তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৯

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৯
অহনা আক্তার

মুসকানদের গ্রামের পাশের গ্রামটিই তাজমহলের বাবার বাড়ি। ফাইজা, ফারিশ তার নানাজানের বাসায় অনেকবার আসলেও জহিরের বেশি আসা হয়নি। ফারিশতো কিশোর বয়স থাকতে প্রচুর এসেছে। কিন্তু নানার বাড়িতে সারাদিনে তার ছায়াও খোঁজে পায়নি কেউ। সারাক্ষণ কিশোর কালের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে থেকেছে। আড্ডা দিয়েছে। দিনের সম্পুর্ণ সময় তাদের সাথেই ঘুরেবেড়িয়েছে। পুরো পরিবার নিয়ে অনেক বছর পর আজ তাজমহল তার বাবার বাড়ি যাচ্ছেন। সামনে উঠান রেখে উঠানের আড়াআড়ি বরাবর একতলা বিশিষ্ট খুব বড় একটা বাড়ি ফারিশের মামাদের। ফারিশের দুই মামা এই বাড়িতেই থাকেন।

পুরো রাস্তা ব*মি করে নেতিয়ে পরেছে মুসকান। তার গায়ে বোধহয় আর শক্তি নেই। ননদের হাত ধরে ধীরে ধীরে আগাচ্ছে বাড়ির দিকে। উঠানের একপাশে কালকের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। রাতের বেলা বলে কিছুই বুঝতে পারছে না মুসকান। তারা বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো প্রবেশদ্বারে সবাই তাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশের বড় মামা কাইয়ুম,উনার বড় মেয়ে শিরিন,রাসেল,রাসেলের বউ কেয়া আর লতিফা তাদের দেখে এগিয়ে এলো। খুব নমনীয়তার সাথে তারা তাদের স্বাগত জানালো। মুসকানকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। কেয়া মুসকান কে ধরে একটা রুমে নিয়ে গেল। তাকে ঠান্ডা সরবত খেতে দিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওয়াশরুম দেখিয়ে ফ্রেশ হতে বলে চলে গেল বাকিদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করতে। কেয়া আজকে একা হাতেই সব সামলাচ্ছে। তার বড় জা শারমিন আজ শাশুড়ীর সাথে তুমুল লাগা লেগেছে। ঝগড়া শুরু করেছে সরমিলা বেগমই। তাও আবার উনার ছোট নাতনি সোনিয়া কে নিয়ে। মেয়েটার চলা ফেরা একদম স’হ্য হয় না সরমিলা বেগমের। মেয়েটাকে বাড়ি থেকে দূরে রেখে হোস্টেলে পড়িয়ে পড়িয়ে একেবারে বে*শরম, বি’য়াদব বানিয়ে ফেলেছে। গতকালকে হোস্টেল থেকে ফিরেছে দাদার মৃত্যু বার্ষিকি উপলক্ষে। আর এসেই উল্টাপাল্টা চলা ফেরা শুরু করে দিয়েছে। কারও কথা শুনে না।

পোশাক আাসাকের পরিবর্তন করে না। দাদির মুখে মুখে তর্ক করে, বাপের মুখে মুখে তর্ক করে, চাচার মুখে মুখে তর্ক করে । মূলত এই জন্যই বড় ছেলের বউয়ের সাথে লেগেছেন সরমিলা বেগম। শারমিন শাশুড়ির মুখে মুখে বেশি কথা না বললেও সরমিলা বেগম অনেক কথা শুনিয়েছেন উনাকে। মায়েদের দায়িত্ব মেয়েকে সঠিক পথ দেখানো। সেখানে উনি এই মেয়েকে আরো লাই দিয়ে মাথায় উঠিয়েছেন। ঝগড়াটা লেগেছেন বিকেলের দিকে। তখন থেকেই নিজের ঘরে মুখ অন্ধকার বানিয়ে বসে রয়েছেন শারমিন। না কোনো কাজে হাত লাগাচ্ছেন আর না কারো সাথে কথা বলছেন। ছোট মেয়ে সোনিয়া আর বড় মেয়ের জামাই রাজন এই দুটো মানুষের জন্য দরদ শারমিনের বরাবরই। তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথাই সহ্য করেননা শারমিন। এই দু’জন আরো বহু আগে থেকে শারমিনের ব্রেন ওয়াশ করে রেখেছে।

ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরেছে মুসকান। শরীর ক্লান্ত হওয়ায় সাথে সাথে ঘুমিয়েও গেছে। ফাইজা নিজের বরাদ্দ করা রুমে আছে। তাজমহল তার আম্মাজানের সাথে কথায় মজে। জহিরও কাইয়ুমের সাথে বাইরে বেড়িয়ে গেছে। ছোট মামা রাসেলের সাথে ফারিশের বেশ ভালো সম্পর্ক। আর সেটা তার কিশোর বয়সেরও আগে থেকে। সে এসেই আগে ফ্রেশ হয়ে রাসেলের সাথে বেড়িয়ে পরেছে এখানে থাকা বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। গ্রামের রাস্তায় বের হতেই আশেপাশের পরিচিত অনেকে ডাকছে, কথা বলছে, জিজ্ঞেস করছে,
— কি অবস্থা ফারিশ?
— আরে ফারিশ কেমন আছিস?
— ফারিশ ভাই যে অনেক দিন পর?
— কখন এসেছেন ভাই?
ফারিশ মাথা নাড়িয়ে সকলের কথার জবাব দিচ্ছে।

ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলেই টেবিলে বসে। তাজমহল আর কেয়া মিলে সকলকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। তাজমহল গিয়ে তার বড় ভাবিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ডিনারে নিয়ে এসেছিল। সরমিলা বেগমের ত্যাড়া কথা শুনে আবার চলে গেছে। রাসেলের পাশে বসে একদম শক্ত চেহারা নিয়ে খাবার খাচ্ছে ফারিশ। চেহারা শক্ত করার কারণ হচ্ছে সোনিয়া। মেয়েটা খাবার টেবিলে ফারিশ কে বসতে দেখেই ছুটে এসে তার পাশে বসেছে। ঢং ঢাং করে মুখের সামনে পরা কাটা চুলগুলো বারবার কানের পিছে গুঁজে দিচ্ছে। লাজুক হেসে ফারিশের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে,

— ফারিশ ভাই কিছুদিন থাকবেন না এবার?
— দেখি।
— আপনি কতোদিন বাদে এসেছেন বলেনতো! জানেন আমরা আপনাকে কতটা মিস করি? আপনি এখন আর আসেন কেন ফারিশ ভাই?
— ব্যস্ত থাকি।
সোনিয়া আরো প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই ফারিশ ফাইজাকে জিজ্ঞেস করে,
— মুসকান কোথায়?
তাজমহল জবাব দিল,
— ওহ ঘুমাচ্ছে তাই আমিই ডাক দেইনি। থাকুক, ঘুমাক একটু। ক্লান্ত মেয়েটা।
সরমিলা মুখ মুচড়া দিলেন,

— এমন নাজুক বউ আমি জীবনে দেহি নাই বাপ। একটু সফর করতে না করতে বিছানায় পইড়া গেছে। বলি সারা রাইত কি ট্রাক চালাই ছিল যে এখন ম’রার মতো পইড়া ঘুমাইতাছে।
ফারিশ কেশে উঠল। সোনিয়া তড়িঘড়ি করে ফারিশ কে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল,
— আপনি ঠিক আছেনতো ফারিশ ভাই? যেমন ওর থেকে কনসার্ন আর কেউ নেই।
ফারিশ মাথা নাড়ালো। খাওয়া শেষ তার। উঠে যেতে নিলে তাজমহল ডেকে বলল,
— এক মিনিট দাঁড়াও। মুসকানের খাবার টা নিয়ে যাও। সারারাত না খেয়ে থাকলে আরো দুর্বল হয়ে পরবে।

ফারিশ রুমে এসে দেখে মুসকান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে হাতের খাবার টা টেবিলের উপর রেখে দরজা লাগিয়ে ফেলল। ঘড়িতে টাইম রাত বারোটা। গ্রামের মানুষ আরো আগেই ঘুমে কাঁদা। ফারিশ গিয়ে নিঃশব্দে মুসকানের পাশে বসলো। মুখের উপর পরে থাকা চুলগুলো গুলো আলগোছে সরিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো। চুলের ভাজে আঙুল ঢুকিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় ডাকল,
—‘ মুসকান ‘
ওঠো খেয়ে তারপর ঘুমিও।
মুসকান উঠলো না। বরং একটু নড়েচড়ে ফারিশের কোমর পেচিয়ে শুয়ে থাকল। ফারিশ এবার ডাকার তাগিদা বাড়ালো,

— মুসকান আমি ডাকছিতো তোমাকে!
মুসকান ঘুম ঘুম কণ্ঠে জবাব দিল,
— আমি খাব না এখন।
— এসব বললে চলবে না ওঠো,,
তাকে তাও উঠতে না দেখে জোর করে টেনে বিছানায় বসালো। মুসকানের বিরক্তিতে নাক ফুসে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
— আপনি আমাকে ঘুমাতে কেন দিচ্ছেন না?
ফারিশের শীতল কণ্ঠ,
— খেয়ে ঘুমাও তোমাকে বারণ করিনি আমি।
— ঠিক আছে আপনি খাইয়ে দিন। আমার এখন উঠে নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না।
ফারিশ হাসল। ফিচেল স্বরে বলল,
— তুমি কিন্তু দিন দিন বড্ড বেশি অলস হয়ে যাচ্ছ মুসকান!
মুসকানের ভাব নিয়ে বসে রইল।

মুসকান কে খাইয়ে লতিফাকে দিয়ে প্লেট পাঠিয়ে দিয়েছে ফারিশ। লাইট নিভিয়ে সেও মুসকানের পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু মুসকানের নড়াচড়ার জন্য পারছে না। খাওয়ার পর ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে মুসকানের। যার জন্য এখন এমন হাসফাস করছে। ফারিশ ধমক দিল,
— এতো নড়ানড়ি করছো কেন? চুপচাপ ঘুমাও।
মুসকান মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
— ঘুম আসছে না।
— এতোক্ষন ঘুমানোর জন্য ছটফট করে এখন ঘুম আসছে না!
— আপনি ইতো ভাঙলেন।
— ঠিক আছে আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি চোখ বুঝে থাকো ঘুম এসে যাবে।

মুসকান বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে ফারিশের বুকে এসে শুলো। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে দেখল ফারিশ চোখ বুঝে তার চুলে হাত বুলাচ্ছে। মুসকানের ঠোঁট নিসপিস করছে ফারিশের হালকা চাপ দাঁড়ি মাখা গালটা ছুঁয়ে দিতে। সে তার ঠোঁটের ইচ্ছা পূরণ করল। টুপ করে ফারিশের গালে একটা চু*মু খেয়ে বসল। সাথে সাথে ফারিশের গম্ভীর স্বর শুনা গেল,
— ঘুমাবে নাকি চু/মু/র পারফরম্যান্স শুরু করবো।
মুসকান লজ্জা পেয়ে জলদি চোখ বুঝে ফারিশের বুকে ঘাপটি মেরে শুলো। মুচকি হেসে ফারিশ নিজেও মুসকানের মাথায় চু*মু দিয়ে তাকে নিবিড় ভাবে বুকে জড়িয়ে রাখল।

ঝলমলে সকাল। বাইরে থেকে ভেসে আসছে কোলাহলের শব্দ। বাবুর্চিরা রান্না করছে। প্রতিবছর ফারিশের নানার মৃত্যু বার্ষিকিতে খুব বড় করে আয়োজন করা হয়। গ্রামের অনেক মানুষদের নিমন্ত্রণ করা হয়। উঠানে পেন্ডেল করা হয়েছে বড়সড়। সেখানে সারি সারি টেবিল সাজানো হচ্ছে। ছোট মামা রাসেলের পাশে দাড়িয়ে সবকিছুর তদারকি করছে ফারিশ। ঘেমে নেয়ে তার শার্ট একদম ভিজে গেছে। মুসকান ফাইজার সাথে ছাঁদে উঠেছিল। ছাঁদ থেকে বাড়ির আশপাশটা খুব সুন্দর দেখায়। সবুজ, শ্যামল, শান্ত, ছায়াঘেরা মনোরম এক পরিবেশ। বাতাসও আছে বেশ। মাথায় ঘুমটা টেনে তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে আছে মুসকান ফারিশের দিকে। ফারিশের পাশেই সোনিয়া মেয়েটা দাঁড়িয়ে। পরনে একটা ছেঁড়া ফাটা লেডিস পেন্ট আর হাটুর উপর পর্যন্ত পড়া টপস। গলার স্কার্ফটাও তেমন লং নয়। ছাঁদ থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা নিজে থেকে বারবার ফারিশের সাথে কথা বলতে চাইছে। একটু পরপর চুল ঠিক করছে। মুচকি মুচকি হাসছে। ফারিশের চেহারায় প্রবল বিরক্তি। মুসকানের নিজেরও ভালো লাগছে না মেয়েটাকে। এমন নি’র্লজ্জ কেন! দেখতে পারছে না উনি যে বিরক্ত হচ্ছেন।
ফারিশ রাসেলের সাথে কথা বলছিল। এর মাঝে সোনিয়া বলে,

— ফারিশ ভাই আপনিতো খুব ঘেমে গেছেন। আমি কি আপনার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে আনবো? খেলে শান্তি পাবেন।
ফাইজা মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
— দেখেছো ভাবি সোনিয়া আপু কেমন নিজে উজে উজে ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। পারেনা একেবারে ভাইয়ার কোলেই উঠে যায় ঢংং।
মুসকান বলল,
— চলো ফাইজা আমরা ওখানে যাই তোমার ভাইয়ের কাছে।
ফাইজা সাথে সাথে নাকোচ করল,
— পাগল নাকি! ওখানে কতো ছেলে মানুষ দেখেছো! ঠ্যাং গুড়িয়ে দিবে ভাইয়া যদি তোমাকে আর আমাকে ওখানে দেখে। আমাকে আগেভাগেই নিষেধ করে দিয়েছে আজকে যেন বিকেলের আগে কোনোভাবে উঠানে পা না রাখি। তোমাকে নিয়েতো আরো আগে না।
মুসকান আর কিছু বলল না। ওখানে আসলেই অনেক ছেলে মানুষ। কিন্তু তার এই সোনিয়া মেয়েটাকে কেন যেন স’হ্য হচ্ছে না।

— তুমি সোনিয়া আপুর জন্য ওখানে যেতে চাইছো তাই না ভাবি?
ফাইজার কথায় তার দিকে ঘুরে মুসকান। ফাইজা তার ভাবির কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,
— তুমি চিন্তা করোনা ভাবি। ভাইয়া সোনিয়া আপুকে একদমই দেখতে পারেনা। সে যতই গায়ে পরে কথা বলতে আসুক না কেনো। ভাইয়া পাত্তাই দেয় না এই মেয়েকে। দেখোনা কখন থেকে শরবত আনবে নাকি জিজ্ঞেস করছে কিন্তু ভাইয়া কথাই বলছে না। ‘
মুসকান জোরপূর্বক হাসে। আসলেই মেয়েটার সাথে কোনো কথা বলছেনা ফারিশ।

___ ঠান্ডা পানি দিয়ে বড় এক জগ লেবুর শরবত বানিয়ে লতিফার হাত দিয়ে উঠানের দিকে পাঠিয়ে দিল মুসকান। শুধুতো ফারিশের জন্য বানালে চলবে না। ওখানে ছোট মামা সহ আরো অনেকেই আছে। সকলেই গরমে ক্লান্ত হয়ে আছে। খেলে সকলেরই খাওয়া প্রয়োজন। লতিফা গিয়ে ফারিশের হাতে শরবতের জগ আর গ্লাস দিল ,,

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৮

— ভাবিমণি পাঠাইছে। সক্কলের জন্য।
ফারিশ স্মিত হাসে। লতিফার হাত থেকে জগটা নিয়ে বলে,
— তোমার ভাবিমণি কে গিয়ে বলো ধন্যবাদ।
সোনিয়া এটা দেখে রাগে গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেল। বরাবরের মতো এইবারও পাত্তা দিল না ফারিশ…

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২০