দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১০
আফরোজা আশা
দুগালে হাত দিয়ে কাঁচা ফুল দিয়ে হলুদের সাজে সজ্জিত বাণীর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে বেলা। কি অপূর্ব দেখতে লাগছে ওর বড় আপাকে। বেলার চাহনি দেখে মিটিমিটি হাসছে বাণী। এক পর্যায়ে জোরে হেসে দিল। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ এভাবে আর কতক্ষন দেখবি? ’
বেলা বিস্মিত গলায় আওড়ালো, ‘ আমার তো মন ভরছে না আপা। ইসস, তোমাকে দেখতে কি মিষ্টি লাগছে! আমি কিছুতেই ছাদে যেতে দেবো না তোমায়। পাজি মানুষরা তোমার মতো পরীকে দেখলে নজর দেবে। ’
অমায়িক হেসে গলায় দুষ্টুমির রেশ ধরে বাণী বলল, ‘ তোকে যে আমার থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে সেবেলা। কে বলবে তুই মাত্র এসএসসি লেভেলে পিচ্চি বেলা। শাড়ি, গয়না পরে একদম পাক্কা গিন্নি লাগছিস। আমার যদি দেবর থাকত তাহলে তোকে তুলে নিয়ে যেতাম, বুঝলি। ’
বোনের কাছ থেকে প্রশংসা শুনে একদফা গলে গেল বেলা। উচ্ছ্বাস ভরা চেহারা নিয়ে বিগলত কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ সত্যি আপা! আমাকে তোমার থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে? আজ তো দিহান ভাইদের বাড়িতে তাদের অনেক আত্মীয় এসেছে তাই না! ’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল বাণী। বেলা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিমা করে বলল, ‘ রায়হান ভাইরাও আসবে তাহলে। ইসস! কি লজ্জা লাগছে আমার। এখনি তো ওবাড়ি যাবো দিহান ভাইকে হলুদ দিতে। আমার মতো পরীকে দেখলে নির্ঘাত আজ রায়হান ভাই নিজে এসে প্রপোজাল দিবে আমায়। হায় হায়! ’
কথাগুলো বলে দুহাতে মুখ ঢাকল বেলা। এদিকে বাণী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বেলার দিকে। কড়া গলায় বলে উঠল,
‘ এ্যাঁহহ! বেলা, কি বললি? এসব কি? রায়হান ভাই আমাদের বড় ভাই এর মতো। তাকে নিয়ে এসব ভাবতে নেই। আর যেন এগুলো না শুনি তোর মুখে।’
কালো হয়ে গেল বেলার মুখ। মুখ ফসকে আপার সামনে কি থেকে কি বলে ফেলেছে ও। এখন কি হবে? চোরা দৃষ্টি ফেলে আমতা আমতা শুরু করল ও। তখনি বাণীর রুমের দরজা ঠেলে রুমে আসলো রহমান পাটোয়ারী। বাবাকে দেখে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল বাণী। রহমান দেখল অভিমানী বড় মেয়েকে। স্মিথ হেসে বেলার কাছে এসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
‘ মাশ-আল্লাহ। আমার ছোট আম্মুকে তো খুব সুন্দর লাগছে। যাও! তোমার জন্য সবাই নিচে অপেক্ষা করছে। সাবধানে যেও আর দিশাকে বলে দিয়েছি তোমার খেয়াল রাখতে। যতক্ষন ওখানে থাকবে ওর সাথেই থাকবে কেমন! ’
মাথা হেলিয়ে সায় জানাল বেলা। শাড়ির কুঁচিগুলো ধরে আস্তেধীরে নিচে নামল। পেছন থেকে বাণীর সাবধানী আওয়াজ ভেসে আসল, ‘ আস্তেধীরে সাবধানে হাঁটবি। শাড়ি যেন পায়ের সাথে না বাঁধে, দেখিস। ’
বাণীর কথা শুনল বেলা কিন্তু ততোক্ষনে রুমের বাইরে চলে এসেছে ও। বেলা চলে যেতে রহমান আবারো তাকালো বাণীর দিকে। ও এখনো অপরদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। রহমান বাণীর পাশে বসে শান্ত আদুরে গলায় বলল,
‘ কেনো রেগে আছেন, আম্মা? কারো কথা শুনছেন না? এ বিয়েতে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে? যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে এখনি বলুন। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমি বিয়ে ভেঙ্গে দিবো। আমার মেয়েদের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কখনোই কোনো কাজ করি না। আপনার মতামত তো নিয়েছিলাম, আপনিও মত দিয়েছিলেন। তাহলে আমার শান্তশিষ্ট,বুঝদার বড় আম্মাজান আজ এতো রুষ্ট কেনো আমার উপরে? ’
ছলছল নেত্রে বাবার দিকে ফিরল বাণী। কণ্ঠে একরাশ অভিমান নিয়ে বলল,
‘ আমার এক বোনকে ঘরে আটকে রেখে তুমি চাইছো আমি হেসে-খেলে গিয়ে হলুদে বসি? ও কি করেছে, কেনো করেছে তা আমি জানি না। জানতেও চাই না এখন। বেলা, বৃষ্টি আমার কাছে আলাদা নয় আব্বু। দুজনকেই কোলেপিঠে বড় করেছি আমি। কিছু খাওয়ার আগে, কিছু কেনার আগে নিজের জন্য না নিয়ে ওদের জন্য নেই। নিজের জন্য ভাবার আগে আমার ছোট দুইবোনের কথা আগে ভাবি। আজ আমার জীবনের এতো বড় মূহুর্তটা একজনকে ছাড়াই পালন করব। এ কেমন বিচার তোমার আব্বু?’
রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাণীর একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভঙ্গুর গলায় বললেন,
‘ আমি ভুল করেছি আম্মা। অনেক বড় ভুল করেছি। মায়ের উপরে কথা বলতে পারব না দেখে তাকে ভরসা করে ছেড়ে দিয়েছিলাম বৃষ্টিকে তার হাতে। শেষ করে দিয়েছে সে আমার মেয়েটাকে। একরোখা, অহংকারী, বদমেজাজি হয়ে গিয়েছে ও। আরো বড় ভুল করেছি মায়ের হুকুমে ওর হাতে ফোন তুলে দিয়ে। এখন এটা আমার কাছে ভুল কম অপরাধ বেশি লাগছে। চোখ দিয়েছিলাম ওর দিকে। নজরে নজরে রেখেছিলাম যেন ভুল পথে পা না বাড়ায় কিন্তু ওতো আমাকে হারিয়ে দিল । বাণী আর বেলার আদর্শ বাবা হতে পারলেও বৃষ্টির জন্য তা হতে পারলাম না। আমি বর্তমানে অপরাধবোধ, দ্বিধা, অনুতপ্ততা, ব্যর্থতা সবকিছুতে ভুগছি, আম্মা। ’
উদ্বিগ্ন হলো বাণী। বাবার হাত আকড়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘ কি করেছে বৃষ্টি? কেনো ওকে এতো মারলে? কেনো আটকে রেখেছো? কাল কি এমন দেখলে ওর ফোনে?’
রহমান সাহেবের নয়নজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো। কাল দিগন্তরা যাওয়ার পর বৃষ্টির গায়ে হাত তুলেছিল সে। তারপর ওকে রুমে বন্দি করে রেখেছে। সবাইকে বলেছে বৃষ্টির জ্বর এসেছে তাই রুমে আছে। কেউ আর এ বিষয়ে বেশি ঘাটে নি কারণ বৃষ্টির ব্যবহার খুব একটা পছন্দসই না। রহমান সাহেবকে বেখেয়ালি হতে দেখে বাণী তার হাতটা একটু ঝাঁকিয়ে আবার বলল, ‘ কি হলো বলো? ওকে মারলে কেনো? তুমি তো কখনো তোমার কোনো মেয়ের গায়ে হাত তোলোনি। তাহলে বৃষ্টিকে কেনো মারলে? ’
রহমান বড় বড় শ্বাস টেনে নিজেকে শক্ত করল। তারপর মুচকি হেসে বাণীর কপালে পিতৃস্নেহের আদর দিয়ে বলল,
‘ আব্বু কখনো তোমাদের কোনো অন্যায় করতে দেয় নি। ভবিষ্যৎতেও দিবে না। ভরসা রাখো আমার উপরে। বৃষ্টির জন্য এখন যতটুকু শাসন প্রয়োজন আমি তাই করছি। এছাড়া ওকে সঠিক পথে ফেরানোর উপায় নেই। নিজ হাতে নিজের জীবন ধ্বংস করতে তাইছে ও, তা আমি বেঁচে থাকতে কি করে হতে দেই আম্মা। একটা গুন্ডা, লাফাঙ্গার সাথে সম্পর্ক অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে ওর। না ছেলেটা ভালো, না ওর কাজ-কর্ম আর নাইবা ওর ব্যাকগ্রাউন্ড। এরকম একটা ছেলের জন্য আমি আমার মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দিতে পারি নি। দেরীতে হলেও জেনেবুঝে চুপ থাকলে বৃষ্টির ক্ষতি হবে। কিন্তু আমার কোনো মেয়ের চুল পরিমাণ ক্ষতিও আমি বরদাস্ত করব না। ’
বাণী থ মেরে গিয়েছে। বৃষ্টির আচার-আচরণ একটু আলাদা হলেও এসবের আভাস ও একদমি পায় নি। বুকটা কেমন শূন্য শূন্য ঠেকছে। বড় বোন হয়েও পারে নি বড় বোনের দ্বায়িত্ব পালন করতে।
ফুপির বাড়িতে আসতেই বেলার অবস্থা নাজেহাল। একে তো শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারছে না ঠিকভাবে। এখন আবার হাত ভর্তি মিষ্টির ব্যাগগুলো নিয়ে নড়াচড়া করাও কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে। ওর বাড়ি থেকে এসেছে পাঁচজন মানুষ। সবার হাতেই কিছু না কিছু রয়েছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুটা হেঁটেই দাঁড়িয়ে পড়ল বেলা। ওর সাথে যারা ছিল তারা এতোক্ষণে ভেতরে চলে গিয়েছে। আর ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করুন চোখে বাড়িতে প্রবেশের আগে বিশাল রাস্তাটাকে দেখছে। এই রাস্তাটুকু পেরিয়ে তবেই বাড়িতে ঢুকতে হবে ওকে। অথচ বেলা আর দুকদমও হাঁটতে পারবে না। শাড়ি পড়তে ভীষণ ভালোবাসে ও। মাঝেমধ্যেই পড়ে। কিন্তু পড়ার পর দুহাত দিয়ে সামলে হাঁটে বলে কখনো খুলে যায় নি। আজ অনেকটাই এলোমেলো ভাবে হেঁটেছে ফলস্বরূপ শাড়ি ঢিলা হয়ে গিয়ে মাটিতে ঝুলছে। একটু হাঁটলেই কুঁচির সাথে প্যাঁচ খেয়ে মাটিতে পড়বেই পড়বে। মিষ্টির ব্যাগগুলো দুহাতে ধরে রেখেই ডাগর ডাগর চোখজোড়া নিয়ে আশেপাশে চোখ ঘুরালো।
এদিকে পার্কিং লটে জীপের উপরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে দিগন্ত। হাতের এক আঙুলে চরকা কাটছে জীপের চাবি। দৃষ্টি নিবদ্ধ বেলার কর্মকাণ্ডের উপর। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিচে নেমে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করে নিজ মতো স্ক্রোল করতে করতে হাঁটা ধরল বাড়ির দিকে। ভাব এমন এখানে যে বেলা দাঁড়িয়ে আছে সেটা ও জানে না। এদিকে দিগন্তকে দেখে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠেছে বেলার। দিগন্ত ওর পাশ কাটিয়ে যেতেই ডাক পারল,
‘ দিগন্ত ভাইইইইই! ’
বেলা ভাইইই ডাকটা মধু মিশিয়ে ডাকলেও দিগন্তের কানে সেটা বিষের ন্যায় ঠেকল। চোখমুখ কুঞ্চিত করে ফিরল ডাকওয়ালীর পানে। কর্কশ গলায় বলল, ‘ কে? ’
ওপাশ থেকে ঝটপট উত্তর এলো, ‘ আমি। ’
‘ কে আপনি? রানি এলিজাবেথ! ’
দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বেলা বলল, ‘ নাহ! ’
‘ তাহলে! ‘ আমি ‘ বলে এতো সুন্দর পরিচয় দিলেন যে? কোন রাজ্যের রানি হোন? ’
‘ পাটোয়ারী বাড়ির। ’
ব্যঙ্গাত্মক গলায় দিগন্ত প্রতিউত্তর করল, ‘ হ্যাঁ, সেই! ভিখারিণী রাজ্যের রানি হয়েই থাকেন আপনি। আপনার মতো বেয়াদপ অন্য কোথাও রানি হতে পারবে না। ’
দিগন্তের কথা অস্পষ্ট শুনল বেলা। নিজে থেকে আবারো বলল,
‘ আমি বেলা, দিগন্ত ভাই। চিনতে পারছেন না? ’
‘ এরকম সং সেজেছিস কেনো? ’
‘ ভালো লাগছে না? ’
‘ না। ’
ব্যস ঠুস করে ভেঙে গেল বেলার ছোট সাইজের মনটা। মূহুর্তেই চোখে জুড়ে পানি ছাপিয়ে গেল। দিগন্তের দিকে ছলছল নেত্রে চেয়ে বলল, ‘ সবাই ভালো বলেছে। শুধু আপনি খারাপ বললেন।’
দাঁতে দাঁত পিষল দিগন্ত। নিজের উদ্দেশ্যে কয়টা গালি ছুড়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ হাতের ব্যাগগুলো দে আমাকে। আর এখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আমি মনি’কে পাঠাচ্ছি। ’
কিছু বলল না বেলা। চুপ করে রইল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছে ওর। দিগন্ত একপলক দেখল ছোট মায়াবী মুখটা। আসলেই সুন্দর লাগছে বেলাকে। হালকা সাজটুকু ফর্সা মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে মারাত্মকভাবে। টানা টানা চোখগুলো সাজিয়েছে আরো নিখুঁতভাবে। আর কিছু দেখার সাহস হলো না। নিজের বেহায়া চোখজোড়া আলগোছে সরিয়ে ফেলল দিগন্ত। বেলার হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।
কিছুক্ষন পরেই হন্তদন্ত পায়ে বেলার কাছে ছুটে এলো মিতালী। হাফ ধরা গলায় বলল, ‘ তোকে আমি কতক্ষন থেকে খুঁজে চলেছি আর তুই এখানেই দাঁড়িয়ে। দিগু না বললে তো এতোক্ষন সারাবাড়ি খুঁজে বেড়াতাম। আয়! আগে শাড়িটা ঠিক করে দেই। ’
কথাগুলো বলে মিতালী অনেকটা হেলে গিয়ে বেলার শাড়ির কুঁচিগুলোতে হাত দিল। এতোক্ষন বেজার মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা বেলা হুট করে হি হি করে হাসা শুরু করল। মিতালী কুঁচি ঠিক করে দিয়ে বলল, ‘ কি হলো? এভাবে পাগলের মতো হাসা ধরলি কেনো? ’
বেলা খানিক সময়ের জন্য হাসি চেপে চঞ্চল গলায় বলে উঠল,
‘ তুমি দিগু বললে আর আমার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে।’
‘ কি? ’
‘ হ আকার গু । ’
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৯
এটুকু বলে আবারো খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করল । এদিকে মিতালী হতভম্বের ন্যায় কয়েক সেকেন্ড ব্যয় করল। তারপর বেলার কথাটা বুঝতে পেরে জোরে হেসে দিল।