দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৬

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৬
আফরোজা আশা

উজ্জ্বল আর দীপ্তিময় আলোয় ধরণীগাত্র আলোকিত হয়েছে।ঝলমলে দিন। পরিষ্কার আকাশ। রোদে ভরে উঠেছে চারদিক। ধোয়া-তোলা নির্মল আকাশে নীলচে-সাদা পেঁজা তুলোগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রান্তরেখায় বিস্তৃত নীল দিগন্ত।
দিন বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে লোকসমাগম। বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষারত রায়হান আর দিগন্ত। নিতে এসেছে রকেয়া তালুকদার, দিলদার তালুকদার আর রেহানাকে। নাতির বিয়ের জরুরি তলব পেয়ে তখনি চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়েছেন তারা। ট্রেন ছিল না, বাড়ির গাড়ি গিয়ে নিয়ে আসতে সময়ের ব্যাপার। তাই শেষমেষ বাসে আসতে হলো তাদের।

স্ট্যান্ডে বাস থামতেই একদল লোক একের পর এক বের হলো। সাথে দেখা গেল দিগন্তের অতি পরিচিত মুখগুলো। রায়হানসহ এগিয়ে গেল সেদিকে। রকেয়া তালুকদার বাস থেকে নেমেই নাতিকে পেল। কোনোদিনে না তাকিয়ে নাতির বুকে পড়ে কিছুক্ষন কাঁদলো। সেই যে গ্রাম থেকে এসেছে আর আজ দেখা পেল। দিগন্ত নিশ্চুপ জড়িয়ে ধরে থাকলো দাদিকে। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গিয়েছে। শুকনো ছোটখাটো শরীরে চামড়াগুলো ঝুলে গিয়েছে রকেয়া তালুকদারের। অথচ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দিলদার তালুকদার এখনো শক্তপোক্ত পুরুষ। চুল,দাঁড়িতে পাক ধরলেও গায়ের গঠন সুঠাম। বলা বাহুল্য, তার মুখাবয়বের ছাপ দিগন্তের মাঝে রয়েছে অনেকটাই।
রায়হানের সাথে রেহানার চোখাচোখি হতেই রায়হান সভ্য ছেলের ন্যায় মুখে হাসি বজায় রেখে তাকে সালাম দিল। রেহানাও স্বাভাবিকভাবে তার সালামের জবাব দিল। সেখানে হালকা ভালোমন্দ কথা সেরে তাদের নিয়ে বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরালো দিগন্ত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ড্রয়িংরুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে চোখবন্ধ করে রেখেছে মাইশা। ভোরসকালেই তালুকদার বাড়ি চলে এসেছে ওরা। মিতালী আর বাণীকে আসতে দিতে চাইছিল না রহমান পাটোয়ারী। জয়নাল আর জুনায়েদ গিয়ে নিজেদের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে। অনেক কথাবার্তার পর মিতালী আর বাণীকে পাঠিয়েছে রহমান। দুপুরের পর বরপক্ষ হিসেবে আবার যাবে ওরা। তার আগে বাড়িঘর সব ঠিক করতে অবস্থা বেহাল।
একটু কাজ করেই কোমড়ের ব্যাথায় কাহিল হয়ে গিয়েছে মাইশা। পুরোপুরি সুস্থ হয়নি এখনো। ভেতরের ব্যাথাটা আছেই। হাঁটাচলা করতে পারছে। কিন্তু উঠবস করে কাজ করার দরুন ভেতরে চিনচিন ব্যাথার উদ্রেক ঘটেছে। পাশে কোমড়ে ওড়না পেঁচিয়ে সোফার কুশন পাল্টাচ্ছে দিশা। মাইশার উদ্দেশ্যে বললো,

‘ বেশি ব্যাথা করলে রুমে গিয়ে আরাম করো। বাকি যা আছে আমি আর ভাবী মিলে করে নিবো। ’
বন্ধ চোখ খুলে তাকালো মাইশা। কাজ বেশ অনেকটাই আছে। এগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করে আবার তৈরি হতে হবে। তাছাড়া মিতালী ওবাড়িতে বসে ছিল না। ভাবীদের হাতে হাতে কাজ করেছে। এখানে এসেও ছুটে বেড়াচ্ছে। ছেলের বিয়ে বলে শরীরের ক্লান্তি টের পাচ্ছে না। শরীর তো! পরে অসুস্থ হয়ে সময় নিবে না। আরো কিছুক্ষন বসে থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো ও। যত বসে থাকবে অলসোতা গ্রাস করবে। জোশ নিয়ে ঝাড়ুটা হাতে তুলে নিল। দিশা ওর কাজে হাসলো। তারপর আবার নিজ কাজে মনযোগ দিল।

মাইশা ঝাড়ু দিতে দিতে দরজার কাছে চলে এলো। হাটখোলা দরজা। দু-তিনজন মহিলা রেখেছে আজকের জন্য। একজন মিতালীর সাথে রান্নাঘরে, একজন কাপড়চোপড় ধুয়ে দিচ্ছে, আরেকজন সবকিছু মোছাগোছা করলে। মাইশা ঝেড়ে দিচ্ছে, ওর পেছন পেছন মহিলাটাও মুছে নিচ্ছে। বাড়ির কর্তী কটা দিন না থাকায় ছাতা পড়েছে বাড়িতে। দিশা, মাইশাও ইচ্ছে করে হাত দেয় নাই। জুনায়েদের ব্যবহারে তারাও অসন্তুষ্ট ছিল।
দরজার সিড়ি দুটো ঝেড়ে ঝাড়ুটা উপরে উঠাতেই একজনের গায়ে লাগলো। চমকে সেদিকে তাকালো মাইশা। সামনের মানুষটাকে দেখে নিজের কাছে লজ্জিত হলো। রায়হান একবার ঝাড়ু দেখলো, আরেকবার মাইশাকে। অবাকতা নিয়ে স্লো ভয়েসে বলল,

‘ শেষ পর্যন্ত ঝাড়ুর বাড়ি! সেই একটা ভুলের জন্য স্বামীকে ঝাটা পেটা করলে। শাস্তির জন্য ঝাটা ইউস না করে, অন্যকিছু ইউস করতে পারতে। যেমন ধরো তোমার…’
রায়হানের বলার আগেই চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল মাইশা। উল্টো ঘুরে চলে আসতে নিলে ওকে পিছু ডাকলো রায়হান।
‘ একটা ব্যাগ নেও। ভারী অনেক। এটা তোমার মায়ের ব্যাগ। এটা নেও। ’
মাইশা আবারো ঘুরে এলো। রায়হানের দুহাতে দুটো বড় ব্যাগ। মায়ের ব্যাগটা চেনা ওর। হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে গেলে পড়লো আরেক ফ্যাসাদে। রায়হানের দুই আঙুল ওর হাত চেপে ধরেছে। একটু টানাটানি করেও ছাড়াতে পারলো না মাইশা।

এদিকে রায়হান সামান্য ঘাড় বেঁকিয়ে চতুরপাশে দেখে নিল। দিশা উপরের দিকে যাচ্ছে। ড্রয়িংরুম আপাতত ফাঁকা। বাইরে দিলদার, রকেয়া আর রেহানাকে নিয়ে বাগানের দিকে আছে দিগন্ত। সেখানে রকেয়ার হাতে গাড়া দুটো মেহগনি গাছ অনেক বড় হয়েছে। বাড়িতে ঢোকার আগে সেটাই দেখছে ওরা। রায়হান ওদের সাথে যায়নি। গাড়ি থেকে দুটো ব্যাগ নিয়ে বাড়ির দিকে এসেছে ও।

পরিবেশ ফাঁকা দেখে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটলো রায়হানের। মুহুর্তেই ব্যাগ নিচে রেখে মাইশার একদম কাছাকাছি চলে এলো। হকচকালো মাইশা। পেছনে সরে যেতে চাইলে বাঁধা পড়লো পুরুষালি হাতের বাঁধনে। রায়হানের চোখমুখ ভালো ঠেকলো না ওর কাছে। ভয়ার্ত চোখে আশপাশ দেখলো। লোকটা যেভাবে চেপে ধরছে কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। ছাড়াতে না পেরে রাগে গা-পিত্তি জ্বলে উঠলো ওর।
রায়হানের পূর্ণ দৃষ্টি মাইশাতে। ওকে দেখতে দেখতে মাথায় শয়তানি ভর করলো। তা ছড়িয়ে পড়লো বাইরেও। ঠোঁট কামড়ে ধরে ধীর গলায় বলে উঠলো,

‘ উফ! রাগলে তোমাকে কি যে লাগে। মাসুম চেহারার থেকে এটাই জোশ। মন যেন কি কি করতে চাইছে! ’
রায়হানের ঠোঁটকাটা কথাগুলো বিষিয়ে দিল মাইশার মন। দাঁত খিঁচে বললো,
‘ ছাড়ুন। আপনি একটা অসভ্য লোক। কিভাবে একটা মেয়ের সাথে এরকম করতে পারেন। ছিহ! ’
রায়হানের গা লাগলো না কথাটা। বরং চেহারায় ফুটলো দ্বিগুণ দুষ্টুমির রেশ। কণ্ঠ টেনে বললো,
‘ এই একটা মেয়ের সাথেই আমি সব অসভ্যতামি করবো। কট খেয়ে মেয়েটাকে পেয়েছি। এমনি এমনি তো ছাড়া যাবে না জানেমান। ’
মাইশা মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো। ভয়ে ভেতর শুকিয়ে এসেছে ওর। কখন যেন কে দেখে ফেলছে! রায়হান সুযোগ বুঝে ওর কোমড়ের দিকে জোরে চাপ দিল। ব্যাথায় তাতক্ষনাৎ মাইশার মুখ থেকে বের হলো,

‘ আহ! ’
সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো রায়হানের বেফাস কথা,
‘ ইস! কি হওওট কথাবার্তা। এখন না বউ। বন্ধুর বিয়ে সেরে আসি। কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ। ’
বলে ছেড়ে দিল মাইশাকে। ব্যাগ দুটো নিয়ে ভেতরে চলে গেল। এদিকে চোয়াল ঝুলে পড়ার উপক্রম মাইশার। নিজে নিজে কি বলে গেল লোকটা! রায়হানের অসভ্য ইঙ্গিত স্মরণ হতেই চোখ বড় বড় হয়ে এলো ওর। লজ্জায় হাত-পা ঘেমে উঠলো।

সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে এতোক্ষনের সবকিছুই দেখেছে দিশা। প্রথমে অবাক হলেও এখন ওর কাছে ব্যাপারটা ভালোই লাগছে। রায়হানের সাথে মাইশাকে মানাবে সুন্দর। জুটিটা কল্পনা করে নিয়েছে দিশা। পরে মাইশাকে ধরবে। এখন ওর মন ভার হয়ে আছে। আগে মাইশাকে দেখে নিজেকে স্বান্তনা দিতো। এখন কাকে দেখে দিবে! সিঙ্গেলনেসের উপর রাগ উঠলো ওর। সেই যে লাস্ট ক্রাশ খেয়েছে তারপর থেকে একবারো ফ্লাটিং করে নি। অনেক ভালো হয়ে গিয়েছে। অথচ যার জন্য ভালো হলো তার পাত্তা নেই। মনে মনে কয়েকদফা গলা ফাটিয়ে কাঁদলো ও। পরপরই ফাহাদের আইডি বের করে ওকে নক করলো,

‘ আবুলের ঘরের আবুল। হাদার বাচ্চা। বলদ ছোকড়া। জাউড়া ব্যাটা ছেলে। এটাই লাস্ট মেসেজ দিলাম। রিপ্লাই না দিলে তুই মরেও শান্তি পাবি না রে। এই সিঙ্গেলের কথা তোর কপালে লাগুক। ফুউউ। ’
লিখে সেন্ড করে দিল। তারপর ফোন অফ করে বিরস মুখে কাজ করতে লাগলো।
রকেয়া তালুকদারেদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে আসলো দিগন্ত। গলা ছেড়ে মিতালীকে ডাকলো। মিতালী, বাণী ছুটে এলো ওদের কাছে। সালাম দিয়ে ওদের তোষামোদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

অপরদিকে এতোদিন পর মেয়েকে সামনে পেয়ে চোখ টলমলে হলো রেহানার। এই প্রথম মেয়েকে ছেড়ে আছে। বুকে আগলে নিয়ে খুব আদর করলো। মাইশাও মায়ের বুকে পড়ে ইমোশনাল হয়ে গেল।
কিছুক্ষন পর ওরা ফ্রেশ হয়ে এলো। সবাই একসাথে সোফায় বসলো হালকা চা নাস্তার জন্য। দিশা চা খাচ্ছে আর বার বার সরু চোখে মাইশার দিকে তাকাচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকবার এর কারণ জিজ্ঞেস করেছে মাইশা। উত্তর দেয়নি ও। মাইশা কেমন বেকায়দায় পড়েছে। একদিকে দিশা কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে, অন্যদিকে ওর পাশের সিঙ্গেল সোফায় রায়হান বসেছে। দূরত্ব খুব একটা নয়। লোকটা চা খাচ্ছে কম, ওকে টিজ করছে বেশি।
রকেয়া তালুকদার বললো,

‘ তুমি যে বেলাকে পছন্দ করো সেটা আগে জানাবা না। আমি আবার তোমার জন্য মাইশাকে নিয়ে আলাপ করেছিলাম। ’
কথাটা শুনে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো মিতালী। সব বাচ্চারা এখানে আছে, এভাবে বলা উচিত হলো না রকেয়ার। একেকজনের রিয়েকশন তাই। দিগন্ত ভ্রুঁ কুঁচকে নিয়েছে। দিশা মুখ গোল করে রেখেছে। মাইশা অস্বস্তিতে মাথা নামিয়ে নিয়েছে। আর রায়হানের গলায় চা আটকেছে। খুক খুক কাশছে ও।
দিগন্ত রায়হানের অবস্থা দেখে ঠোঁট বাঁকালো। হালকা গলা ঝেড়ে বললো,
‘ ওসব ভাবনা মাথায় এনেছিলে কিভাবে? মাইশাকে আমি দিশার মতো স্নেহ করি। একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওর জন্য একটা ছেলে দেখেছি। দেখেছি ভুল। প্রস্তাব পেয়েছি। আমারো ভালো লেগেছে অনেক। ছেলেটা নৌ-বাহিনীতে আছে। দেখতে শুনতে ভালো। আমার ঝামেলা মিটুক তারপর ওদের আসতে বলব। তোমরাও আছো এখন। ’

ক্ষুব্ধ নয়নে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে রায়হান। চোখ দিয়ে মেরে খান খান করতে চাইছে ওকে। ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলছে। দিগন্ত যে ওকে জ্বালানোর জন্যই বলছে তা ও বেশ জানে। জানার পরেও জ্বলছে।
মাইশা একপলক রায়হানকে দেখে আবারো চোখ নামিয়ে নিল। ভালো লাগছে না ওর। সবকিছুই বিষাদ ঠেকছে।

__দিগন্তবেলা স্পেশাল-২__
প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। পাটোয়ারী বাড়ির সামনে আসলো দুটো গাড়ি। গাড়ি থেকে একে একে নামলো সবাই। রহমান, রাসেল আর বেলার খালুসহ কয়েকজন এগিয়ে এলো ওদের কাছে। সবার সাথে কথাবার্তা বলে তাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। এদিকে দিগন্ত দাঁড়িয়েই আছে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। রহমান পাটোয়ারীও দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে এখনো কথা বলেনি। দিগন্ত কিছুক্ষন নিরব থেকে হুট করে সালাম দিল। এটাই চাইছিল রহমান। এজন্যই এতোক্ষন আগ বাড়িয়ে টু শব্দটি করে নি। সালাম নিয়ে বললো,
‘ বেওয়ারা জীবন-যাপন করেন আর যাই করেন। আমার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছেন। এটা আপনার শ্বশুড়বাড়ি এলাকা হতে চলেছে। এলাকার সব মুরুব্বিকে সামনে পেলে এ জিনিসের হেরফের যেন না দেখি। অন্তত আমার মেয়ে জামাই হওয়ার চেষ্টা করবেন। বাকি দুই জামাই আবার এদিকে ঠিকঠাক। ’
দিগন্ত মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। রহমান স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে দিগন্তকে নিয়ে ভেতরে এলো। সব পরিবারের লোকজন, বাইরের মানুষ নেই। তাই স্টেজের প্রয়োজন পড়লো না। বাড়ির ভেতরে ফাঁকা জায়গায় ছোটখাটো আয়োজন করা হয়েছে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখছে বেলা। লালশাড়ি, মাথায় লাল ওড়না, মুখে পার্লারের সাজিয়ে দেওয়া হালকা প্রসাধনী, গায়ে সোনার অলংকারে পুরো রূপ পাল্টে গিয়েছে ওর। মনে হচ্ছে আয়না ও না আরেকজন।
অপরদিকে,কোমড়ে হাত রেখে বেলার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে বৃষ্টি। ওকে নিচে নিয়ে যেতে বলছে আর এদিকে বেলার নিজেকে দেখাই শেষ হচ্ছে না। একে একে সবাই এসে ঘুরে গিয়েছে কিন্তু রুম থেকে বের করতে পারেনি বেলাকে। ইচ্ছে করেই রুমে ঘাপটি মেরে সময় নষ্ট করছে ও।
বৃষ্টির কথা কানে না তুলে আয়নার সামনে মুখ আবারো এলো বেলা। বৃষ্টিকে বললো,
‘ আপা, এইটা আমি? আমাকে এতো সুন্দর লাগছে কেনো? বিয়ে হলেই মেয়েদের এতো সুন্দর লাগে? তাহলে তো আরো আগেই বিয়ে করতে হতো। তাই না? ’

বৃষ্টি কপাল চাপড়ালো। বেলা আবারো বললো,
‘ এখন থেকে আমি প্রতিদিন বউ সাজবো। কি সুন্দর শাড়ি পড়ে সাজা যায়। ’
বৃষ্টি বাঁকা গলায় বললো,
‘ পাগল মেয়ে। বউ সাজ নিয়ে পরে থাকবি নাকি বিয়েও করবি। সেদিন তো খুব ফরফরালি আব্বুর সামনে। আমার দেবরকে ফেলে আপার ভাসুরের জন্য কেঁদে মরলি। এখন দেরী করছিস কেনো? চল আমার সাথে। কাজী বসেছে অনেকক্ষন হলো। সবাই অপেক্ষা করছে। ’
বেলা কয়েকপলক ঝাপটে বৃষ্টির দিকে চাইলো। মাথার ওড়ানার দুই কোণা টেনে ধরে হেলেদুলে উঠে বললো,
‘ আগে দুইটা ছবি তুলে দেও। আমার বাচ্চাকাচ্চা, নাতি-নাতনীরা দেখবে না আমাকে কত সুন্দর লাগছিল বিয়ের দিন। বিয়ের পর তো সোজা ওবাড়িতে নিয়ে যাবে। ততক্ষনে সাজ খারাপ হয়ে যাবে। দেও না আপা ছবি তুলে। ’
আক্কেল গুড়ুম বৃষ্টির। এরমধ্যে দিশা এলো রুমে। দেরী হচ্ছে দেখে ওকে পাঠিয়েছে দিগন্ত। দিশাকে দেখে বেলা শাড়ি হালকা উঁচু করে লাফিয়ে ওর কাছে এলো। বেলার কাজে চোখ রাঙানি দিল দিশা। শাড়িতে পা আটকে এখনি পড়ে যেত।

‘ এভাবে লাফাচ্ছিস কেনো? বিয়ের দিন বউদের চুপ করে বসে থাকতে হয় গাধা। ’
দিশার হাতের ফোনটা টেনে নিল বেলা। ক্যামেরা অন করে আবার ওর হাতে ধরিয়ে দিল। দিশা ভ্রুঁ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওকে। বেলা ওড়নার একপাশের কোণা দিয়ে মুখের অর্ধেক ঢেকে বললো,
‘ ছবি তুলে দেও। ভালোভাবে তুলবে হ্যাঁ। ’
দিশা বাঁকা মুখে বললো,
‘ এখন থেকে আমি তোর ননদ। সম্মান দিয়ে কথা বলবি। কি হুকুম করছিস আমাকে? আমার হুকুম মেনে চলবি তুই। বুঝলি?’
চোখজোড়া সরু করে নিল বেলা। প্রশ্নাত্মক গলায় বললো,
‘ দিশা আপু, দিগন্ত ভাই তোমার বড় ভাই না? ’
দিশা সরল মনে জবাব দিল, ‘ হ্যাঁ। ’
বেলা পুনরায় প্রশ্ন করলো, ‘ তার বউ তোমার বড় ভাবি না? ’
‘ হ্যাঁ। কেন? ’
মুচকি হাসলো বেলা। ভাবসাব নিয়ে বললো,
‘ ভাবি মায়ের সমান হয়। রেসপেক্ট মী। তাড়াতাড়ি ছবি তুলো তো। ’
সরু চোখে বেলার দিকে তাকিয়ে থাকলো দিশা। তারপর মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে বেলার ইচ্ছেমতো ছবি তুলে দিল।

এতোক্ষনেও বেলাকে আসতে না দেখে নিচে সবার পীড়াপীড়ি উঠেছে। দিগন্ত চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে। অপেক্ষা করতে করতে আর পারছে না। ধৈর্য্যের বাঁধ চরমে উঠেছে। তবুও নিশ্চুপ। হাঁটুতে একহাতের ভর ঠেকিয়ে আরেকহাত দিয়ে ফোন ধরে রেখেছে। স্টপওয়াচ চলছে। এখানে এসে বসার তিন ঘণ্টা, বারো মিনিট হয়ে গেল। সেকেন্ডের গতি চোখের পলকে পরিবর্তন হচ্ছে। এখান থেকে সদর দরজা পেরেয়ি আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকালো দিগন্ত। সন্ধ্যা নেমে আসছে।

ছবি তুলা শেষে হতেই বেলার চঞ্চলতা কমে গেল। বিরস মুখ নিয়ে বিছানায় বসলো। দৃষ্টি থামালো দরজার দিকে। বৃষ্টি এবার বেলার উপর বিরক্ত হলো খুব। ও নিজেও ভারী শাড়ি, গহনা পড়ে আছে। বেলার সাথে সাথে ও শ্বশুড়বাড়ি চলে যাবে। শেষমেষ জোরে ধমকালো বেলাকে। তাতক্ষনাৎ বেলার নেত্রপল্লব ভারী হলো। টলমলে চোখ দরজা থেকে সরিয়ে বৃষ্টির দিকে ফেরালো। কম্পমান গলায় বলে উঠলো,
‘ আব্বু সকাল থেকে আমার সাথে একবারো কথা বলেনি আপা। তোমার আর বড় আপার বিয়ের আগে আব্বু তোমাদের সাথে একা একা কথা বলেছিল। আদর দিয়েছিল তোমাদের, দোয়াও দিয়েছিল অনেক। আমার সাথে এখনো কথা বলতে এলো না যে? আমি আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছি। ’
বেলার কান্নারত কথা শুনে থামকালো বৃষ্টি। আসলেই রহমান পাটোয়ারী একবারো এদিকে আসেন নি। দিশা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

অন্যদিকে, কাজীর তাড়া দেখে উপরে আসতে বাধ্য হলো রহমান। মাত্রই মেয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। বেলার বলা কথাগুলো সব শুনেছে। বুক খামচে ধরে আছে তার। মেয়ের উপরে রাগ নেই তবে কিঞ্চিৎ অভিমান তো রয়েছেই বটে। নিজেই নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছে দেখে ওই কিঞ্চিৎ অভিমানের রেশ ধরে সকাল থেকে বেলার মুখোমুখি হোননি তিনি।
তবে অভিমান হয়তো কিছুটা কমলো। বেলা যে এখনো ওর আব্বুর অপেক্ষায় বসে আছে সেটা শুনে ভেতরে কোথায় যেন প্রশান্তি মিললো রহমানের। পরক্ষনে, আবার বুক ধুক করে উঠলো। এইতো আর কিছুক্ষন তারপর পাটোয়ারী বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে। বাড়ির তিন মেয়ে নিজ নিজ সংসার সামলাবে। তারপর সপ্তাহে,মাসে বা বছরে আসবে এক-দুবার। কদিন থেকে আবার ফিরবে নিজ গন্তব্যে। ভাবতে ভাবতেই চোখের পাতা ভিজে আসতে চাইলো রহমান পাটোয়ারীর। কিন্তু নিজেকে কঠোর খোলসে আবৃত করে নিল।
ধীর পায়ে রুমে এসে মুখভর্তি করে ডেকে উঠলো,

‘ আমার ছোট আম্মাজান। নিচে সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। ’
আব্বুর কণ্ঠ শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলো বেলা। রহমান ব্যস্ত পায়ে মেয়ে কাছে গিয়ে ওকে বুকে আগলে নিল। মাথায় আলগোছে হাত রেখে আদুরে গলায় বললো,
‘ কাঁদবেন না আম্মা। আপনার সুখে,দুঃখে, ভালো-মন্দে সব সময় আব্বুকে পাশে পাবেন। আব্বুর দোয়া সারাজীবন আপনার সাথে থাকবে। শুধু স্বামী নিয়ে পরবর্তী জীবনে আফসোস করতে পারবেন না। এটা আপনি স্বইচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। আব্বুকে দোষারোপ করবেন না। কান্না থামান আম্মা। ’
উপস্থিত দিশা আর বৃষ্টিরও চোখে পানি। এদিকে, বেলার কান্নারগতি থামলো না বরং বাড়লো। রহমান আরো কিছুক্ষন ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিচে নিয়ে এলো।

নিচে আসার পর বেলাকে একপলক দেখেছে দিগন্ত। চোখে কাজল দিয়েছিল হয়তো। বিয়ের আগেই কেঁদেকেটে সব লেপ্টে দিয়েছে মেয়েটা। খারাপ না, অগোছালো সাজটা ভালোই লেগেছে ওর। বেলা দিগন্তকে দেখেনি এখনো। আব্বুর হাত ধরে নেমেছে। যেখানে বসতে বলেছে সেখানেই বসে পড়েছে। হুট করে কেমন যেন লাগছে ওর। গালমুখ গরম হয়ে গিয়েছে। চোখের পাতা এতো ভারি হয়েছে যে তুলতেও পারছে না। মুখ নামিয়ে রেখেছে।
অতঃপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সময়। কাজী সব পড়ছে। শেষে এসে সাক্ষীর উদ্দেশ্যে কাজী কাগজ দেখে পড়তে শুরু করলেন। সাক্ষী হিসেবে থাকলো রাসেল পাটোয়ারী। দিগন্তবেলার বিয়ের উকিল দিলেন তিনি। কাজীর সঙ্গে সঙ্গে মুখ মিলিয়ে বেলার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘ জুনায়েদ তালুকদারের একমাত্র পুত্র, দিগন্ত তালুকদারকে নগদ ছয় লক্ষ টাকা দেন-মোহর ধার্য করিয়া, তন্মধ্যে নাকের ফুল স্বর্ণ বাবদ এক হাজার নয়শত নিরানব্বই টাকা কাটিয়া নগদ পাঁচ লক্ষ আটানব্বই হাজার এক টাকা বেলা পাটোয়ারী বিনতে(কন্যা) আব্দুর রহমান পাটোয়ারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলো। আপনি কি এই প্রস্তাব কবুল করিবেন? ’
বেলার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। ও লজ্জায় নিচু মাথায় আস্তে করে রেখেছে। কাজী আর আশপাশ থেকে ওকে বারবার কবুল করতে বলছে। শব্দটা খুব সহজ ঠেকলো বেলার কাছে। একবারেই বলে ফেলতে পারবে ও। কিন্তু যেই না মুখে আনতে চাইলো ওমনি খুব ভারী ঠেকলো। চোখ গড়িয়ে আপনা আপনি পানি পড়লো। খুব কষ্ট হচ্ছে বলতে। কণ্ঠনালি ভেদ করে টেনে হিঁচড়ে বের করতে হলো ওকে। অবশেষে বলতে সক্ষম হলো,

‘ কবুল। ’
কাজী পুনরায় বললেন,
‘ কবুল করলেন? তাহলে আবারো কবুল বলেন। ’
বেলা কাঁপাকাঁপা স্বরে বললো,
‘ কবুল। ‘
তৃতীয়বার আবারো জিজ্ঞেস করলেন কাজী,
‘ আবার বলেন কবুল করলেন। ’
বেলা এবার হাউমাউ করে কেঁদে দিল। ভালো লাগছে না ওর। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নার্ভাসনেস আটসাটভাবে ধরেছে ওকে। রহমান পাটোয়ারী মেয়ের হাতে হাত রেখে ভরসা দিলেন। বেলা কান্নারত চোখে একবার আব্বুকে দেখে চোখ বন্ধ করে নিল। জোরে দম টেনে স্পষ্টভাবে বলে উঠলো,

‘ কবুল। ‘
সকলে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো। কাজী এবার দিগন্তের কাছে গেল। ওকে কবুল বলতে বললে বেশি সময় নিল না দিগন্ত। নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে ধীরস্থিরভাবে তিন কবুলের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করলো। স্বীকার করলো বেলাকে স্বীয় স্ত্রীরূপে।
কাজী হাসিমুখে ঘোষণা করলেন,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৫

‘ সাক্ষীগণ শুনেন, দিগন্ত তালুকদার ও বেলা পাটোয়ারী বিনতে (কন্যা) আব্দুর রহমান পাটোয়ারী। নগদ মোহরানা নির্ধারণ করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। আল্লাহ তাদের দাম্পত্য জীবন বরকতময় করুন। আমীন। ’
কাজীর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে শুকরিয়া আদায় করলো দিগন্ত। তারপর পাশে বসে থাকা বেলার হাতের ভাজে হাত গলিয়ে দিল তড়িৎ বেগে। ছোটখাটো নরম হাতটা সামনে এনে উল্টো পিঠে পরশ বুলিয়ে বললো,
‘ অবেলায় আগমন যার, দিগন্তবেলায় সে আমার। ’
—|| আমার বিন্দুচারিণী ||—

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৭

(প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)