দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১১
অবন্তিকা তৃপ্তি
সকাল তখন আনুমানিক ৯ টা! শেখ বাড়িতে হৈ-হল্লোর চলছে ভীষণ! অনিরূপের বিয়েতে ওয়াহিদা নিজে তাদের দুই বংশের মানুষদের দেখে দেখে দাওয়াত করেছেন। এটা হতে পারে- শো অফ! হয়তো ওয়াহিদা চেয়েছেন, সবাইকে দেখিয়ে দিতে শেখ বাড়ির মর্যাদা ঠিক কতখানি! অরূপরা সারারাত হৈ-হল্লোর করে ফজরের পর ঘুমিয়েছে। তাই এখন তাদের ঘুম থেকে উঠানো একপ্রকার অসম্ভব!
কারো মনে চলছে আনন্দ-ফুর্তি; তো কারো মনে বইয়ে যাচ্ছে ঝড়! অনিরূপ ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে গেলেও আশা সারারাত সজাগ ছিল! সারারাত অনবরত কান্নাকাটি করে গলা ভেঙে ফেলেছে একপ্রকার! অনিরূপ উদোম গায়ে বিছানায় শুয়ে, গৌড় রঙের পিঠে অসংখ্য নখের দাগ! আশা সেদিকে চেয়ে নিজের গায়ের দিকে চাইল! শুধুমাত্র একটা কাঁথা জড়িয়ে রাখা গায়ে! আশা দুহাতে বাচ্চাদের মতো চোখ মুছে! তারপর কাঁথা জড়িয়ে ওয়াশরুমে যায় শাড়ি নিয়ে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গোসল করার মুহূর্তটা আশা নিজের গায়ে সাবান ডলে ডলে মাখে,ঘষতে থাকে সারা গা পাগলের মতো! সম্পূর্ণ গায়ে যেন ওই নিকৃষ্ট লোকটার গন্ধ মেখে গেছে, সাবানেও যার গন্ধ শরীর থেকে ছাড়াতে পারছে না আশা! আশা শরীরে সাবান ঘষতে ঘষতে কেঁদে উঠল আবার।
কী ছিল আশা, আর লোকটা তাকে কী বানিয়ে দিয়েছে!
অনিরূপের দরজায় ধাক্কানো হচ্ছে। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে বারবার। প্রচণ্ড শব্দে অনিরূপের ঘুম ভেঙে যায়, আড়মোড়া ভাঙে সে। চোখ পিটপিট করে পাশে চায়, আশা নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে, গোসল করছে হয়তো। অনিরূপ শোয়া থেকে চোখ ডলে উঠে বসে। মোবাইল বালিশের কাছ থেকে নিয়ে ঘড়ি দেখে, ১০ টা বাজতে চললো!সবসময়ই ও বেলা করে উঠে ঘুম থেকে, কিন্তু আজকের ব্যাপার ভিন্ন! এখন আর অনিরূপ একা নয়, সে বিবাহিত! মনেমনে ক্রূর হাসে অনিরূপ! আত্মিক একটা শান্তি অনুভব করছে ও!
অনিরূপ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়, ঘরের টিশার্ট-ট্রাউজার বের করতে করতে একবার বিছানার দিকে চায়। সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু কুঁচকে ফেলে ও। এগিয়ে এসে একটানে বিছানার চাদর তুলে ফেলে ভাঁজ করে ময়লার ঝুড়িতে রেখে দিলো। মনেমনে কোথাও একটা প্রশান্তি কাজ করছে অবশ্য! সে ঠকে যায়নি!
আশা অনেকক্ষণ হয়ে গেছে গোসলে, অনিরূপেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনিরূপ তাই বাথরুমের দরজায় টোকা দিল,
‘আশা, আর কতক্ষণ?’
অনিরূপের বারবার ডাকাডাকিতে আশা দুহাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়! শাওয়ার অফ করে শাড়ি গায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।
অনিরুপ থমকে যায়! সদ্য গোসল করে আসা নিজের বধুকে দেখে- চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায় যেন! আশার পা থেকে মাথা অব্দি এক মুহুর্তেই যেন মুখস্ত হয়ে যায় অনিরূপের।সহসা চোখ যায়, আশার ঠোঁটের কোণায়। কেটে গেছে ওখানে। তারপর ধীরে ধীরে আশার ঘাড়ে চোখ যায়, ওখানে লাল লাল ছোপ-ছোপ দাগ পড়ে গেছে। অনিরূপ জায়গাগুলোর দিকে চেয়ে দু কদম এগিয়ে আসে,
‘মলম-‘
অনিরূপ দু কদম এগিয়ে আসার সঙ্গেসঙ্গে আশা ভয়ে পিছিয়ে গেলো! অনিরূপ থেমে গেলো! আশা ভয়-আতঙ্ক নিয়ে অনিরুপের দিকে চেয়ে আছে। মুখে কথা নেই ওর, চোখদুটো অশান্ত, অনিরূপের এভাবে ঘোরলাগা চোখে চেয়ে আছে দেখে ও ইতিমধ্যেই ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছে। আশার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে অনিরূপ নিজেও লজ্জায় পড়ে গেলো কিছুটা। অনিরূপ আবারো আগের জায়গায় পিছিয়ে গেলো, সাফাই গাওয়ার উদ্দেশ্যে বললো-
‘ছুঁবো না আমি, ডোন্ট ওরি!’
আশার ভয় তবুও কমে না। রাতেও ঠিক এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অনিরূপ। আশাকে ছুঁবে না বলে, বিছানায় টেনে এনেছিল। তারপর বরাবরের মতো প্রতিশ্রুতি ভেঙে ছুঁয়েছে আশাকে।
আশা অশান্ত হয়ে গেছে একদম। অনিরূপের কথা শোনার আগেই অনিরুপকে ঠেলে দরজার সামনে চলে গেলো! হতবাক অনিরূপ পেছন ফিরে আশার দিকে চেয়ে বললো-
‘আশা? তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো? আমি তোমার হাসবেন্ড, ছুঁতে পারিনা?’
আশার গলার স্বর কাঁপছে! ও ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো-
‘আ-আমার অনুমতি ছিল না।’
অনিরূপ ভ্রূ কুঁচকে আশার দিকে চাইল। আশা নজর লুকাচ্ছে শুধু! শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছে নিজের সঙ্গে! আঁচলেই সম্পূর্ণ গা ঢেকে ফেলতে চাইছে যেন অনিরূপের রুক্ষ-শকুনি নজর হতে! অনিরূপ এসব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
‘আ’ম সরি আশা! রাতে আমার কী হয়েছিল আই ডোন্ট নো! আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি!’
‘কেন পারেন নি। আমি বৈধ স্ত্রী বলে? আপনার যা মন চায় আমার সঙ্গে করা যাবে, এই বলে?’
আশা ধীরে ধীরে আগের রূপে ফিরে আসছে! তেজদীপ্ত আশার পুরনো তেজ ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। অনিরূপ আবারো বললো-
‘তেমনটা নয় আশা! আমি তোমার প্রতি শুরু থেকেই ফ্যাসিনেটেড, শুধুমাত্র স্ত্রী বলে তোমার কাছে যাই নি আমি!’
‘ফ্যাসিনেটেড?’ -আশার উপহাসের স্বর!
অনিরূপ এবার বিরক্ত হলো! আশার সামনে নিজেকে এক্সপ্লেইন করার সকল ধৈর্য্য, যুক্তি এবার হারিয়ে ফেলল! অনিরূপ হাল ছেড়ে বললো-
‘মলমটা লাগিয়ে নিও, ড্রয়ারে আছে। আমি গোসল থেকে এসে পেইনকিলার দিচ্ছি বের করে, তুমি খুঁজে পাবে না।’
আশা বিদ্রুপের হাসি হাসে! জ/খম করে এখন মলম লাগাতে আসছে! অনিরূপ আশার হাসি দেখে, কিছু না বলে চুপ করে টাওয়াল নিয়ে গোসলে চলে যায়।
আশা বিছানার উপর বসে! স্থির বসে থাকে কিছুসময়! এতোক্ষণ কষ্ট লাগলেও, এখন রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে রীতিমত। আশা এতটাই ঠুনকো নয় যে, অনিরুপ যখন মন চাইল ‘ফ্যাসিনেশনের’ দোহাই দিয়ে আশাকে ছুঁবে! আরেকবার ছুঁতে আসলে, আশা এই অনিরূপকে কী করবে ও নিজেও জানে না। খু/নও করে ফেলতে পারে।
অনিরূপ গোসল শেষ করে বেরিয়েছে। পরনে শুধু ট্রাউজার। আশা বিছানায় বসে ছিল। বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজে সামনে তাকাল। অনিরূপ আয়নার সামনে দদাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ভেজা চুল নাড়ছে। আশা আয়নার মধ্যে অনিরূপের দিকে রাগান্বিত চোখে চেয়ে আছে! অনিরূপ সেটা দেখে মজা করে হেসে বললো-
‘সারারাত তো একসঙ্গেই ছিলাম। আমার গায়ে এখনো নখের দাগ রয়ে গেছে। অথচ তোমার আমাকে দেখা শেষ হচ্ছে না। তাহলে আসো-তৃষ্ণা মিটিয়ে দিই।’
অনিরুপ কথাটা বলে পেছন ফিরল। আশা চেয়ে দেখে- অনিরূপের সারা গায়ে ছোট-ছোট লাল-লাল ক্ষত অনিরূপের। আশা তাচ্ছিল্য হেসে বললো- – ‘ওসব ভালোবাসার দাগ না। ওসব আমার বাঁচবার আকুতি ছিল। ভালোবাসা আর আকুতি-দুটো অনুভূতি আপনি কখনোই বুঝবেন না।’
অনিরূপ ভ্রূ কুঁচকালো। আশা বিছানা থেকে টিশার্ট নিয়ে ছুড়ে ফেলল অনিরূপের দিকে। অনিরূপ সঙ্গেসঙ্গে টিশার্ট ক্যাচ করল। আশা রাগে গজরাতে গজরাতে বললো- ‘আপনার কুৎসিত দেহ ঢাকুন এখন। আমি আবার রাতের স্মৃতি মনে করতে চাইছি না।’
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১০
আশা কথাটা বলে দরজার সিটকিনি খুলে মাথায় আঁচল তুলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে! অনিরূপ টিশার্ট হাতে ফ্যালফ্যাল চোখে আশার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো- ‘আমি কুৎসিত?’