তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৭
অহনা আক্তার
কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মুসকান। বাইরে এসে এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আড়াল থেকে ফারিশকে বলা হিয়ার প্রতিটি কথা শুনেছে সে। আর তখন থেকেই কোনোভাবে নিজের কান্না থামাতে পারছে না। মুখ ঢেকে অনবরত হেঁচকি তুলে যাচ্ছে। মুসকান কে খোঁজতে খোঁজতে বাহিরে এসে হাজির হয় ফারিশ। আকাশের অবস্থা ভালো না। জড়ো বাতাস শুরু হয়েছে। বৃষ্টি নামার আগ পর্যন্ত এ বাতাস থামবে বলে মনে হয় না। কিন্তু মুসকান কোথায়? তাদেরতো দ্রুত ফিরতে হবে। চারপাশে পাশে চোখ বুলিয়ে রেস্টুরেন্টের ডান সাইডের দিক থেকে মুসকানের কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে যায় ফারিশ। “মুসকান” বলে তড়বড় করে সেদিকে ছুটে যায় । রেস্টুরেন্টের ডানপাশে একটা নির্জন জায়গায় বসে কাঁদছিল মুসকান। ফারিশের গলা শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেলো যেন। ফারিশ ছুটে মুসকানের সামনে আসে। মুসকানের কান্না ভেজা মলিন মুখটা হাতের তালুতে নিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
—‘হেই কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? কেউ কিছু বলেছে? কে কি বলেছে বলো আমায়?’
মুসকান এবার আরো জোরে কেঁদে দিল। ফারিশ মুসকানের চোখের পানি মুছে দিয়ে খুব সফ্টলি জিজ্ঞেস করল,
—‘ জাননন ‘ কি হয়েছে বলো আমায়?
মুসকান শরীরের বেগে ফারিশকে জড়িয়ে ধরে। হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে,
–‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। খু..খুবব ভালোবাসি।’
ফারিশ বাকরুদ্ধ। এই প্রথমবার মুসকান তাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি বলছে তাও আবার নিজ থেকে। ভালোলাগায় ছেঁয়ে যায় ফারিশের মন প্রাণ। দৃঢ় করে মুসকানের পিঠে হাত রাখে সে। সাথে সাথে মুসকান তার সিক্ত লাল চোখ জোড়া নিয়ে ফারিশের চোখের দিকে তাকায়। এক নিশ্বাসে বলতে থাকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— বিশ্বাস করেন আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। আপনার জন্য সব করতে পারি। আপনি যা বলবেন এখন থেকে সব শুনবো আমি। আপনাকে খুব খুব ভালোবাসবো। দয়া করে আপনি ওই মেয়েটার কাছে আর যাবেন না। ‘আমার স’হ্য হয় না’। আপনাকে অন্য নারীর পাশে দেখলে আমার খুব ক’ষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। ‘আমি, ‘আমি,,,
কাঁদার মাঝে একনাগাড়ে এতোগুলো কথা বলায় শ্বাস আটকে আসে মুসকানের। ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে আবার কিছু বলতে নিলে ফারিশ থামিয়ে দেয়। মুসকানের আর্দ্র ভেজা গালে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। মুখের সামনে পড়া এলোমেলো চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বলে,
—‘ রিলাক্স, টেক এ ব্রেথ। কি হাল করেছো নিজের?’
মুসকান বড়বড় করে শ্বাস নেয় ,,
–‘ আগে বলুন আপনি ওই মেয়েটার কাছে আর যাবেন না। ‘
ফারিশ চাপা শ্বাস ফেলে,
—‘আমাকে হিয়ার কাছে যেতে দেখেছো তুমি? ‘
মুসকান একটু দমে। পরপর আবার বলে,
–‘ কিন্তু ওই মহিলাতো আপনার কাছে এসেছে, আপনার হাত ধরেছে, আপনাকে ভালোবাসি বলেছে, আমার স্বামীকে ওহ কেন ভালোবাসি বলবে!’
ফারিশ ভ্রু উঁচায়,
—“আর ইউ জেলাস?”
মুসকান ঝাঁঝাল স্বরে বলে,
–‘ অবশ্যই আমি জেলাস। জেলাস হওয়ার পূর্ণাঙ্গ অধিকার আছে আমার।’
ফারিশ অস্পষ্ট স্বরে হাসে। মুসকান সাথে সাথে চোখ পাকিয়ে তাকায়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
–‘ আপনার হাসি পাচ্ছে? আমার কষ্ট হচ্ছে আর আপনার হাসি পাচ্ছে? ‘
মুসকানের গোলগাল মুখ ফুলে আছে। গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে আছে। ডাগর আঁখি গুলোতে এখনও পানি জমে আছে, সাথে আছে ভয় আর তীব্র ঈর্ষা । ফারিশ মুসকানের ফুলো মুখটা পুনরায় হাতের তালুতে নেয়। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
—‘ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমায়। এমন কেউ করে? আ’ম অনলি ইউর মুসকান। তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আকৃষ্ট নই আমি। হিয়ার জন্য কখনোই আমার তেমন কেনো ফিলিংস ছিলো না যেটা তোমার জন্য আছে। আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি। অবশ্যই আমার জীবনে তোমার স্থান উপরে। এই প্রথম তোমার কান্নায় কষ্টের বদলে শান্তি পাচ্ছি আমি। তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনে কতটা তৃপ্তি পেয়েছি বলে বুঝাতে পারবো না। ‘ইউ আর দ্যা ওয়ান ফর মি’।’
মুসকান এতোক্ষণে স্থির হয়। নাক ফুলিয়ে বলে,
–‘ বাসায় কখন যাবেন? ‘
—‘ চলেতো যেতাম কখনই। তোমার জন্যই তো এতোটা লেট হয়ে গেল। এখন আকাশের যা অবস্থা! ‘
–‘ কিছু হবে না জলদি চলেন। বাইক ইতো! ‘সুড়ুৎ’ করে উঠে ‘ফুড়ুৎ’ করে চলে যাব। ‘
ফারিশ আবারও হাসে…
বাতাসের বেগ বাড়ছে। ফারিশ স্পিডে বাইক ছেড়েছে। এই বৃষ্টি এলো বলে। বলতে বলতে বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা মুসকানের নাকে মুখে পরে। মুহূর্তেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামতে শুরু করে। ফারিশ বাইকটা থামিয়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু মুসকানের জন্য পারল না। মেয়েটা এতো বাচ্চামো করে। রাতের বেলা এই বৃষ্টিতে ভিজে নির্ঘাত জ্বর বাঁধাবে। মুসকান আর ফারিশ বাসায় ঢুকতেই দেখে সব অন্ধকার। এই বৃষ্টির রাতে সকলে আগে আগেই শুয়ে পরেছে। তারা নিঃশব্দে নিজেদের কক্ষে গিয়ে লাইট ওন করলো। দুজনেই হালকা পাতলা অনেকটা ভিজে গেছে। বাড়িতে আসার পরেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফারিশ গায়ের ব্লেজার টা খুলে মাথা মুছতে মুছতে আড়চোখে মুসকানের দিকে তাকালো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঝাড়তে ব্যস্ত মুসকান। ভিজে যাওয়ার ফলে তার পুরো শাড়ি বডির সাথে লেপটে আছে। উন্মুক্ত ফর্সা পিঠ জুড়ে গড়িয়ে পড়ছে জলরাশি। কোমরের দিকটাও দৃশ্যমান। ফারিশ দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নিজেকে সামলানোর জন্য চোখ বুঝে বড় একটা দম নিল। মানছে মুসকানের বয়স কম। কিন্তু সে ওতো তাগড়া যুবক। নিজেকে সামলানো কি এতোই সহজ।
–‘ শুনছেন.. একটু এদিকে এসে চুল থেকে কনের দুলের প্যাচ টা ছুটিয়ে দেন তো। আমি পারছি না। ‘
মুসকানের ডাকে তার দিকে ফিরে ফারিশ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকেই এগিয়ে যায়। কানে ঠান্ডা হাতে স্পর্শ পেতেই খানিকটা কেঁপে উঠে মুসকান। ফারিশ খুব দৃঢ় ভাবে তার কানের দুল থেকে চুলের প্যাচ খুলে দিচ্ছে। মুসকান মুগ্ধ চোখে তাকায় ফারিশের দিকে। ভেজা স্নিগ্ধ মুখ। কালচে ঠোঁট। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য চেহারার মাঝে। এমন ঠান্ডায়ও কেমন কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে লোকটার। এমন না যে মুসকান ফারিশের অনুভূতি বোঝে না। পরীক্ষার সময় দাদুর বাড়িতে যাওয়ার পর তার তানিয়া আপুর সাথে হালকা পাতলা অনেককিছুই শেয়ার করেছিল মুসকান। তানিয়াও খুব সুন্দর করে তাকে স্বামী, স্ত্রীর মাঝের কার সম্পর্কের অনেক কিছু বুঝিয়েছে। সেও বুঝেছে। কিন্তু তার এখন ভিষণ লজ্জা লাগছে।
জট ছাড়িয়ে চলে যেতে নেয় ফারিশ। আচমকা মুসকান তার হাত টেনে ধরে। ফারিশ ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বোঝায়, ” কিহ ”
মুসকান লাজুক হেসে দুই দিকে মাথা নাড়ে, ” কিছুনা ”
ফারিশ ধীর আওয়াজে বলে,
— যাও চেঞ্জ করে আসো ঠান্ডা লেগে যাবে।
— আপনি চেঞ্জ করবেন না?
— করবো আগে তুমি করে আসো।
মুসকান বেকুবের মতো বলে,
— আজকে চেঞ্জ না করলে কি হবে ?
ফারিশ আশ্চর্য হয়ে তাকায়,
— কি হয়েছে তোমার?
মুসকান ফারিশের নেশাতুর চোখে চোখ রাখে। দুই জোড়া চোখে আজ নিষিদ্ধ ইচ্ছের আনাগোনা। বাহিরে ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়েছে। সেই তান্ডব চলছে মুসকানের বুকের ভিতরও। হৃদপিণ্ড প্রবল বেগে ধাক্কাচ্ছে। সে একনিশ্বাসে বলে ফেলল,
—‘ আমাকে আপন করে নিবেন? একেবারে নিজের সবটুকু উজাড় করে।’
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও ফারিশের চোখে চোখ রাখতে পারে না মুসকান। ত্রপিত মাথা নুইয়ে ফেলে।
আচমকা কোমরে ঠান্ডা হাতের টান খেয়ে মুর্তি ন্যায় শক্ত হয়ে গেল মুসকান। হাত জোড়া আনমনে চলে গেল ফারিশের বুকে। ফারিশ মুসকানের কানের নিচে হাত রাখে। কাপালে কপাল ঠেকায়। নাকে নাক ঘষে উত্তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
—‘ কেন পা’গল করছো? ‘
মুসকান নিজেও বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। বারান্দার দরজা খোলা। সেখান থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছে বৃষ্টির শব্দ। ঠান্ডা হাওয়া। বাতাসে কেমন মাদকতা মেশানো। ফারিশের ঘোর লেগে যায়। নেশার মতো মুসকানের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ঘষে। অধৈর্য, অস্থির কণ্ঠে বলে,
—‘ নিজের থেকে কাছে আসতে চাইছো! সামলাতে পারবা তো? আজ কাঁদলে কিন্তু একটা মা’রও মাটিতে পরবে না। ‘
মুসকান চোখ বুঝে ফারিশের বুকে মাথা রাখে। কম্পিত হাত দিয়ে ফারিশের ভেজা শার্ট খামচে ধরে বলে,
–‘ কাঁদব না ‘
ফারিশের এতোদিনের ধৈর্য্যের বাঁধ নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ঝড়ের বেগে মুসকান কে পাজা কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। একহাতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সুইচ টিপে সমস্ত রুমের ইলিক্ট্রেসিটি বন্ধ করে মুসকানের অতি নিকটে চলে আসে। মুসকানের সারা অঙ্গে লাজ। ফারিশের বেহায়া স্পর্শে ছটফটিয়ে উঠে সে। এবার বুঝি বেহুশই হয়ে যাবে। ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠছে তার সমস্ত শরীর।
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৬
মুসকানের শরীরের হালকা কাঁপুনি আরো অস্থির করে তুলে ফারিশকে। নিজের সেল্ফকন্ট্রোল পুরোপুরি হারিয়ে বসেছে ফারিশ। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে যেন। মুসকান যতই কাঁদবে না বলুক ফারিশের তীক্ষ্ণ স্পর্শে একসময় কাঁদতে বাধ্য হয় সে। ব্যথার তাড়নায় অস্পষ্ট স্বরে গুঙিয়ে উঠে বারবার। চোখের পানি আপনা আপনি গড়িয়ে পড়ে কিনারা বেয়ে। ফারিশ মুসকানের ব্যথাতুর বিবর্ণ মুখটার দিকে নিরাধার দৃষ্টিতে তাকায়। সর্ব মুখে অজস্র চু*মু খেয়ে কাতর কণ্ঠে বলে,
—‘ সকালে ঔষধ খেলেই ব্যথা কমে যাবে জান। আর একটু সহ্য করে নাও প্লিজজজ…