তোমার জন্য সব পর্ব ২০
রেহানা পুতুল
কন্ডিশন আর কন্ডিশন। হায়রে! বলুন।”
“বিষয়টা আমার পরিবার নিয়ে স্যার।”
” ওহ হো! সিউর কলি। প্লিজ।”
কলির মুখ ম্লান। দৃষ্টি আনমনা। কন্ঠ ভারি। সে বলতে লাগলো,
“স্যার যেহেতু এটা পারিবারিক বিয়ে। সেই সুবাধে অনেক কিছু না জানলেও কিছু বিষয় নিঃশ্চয়ই জেনে গিয়েছেন ইতঃপূর্বে।”
“কোন বিষয়ে কলি?”
“আমার পরিবারের বিষয়ে।”
“হ্যাঁ। আমাদের জন্য যতটুকু জানার প্রয়োজন ছিলো। ততটুকু আমরা জেনে নিয়েছি। এনাফ।”
“আপনাদের জন্য হয়তো এনাফ। আমাদের সিচুয়েশনে জানানো অত্যাবশ্যক।”
টেবিলের উপরে চোখ রেখে বলল কলি।
“প্লিজ কন্টিনিউ।”
মাহমুদ কলির মুখপানে চেয়ে ভারিক্কি গলায় অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“স্যার আমি মিডেল ক্লাস পরিবারের মেয়ে। বড় আপা অনার্স কমপ্লিট করেনি। সুপাত্র পেয়ে যাওয়াতে আব্বু আম্মু আপাকে পাত্রস্থ করে দেয় আগেপরে সব বিবেচনা করে। জুলি ছোট। নাইনে পড়ে। আমাদের কোন ভাই নেই। আব্বু গভর্মেন্ট জব করে। রিটায়ার্ড হয়ে যাবে এক বছর বাদে। তখন,আব্বু যে পেনশনের টাকা পাবেন,তা দিয়ে উনি একটা বিজনেস দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। এই বিষয়গুলো বিয়ে ঠিক হওয়ার বেশ আগেই আমাদের বাসায় ডিসকাসন হয়েছে। তো জব করা মানুষ তো হুট করে বিজনেস দাঁড় করাতে পারবে না। হিমশিম খেয়ে যাবে। তাই আব্বু,আম্মুর কথা, আব্বু ও আমি মিলেই যেন বিজনেস শুরু করি। অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক বিজনেসটা পুরোপুরি আমার হস্তক্ষেপে চলতে হবে। আব্বু অনেক সময় অসুস্থ থাকে। আর লোকও রাখবো একজন প্রয়োজন বুঝে।”
মাহমুদ কফি পান করতে করতে মনোযোগ সহকারে কলির কথাগুলো শুনলো। এবং বলল,
“আমার করণীয়?”
“আপনার কিছুই করতে হবে না। আমাকে সেই ফ্রিডম দিতে হবে। এটা চাওয়া আমার। বিয়ে পিছাতে চেয়েছি। তাতো আর হলো না।”
অনুযোগ করে চাপাস্বরে বলল কলি।
“আমি এবং আমার পরিবার এসব বেশ উপলব্ধি করতে পারি। কারণ আজ আমরা সমাজের শ্রেনীভেদে যে সচ্ছল অবস্থানে আছি। তা কেবল পরিশ্রম, সততা ও বুদ্ধির জোরে। সো এ নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন না। আপনার পরিবারের জন্য যা যা করতে চান, করবেন। আমি স্যাক্রিফাইস করতে জানি। বাসায় গিয়ে আজই জানিয়ে দিবেন এই বিষয়টা। কেমন?”
কলি ঈষৎ হাসলো।
“আন্তরিক ধন্যবাদ স্যার। খুব ভালোলাগছে এখন। এটা নিয়ে এই কয়দিন দ্বিধায় ছিলাম আমি।”
“বিয়ে পেছানোর মতো উপযুক্ত কোন হেতু খুঁজে পায়নি আমার ফ্যামেলি। তাই মামা ও বাবা পেছায়নি। কিন্তু আমি আপনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বিয়ে পিছাতে। সরি।”
“হুম। কচু! ঘোড়ার ডিম করেছেন।”
গোপনে বলল কলি।
” হুম। ওহ! এক মিনিট কলি। আপনার বিয়ে ঠিক হলো যেন কার সঙ্গে?”
সিরিয়াস মুডে জানতে চাইলো মাহমুদ।
কলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠলো। দোনোমোনো করতে করতে অপ্রস্তুত গলায় বলল,
“এটা কি ধরনের প্রস্ন হলো ?”
“প্রশ্ন প্রশ্নই। সেটা যেমনই হোক। জাস্ট আপনার হবু বরের নামটা জানতে আগ্রহী এই মন।”
“আমি জানি না। বাসায় গিয়ে জেনে জানাবো।”
“আমি জানিয়ে দিবো এখন?”
“আপনি জানলে আবার জানতে চাইলেন কেন?”
“আপনার মুখ থেকে শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো।”
“স্যার বাসায় যাবো। আম্মু চিন্তা করবে।”
মাহমুদ তার তিন আঙুলের ডগার পিঠ কলির কোমল গালের একপাশে উপর থেকে নিচে বুলিয়ে নিলো। থুতনির মাঝে এনে আঙুল থামিয়ে নিলো। রোমান্টিক চাহনিতে বলল,
“ফাঁকি দেওয়ার ধান্ধা আর নয়। অনেক ফাঁকিঝুঁকি দিয়েছেন। আম্মু একটুও চিন্তা করবে না। এডাল্ট মেয়ে। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। হবু বরের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করবে এটাই স্বাভাবিক। কলি হয়ে আর কতকাল থাকবেন? এবার ফুল হয়েতো ফুটুন। বিকশিত হোন সমস্ত অঙ্গসুরভি নিয়ে।”
কলির নাক মুখ দিয়ে যেন উষ্ণ ধোঁয়া বের হচ্ছে। কি করছে স্যার। এতো দেখি শিক্ষক বেশের আড়ালে কড়া ডোজের প্রেমিক।
একরাশ বিরক্তি ভর করলো কলির মুখশ্রীতে। সে না পেরে ঠনঠনে গলায় বলল,
“বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার চান্স থাকে শতভাগ। এটা বোধহয় আপনি জানেন না?”
মাহমুদের ভিতর থেকে রোমান্টিকভাব মিলিয়ে গেলো। চোখ থেকে চশমা খুলে নিলো। কাঠিন্য সুরে বলল,
” আল্টিমেটাম দিচ্ছেন মনে হয়?”
“ধরে নিন তাই। সময়ের কাজ অসময়ে করতে চান কেন? আপনি আমার জন্য পর পুরুষ। ভুলে যাবেন না।”
“কি করলাম আমি?”
নিরস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।
“কি না করলেন? হাত ধরে ফেললেন, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। গালে,চিবুকে হাত দিলেন।”
লজ্জাবনত কন্ঠে দৃষ্টি নামিয়ে বলল কলি।
মাহমুদের জেদ হলো। সে ফের কলির গলা বরাবর চার ইঞ্চি নিচে বুকের উপরে চার আঙ্গুল রাখল। গম্ভীর মুখে ও কন্ঠে বলল,
“বুকের উপরে হাত রেখেছি এটা বলতে ভুলে গেলেন? পর পুরুষ আমি? ওকেহ! যেদিন থেকে আপন পুরুষ হবো,সেদিন থেকেই ছোঁবো। আমি আপনার ছায়াও মাড়াবো না আর। মাইন্ড ইট। পারিবারিক বিয়ে পারিবারিক নিয়মেই হবে। তার আগে না আমি আপনাকে চিনি। না আপনি আমাকে চিনেন। বেস্ট অফ লাক। আসতে পারেন আপনি। বাই।”
মাহমুদ উঠে গেলো নিমিষেই। বিল মিটিয়ে বের হয়ে গেলো গমগমে পায়ে। কলিও তার মতো করে বের হয়ে বাসায় চলে গেলো।
দুই পরিবার নিজেদের মতো করে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাহমুদের পরিবারের তেমন সমস্যা না হলেও বিপাকে পড়ে গেলো কলির পরিবার। নুরুল হল ব্যাংক থেকে লোন নিলেন গ্রামের হাউজ প্রোপার্টি দেখিয়ে। মাসিক কিস্তিতে শোধ করতে হবে। কিন্তু করবেন কিভাবে? তা ভেবেও দিশেহারা। রেবেকা স্বামীকে আস্বস্ত করলেন। বললেন,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমার যে ব্যংকে ডিপোজিট আছে। সেটা ক্লোজ করে ফেলব। সেই টাকা দিয়ে লোন নেওয়া ব্যাংকের কিস্তি দিতে পারবেন। আমার এই টাকায় যদি দরকার সারতো তাহলেত লোন নিতেই হতোনা।”
রেবেকা উঠে গেলো অন্যদিকে। নুরুল হক ভিতরে নরম হয়ে গেলেন রেবেকার জন্য। আজকাল রেবেকার মাঝে স্থিরতা ও ধৈর্যতা চোখে পড়ার মতো। সামান্যতেই হই হই আর হায় হায় করে উঠা রেবেকা কেন এত শান্ত হয়ে গেলো? কি হয়েছে রেবেকার? যারজন্য রেবেকার এই প্রকাশ্য পরিবর্তন? নুরুল হক উত্তর খুঁজে পেলনা।
মাহমুদ ক্লাসে কলির সঙ্গে একাডেমিক বিষয়েও কোন কথা বলে না। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আজকাল মাহমুদের ভাবখানা এমন, যেন কলিকে সে চেনেই না। অথচ মাত্র কটা দিন পার হলেই এই মেয়ের সঙ্গে তার বাসর উদযাপন হবে। হবে স্মরণীয় রাত্রি যাপন।
কলির সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। মাহমুদ অন্যদের বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কলির বেঞ্চের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না। যদিও প্রয়োজন হয়। তখন বরাবরের মতো শিক্ষকসুলভ আচরণ করে কলির সঙ্গে। মাহমুদের একরোখা মনোভাব কলির চেনা। তবুও তা নিয়ে কলির মাঝে বিশেষ হেলদোল পরিলক্ষিত হলো না। পরিক্ষা শেষ হলো। রেজাল্ট প্রকাশ হলো যথাসময়ে। কলি ধরে নিলো মাহমুদ তাকে ইচ্ছে করে মার্ক কমিয়ে দিবে। কিন্তু না। সে খুব ভালো রেজাল্ট করলো তার দুই বিষয়ে।
দিন ফুরিয়ে গেলো। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। দু’পক্ষের সমঝোতায় গায়ের হলুদের স্টেজ তৈরি হলো। কলি + মাহমুদের গায়ে হলুদ। কলি খুব চেয়েছে গায়ে হলুদে বর না আসুক। দুই পক্ষ আলাদা আলাদাভাবে গায়ে হলুদ করবে।
কিন্তু বরপক্ষ মানল না। বিশেষ করে বরের ছোট বোন আনুশকা। গায়ে হলুদের স্টেজে মাহমুদ চুপচাপ রইলো। একইভাবে কলিও। দুজন দুজনের সঙ্গে কোন কথা বলল না। দৃষ্টি বিনিময় করল না। অন্যরা ভেবে নিলো দুজন টিচার স্টুডেন্ট বলে সংকোচে ও ,ভদ্রতা বজায় রেখে চুপ হয়ে আছে।
কিন্তু তা নয় আদৌ। তারা দুজন জানে কেন এমন নিরবতায় চাদরে জড়িয়ে গেলো তারা। একজনের অসন্তোষজনক বিহেভিয়ার ও বাকিজনের একরোখা মনোভাবের স্বচ্ছ প্রতিফলন এটা।
ফটোগ্রাফারের অনুরোধে কিছু পোজ দিতে হয়েছে মাহমুদ ও কলিকে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান নাচে গানে শেষ হয়ে গেলো। মাহমুদ উঠে চলে গেলো বাসায়। কলির সঙ্গে সে টু শব্দটিও করল না। কি ভেবেছে কলি তাকে। সে ইমশোনকে কন্ট্রোল করতে পারবে না? প্রয়োজনে মানুষকে অনেক কিছুই পারতে হয়। তাই সেও পেরে যাচ্ছে। কলিও মনে মনে বলল,
“বেশ হয়েছে। আমি দারুণ মজা পেয়েছি। দু ‘বাক্যে কিছুদিনের জন্য স্টপ করিয়ে দিতে পারলাম। বাহ! আমার কথারও তো দেখি হেবি জোর আছে। শালা মাহমুদ। কি পেয়েছো। হুহ্!”
উৎসবে, আমেজে, বর্ণিল আলোকসাজে,ভরপুর খাওয়া দাওয়ায় মাহমুদ ও কলির বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো। বিয়ের দিনেও কলি ও মাহমুদ কোন বাক্য বিনিময় বা খুনসুটি আলাপে মগ্ন হয়নি। আগের দিনের মতই ফটোশেসনের জন্য কিছু ক্লোজলি পোজ দিতে হয়েছে কলির সঙ্গে।
ইট কাঠের নগরীর মধ্যরাত। হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক লাইট জ্বলছে। রুমভর্তি আলোর ঢল। শতপুষ্পরাজিতে সজ্জিত মাহমুদের বেডরুম। কলি একহাত ঘোমটা টেনে বধূবেশে বসে আছে মাহমুদের বিছানায়। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিতর থেকে দরজা চাপানো।
হাট করে দরজা খুলে মাহমুদ রুমের ভিতরে প্রবেশ করলো। ইচ্ছে করেই সে এমন করেছে। কলির হার্টবিট কি পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে আজ সে দেখবে।
কলির কলিজা শুকিয়ে গেলো। প্রাণ বুঝি উড়ে যায়। ভয়ে,আড়ষ্টতায় জুবুথুবু হয়ে যাচ্ছে সে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি এত প্রবলতর হচ্ছে, মনে হয় এক্ষুনি ছিঁড়েপুড়ে বেরিয়ে আসবে।
মাহমুদ দরজার খিল লাগিয়ে দিলো ভিতর থেকে। এগিয়ে গিয়ে বিছানার সামনে কলির মুখোমুখি দাঁড়ালো।
প্রেমিক কন্ঠে শুধালো,
তোমার জন্য সব পর্ব ১৯
“কলিইই কেমন আছেন?”
“হ্যাঁ.. জ্বিইই…স্যার..একটু..একটু পানি হবে?”
গহীন গুহায় আটকে পড়া বিপথগামী মানুষের মতো ভীত কম্পিত স্বরে অনুনয় করে বলল কলি।