তোমার জন্য সব পর্ব ১৫

তোমার জন্য সব পর্ব ১৫
রেহানা পুতুল

কলির মাথায় যেন আকস্মিক বজ্রপাত হলো। তার সমস্ত শরীর দুলে উঠলো। চোখ বড় বড় করে কপালে তুলে কিইই বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আতংকিত গলায় বলে উঠলো,
“অসম্ভব আন্টি! মরে গেলেও আমি এটা পারব না। উনাকে স্যার হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। অন্যচোখে দেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! আমাকে ক্ষমা করবেন।”
“তুমি এক মাকে ফিরিয়ে দিবে?”
শীতল গলায় বলল মাহফুজা।

“আপনার পছন্দের জন্য দুটো জীবন বলী হতে পারে না আন্টি। স্যারও আমাকে শুধু ছাত্রী হিসেবেই দেখে। অন্যদৃষ্টিতে নয়।”
” তোমার স্যারের মত না জেনে আমরা এসেছি?”
হেসে বলল আনুশকা।
কলি বলল,
“উনি মায়ের অনুরাগী ছেলে। তাই মায়ের মুখের উপর মানা করতে পারেনি বিধায় হয়তো হ্যাঁ বলতে বাধ্য হয়েছে।”
“এমন কিছুই না। ঠিকাছে তোমার কথাই রইলো। তুমি যদি আমার কাছে থাকতে না চাও। নাই। বিয়ে জোরের বিষয় নয়। মনের বিষয়।”
হতাশ গলায় বলল মাহফুজা।
আনুশকা বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কলি বাচ্চামো করো কেন? তোমাকে প্রথমে আম্মু পছন্দ করেছে। এটা সত্যি। তারপর আম্মু আমাদের সবাইকে বলল তোমার কথা। ভাইয়া ও আমরা চিন্তা করে সহমত জানালাম। বিষয়টা যে আম্মুর ইচ্ছাকেই কেবল প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তা মোটেও নয়। এটা দুজন মানুষের পুরো লাইফের বিষয়। আমরা ভেবেচিন্তেই সিদ্বান্ত নিয়েছি। তোমাদের পরিবারের সবাই, ভাইয়া ও আমাদেরকে পছন্দ করেছে।”
কলি নত মস্তকে মৌন হয়ে রইলো। পরক্ষণেই বলল,
“বুঝলাম। তবুও আমি সরি বলবো। স্যারকে আমি অন্যচোখে দেখতে পারব না।”

“রাজধানীতে বাস করেও তুমি দেখি মান্ধাতার আমলের মেয়েদের মতো কথা বলছ? আম্মুর মাথা হেঁট হয়ে যাবে এখন ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া বারবার বলছে কলির মত না জেনে তোমরা যেওনা। পরে অপমানিত হবে।”
স্বল্পভাষী আবদুর রহমান নিরব ভূমিকা পালন করছেন। কি বলবেন তিনি। কিছুই বলার নেই। বাকিরা নিরব দর্শকের মতো চুপ হয়ে আছে। আড়চোখে কলিকে দেখছে ও কলির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। মাহফুজা দীর্ঘস্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। খেদ ঝেড়ে মরাকন্ঠে বললেন,
“সব ভুল আমারই হয়েছে। নিজের উপর অগাধ আত্মবিশ্বাস ছিলো। সব ভেস্তে গেলো। মাহমুদের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো আমার।”
আনুশকা বলল,

“ফাইনাল একটা জিজ্ঞাসা কলি। আচ্ছা ভাইয়া যদি তোমার মুখোমুখি হয়ে বলে তোমাকে পছন্দ। তাহলে কি তুমি ইয়েস বলবে?”
“নাহ আপু। সরি।”
বলে কলি নিজের রুমে চলে গেলো।
” আপা,ভাইসাহেব আপনারা যাবেন না। একটু বসুন।”
নুরুল হক আন্তরিক গলায় অনুরোধ করলো অতিথিদের।

তারা তিনজন দাঁড়ানো থেকে আবার বসলো। রেবেকা,মিলি,নুরুল হক উঠে ভিতরে গেলো। জুলি ও হারুন বসে আছে। হারুন কথোপকথন চালিয়ে নিলো অতিথিদের। জুলি ও আনুশকা নানান রসবোধে মেতে উঠলো। নাইনে পড়ুয়া জুলি বন্ধুবৎসল ও স্বভাবে মিশুক প্রকৃতির। পৃথিবীর সব পর মানুষকে এক দেখায় আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা এই বালিকা মেয়েটির।

আনুশকা অতি আগ্রহ নিয়ে জুলির সঙ্গে গল্প করছে। এক পর্যায়ে জুলি বলল,
“আনুপু আমি একটা মজার জোকস জানি। এক্ষুনি শোনাতে চাই আপনাকে। পরে যদি আপার বিয়ে না হয় তার স্যারের সঙ্গে। তাহলে আর কোনদিন শুনানো হবে না। আমার আফসোস রয়ে যাবে।”
আনুশকা দেখলো জুলি তার এত সুন্দর নামের অর্ধেক ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলেছে। শুধু আনুপু বলছে। যদিও তার কাছে এটাও শুনতে বেশ লাগছে। শটকার্ট সহজ সরল শব্দ। আনুশকা চায়না এত হাসিখুশী মেয়েটার মনে বিন্দুসম হলেও অপূর্ণতাটা রয়ে যাক।
সে উৎসুক চাহনিতে বলল,

“সেটাই। বিয়ে না হওয়ার চান্স সেভেনটি পার্সেন্ট। অবশ্য হতেও পারে। জিরো পার্সেন্ট চান্স থেকেও মানুষ হিরো হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলায় দেখনা,হারতে হারতে চার,ছক্কা মেরে জিতে যায়। আমার কাছে এই বিষয়টা অদ্ভুত মজার লাগে জুলি। ও হ্যাঁ তোমার কৌতুকটা? প্লিজ।”
“ওহ! শোন,

পার্কের খোলা বেঞ্চে বসে আসে দুজন কপোত-কপোতী। ছেলেটা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বুক টান টান করে পাখির ডানার মতো দুই হাত দুই দিকে মেলে ধরলো। বলল,
প্রিয়া এই পৃথিবী শুধু তোমার আমার।কোন ভয় নেই। কোন দ্বিধা নেই। বুকে আসো। তখন সামনের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো একজন অচেনা মুরুব্বি। তিনি থেমে গেলেন। তাদের দুজনের দিকে স্থির চোখে চাইলেন। বললেন,
তা বাবা তাহলে কি এই পৃথিবীর আমরা সব মানুষেরা তোমাদের ভাড়াটিয়া?”
আনুষকা উচ্ছল হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। জুলিও রিনরিনিয়ে হেসে ফেলল। বলল,

“মজার না জোকসটা?”
“সেরা। সেরা। কোথায় শুনেছে এটা?”
“স্কুলে গনিতের স্যার বলেছে।”
“বাহ! জটিল গণিতের মতো সাবজেক্টের স্যার এত রসিক? লাইক সিরিয়াসলি? ”
কলিকে এতক্ষন মা,বাবা,বোন তাদের সাধ্যনুযায়ী জীবন নিয়ে বিভিন্ন যুক্তিখন্ডন করে বোঝালো। কলির ঘুরেফিরে দুটো কথা। এক, স্যার তাকে পছন্দ করেছে এটা তার বিশ্বাস হয়না। দুই, হলেও তার সংকোচ হয়। অন্য কেউ হলে এতটা হতো না। কলি বসে রইলো চেয়ারে নিজের রুমে। তারা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। কলির বিষয়টা জানালো।
আনুশকা উঠে এলো কলির কাছে। বলল,

“ভাইয়াকে বলবো আসতে তোমাদের বাসায়? বাইকে একটানে চলে আসতে পারবে। ভাইয়ার মুখ থেকেই শুনে নাও তবে। আম্মু,আব্বু কত অগাধ বিশ্বাস নিয়ে এসেছে তোমাদের বাসায়। শুভকাজকে অবহেলা করতে নেই কলি। রেস্পেক্ট করতে হয়। টিচার স্টুডেন্ট এর বিয়ে সেই আদিকাল থেকেই আমাদের সমাজে প্রচলিত ও জনপ্রিয়। প্লিজ হবু ভাবি ইয়েস বল না।”

“নাহ। উনি আসতে হবে না।”
নিরুৎসাহিত কন্ঠে জানালো কলি।
“তাহলে কি? ইয়েস?”
কলি নিরুপায় হয়ে নিমরাজি হলো। তাও শর্ত জুড়ে দিয়ে। বলল,
“আমি এক সপ্তাহ একটু ভেবে দেখি আপু।”
“আচ্ছা। রাজী।”
আনুশকা কলিকে নিয়ে সামনে চলে গেলো। কলিকে তার মায়ের পাশে বসালো। সুখ সুখ গলায় বলল,
“আম্মু তোমার হবু পুত্রবধূর অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দাওতো।”
কলির মুখে অমানিশার আঁধার ভর করলো। আনুশকা কলির আঙ্গুলগুলো মেলে ধরলো।
মাহফুজা আংটি পরিয়ে দিতে দিতে বলল,

“আমি এটা এমনিতেই দিলাম তোমাকে। ভালো থেকো মা।”
নুরুল হক ও আবদুর রহমান আলহামদুলিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে মোলাকাত করলো। জুলি, আনুশকাও আলহামদুলিল্লাহ বলে মোলাকাত করলো।
হারুন দুষ্টমিষ্ট চোখে মিলির দিকে তাকালো। ইশারায় বোঝালো,
আসো আমরাও বুকে বুক মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলি। মিলি কঠিন চোখের দৃষ্টি দিয়ে শাসালো স্বামীকে।
নুরুল হক বললেন,

“ভাইসাহেব রাত হয়ে গেলো। আপনারা নৈশভোজ সেরে যান।”
“নাহ ভাইসাহেব। আজতো বিয়ের দিনক্ষন আমরা ঠিক করিনি। যেদিন পাকা কথা হবে বিয়ের। সেদিন খাবো। কথা দিলাম। আপনারা কলির মতামত নিয়ে সময়টা আমাদের জানাবেন।”
তারা হাসিমুখে চলে গেলো বিদায় নিয়ে।
কলি নিজের রুমে এসে আংটি ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। জুলি সেই আংটি নিয়ে নিজের বুড়ো আঙ্গুলে দিয়ে বসে রইলো। কলি দরজা বন্ধ করে ফুঁফিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মাহফুজা বাসায় গিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন।
তিনি বুঝতে পেরেছেন সেদিন ছেলের কথায়। তার সঙ্গে ছেলেও কলিকে বেশ পছন্দ করে বসে আছে। তাই ছেলের মনোবাসনা পূরণের জন্যই মা হয়ে উঠে পড়ে লাগলেন।
মাহমুদ তাদেরকে অবাক চোখে বলল,

“এত লেট হলো? তোমরা গেলে কখন আর এলে কখন? ডিনার করে এসেছো নাহ?”
“আরেহ নাহ। তারাতো যথেষ্টবার সেধেছে। আমরা করিনি। তোর অভিমানীনি ছাত্রীকে ম্যানেজ করতেই আমরা নাকানি চুবানি খেলাম। রীতিমতো ছোটখাটো একটা যুদ্ধ হাফ জয় করে এসেছি। আমরা রুমে যাই। কাহিল। বিশ্রাম নিতে হবে। তোর বোন থেকে ইতিহাস শোন।”
মাহমুদ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসে পড়লো দাঁড়ানো থেকে। তার বাবা মা নিজেদের রুমে চলে গেলো।
“আনুশকা এদিকে আয়।”
আনুশকা গিয়ে বসলো ভাইয়ের সামনে।
“আমার আংটি কই?
দে।”

“আজব! আংটি কি ফেরত আনার জন্য কিনে দিয়েছো?”
“বিয়ে ফাইনাল হয়নি আংটি কেন রাখলো?”
বিরক্ত হয়ে বলল মাহমুদ।
” ধীরে বৎস ধীরে।”
হাত উঁচিয়ে সাধু,সন্নাসীর মতো বলল আনুশকা।
সে কলিদের বাসার সব ইতিবৃত্ত ভাইকে বুঝিয়ে বলল। মাহমুদ চিন্তিত সুরে বলল,
“তার মানে বিয়েটা মাকড়সার বাসার মতো ঝুলে আছে? যেকোনো সময় ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা বিপুল?”
“ইয়েস ব্রো। হান্ড্রেডপার্সেন্ট।”

“এখন আমার কি করতে হবে তাহলে?”
” কি বললাম এতক্ষণ? ওক্কে এগেইন রিপিট করি। কলির ফার্স্ট কথা হলো, তার বিলিভ হয়নি তুমি তাকে পছন্দ করেছো বিয়ে করার জন্য। দ্বিতীয় কথা হলো বিলিভ করলেও তার তোমাকে সেভাবে পছন্দ নয়। স্যার হিসেবেই দেখে তোমাকে সে।”
“তো আমার আংটি দিয়ে আসলি ক্যান? যা নিয়ে আয় গিয়ে।”
“এত ত্যাড়ামো করো কেন? এমন ভাবে তার সঙ্গে চলবা, যেন সে বিলিভ করতে বাধ্য হয় তুমি তাকে মন নয় শুধু, অস্থি,মজ্জা,পাঁজর,কলিজা,ফুসফুস, হার্ট,কিডনি, শিরা,উপশিরা, সব দিয়ে লাইক করো। এবং সেও যেন তোমাকে লাইক করে।”

“হুম বুঝলাম। আচ্ছা যা। ঘুমাবো।”
“টিপস দিয়ে দিলাম। এখন তো ভাগিয়ে দিবাই। হুহ্!”
আনুশকা চলে গেলে মাহমুদ তার ডায়েরিটা টেনে নিলো। একটানে লিখে ফেলল,
” আমার হৃদয়টা পোড়াতে এই অরণ্যহীন শহরে এত চন্দন কাঠ কোথায় পাও তুমি?”
তারপর ডায়েরিটা বন্ধ করে একপাশে ঠেলে রেখে দিলো মাহমুদ।

কলি আবার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মাহমুদের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার জো রইল না আর। এই তীব্র সংকোচে তার প্রান উড়ে যাওয়ার দশা। মিসেস হেড কলিকে ফোন দিলো। কলি জানালো অসুস্থ। সুস্থ হয়েই ফিরবে ক্যাম্পাসে। এক সপ্তাহ পর কলি ক্লাসে গেলো। মাহমুদ বুঝতে পারলো বিষয়টা। তাই নিজেও কলির থেকে দূরে দূরে রইলো। কোন অযাচিত প্রসঙ্গ তুলে সামন্দ যাওয়া, কথা বলা, ফোন করা, মেসেজ দেওয়া সবকিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখলো।

এভাবেই পার হচ্ছে তার সময় ও দিন। তবে লুকানো নয়নে কলির প্রতি সুক্ষ্ম নজর রাখছে মাহমুদ।
তার পর একদিনের ঘটনা। বর্ষার এক বৃষ্টি ভেজা বিকেল। রাস্তাঘাট অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা নিরব। বাস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচুর জ্যাম রাস্তায়। কলি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে বাস স্টপেজ পার হয়ে ফুটপাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। তার পথরোধ করে ফেলল দুটো যুবক ছেলে। তারা কলির সঙ্গে অশালীন কথা বলছে৷ এরা মাস্তান টাইপ। তাই কেউ কেউ দেখেও না দেখার মতো রইলো।

এক পর্যায়ে একজন ছেলে কলির বুকের উপর থেকে হ্যাঁচকা টানে ওড়নাটা নিজের হাতে নিয়ে পেঁচিয়ে নিলো। বলল,
“এভার যাও পারলে। প্রতিশোধ নিলাম। ওড়না পাবে না।”
কলি লজ্জায়,ঘৃণায়,আড়ষ্টতায় মিশে গেলো মাটির সঙ্গে। হাতের ব্যাগকে বুকে চেপে ধরে অসহায় ভঙ্গিতে অন্যদের সাহায্য চাইলো। কেউ এগিয়ে এলো না। কলি দাঁড়িয়ে রইলো ফুটপাতের কিনারা ঘেঁষে। ছেলেদুটো তার ওড়না নিয়ে বাইক চালিয়ে চলে গেলো। তাদের ধরার ও শায়েস্তা করার কোন সুযোগ নেই। কলি কেঁদে ফেলল।
পরক্ষণেই পিছন হতে কলির পিঠের উপর দিয়ে বুকের উপর ওড়নাটি মেলে দিলো মাহমুদ। কলি বিস্ময় ভরা কন্ঠে কাঁপা কাঁপা অধরে শুধালো,

তোমার জন্য সব পর্ব ১৪

“স্যার আপনিই? আমার ওড়নাটা কোথায় পেলেন? ”
“হ্যাঁ আমি। বাইকে উঠে আসুন।”
গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে আদেশ করে বলল মাহমুদ।

তোমার জন্য সব পর্ব ১৬