করেছে। কারণ একটাই। তার পড়াশোনা যত দ্রুত শেষ হবে। তত দ্রুত একটা চাকরি করবে মেয়ে। টানাপোড়েন কমে আসবে সংসারে। কলি মাকে মোলায়েম স্বরে বলল,
“আম্মু তোমার মেডিসিন শেষ? তাহলে প্রেসক্রিপশনটা এনে দাও। একটু পরে স্টুডেন্টদের বাসায় যাবো। আসার সময় নিয়ে আসবো।”
রেবেকা চলে যায়। খানিক পর ফিরে আসে। কলির দিকে প্রেসক্রিপশনটা বাড়িয়ে দেয়। ধূসর মুখে চলে যায় পা ঘুরিয়ে।
কলির চোখ ভিজে উঠে আজ মাকে দেখে। ভাবে সংসারে এই মা নামক প্রাণটির কত ত্যাগ! কত যন্ত্রণা! নিরবে কত রোগ শোক বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদীর মতো। কলি সন্ধ্যার পর আসতে মায়ের ঔষধ নিয়ে এলো।
মাহফুজা পরেরদিন মেয়েকে ফোন দিলেন। যদিও স্বামীকে শুনান নি। অযথা টেনশন ঘাড়ে দেওয়ার মানে হয়না রিটায়ার্ড করা লোকটাকে। সব বললেন মেয়েকে। শুনে আনুশকা মাকে উপদেশের ভঙ্গিতে বলল,
“বুঝলাম। যেহেতু তোমার এতই পছন্দ ফুটন্ত কলিকে। অপরদিকে ভাইয়ার সঙ্গে কলির টিচার স্টুডেন্ট সম্পর্ক। এর বাইরে বাড়তি কোন সখ্যতা নেই। তাহলে একটু সময় নাও। ভাইয়া ট্রাই করে দেখুক, ভাব জমানো যায় কিনা। আর পারসোনালিটির জন্য যদি ভাইয়া না পারে এডভান্স হতে। তাহলে আট দশটা বাঙালী মেয়ের মতো বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হবে তাদের বাসায়। যাও বিনা ভিজিটে এডভাইস দিয়ে দিলাম। সফল হলে আমায় ট্রিট দিতে বলবা তোমার একমাত্র পুত্রধনকে। ”
“এমন করে বলিস কেন? ফাজিল মেয়ে। তুইওতো আমার একমাত্র মেয়ে।”
মুঠোফোনের দু’প্রান্তে নির্মল হাসিতে ঢলে পড়লো মা, মেয়ে দুজনেই।
“আম্মু কলিকে বাসায় আরেকদিন নিয়ে আসতে বলনা ভাইয়াকে। আমি দেখবো ভালো করে বিয়ের পাত্রী হিসেবে। ”
“একবার আসছে। আর আসবে নাকি। আল্লায় জানে। আচ্ছা আমি বলছি তোর ভাইকে।”
মাহফুজা দেরী করলেন না। মাহমুদকে আনুশকার আবদারের কথা জানালেন। মাহমুদ বলল,
“আমি হার্ডলি ট্রাই করবো। তবে মনে হয়না কাজ হবে।”
“আচ্ছা দেখ। আমার কথা বলিস।”
দু’দিন পর মাহমুদ ক্লাসে গিয়েই খেয়াকে খুঁজলো মনে মনে। দেখলো খেয়া আসেনি ক্লাসে। এই ভিতরে তাদের থেকে কোন ফোনও,আসেনি তার কাছে। স্বস্তির দম ফেলল মাহমুদ। নয়তো ক্লাসেও হয়তো সবার সামনে সিনক্রিয়েট করে বসতো খেয়া। মাহমুদ দেখলো কলি এসেছে ক্লাসে। অফিসে গিয়ে কলিকে মেসেজ দিলো।
“ক্লাস শেষে অফিসে আসবেন।”
কলি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মাহমুদের।
“স্যার ডেকেছেন?”
“হুম। আমার ছোট বোন আনুশকা আপনাকে দেখতে চেয়েছে। কিবোর্ড এ আঙ্গুল চালাতে চালাতে ব্যস্ত সুরে বলল মাহমুদ। ”
কলি নির্বোধের মতো হেসে বলল,
“কারণ?”
“কারণ আপনার আন্টির অতিরিক্ত প্রশংসা আপনাকে নিয়ে।”
“ওহ বুঝলাম। বাসায় যাব না স্যার। উনি বাইরে আসুক না। সমস্যা কি? বাইরেই কোন কফিশপে আড্ডা দেওয়া যাবে।”
“ওহ সিউর কলি। তাই হবে। ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস আমার আদরের ছোট বোনের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য।”
” কারেকশন প্লিজ স্যার। ইচ্ছেটা এখনো পূরণ হয়নি। ও হ্যাঁ স্যার, খেয়া আর আপনার বিয়েটা কবে যেন?”
মাহমুদ হেসে ফেলল। বলল,
“কেন আসবেন নাকি?”
“আমি ইনভাইট পাবো নাকি?”
স্মিত হেসে বলল কলি।
“আপনার আন্টি আপনাকে ছাড়া আমার বিয়ে সম্পূর্ণ করবে না। এনিওয়ে, সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনাকে নিলাম খেয়ার বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্য। কিন্তু বলা হলো না। এখন আসুন না সময় থাকলে। এখানে এতক্ষণ কথা বলা দৃষ্টিকটু।”
ভরাট কন্ঠে বলল মাহমুদ।
“কোথায় আসবো স্যার?”
“সেখানেই আসুন। নাকি?”
“ওকে স্যার।”
মাহমুদ কলিকে খেয়ার বিষয়ে ডিটেইলস বলল। কলি আশ্চর্য হয়ে গেলো শুনে। হতভম্ব গলায় বলল,
“আন্টির কথায় আমি সহমত। এক পাক্ষিক ভালোবাসায় কোন পূর্ণতা আছে কি? এজ আর এজ পসিবেল আপনি বিয়ে করে ফেলুন। তখন ডাবল আপনাকে সিংগেল খেয়া আর বিরক্ত করবে না।”
“হুম করবো। মায়ের একটা মেয়েকে পছন্দ। তাদের বাসায় প্রপোজাল পাঠাবে বাবা। মা বলছে তার সঙ্গে আগে একটু ফ্রেন্ডশিপ করার চেষ্টা করতে। আমার মতো বোরিং ছেলের সঙ্গে কোন মেয়ে ফ্রেন্ডশিপ করবে বলেন?”
“আপনি চিনেন তাকে?”
মাহমুদ ধরা না পড়ার জন্য বলল,
“নাহ। মা বলল পরিচয় করিয়ে দিবে।”
“ভালো তো। সেটাই করুন। স্যার উঠি। বাসায় যেতে হবে।”
“বাইকে যেতে আপত্তি?”
“হ্যাঁ স্যার। ঘোর আপত্তি।”
কলি উঠে গেলো তাড়া করে। নিচে নেমে গেলো। বাস এলে উঠে গেলো ভীড় ঠেলে। মাহমুদ বিল মিটিয়ে দ্রুত নেমে এলো। কলিকে দেখতে পেল না। ভারী মুড নিয়ে বাসায় চলে গেলো মাহমুদ। বুঝলো কলির সঙ্গে এভাবে এগোনো এভারেস্ট জয়ের মতো। আবার নিজেও সরাসরি কিছু বলতে পারছে না। ব্যক্তিত্বে ভাটা পড়ে তাহলে। টিচার না হয়ে অন্য পেশায় হলে হয়তো বলা যেতো।
গ্রীষ্মঋতু শেষের দিকে। বরষার আগমনী সংকেত প্রকৃতিজুড়ে। এমন এক আলো আঁধারির শেষসন্ধ্যায় রেবেকা তাড়া দিলো কলিকে। পাশ থেকে নুরুল হকও বলে উঠলেন,
“কিরে মা। শাড়ি পরা হয়েছে? পাত্রপক্ষ এসে পড়বে যে। ”
“এইতো আব্বু রেডি হচ্ছি। বদ্ধ দরজার ভিতর থেকে গলা বাড়িয়ে জবাব দিলো কলি।”
রেবেকা ফের বলে উঠলো আশাবাদী কন্ঠে,
“সুন্দর করে রেডি হয়ে নে কলি। তারা বলছে দু’পক্ষের সবার পছন্দ এক হলে আজই তারা আংটি পরিয়ে দিবে।”
কলি মেঘমন্দ্র মুখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
তোমার জন্য সব পর্ব ১২
“আমার পছন্দের খেতা পুড়ি। এক জীবনে যার একজন ছেলে বন্ধু জুটল না কপালে। তার আবার বিয়ের পাত্র পছন্দ। তার পছন্দের গুরুত্ব থাকলে এই কাহিনী করতে না তোমরা আমার সঙ্গে।”