তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ১৯
নওরিন মুনতাহা হিয়া
ইনায়া যখন উপলব্ধি করতে পারে ফোনের ওপর পাশে থাকা মানুষ যে নিশব্দে দাঁড়িয়ে আছে সে আর কেউ না ইভান। তখন তার সারা শরীর পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে তার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এক বিন্দু জল। প্রায় সাতদিন পর ইনায়া আজ প্রথম ইভানের কণ্ঠ শুনছে তার মনের ভিতরে হাজারো সৃতি ঘুরঘুর করছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তার মনে পড়ে যায় বিয়ের দিনের ঘটনা। ইনায়া নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে
“- ইভান ভাই আপনি হঠাৎ ফোন করেছেন কেনো? নিজের জীবনের সবচেয়ে ঘৃণিত নারীকে বিদায় দিয়ে নিশ্চয়ই অনেক সুখে আছেন? বলেন না ইভান ভাই আমার বিদায়ে আপনার আত্মা ঠিক কতটা সন্তুষ্ট হয়েছে?
ইনায়ার কথা শুনে ইভান এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তার হঠাৎ করে ফোন দেওয়ার কারণ কি ইনায়া সত্যি উপলব্ধি করছে পারছে না? ইভান ইনায়াকে ঘৃণা করে বড্ড বেশি অপছন্দ করে তবে কেনো আজ ইনায়ার কণ্ঠ শুনে তার মনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। যাকে নিজের জীবন থেকে হাসি মুখে বিদায় দিয়েছে তার কণ্ঠে নিজের নাম শুনে এতো শান্তি কেনো লাগছে ইভানের। তার জীবনে ঘটে যাওয়া সকল কেনো র উত্তর কি দিতে পারবে ইভান?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইনায়ার বিয়ের পর থেকে ইভানের জীবনে সব সুখ হারিয়ে গেছে শুধু মস্তিক জুড়ে ঘিরে আছে ইনায়ার সৃতি। তার রাতের ঘুমের মধ্যে সপ্নে জুড়ে শুধু থাকে একজন মানুষ তার নাম ইনায়া। ইভান কি সত্যি ইনায়াকে গভীর ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে নিজের মনের ঘৃণা আড়ালে ইনায়ার জন্য মায়া জমিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন কি হাজার জনম ত্যাপসা করে ও ইনায়াকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে? ইভানের ভাবনার মাঝে ইনায়া আবার তাকে পুনরায় ডাক দেয় যার কারণে হুঁশ ফিরে আসে। ইভান বলে –
“- ইনায়া কেমন আছেন আপনি? স্বামী সংসার নিয়ে নিশ্চয়ই খুব সুখে শান্তিতে দিন কাটছে আপনার?
ইভানের কথা শুনে ইনায়ার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে সুখ শব্দটা কি তার ভাগ্য আছে? জীবন শুধু তাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছু উপহার দেয় নাই। যাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসে পনেরো বছর অপেক্ষা করেছে সে তাকে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। নিজের ভালোবাসার দহনে পুড়িয়ে অন্য কারো হাতে তুলে দিয়েছে। অবশ্য ইভান কি বুঝতে ইনায়ার কষ্ট সে তো কখনো ইনায়াকে ভালোবাসে নাই। সারাজীবন ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে রেখেছে মিথ্যা অপরাধে দোষী করে তার জীবন থেকে ছুড়েঁ ফেলে দিয়েছে।
ইনায়ার চোখ বেয়ে পড়া জল এক হাত দিয়ে মুছে নেয় বুকে কষ্ট জমিয়ে রেখে মুখে হাসি নিয়ে বলে –
“- অবশ্যই ইভান ভাই স্বামী সংসার নিয়ে অনেক সুখে দিন কাটছে আমার? বিশ্বাস করেন ইভান ভাই এই ইনায়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এতো সুখ উপর ওয়ালা আমার ভাগ্য কেনো দিলেন বলেন তো ইভান ভাই। অতিরিক্ত সুখ ইনায়ার কপাল যে সয্য হয় না “।
ইনায়ার কথা শুনে ইভান কথা না বলে শান্ত হয়ে যায় অন্যদিকে ইনায়া নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। ইনায়া নীরবে কান্না করে তবে কার কণ্ঠে কেনো কান্নার আওয়াজ হয় নাই। কারণ ইনায়া অনেক আগেই বুকে কষ্ট জমিয়ে রেখে মুখে হাসি নিয়ে কথা বলা আর শব্দ ছাড়া কান্না করা শিখে গেছে। ইনায়া বলে –
“- তবে ইভান ভাই আপনি কি শুধু আমার সুখের সংসারের গল্প শোনার কথা জানার জন্য ফোন করেছেন? হঠাৎ করে আমার বিষয়ে জানার এতো আগ্রহ কেনো আপনার?
“- না মানে আসলে ইনায়া আপনার সংসার কেমন চলছে তা জানার জন্যই কল দিয়েছি।অরণ্য খুব ভালো ছেলে নিশ্চয়ই ও সাথে আপনি ভালো থাকবেন ইনায়া “।
“- কি অদ্ভুত বিষয় তাই না ইভান আপনি আমার ভালো চাইলেন কিন্তু আমাকে চাইলেন না। আর ইভান ভাই আমার স্বামী অরণ্য যথেষ্ট ভালো মানুষ। ভাগ্য করে এমন জীবনসঙ্গী পাওয়া যায় ওর সাথে আমি অনেক ভালো আছি।
“- আপনি অরণ্যকে ভালোবাসেন তাই না ইনায়া?
“- ইভান ভাই ভালোবাসা কখনো শখ বা বিলাসিতা নয়, ভালোবাসা হচ্ছে একটি মানুষের প্রতি নিশ্বার্থ অনুভূতি “।
ইনায়ার মুখে অরণ্যর নাম শুনে ইভানের বুকের ভিতরে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেটা সে মুখে প্রকাশ করে নাই শুধু চুপচাপ শুনে যায় নিজের প্রিয়তমার কণ্ঠে অন্য পুরুষের নাম। যাকে নিজের হাতে অন্যর অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়েছে তার জন্য কান্না করা মানায়। ইনায়া আজ অরণ্যর বউ এই বাস্তব কথাটা ইভানের কাছে মৃত্যু সমতূল্য। ইনায়াকে অন্য কারো সাথে দেখার আগে তার যদি মৃত্যু হতো তাহলে ও এতো কষ্ট হতো না। ইভান আর শুনতে পারল না ইনায়ার আর অরণ্যর সুখের সংসারের গল্প। ইভান ফোন রেখে দেওয়ার আগে ছোট করে বলে –
“- বিদায় ইনায়া আজ আর আপনার স্বামী ভালোসার গল্প শুনার আগ্রহ নাই। সারাজীবন সুখে শান্তিতে সংসার করবেন যদি সময় হয় তাহলে না হয় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন “।
ইভান আর ইনায়ার উত্তরের অপেক্ষা করে নাই সে ফোন কেটে দেয়। ইভান ফোন বিছানায় ছুড়েঁ মারে এরপর জীবনের বাস্তবতা থেকে টার্য়াড হয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। তার বুকের বা পাশে বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে এই ব্যাথার কি কেনো ঔষধ আছে। আর কে এই ব্যাথার ঔষধ লাগিয়ে দিবে তাকে যে ছিলো সে তো আজ অন্য কারো। কেনো আজ এতো পীড়া হচ্ছে তার এক অজানা দহনে সমগ্র দেহ মন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা কি এতো কষ্ট দেয় মানুষকে?
অন্যদিকে ইনায়া ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইভান ফোন রেখে দিয়েছে যা দেখে সে হাসে। ইনায়ার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল সযত্নে মুছে নেয়। ইনায়া মনে মনে বলে –
“- মূল্য দিয়ে অমূল্য বানিয়ে মূল্যহীন মানুষ বানিয়ে দিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছেন সুখে আছি কি না? কি এমন হতো ইভান যদি পৃথিবীর সব নিয়ম ভেঙে আপনি আমার হয়ে যেতেন। শুধু ঘৃণা না করে ভালোবেসে আগলে রাখতেন তাহলে আজ আমি আর আপনি বাস্তবতা মেনে নিয়ে একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতাম না। কেনো ভালোবাসলেন না আমাকে ইভান ভাই কেনো?
ইনায়া নিজের মনে মনে বলা কথাটা বলে ফুপিয়ে কান্না করে দেয় এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে অল্প সময় নিজের সাথে কাটায়। ইনায়া মনে হয় হঠাৎ করে পিছনে ছায়ার মতো কেউ এতোখন দাঁড়িয়ে ছিলো কিন্তু ভালো করে খেয়াল করে দেখে সেখানে কেউ নাই। নিজের মনের ভুল ভেবে ইনায়া আর এই বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর ইনায়া রুমে এসে দেখে অরণ্য মাএ ঘুম থেকে উঠেছে যা ওর চোখ মুখে ফুলা ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে অরণ্য বলে –
“- ইনায়া আপনি কখন ঘুম থেকে উঠলেন? আর আপনার চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো? যেনো মনে হয় অনেক সময় ধরে কান্না করেছেন? কিছু কি হয়েছে আপনার?
অরণ্যর কথা শুনে ইনায়া বুঝতে পারে কান্না করার জন্য তার চোখ মুখ ফুলে গেছে। কিন্তু অরণ্যকে সত্যি কথা বলা যাবে না তাই সে বলে –
‘- না অরণ্য এমন কিছু না আসলে অনেক সময় ঘুমিয়ে ছিলাম যার জন্য এমন হয়েছে। আপনি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসেন আমি আপনার কফি নিয়ে আসছি “।
ইনায়া কথাটা বলে অরণ্যর সামনে থেকে চলে যেতে চাই ঠিক তখন ওর হাত শক্ত করে ধরে ফেলে অরণ্য। অরণ্য হাতে টান দিয়ে ইনায়াকে নিজের খুব নিকটে নিয়ে আসে। অরণ্যর এমন কাণ্ডে অবাক হয়ে যায় অরণ্য ইনায়ার গালে আলতো করে ছুয়েঁ দিয়ে বলে –
“- ইনায়া আপনি আমাকে ঘৃণা করেন বড্ড বেশি ঘৃণা করেন। আমার কেনো অভিযোগ নাই কিন্তু প্রমিজ করেন কখনো ছেড়ে চলে যাবেন না আমাকে। বিশ্বাস করেন ইনায়া এই অরণ্য আপনাকে ছাড়া বাচঁবে না।
অরণ্যর কথা শুনে ইনায়ার চোখ যায় অরণ্যর চোখে জমে থাকা পানির দিকে। অরণ্যর চোখে পানি কেনো তাহলে কি অরণ্য শুনে ফেলেছে ইভান আর ইনায়ার কথা। ইনায়া তার গালে থাকা অরণ্যর হাতের উপর নিজের হাতের ছোঁয়া দেয় এরপর বলে –
“- অরণ্য মেয়েদের বিয়ের পর স্বামী তার সবকিছু। আপনি আমার স্বামী আর আমি আপনার বিবাহিত স্ত্রী। আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাবো আমি।
“- ইনায়া আমার ভালোবাসার মানুষ সবসময় দূরে চলে গেছে আমার গর্ভধারণী মা ও আমাকে ঘৃণা করে। সবার ঘৃণা সয্য করে আমি বেঁচে আছি কিন্তু আপনার থেকে দূরে গেলে আর বাঁচতে পারব না।
“- হুম আমি জানি অরণ্য। আচ্ছা এখন ইমোশনাল কথা বাদ দিয়ে ফ্রেশ হন আমি কফি নিয়ে আসছি “।
অরণ্য ইনায়ার যাওয়ার দিকে অল্প সময় তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। অন্যদিকে ইনায়া রুম থেকে বের হয় একটু দূরে গিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।ইনায়া মনে মনে বলে –
তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ১৮
“- অরণ্য আমাকে মাফ করে দিবেন হয়তো এই জীবনে আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু কখনেন ছেড়ে ও যাবো না আপনি আমার স্বামী অরণ্য। নারীর জীবনে অতীত থাকতে হয় না যা থাকে তা হলো বর্তমান।
” অতীত থাকা দোষে কিছু না কিন্তু অতীতে পড়ে থাকা ঠিক না “।