তোমার জন্য সব পর্ব ১৬
রেহানা পুতুল
পরক্ষণেই পিছন হতে কলির পিঠের উপর দিয়ে বুকের উপর ওড়নাটি মেলে দিলো মাহমুদ। কলি বিস্ময় ভরা কন্ঠে কাঁপা কাঁপা অধরে শুধালো,
“স্যার আপনিই? আমার ওড়না কোথায় পেলেন? ”
“হ্যাঁ আমি। বাইকে উঠে আসুন।”
গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে আদেশ করে বলল মাহমুদ।
মাহমুদ বাইকে চড়ে বসলো। কলি বিব্রত গলায় আবারো জানতে চাইলো,
“স্যার ওড়নাতো ওরা নিয়ে গিয়েছিলো। কিভাবে পেলেন?”
“আশ্চর্য কলি! পথের উপর থেকে সব বলবো? বাইকে চড়ুন। বলছি। স্প্রীড ব্রেকার দেখলে স্লো চলবে বাইক। নো টেনস।”
শক্ত চোয়ালে বলল মাহমুদ।
কলি দোনোমোনো করতে করতে বাইকে মাহমুদের পিছনে গিয়ে বসলো। মাহমুদ কলিকে নিয়ে লালবাগ চৌরাস্তার মোড়ে চলে গেলো। বাইক থামালো একটি নিরিবিলি হোটেলের সামনে।
” আসুন লাঞ্চ করতে করতে বিষয়টা বলি।”
বলেই মাহমুদ বীরের মতো গটগট পায়ে হোটেলের ভিতরে চলে গেলো। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ফ্যান বরাবর একটি টেবিলে বসলো। কলিও হাত ধুয়ে এসে মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। দুটো বিফ খিচুড়ির অর্ডার দিলো মাহমুদ। কলি মনে মনে আওড়ালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিয়ে ঠিক না হতেই অধিকার খাটানো শুরু করেছে। আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। কলি বলে উঠলো,
“স্যার আমার বাসাতো এই সামনেই। আমি বাসায় গিয়েই লাঞ্চ করতাম। দরকার কি ছিলো।”
” আপনার বাসা এখানে। এটা আমি জানি না? ওড়না উদ্ধারের কাহিনী শুনবেন না?”
“অবশ্যই স্যার। বলুন?”
“তো শুনতে হলে কোথাও বসতে হচ্ছে। নয়তো আমিও বাসায় চলে যেতাম।”
কলি চুপ রইলো।
মাহমুদের মোবাইলে বেজে উঠলো।
“হ্যাঁ মা বলো?”
” আসতে ওই চিকন কাটা সুপারিগুলো এক কেজি নিয়ে আসিস। সুপারি শেষ। তুই কোথায় এখন?”
“তোমার অভিমানীনি ছাত্রীর সঙ্গে। লালবাগ।”
“কলিকে ফোনটা দে।”
কলি নারভাস হয়ে গেলো। মাহমুদ ফোন বাড়িয়ে দিলো কলিকে।
“হ্যালো আন্টি আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। যাক তোমার স্যারের সঙ্গে আছো শুনে ভালো লাগলো। কিছুদিন পরেই তার বউ হবা। জড়তা কাটানো দরকার।”
বন্ধুসুলভ কন্ঠে বলল মাহফুজা।
কলি কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও মাহফুজাকে বুঝতে দিল না। ছোট্র করে ‘হুঁ’ বলল। স্পিকার অফ ছিলো। তবুও মাহমুদ মায়ের কথা শুনতে পেলো। কেননা তার মোবাইলের ভলিউম ফুল ছিলো। এবং সে কান পেতেও ছিলো শোনার জন্য।
“মা খুব ওপেন মাইন্ডের। ডোন্ট মাইন্ড।”
মাহমুদ ইচ্ছে করেই কলির অভিব্যক্তি দেখার জন্য কথাটা বলল। কলি হতবাক চোখে মাহমুদের দিকে চাইলো।
“ওভাবে চেয়ে লাভ নেই। আমার এই সেটের দোষ। আমার কানের দোষ।”
“আন্টি অতিরিক্ত করে ফেলছে। এটা অবাস্তব।”
“মানলাম। যুক্তিতে না যাই।খেয়ে নিন। খাবার চলে এসেছে। ”
চাপাস্বরে বলল মাহমুদ।
বিফ খিচুড়ি, সালাদ,কোক এসে গেলো। খাওয়া শেষে মাহমুদ বলল,
আমি বাইক নিয়ে বাস স্টপেজের কাছাকাছি এসে একটু থামলাম। ফটোকপির দোকানে কাজ ছিলো বলে। সেখান থেকেই আমার চোখ পড়লো চায়ের টং দোকানে দুজন ছেলের দিকে। তারা গ্যাসলাইট দিয়ে সিগারেট জ্বালাচ্ছিলো। একজনের হাতে চোখ যেতেই দেখলাম এটা আপনার ওড়না। ভালো করে চেয়ে দেখলাম আবার। ভুলও হতে পারে। আপনার ওড়না কেন ওদের হাতে আসবে। আমার তীক্ষ্ণভাবে তাকানো দেখেই ফটোকপির দোকানের অন্য একটা ছেলে বলল,
“স্যার এরা নষ্ট ছেলে। বখাটে! দেখেন কোন মেয়ের ওড়না ছিনিয়ে নিলো। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাই এদের কাজ।”
আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“সত্যি বলছ তুমি?”
“একদম সত্য স্যার। আমি চিনি। প্রায় রাতে মদ খেয়ে এসে এইখানে মাতলামো করে । চা,সিগারেটের বিল দেয়না।”
” আমি তড়িতেই ছেলে দুটোর কাছে চলে গেলাম। ছেলেটার হাত থেকে ওড়না কেড়ে নিতে হলো। তারা ভয়ানক ক্ষেপে গেলো। হাতাহাতি শুরু করলো আমার সঙ্গে। লোক জড়ো হয়ে গেলো। তারা আমার পক্ষ নিলো। এবং তাদের ধরে ফেলল। তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি। বাস স্টপেজে পুলিশ ছিলো। ফটোকপি দোকানের সেই ছেলেটা গিয়ে দুজন পুলিশ নিয়ে এলো। উপস্থিত সবার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিলো। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলো ওড়না কার? বললাম,আমার ডিপার্টমেন্টের এক ছাত্রীর। সেজন্যই আমার চিনতে অসুবিধা হয়নি। মাহমুদ থামলো। ভরা গ্লাসের অর্ধেক পানি খেয়ে জোরালো নিঃস্বাস ফেলল।
কলি মনে মনে উচ্চারণ করলো, আমার দিকে কতটা খেয়াল করলে উনি আমার ওড়না চিনতে পারলো। তারমানে ক্লাসে গেলে চোরাচোখে কেবল আমাকেই দেখে নাকি। উফফস!
” ধন্যবাদ স্যার। আপনাকে বারবার
আমার জন্য কষ্ট ও ঝামেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।”
নিচু মাথায় কৃতজ্ঞতার স্বরে বলল কলি।
“আগের এক্সিডেন্ট, আজকের ঘটনার জন্য শুধু ধন্যবাদ?”
বিরস কন্ঠে শুধালো মাহমুদ।
“অনেক ধন্যবাদ স্যার।”
“অনেক ধন্যবাদ?”
কলির চোখে ঠায় চেয়ে থেকে বলল মাহমুদ।
“আন্তরিক ধন্যবাদ স্যার।”
“কেবল আন্তরিক ধন্যবাদই প্রাপ্য আমি?”
ভারমুখে বলল মাহমুদ।
“বিশেষ ধন্যবাদ স্যার।”
“বিশেষ ধন্যবাদ ত দূরের মানুষকেও দেয়। কাছের মানুষকে আরো কিছু দিতে হয়।”
কলি চমকানো দৃষ্টিতে তাকালো মাহমুদের দিকে। বলল,
“কাছের?”
“ভার্সিটির টিচার স্টুডেন্টের সম্পর্ক কাছের নয়? ফ্রেন্ডলি নয়?”
“ওহ বুঝলাম। হয়তো। ”
মাহমুদ কলির হাতের দিকে খেয়াল করলো। তার দেওয়া আংটিটা নেই কোন আঙ্গুলেই। তার খারাপ লাগলো। কিন্তু কলিকে বুঝতে দিল না। প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে বলল,
“এবার বলুল, তারা কেন আপনার ওড়না ছিনতাই করলো। পথ দিয়ে আর মেয়ে চলাফেরা করে না?”
“স্যার এই দুজন ছেলে আমাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করেছিলো। হাত ধরতে চেয়েছিলো। শেষদিন আমি স্যান্ডেল খুলে মারতে চেয়েছি। তাই এমন করেছে আজ।”
“হুম। শিক্ষক হিসেবে আমাকে জানাতে পারতেন। যাইহোক। সাবধানে পথ চলবেন। সবসময় ইগো নিয়ে থাকলে চলে না।”
কলি শান্ত মেজাজে বলল,
“দুজন বখাটেকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন। এতে অনেকের অনেক উপকার হলো। সেই চা বিক্রেতা মামাও রক্ষা পেলো। তারজন্য আপনাকে স্পেশাল থ্যাংকস।”
” শুধু থ্যাংকসে আমার পোষাবে না।”
“তো?”
” আপনি সেটা দিবেন না। যেটা আমি চাইবো। বাদ দেন। খাল্লি বাল্লি। আসুন। পৌঁছে দিই বাসায়।”
মাহমুদ কলিকে বাসার নিচে পৌঁছে দিলো। বাইক ঘুরিয়ে চলে গেলো।
এ এক আজব চিজ। কোন ধাতু দিয়ে বিধাতা তাকে গড়ালো। কি নিরস রসকষহীন নারীরে ভাই। কিছু বললে তার কারণ জানার জন্য নুন্যতম কৌতুহলের আভাস তার মাঝে দেখা যায় না।
কলি বাসায় গিয়ে আংটিটা নিয়ে অনামিকায় পরে নিলো। আবার খুলে ফেলল কিছু একটা ভেবেই। নেড়েচেড়ে দেখলো আংটিটা। ভারি সুন্দর। তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আজকের বিফ খিচুড়িটাও দারুণ ছিলো। বিফ খিচুড়ি তার ভীষণ পছন্দ। কিছু বিষয়ে ভাবলে তার হ্যাঁ বলতে ইচ্ছে করে মাহমুদকে। আবার শুরুর দিনের অপমানের কথা ভাবলে মানা করতে ইচ্ছে করে। দ্বিধাদ্বন্ধের দোলায় অনবরত দুলছে কলি। এত কনফিউশানে থেকে কিভাবে হ্যাঁ বা না বলবে সে। সে বাসার কাউকে এই বিষয়ে মত জানায়নি। তারাও তারকাছে মত জানতে চায়নি।
সাতদিন পর আবদুর রহমান ফোন দিলো নুরুল হককে। জানতে চাইলো কলির মতামত এবং তারা কবে আসবে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।
নুরুল হককে পাশে বসা থেকে রেবেকা ফিসফিসিয়ে বলে দিলো,
বলেন কলি হ্যাঁ বলেছে। সমস্যা নেই।
নুরুল হক তাই জানিয়ে দিলো।
আবদুর রহমান মুঠোফোনের ওপ্রান্ত হতে সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
জিজ্ঞেস করলো,
“ভাই সাহেব তাহলে আমরা কবে আসবো বিয়ের তারিখ ফেলতে?”
“ভাই সাহেব সামনের সপ্তাহে আসুন। শুক্রবারে। সেদিন আমার অফিস বন্ধ থাকে। আমি বাসায় থাকি।”
তারা দুজন ফোন থেকে বিদায় নিলো। মাহফুজা ছোট বাচ্চার মতো ছুটে এসে মাহমুদকে সংবাদটা জানালো।
“সুখবর আছে মাহমুদ। কঠিন সুখবর!”
” বলে ফেলো জননী?”
“তোর অভিমানীনি ফুলকলি রাজী বিয়েতে।”
“ফুলকলি! মজাতো নামটা। ফুলকলি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান আছে ঢাকার কয়েক স্থানে।”
” শোন,সে এক সপ্তাহের সময় নিয়েছে না। সেটাতো আরো আগেই ফুরিয়ে গেলো। তারাতো কিছুই জানাচ্ছে না। হয়তো সংকোচে। তাই আমি তোর বাবাকে দিয়ে একটু আগে ফোন করালাম। কলির বাবা বলল বিয়ের ডেট ফেলার জন্য সামনের শুক্রবারে যেতে তাদের বাসায়। তুই থাক। আমি আনুশকাকে ফোন করি।”
মাহমুদা উৎফুল্ল মনে চলে গেলো নিজের রুমে। মাহমুদের অশান্ত হৃদয় শান্ত হলো। হৃদয়ের পুরো আঙিনা জুড়ে সুখের বারতা ঝরে পড়ছে শিউলি ফুলের মতো। অনুভূতির বেহাল দশা। মাহমুদ মনে মনে ধন্যবাদ দিলো কলির ওড়না নিয়ে যাওয়া সেই বখাটে দুজন ছেলেকে।
কারণ দিনের আলোয় প্রকাশ্যে একটা মেয়ের বুক খালি করে ওড়না নিয়ে চলে গেলো কেউ। এটা সেই মেয়ের জন্য কতখানি দূর্বিষহ ও লজ্জার তা আর বলার অপেক্ষা থাকে না। মাহমুদ কলিকে সেদিন ওড়না ফিরিয়ে এনে না দিলে খালি বুকেই কলির বাসায় যেতে হতো। তাই মাহমুদ বিশ্বাস করলো তার কাছে বিয়ে বসতে কলির রাজী হওয়ার পিছনে এই ঘটনা বড় ভূমিকা রেখেছে।
সে কলিকে নিয়ে হারিয়ে গেলো কল্পলোকের অন্তপুরে। ডায়েরিতে লিখে ফেলল,
“ওহে ফুলকলি,তুমি আমার কাছে অনেক ঋণী হয়ে গিয়েছো। একবার বুকের মাঝে পাই। নিংড়ে নিংড়ে সুদসমেত পুষিয়ে নিবো। তোমার ঋণের বোঝা কমানোর গুরুদায়িত্ব শুধুই আমার। কেবইলই আমার। বাকির খাতায় নাম রাখব না তোমার।”
মাহমুদের ভীষণ ইচ্ছে করছে কলির হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখতে। কলির মুখোমুখি হতে। কলির মুখ থেকে অন্তত ভালোলাগে কথাটি শুনতে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। কলি আর তার স্বভাব প্রায় একইরকম। ইগো! ব্যক্তিত্ব! মৃদুভাষী! চাপা,স্বভাবের! তবে তার রাগ মনে হয় কলির চেয়ে বেশী। এমন এলোমেলো ভাবনায় ডুবে গেলো মাহমুদ।
শুক্রবারের দুইদিন আগে রেবেকা কলিকে জানালো,
” এই কলি, পরশু তারা বিয়ের তারিখ ফেলতে আসবে। বাগদান অনুষ্ঠান আরকি।”
কলি চকিতে চাইলো মায়ের মুখপানে।
“আমি ত মত জানাইনি আম্মু।”
“তোর আব্বু তাদেরকে তারিখ বলল। বলে বিবাহের মতো শুভকাজে ঢিলেমি করা ঠিক নয়। আর তারাও ফোন দিয়ে জানতে চাইলো মতামত।”
পিতার কথার উপরে কলির কিছুই বলার রইলো না। সে অন্তঃসারশূন্য মুখে বলল,
“আচ্ছা আম্মু। ঠিকাছে।”
বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে মাহমুদ অফিসে কাজ করছে। তার মোবাইলে জ্বলে উঠলো। মেসেজের রিংটোন বেজে উঠলো।
তোমার জন্য সব পর্ব ১৫
“স্যার একটু দরকার ছিলো। আসবো?”
মাহমুদের মন অদ্ভুত আনন্দে নেচে উঠলো ময়ুরের পেখম ছড়িয়ে নাচার মতো। কাল বাগদান। আজ কলি দেখা করতে চাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু বলবে। সে দ্রুত টাইপ করে মেসেজ সেন্ড করে দিলো।
“আমার কাছে আসতে আপনার অনুমতির প্রয়োজন নেই। আসুন।”
সত্যিই কি মাহমুদের ভাবনার মতই কলি কিছু বলবে? নাকি ভিন্ন কিছু বলবে। যা শোনার জন্য মাহমুদ কখনোই প্রস্তুত ছিল না।