তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২৬

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২৬
অহনা আক্তার

এক্সাম শেষে আবারও স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসে মুসকান। এইবারের প্রতিটি এক্সামই সে ভালো দিয়েছে। মুসকানের সাথে এসেছে জিন্নাতও। ভাইয়ের বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি, বাবার বাড়ি থেকে ভাইয়ের বাড়ি এই দুই জায়গায় যাওয়া আসাই তার কাজ হয়েগেছে এখন। বিষন্ন মন নিয়ে সে কোনো রকমে দিন গুলো পার করছে শুধু । মুখে হাসি টেনে সকলের সাথে কথা বললেও মনের দিক থেকে একদমই ঠিক নেই জিন্নাত। ছেলেটাকে ওইদিন দেখেছিল। শুকিয়ে মুখটা এইটুকু হয়ে গেছে। রিতা ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছে। মোকলেসও কতোবার মাফ চেয়েছে। এবার কি তবে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। ছেলেমেয়েদের এভাবে কষ্ট দিয়েতো সেও ভালো নেই। এতো শক্ত তো সে কোনোদিনও ছিল না! তাহলে আজ কেন? না সে ভালো আছে আর না তার ছেলেমেয়েরা ভালো আছে! মনের শান্তির জন্য মোখলেস কে কি লাস্ট আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখবে? সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে জিন্নাত। নিজের রুমে বসে একা একা এই কথাগুলোই ভাবছিল সে আর তখনি তার ঘরে ফাইজা আসে,

— কি করছো ফুপিমণি?
ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিল জিন্নাত,
— কিছুনা আয় বস।
— বসবো না। বারান্দায় চলো আমার মাথায় তেল দিয়ে দিবে আর তোমার সাথে গল্প করবো।
জিন্নাত আবারো হাসল,
— আচ্ছা আয়।
বারান্দায় আরাম করে বসে হাতের তালুতে তেল নিয়ে ফাইজার চুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল জিন্নাত,
— মুসকান কোথায়?
— ওইতো দেখে এলাম মায়ের সাথে কিচেনে কি যেন রান্না করছে।
— মুসকানতো দেখছি ভালোই রান্না শিখেছে ! এবার তাহলে তোকেও বিয়ে দিয়ে দেই তুইও শাশুড়ীর সাথে গল্প করে করে রান্নাটা শিখে নিবি।
ফাইজা মুচকি হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— তোমার মতো শাশুড়ী হলে আমি সব চোখ বুঝে করতে রাজি।
জিন্নাত মুখ লটকিয়ে বলল,
— আমার মতো শাশুড়ী পেতে হলে তো আমার ছেলের মতো ব*দমাশ কে বিয়ে করতে হবে! ঐ ফা*জিলকে কে বিয়ে করবে?
ফাইজা এবার কথার পয়েন্ট খোঁজে পায়। কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বলে,
— রিশাদ ভাইয়াকে কি ক্ষমা করা যায়না ফুপিমণি?রিশাদ ভাইয়া খুব ভালো হয়ে গেছে বিশ্বাস করো।তোমায় খুব ভালোবাসে।

— তোকে কে বলেছে রিশাদ ভালো হয়ে গেছে? এইসব ওই ছেলের অভিনয়। তুই বুঝবি না।
ফাইজা উল্টো ঘুরে তার ফুপিমণির হাত চেপে ধরে,
— আমি সত্যি বলছি ফুপিমণি। রিশাদ ভাইয়া একদম ভালো হয়ে গেছে। উনি আর ওইসব বাজে জিনিস খায় না। বাজে বন্ধুদের সাথে মিশে না। রাতেও দ্রুত বাসায় ফিরে আসে। ট্রাস্ট মি..
জিন্নাত ভ্রু কুঁচকায়,
— তুই এতোকিছু কিভাবে জানিস? বেশ কয়েকদিন যাবৎ দেখছি তোর মুখ থেকে রিশাদের প্রসংশাই সরছেই না। ব্যাপার কি বলতো?
ফাইজা তোতলায়,

— ব..ব্যাপার থাকতে যাবে কেন? আমাদের চোখে কি প..পড়ে না? রিশাদ ভাইয়া যে পরিবর্তন হয়েছে এটাতো আমাদের গেটের দারোয়ানও বলে দিতে পারবে। কারণ উনি বাড়ির রাস্তায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকে তোমার জন্য।
— কি কথা হচ্ছে তোমাদের মাঝে? হাতে পাকড়ার প্লেট নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করে মুসকান।
মুসকান কে দেখে চমকে যায় ফাইজা,
— তেমন কিছুনা ভাবি। ফুপিমণির সাথে গল্প করছিলাম।
জিন্নাত তীক্ষ্ণ নজরে ফাইজা কে দেখছে। কথা ঘুরাচ্ছে কেন এই মেয়ে..
মুসকান হেসে বলে,
— আমাকে ছাড়া গল্প আমি মানবো না। এই দেখ গরম গরম পাকড়া নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য । খেতে খেতে গল্প করো।
ঠিক সেই মুহূর্তেই কল আসে ফাইজার ফোনে। ফাইজা ফোনের স্কিনে তাকিয়ে চলে যেতে যেতে বলে,
— আমি এক্ষুনি আসছি তোমরা বসো।
মুসকান আর জিন্নাত দু’জনেই অবাক হয়ে ফাইজার চলে যাওয়া দেখে।

বিকাল থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে কারো সাথে কথা বলছে ফাইজা। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মুসকান কয়েকবার ফাইজার রুমের সামনে থেকে চক্কর কেটে চলে গেছে। এতোক্ষণ ধরে কার সাথে কথা বলছে ফাইজা! বেশ কয়েকদিন ধরে ফাইজার পরিবর্তন মুসকানেরও চোখে পরছে। মেয়েটা সারাক্ষণ ফোন নিয়েই পরে থাকে। পড়াশোনায়ও মনযোগ কমে গেছে। কে জানে এক্সাম গুলো ঠিকমতো দিয়েছে কিনা।
মুসকান আর এতো চিন্তা না করে নিজের ঘরে চলে গেল। ইদানীং তার শরীর টা কেমন দুর্বল লাগে। বুঝতে পারছে না কি হলো। মাথাটা শুধু ভার ভার লাগে। সারাদিন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
ঘরে ঢুকে ফোনটা হাতে নিতেই ফারিশের অনেকগুলো মিসডকল দেখতে পেল। সে দিয়েছিল বলেই হয়তো দিয়েছে। মুসকান কল বেক করার সাথে সাথে ফারিশ কেটে আবার কল দিল। মুসকান রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ফারিশের চিন্তিত গলা শুনা গেল,

— শরীর কেমন লাগছে এখন? ফোন কাছে রাখো না কেন তুমি? কল দিলে পাই না। শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
মুসকান ছোট্ট করে উত্তর দিল,
— ভালো লাগছে। আপনি কখন আসবেন?
— এসে পরবো জলদি। কিছু লাগবে?
— আচার নিয়ে আইসেন তো।
— আনবো। আর কিছু?
— নাহ।
— চটপটি, আইসক্রিম, ফুচকা এগুলো কিছু লাগবে না?
— না ওইসব খেতে ইচ্ছে করছে না।
ফারিশ একটু অবাকই হলো। চটপটি খাওয়ার জন্য পা’গল হয়ে যাওয়া মেয়েটা বলছে তার এসব খেতে ইচ্ছে করছে না। চিন্তিত স্বর নিয়ে ফারিশ আবারো জিজ্ঞেস করল,
— তোমার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? আমি কি ডক্টর নিয়ে আসবো?
মুসকান হেসে ফেলল,

— আরে নাহ। পা’গল হয়েছেন? এইটুকুর জন্য কেউ ডক্টর নিয়ে আসে।
— আচ্ছা তুমি রেস্ট নাও। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই।
ফারিশের সাথে কথা বলে বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল মুসকান। এই সময়টা তার কাছে এতো খারাপ কেন লাগে সে বুঝতে পারেনা।

তাজমহল বিকেল থেকেই মুসকানকে খেয়াল করছে। নিজের হাতে পাকড়া ভেজেছে খাবে বলে। কিন্তু ভাজার পর আর নাকি খেতে ইচ্ছে করছে না। ফাইজা আর তার ফুপিমণির জন্য নিয়ে গেছে। এই অবেলায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। তাজমহল গিয়ে বার দুয়েক ডেকে এসেছে খাওয়ার জন্য। রাতের খাবার টা খেয়ে নাহয় শুয়ে থাকুক। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে উনাকে। তাজমহল আর জোর করে নি। ছেলে আসলে নাহয় সেই রাজি করাবে এইভেবে চলে এসেছে।
বেশিরাত করে বাড়ি ফিরেনি ফারিশ। কাজ শেষ করে মুসকানের জন্য দ্রুতই ফিরে এসেছে। হাতে করে যেন আচারের দোকান নিয়ে এসেছে।
ফারিশ ঘরে ঢুকতেই দেখে পুরো রুম অন্ধকার। সে আচারের বড় থলে টা সোফার উপর রেখে লাইট ওন না করেই ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেল।

ফারিশ এসেছে বুঝতে পেরে শুয়া থেকে উঠে বসল মুসকান। সজাগই ছিল এতোক্ষণ । ফারিশের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে খাবার খাইয়ে একেবারে ঘুমাবে বলে শুধু শুয়ে ছিল। প্রতিদিন যেটা করে।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মুসকান কে খাটের উপর মাথা ধরে বসে থাকতে দেখে ফারিশ। সে গিয়ে মুসকানের পাশে বসলো। আলগোছে মুসকানের মাথাটা নিজের কাঁধে ফেলে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— কি হয়েছে? মা বলল সারাদিন নাকি কিছু খাওনি?দিন শেষে বাড়ি এসে যদি তোমাকে এভাবে নিস্তেজ হয়ে পরে থাকতে দেখি তাহলে কি ভালো লাগে বলো?
মুসকান ফারিশের কাঁধ থেকে মাথা ওঠায়। মৃদু হেসে বলে,
— আমার কিছু হয়নি। আপনার মতো স্বামী থাকলে কি কিছু হতে পারে ? নিচে আসুন। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
ফারিশ বাঁধা দিল,

— পরে খাব। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও?
মুসকান চোখ ছোট করে বলল,
— কি প্রশ্নের?
ফারিশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মুসকানের চোখে। গাঢ় কণ্ঠে সরাসরি প্রশ্ন করল,
— তোমার কি এই মান্থে পি’রি’য়’ড মিস হয়েছে?
সরাসরি এভাবে বলায় লজ্জা পেয়ে গেল মুসকান। ফারিশ আবারো বলল,
— কথার উত্তর দাও মুসকান। লজ্জা পরে পেও।
মুসকান যেন আরো লজ্জা পেল। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
— শুধু এই মান্থে নয় গত মান্থেও মিস হয়েছে।
—” হোয়াট ”
উত্তেজিত হয়ে খাট থেকে উঠে দাঁড়াল ফারিশ। ফারিশের উচ্চ কণ্ঠে মুসকান কেঁপে উঠল…
— টু মান্থ হয়েগেছে তুমি আমাকে জানাওনি কেন?
মুসকান ঢুক গিলল। পি’রি’য়’ড মিস হয়েছে এটা কি বলার মতো বিষয় !
সে ভয়ে ভয়ে বলল,

— আগে ওতো এমন হয়েছিল তাই…
— তাই কি ??? ওহহ গড এতোটা ইরেসপন্সিবেল কি করে হলে তুমি? আগে এমন হয়েছে বলে যে এখনো এমন হবে এটার তো কোনো মানে নেই না !!!
মুসকান থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশের কথা শুনে উত্তেজনায় তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। ফারিশ দ্রুত নিজের পেন্টের পকেট থেকে মুসকানের জন্য আনা প্রেগন্যান্সি কিট টা বের করল। মুসকানের হাতে দিয়ে বলল,
— ওয়াশরুমে যাও কুইক। ইমিডিয়েটলি আমাকে এনে দেখাবে বুঝেছো..?
— কিন্তু..
— সব কিন্তু পরে শুনবো দ্রুত কর। মুসকানকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিল ফারিশ। ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সে সমানে পায়চারী করতে লাগল।

সময় নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খোলে মুসকান। ভীতু চোখে তাকিয়ে ফারিশের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়,,,
স্পষ্ট দুটি লাল দাগ ফারিশের চোখের সামনে ঝলঝল করছে। যা দেখে ফারিশের চোখও ঝলঝল করে উঠে! মুসকানের হাত থেকে কিট টা নিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পরে ফারিশ। সামনের চুল গুলো উঁচু করে টেনে ধরে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করে,,,
—” ওহ মাই গড ”
অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপছে ফারিশের। এতো কেয়ারফুল থাকার পরেও এটা কি করে হলো! এক বাচ্চার পেটে আরেক বাচ্চা কিভাবে কিহ! কিছু বুঝে আসছে না ফারিশের। মাথা যেন ভনভন করে ঘুরছে। বাবা হওয়ার জন্য খুশি হবে নাকি বউয়ের টেনশনে পা’গল হয়ে যাবে। কি করবে সে! অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করার পরিণাম হারে হারে বুঝতে পারছে এবার।

মুসকান পেটে হাত দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। খুশিতে তার চোখে পানি চিকচিক করছে। হাত-পা কাঁপছে। গলা দিয়ে সাউন্ড বের হচ্ছে না। ফারিশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই ঢুকরে কেঁদে উঠলো সে। আকস্মিক মুসকানের কান্নায় ঘাবড়ে গেল ফারিশ। খাট থেকে লাফিয়ে ওঠে মুসকানের সামনে এসে দাঁড়াল। মুসকানের দুগালে দু হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
— কাঁদছ কেন?

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২৫

মুসকান আচমকা ফারিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আঁটকে আসা গলায় বলল,
— আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি মা হবো!
মুসকানের চুলে হাত রেখে স্নিগ্ধ হাসল ফারিশ। ক্ষনিকের জন্য সেতো ভুলেই গিয়েছিল যে সেও বাবা হবে! তাদের ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে বেবি আসবে। ভাবতেই শরীর জুড়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল ফারিশের..

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২৭