দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন গল্পের লিংক || আফরোজা আশা

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১
আফরোজা আশা

“ আমি আপনার বউ হতে চাই রায়হান ভাই। আপনার হালি হালি বাচ্চার মা হতে চাই। করবেন আমাকে বিয়ে? ”
আড্ডার মাঝে ষোড়শীর কন্যার কথা শুনে ভ্রুঁ দ্বয় গুটালো #দিগন্ত তালুকদার। হাতের সিগারেটটা কয়েক টানে শেষ করল। নাক মুখ দিয়ে বেপরোয়াভাবে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আড্ডার মাঝ থেকে উঠে এলো।
-“ পাটোয়ারী বাড়ির ছোট রাজকন্যা #বেলা পাটোয়ারী শেষমেষ কিনা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্রপোজাল দিয়ে বেড়াচ্ছে। ভ্যারি ব্যাড!”
দিগন্তের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সেখানে উপস্থিত সকলে হু হা করে হাসা শুরু করল। রায়হান হাসতে হাসতে দিগন্তের পাশে এসে বলে,

“ আহহ! এভাবে বলছিস কেনো? মেয়েটা কত সাধ নিয়ে আমাকে প্রপোজাল দিচ্ছে দেখছিস না। ”
রায়হানের কথায় আরেক দফা হাসির রোল পড়ল সেখানে। দিগন্ত গরম চোখের তাকালো রায়হানের দিকে। কিন্তু রায়হান যেন দেখেও দেখল না। দিগন্তকে টপকিয়ে বেলার কাছে এলো। রায়হানকে কাছে আসতে দেখে খানিকটা লজ্জায় গুটিয়ে গেল বেলা। কখন, কিভাবে যেন এই সুদর্শন ছেলেটা মন কেড়ে নিয়েছে ওর। রায়হান বেলার গুটিয়ে যাওয়া দেখে আড়চোখে দিগন্তের দিকে তাকালো। ওর জ্বলন্ত চোখ বেলাতেই নিবদ্ধ। রায়হান গলা খাকড়ি দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আমি তো হালি হালি বাচ্চা সামলাতে পারব না বেলা। চাকরি নেই বেকার একটা ছেলে, সাথে গুন্ডামি করে বেরাই। বউ সামলানোই তো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এতো বাচ্চা কিভাবে সামলাবো? ”
খুব সাহস নিয়ে বলে তো ফেলেছে বেলা কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মাটি ফাঁক করে নিচে ঢুকে যেতে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে নিজের বেহায়াপনায়। একটা মেয়ে হয়ে কিনা এতোগুলো ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রাশ বয়কে প্রপোজ করল! আর করলই বা কিভাবে! ডিরেক্ট হালি হালি বাচ্চা। এটা মনে পড়তেই চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। রায়হান ঠোঁট টিপে হেসে কিছু বলতে নিবে তার আগেই একটা দাবাংমার্কা চড় পড়ল বেলার গালে। চড়ের তাল সামলাতে না পেরে একটু দূরে গিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল বেলা। গালে মনে হয় কেউ আগুন লাগিয়ে দিলো, মাথা ঘুরছে সাথে চোখ দিয়ে টুপটুপ করে অশ্রুকোণা আপনা-আপনি ঝরে পড়ল। রায়হান রাগী চোখে তাকালো দিগন্তের দিকে। বেলাকে নিচ থেকে উঠানোর জন্য এগোতে নিলে দিগন্ত হুংকার ছেড়ে বলল,

“ খবরদার! সাহায্য তো দূর ওর আশেপাশেও ঘেঁষবি না। বেয়াদপ মেয়ে, এভাবেই পড়ে থাক। কলিজা কত বড় ওর! আমার সামনে এসে পিরীতি আলাপ মারায়। মুখ টিপলে দুধ বের হবে সে মেয়ে এসেছে হালি হালি বাচ্চা জন্ম দিবে। ওকে একটা কেনো, হালি হালি থাপ্পড় মারা উচিত। অসভ্য মেয়ে কোথাকার।”
অপমানে, ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করল বেলার। ভর দুপুরে রাস্তার মাঝখানে এতো মানুষের সামনে এভাবে অপমানিত হতে হলো ওকে। চড়টা যে শুধু গালে পড়েনি, তা বেলার চোখ দিয়ে ঝরে পড়া অশ্রুগুলোই বলে দিচ্ছে ।

চড়টা ওর আত্মসম্মানে পড়েছে। রাস্তার পাশে থাকা কচিকাঁচারা থেমে থেমে তাকিয়ে আছে বেলার দিকে। কেউ কেউ বিনোদন নিয়ে হাসছে। আর কেউ কেউ হালকা ফিসফাসে বেলাকে দেখিয়ে বলছে, “ওই যে পাটোয়ারী বাড়ির ছোট মেয়ে না? শুনলাম কার যেন প্রেমে পড়েছে.. এতো সাহস! দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে গলা উচিয়ে কথা বলছে। ”
বেলা মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় মাটির গন্ধ নিচ্ছে আর কাঁদছে। মনে হচ্ছে মাটি একটু দয়া করে ফেটে গেলে ও ঢুকে পড়ত সেখানে। মাথার ভেতরে যেন বাজ পড়েছে। গালটা তো জ্বলছেই কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি জ্বলছে ওর অন্তর-আত্মা। কিছু না ভেবেই উঠে দাঁড়ালো বেলা। রক্তাক্ত ঠোঁট আর ধুলো মাখা জামা নিয়ে চোখ তুলে চাইল দিগন্তের দিকে।
রায়হান ওর দিকে এগিয়ে এসেছিল ঠিকই কিন্তু দিগন্তের হুংকারে থেমে গিয়েছে। কড়াগলায় বলল, “তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস দিগন্ত। ও ছোট মানুষ! এসবের কি বুঝে?”
দিগন্ত উপেক্ষা করল রায়হানের কথা। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“ ছোট মাই ফুট! ওকে আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বল এখনি। নাহলে ওকে মেরে কি অবস্থা করব নিজেও জানি না। ”
বেলা কিছু বলল না। নিঃশব্দে একবার তাকাল রায়হানের দিকে। তারপর রাস্তার লোকজনের চোখ উপেক্ষা করে সোজা হেঁটে চলে গেল। না কারও সাহায্য নিল। না কারও চোখের করুণা চাহনি। পা দুটো টলছিল, চোখ ঝাপসা। সেভাবেই হেঁটে চলে গেল।

পাটোয়ারী বাড়ি—
#দিগন্তবেলা গড়িয়ে রাতের প্রহর চলছে। বেলা চুপ করে ঘরের এক কোণে বসে আছে। গালটা এখনও লাল, হালকা ফোলা। মা অনেকবার ওর ঘরে এসে জানতে চেয়েছে কী হয়েছে কিন্তু বেলা কিছু বলেনি। এমনকি বাবার প্রশ্নও এড়িয়ে গিয়েছে।

বেলা! এইই বেলা। কি করছিস? সারাদিন শুয়ে-বসে থাকা ছাড়া আর কাজ নেই তোর তাই না। জানিস না কাল তালুকদার বাড়ি থেকে সবাই আসবে। একটু গা-গোতর নড়া না বোন। আমি একা এতোকিছু কখন করব। বৃষ্টি তো রূপচর্চায় ব্যস্ত। যেন কাল আমাকে না ওকেই দেখতে আসছে, চোখমুখ কুঁচকে ক্লান্ত শরীর ঠেলে বেলার রুমে ঢুকল বাণী। বেলার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। বড় আপার ক্লান্ত মুখখানা দেখে নড়ে-চড়ে বসল বেলা। মাথাটা টুপ করে বাণীর কোলের উপর রেখে শুয়ে পড়ল। বাণীও মুচকি হেসে বোনের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলল,

“ কি হয়েছে রে? সেই বিকেল থেকে শুনছি তুই ঘরের কোণে লুকিয়ে আছিস। মন খারাপ কেনো? কে কি বলেছে? ”
বড় আপার আস্কারা পেয়ে আহ্লাদে গলে পড়ল বেলা। নাক টানতে টানতে নিজের অপকর্ম ছাপিয়ে রেখে শুধু দিগন্তের ব্যাপারটা বলল। দিগন্ত মেরেছে শুনে কিছুক্ষন নীরব থাকল বাণী। বেলাকে টেনে সোজা করে বসিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
“ দিগন্ত ভাই এমনি কিছু করে না বেলা। নিশ্চয়ই তুই এমন কিছু করেছিস যেটা ভাইয়ের ভালো লাগেনি তাই মেরেছে। এখন কেঁদে ভাসিয়ে লাভ আছে। কি কাহিনী করেছিস তুই ভালো জানিস। ”

তারপর বেলার চুলগুলো ঠিক করতে করতে আবার বলে উঠল, “ দিগন্ত ভাই আমাদের বড় ভাইয়ের মতো। সে একটু-আধটু শাসন করলে সেগুলোকে খারাপভাবে নিবি না বুঝলি। দিগন্ত ভাই মানুষটা যেমনই হোক না কেনো আমাদের বোনদের সবসময় বাজে পরিস্থিতি থেকে আগলে রেখেছে। এখন ওসব নিয়ে মুড অফ করে যে ঘরে বসে আছিস, দেখছিস না আমার উপর দিয়ে কত প্রেশার যাচ্ছে। একসাথে এতো কিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি আমি। আম্মুও বেশি কাজ করতে পারছে না, বাত ব্যাথা বেড়েছে। চাচিআম্মু তো রান্নাবান্নার দিকটা সামলাতে ব্যস্ত। এতো বড় বাড়ি ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করা কি চাট্টেখানি কথা! কাল দিনটা দেখতে দেখতে চলে আসবে। এখনো কত কাজ বাকি। তুই একটু দাদিমার কাছে গিয়ে সেদিকটা দেখাশোনা করলেও তো পারিস বোন। শুনছিস না ঘর থেকে কিরকম চিৎকার ছুঁড়ছে। ”

বেলা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “ আচ্ছা বড়পা! দিহান ভাই কত কিউট, ভালো, ভদ্র একটা মানুষ। তার বংশের দিগন্ত ভাইয়ের মতো এরকম গুন্ডা, মাতাল, রগচটা বদের হাড্ডি কিভাবে হলো বলো তো!”
-“ গুরুজনদের এভাবে বলতে নেই বেলা। দিগন্ত ভাই বয়সে আমাদের থেকে অনেক বড়। ”
বেলা ভেংচি দিয়ে হিসহিসিয়ে বলল, “ গুরুজন না ছাই! কেমন রামছাগলের মতো এক একটা হুংকার ছুড়ে। আজ কতগুলো মানুষের সামনে আমাকে থাপ্পড় দিয়েছে জানো! বেয়াদপ, গুন্ডা লোক একটা। ”
বাণী মৃদু রাগ নিয়ে বলল,“ আহহ! বেলা, কি হচ্ছে কি এসব! সে কিন্তু আমার হবু ভাসুর হয়। এভাবে বলবি না।”
আচানাক বেলার মুখটা আবার কালো হয়ে গেল। বাণীর গায়ের সাথে ঘেষে বসল। মন ভার করে বলে উঠল, “ তোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমি একা হয়ে যাবো বড়পা। বৃষ্টি আপার সাথে তো আমার মিলে না। কেমন দুঃছাই ব্যবহার করে, ভালো লাগে না। ফুপিকে বলে বিয়ের পর তুমি এখানে থেকে যাও না আপা। ”

আদরের ছোট বোনের আবদারে স্মিথ হাসল বাণী। বেলার গালে স্নেহের হাত রেখে বলল, “ তুই তো বোকা না। তাহলে বোকা বোকা কথা বলছিস কেনো! বিয়ের পর মেয়েদের ঠিকানা শ্বশুরবাড়ি হয়। সে আমাদের নিজের ফুপিই হোক না কেনো। আমার বিয়ে হলে আমাকে তো শ্বশুড় বাড়িতেই থাকতে হবে। তোরও তো বিয়ের পর শ্বশুড়বাড়িতেই থাকতে হবে, তখন কি আমাকে সাথে নিয়ে যাবি নাকি! হুমউ, হুমউ! বল, বলতে বলতে বেলাকে কাতুকুতু দেওয়া শুরু করল।”

এই এক জিনিস একদমি নিতে পারে না বেলা। দূর থেকে একটু হাত নড়ালেও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। এখনো একি অবস্থা হলো। বাণীর কাতুকুতু দেওয়াতে পেটে খিল দেওয়া হাসিতে মেতে উঠল। বেলার সাথে তাল মিলিয়ে বাণীও হাসছে। দু’বোনের হাসিতে মুখোরিত হলো পাটোয়ারী বাড়ির আনাচে-কানাচে। দরজার সামনে থেকে উঁকি দিয়ে বেলা আর বাণীর কারবার দেখে বিরক্ত হলো বৃষ্টি। এদের দুজনের ন্যাকাষষ্টি কাজ দেখলে শরীর রি রি করে ওর। ফেস মাস্কটা আলতো হাতে নাড়তে নাড়তে নিচের দিকে চলে গেল ও। কাল সবার সাথে দিগন্ত আসবে তাই ওকে একদম ফিটফাট সুন্দরী হতে হবে। ওকে দেখার পর যেন দিগন্ত চোখ ফেরাতে না পারে এমন সুন্দর হতে হবে। যদিও দিগন্তের কাছে পাত্তা পায় না ও। তাতে কি কাল দিগন্তকে পটিয়েই ছাড়বে।

পাটোয়ারী বাড়িতে মোট সদস্য সংখ্যা আট। বেলার দাদা রহিম পাটোয়ারীর তিন সন্তান। রহমান পাটোয়ারী, রাসেল পাটোয়ারী আর মিতালী পাটোয়ারী। রহমান পাটোয়ারীর তিন কন্যা বাণী, বৃষ্টি আর বেলা। রাসেল পাটোয়ারীর কোনো সন্তান নেই। আর দুভাইয়ের আদরের বোন, মিতালী হলো তালুকদার বাড়ির ছোট বউ। তার দুই সন্তান দিহান তালুকদার আর দিশা তালুকদার। দিহানের সাথেই বাণীর বিয়ে ঠিক করতে আসছে তালুকদার বাড়ির লোকজন। ভাইয়ের মেয়েকেই নিজের পুত্রবধূ বানাতে চায় মিতালী। বেলার দাদা মারা গিয়েছে অনেক আগেই। বুড়ো দাদি রূপজান বেঁচে আছে এখনো।

“তোমার ভাইয়ের মেয়ে’র চলাফেরায় লাগাম টানো, মনি। ওর উগ্র আচরণের কারণে আমি কোনো স্টেপ নিলে পরে দোষারোপ করতে পারবা না, ” সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে জোড় গলায় বলল দিগন্ত।
ঘড়ির দিকে তাকালো মিতালী। বারোটা বেজে গিয়েছে। দিগন্তের জন্যই ডাইনিং এ অপেক্ষা করছিল সে। হাতের কাজটুকু তাড়াহুড়ো করে শেষ করে রান্নাঘর থেকে গরম কফি হাতে দিগন্তের পিছু ছুট লাগালো সে।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২