তোমার জন্য সব পর্ব ১৮
রেহানা পুতুল
হসপিটালের বেডে বসে আছে আয়মান। তার পাশেই বিরক্তিকর মুখভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা মেয়েটি। মেয়েটির বিরক্তের কারণ, আয়মান। তাকে কপাল ফাটিয়ে হসপিটালে নিয়ে আসতে হয়েছে সেজন্য নয়, বরং কপালে ব্যান্ডেজ করা নিয়ে। মেয়েটি যখন আয়মান’কে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছায়, তখন একজন নার্স এসে আয়মানের কপালে ব্যান্ডেজ করে দিতে চাইলে আয়মান জানায় সে নার্সের হাতে ব্যান্ডেজ করবে না। নার্স ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, তাহলে কার হাতে করবে? আয়মান জানায় যেই মেয়ে তার কপাল ফাটিয়েছে সেই মেয়ের হাতে ব্যান্ডেজ করবে। এরপর, এতবার বলার পরও আয়মান নার্সের কথা শোনে নি। আয়মানের এক কথা, যে তার কপাল ফাটিয়েছে ব্যান্ডেজ সে তার হাতেই করবে। তারপর থেকেই মেয়েটির মুখে বিরক্তিকর আভাস ফুটে ওঠে। নার্স অচেনা মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” তুমি এই ছেলের কপাল ফাটিয়েছ? কেন? কি করেছিলো সে? বয়ফ্রেন্ড হয় নাকি তোমার? তেমাকে রেখে অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলে সেজন্য এই অবস্থা করেছ? ”
মেয়েটি কপাল কুঁচকে তাকায় নার্সের দিকে। চওড়া গলায় জবাব দিলো,
” কি যা তা বলছেন আপনি? বয়ফ্রেন্ড তো দূরের কথা, আমি তো এই ছেলে কে চিনিই না। আর রইল বাকি কপাল ফাটানো? এই ছেলেটা খুবই ভদ্র। আমার আবার ভদ্র ছেলেদের প্রতি এলার্জি আছে। এত ভদ্র ছেলেদের আমি পছন্দ করি না। দেখলেই গা জ্বলে। তাই এই ছেলের কপাল ফাটিয়েছি। ”
নার্স অচেনা মেয়েটির দিকে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকাল। ভদ্র ছেলেদের প্রতি এলার্জি? নির্ঘাত এই মেয়ে পাবনা ফেরত পাগল। নয়তো, এমন অদ্ভুত কথাবার্তা কেউ বলে? আর এই ছেলেটাও ভারী অদ্ভুত! যে তার কপাল ফাটালো তাকে কিছু না বলে উল্টো তার হাতেই ব্যান্ডেজ করতে চাচ্ছে? দুইটাই পাগল। নার্স তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে জানায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” সে যাইহোক, এই ছেলে তো তোমার হাতে ছাড়া আর কারো হাতে ব্যান্ডেজ করবে না বলছে। এই নাও ফাস্ট-এইড বক্স। এটাতে সবকিছু আছে। যেহেতু, ক্ষত’টা অতোটা গভীর না, অল্প জায়গা নিয়ে থ্যাঁতলেছে। তাই ইনজেকশন দিতে হবে না। ঔষধ লিখে দিচ্ছি এগুলো তিন বেলা খেতে হবে। আর ব্যান্ডেজ করে দ্রুত সিট খালি করে বিদায় হও। এক পেশেন্ট নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। আমাদের আরও অনেক পেশেন্ট আছে। তাদের জন্যেও তো সিটের ব্যবস্থা করতে হবে নাকি? ”
মেয়েটি ভাবলেশহীন গলায় বলল,
” আমি একে ব্যান্ডেজ করে দিতে পারবো না। একে টাচ করতেও আমার রুচিতে বাঁধবে। ”
এ পর্যায়ে আয়মান ক্ষেপে উঠল। ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে বলল,
” এই মেয়ে, এখন কিন্তু বেশি বেশি বলছো। তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি, হ্যাঁ? আমাকে টাচ করতে তোমার রুচিতে বাঁধবে অথচ সারাটা রাস্তা আমার সাথে ঘেঁষে বসে, আমাকে এক হাতে আগলে ধরে হসপিটালে নিয়ে আসলে। তখন রুচিতে বাঁধলো না? কার কপাল ফাটিয়েছ জানো? বিখ্যাত বিজনেস ম্যান রাশেদ শিকদারের ছোট ছেলে আয়মান শিকদারের। এই অপরাধে আমি চাইলে তোমাকে জেলের ঘানি টানাতে পারি। তখন তোমার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কোথায় যায় আমিও দেখবে। ”
এ কথায় মেয়েটির মুখ খানিকটা চুপসে গেল। জেলখানায় গেলে বাবা ভীষণ কষ্ট পাবে। হয়তোবা রাগও করবে। তার থেকে বরং এই উটকো ঝামেলাকে কপালে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বিদায় করে দেওয়াই ভালো।। হুম, সেটাই ভালো হবে। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও আয়মানের কপালে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে অচেনা মেয়েটি। আয়মান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির শ্যামলাটে মুখশ্রীর দিকে। মেয়েটির নজর আয়মানের থ্যাঁতলে যাওয়া কপালে। এই মেয়ে যা ধানিলংকা, কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে না সেটা আয়মান খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। মুহূর্তেই মাথার মধ্যে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে ব্যগ্র গলায় শুধাল,
” বাবুর আম্মু, তোমার বাসা কোথায়? ”
মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আশেপাশে নজর বুলালো। না, এই রুমে ও ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। নার্স ঔষধ লিখে আরও কিছুক্ষণ আগে এখান থেকে চলে গিয়েছে। তাহলে কি কথাটা ওকে উদ্দেশ্য করে বলল? ভ্রু কুঁচকে তাকায় আয়মানের দিকে। নাক ফুলিয়ে চওড়া গলায় বলে ওঠে,
” এই, কাকে বাবুর আম্মু বলছেন? আমাকে? ”
” আপাতত তুমি ছাড়া এখানে তো কেউ নেই। ”
” আপনার কি মাথায় আগে থেকেই সমস্যা? নাকি আমি মাথায় আঘাত করার পর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে? ”
আয়মান তাচ্ছিল্য গলায় বলল,
” আগে আমি একদম ঠিক ছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে আর ঠিক থাকতে পারছি না, বাবুর আম্মু। ”
” তখন থেকে কি বাবুর আম্মু, বাবুর আম্মু বলছেন! আমার তো এখনো বিয়েই হয়নি। বাবু আসবে কোথা থেকে? ”
আয়মান দুষ্টু হেসে বলল,
” তুমি চাইলে খুব শীগ্রই আমাদের বাবু চলে আসবে। শুধু বলো তুমি রাজি কি না? ”
” আপনার সাথে এসব ফালতু কথা বলার সময় আমার নেই। ব্যান্ডেজ করা হয়ে গিয়েছে। এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান। ”
আয়মান গোমড়া মুখে উত্তর দিলো,
” যা! এত তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেল? ব্যাপার না, চলো আমরা এক সাথে বসে কিছুক্ষণ কথা বলি। ”
” আমার আপনার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই। ”
বলেই রুম থেকে চলে যেতে উদ্যত হতেই আয়মান মেয়েটির হাত টেনে ধরল। মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” আমার হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়ুন। ”
আয়মান বেড থেকে নেমে বাঁকা হেসে বলল,
” রাশেদ শিকদারের ছোট ছেলে আয়মান শিকদারকে ভরা রাস্তায়, জনসম্মুখে মারার চেষ্টা করেছে এক যুবতী মেয়ে। আল্লাহর অশেষ কৃপায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে সে। আয়মান শিকদারের ভাষ্য মতে, সে মেয়েটির উপকার করায় মেয়েটি কোনো কারণ ছাড়াই তাকে হ*ত্যা করতে চেয়েছে। পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে রাশেদ শিকদারের ছেলে। এই হলো মেয়েটির ছবি। কেউ মেয়েটিকে চিনে থাকলে দ্রুত পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইল। একবার ভাবো, এতক্ষণ আমি যা যা বললাম এটা যদি কালকে নিউজে দেখানো হয় তাহলে কেমন হবে? ”
মেয়েটি ভড়কে গেল। বারকয়েক পলক ঝাপটালো। এই ছেলের মতিগতি ঠিক লাগছে না। শুষ্ক ঢোক গিলল। ভয়টা লুকিয়ে বেশ দাম্ভিক সহিত বলে ওঠে,
” এমন কিছুই হবে না। কারণ, আমি তো আপনাকে মারতে চাইনি। আপনি আমাকে থাপ্পড় মেরে ছিলেন বলে আমিও আপনাকে পাল্টা আঘাত করেছি। ”
” মারতে চেয়েছ কি চাওনি সেটা তো আর পাবলিক জানে না। পাবলিক তো সেটাই জানবে, যেটা আমি তাদেরকে জানাবো। আজকাল টাকাই কথা বলে, বুঝেছ? আর তোমাকে থাপ্পড় মেরেছিলাম তুমি আমার শার্টের কলার চেপে ধরেছিলে বলে। কেন ধরেছিলে? ”
মেয়েটি বুঝতে পারছে এই ছেলের বাবার অনেক ক্ষমতা। এর সাথে বেশি কথা না বাড়ানোই ভালো। মৃদু গলায় বলল,
” আমি ভেবেছিলাম আপনি একজন চাঁদাবাজ। ”
” হোয়াট! ”
” হুম। ”
আয়মান অবাক হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সম্মুখের মেয়েটির দিকে। গমগমে আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
” এরকম ভেবেছো কেন? আমাকে দেখে কি তোমার চাঁদাবাজ মনে হয়? ”
মেয়েটি ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিলো,
” না। তবে এখন অনেক মানুষ ভদ্রতার মুখোশ পড়ে চাঁদাবাজি করে তো তাই আর কি। ”
আয়মান ঠোঁট কামড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” ভুল যখন করেছ, তখন এর দামও তোমাকে দিতে হবে। ”
” মানে? ”
আয়মান মেয়েটির মুখের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলল,
” মানে, এখন আমি যা বলবো তোমাকে সেটা শুনতে হবে। যদি না শোন… ”
” যদি না শুনি। ”
আয়মান সটান হয়ে দাঁড়াল। রাশভারি গলায় বলল,
” না শুনলে একটু আগে যেটা বলেছি সেটা কাজের মাধ্যমে করে দেখাবো। ”
মেয়েটি তর্জনী উঁচিয়ে গমগমে গলায় জবাব দিলো,
” দেখুন… ”
আয়মান কথা কেড়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলল,
” দেখাও। ”
” আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। ”
” বাড়াবাড়ির তো এখনো কিছুই দেখোনি। আমার কথা না শুনলে সেটাও খুব শীগ্রই দেখতে পারবে। ”
মেয়েটি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
” বলুন, কি করতে হবে আমাকে। ”
” সো সুইট! এখন যা যা জিজ্ঞেস করবো সবকিছুর সঠিক উত্তর দিবে এবং আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তবেই তুমি নিজের বাড়িতে যাবে। ”
” এখন তো আপনি ঠিক আছেন। ”
” ভুল, আমি ঠিক নেই। একা একা বাসায় যেতে পারবো না। মাথা ঘুরে যদি পড়ে গিয়ে আবার ব্যথা পাই, তখন? তাই তোমাকেও সাথে যেতে হবে। তাছাড়া, তোমারো বাসাটা চেনা হয়ে যাবে। তবে আপাতত ভাসুরের বাসাটা চিনে রাখো? ”
মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” কি বললেন, ভাসুর? এখানে আবার ভাসুর আসলো কোথা থেকে?
আয়মান মেকি হেসে জবাব দিলো,
” কিছু বলিনি। আচ্ছা, তোমার নাম কি? বাসা কোথায়? কোন ক্লাসে পড়ো? ”
” বলবো না। ”
” বলতে তো হবেই। মনে আছে তো? আমার কথা না শুনলে! ”
মেয়েটি বিরক্তি নিয়ে বলে,
” আনিকা। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। সামনেই এক্সাম দিবো। আর বাসার ঠিকানা বলবো না। ”
আয়মান ঠোঁট কামড়ে হাসে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
” যতটুকু বলেছো, ইনাফ। বাসার ঠিকানা বলতে হবে না। আমি নিজেই খুঁজে নিতে পারবো। ”
” আপনি কেন আমাদের বাসা খুঁজবেন? ”
” সেটা এখন তোমার না জানলেও চলবে। দেরি হচ্ছে। চলো। ”
আনিকা সামনের দিকে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল। আয়মান ফের পিছু ডাকল। চোয়াল শক্ত করে তাকায় সে। আয়মান মিটিমিটি হেসে ব্যগ্র গলায় বলল,
” একা হাটতে কষ্ট হচ্ছে। তোমার সাপোর্ট দরকার।”
আনিকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। না চাইতেও আয়মানের এক বাহু আঁকড়ে ধরে হাঁটতে লাগলো। আয়মান বাহু ছাড়িয়ে আনিকার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। আনিকা কটমট করে তাকাতেই আয়মান জানায়,
” এভাবে তাকিও না, আমার লজ্জা লাগে। আর বাহু আঁকড়ে ধরায় ঠিক মতো হাঁটতে পারছিলাম না। এখন একদম পারফেক্ট। ”
আয়মান বাসায় পৌঁছে আনিকা’কে বিদায় দেওয়ার সময়ও মেয়েটা’কে জ্বালাতে ভুলল না। আয়মানের কপালে ব্যান্ডেজ দেখে মিনা অস্থির হয়ে পড়লেন। আয়মান মা’কে শান্ত করে বলল, হাঁটতে গিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে কপালে কিছুটা ব্যথা পেয়েছে। এখন সে ঠিক আছে। মিনা নিজ হাতে ছেলেকে ভাত খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলেন। আয়মান চলে গেল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। আগুন ভেবেছিল আয়মান’কে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিবে কিন্তু আয়মানের কপালে ব্যান্ডেজ দেখে আর রাগারাগি করল না। আয়মান, আগুনের রুমে এসে দেখে দরজা খোলাই আছে। তবুও একবার টোকা দিয়ে মৃদুস্বরে ডেকে উঠলো,
” ব্রো, ভেতরে আসবো? ”
আগুন গমগমে গলায় জবাব দিলো,
” না। ”
আয়মান হকচকিয়ে যায়। লেট করেছে বলে হয়তো ভাই রাগ করেছে। সাফাই দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই আগুন রুম থেকে বেরিয়ে দরজা আটকে দিলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমার সাথে আয়। মোম ঘুমাচ্ছে। রুমে কথা বললে, ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। ”
আয়মান চলল ভাইয়ের পিছু পিছু। আগুন ড্রয়িংরুমে এসে থামলো। সোফায় বেশ আয়েশ করে বসলো। আয়মান’কেও ইশারায় পাশে বসতে বলল। আয়মান বসলো। আগুন ভারিক্কি গলায় জানতে চাইল,
” যেই কাজটা করতে বলেছিলাম করেছিস? ”
” হুম। তুমি চিন্তা করো না। সঠিক সময় এসে পড়বে। তবুও তুমি একবার চাইলে রিসিভ করতে যেতে পারো। ”
” যাবো। তোর কপাল ফাটলো কিভাবে? ”
আয়মান থমথমে খায়। স্মিথ হেসে জবাব দিলো,
” তখন তো বলালম, হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। ”
আগুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রাশভারি কন্ঠে শুধাল,
” তুই শুধু হোঁচট’ই খাস? হোঁচট খেয়ে ড্রেনে পড়ে যাস, রাস্তায় পড়ে যাস। মেয়েরাও তো এতবার হোঁচট খায় না, তুই ছেলে হয়ে যতবার হোঁচট খাস! ”
আয়মানের মুখ’টা চুপসে গেল। কিছুটা অপমানিত বোধ করল। ভাই ওই পারে একমাত্র ওর রাস্তা ক্লিয়ার করে দিতে। তাই আর আগুনের থেকে কিছু লুকালো না। লুকানোর কি আছে? আজ না হোক কাল আগুন’কে তো জানাতেই হতো। আয়মান গড়গড় করে রাস্তায় আনিকার সাথে কিভাবে দেখা হয়েছে, কিভাবে কপালে আঘাত পেলো, হসপিটালে যাওয়া, তারপর আনিকার সাথে বাসায় আসা পর্যন্ত সবকিছুই খুলে বলল। কিছুই লুকায় নি। আগুন মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। আয়মান নিষ্পাপ মুখ করে ভাইয়ের নিকট আবেদন জানায়,
” ব্রো, আই রিয়েলি লাইক হার। আই থিংক, আই লাভ হার। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে চওড়া গলায় বলল,
” পছন্দ করেছিস মানলাম। কিন্তু আজকেই তো দেখা হলো। এই তো ঘন্টা খানিক হবে। এরই মধ্যে ভালোবেসে ফেললি? ”
আয়মান ঠোঁট উল্টে বলল,
” ভালোবাসতে হলে কি বেশি সময় লাগে নাকি? তোমার হয়তো অনেক সময় লাগতে পারে, আমার না। তুমি তো একটা নিরামিষ। নয়তো তোমাদের বিয়ের মাস পেরিয়ে গেল অথচ এখনো চাচ্চু ডাক শোনাতে পারলে না। আমাকে একবার বিয়ে করিয়ে দেখো। তোমার আগে যদি বাবা হতে না পেরেছি, তখন বলো। ”
আগুন ধমকে বলে উঠলো,
” লাগাম টেনে কথা বল, আয়মান। বড়ো ভাইকে এসব কথা বলতে লজ্জা করে না। ”
আয়মান ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে,
” লজ্জা লাগবে কেন? ছেলেদের লজ্জা থাকতে নেই। এতে নিজের’ই ক্ষতি। ”
আগুন বিরক্ত হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমার সামনে থেকে চলে যা। ”
আয়মান বুঝতে পারলো, আগুন রেগে যাচ্ছে। কিন্তু ভাই রেগে গেলে তো মহা মুশকিল। দেখা যাবে, তার সখের আনিকা হাত ছাড়া হয়ে গেল। তাই নত মস্তিষ্কে মাসুম চোখে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
” আচ্ছা, আর বলবো না। তবুও রাগ করো না। আমি তো তোমার ওই কাজটা করে দিয়েছি বলো? আবার বিকেলে ভাবি’কে নিয়ে শপিংমলেও যেতে হবে। ভেবো না আঘাতের ছুতো দিয়ে বাসায় বসে রেস্ট নিবো। ব্যথার মেডিসিন খেয়েছি। আমি এখন একদম ঠিক আছি। শপিংয়ে যেতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। ”
আগুন নিশ্চুপ রইল। আয়মান আমতা আমতা করে বলল,
” বলছিলাম কি, তোমার এই সারপ্রাইজ প্লানিং টা মিটে গেলে আনিকার ফ্যামিলির সাথে কথা বলে আমার একটা ব্যবস্থা করে দিও প্লিজ। ”
আগুন চোখ রাঙিয়ে তাকায়। আয়মান তড়িৎ গতিতে পুনরায় বলে ওঠে,
” আরে না! এক্ষুনি বিয়ে করতে চাচ্ছি না। আপাতত জাস্ট এনগেজমেন্ট করিয়ে দিলেই হবে। ”
আগুন এবার সিরিয়াস হয়ে জানতে চাইল,
” মেয়েটা জানে তুই তাকে পছন্দ করিস? ”
” না। ”
” মেয়েটা কি তোকে পছন্দ করে? ”
” আরে না। ও তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না, পছন্দ তো দূর! ”
আগুন ধমকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” মেয়েটা তোকে পছন্দ করে না। তুই তাকে পছন্দ করিস সেটাও জানে না। তাহলে এত তাড়াতাড়ি এনগেজমেন্ট কিভাবে হবে? মেয়েটা যদি রাজি না থাকে, তাহলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কখনোই তোদের এনগেজমেন্ট করাবো না। ”
আয়মান একটু ভেবে বলে,
” আনিকা যদি রাজি থাকে, তখন তো আর কোনো সমস্যা থাকবে না, তাই না? ”
” হুম। ”
” ঠিক আছে। আনিকা’কে রাজি করানো দায়িত্ব আমার। ও রাজি হয়ে গেলেই তুমি ওর ফ্যামিলির সাথে কথা বলবে। ওকে? ”
” দেখা যাক। আগে রাজি তো করা। পরেরটা পরে ভেবে দেখা যাবে। ”
আগুন উঠে দাঁড়ায়। ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করল নিজের রুমের দিকে। দরজা আটকে বিছানায় আসে। এখনো বেশ কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করা যায় বিকেলের মধ্যেই সকল কাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে। এখন একটু রেস্ট নেওয়া যাক। মোম ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে,
” ঘুম পাগলি বলে, ঘুম আসছে না। তাহলে এখন কে ঘুমাচ্ছে? মোম নয়তো কে? আমার বউ? ও হ্যাঁ, ছকিনার মা! না না, আমার হবু বাবুর আম্মু। ”
আগুন নিজের বোকা বোকা কথায় নিজেই কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল। নিজের বালিশ মোমের বালিশের সাথে মিলিয়ে মোমের শরীর ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। পেছন থেকে মোম’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাছে নিয়ে আসলো। এভাবে কিছু মুহূর্ত কাঁটার পর আগুন ঝুঁকে নিজের মুখটা মোমের মুখের কাছে আনলো। মোমের কোনো হেলদোল নেই। সে আরামে ঘুমাচ্ছে। মোমের মুখের সামনে আসা কিছু বেহায়া চুল গুলো আঙুল দিয়ে কানের পিঠে গুঁজে দিলো। এই চুল গুলোর প্রতি আগুনের ভীষণ হিংসা হচ্ছে। এই কোমল, নরম মুখে কেবল আগুনের ওষ্ঠের বিচরণ ঘটবে আর কারো আধিপত্য বিস্তার আগুন সহ্য করতে পারবে না। সেটা চুল হলেও না। এই বেহায়া চুল গুলো উড়ে এসে আগুনের বউয়ের মুখে কি সুন্দর তাদের জায়গা করে নিচ্ছে। এতে আগুন চরম বিরক্ত। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তপ্ত নরম ওষ্ঠপুট ছুঁয়ে দিলো মোমের মসৃণ গালে। গাঢ় করে একটা চুমু খেয়ে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সরিয়ে নিলো। মোমের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” বিয়ের পর তোমাকে নিজে থেকে কিছুই দেইনি, আমার কোমলমতি। এখন যেই সারপ্রাইজ গুলো দিবো, আশাকরি পুষে যাবে। যদিও মানুষের চাহিদার শেষ নেই। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমার সকল চাহিদা পূরণ করার। তবে এই সুখের পাশাপাশি তোমার কপালে দুঃখও আছে। তুমি তৈরী থেকো। ”
তোমার জন্য সব পর্ব ১৭
বলেই মোম’কে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে শুয়ে পড়ল। মানুষের জীবন একটি কঠিন চক্র। এই চক্র মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শেষ হবার নয়। এই কঠিন চক্রের বেড়াজালে থেকেই প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে বাঁচতে হয়। টিকে থাকতে হয় এই সাময়িক সময়ের জন্য আসা পৃথিবীতে। এই মানুষ গুলো ঘুমানোর আগে কতশত স্বপ্ন বুনে, সেথায় থাকে কত আকাঙ্ক্ষা। অথচ কখনো কখনো ঘুম ভাঙলে সেই সোনালী স্বপ্ন গুলো কালো অন্ধকারে ঢেকে সেখানে প্রতিস্থাপিত হয় কতশত বিষাদের ছায়া।