তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৭
নওরিন মুনতাহা হিয়া
রাত প্রায় নয়টা, আকাশে থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। সূর্যের রোদে যখন সমগ্র শহর জ্বলসে যাচ্ছে, তখন শান্তির পরশ হয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছে। ঢাকা গাজীপুর শহরের একটা রাস্তায় গাড়ির দুঘর্টনা হয়েছে। গাজীপুর জনবহুল এলাকা থাকার কারণে, এখানে দুর্ঘটনা ঘটনার সাথে সাথে লোকজনের ভিড় মানে। শহরের সবচেয়ে বড়ো বিজনেস ম্যান অরণ্য রাজ চৌধুরী আজ রাত দুইটার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে এডমিট হয়েছে। শহরের প্রতিটা সংবাদ মাধ্যম আর গণমাধ্যমে এখন এই কথা ভাইরাল। ঘটনা স্থলে পুলিশ সহ হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে গেছে। পুলিশ তার উদ্ধারকারী সংস্থার লোক দিয়ে গাড়ির ভিতর থেকে অরণ্যর রক্তাক্ত দেহ বের করে আসছে। অরণ্যর মাথা থেকে রক্ত যেনো নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। তার সমস্ত শরীর জুড়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে, তার হাতে পায়ে সহ শরীরের অনেক অংশ ছুলেঁ গেছে।
উদ্ধারকারী সংস্থা অরণ্যর শ্বাস নিশ্বাস চেক করার জন্য, নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে দেখে। জীবিত রয়েছে, তবে ওর শরীর থেকে আর মাথা থেকে যেমন করে রক্ত পড়ছে। যদি এখুনি ব্লাড যাওয়া বন্ধ না হয়, তাহলে তাকে বাঁচানো অসম্ভব। প্রায় তিরিশ মিনিট আগেই তার এক্সিডেন্ট হয়েছে, হঠাৎ করে ট্রাক এসে জোরে তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। যার কারণে অরণ্যর মাথা গাড়ির সামনের অংশের সাথে লাগে, আর গাড়ি উল্টো যাওয়ার কারণে তার পায়ে বা হাতে ব্যাথা পায়। অরণ্যর মাথার এতো আঘাত পেয়েছে যার কারণে তার বাঁচা প্রায় অসম্ভব। যদি অরণ্য বেঁচে যাও হয় সে সারাজীবন কোমায় থাকবে না হয় প্যারালাইসেস হয়ে যাবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স চলে আসে, অরণ্যর নিথর দেহ সেখানে উঠানো হয়। তার মুখে দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক লাগলো হয়, এম্বুলেন্স থাকা ডক্টর তার পার্লস চেক করছে বারবার। মাথা থেকে রক্ত বের হওয়া এখনো বন্ধ হচ্ছে না, শরীরে অন্য সব জায়গা থেকে ও রক্ত পড়ছে। অরণ্যর অবস্থা কতটা খারাপ, তা হয়তো ডক্টর নিজে ও বলতে পারবে না। প্রতি মূহুর্তে শরীরের অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে, তার শরীর ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যাচ্ছে। এম্বুলেন্স অবস্থিত একজন বলে –
“- স্যার অরণ্য রাজ চৌধুরী কি অবস্থা?
“- অবস্থা ভালো না। যদি আমার সন্দেহ ঠিক হয়, তবে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ওনার মৃত্যু হবে “।
শহরের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী অরণ্য রাজ চৌধুরী, প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনে তার নাম ছাপে। মাএ পঁচিশ বছর বয়সে, তার ব্যবসায়িক দক্ষতা, বুদ্ধি আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অরণ্যর শ্বাস নিশ্বাস উঠা নামা করছে, জীবনের প্রতিটা পুরুষের সপ্ন থাকে তার পরিবার সন্তান নিয়ে ছোট একটা সংসার গড়ে তুলার।অরণ্যর এতো সৌভাগ্য কখনো ছিলো না, তার জীবনে সুখ কথাটা খুব একটা সয্য হয় না। তবে তার জীবনে ইনায়ার আগমনের পর সে সুখের সপ্ন দেখেছে, ভালোবাসার মানুষের সাথে সারাজীবন থাকার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু এক ঝড়ে সব শেষ হয়ে গেছে তার জীবন থেকে।
গ্রামে থাকা অবস্থায় অরণ্য একবার বলে ছিলো সে অভাগা কথাটা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। ছোটবেলা বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে, বিনা অপরাধে মায়ের ঘৃণার কারণ হয়েছে। বোনের সাথে দুরত্ব তৈরি হয়েছে। তবুও তার প্রতি থাকা সকলের অভিযোগ মেনে নিয়েছে। তার জীবনে হঠাৎ করে আসা ঘূর্ণিঝড়ের মতো আগমন হয়ে ছিলো এক রমণীর যার নাম ইনায়া। প্রায় অনেক সময় তার সাথে শএুতার সম্পর্ক ছিলো তার। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার সাথে বিয়ে হয় অরণ্যর। বিয়ে বাড়ির সকলের সামনে কবুল বলে শএু থেকে বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা দেয় সে। প্রতৈকে তার শএুর সাথে খারাপ কথা বলে, তাকে আঘাত করে বিয়ের আগে অরণ্যর পরিকল্পনা ছিলো এমন কিছু করার।
কিন্তু বিয়ের দিন যখন প্রথমবার লাল শাড়ি পড়া বধূ বেশে রূপবতী কন্যাকে দেখেছে। তার মুখ থেকে তিনবার কবুলের মতো পবিত্র ধ্বনি শুনেছে। যখন তার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার বাড়িতে প্রবেশ করেছে৷ তখন শএুর প্রতি থাকা সমস্ত ঘৃণা তার মন থেকে মুছে গেছে, শুধু সামনে হাত ধরে থাকা মানুষটাকে বউ মনে হয়েছে। যার কান্না করা অশ্রু ঝরা দুই আঁখি, তার পড়নে বেনারসি, আর তার নিষ্পাপ মুখ সব অরণ্যর মনে মুগ্ধতা তৈরি করছে। প্রথমবার কোনো নারীর চোখ তাকে আর্কষিত করেছে, তার মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অরণ্য।
ভাগ্যের কি নিরর্মম পরিহাস, শুধু জীবনে এইটুকু সুখের কামনা করেছে সে তাও পূর্ণ হলো না। নিজের প্রিয় শএুর সাথে ঘর বাঁধা হলো না, তার মুখ থেকে একবার ভালোবাসি শব্দ শুনার ইচ্ছা পূর্ণ হলো না। রাতের আকাশে নিজের প্রিয়তমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকার সৌভাগ্য আর বুঝি এই জন্মে তা হলো না। অরণ্যর শ্বাস নিশ্বাস দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, সে দ্রুত গতিতে নিশ্বাস নেওয়ার কারণে তার বুক উঠানামা করছে। এম্বুলেন্স থাকা ডক্টর অরণ্যর হাতের পার্লস চেক করে সামান্য ভয় পেয়ে তার পাশে থাকা লোককে বলে –
“- অ– অরণ্য “।
চৌধুরী বাড়িতে অরুণা বেগম আর মিলন সাহেব খাওয়া দাওয়া শেষ করেছে মাএ। প্রায় প্রায় নয়টা বেজে তিরিশ মিনিট, মিলন সাহেব খাবার খাওয়া শেষ করে ছোফায় দিয়ে বসলেন। আজ রাত আটটার খবর শুনা হয় নাই, তবে সাড়ে নয়টার সময় আর কি খবর শুনবে। তবুও ওনি টিভি অন করলেন, খববের চ্যানেলে গেলেন খবর শুনবে বলে। অন্যদিকে অরুণা বেগম টেবিল থেকে সকলের এটো খাবার রান্না ঘরে নিয়ে রাখছেন। অরুণা বেগম যখন খাবারের প্লেট হাতে নিলেন, তখন মিলন সাহেব মাএ খবের চ্যানেলে লেগেন। খবরের চ্যানেলে যাওয়ার সাথে সাথে একজন বলে উঠে –
“- ব্রেকিং নিউজ আজ রাত নয়টার সময় গাজীপুর শহরে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। শহরের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী অরণ্য রাজ চৌধুরী। পুলিশ গাড়ির ভিতর থেকে তার দেহ বের করেছে, তবে পুলিশের কথা অনুসারে বর্তমানে অরণ্য রাজ চৌধুরীর অবস্থা খুব খারাপ। দুর্ঘটনায় ওনার মাথা থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে।
টিভিতে থাকা লোকের মুখে অরণ্য রাজ চৌধুরীর নাম শুনে অরুণা বেগমের হাত থেকে খাবারের থালি পড়ে যায়। মিলন সাহেব ছোফা থেকে উঠে বসে পড়ে, অরুণা বেগম টিভির দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে অরণ্য রাজ চৌধুরী নামটা জ্বল জ্বল করছে। এবং অরণ্যর ছবি রয়েছে, অরুণ মা বেগম পাশে থাকা চেয়ার শক্ত করে ধরে বলে –
“- মিলন অরণ্য “।
মিলন চৌধুরীর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এমন হঠাৎ করে অরণ্যর এক্সিডেন্ট হয়ে যাওয়ার কথা শনে ওনি সম্পূর্ণ শকড। নাতাশা সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে, সে তাড়াতাড়ি করে ইভানের রুমের দিকে ছুটে যায়। রুমের মধ্যে অন্ধকার করে বসে আছে ইভান, হঠাৎ দরজার মধ্যে কারো শব্দ শুনে ইভান বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়৷ বাহির থেকে নাতাশার কণ্ঠ শুনা যাচ্ছে, ইভান বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে। সে নাতাশাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই নাতাশা হাঁপাতে থাকে বলতে থাকে –
“- ইভান ভাইয়া, অরণ্য ভাই এক্সিডেন্ট করছে। ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো না, বাঁচবে কি না সন্দেহ রয়েছে “।
হঠাৎ করে নাতাশার কথা শুনে ইভান অবাক হয়ে যায়, এরপর যখন বুঝতে পারে অরণ্য এক্সিডেন্ট করছে তখন সে বলে উঠে –
“- হেয়াট “।
ইভান নাতাশার সাথে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে যায়, অরণ্যর সাথে তার শএুতা রয়েছে কারণ সে ইনায়ার স্বামী। কিন্তু অরণ্যর সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে ইভানের,। তার ছোট চাচার ছেলে অরণ্য, তার ছোট ভাই। অরুণা বেগম আর মিলন সাহেব সময় নষ্ট না করে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ে। খবরে বলা হয়েছে অরণ্যকে সিটি হাসপাতালের উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
হাসপাতাল রোডের দিকে এক গাড়ি চলছে, যার মধ্যে একজন নারী কান্না করে যাচ্ছে। অন্যজনের হাত পা অনবরত কাঁপছে সে আর কেউ না ইনায়া। তার গলা শুকিয়ে আসছে, বুকের ভিতর ভয় জমা হয়েছে। গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে, পাশের সিটে রেহানা বেগম কান্না করছে। মা তার সন্তানের প্রতি যতো রাগ করে থাকুক, তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেখ। তবুও সে সন্তান, ইনায়া যখন অরণ্য বলে চিকৎকার দেয় তখন রেহানা বেগম ছুটে যায় তার রুমে। এরপর গাড়ি থেকে বের হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্য, সায়মা এখনো কিছু যানে না। তার এই অবস্থায় এখন যদি অরণ্যর এক্সিডেন্টের কথা শুনে তবে সে উত্তেজিত হয়ে যাবে। যা তার সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।
ইনায়ার হাত পা ভীষণ কাঁপছে, সে বারবার ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আজ রাস্তা যেনো শেষ হচ্ছে না, কখন যে সে হাসপাতালে পৌঁছে অরণ্যকে দেখবে সে আর অপেক্ষা করঅে পারছে না। ইনায়ার সমস্ত শরীর পাথর ন্যায় হয়ে যাচ্ছে, রেহানা বেগম কান্না করছে কিন্তু তার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। ভাগ্যার উপর তার করুণা হচ্ছে, কি অদ্ভুত তাই না ছোটবেলা একটা মানুষের জীবন থেকে সব কেঁড়ে নিয়ে ও শান্তি হলো না তার ভাগ্যের। কিন্তু যদি এইবার অরণ্য তার জীবন থেকে চলে যায়, তাহলে সে কি করে বাঁচবে। অরণ্য ছাড়া ইনায়ার কোনো অস্বস্তি নাই।
[ প্রায় রাত ১০ : ০০]
হাসপাতালে এসে গাড়ি থামে ইনায়ার, চৌধুরী বাড়ির সকল সে পৌঁছায় একই সময়। অরুণা বেগম আর রেহানা বেগমের মধ্যে আগে দেখা হয় নাই,বউভাতের অনুষ্ঠানেন দিন রেহানা বেগম রুমে ছিলেন। তবুও রেহানা বেগমের কান্না থামাতে অরুণা বেগম তার কাছে যায় তাকে সান্তনা দেয়। ইনায়া, ইভান, মিলন সাহেব, আর নাতাশা হাসপাতালের ভিতরে চলে যায়। হাসপাতালে একজন ডক্টর কেবিন থেকে বাহির হয়েছে, ইনায়া তার কাছে ছুটে যায় আর বলে –
“- গাজীপুরে একটু আগে যে এক্সিডেন্টে হয়েছে সেই রোগীর কি অবস্থা? ওনাকে কোন কেবিনে রাখা হয়েছে?
ডক্টর বলে –
“- ওহ হ্যা গাজীপুর থেকে একজন এক্সিডেন্ট রোগী নিয়ে আসা হয়েছে। তবে ওনি বেঁচে নাই, এম্বুলেন্স করে নিয়ে আসার সময় ওনি মারা গেছেন। ওনার লাশ মর্গে রাখা হয়েছে “।
ডক্টরের কথা শুনে ইনায়ার শরীর @অবশ হয়ে যায়, সে শুধু শুনতে পায় যে “- ওনি আর বেঁচে নেই, মারা গেছেন “। ইনায়ার শরীর অবশ হয়ে পড়ে যেতে যাবে, তার আগেই ইভান তাকে ধরে বলে –
“- ইনায়া “।
ইনায়া শুধু মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে –
তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৬
“- আমার অরণ্য মারা গেছে “।
গল্প শেষ হয় নাই এখনো। সো নেগেটিভ কমেন্ট করবেন না।
,, জীবন এতোটাই অনিশ্চিত যে,,
,, শেষ কথা, শেষ দেখা হবার আগেই,,
,, মানুষ হাতের নাগালের বাহিরে চলে যায়,,