তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৯
নওরিন মুনতাহা হিয়া
সময় প্রায় রাত বারোটা হাসপাতালের এক বেডে ইনায়া অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে রয়েছে, তার হাতে ক্যানেলা দেওয়া। অতিরিক্ত চিন্তা আর হঠাৎ করে এমন দুর্ঘটনার কথা শুনে ইনায়ার পেশার কমে যায়, যার কারণে তার শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। ডক্টর তাকে স্যালাইন দিয়েছে। ইনায়ার জ্ঞান ফিরে আসে সে পিটপিট করে চোখ খুলে, সামনে এক পলক তাকিয়ে নিজেকে এক অজানা জায়গায় আবিস্কার করে। হাতে থাকা ক্যানেলার দিকে চোখে যায়, এরপর অরণ্যর এক্সিডেন্টর কথা তার মনে পড়ে। ডক্টরের মুখে অরণ্যর মৃত্যুর কথা শুনে সে অজ্ঞান হয়ে গেছে, অরণ্যর কথা মনে পড়তেই ইনায়া চিৎকার দিয়ে উঠে বলে –
“- অরণ্য অরণ্য আমার অরণ্য কোথায়? আমি অরণ্যর কাছে যাব “।
ইনায়ার চিৎকার শুনে বাহিরে থাকা ইভান কেবিনের ভিতরে আসে। মূলত ইভান এতোসময় ইনায়ার কেবিনের বাহিরে তার জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু সারাদিন অনেক টার্য়াড থাকার ফলে তার শরীরের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন ছিলো। যার জন্য সে বাহিরে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো, হঠাৎ করে ইনায়ার কণ্ঠ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। ইনায়া বেড থেকে নেমে যায়, তার হাতে থাকা ক্যানেলা জোরে টান দিয়ে খোলে ফেলতে যাবে তখন ইভান তার কাছে ছুটে আসে। ইভান বলে –
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“- কি হয়েছে ইনায়া? কোনো সমস্যা হচ্ছে তোমার? শরীর কি অতিরিক্ত খারাপ লাগছে? ডক্টরকে ইনর্ফরম করব?
ইভানের কোনো কথা ইনায়ার কানে যায় না, তার চোখ শুধু অরণ্যকে খুঁজে যাচ্ছে। ইভান ইনায়ার কাছে যাওয়ার কারণে, সামান্য পিছিয়ে দুরত্ব বাড়ায় ইভানের সাথে। ইনায়া বলে –
“- অরণ্য কোথায়? আমি অরণ্যকে দেখব? ওর কাছে নিয়ে যান আমাকে ইভান ভাই?
ইনায়ার কণ্ঠে অরণ্যর নাম শুনে ইভান মৃদু হাসে। তার হাসির মধ্যে সকল বিষাদের বেদনা জড়িয়ে রয়েছে, সে তার প্রাণপ্রিয় প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলেছে। সারাজীবনের জন্য সে অন্য কারো হয়ে গেছে, ভালোবাসার যুদ্ধে ইভান আজ পরাজিত সৈনিক। শত দুঃখ তার কষ্ট অন্তরে লুকিয়ে রেখে ইভান শান্ত স্বরে জবাব দেয় –
“- তোমার অরণ্য বেঁচে আছে ইনায়া। যাকে তুমি তোমার সমস্তটা দিয়ে ভালোবাসো, সেই ভালোবাসার মানুষ জীবিত রয়েছে।
অরণ্যর বেঁচে থাকার কথা শুনে ইনায়ার হৃদয় জুড়ে প্রশান্তিতে ভরে যায়। তার সকল চিন্তা আর উন্মাদনা শান্ত হয়ে যায়, সে হাসি মুখে বলে –
“- সত্যি বলছেন ইভান ভাই। অরণ্য সুস্থ হয়ে গেছে। কোথায় অরণ্য ওর কাছে নিয়ে যান আমাকে। অরণ্যকে দেখব আমি “।
ইনায়ার হাসি মুখ দেখে ইভানের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে। আজ থেকে ইনায়ার উপর সকল অধিকার তার মিথ্যা। অন্য পুরুষের ভালোবাসার মানুষ, আর বউয়ের প্রতি অনুভূতি তার মনে আর রাখবে না ইভান। তাদের মধ্যে থাকা সকল সম্পর্ক শেষ, তার চাচাতো ভাইয়ের প্রতি মনে আবেগ জমিয়ে রাখা তার জন্য পাপ। নিজের জীবন থেকে ইনায়া নামক মানুষটার ভালোবাসকে হারাম বলে দূরে সরিয়ে রাখে। ইভান বলে –
“- হুম চলেন ইনায়া আপনার অরণ্যর কাছে যাবো আমরা.
[রাত ১২: ১০ মিনিট ]
হাসপাতালে এক কেবিনের সামনে পায়চারি করছেন মিলন সাহেব। তার মুখে চিন্তা, ভয়, কষ্ট সবকিছুর ছাপ রয়েছে। কেবিনের ছোট জানলা দিয়ে ভিতরে থাকা রোগীর মুখ দেখার প্রয়াস করে যাচ্ছে। লাশঘর থেকে যখন মিলন সাহেব আর ইভান বেরিয়ে আসে, তখন এক ডক্টরের সাথে তাদের দেখা হয়। ডক্টর জানান অরণ্য রাজ চৌধুরীকে এক্সিডেন্টের পর তাকে এই কেবিনের সামনে রাখা রয়েছে যেখানে ওনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার অবস্থা খুব খারাপ, মাথা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লেগেছে, অরণ্যর অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে।
অরণ্যর কেবিনের সামনে উপস্থিত হয় ইনায়া, তার সাথে রয়েছে ইভান আর নাতাশা। রেহানা বেগম আর অরুণা বেগম এখন বাসায় গেছেন, নাতাশা তাদের মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়েছে যে অরণ্য সুস্থ হয়ে গেছে। কারণ রেহানা বেগম অতিরিক্ত কান্না করার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইনায়া দ্রুত এগিয়ে আসে কেবিনের কাছে এরপর বলে –
“- ভালো বাবা অরণ্য কোথায়? ডক্টর কি বলেছে?
মিলন সাহেব মুখ গম্ভীর করে বলে –
“- অরণ্যর অবস্থা ভালো না রে ইনায়া। ওর মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছে। ডক্টর কেবিনের ভিতর গিয়েছে, এখনেন বের হন নাই “।
মিলন সাহেবের কথা শুনে ইনায়ার প্রতাশ্যিত মুখ চুপসে যায়, তার চোখ শান্ত হয়ে যায়। মনের মধ্যে জ্বলে উঠা আশার প্রদীপ, আবার ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায়। ইনায়ার চোখের মণি শান্ত, তার কানে শুধু ভেসে উঠে একটা কথা তার অরণ্য ভালো নেই। ইনায়া কথাটা মনে আওড়ালো অল্প সময়, এরপর কেবিনের দরজার সামনে যায়। কেবিনের ভিতরে থাকা দশ বারো জন ডক্টরের মধ্যে তার চোখ যায় এক নিথর দেহের দিকে। ইনায়ার মনটা বড্ড বেসামাল হয়ে যাচ্ছে, তার স্বামী নামক মানুষটার মুখটা একবার দেখার জন্য।
কিন্তু চারপাশে ডক্টররা ঘিরে রয়েছে, যার কারণে সে অরণ্যকে দেখতে পায় নাই। তবে শুধু অরণ্যর হাতটা দেখে সে, ডক্টর তার হাতে জমে থাকা রক্ত পরিস্কার করছে। ইনায়া চাতক পাখির ন্যায় দীর্ঘ সময় অরণ্যর রক্ত মাখা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় দশ মিনিট পর ডক্টর বের হয়ে আসে, মিলন সাহেব বলে –
“- ডক্টর অরণ্যর অবস্থা কেমন? ও কি সুস্থ হয়ে যাবে?
ডক্টর বলে –
“- দেখুন আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু ওনার মাথার আঘাতটা খুব ভয়ংকর, মাথার ভিতরে রক্ত জমে গেছে। আজ রাতের মধ্যে যদি অপারেশন না করা হয়, তবে ওনাকে বাঁচানো অসম্ভব “।
“- তাহলে অপেক্ষা কেনো করছেন ডক্টর? অপারেশন শুরু করেন? যতো টাকা লাগবে তত দিব। কিন্তু অরণ্য যেনো কিছু না হয় “।
“- টাকার কোনো সমস্যা হবে না সেটা আমি জানি। তবে এক্সিডেন্ট অরণ্যর শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে। রাত প্রায় বারোটা এমন সময়, কোনো রক্তদান সেন্টার খোলা থাকবে না। আর ও পজিটিভ রক্ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল “।
ডক্টরের কথা শুনে ইভান বলে উঠে –
“- ডক্টর আমার রক্ত ও পজিটিভ। যদি কোনো সমস্যা না থাকে তবে আমি রক্ত দিতে চাই “।
ইভানের রক্ত দেওয়ার কথা শুনে ইনায়া অবাক হয়। যে ইভান অরণ্যর নাম অবধি শুনতে পেতো না, সে তার জন্য রক্ত দিবে। রক্তের সম্পর্ক বুঝি এমনই হয়, শত ভুল রাগ অভিমান থাকুক না কেনো বিপদে আপদে একে অন্যর সাহায্য অবশ্যই করে। ইনায়া কথাটা ভেবে শত কষ্টের মধ্যে ভালো লাগে। ইভান রক্ত দেয় যতোই হোক তার ছোট ভাই অরণ্য। আর অরণ্যর সাথে তার শএুতা কি নিয়ে থাকবে। নিজের ভুল আর জিদের কারণে ইনায়াকে সে হারিয়ে ফেলেছে, অন্য তার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া জিনিসকে যত্ন করে আগলে রেখেছে তাকে ভালোবাসা দিয়েছে।
রাত বারোটার সময় হাসপাতালে অরণ্যর অপারেশনের জন্য প্রায় ছয় থেকে সাতজন ডক্টরকে দেখে অবাক হয় ইনায়া৷ এতো রাতে গ্রাম বা শহরের যেকোনো জায়গায় ডক্টর পাওয়া মুশকিল, সেখানে প্রায় ছয়জন ডক্টর উপস্থিত রয়েছে। ডক্টরদের দেখে মনে হচ্ছে তারা প্রতৈকে অনেক হাই কোয়ালিফাই, আর এর মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি ডক্টর। যেনো মনে হচ্ছে এক্সিডেন্টের ঘটনার বিষয়ে তার আগে থেকেই যানত, সব পূর্ব পরিকল্পনা। ইনায়া কতটা আর ভাবে না, অপরাশনের উপর মনোযোগ দেয়।
রাত প্রায় একটার দিকে অরণ্যর অপারেশন সম্পূর্ণ হয়। ইনায়ার চোখে ঘুম নাই, শুধু ইনায়া না প্রতৈকে জেগে রয়েছে। ডক্টর কেবিন থেকে বাহিরে বেরিয়ে আসে ইনায়া তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে –
‘- ডক্টর অরণ্যর কি অবস্থা? অপরাশেন কি সাকসেসফুল হয়েছে ?
ডক্টর বলে –
“- অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে কিন্তু মাথায় অতিরিক্ত রক্ত জমাট বাঁধার কারণে, অরণ্য রাজ চৌধুরী কোমায় চলে গেছেন।
ডক্টরের মুখে কোমায় চলে যাওয়া কথাটা শুনে ইনায়ার পা থমকে যায়, সে এক পা পিছিয়ে যায়। সেইদিন হাসপাতালে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কান্না করেছে সে। ইভান আর নাতাশা তাকে সান্তনা দিয়েছে, মিলন সাহেব নিজে ও পাথর হয়ে যান। ডক্টরের কথা অনুসারে অরণ্যর কোমা থেকে বের হওয়া আদৌ সম্ভব না।তার মাথায় জোরে আঘাত লাগার কারণে অতিরিক্ত রক্তপ্রাত হয়, যার ফলে হাতের এক সাইড অবশ হয়ে যায়। যদি অরণ্য কোনো দিন কোমা থেকে বের হয়, তবুও তার হাতের ডান সাইড অবশ থাকবে।
[ প্রায় দুই বছর পর ]
সময় চলে যায় তার আপন গতিতে, এই দুইবছরে ইনায়ার জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে একজন বিজনেস লেডি, তার এসএস কোম্পানির কেসের বিষয়ে অনেক ডিটেইলস সে খুঁজে বের করেছে। যার ফলে আদালতের সামনে প্রমাণিত হয়েছে ইনায়া নিদোষ, কিন্তু তবুও সে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে। চৌধুরী কোম্পানি ওর এখন যথেষ্ট সুনাম রয়েছে, অরণ্য দুইবছর পর ও কোমা থেকে বের হয় নাই।
সকালে ইনায়া অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে , আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চেহারা ভালো করে খেয়াল করছে। জীবন তার থেকে কতকিছু কেড়ে নিয়েছে তার হিসাব মিলিয়ে দেখছে, অন্যদিকে বিছানার উপর খেলা করছে এক ছোট শিশু। তার ছোট ছোট হাত টা দিয়ে বিভিন্ন খেলার জিনিস দেখছে। ছোট বাচ্চাটা ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে –
তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৮
“- মাম্মা “।
ইনায়ার ভাবনার মাঝে হঠাৎ বাচ্চার কথা শুনে বিছানার কাছে যায, এরপর তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে –
“- কি হয়েছে আমার আম্মুটার “।
“- মাম্মা “।