দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১১

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১১
আফরোজা আশা

প্রায় অনেকক্ষন যাবৎ রায়হানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে বেলা। নানা তাল-বাহানা করছে আর রায়হানের সাথে কথা বলার ছুতো খুঁজছে। বেলার এসব কর্মকান্ডে রায়হান বেচারা দোয়া-দরুদ পড়ছে আর চোখ বুলাচ্ছে চারপাশে। দিগন্ত আপাতত এখানে নেই। দিহানের গায়ে হলুদের জন্য স্টেজে ওর কাছেই বসে আছে রায়হান। সাথে আরো বেশ কয়েকজন ছেলেপেলে। কিছুক্ষন আগেই বেলা একবার ঢু মেরে রায়হানের পাশ কেটে বাহিরের দিকে গিয়েছিল। এখন আবার আসলো এদিকে। শাড়ির কুঁচিগুলো ভালোভাবে সামলে রায়হানের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে কিছু একটার সাথে জোরে ধাক্কা খেলো। নাকে ব্যাথা পেল অনেকটাই। চোখে পানি চলে এসেছে। হাত দিয়ে নাক বুলাতে বুলাতে সামনে তাকালো। দেখতে পেল ফোন হাতে দাঁড়ানো গম্ভীর মুখাবয়বের অধিকার দিগন্ত তালুকদারকে। সরু চোখে বেলার দিকে তাকিয়ে আছে দিগন্ত। হুট করে ভারী গলায় বলে উঠল,

‘ চোখ কোথায়? ’
বেখেয়ালি বেলাও নাকে হাত রেখে ফট করে বলে দিল বলে দিল ,
‘ রায়হান ভাইয়ের দিকে। ’
বলেই জিভ কাটল। তড়িৎ গতিতে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে না বলল। এদিকে দিগন্তের নজর আটকে গেল বেলার কানের দুপাশে ছেড়ে রাখা ছোট চুল গুলোতে। মাথা নাড়ানোর সাথে সাথে ও দুটো হালকা উড়ে গিয়ে বেলার মুখে পড়ল। সেগুলো আবার বেলা হাত দিয়ে ঠেলে কানের পিছে গুজে নিল। এসব দেখে দিগন্ত ধমকে উঠে বলল,
‘ দুপাশে দুটো অ্যান্টেনা ছেড়েছিস কেনো? ছেলেদের কাছে গিয়ে আবার ছাপরিগুলোর মতো কানে পিছনে ঘঁষা মারছিস। সমস্যা কি? মনে রঙ লেগেছে খুব? ’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেলা অবুঝ গলায় বলল, ‘ মানে? ’
মেজাজ আগে থেকেই গরম ছিল দিগন্তের। বেলার সব কারবারই দেখেছে ও। এখন ষোল কলা পূর্ণ হলো। রাগে চিড়চিড়িয়ে উঠে চাপা গলায় বলল,
‘ অসভ্য মেয়ে কোথাকার! মানুষ করতে পারে নি তোকে। সব দোষ তোর বাপের। ’
বেলা দুপাশে ছোট চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ এটা তো স্টাইল দিগন্ত ভাই। এখানে আব্বু কি দোষ করল? ’
কি… বলতে গিয়েও থামল দিগন্ত। কিছু একটা মনে করে বেলাকে প্রশ্ন করল, ‘ এই, চ্যাপ্টার শেষ করিস নি? আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস তোর বাপের দোষ কোথায়! ’
বেলা আমোদ কণ্ঠে বলল, ‘ করেছি তো। সকালেই শেষ করেছি পুরোটা। ’

‘ আচ্ছা। কি বুঝলি, বল? ’
চোখের বড় বড় পাপড়িগুলো কয়েক পলক ঝাপটে টুকুর টুকুর চোখে দিগন্তের পানে তাকালো বেলা। সোজা গলায় বলল,
‘ আপনি কি বুঝে পড়তে বলেছিলেন? ’
‘ হু। কেনো? আবার কি করেছিস? ’
‘ মুখস্থ করেছি। ’
তেঁতে উঠল দিগন্তের মন। উপরের দিকে মুখ উঠিয়ে ফোঁস করে জোরে শ্বাস টানল। তারপর বেলার দিকে ত্যক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,

‘ চরম লেভেলের বেয়াদব তুই। তোর মতো বেয়াদবের পাল্লায় না পড়লে বুঝতাম না আল্লাহ আমার এতো ধৈর্য্য দিছে। তোর আর তোর বাপের উচিত দিনের চব্বিশ ঘণ্টা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। ’
কি কারণে শুকরিয়া আদায় করবে বুঝল না বেলা। অযথায় দিগন্তের কথার তালে সায় জানিয়ে বলল, ‘ আচ্ছা। ’
‘ কি আচ্ছা? ’
‘ আমার আর আব্বুর উচিত দিনের চব্বিশ ঘণ্টা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। ’
বাকরুদ্ধ দিগন্ত। মাত্রাতিরিক্ত শান্ত চাহনিতে দেখল বেলাকে। তার থেকেও শান্ত গলায় উচ্চারণ করল,
‘ এখান থেকে সোজা হেঁটে গিয়ে আমার জীপে উঠবি। তোকে আর এবাড়িতে থাকতে হবে না। দিয়ে আসব আমি। যা সোজা হাঁটা ধর।’

ঠোঁট উল্টালো বেলা। মুখ ফুটে বলতে চাইল, আমি যাবো না কিন্তু কেন যেন আর সাহসে কুলালো না। চুপচাপ উল্টোদিকে ঘুরল। দুকদম হেঁটে আবার দিগন্তের দিকে ফিরে বলল,
‘ ফুপিকে বলে আসি। ’
‘ কোনো প্রয়োজন নেই। যত তাড়াতাড়ি তোর বাপের হাতে তার নাদান বাচ্চাকে তুলে দিতে পারব ততো শান্তি আমার। যা! আমি বলে দিবো। ’
বেলা অসহায় চোখে অদূরে বসে থাকা রায়হানের দিকে চেয়ে বলল, ‘ তাহলে দিহান ভাইদের থেকে বিদায় নিয়ে আসি? ’
মুখ দিয়ে চুউউউ শব্দ করল দিগন্ত। জোরে ধমকে উঠে বলল,
‘ এইই তুই যাবি এখান থেকে? ’
চমকে উঠল বেলা। আর কথা না ঝটপট পা ফেলে দৌড় লাগালো বাহিরের দিকে। ও চলে যেতে দিগন্ত পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরল। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই চোখ ফেরালো রায়হানের দিকে। ব্যস এতোক্ষনের সব রাগ উগলে দিল নিমিষেই।

‘ শালা! ঠাডা পড়বে তোর উপরে। রহমান পাটোয়ারীর নাদানটাকে তোর রূপের জালে ফাঁসাইছিস। আল্লাহ বিচার করবে তোর। তোকে ধুবে রে ধুবে! তোর বউ সারাদিন তোকে ধুবে। পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবে তোর রূপ শালা। দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করে প্রাণ খুলে দোয়া করব তোর জন্য। ’
এদিকে ফোন কানে চেপে ঠোঁট কামড়ে ধরে চাপা হাসছে রায়হান। এ নতুন কিছু না। দিগন্তের মাথার তার ছিঁড়ে গেলে রায়হানের উপরেই সব ঝড় যায়। ওর কথা শেষ হওয়ার পর নিজেকে ধাতস্থ করল রায়হান। তারপর বলে উঠল,

‘ বেটা শান্ত হো। বেলা ছোট মানুষ। ’
‘ আবার ছোট মানুষ বলে লাই দিচ্ছিস। শালা গেঞ্জামমার্কা পাবলিক, তোকেও তোর বউ ছোট বলে দূরে ধাক্কা মারবে, মিলায় নিস। ’
তির্যক হাসল রায়হান। দিগন্তকে ঠেস মেরে বলল,
‘ মন থেকে বদদোয়া দে শালা। তোর বদদোয়া কাজে লেগেও যদি বিয়ে হয় তাহলে মসজিদে তোর ভবিষ্যৎ এর জন্য মিলাদ পড়াবো। জীবনে এগুলো কম বললি না। বিয়ের পর বউ যদি এতো অত্যাচার করে তাও সয়ে নিবো। কিন্তু আফসোস তোর মুখের একটা কথাও আমার কপালে লাগে না। সব তোর কাছেই ফিরে যায়। লানত তোর উপরে শালা। ’
ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে নিল দিগন্ত। কিছু একটা মনে করে আবার আগের মতো শান্ত হয়ে গেল মন। ঠান্ডা গলায় বলল,

‘ শোন! ’
‘ বল।’
রায়হানের দিকে বাঁকা হাসি ছুড়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ দিশা ছোট মানুষ। ’
এটুকু বলে সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের ওপর লাইন কেটে দিল দিগন্ত।
মূহুর্তেই চোখমুখ আঁধারে ছেয়ে গেল রায়হানের। রাগী গলায় দিগন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ শালা ইতর। এই জন্যই তোর কপালে এতো দূর্ভোগ। শালা নিজেও বুড়া হবি, আমাকেও বুড়া বানাবি। ’
রায়হান যে এখন দিগন্তকে গালি দিচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে দিগন্ত। মনে মনে কেন যেন শান্তি পাচ্ছে এখন। দুজনেই এক ঘাটের মাঝি। যদিও দিশার বয়স আঠারো পেরিয়েছে কিছুদিন আগে কিন্তু দিগন্ত এখনি দিশার বিয়ে দিবে না। এর পেছনেও অবশ্য কারণ আছে। সব বাদ দিয়ে রায়হান আর ও একই পথের পথিক একথা ভাবলেও মনে কিছুটা শান্তি কাজ করেছে ওর। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে পকেটে দুহাত গুজে বাহিরের দিকে পা বাড়ালো দিগন্ত।

অন্ধকার রুমের মধ্যে কাউচের উপরে বসে আছে ফাহাদ। পায়ের উপরে পা তুলে ল্যাপটপে গভীর মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে হাসোজ্জল এক ষোড়শী কন্যার প্রতিচ্ছবি। এতোক্ষন তার সব বায়োডাটা চেক করা শেষ ফাহাদের। ছবিটা ছোঁয়ার জন্য হাত উঠালো কিন্তু ছুঁল না। নামিয়ে নিল। দৃষ্টি আবারো ফেলল স্ক্রিনের উপরে। ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ালো,
‘বেলা পাটোয়ারী। ’

ছবিটা দেখছে অথচ চাহনিতে কোনো নোংরামো নেই, নেই কোনো রুষ্টতা। যা আছে তা মোহমায়া, ভালোলাগা আর নরম একটা চাহনি। লাফাঙ্গা, মেয়েবাজ ফাহাদ দেওয়ান এই প্রথম চাইলেও মন থেকে কোনো খারাপ ভাইব আনতে পারছে না। ছোট মেয়েটার কান্নারত নিষ্পাপ মুখটা মনসাপেটে ভেসে উঠলে কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারংবার। অথচ এই মেয়েটা ওর জাতশত্রু দিগন্ত তালুকদারের রিলেটিভ। দিগন্তের সাথে দেখেছেও সেদিন। ওই সীনটুকু মাথায় আসলেই ভেতর থেকে রাগ আসছে ফাহাদের। চোখের দৃষ্টি ল্যাপটপ থেকে সরিয়ে নিয়ে ঠাস করে নামিয়ে দিল সেটা। শব্দ করে টেবিলের উপরে রেখে মাথার চুল টেনে ধরল। নিজের উপরে নিজেই ভীষণ বিরক্ত ও। কোনো কাজ ঠিকভাবে করতে পারছে না। কেনো পারছে না, কি হলো, কিভাবে হলো এসবের কোনো উত্তর নেই ওর কাছে।
বিরক্তিতে চিরচিরিয়ে উঠে রুমের ছোট ফ্রিজ খুলে একটা বিয়ারের ক্যান হাতে নিল। বেলকনিতে গিয়ে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে বিয়ারের ক্যানটা মুখের সামনে ধরতেই আবারো বেলার মুখটা চোখে ভাসল। দাঁতে দাঁত পিষে এক আছাড় মারল ক্যানটা। নিজেকে কয়েকটা বিচ্ছিরি গালি দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে, গাড়ি নিয়ে চলল ওর আড্ডাখানার দিকে।

আড্ডাখানায় এসে আরো মেজাজ বিগড়ে গেল ফাহাদের। দলের ছেলেরা দুটো মেয়ে এনে নাচানাচি করছে। রাগে হুঙ্কার ছেড়ে একটানে প্যান্টের বেল্ট খুলল। মেয়েগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করতে করতে বলল,
‘ তোদের যদি আর কোনোদিনও এদিকে দেখেছি জানে মেরে ফেলব। শালীরা, আর কোনোদিনও এমুখ হবি না। বের হো এখান থেকে। ’
মেয়েগুলো জান হাতে করে নিয়ে পালালো। এরপর ফাহাদ ওর ছেলেগুলোকে বলল,
‘ আজ থেকে মেয়েবাজি ছাড়বি সবগুলা। কাউকে যদি দেখছি আবার মেয়ে এনেছিস এখানে তাহলে এখানেই পুঁতে দিবো। মাথায় রাখিস। ’
একটা ছেলে সহসা বলল, ‘ ভাই! আমাগো ওয়ার্নিং দিয়া আপনি মেয়েবাজি করে বেড়াবেন। এইডা কেমন কথা। ’
ফাহাদ একটা চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা রেখে বলল,
‘ কে বলেছে আমি মেয়েবাজি করব? সেদিন পার্কের এক বিশেষ ঘটনার পর থেকেই ছেড়েছি ওসব। কেনো যেন আর মন টানে এগুলোতে। ’
‘ কি হইছে ভাই? হুট কইরা এতো পরিবর্তন?’
ফাহাদ আনমনে হয়ে বলল, ‘ কি জানি! কি যে হইল। বুঝতে পারতাছি না। ’

সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষন আগেই। দিগন্তের লাল-কালো মিশেলের জীপ গাড়িটা এসে থামল বিয়ে বাড়ির সাজে সজ্জিত পাটোয়ারী বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নামল বেলা। দিগন্তের পাশে এসে আস্তে করে বলল, ‘ ভেতরে চলুন। ’
দিগন্ত ঘাড় বাঁকিয়ে বেলার দিকে ফিরে বলল, ‘ কাজ আছে আমার। যা বাড়িতে যা। ’
আচ্ছা! বলে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো বেলা। পেছন থেকে দিগন্ত ডেকে উঠল,
‘ শুন! ’
বেলা আবারো দিগন্তের পানে ফিরে বলল, ‘ জ্বি। ’

‘ রায়হানের প্রেমিকা আছে। ’ এটা বলে জীপ ঘুরিয়ে চলে গেল দিগন্ত। বেলাকে দেখার আর প্রয়োজনবোধ করল না।
এদিকে বেলার চক্ষুজোড়া ছাপিয়ে পানি পড়ছে। ছোট মনটাতে বড় ভাঙ্গন ভেঙ্গেছে। রায়হান ভাইকে পছন্দ হলো, এখন সে নাকি অন্যজনের। ঠোঁট উল্টে বেলা বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ বেলার মন ভাঙলেন রায়হান ভাই! অবুঝ, ছোট মন ভাঙার জন্য দোয়া দিল এই বেলা পাটোয়ারী, আপনার ওই প্রেমিকা আপনাকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। আমিন আমিন আমিন। ’
তারপর চোখমুখ ঠিক করে চলে গেল বাড়িতে।
এদিকে দিগন্ত কিছুটা দূরে এসে জীপ থামিয়ে একটা গাছের নিচে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।

‘ তোরও আমার মতো একটা ধৈর্য্যশীল প্রেমিক আছে। যেদিন বড় হবি সেদিন বুঝবি। আর যখন বুঝবি তখন তোর কপালকে বাহাবা দিবি, বিন্দুচারিণী। ’
চোখ খুলে পাশ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরল। ধোঁয়াশে আকাশে দিকে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আবারো বলল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১০

‘ আমার মতো বদমেজাজি, রগচটা, অধৈর্য্য ছেলেকে ধৈর্য্য শিখতে হয়েছে। তাও তোর মতো নাদান,পুচকে একটা মেয়ের জন্য। মেয়েটা তুই আসলেই বড় বেয়াদব, বেলা। তোর বাপ আমার মতো ছেলের হাতে তোকে ভালোয় ভালোয় তুলে না দিলে পাপ লাগবে, দেখিস। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১২