তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৮
অহনা আক্তার
ঘড়ির কাঁটা চারটা ছুঁই ছুঁই। মুসকানের অবস্থা নাজেহাল। সারা শরীর ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আছে। সমান্য নাড়াচাড়ার শক্তি পর্যন্ত পারছে না। ফারিশ মুসকানকে সাওয়ারের জন্য কোলে তুলে নিতেই মুসকান অস্পষ্ট স্বরে কেঁদে দেয়। ফারিশ অপরাধীর ন্যায় মুসকানের মুখের দিকে তাকায়। কাতর কণ্ঠে বলে,
—‘ আ’ম সরি জান! খুব কষ্ট হচ্ছে ? ‘
মুসকান ঠোঁট উল্টে কাঁদে। মৃদু স্বরে বলে,
–‘ খুবব ‘
ফারিশকে বড্ড হেল্পল্যাস দেখায়। সে মুসকানকে কোলে নিয়ে আলগোছে ওয়াশরুমে ঢুকে। বুকের সাথে দাঁড় করিয়ে শরীরে পানি ঢালে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় ঠান্ডা পানি গায়ে পরতেই মুসকানের সমস্ত শরীর তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠে। নরম দেহে পীড়া সর্বত্র। পানি লাগলেই জ্ব’লন বাড়ে। মুসকান দুর্বল স্বরে চেঁচায়। ফারিশের বাহু খা’মচে ধরে সমানে ছটফট করতে থাকে। ফারিশের গলার স্বর অত্যন্ত নরম। মুসকানকে নিজের সাথে আড়ষ্টভাবে জড়িয়ে নিয়ে আস্তে করে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—‘শেষ জা’ন! আর একটুু ‘
বিছানায় জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে মুসকান। তার উষ্ণ দেহ মৃদু কাঁপছে। শরীরের ব্যথায় পেট গুলিয়ে আসছে। বাইরে এখনো ঝুম বৃষ্টি। মুসকান অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পারছে ওয়াশরুম থেকে আসা পানির শব্দ। ফারিশ সাওয়ার নিচ্ছে। সময় নেয়নি বেশি। ঝটপট পানি ঢেলে চলে এসেছে। এসেই বিছানায় শুয়ে মুসকনকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। উপরে কাঁথা টেনে ভেজা চুল গুলো বালিশে ছড়িয়ে দিয়েছে,
—‘খুব বেশি খারাপ লাগছে?’
ফারিশের প্রশস্ত বুকে গুটিশুটি মে’রে শুলো মুসকান। নেতিয়া যাওয়া ভয়েসে বলল,
–‘ খারাপ লাগছে না ‘
ফারিশ বুঝে। মুসকানের পিঠে থাকা হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করে। কপালে, চোখে মুখে অজস্র চুমু দিয়ে বলে,
—‘ আ’ম সরি। খুব সরি। ‘
স্নিগ্ধ সকাল। মুসকান গভীর ঘুমে। ফারিশ নিজের কাজের জন্য বেড়িয়ে গেছে সেই কখনই। ঘুম থেকে উঠতে দেড়ি হওয়ায় ফাইজা এসেছে মুসকানকে ডাকতে। মুসকান চোখমুখ ঢেকে ঘুমিয়ে আছে। ফাইজা মুসকানের উপর থেকে কাঁথা সরায়। আস্তে করে ডাকতে থাকে,
–‘ ভাবি উঠো। ‘
মুসকানকে উঠতে না দেখে কাঁধ ঝাঁকায়,
— ভাবি অনেক বেলা হয়েছে মা ডাকছে তোমাকে।
মুসকান একটু নড়েচড়ে শুয়। ঘুমঘুম আওয়াজে বলে,
— আমাকে ঘুমাতে দাও ফাইজা। তোমার ভাই সারারাত জ্বালিয়েছে আমায়। একটুও ঘুমাতে দেয়নি।
ফাইজা বেক্কল বনে গেলো। মুসকান কি বলছে এসব ঘুমের ঘোরে । সে এবার একটু জোরেই বলল,
–‘ ভাবি কি বলছো এসব? ভাইয়া কেন তোমাকে জ্বালাবে? ‘
মুসকানের ধ্যান ভাঙে। হকচকিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে। ফাইজার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় পরে যায়। আমতাআমতা করে বলে,
— খুব বে..বেলা হয়ে গেছে না?
— এগারোটার উপর বাজে। আজকে আমাদের মামার বাসায় যাওয়ার কথা। নানিজান সকাল থেকে কল দিচ্ছে।
— আমি আমি এক্ষুনি উঠছি।
বলতে বলতে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল মুসকানের।
ফাইজা ধরে ফেলল,
— কি হয়েছে ভাবি? তুমি কি অসুস্থ? শরীর এতো গরম কেন?
তখনই দরজার কাছ থেকে তাজমহলের গলা শোনা গেল,
— ফাইজা মুসকান উঠেছে? খাবে না ওহ?
— মা ভাবির গায়েতো খুব জ্বর।
‘ সে কিহ ‘ তাজমহল দ্রুত পায়ে মুসকানের কাছে আসলো। কপালে হাত দিয়ে বলল,
— জ্বর কি করে আসলো? রাতে কি বৃষ্টিতে ভিজে ছিলে?
মুসকান মাথা নুইয়ে ফেলে। তাজমহল বুঝে গেলেন,
— আসুক ওই হতচ্ছাড়া বাড়িতে। তোমাকে এই রাতের বেলায় বৃষ্টিতে ভিজিয়ে আনতে কে বলেছে ওকে?
মুসকান কিছু বলতে নিলে তাজমহল পরপর আবার বলেন,
— ঔষধ খেয়েছো?
মুসকান ওপর নিচ মাথা নাড়ে,
— ওনি দিয়েছেন।
তাজমহলের চোখ যায় মুসকানের গলায়। ফর্সা গলার কিছু কিছু অংশ ছোপ ছোপ লাল হয়ে আছে। হতভম্ব হয়ে যান তিনি। মুহূর্তেই বুঝে যান মুসকানের এতো বেলা করে উঠার কারণ। ওনার ছেলে যে কাল রাতে মেয়েটাকে বিধস্ত করে ছেড়েছে এটা বুঝতে সময় লাগলো না আর। মুসকান উঠে দাঁড়াতে নিলে তাজমহল বাঁধা দেন,
–‘ উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো রেস্ট নাও। আমি ফাইজাকে দিয়ে তোমার নাস্তাটা উপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। জ্বর বাড়লে অবশ্যই জানাবে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব। মাথা টাথা খারাপ লাগলেও জানিও কেমন। ‘
মুসকান আর কিছু বলতে পারলো না। অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকলো। তাজমহল চলে গেলেন।
বিকেলের দিকে ফারিশ বাসায় আসে। মুসকানকে এই অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে রেখে সারাটাদিন কেমন হাসফাস করেছে সে। ফোনও দিয়ে ছিলো। তাজমহল তুলে কয়েকটা ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলে রেখে দিয়েছে। বলেছে কাজ নিয়েই যেন পরে থাকে। বউয়ের খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই। যার জন্য আজ একটু দ্রুতই বাড়ি ফিরেছে ফারিশ। মুসকান তখন ঘরে গোছগাছ করছিলো।
কয়েকদিন যাবৎ তার শরীরের উপর একটু বেশিই দখল যাচ্ছে। একটানা এক্সাম, রাত জাগা, তারপর একটা লম্বা জার্নি দিয়ে গ্রাম থেকে বাড়িতে আসা, এসেই আবার গেটটুগেদারে যাওয়া, সেই রাতেই বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় আসা, আবার মাঝরাতে নিজের উপর বয়ে যাওয়া ভয়ংকর লজ্জা জনক তুফান, জ্বর, দুর্বলতা, এখন আবার আরেকটা লম্বা জার্নি করে নানিজানের বাড়িতে যাওয়া। ভেবেই বিষিয়ে উঠছে শরীর। একটুও ইচ্ছে করছে না যেতে। খুবই ক্লান্ত সে। একেবারে বিছানায় নেতিয়ে পরে থাকার মতো ক্লান্ত । না কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে আর না কিছু করতে।
ফারিশ রুমে এসে দেখে তার পিচ্চি বউটা কেমন দুর্বল হাতে ব্যাগ গুছাচ্ছে। সে গিয়ে মুসকানের হাত টেনে ধরে নিজের দিকে ফেরায়। মুখের সামনে উড়তে থাকা অবাধ্য চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
—‘ দুপুরে খেয়েছো?’
মুসকান কথা বলে না। উল্টো ঘুরে আবার ব্যাগে কাপড় ভরতে ব্যস্ত হয়ে পরে। ফারিশ কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করতে নেয়। মুসকান সাথে সাথে হাত সরিয়ে দেয়। ফারিশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়,
—‘ এমন বিহেভ কেন করছো? কি হয়েছে? ‘
মুসকান তেজ দেখিয়ে বলে,
–‘ এসেছেন কেন? আপনার কাজ আছে না যান কাজে যান। আমি একাই নিজের খেয়াল রাখতে পারি। ‘
ফারিশ মৃদু হাসে। মুসকানকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কাছে টেনে বলে,
—‘ আজকে যাওয়াটা খুব জরুরি ছিল মুসকান। নাহলে তোমাকে না বলে এভাবে কখনও যেতাম না আমি। তাও আবার তুমি এতোবার বারণ করার পর। ‘
মুসকান ঠোঁট ফুলায়,
–‘ আপনি একটা নির্দয় লোক। ‘
ফারিশ শব্দ করে হাসে,
—‘ তাই ‘
মুসকান ফারিশের বুকে মাথা রাখে।
–‘ আমার নানিজানের বাড়িতে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। ‘
ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,
—‘ যেতে হবে মুসকান। না গিয়ে উপায় নেই। তোমার সামনেই তো নানিজান কতোবার বললো দেখলে না! ‘
–‘ হুঁ ‘
শাশুড়ী আর ননদের মাঝখানে বসে আছে মুসকান। মাথা সিটে হেলান দিয়ে রেখেছে। এসব গাড়িতে উঠতে একেবারেই বিরক্ত সে। গাড়ির গন্ধ একদম সহ্য হয় না তার। তারউপর আবার জ্বরটাও বাড়ছে মনে হচ্ছে । ড্রাইভ করতে নিয়ে মিররে তাকিয়ে বারবার মুসকানকে দেখছে ফারিশ। মুখটা কি ছোট হয়ে আছে। নিশ্চয়ই খুব দুর্বল লাগছে। বউয়ের অসুস্থতার জন্য সরমিলা বেগমের সাথে কথা বলেছিল ফারিশ। বলেছে আজ যেতে পারবে না কাল সকাল হতেই রওনা দিবে তারা। তাজমহলও বলেছিল। কিন্তু সরমিলা বেগম কড়াকড়ি ভাবে নিষেধাজ্ঞা জানায়। যেতে হলে আজকেই যেতে হবে। নাহলে আর কোনোদিনও আসার দরকার নেই। মুসকান নাকি না যাওয়ার জন্য অভিনয় করছে। ফোনের পাশেই ছিল মুসকান। সরমিলা বেগমের কথা শুনে জিদ ধরে সে নিজেই সবার আগে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
ফরিশকে ড্রাইভিং করার ফাঁকে বারবার পিছনে তাকাতে দেখে জহির তালুকদার বিরক্ত হলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
— বাবা তুমি পেছন ঘুরে কেন গাড়ি চালাচ্ছো না! নতুন একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যেত। আমরাও অক্কা পেতাম আর তুমিও তোমার বউকে শান্তি মতোন দেখতে পেতে।
বাবার কথায় ফারিশ খানিকটা লজ্জা পেল। সত্যিই সে আজকে একটু বেশিই তাকাচ্ছে পেছনের দিকে। আর কেন তাকাচ্ছে এটা বুঝতে কারোরই বাকি নেই।
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৭
এভাবে বারবার পিছন তাকিয়ে ড্রাইভ করলে বড় কোনো দূর্ঘটনার ঘটে যেতে পারে নিমিষেই । ফারিশ এবার ভালো করেই ড্রাইভিং এ মনযোগ দিল। সকলের সামনে বড় চাচা ওরফে শ্বশুর কে এভাবে কথা বলতে দেখে মুসকানও ভিষণ লজ্জিত হলো। এতোবার তাকানোর কি আছে আজব। ফাইজা মিটিমিটি হাসছিল। তাজমহলের চোখ রাঙানোতে থেমে যায়…