দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৩
আফরোজা আশা
রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে। হলুদের অনুষ্ঠান শেষে নাচ-গান করে অনেক রাত করেছে সবাই। বড় সদস্যরা ভোর-সকাল থেকে কাজ করলেও, ছোটরা সব ঘুমে। বেলার ঘুম হয়নি রাতে। দিগন্তের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত শান্তি পাবে না হয়তো। সবকিছুই বিরক্ত ঠেকছে ওর কাছে। বাড়িভর্তি আত্মীয়-স্বজন। মন খুলে কাঁদারও জায়গা নেই,উপায় নেই। ভোরের দিকে যা একটু শুয়েছিল এপাশ-ওপাশ করেই কাটিয়েছে। বুঝতে পারছে, রাতে তেল-চর্বিযুক্ত খাবার আর সারারাত না ঘুমানোর ফলে এসিডিটি বেড়েছে ওর। শরীরটাও মেজ-মেজ করছে। মাত্রাতিরিক্ত ভাবনায় জ্বর আসছে হয়তো। তাই মন-মরা হয়ে নিচে নামলো। রহমানকে দেখলো সোফায় বসে থাকতে। রূপজান পাটোয়ারীর রুম থেকে ওষুধের বাক্স নিয়ে রহমানের পাশে এসে বসলো বেলা।
মেয়ের বিয়ে। কাঁধে হাজারো দ্বায়িত্ব। গতকাল থেকে দু’দণ্ড বসার সময় পায়নি রহমান। রাসেল জোর করে অন্দরে পাঠিয়েছে তাকে কিছুক্ষন জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। সোফায় বসেছে চা খাচ্ছে আর পেপার এ চোখ বুলাচ্ছে সে।
ছোট কন্যাকে দেখে হালকা হাসলো। মাথায় আদুরে হাত রেখে বলল,
‘ আমার আম্মা এতো তাড়াতাড়ি উঠলো। তোমরা সবাই তো ঘুমালে দেরী করে। ’
নিভু গলায় উত্তর দিল বেলা,
‘ কেন যেন ঘুম আসেনি আর? ’
হুট করে রহমানের বুক মুচড়ে উঠলো। মনে প্রশ্ন উদিত হলো, এই ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিবে? ভার হয়ে এলো চোখমুখ। মুখের হাসিভাবটুকু গায়েব হলো। বেলার মাথা থেকে হাত সরিয়ে পেপারটা মুখে সামনে ধরে নানান চিন্তায় মগ্ন হলো। নিজের সিদ্ধান্তের উপর বার কয়েক প্রশ্ন তুললো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ওষুধের বাক্স খুলে গ্যাসের ট্যাবলেটের উপরিভাগ একপলক দেখে হাতে তুলে নিল বেলা। দৃষ্টি অন্য জায়গায় রেখে উদাস মনে ওষুধ খেলো। পাতাটা আবার বক্সে রাখতে গিয়ে হাত থেমে গেল ওর। ওষুধের নাম দেখে ঠোঁট উল্টালো। প্যারাসিটামল এর পাতার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে পলক ঝাপটালো। কিছু সময় পর রহমানকে ডেকে উঠলো,
‘ আব্বুউউ! ’
বেলার ডাক শুনে পেপার থেকে চোখ সরালো রহমান। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কি হয়েছে আম্মা? ’
কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো বেলা,
‘ গ্যাসের ওষুধ খেতে গিয়ে প্যারাসিটামল খেয়ে ফেলেছি। ’
হতভম্বের ন্যায় রহমান একবার বেলার হাতের দিকে দেখলো। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ খালি পেটে খেলে। তাড়াতাড়ি পেট ভরে খেয়ে আসো, যাও। রান্নাঘরে তোমার আম্মুরা আছে। ভারি খাবার খাবে। ’
শ্বাস আটকে, আব্বুর কথামতো খেতে ছুটলো বেলা। রান্নাঘরের সামনে আসতেই পাশের বাড়ির এক মেয়েকে দেখে থামলো। ওর হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুরির প্লেট। প্লেটটা টেনে গুপ গাপ খাওয়া শুরু করতে করতে বলে উঠল,
‘ শেলু রে, তাড়াতাড়ি দে। তুই আরেকটা প্লেট আন যা। লোকটার সাথে কথা হয় নি এখনো। ভুলভাল ওষুধ খায়ে পটল তুললে শান্তি পাবো না রে। ’
সাত বছর বয়সী শেলু কি বুঝল কে জানে। পিটপিট চোখে চেয়ে বলল,
‘ কোথায় পটল তুলতে যাবি? আমিও যাবো তোর সাথে। ’
গো-গ্রাসে খিচুরি খাওয়া শুরু করেছে বেলা। মুখভর্তি খাবার নিয়ে ভাঙারি গলায় বলল,
‘ এ পটল সে পটল না রে। খিচুরিটা মজা। যা তোর প্লেট নিয়ে আয়। আমি টেবিলে অপেক্ষা করছি। ’
ছোট শেলু এতো বুঝল না। খিচুরি মজা শুনে আবারো প্লেট নিতে চলে গেল।
ক্লাবের পুরনো বেতের সোফায় শুয়ে আছে দিগন্ত। মাথার উপরে ঘ্যাড় ঘ্যাড়ে ফ্যান চলছে। চোখ দুটোর শিরাগুলো লাল। ঘুমায়নি দুদিন থেকে। এক নাগাড়ে সিগারেট টানছে তো টানছেই। রাতে একবার শ্বাসকষ্ট হয়েছিল তাও থামেনি। রায়হান ওর উপর চরম বিরক্ত হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে। দুদিন থেকে দিগন্তের সাথে সেও ক্লাবেই পড়েছিল। পুরো ক্লাব ঘরটাতে সিগারেট আর ধোঁয়ার আস্তানা গড়েছে দিগন্ত। ওর সিগারেটের অত্যাচারে আর টিকতে পারেনি রায়হান।
ছোট টেবিলে পড়ে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালো দিগন্ত। ফলস্বরূপ, চোখের শিরায় টান পেয়ে ঝনঝন করে ব্যাথা উঠে,মস্তিষ্কে গিয়ে লাগলো। চোখ বন্ধ করে নিয়ে স্ক্রিনের নামটা দেখলো। জহিরুলের ফোন দেখে প্রথমে তুলতে চাইলো না। কিন্তু জহিরুলের ফোনকল দেখার পর ইগনোরের মতো বেয়াদবি করার সাহস নেই ওর। ফোনটা কানে চেপে সালাম দিল। অপরপাশ থেকে জহিরুল সালামের জবাব নিল।বলল,
‘ সেদিন আসতে বললাম তোদের দেখা নাই। কাজের চাপে মনে থাকে এতো কিছু! রায়হানকে ফোন দিলাম। লাপাত্তা। বিয়েতে তো আসবি। সেখানে কথা হবে। ’
‘ যাবো না। ’
’ কেনো? ওরা তোর রিলেটিভ না। মিতালী আপাকে ওবাড়িতেই দেখছি। ’
জোরে দম ছাড়লো দিগন্ত। ভারী গলায় বলল,
‘ সব সময় জানতে চেয়েছিলেন না বেয়াদব মেয়ের নাম। মেয়েটা বেলা পাটোয়ারী। ’
ব্যস,দিগন্তের কথা শুনে চোয়াল ঝুলে পড়ার উপক্রম হলো জহিরুলের। চরম বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ এখন জানাচ্ছিস। আহাম্মক! তোরা দুইটা কি সারাজীবন মারামারি-ই করে যাবি? এখন একটা মেয়ে নিয়ে কাড়াকাড়ি।কিছুক্ষন পরেই ওদের বিয়ে। ’
মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে যেতেই জিভ কাঁটলো জহিরুল।
দিগন্ত যা বোঝার বুঝলো। প্রশ্ন ছুড়লো, ‘ বেলা জানে? ’
জহিরুল ভার গলায় বলল,
‘ রহমান ভাই কাউকে জানায়নি এখনো। ’
বড় হাই তুলে বলল দিগন্ত, ‘ ওহ! করুক বিয়ে। ’
আরেকদফা বিস্ময় পেয়ে তাতক্ষনাৎ কথা বলতে ভুলে গেল জহিরুল। কিছুক্ষন পর কণ্ঠে অবাকতার রেশ টেনে বলল,
‘ তুই আটকাবি না? ’
ভাবাবেগহীন ভাবে উত্তর দিল দিগন্ত,
‘ ভেবে রেখেছিলাম অনেক কিছু। জ্বালিয়ে,পুড়িয়ে,উড়িয়ে দেবো। কিন্তু ওই মুখ বন্ধ, বোবা, বেয়াদব মেয়ের জন্য আর খাটবো না। ওর বাপের কড়া কথা আমার গায়ে লাগে। দিগন্ত তালুকদার অনেক ছোট হয়েছে। নিজে থেকে হাত পেতে চেয়েছি, বাড়ির লোক গিয়েও চেয়েছে, হুমকি-ধমকি দিয়ে মেয়ে চেয়েছি। কোনটাতেই কাজ হয়নি। আর কত! এতো ধৈর্য্য নাই আমার। নাদানের ঘরের নাদান আমার ধৈর্য্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। ’
মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে দিগন্তের। আর কথা বাড়ালো না। জহিরুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পুনরায় বলল,
‘ দুই ছেলের বিয়েতে আপনি ব্যস্ত নিশ্চয়ই
আসসালুমুয়ালাইকুম,স্যার। ’
বলে ফোন কেটে দিল দিগন্ত।
টেবিলে রাখতে গিয়ে কি ভেবে আবার চোখের সামনে আনলো। স্ক্রল করে জাতশত্রু ‘ বিসি দেওয়ান ’ দিয়ে সেইভ করা নাম বের করলো। ভাবলো না বেশি,কল লাগিয়ে দিল।
উপুর হয়ে শুয়ে এখনো ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে ফাহাদ। ফোনের টোন শুনেও চোখ সরালো না। নাম না দেখেই রিসিভ করল। হ্যালো বলার আগেই অপর পাশ থেকে ভেসে এলো সবচেয়ে পরিচিত অপছন্দের স্বর,
‘ বিয়ের খুশিতে ঘুমাস নি? ’
চোখ সরলো ফাহাদের। কান থেকে ফোন নামিয়ে স্ক্রিনে দেখলো। সেইভ করা নাম ‘ এমসি তালুকদার ’। চকচক করে উঠল চোখজোড়া। কানে ধরে কটাক্ষ করে বলে উঠল,
‘ শালা! বলছিলাম না। তৃতীয়বারের কলটা তুই দিবি। সী! ফাহাদ দেওয়ানকে তুই কল দিছিস। ’
‘ দিলাম। শত্রুর বিয়ে শুনলাম। কাজে লাগাতে হবে রে হারামজাদা। তোর দূর্বলতা পেয়েছি। জায়গামতো কোপ বসাবো।’
শব্দ করে হাসলো ফাহাদ। কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
‘ ফ্লার্টবাজ ফাহাদ দেওয়ান অন্যের বউয়ের দিকে নজর দেয় না। তুই ডিসেন্ট, ক্লিন ইমেজের দিগন্ত তালুকদার কিসের ভয় দেখাস বে? ’
‘ ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ। বিয়ের জ্বালায় ঘুম ধরেনি বাবুর। ’
ল্যাপটপ অফ করে উপুর থেকে সটান হয়ে শুলো ফাহাদ। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,
‘ নাহ। বিশাল রাতটা ওর ছবি দেখে কেটে গেল। কাল হলদে পরী সেজেছিল, আমার বউ। ’
হাতের সিগারেটটা চট করে তালুর দিকে ঘুরিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো দিগন্ত। ভেতরের জ্বালা আর বাইরের জ্বালার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় শান্তি পেল। চোখ বুজে বলে উঠল,
‘ বউ! আমি তো আমারটাকে ইউনিকভাবে ডাকবো। আমার শত্রু তুই,শালা। ইউনিক কিছু ডাকতি। এতো কমন ডাক আশা করি নি। ’
ফাহাদকে কথা বলার সুযোগ দিল না দিগন্ত। আবারো বলল,
‘ কাল সেজেছিল? হলদে পরী? হলুদ রঙ? তোর আবার ভালো লেগেছে? এটা একটা বিচ্ছিরি রঙ। তোর চয়েস খারাপ। ছিহ! ’
দাঁতে দাঁত পিষে দিগন্তের অপমান গিলল ফাহাদ। রাশভারি গলায় বলল,
‘ শালা! স্বৈরাচার। ইউনিক মারায়। বা*ল ফেলা কথা। ’
‘ তোর মতো ইতরের সাথে তর্ক করে মজা নাই। হাত নিশপিশ করতেছে নাক ফাটানোর জন্য। ধ্যাত! শালাহ। ’
দিগন্ত ফোন কাটার আগে ফাহাদ কেটে দিল। তারপর বিশ্ব জয়ের হাসি দিল।
পাটোয়ারী বাড়িতে বিয়ের ধুম শুরু হয়েছে। পাত্রপক্ষ চলে এসেছে। বৃষ্টিকে লাল বধূ সাজানো হয়েছে। গায়ে লাল বেনারসি, মুখে লাইট মেকআপ এ সৌন্দর্য্য বেড়েছে ওর। বয়স্ক কাজী ওর সামনে বসে খাতার লেখা পড়ছে। পাশে ওর খালু উকিল দিচ্ছে। ভয়,লজ্জা,নতুন মানুষজন এর মধ্যে হাপড়ে উঠেছে বৃষ্টি। চোখ ঘুরিয়ে রহমানের পানে তাকালো। রহমান হালকা হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলো। ঝর ঝর করে কেঁদে দিল বৃষ্টি। পাশে কাজী বার বার কবুল বলতে বলছে। সে শব্দ শুনে ভেতর ফাঁকা হয়ে গেল ওর। ‘ আব্বুউ! ’ বলে রহমানকে ডেকে শব্দ করে কাঁদলো।
চোখ ভার হয়ে এসেছে রহমানের। বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘ বলেন আম্মা। ’
বেশ খানিক সময় নিয়ে কবুল বলল বৃষ্টি। বৃষ্টির বলা শেষ হলে কাজীসহ মুরুব্বীরা স্টেজে ফয়সালের কাছে গেল। রাসেল গিয়েছে ওদের সাথে। রহমান কিছুক্ষন বৃষ্টিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেদিকে গেল। কিছুক্ষণের মাঝে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বৃষ্টি আর ফয়সাল দুটো ভিন্ন মানুষ একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেল। ফয়সাল আর বৃষ্টিকে একসাথে বসানো হলো। ফয়সাল বৃষ্টির দিকে তাকালেও, বৃষ্টি দেখল না ওকে। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল।
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪২
বিয়ে শেষ হয়েছে অনেকক্ষন আগে। বেলা চুপ করে বৃষ্টির পাশে বসেছিল। আমেনা এসে ডাকলো ওকে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও টেনেহিঁচড়ে মায়ের সাথে গেল বেলা। রুমে এনে বেলার কানে হাতে সোনার জিনিস পড়িয়ে দিতে শুরু করল আমেনা। আমেনার কারবারে বিরক্ত হলো বেলা।
‘ এগুলা কেন দিচ্ছো? ’