তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩৩
অহনা আক্তার
ফারিশের জন্য কফি নিয়ে রুমে প্রবেশ করল মুসকান। ফারিশ তখন ওয়াশরুমে ছিলো।
কফিটা সাইড টেবিলে রেখে আম্মা কে কল দিবে বলে মোবাইলটা হাতে নিল সে। কিন্তু মোবাইল সাইলেন্ট করা দেখে অবাক হলো। কপাল কুঁচকে গেল অপরিচিত নাম্বার থেকে অনেক গুলো মিসডকল উঠা দেখে। এতোগুলো কল তাকে কে দিল এটা চিন্তা করতে করতে আবারো কল আসলো। কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই অপর পাশের ব্যক্তির বিচলিত স্বর ভেসে আসলো,
— থ্যাংক গড তুই ফোন তুলেছিস। সারারাত ধরে ট্রাই করছি ইয়ার।
মুসকান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। গলা শুনে কে বুঝে গিয়েছে। ভীতু চোখে একবার ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে বেলকনিতে চলে আসল। চাপা স্বরে বলল,
— রিশাদ ভাইয়া তুমি?
রিশাদের কণ্ঠ বড্ড উদ্ভ্রান্ত শুনালো,
— হ্যা আমি। ফাইজা কোথায়? ওহ ফোন তুলছে না কেন আমার? ওর কি হয়েছে? ফাইজা ঠিক আছে তো?
গোটা একটা দিন চলে গেছে আমি ফাইজার সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।
— রিশাদ ভাইয়া শান্ত হও তুমি। ফাইজা ঠিক আছে..
— ঠিক থাকলে আমার ফোন কেন তুলছে না? কাল রাত থেকে আমি তোদের বাড়ির রাস্তায় ঘুরঘুর করছি। সকাল থেকে ফাইজা একবারও তার রুমের জানালা খোলেনি। প্লিজ মুসকান আমাকে একবার ফাইজার সাথে কথা বলিয়ে দে। আমি পা’গল হয়ে যাচ্ছি।
মুসকান তাড়াহুড়োতে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— ফাইজার রেজাল্ট একটু খারাপ হওয়ায় বড়চাচি ওর ফোন নিয়ে নিয়েছে। যার জন্য তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। আমি সুযোগ হলে তোমাদের কথা বলিয়ে দিব।
— এখন কি হয়েছে? এখনি বলিয়ে দে…
— এখন কি করে সম্ভব? উনি বাড়িতে আছে। জানতে পারলে সমস্যা হবে? তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি কল না দিলে তুমি নিজে থেকে কখনো এই নাম্বরে কল দিও না…
— কাকে কল দিতে নিষেধ করছো?
আচমকা ফারিশের গলা শুনে চমকে তাকাল মুসকান। ফারিশ তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। শেষের প্রতিটা কথা শুনেছে।
ভয়ে মুসকানের বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। কথা বলতে গলা কাঁপছে । মুসকানের এহেম আচরণে ফারিশের নজর আরো সন্দেহসূচক হলো। সে ধারাল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— কি হলো বলছো না কেন? কাকে কল দিতে নিষেধ করছো তুমি? আড়ালে এসে কার সাথে কথা বলছো?
মুসকান বিব্রত স্বরে বলল,
— কেউনা। এমনিই কল দিয়ে…
— মিথ্যে বলবে না বলে দিচ্ছি*** (গর্জন ছুঁড়ে বলল ফারিশ)
মুসকানের নিঃশ্বাস থমকে গেল। বুক কাঁপছে বিরতিহীন ভাবে। ফারিশ হাওয়ার বেগে ছুটে এসে মুসকানের বাহু চেপে ধরল। হিংস্র কণ্ঠে বলল,
— আমি স্পষ্ট শুনেছি তুমি কাউকে বাড়ি চলে যেতে বলছো। আমি জানতে পারলে সমস্যা হবে বলছো! আমি জানতে পারলে কি সমস্যা হবে মুসকান? কি লুকাচ্ছ আমার থেকে? এসব কি হচ্ছে বলবে আমায়???
শেষের কথাটা অনেকটা চিল্লিয়ে বলেছে ফারিশ।
মুসকানের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। দৃষ্টি নিচের দিকে। ফারিশের চেপে ধরায় হাতে প্রচন্ড ব্যথা পাচ্ছে। নাকের পাটা লাল হচ্ছে। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে পারছে না। ফারিশ আবার বলল,
— তাকাও আমার দিকে,, কে ছিলো বলো? তোমার ভীতু চাহনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ তুমি! কি লুকাচ্ছ বলো? রাত দুটো বাজে কে কল করে তোমায় ?? কাকে নিজে থেকে কল দিতে নিষেধ করছো ???
মুসকানের চোখের কোনে জল চিকচিক করছে,
— আপনি ভুল ভাবছেন আমায়।
মুসকানের চোখে পানি দেখেও ফারিশ পরোয়া করল না। হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজেই কল বেক করল। তখন ফারিশের গলা শুনামাত্রই কল কেটে দিয়েছিল মুসকান ৷ যার জন্য রিশাদ বুঝতে পারেনি। এখন কল করায় রিশাদ সাথে সাথেই কল রিসিভ করল,
— হ্যালো হঠাৎ কল কেটে দিয়েছিস কেন? কেউ এসেছিল?
বিস্ময় নিয়ে মুসকানের দিকে তাকালো ফারিশ। মুসকান চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছে। ফারিশের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পরেছে।
ফোন কেটে গটগট পায়ে রুমে চলে আসল ফারিশ। রাগে তার মাথা ফে’টে যাচ্ছে। পায়ের রক্ত টগবগ করে মাথায় উঠে গেছে। চোখ রক্তবর্ণ। ফারিশের পিছু পিছু কম্পিত পায়ে রুমে প্রবেশ করল মুসকান। তার সাঙ্ঘাতিক ভয় হচ্ছে। ফারিশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তীরের ফলার মতো গায়ে বিঁধছে। সে কাঁপা স্বরে বলার চেষ্টা করল,
— আমার কথা শুনুন*****
— শোনার মতো কিছু বাকি রেখেছো তুমিইইই ???
কথাটা চিল্লিয়ে বলে হাতে থাকা ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেলল ফারিশ। হুংকার ছাঁড়ল,
— আমার বিশ্বাস ভেঙেছো তুমি। আমার থেকে লুকিয়ে রিশাদের সাথে যোগাযোগ করেছো। না করেছিলাম আমি তোমায়। আমার কথা রাখোনি। কেন রাখো নি??
মুসকানের দৃষ্টি ঝাপসা। চোখ দুটিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। ফারিশ কে বুঝাতে সক্ষম হচ্ছে না সে। লোকটা তার কথাই শুনতে চাইছে না। চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিল মুসকান। ফারিশের সামনে এসে তার শক্তপোক্ত হাত দুটো নিজের নরম হাত দ্বারা আঁকড়ে ধরল। লাল চোখ দুটোতে দৃষ্টি স্থির করে বলল,
— এতো উত্তেজিত হবেন না প্লিজ শান্ত হন।
ঝাড়া মেরে নিজের হাত সরিয়ে ফেলল ফারিশ। বিদ্রুপ হেসে বলল,
— একটা ছেলে আমার স্ত্রীকে মাঝরাতে কল করছে। আমার স্ত্রীও আমাকে না জানিয়ে সেই ছেলের সাথে কথা বলছে। আবার এও বলছে আমি জানতে পারলে নাকি তার সমস্যা হবে। এমনটা জানতে পারলে কোন স্বামী উত্তেজিত হবে না বলতে পারো? যেখানে আমি জানি ছেলেটি একসময় তোমাকে বিয়ে করার জন্য উন্মাদ ছিলো!
মুসকান নতজানু হয়ে চোখের পানি ফেলছে। কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সত্যি টাও এখন বলা সম্ভব নয়। ফাইজা বিপদে পড়বে। কি করবে সে,,,
রক্তিম চোখ নিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো ফারিশ। ঠান্ডা স্বরে বলল,
— রিশাদ কেন কল করেছিল?
মুসকানের বুক ধড়াস করে উঠল। ফারিশের কণ্ঠে কি যেন ছিল। সে নতমুখে বলল,
— খো…খোঁজ নিতে?
— আমার বউয়ের খোঁজ সে কেন নিবে?
— সম্পর্কে বোন হই এইজন্য।
প্রচন্ড আক্রোশে মুসকানের গাল চেপে ধরল ফারিশ। ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে বলল,
— আমাকে নাদান মনে হয়। যা খুশি তাই বলে দিবে আর বিশ্বাস করে নিব। রিশাদ শুধু তোমার খোঁজ নিতে এতোগুলো কল দিবে ?? কি মনে করো নিজেকে?
মুসকান আর্তনাদ করে উঠল। আহত স্বরে বলল,
— আমি ব্যথা পাচ্ছি…
ফারিশ হাত শিথিল করে ধরল। তবে গাল ছাড়ল না,
— সত্যি টা বলো?
— এটাই সত্যি।
ফারিশ মুসকানের গাল ছেড়ে দিল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে কফির মগটা ছুঁড়ে ফেলল। কাঁচের কাপটা বিকট শব্দ তুলে মুসকানের পায়ের কাছে এসে গুড়িয়ে গেল। ভয়ে আতঙ্কে মুসকানের হৃদপিণ্ড কাঁপছে। শব্দ শুনে তাজমহল আর ফাইজা ছুটে আসল রুমে। ফারিশের ক্রোধান্বিত লাল চেহারা দেখে মা-মেয়ে দু’জনেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল।
মুসকান কাচুমাচু হয়ে এককোনায় কাঁদছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তাজমহল ছেলের দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
— কি হয়েছে ফারিশ?
ফারিশ জবাব দিল না। গটগট পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ফারিশ চলে যাওয়ার পর মুসকান এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। ভয়ের কারণে এতোক্ষণ ঠিক করে কাঁদতেও পারছিল না বেচারা। যদি আরো রেগে যায়।
ফাইজা ছোটে মুসকানের কাছে আসল। তাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল,
— কি হয়েছে ভাবি? ভাইয়া এতো রেগেছে কেন?
মুসকান ঢুকরে কাঁদছে। কাঁদার জন্য কথা বলতে পারছে না। এবার তাজমহলও মুসকানের কাছে আসল। মাথায় হাত রেখে মমতাময়ী সুরে বলল,
— কি হয়েছে মা? বলো আমায়। না বললে বুঝবো কি করে?
তাজমহলের কোমল স্বরে মুসকান তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— আপনার ছেলের এতো রাগ কেন বড়চাচি?
তাজমহল মুসকানের চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
— পুরুষ মানুষতো তাই রাগটা সবসময়ই বেশি। আর আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই মাথা গরম হয়ে গেলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা। তোমার বড়চাচাও এইরকম। কাঁদে না মা। রাগ কমে গেলে দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।
মুসকান তাও কাঁদছে। ফাইজা দ্রুত এক গ্লাস পানি এনে মুসকানকে খেতে দিল,
— পানি খাও ভাবি।
তাজমহল মুসকানের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তাকে পানি খেতে সাহায্য করল। মুসকান পানিটা খেয়ে একটু শান্ত হতেই তাজমহল বলল,
— আসুক আজকে ওর বাবা বাড়িতে। হ’তচ্ছাড়াটাকে যদি কিছু না বলেছে তো আমিও দেখবো। তুমি যাও মা গিয়ে একটা গোসল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। কিভাবে ঘেমেছো খেয়াল আছে। এভাবে তো ঠান্ডা লেগে যাবে। ফাইজা মুসকানের কাপড় গুলো একটু বের করে দাও তো..
ফাইজা ছুটে গিয়ে কাবার্ড থেকে মুসকানের কাপড় নিয়ে আসল। তাজমহল মুসকানকে বুঝিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে বলল,
— জলদি গোসল করো। ওই অ’সভ্যটাকে এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই…
সাওয়ার নিয়ে এসে চিন্তিত হয়ে সোফায় বসে আছে মুসকান। পাশেই ফাইজা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মুসকানের মুখ থেকে সব কথা শুনে তার কলিজা শুধু ধপাস ধপাস করছে। রিশাদকে অ’শ্রাব্য ভাষায় কয়েকটা গা’লি দিতে ইচ্ছে করছে। ওই লোকটা হচ্ছে যত ন’ষ্টের মূল। ওর ফোনের জন্যই আজ তার ভাইয়া ভাবির মধ্যে এতোবড় একটা ঝামেলা হয়ে গেল। সামনে পেয়ে নেক শুধু। একটা দিন একটু ধৈর্য ধরতে পারল না। সে তো যোগাযোগ করতোই। এখন কি হবে? ফারিশ ভাইয়া যদি জেনে যায় তাহলে ভাবির থেকেও তার অবস্থা করুন করে ছাঁড়বে। বাচ্চাদের মতো শুয়ে বসে গড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ফাইজার। কেন যে এসব প্রেম ভালোবাসায় জড়াতে গেল,,
কথা বলবে না সে! রিশাদের সাথে একটুও কথা বলবে না। ওই লোকটার জন্যই মুসকান কে এতো বিপদে পড়তে হচ্ছে। সে কি জানে না তার ভাই কেমন। জানতে পারলে কি কি করবে। এরপরও এতোবার কল করবে কেন! মুসকানের মোবাইল হাতে নিয়ে রিশাদের নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিল ফাইজা। তার জন্য মেয়েটাকে আর বিপদে ফেলবে না সে। এই অবস্থায় এমনিতেই অনেক দখল গিয়েছে উপর দিয়ে।
ফাইজা মুসকানকে পেছন থেকে জাপটে ধরে মুখ গোমড়া করে বসে রইল। মুসকন বলল,
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩২
— এভাবে যে সবকিছু থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছ। তোমাকে না পেয়েতো ডিরেক্ট বাড়িতে এসে উঠবে। তখন কি করবে?
— উঠলে উঠুক। মামার বাড়িতে উঠে না মানুষ।
মুসকান মৃদু হাসে। তার মনটা যে খুব উসখুস করছে। লোকটার রাগ কি করে ভাঙাবে সে..